সাহাবা বিশ্বকোষ পরিচিতি
সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক, সকল কর্মের বিধায়ক এবং সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক। অসংখ্য দরূদ ও সালাম সেই মহামানবের প্রতি যিনি রাসুলগণের ইমাম, সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গাম্বর, যাকে আল্লাহ তা’আলা কুল-মাখলুকের হেদায়েতের আঁধার ও উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করূপে প্রেরণ করেছিলেন এ ধরায়। তাঁর পূন্যাত্মা পরিবারবর্গ ও আলোকিত সাহাবায়ে কিরাম রা.-এর প্রতি অযুত সালাম।
রাসূলে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রায় সোয়া লক্ষ সাহাবীর নাম পরিচয় জানা যায়। তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন আলোকিত সত্তা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরশে ধন্য সোনার মানুষ। তাঁদের ত্যাগ ও কুরবানী, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার বদৌলতে আজ বিশ্বের আনাচে কানাচে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেছে। তাইতো মহান আল্লাহ তা’আলা তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং সে সন্তুষ্টির ঘোষণা প্রদান করেছেন। এর বিনিময়ে তাদের মহাসাফল্য ও পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে—
মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে সর্বাগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে আল্লার তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাতে সন্তুষ্ট। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। এটা মহাসাফল্য (সূরা তাওবা : ১০০)।
সাহাবাদের প্রতি সন্তুষ্টির ঘোষণা দিয়ে আরো ইরশাদ হয়েছে—
‘আল্লাহতো মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট হলেন যখন তারা গাছের নিচে তোমার নিকট বায়আত গ্রহণ করেছে । তাদের অন্তরে যা ছিল তা তিনি অবগত ছিলেন। তাঁদেরকে তিনি দান করছেন প্রশান্তি এবং তাদেরকে তিনি পুরস্কার দিলেন আসন্ন বিজয়’ (সূরা ফাতহ : ১৮)।
মহান আল্লাহ স্বয়ং সাহাবায়ে কিরামের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আর সে প্রশংসা শুধু কুরআনেই নয়, পূর্ববর্তী কিতাব তাওরাত, ইঞ্জীলেও করেছেন। ইরশাদ হয়েছে—
মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। তার সহচরগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবে। তাদের লক্ষণ তাদের মুখমন্ডলে সিজদার প্রভাবে প্রস্ফুটিত থাকবে। তাওরাতে তাদের বর্ণনা এরূপ, ইঞ্জিলেও তাদের বর্ণনা এরূপ। (সূরা ফাতহ : ২৯)।
সাহাবায়ে কেরামের ত্যাগ ও কুরবানীর কথা উল্লেখ করতঃ তাঁদের উত্তম বিনিময়ের কথা ঘোষণা করে তিনি ইরশাদ করেন—
অতপর যারা হিজরত করেছে, নিজ গৃহ থেকে উৎখাত হয়েছে, আমার পথে নির্যাতিত হয়েছে এবং যুদ্ধ করেছে ও নিহত হয়েছে আমি তাদের পাপ কাজগুলো অবশ্যই দূর করে দেব এবং অবশ্যই তাদেরকে দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। এটা আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার। আর উত্তম পুরস্কার আল্লাহরই কাছে। (সূরা আলে ইমরান : ১৯৫ )।
এমনিভাবে রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও স্বীয় মোহব্বতে সিক্ত করেছেন তাঁর প্রাণ প্রিয় এ সাহাবীদেরকে। তাই কেউ তাদের বিরুদ্ধে সামান্য তীর্যক বাণী নিক্ষেপ করুক তাও তিনি পছন্দ করেননি। যারা এরুপ করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সর্তক বাণী উচ্চারণ করেছেন। সাথে সাথে তিনি তাঁর সাহাবীদের শ্রেষ্ঠত্বও বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
তোমরা আমার সাহাবীদের গালি দিবে না। তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমান স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে তবুও সে তাদের এক যুদ্দ্-এর পরিমানও পৌঁছতে পারবে না এবং তার অর্ধেক পর্যন্তও না। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ৩৬৭৩)
তিনি আরো বলেন,
সবচেয়ে উত্তম মানুষ হলো আমার সময়ে যারা রয়েছে (সাহাবায়ে কিরাম); তারপর হলো তাদের সময়ে যারা থাকবে (তাবিঈগণ); তারপর হলো যারা তাদের সময়ে থাকবে (তাব তাবিঈগণ)। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৬৫১)
ইসলামের সঠিক দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তা’আলার বাণী, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কিরাম রা.-এর বর্ণনা সবচেয়ে অগ্রাধিকারযোগ্য ও পালনীয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্ণাঙ্গ জীবন সাহাবায়ে কিরামের সামনে ছিল দিবালোকের মত সুস্পষ্ট। তাঁদের বাস্তব দেখা বিষয়গুলো তাঁরা নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন। তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সার্বক্ষনিক সাথী ছিলেন। তাঁর সর্বোত্তম চরিত্রের সৌন্দর্যময় দিকগুলোসহ সবকিছুই তারা আলোকপাত করেছেন। এ জন্য হাদীস শরীফে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুষ্পষ্টভাবে বলেছেন—
আমার সাহাবারা হচ্ছেন নক্ষত্রের সমতুল্য। তাদের যে কাউকে অনুসরণ করবে— তোমরা হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে।
সাহাবায়ে কেরামের ফজিলত, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্তবা সম্পৃক্ত আরো বহু হাদীস রয়েছে। তাই তাদের পূন্যময় জীবন ও কর্ম তুলে ধরার লক্ষ্যে ‘হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবায়ে কেরামের সুবিন্যস্ত জীবনী’ বা ‘সাহাবি বিশ্বকোষ’ প্রণয়ন করার আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
তারাজিমের প্রসিদ্ধ কয়েকটি গ্রন্থ
ইতোপূর্বে বিভিন্ন ভাষায় মুসলিম মনীষীও গবেষকগণ সাহাবায়ে কেরামের জীবনী সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
১. ইবনে হাজার আল আসকালানী (৭৭৩-৮২৫/১৩৭২-১৪৪৯ ) রচিত আল ইসাবা ফী তাময়ীমিস সাহাবা
২. ইবনুল আছীর (১১৬০-১২৩৪)খ্রি. রচিত উসদুলগাবা ফী মারিফাতিস-সাহাবা, যাতে ৭০০০ হাজার সাহাবীর জীবনী স্থান পেয়েছে।
৩. ইবন আবদিল বারর (৪৬৩ হি./১০৭১খ্রি.) রচিত আল ইসতীআব ফী মারিফাতিল আসহাব উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া হাদীসের রাবীদের জীবনী সংরক্ষণ করে গ্রন্থ রচনা করেছেন অনেক মনীষী। আর সাহাবায়ে কেরামের বিরাট একটি অংশ যেহেতু হাদীস বর্ণনার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এজন্য তাঁদের রচিত গ্রন্থে সাহবীদের জীবনীও উল্লিখিত হয়েছে। যেমন,
৪. আয-যাহাবী রচিত চার খণ্ডে প্রকাশিত তাযকিরাতুল হুফফাজ, তাঁরই রচিত ২১ খন্ডে সিয়ারু আলামিন নুবালা
৫. আল মিযী রচিত ৩২ খণ্ডে প্রকাশিত তাহযীবুল কামাল
৬. মুহাম্মদ ইবন সাদ রচিত নয় খণ্ডে প্রকাশিত আত-তাবাকাতুল কুবরা; যাতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনীসহ ৪২৫০ জনের জীবনী উল্লিখিত হয়েছে।
তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আবরার ফাউন্ডেশন-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান আইপিডিয়া- ‘হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবায়ে কেরামের সুবিন্যস্ত জীবনী’ বা ‘সাহাবি বিশ্বকোষ’ -প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে।
সংকলন পদ্ধতি
‘হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবায়ে কেরামের সুবিন্যস্ত জীবনী’ বা বা ‘সাহাবি বিশ্বকোষ’ -প্রকল্পে প্রায় ৩৫০০ সাহাবায়ে কেরামের সুবিন্যস্ত জীবনী আলোচনা করেছি। সাহাবিদের তালিকা অক্ষর (অ-হ) হিসেবে সাজানো হয়েছে। আবার প্রতি অক্ষরকে আ-কার, ই-কার, ঈ-কার, উ-কার, ঊ-কার, ঋ-কার, এ-কার, ঐ-কার, ও-কার, ঔ-কার, ক-ফলা, ব-ফলা, য-ফলা, র-ফলা হিসেবে বিন্যাস করা হয়েছে। যেমন কা, কি, কী, কু, কূ, কৃ, কে, কৈ, কো, কৌ, ক্ক, ক্ক, ক্যা ক্স, (ঞ) ইত্যাদি।
আমরা আশা করি, সাহাবি বিশ্বকোষ, তাবেয়ী বিশ্বকোষ, তাবে তাবেয়ী বিশ্বকোষ ও সালাফ বিশ্বকোষ আমাদের জ্ঞানের রাজ্যে ও জাতীয় জীবনে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলবে। আলোকিত এসব মনীষীর জীবন ও কর্ম আত্মস্থ করে নিজেরাও আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে বাংলা ভাষাভাষী জনগণ। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে বাকী কাজগুলো সফলতার সাথে সমাপ্ত করার তাওফীক দান করুন এবং ক্ষুদ্র এ প্রয়াস কবুল করুন। আমিন।