বাংলাদেশে ইসলামের আগমন
এক
প্রাক- ইসলাম যুগ থেকেই আরব বণিকগণ বাণিজ্যের জন্য লোহিত সাগর, আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী বন্দরগুলোতে আসা-যাওয়া করতেন।
আরব দেশের বণিকেরা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরগুলোতে এসে চন্দন কাঠ, হাতীর দাঁত, মসলা এবং সূতী কাপড় ক্রয় করতেন এবং জাহাজ বোঝাই করে নিজেদের দেশে নিয়ে যেতেন।
ভারতের বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক সাইয়েদ সুলাইমান নদবী তাঁর লিখিত গ্রন্হ ‘আরবোঁ কি জাহাজরানী’-তে লিখেন যে মিসর থেকে সুদূর চীন পর্যন্ত প্রলম্বিত দীর্ঘ নৌ-পথে আরবগণ যাতায়াত করতেন। মালাবার উপকূল হয়ে তাঁরা চীনের পথে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করতেন। [বাংলাদেশে ইসলামঃ কয়েকটি তথ্যসূত্র, মুহীউদ্দীন খান, মাসিক মদীনা, জানুয়ারী ১৯৯২, পৃষ্ঠা-৪১]
বাংলাদেশের বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক মাওলানা আকরাম খাঁ তাঁর রচিত ‘মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্হে লিখেন যে আরব বণিকগণ এই পথ ধরেই বাংলাদেশ ও কামরূপ (আসাম) হয়ে চীনে যাতায়াত করতেন। মালাবার ছিলো মধ্য পথের প্রধান বন্দর। [বাংলাদেশে ইসলামঃ কয়েকটি তথ্যসূত্র, মুহীউদ্দীন খান, মাসিক মদীনা, জানুয়ারী ১৯৯২, পৃষ্ঠা-৪১] বঙোপসাগরে প্রবেশের পূর্বে তাঁরা মাদ্রাজ উপকূলেও নোঙর করতেন বলে মনে হয়।
দীর্ঘপথে পালে-টানা জাহাজের একটানা সফর সম্ভবপর ছিলোনা। পথে যেইসব মানযিল ছিলো সেইগুলিতে আবশ্যিকভাবে থেকে জাহাজ মেরামত এবং পরবর্তী মানযিলের জন্য রসদ সংগ্রহ করতে হতো।[বাংলাদেশে ইসলামঃ কয়েকটি তথ্যসূত্র, মুহীউদ্দীন খান, মাসিক মদীনা, জানুয়ারী ১৯৯২, পৃষ্ঠা-৪১]
দুই
মুহাদ্দিম ইমাম আবাদান মারওয়াযীর গ্রন্হ থেকে জানা যায় যে, মুহাম্মাদুর রাসূলূল্লাহ (সা) সাহাবী আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনু ওহাইব (রা) নবুওয়াতের পঞ্চম সনে (অর্থাৎ খৃষ্টীয় ৬১৫ সনে) হাবশায় (ইথিয়পিয়ায়) হিজরাত করেন। নবুওয়াতের সপ্তম সনে (অর্থাৎ খৃষ্টীয় ৬১৭ সনে) তিনি কায়েস ইবনু হুযাইফা (রা), উরওয়াহ ইবনু আছাছা (রা), আবু কায়েস ইবনুল হারিস (রা) এবং কিছু সংখ্যক হাবশী মুসলিমসহ দুইটি জাহাজে করে চীনের পথে সমুদ্র পাড়ি দেন। [বাংলাদেশে ইসলামঃ কয়েকটি তথ্যসূত্র, মুহীউদ্দীন খান, মাসিক মদীনা, জানুয়ারী ১৯৯২, পৃষ্ঠা-৪১]
শায়খ যাইনুদ্দীন তাঁর রচিত গ্রন্হ ‘তুহফাতুল মুজাহিদীনে’ লিখেন যে ভারতের তামিল ভাষার প্রাচীন গ্রন্হে উল্লেখ রয়েছে যে একদল আরব জাহাজে চড়ে মালাবার এসেছিলেন। তাঁদের প্রভাবে রাজা চেরুমল ইসলাম গ্রহণ করেন। অতপর মাক্কায় গিয়ে তিনি কিছুকাল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সা) সান্নিধ্যে থাকেন।[বাংলাদেশে ইসলামঃ কয়েকটি তথ্যসূত্র, মুহীউদ্দীন খান, মাসিক মদীনা, জানুয়ারী ১৯৯২, পৃষ্ঠা-৪১]
আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনু ওহাইব (রা) দীর্ঘ নয় বছর সফরে ছিলেন।
মালাবার বা চেরর রাজা চেরুমল পেরুমল তাঁর কাছেই ইসলামের দাওয়াত পেয়েছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়।
চীন যাবার পথে তাঁকে বাংলাদেশের বন্দরগুলোতেও নোঙর করতে হয়েছে। আর তাঁর পবিত্র সাহচর্যে এসে বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক মানুষ নিশ্চয়ই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তবে কারা ছিলেন সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি তা আমাদের জানা নেই।
চীনের মুসলিমদের বই পুস্তক থেকে জানা যায় যে আবু ওয়াক্কাস মারিক ইবনু ওহাইব (রা) তাঁর সাথীদেরকে নিয়ে খৃষ্টীয় ৬২৬ সনে চীনে পৌছেন। [বাংলাদেশে ইসলামঃ কয়েকটি তথ্যসূত্র, মুহীউদ্দীন খান, মাসিক মদীনা, জানুয়ারী ১৯৯২, পৃষ্ঠা-৪০]
আবু ওয়াক্কাস মারিক ইবনু ওহাইব (রা) ক্যান্টন বন্দরে অবস্থান করেন। সমুদ্র তীরের কোয়াংটা মাসজিদ তিনিই নির্মাণ করেন। মাসজিদের নিকটেই রয়েছে তাঁর কবর। দুইজন সাহাবীর কবর রয়েছে চুয়ান-চু বন্দরের নিকটবর্তী লিং পাহাড়ের ওপর। চতুর্থজন দেশের অভ্যন্তর ভাগে চলে যান। [বাংলাদেশে ইসলামঃ কয়েকটি তথ্যসূত্র, মুহীউদ্দীন খান, মাসিক মদীনা, জানুয়ারী ১৯৯২, পৃষ্ঠা-৪০]
এই সব তথ্য প্রমাণ করে যে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সা) যুগেই চীনে সর্বপ্রথম ইসলাম পৌছে এবং তা পৌছে একদল খাঁটি আরব মুসলিমের নেতৃত্বে। যাঁরা বাংলাদেশের বন্দরগুলোতে নোঙর করে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করে চীন অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন তাঁরা বাংলাদেশেও অবশ্যই ইসলাম প্রচার করেছেন। আর তা যদি হয়ে থাকে তাহলে খৃষ্টীয় সপ্তম শতকেই বাংলাদেশে প্রথম ইসলামের আগমন ঘটে।
তিন
আরব ভূগোলবিদ আবুল কাসিম উবাইদুল্লাহ ইবনু খরদাধবিহ (৯১২ খৃষ্টাব্দে মৃত্যু) বলেন যে সরন্দ্বীপ (শ্রীলংকা) এবং গোদাবরী নদ পেরিয়ে এগিয়ে গেলে সমন্দর নামে একটি বন্দর রয়েছে যার আশেপাশে প্রচুর ধান উৎপন্ন হয়। তিনি আরো জানান যে এই বন্দরে কামরূপ (আসাম) থেকে মিষ্টি পানির পথে পনর/বিশ দিনে নৌকাযোগে চন্দন কাঠ আনা হয়। [হিষ্ট্রি অব দ্যা মুসলিমস অব বেঙ্গল, ডঃ মুহাম্মদ মোহর আলী, পৃষ্ঠা-৩০] আরব ভূগোলবিদ আবু আবদিল্লাহ আলইদরিসী ও এই বন্দরের কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে এটি একটি বড়ো বন্দর এবং কামরূপ থেকে নদীপথে কাঠ এনে এখানে বিক্রয় করা হয়। তিনি আরো জানান যে এই বন্দরটি একটি বড়ো নদীর মোহনায় অবস্থিত। [হিষ্ট্রি অব দ্যা মুসলিমস অব বেঙ্গল, ডঃ মুহাম্মদ মোহর আলী, পৃষ্ঠা-৩০]
এইসব বর্ণনা ইংগিত বহন করে যে মেঘনা তীরের চাঁদপুরই ছিলো সে নদীবন্দর যেখানে আরব বণিকগণ প্রধানত চন্দন কাঠের জন্য আসতেন।
আবু আবদিল্লাহ আলইদরিসী লিখেছেন যে বাগদাদ ও বাসরাহ থেকে আরব বণিক এবং পর্যটকগণ মেঘনার মোহনার সন্নিকটস্থ অঞ্চলে আসা-যাওয়া করতেন।
আরব ভুগোলবিদ আবুল কাসিম উবাইদুল্লাহ ইবন খুরদাধবিহ লিখেন যে সরন্দ্বীপের পর জাতিরাতুর-রামি নামক একটি ভূখণ্ড আছে। [হিষ্ট্রি অব দ্যা মুসলিমস অব বেঙ্গল, ডঃ মুহাম্মদ মোহর আলী, পৃষ্ঠা-৩৫]
আরব ভূগোলবিদ আল মাসউদী উল্লেখ করেন যে ভারত সাগরের তীরে নদী বিধৌত একটি দেশ রয়েছে। [হিষ্ট্রি অব দ্যা মুসলিমস অব বেঙ্গল, ডঃ মুহাম্মদ মোহর আলী, পৃষ্ঠা-৩৫]
আরব ভূগোলবিদ ইয়াকুত ইবনু আবদিল্লাহ বলেন যে এই ভূ-খণ্ডটি মালাক্কার দিকে ভারতের দূরতম অঞ্চল। [হিষ্ট্রি অব দ্যা মুসলিমস অব বেঙ্গল, ডঃ মুহাম্মদ মোহর আলী, পৃষ্ঠা-৩৫]
একসময় চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে রামি বা রামু নামে একটি রাজ্য ছিলো। সুলাইমান নামক একজন আরব বণিক বলেন যে রামির রাজার পঞ্চাশ হাজার হাতী এবং পনর হাজার সৈন্য ছিলো। [হিষ্ট্রি অব দ্যা মুসলিমস অব বেঙ্গল, ডঃ মুহাম্মদ মোহর আলী, পৃষ্ঠা-৩৫]
এইসব তথ্য ইংগিত বহন করে যে আরব ভূগোলবিদগণ জাজিরাতুর রামি নামে যেই ভূ-খন্ডের উল্লেখ করেছেন তা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলই ছিলো। কক্সবাজারের সমুদ্র সন্নিকটবর্তী আজকের রামু সেই রাজ্যেরই একটি ক্ষুদ্রাংশ। আরব ভূগোলবিদগণের বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে আরব বণিকগণ তাদের বাণিজ্য জাহাজ নিয়ে চট্টগ্রাম আসতেন এবং মসলা, হাতীর দাঁত ইত্যাদি সামগ্রী সংগ্রহ করতেন।
চার
৭৫০ খৃষ্টাব্দে বাংলাদেশে পালবংশের রাজত্ব শুরু হয়। পালগণ বৌদ্ধ ছিলেন। পাল বংশের সবংশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন ধর্মপাল। তিনি ৭৭০ খৃষ্টাব্দ থেকে ৮১০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন।
ধর্মপাল পাঞ্জাবের উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করে কান্যকুব্জে অভিষেক অনুষ্ঠান করেন। এই অনুষ্ঠানে ভোজ, মৎস্য, মদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবন্তি, গান্ধার এবং কীর রাজ্যের রাজাগণ উপস্থিত ছিলেন।
ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার মন্তব্য করেন যে যবন রাজ্যটি সম্ভবত সিন্ধু নদীর তীরবর্তী কোন মুসলিম অধিকৃত রাজ্য হবে। [বাংলাদেশের ইতিহাসঃ প্রাচীন যুগ, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, পৃষ্ঠা-৪৩, ৪৪]
ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদারের উক্তি থেকে বুঝা যায় যে, খৃষ্টীয় অষ্টম শতকের শেষভাগ এবং নবম শতকের প্রথম ভাগে সিন্ধু নদীর তীরবর্তী আরব মুসলিম শাসিত এক বা একাধিক রাজ্যের সাথে পাল শাসিত বাংলাদেশের যোগাযোগ ছিল।
আগেই বলেছি যে খৃষ্টীয় ৭৫০ সনে বাংলাদেশে পাল বংশের রাজত্ব শুরু হয়। আর খৃষ্টীয় ৭৫০ সনেই বাগদাদে বানুল আব্বাস খিলাফাহ প্রতিষ্ঠিত হয়।
ধর্মপাল যখন বাংলাদেশের শাসক তখন বাগদাদের শাসক ছিলেন হারুনুর রশীদ।
রাজশাহীর পাহাড়পুরে বৌদ্ধ বিহার খননকালে একটি আরবী মুদ্রা পাওয়া যায়। এই মুদ্রাটি তৈরী হয়েছে ৭৮৮ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ হারুনুর রশীদের শাসনকালে।[হিষ্ট্রি অব দ্যা মুসলিমস অব বেঙ্গল, ডঃ মুহাম্মদ মোহর আলী, পৃষ্ঠা-৩৮]
কুমিল্লা জিলার ময়নামতিতে অনুরূপ খননকার্য কলে বানুল আব্বাস যুগের দুইটি মুদ্রা পাওয়া যায়। [হিষ্ট্রি অব দ্যা মুসলিমস অব বেঙ্গল, ডঃ মুহাম্মদ মোহর আলী, পৃষ্ঠা-৩৮]
এইসব মুদ্রাপ্রাপ্তি এই কথাই প্রমাণ করে যে খৃষ্টীয় নবম শতকে বাংলাদেশে আরব মুসলিমদের যাতায়াত ছিলো।
পাঁচ
বাংলাদেশের সন্নিকটে বংগোপসাগরের তীরে রয়েছে আরাকান। এক সময় এটি বড় একটি রাজ্য ছিলো।
আরাকানের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে রাজা মা-বা তুইঙ (Ma-ba-toing) ৭৫০ খৃষ্টাব্দ থেকে ৮১০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত দেশ শাসন করেন।
উল্লেখ্য যে ঐ সময় বাংলাদেশের শাসক ছিলেন বৌদ্ধ রাজা ধর্মপাল। আর বাগদাদকেন্দ্রিক বিশাল বানুল আব্বাস খিলাফাহর শাসক ছিলেন হারুনুর রশীদ।
রাজা মা-বা-তুইঙ-এর শাসনকালে আরব মুসলিমদের কয়েকটি জাহাজ সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে আরাকান উপকূলের নিকটে বিধ্বস্ত হয়। যাত্রীদের মধ্যে যাঁরা জীবিত ছিলেন তাঁরা রামরী দ্বীপে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখান থেকে তাঁরা আরাকানের মূল ভূ-খন্ডে পৌছে রাজার সাথে সাক্ষাত করেন। তাঁদের আলাপ ও আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে রাজা তাঁদের বসবাসের জন্য কয়েকটি গ্রাম নির্দিষ্ট করে দেন। আরব মুসলিমগণ ঐ গ্রামগুলোতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। [চট্টগ্রামে ইসলাম ডঃ আবদুল করীম, পৃষ্ঠা-১৫, ১৬]
আরাকানের ঐতিহাসিক দলীল থেকে জানা যায় যে, রাজা Tsu-la-Taing-Tsan-da-ya ৯৫১ খৃষ্টাব্দ থেকে ৯৫৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত আরাকান শাসন করেন।
তাঁর রাজত্বকালে একজন থু-রা-তান (Thu-ra-tan) কে পরাজিত করে তিনি Tset-ta-going (চাটিগাঁও) নামক স্থানে একটি বিজয় স্তম্ভ নির্মাণ করেন।
গবেষকদের মতে থু-রা-তান শব্দটি আরবী শব্দ সুলতান-এর পরিবর্তিত রূপ। [হিষ্ট্রি অব দ্যা মুসলিমস অব বেঙ্গল, ডঃ মুহাম্মদ মোহার আলী, পৃষ্ঠা-৩৮]
এত্থেকে একটি প্রমাণিত হয় যে, খৃষ্টীয় দশম শতকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলিম জনপদ গড়ে উঠে এবং মুসলমানদের নেতা এতোখানি শক্তিধর হয়ে উঠে যে আরাকান-রাজ তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হন।
ছয়
ইসলামের সোনালী যুগের এবং তার নিকটবর্তী যুগের মুসলমানগণ যেই উদ্দেশ্যে যেখানেই যেতেন না কেন তাঁর ইসলামী জীবনদর্শনের মর্মকথা মানুষের সামনে উপস্থাপন করার কোন সুযোগ হাতছাড়া করতেন না। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যেইসব মুসলিম বাংলাদেশে এসেছিলেন তাঁরাও নিশ্চয়ই মুবাল্লিগ হিসেবে তাঁদের কর্তব্য পালন করেছেন। তবে তাঁদের তৎপরতা ও প্রভাব সম্পর্কে তথ্য অনুপস্থিত।
আবার, ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, শুধুমাত্র ইসলাম প্রচারের জন্যই এসেছেন অনেকেই। তাঁদের ব্যাপারেও ইতিহাস নীরব। তবে কিছু সংখ্যক মুবাল্লিগের ব্যাপারে ইতিহাস নীরব থাকতে পারেনি।
মধ্য এশিয়ার বালখের শাসক শাহ মুহাম্মদ সুলতান বালখী রাজ্য শাসন ত্যাগ করে দিমাসক এসে তাওফীক নামক একজন নেক লোকের সান্নিধ্যে থাকেন বহু বছর। উক্ত ব্যক্তি তাঁকে বাংলাদেশে এসে ইসলাম প্রচারে উৎসাহিত করেন।
শাহ মুহাম্মদ সুলতান বালখী নৌ-পথে সন্দ্বীপ পৌঁছেন। অতপর নৌ-পথে তিনি আসেন হিন্দু রাজা বলরামের রাজ্য হরিরামনগর। সম্ভবত মানিকগঞ্জ জিলার হরিরামপুরই সেই কালের হরিরামনগর। রাজা বলরাম একজন মুসলিম মুবাল্লিগের উপস্থিতি বরদাশত করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে শাহ মুহাম্মদ সুলতান বালখী ও তাঁর সংগীদের ওপর চড়াও হন। শাহ মুহাম্মদ সুলতান বালখীও আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। সংঘর্ষে রাজা নিহত হন। রাজার মন্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করেন। শাহ মুহাম্মদ সুলতান বালখী এই নও মুসলিম মন্ত্রীকেই সিংহাসনে বসান।
এরপর তিনি রাজা পরশুরামের রাজ্য (বগুড়ার) মহাস্থানে আসেন। রাজার বোন শিলাদেবী তন্ত্রমন্ত্র প্রয়োগ করে শাহ মুহাম্মদ সুরতান বালখীকে তাড়াবার চেষ্টা করে ব্যথর্খ হন। রাজা পরশুরাম সুলতান বালখী ও তাঁর সংগীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালান। যুদ্ধে তিনি নিহত হন। পরে তাঁর মন্ত্রীও যুদ্ধ চালিয়ে প্রাণ হারাম। শিলাদেবী কালী মন্দিরে আশ্রয় নেন। পরে করতোয়া নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
রাজকুমারী রত্নমনি বন্দী হন। মুসলিমদের কথা ও আচরণ তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। নিহত রাজা পরশুরামের সেনাপতি সুরখাবও ইসলাম গ্রহণ করেন। শাহ মুহাম্মদ সুলতান বালখীর উদ্যোগে সুরখাব ও রত্নমনির বিয়ে সুসম্পন্ন হয়। [এ হিষ্ট্রি অব সুফীজম ইন বেঙল, ডঃ এনামূল হক, পৃষ্ঠা- ২০৮]
মহাস্থানে শাহ মুহাম্মদ সুলতান বালখী মাসজিদ ও ইসলামী শিক্ষালয় স্থাপন করেন। নিকটবর্তী অঞ্চলে তিনি ইসলাম প্রচার করতে থাকেন।
খৃষ্টীয় একাদশ শতকের মধ্যভাগে বাংলাদেশের নেত্রকোনা অঞ্চলে এসেছিলেন একজন বিশিষ্ট মুবাল্লিগ। তাঁর নাম শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমী। একটি ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায় যে ১০৫৩ সনেও তিনি জীবিত ছিলেন।
একদল সংগী নিয়ে তিনি মদনপুর নামক স্থানে পৌঁছেন। এটি ছিলো তখন একজন কোচ রাজার শাসনাধীন। কোচ রাজা প্রথমে তাঁর প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করেন। পরে তাঁর মনোভাব পরিবর্তিত হয়। কোচ রাজা শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমীকে মদনপুর গ্রামটি দান করেন। এখানে অবস্থান করে শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমী ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। [বাংলাদেশে ইসলাম, আবদুল মান্নান তালিব, পৃষ্ঠা-৬৯]
খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতকের গোড়ার দিকে বিক্রমপুরে (যার একাংশ মুনশীগঞ্জ জিলায় শামিল) একদল সংগী নিয়ে আদম নামক একজন মুবাল্লিগ এসেছিলেন। এই স্থানটি তখন বল্লাল সেন নামক, একনজ রাজার শাসনাধীন ছিলো।
আদম সাথীদেরকে নিয়ে এক স্থানে তাঁবু স্থাপন করে খাওয়ার জন্য একটি গরু জবাই করেন। একটি কাক গরুর গোসতের একটি টুকরা নিয়ে উড়ে যায়। আরেকটি কাকের তাড়া খেয়ে কাকটি গরুর গোসতের টুকরাটি ফেলে দেয়। রাজা বল্লাল সেনের সৈন্যদের একটি ক্যাম্পে গোসতের টুকরাটি পড়ে। সৈন্যরা বিষয়টি রাজাকে জানায়। হিন্দুরাজা বল্লাল সেন রাগাম্বিত হন এবং মুবাল্লিগ গ্রুপটির ওপর হামলা করার জন্য একদল সৈন্য পাঠান। আদমের নেতৃত্বে মুবাল্লিগগণ আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধে নামতে বাধ্য হন। চৌদ্দ দিন পর্যন্ত লড়াই চলে। পঞ্চাদশ দিবসে রাজা নিজে রণাংগনে আসেন।
চৌদ্দ দিন যুদ্ধ চলাতে রাজা বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি রাজধানীতে একটি অগ্নিকুন্ড প্রস্তুত করালেন এবং মহিলাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে তিনি পরাজিত হয়েছেন জানতে পেলে তারা যেন অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করে। তিনি তার পোষাকের নীচে একটি কবুতর লুকিয়ে নিলেন। বলে গেলেন যে কবুতরটি উড়ে এলে বুঝ হবে যে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়েছেন।
রাজার প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে মুসলিমগণ একে একে প্রাণ হারাতে থাকেন। অবশেষ আদমও শাহাদাত বরণ করেন। এটি ছিলো ১১১৯ সনের ঘটনা।
রামপাল গ্রামে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
রাজা পুকরে নেমে রক্ত রঞ্জিত পোষাক ধুতে থাকেন। হঠাৎ কবুতরটি পোষাকের নীচ থেকে বেরিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে উড়ে যায়। তার আগমনে রমণীকূল অগ্নিকূন্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যু বরণ করে।
দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে রাজা ছুটলেন রাজপ্রাসাদের দিকে। এসে দেখেন সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শোকের প্রাবল্যে তিনিও ঝাঁপ দিলেন সেই অগ্নিকুণ্ডে। [এ হিষ্ট্রি অব সুফীজম ইন বেঙ্গল, ডঃ এনামুল হক, পৃষ্ঠা-২১১]
মনে হয় স্থানীয় লোকদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক মুসলিম ছিলেন। তারা শহীদ আদম এবং তাঁর সাথীদের মৃতদেহ কবরস্থ করেন। অমুসলিমদের তো মুসলিমদের মৃতহেদ দাফন করার পদ্ধতি জানা থাকার কথা নয়।
খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে শাহ মাখদুম রূপোস নামে একজন মুবাল্লিগ আসেন রাজশাহী অঞ্চলে। খৃষ্টীয় ১১৮৪ সনেও তিনি সেখানে ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐ অঞ্চলে তিনিই ছিলেন ইসলামের প্রথম মুবাল্লিগ। রামপুর নামক গ্রামে তিনি অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁর পবিত্র চরিত্র ও সুন্দর ব্যবহার লোকদেরকে আকৃষ্ট করে। তাঁর সান্নিধ্যে এসে লোকেরা ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান হাছিল করতো। ইসলাম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করে বহু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেন। পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়ে কিংবা তাঁর সান্নিধ্যে থাকার আকর্ষণে বহু নও মুসলিম রামপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তাঁদের সংখ্যা এতো বেশি হয় যে রামপুর গ্রামে আর ঠাঁ মিলছিলো না। তাই পার্শ্ববর্তী গ্রাম বোয়ালিয়াতেও তাঁরা বসবাস করতে শুরু করেন।
রামপুরু- বোয়ালিয়া বাস্তবে ইসলামী লোকায়লে পরিণত হয। উল্লেখ্য যে এই রামপুর- বোয়ালিয়াকে ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে গড়ে উঠে রাজশাহী শহর।
সাত
বাংলাদেশে পাল বংশের শাসন এক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সময়টিতে দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেনগণ বৌদ্ধ পালদেরকে রাজিত করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতকের গোড়ার দিকে (১১২৫ খৃষ্টাব্দে) বিজয় সেন নদীয়াকেন্দ্রিক রাজ্যের অধিপতি হন। বিজয় সেনের পুত্র ছিলেন বল্লাল সেন। আর বল্লাল সেনের পুত্র ছিলেন লক্ষণ সেন। উত্তরে গৌড় এবং পূর্বে বিক্রমপুর পর্যন্ত তাঁদের রাজ্য বিস্তৃত ছিলো।
সেনগণ গোঁড়া হিন্দু ছিলেন। তাঁরা পালদেরকে উৎকাত করেন। প্রজাগণের ওপর হিন্দুত্ব চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালান। কৌলিণ্য প্রথা প্রবর্তন করে তাঁরা সমাজে অনৈক্য সৃষ্টি করেন।
সেন রাজদের রাজত্বকালেও বাংলাদেশে মুসলিমদের যাতায়াত ছিলো।
ইতিহাসবিদ মিনহাজুদ্দীন সিরাজ রচিত তাকাকাত-ই-নাসিরী গ্রন্হ থেকে জানা যায় যে বিক্রয়ের জন্য উন্নত জাতের ঘোড়া নিয়ে মুসলিম বণিকগণ স্থল পথে নদীয়া (বর্তমানে এটি পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত) এবং অন্যান্য স্থানে আসতেন। [হিষ্ট্রি অব দ্যা মুসলিমস অব বেঙল, ডঃ মুহাম্মদ মোহর আলী, পৃষ্ঠা-৪২]
আট
এইসব তথ্য সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে আরব বণিক এবং মুবাল্লিগদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ইসলামের আলো পৌঁছে। পরবর্তীকালে অনারব অঞ্চল থেকেও মুসলিমগণ এই দেশে আসতে থাকেন।
মুসলিম বণিক এবং মুবাল্লিগদের উপস্তাপিত শিক্ষা ও আচরণ স্থানীয় লোকদের একাংশকে মুগ্ধ করে। তাঁরা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মুসলিম হন। এইভাবেই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মুসলিম লোকালয় গড়ে ওঠে।