ফিকহ ও ফতোয়া বিশ্বকোষ পরিচিতি
ইসলাম মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহ-র শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। ইসলামের বিধি-বিধান পালনের মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভে সক্ষম হয়। মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সকল সফলতা এ অনুশাসন মেনে চলার মধ্যেই নিহিত। ইসলামী পয়গামের সর্বোচ্চ মাধ্যম হল পবিত্র কুরআন ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ্। অতঃপর রয়েছে কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে ইজমা কিয়াস তথা ইজতিদের ধারা।
ফিকহ্ কি?
ফিকহ্ হচ্ছে ইসলামী আইন-কানূন, বিধি-বিধানের সুবিন্যস্ত শাস্ত্রের পারিভাষিক নাম। মানুষের জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য ইসলামে সুস্পষ্ট আইন-কানূন, বিধি- বিধান রয়েছে। এই আইনের মূল উৎস হচ্ছে পবিত্র কুরআন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ্ বা হাদীস। এই দুই মূল উৎসের ভিত্তিতে কালপরিক্রমায় উদ্ভাবিত সমস্যাবলীর যে সমাধান ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমে করা হয়েছে তাও ইসলামী আইনের অন্যতম উৎস হিসাবে স্বীকৃত।
ফিক্হ শাস্ত্রের সর্ববাদী সম্মত প্রধানত উৎস হচ্ছে চারটি। যথা ১. কুরআন, ২. সুন্নাহ্ ৩. ইজমা ও ৪. কিয়াস।
মূলত আকাইদ, ইবাদত, মু’আমালাত অর্থাৎ বৈষয়িক লেনদেন সম্পর্কিত বিষয়সমূহ, মু’আশারাত অর্থাৎ সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কিত বিষয়সমূহ, উক্বাত অর্থাৎ অপরাধের শাস্তি বিধান সম্পর্কিত বিষয়সমূহ, আদাব ও আলাক ইত্যাদি বিষয়সমূহ ফিকহ শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত।
ফিকহরে প্রয়োজনীয়তা
মুসলমান হিসাবে জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় মাসাইল জানা সকলের জন্যই আবশ্যক। তা ছাড়া কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন দর্শন, মতবাদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাবে জীবনযাত্রার সহিত সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু নতুন জিজ্ঞাসাও বর্তমান সমাজে উপস্থিত। সাধারণত ফিকহবিদ আলিমগণ যুগে যুগে এ ধরনের নতুন সমস্যাবলীর সমাধান দিয়ে আসছেন।
মানব জীবনে ফাতাওয়া ও মাসাইলের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন মুসলমান হিসাবে জীবনের প্রত্যেকটি কাজ ইসলামী শরী’আতের বিধি-বিধান মুতাবেক সম্পাদন করা আবশ্যক। বস্তুত ইসলামী জীবন যাত্রার সর্বোচ্চ সফলতা এখানেই। জীবনের কাজগুলি শরীআতের বিধানের আলোকে বিশুদ্ধরূপে সম্পাদন করতে চাইলে শরী আতের ফাতাওয়া ও মাসাইল জানা থাকা একান্ত জরুরী।
ফিকহ ও ফতোয়া বিশ্বকোষ
শরী’আতের এ বিধি-বিধান মাসাইলের আকারে ফিক্হ এবং ফাতাওয়া আকারে ফাতাওয়া বিষয়ক আরবি ভাষায় বেশ কয়েকটি ওয়েবসাটি রয়েছে। বাংলা ভাষায় ইতিপূর্বে মাসাইল সংক্রান্ত কিছু ওয়েবসাইটে কাজ হলেও ‘ফিকহ ও ফতোয়া বিশ্বকোষ’ শিরোনামে বড় ও পূর্ণাঙ্গ কোন কাজ অদ্যাবধি হয় নি। অথচ মুসলমানদের জীবন-যাত্রার ক্ষেত্রে ফাতাওয়া গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা অসামান্য। এ প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ্য রেখেই আইপিডিয়া ‘ফিকহ ও ফতোয়া বিশ্বকোষ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয় এবং দেশ বরেণ্য আলিম ও ফকীহগণের সমন্বয়ে একটি সম্পাদনা পরিষদ গঠন করে। পরিষদ এ কাজের পদ্ধতি ও রূপরেখা তৈরী করে তার আলোকে ইন্সিত লক্ষ্য অর্জনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানের ‘ফিকহ ও ফতোয়া বিশ্বকোষ’ সেই প্রকল্পের ফসল।
ফাতাওয়া ইতিহাস
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়ে তিনি নিজেই বিভিন্ন বিষয়ের বিধান বর্ণনা করতেন। বিভিন্ন সমস্যার প্রেক্ষিতে ফাতাওয়া তথা সমাধান পেশ করতেন।
হিজরী প্রথম শতকেই ফিক্হ প্রণয়ন ও সংকলনের কাজ শুরু হয় এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে এসে আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের যুগে তা স্বয়ং সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। বিশেষত ইমাম আযম আবূ হানীফা নুমান ইবন সাবিত (রাহি.), ইমাম মালিক ইবন আনাস (রাহি.), ইমাম শাফিঈ (রাহি.) ও ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রাহি.) ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে শরীআতের যাবতীয় বিধি-বিধানকে সুপরিকল্পিতভাবে সুবিন্যস্ত করেন। তাঁদের এই অনন্য সাধারণ ইজতিহাদ কর্ম মুসলিম উম্মাহর নিকট ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং যে কোন মুসলমান তাঁর জীবনের যে কোন সমস্যা ও জিজ্ঞাসার শরীআত সম্মত সদুত্তর পাওয়ার সুযোগ পায়।
তাঁরা সারা জীবনব্যাপী সাধনা করে মুসলিম জীবনের সকল দিকের জন্য ইসলামী শরআতের সুবিন্যস্ত ও সুসংবদ্ধ আইন কানুন, বিধি-বিধান পেশ করেন। তাঁদের এই অবদান অনবদ্য ও অবিস্মরণীয়। এবং তাঁদের মাযহাব বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও অনুসরণীয় হয়ে আসছে।
ফিকহ ও ফতোয়া বিশ্বকোষ সংকলন পদ্ধতি
এই ওয়েবসাইটের ‘ফিকহ ও ফতোয়া বিশ্বকোষ’-আলোচনায় ঈমান ও আকাইদ সম্পর্কিত বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বিরোধী মতবাদসমূহ দলীল ও যুক্তির ভিত্তিতে খন্ডন করে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সত্যতা ও সঠিকতা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কাল পরিক্রমায় আধুনিক মতবাদ, দর্শন ও বিজ্ঞানের প্রভাবে যেসকল জিজ্ঞাসার উদ্ভব হয়েছে তার সময়োপযুগী সমাধানও পেশ করা হয়েছে। কোন কোন নব উদ্ভাবিত সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত দেশের প্রখ্যাত আলিমদের নিকট পাঠিয়ে সে সম্পর্কে তাঁদের অভিমত নেওয়া হয়েছে।
আমরা এই সংকলনের বিষয়গুলি পূর্বসূরী ফকীহগণের অনুসরণে সুবিন্যস্ত করেছি। যেহেতু বাংলাদেশের প্রায় সব মুসলমানই হানাফী মাযহাবের অনসারী তাই মাসআলা সমূহের সমাধান হানাফী মাযহাব অনুযায়ী পেশ করা হয়েছে। অবশ্য প্রয়োজনবোধে কোথাও কোথাও অন্যান্য ইমামগণের মতামতও উল্লেখ করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শরীআতের পরিভাষা বহাল রাখা হয়েছে। তবে পরিচিত পরিভাষার ক্ষেত্রে বাংলা তরজমাও বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই সংকলনে আমাদের প্রধান অনুকরণীয় গ্রন্থ ছিল আলমগীরী, শামী, হিদায়া, বাদায়ে, বাহারুর রাইক প্রভৃতি ফিকহের বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থসমূহ। এছাড়া অন্যান্য যে সকল নির্ভরযোগ্য ফিকহ্ ও মাসাইল গ্রন্থের সহায়তা নেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট মাসাইলের শেষে সে সবের বরাত উল্লেখ করা হয়েছে। ভাষা সর্বসাধারণের বোধগম্য ও সহজ সরল করার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। আশা করি এটি দেশবাসী মুসলিম জনগণের নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। যেহেতু এটি এ ধরণের প্রথম কাজ তাই এতে ভুল-ত্রুটি থেকে যাওয়া অসম্ভব নয়। কারো দৃষ্টিতে কোন ভুল পরিদৃষ্ট হলে তা ‘আইপিডিয়া’ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। পরিশেষে মহান আল্লাহ-র দরবারে আমাদের ফরিয়াদ, তিনি এই প্রকল্পকে কবুল এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে জাযায়ে খাইর দান করুন। আমীন!