অন্ধকূপ হত্যা
অন্ধকূপ হত্যা (Black Hole of Calcutta) হলো নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ইংরেজ ঐতিহাসিক হলওয়েলের (John Zephaniah Holwell) সাজানো একটি উপাখ্যান। নবাব কর্তৃক ১৭৫৬ সালে জুন মাসে কলকাতার ইংরেজ দুর্গ দখলের পর ১৪৬ জন ইংরেজ বন্দিকে অবিশ্বাস্য রকম ক্ষুদ্র একটি কক্ষে আবদ্ধ রেখে হত্যা করা হয় বলে এই উপাখ্যানে দাবি করা হয়।

ঘটনার প্রেক্ষাপট
সকল ঐতিহাসিকই এই ব্যাপারে একমত যে, তরুণ নবাবের সিংহাসন আরোহণকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির (East India Company) লোকেরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের কূটনৈতিক নিয়ম বহির্ভূত আচরণে। বিশেষত,
(১) নবাবের দরবারে উপস্থিত হয়ে আনুগত্য প্রকাশ না করা।
(২) সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দুর্গ নির্মাণ ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি।
(৩) সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদেরকে নবাবের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান ও অভ্যুত্থানের প্রয়াস।
(৪) বাণিজ্যক্ষেত্রে দেশিয় নিয়ম অমান্য ও স্বেচ্ছাচারিতা প্রদর্শন।
(৫) ফোর্ট উইলিয়াম (Fort William) দুর্গের গভর্নর রজার ড্রেক (Roger Drake) কর্তৃক রাজদ্রোহী কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় প্রদান; ইত্যাদি ঘটনা নবাবকে ইংরেজ দমনে উদ্যোগী হতে বাধ্য করে।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে প্রথম ও শেষ কারণটি ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
নবাব আলিবর্দী খানের অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত বাংলার শাসনকার্য নির্বাহ করতেন সিরাজ-উদ-দৌলা (দ্রষ্টব্য : আলিবর্দী খান)। তখন তিনি গোপন সূত্রে খবর পান, ঢাকা অঞ্চলের রাজস্ব কর্মকর্তা রাজা রাজবল্লভ (Rajballabh, Raja) দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারি তহবিল তসরুপে লিপ্ত। নবাব হিসেবের সমস্ত কাগজপত্র নিরীক্ষা করার জন্য রাজবল্লভকে ডেকে পাঠান। ভীত-বিহ্বল রাজবল্লভ তিপ্পান্ন লক্ষ টাকাসহ পুত্র কৃষ্ণদাস ও পরিবারের সকল সদস্যকে গোপনে ইংরেজদের আশ্রয়ে কলকাতা পাঠিয়ে দেয়।
কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দানের পেছনে কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল,
(১) তার সঙ্গে আনীত তিপ্পান্ন লক্ষ টাকা কোম্পানির পুঁজি বৃদ্ধির সহায়ক হবে।
(২) কলকাতা কর্তৃপক্ষের কতক অফিসার কর্তৃক পঞ্চাশ হাজার টাকা করে ঘুস লাভ।
(৩) ঘসেটি বেগম (Ghaseti Begum)-এর উপর রাজবল্লভের প্রভাব যার মাধ্যমে আলিবর্দীর মৃত্যুর পর সিংহাসনের দাবিদার শওকত জঙ্গের ক্ষমতারোহণ নিশ্চিত করা (স্বার্থলোভী অমাত্য ও পরিবারের সদস্যরা শওকত জঙ্গকে ক্ষমতাসীন করা সমর্থন করত), যাতে কোম্পানি সরকারের নিকট থেকে বিপুল আর্থিক ও ব্যবসায়িক সুবিধা লাভে সমর্থ হতে পারে।
অপরপক্ষে ইংরেজরা ১৭৫৫ সালে দুরভিসন্ধিমূলকভাবে কলকাতার দুর্গ সম্প্রসারণ ও শহরের চারপাশে পরিখা খনন করতে থাকে। কৃষ্ণদাস ও দুর্গ নির্মাণের ঘটনায় নবাব স্পষ্টতই বুঝতে পারেন, ইংরেজরা তার সিংহাসন লাভের অন্তরায় সৃষ্টি করছে। তাই ১০ই এপ্রিল, ১৭৫৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের দিনই নবাব ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের গভর্নর রজার ড্রেককে দুর্গ নির্মাণ স্থগিত ও কৃষ্ণদাসকে নবাবের হাতে সোপর্দ করার ফরমান পাঠিয়ে দেন।
ড্রেক পত্রবাহক নারায়ণ সিংহ (Narain Singh)-কে অপমানিত করে ফেরত পাঠায়। তথাপি নবাব যুদ্ধের পথ পরিহারপূর্বক শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করেন। তাই তিনি খাজা ওয়াজিদ (Khoja Wajid) নামক আর্মেনিয়ান দূতের মাধ্যমে ইংরেজদেরকে জানিয়ে দেন,
‘ইংরেজরা যদি শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবসা করতে চায় এবং নবাবের সহযোগিতা চায়, তবে তারা যেন অনতিবিলম্বে নবনির্মিত দুর্গ ভেঙে ফেলে এবং কৃষ্ণদাসকে ফেরত পাঠায়, নতুবা আমি সুবা থেকে এদের বহিষ্কার করতে বদ্ধপরিকর।’
উল্লেখ্য, এই পত্রটি ২৮শে মে, ১৭৫৬ সালে প্রেরিত হয়। খাজা ওয়াজিদকেও নারায়ণ সিংহের মতো দুর্ব্যবহারের শিকার থেকে হয়। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে এই ধরনের মিশন কলকাতা গেলে দুঃখজনক পরিস্থিতির শিকার থেকে হবে বলেও মি. ড্রেক হুমকি দেয়। এই অবস্থায় নবাব সামরিক অভিযান ভিন্ন মি. ড্রেকের ঔদ্ধত্য দমনের বিকল্প দেখলেন না।
অবরোধ
তাই ৩ রা জুন, ১৭৫৬ সালে তিনি ৫০,০০০ সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে কলকাতা আক্রমণের পূর্ব-পদক্ষেপ হিসেবে কাসিম বাজার দুর্গ (Kasimbazar Fort) অবরোধ করেন। ফ্যাক্টরি প্রধান মি. ওয়াটস আত্মসমর্পণ করলে নবাব অধিকৃত ফ্যাক্টরির সকল মালামাল তালিকাবদ্ধ করে অফিস সিল করে দেন–যাতে নবাবের অনুপস্থিতিতে লুটতরাজ থেকে না পারে।
কাসিম বাজার পতনেও মি. ড্রেক সিরাজের সাথে আলোচনায় বসতে রাজি হয়নি; বরং ১০ই জুন, ১৭৫৬ সালে নবাবের ঘাঁটি শোকসাগর ও থানা আক্রমণ করে। এর পরও নবাব আলোচনার পথ পরিহার করেননি। কিন্তু তার এই সংলাপ প্রয়াসকে মি. ড্রেক দুর্বলতার লক্ষণ হিসেবে দেখে ভুল করে।
কলকাতা আক্রমণ
ড্রেকের ধারণা ছিল নবাবের সমরশক্তি দুর্বল এবং কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সাহস তার নেই। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে ইংরেজ বিরোধী অপরাপর ইউরোপীয় শক্তি, বিশেষত ওলন্দাজ (Hollander) ও ফরাসি (French) শক্তিকে নবাব নিজ পক্ষে আনার চেষ্টা করেন। এতে আংশিক সফলও হন। সার্বিক প্রস্তুতি শেষপ্রান্তে ১৬ই জুন, ১৭৫৬ সালে ৩০ হাজার সৈন্যের বাহিনী নিয়ে নবাব কলকাতা আক্রমণ করেন।
ঘটনার বিবরণ
ইংরেজ বাহিনীতে ছিল মাত্র আড়াইশত ইউরোপিয়ান ও এক হাজার ভারতীয় সিপাই। দূরপাল্লার কামান ছিল পঞ্চাশটি। নবাবের সঙ্গে গভর্নর ড্রেকের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের তুলনায় তার সমরশক্তি ছিল খুবই অল্প। নবাবের বিশাল বাহিনী চারদিক দিয়ে কলকাতা শহর ও দুর্গ ঘিরে ফেলে।
প্রথম দিনের গোলাগুলিতে সিরাজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। তাই যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে ইংরেজদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে দেশিয় সিপাহিগণ নবাবের বাহিনীতে যোগ দেয়। তৃতীয় দিনে ড্রেক শহর রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা পরিহার করে শুধু ‘ফোর্ট উইলিয়াম’ দুর্গ রক্ষার ব্যবস্থা করে। কিন্তু নবাবের গোলন্দাজ বাহিনী ইংরেজদেরকে পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। ড্রেক এমন ভীত-সন্ত্রস্ত হয় যে, তার চেহারায় সৃষ্ট আতঙ্কের ছাপ দেখে অন্য সবাই পালাবার চেষ্টা শুরু করে। রাতের অন্ধকারে নোঙর করা জাহাজে ড্রেকের পেছনে একসাথে এত লোক উঠতে গিয়ে অনেকে পদদলিত হয়ে, কেউ-বা পানিতে পড়ে মারা যায়।
নোঙর তুলতে গিয়ে পলায়নপর সর্বশেষ জাহাজ প্রিন্স চড়ায় আটকে যায়। এই আটকে পড়া জাহাজে ইউরোপিয়ানদের মধ্যে ছিল রিচার্ড পার্কস (Richard Parks), জন হলওয়েল (Holwell, John Zepheniah), অ্যাডওয়ার্ড আয়ার (Edward E. Ayer), লরেন্স উইথারিংটন (Laurence Witherington), ডেভিড ক্রেটন (David Craton) প্রমুখ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ। হলওয়েল অবশ্য পরে দাবি করে, সে ও তার সঙ্গীরা ইচ্ছে করেই জাহাজে থেকে যায়। হলওয়েলের এই দাবি পরিচিত মহলে হাস্যাস্পদ মনে করা হয়। ২০শে জুন তারিখে বিকাল ৪টায় কলকাতার চূড়ান্ত পতন ঘটে।
হলওয়েলর কথিত ‘অন্ধকূপ হত্যা’ উপাখ্যান
অতিরিক্ত মদ্যপান, নৈরাশ্য আর আতঙ্কের কারণে বন্দি ইংরেজরা নবাব বাহিনীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। এসব অস্বাভাবিক আচরণের বন্দিদেরকে একটি কক্ষে ২০শে জুন দিবাগত রাতে আটক রাখা হয়। এই আটক বন্দিদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জন হলওয়েল ‘অন্ধকূপ হত্যা’ উপাখ্যানটি সৃষ্টি করে।
জন জেফানায়া হলওয়েল কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ, যদিও পদবির দিক থেকে ছিল বেশ নিম্নে। পলায়নপর প্রিন্স জর্জের অন্যান্য বন্দির সাথে সে-ও আটক হয় এবং ইংরেজ বন্দিদের সঙ্গে কথিত অন্ধকূপে সে-ও ২০ জুনের রাত অতিবাহিত করে। বন্দি অবস্থায় কৃতকর্মের শাস্তি পাওয়ায় এবং নিজেদের নির্মিত দুর্গের গারদখানায় কষ্টকর সময় যাপন করায়–নবাব ও নবাব বাহিনীর প্রতি সে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। তাই নবাবকে ঘৃণা, অবজ্ঞা আর নিন্দার পাত্র বানানোর উদ্দেশ্যে অন্ধকূপ হত্যার কল্পিত লোমহর্ষক কাহিনি রচনা করে ব্যাপকভাবে প্রচার করে। সে বলে,
সেই রাতে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের গারদখানায়, যার আয়তন ১৮ ফুট বাই ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি, ১৪৬ জন বন্দিকে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়। গ্রীষ্মের রাতে ভীষণ গরমে ১২৩ জন বন্দি চরম অমানবিক কষ্টে মারা যায়, জীবিতদের অবস্থাও ছিল করুণ।
তার বিবরণ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তপন মোহন চট্টোপাধ্যায় (Mohan Chatterjee) বলেন,
‘হলওয়েল সাহেব হেরে গিয়েও কল্পনার জোরে সিরাজ-উদ-দৌলার উপর টেক্কা মেরে বেরিয়ে গেছেন। তিনি অন্ধকূপের কাহিনিকে ইনিয়ে-বিনিয়ে ভাষাকে জীবন্ত করে বিচিত্র পদ্ধতিতে প্রচার করে গেছেন। কিন্তু ওই রকম একটা ছোট ঘরে ১৪৬ জন পালোয়ানমার্কা ইউরোপিয়ানকে একসঙ্গে রাখা তো অসম্ভব ব্যাপার। তা ছাড়া তখন এত ইউরোপিয়ান একসঙ্গে পাওয়া গেলই-বা কোথা থেকে?
‘গোড়া থেকেই তো কলকাতায় ইউরোপিয়ানদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। তার উপর চিৎপুরের এক যুদ্ধে, লালদিঘীর প্রথম যুদ্ধে, ফোর্টের কাছে লালদিঘীর দ্বিতীয় যুদ্ধে কম লোক তো মারা যায়নি। তার চেয়েও অধিকসংখ্যক লোক পালিয়ে গেছে। ফোর্টের লড়াই শেষ হবার পরেও অনেক ইউরোপিয়ান ছাড়া পেয়ে এদিক-ওদিক সরে পড়েছিল। সব মিলিয়ে ঘাটের বেশি লোক কিছুতেই ফোর্টে থাকতে পারে না। আসল কথা, পরবর্তীকালে যার-ই কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি—তাকেই অন্ধকূপে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। এরকম যদি করা হয়, তবে তো গণিতের নিয়মানুসারে অঙ্ক আরও বেড়ে যাবে।’
হলওয়েলের বানোয়াট গল্পের প্রতি রসিকতা করে শ্রী চট্টোপাধ্যায় বলেন,
‘খবর পাওয়া যায়, মিসেস ক্যারি নামক একটি স্ত্রীলোক তার স্বামীকে ছেড়ে যেতে না চাওয়ায় স্বামীর সঙ্গে তাকেও অন্ধকূপে যেতে হয়েছিল। ভাগ্যিস সকালবেলা তিনি জীবিত বেরিয়েছিলেন, আর পরেও তার দেখা পাওয়া গিয়েছিল, নইলে লোকে এখনো হলওয়েল সাহেবের কাহিনিতে বিশ্বাস করতো যে, ওই মহিলা সিরাজ-উদ-দৌলার অন্তঃপুরে নবাবের ভোগে লেগেছিলেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর সিরাজুল ইসলাম (Dr. Sirajul Islam) বলেন,
‘সমস্যাটির পূর্ণ পরিসংখ্যান যাচাই করে গুপ্ত (Brijen K. Gupta) এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন, বড়োজোর চৌষট্টিজন লোককে ২৬৭ বর্গফুটের একটি ঘরে বন্দি করা হয়। এদের মধ্যে একুশজন জীবিত থাকে, আর বাকি বন্দিরা মারা যায়। যারা মারা যায়, তাদের অনেকেই ছিল যুদ্ধে কমবেশি আহত। এ কথা মনে রাখা উচিত, যারা মারা যায়–তারা ছিল সকলেই যুদ্ধবন্দি এবং পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধবন্দিদের বিশেষ ক্ষেত্রে হত্যা করা বা অমানবিক ব্যবহার করা বিরল কিছু নয়। সিরাজ-উদ-দৌলাকে জড়িয়ে তথাকথিত এ অন্ধকূপ হত্যা সম্পর্কে যত লেখা হয়েছে, অন্য কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমন লেখা তৈরি হয়েছে বলে জানা নেই। এর একটি কারণ হলো, ইউরোপীয়দের শ্রেষ্ঠত্ব বোধ।
একটি এশীয় দেশের শাসক কর্তৃক ইউরোপীয়রা এমনভাবে পরাজিত হবে, লাঞ্ছিত হবে, এটা ছিল তাদের ভাবনার অতীত। এশিয়া-আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শাসন স্থাপন করতে গিয়ে, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করতে গিয়ে, তার সাথে বর্বরোচিত দাস ব্যবসায় সমকালীন ইউরোপীয়রা যে নৃশংসতা, পৈশাচিকতা প্রদর্শন করে–এর উপমা কোথায়? কিন্তু সে যুগের ইউরোপীয়রা ছিল এমনি বর্ণবাদী, কৃষ্ণকায়ের উপর নির্যাতনকে কখনো তারা নির্যাতনই মনে করেনি। কারণ, তাদের কাছে কৃষ্ণকায়রা ছিল পশুতুল্য। সিরাজউদ্দৌলার প্রতি ব্রিটিশ বণিকদের যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মনোভাব লক্ষ্য করি, তাদেরকে আইনের অধীনে আনার প্রচেষ্টায় সিরাজউদ্দৌলার যে অর্থ ব্যয় ও লোকক্ষয় হয়, সেই পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র একুশজন লোকের অনভিপ্রেত মৃত্যু স্বৈরাচারী নৃশংসতার পরিচয় বহন করে কি?’
হলওয়েলের মিথ্যা রটনা অনুযায়ী নবাব সিরাজউদ্দৌলার নির্দেশে ১৮×১৪ ফুট মাপের একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দি করে রাখা হয়। ওই ক্ষুদ্র কক্ষে মাত্র দুটি ক্ষুদ্র জানালা ছিল। হলওয়েলের ভাষ্য অনুযায়ী শ্বাসরুদ্ধকর ওই পরিবেশে বন্দি করে ১৪৬ জনের মধ্যে ১২৬ জনই সেই রাতে মারা যায়।
তথাকথিত এই ঘটনা যে অবান্তর ও সত্যবিবর্জিত–তা সহজেই অনুমেয়। একটি ১৮×১৪ ফুট কক্ষে অর্থাৎ ২৫২ বর্গফুটের মধ্যে ১৪৬ জন ব্যক্তিকে যে ঠাসাঠাসি করে আবদ্ধ রাখা কোনোক্রমেই যে সম্ভব নয়; তা কোনো ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। ড. সি.আর.উইলসন (Dr. Charles Robert Wilson) জ্যামিতির সাহায্যে প্রমাণ করেছেন, মাথাপিছু দেড় ফুটের কিছু বেশি জায়গা প্রত্যেকের ভাগে পড়েছিল। সুতরাং এ সবই নিছক মনগড়া কাহিনি। (Dr. C.R. Wilson, Old Fort William in Bengal, vol. II, p. ৫৯)
হলওয়েল নিজেও স্বীকার করেছেন, গোলন্দাজ বাহিনীর ৩১ জন সৈন্য ২০শে জুনের দুপুরের পূর্বেই নিহত হয়। (S.C. Hill, Bengal in 1756-57, Indian Record Series, Vol. I, p. ১১৪)
অপরদিকে মিলস দাবি করেন,
দুর্গের পতনের সময় ১৮ জন সৈন্য পালিয়ে অর্থাৎ একজনের বর্ণনার সাথে অন্যজনের বর্ণনার কোনো মিল নেই। প্রাজ্ঞ ঐতিহাসিকদের গবেষণাপ্রসূত হিসেবে প্রতীয়মান হয়, শেষপর্যন্ত ওই দুর্গে ৮ থেকে ১০ জন মাত্র ইংরেজ জীবিত ছিল। হলওয়েলের কল্পনাপ্রসূত অন্ধকূপ হত্যার কাহিনি কত বাস্তবতা বিবর্জিত–তা উল্লিখিত তথ্যসমূহ থেকে সহজেই প্রমাণিত হয়।
প্রসঙ্গত এ কথাও উল্লেখ করা যায়, ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ইংরেজ ‘বীরপুরুষদের’ পলায়নের বিবরণ বা সিরাজউদ্দৌলার প্রতি পিগটের পরে অথবা তাকে লিখিত ওয়াট্স-এর পত্রেও অন্ধকূপের কোনো উল্লেখ নেই। তা ছাড়া নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে লিখিত ইংরেজদের পরেও অন্ধকূপ সম্পৃক্ত কোনো অভিযোগ বিধৃত হয়নি। আলি নগরের সন্ধি’ পত্রেও তথাকথিত অন্ধকূপের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না, এমন কি ক্লাইভ ‘কোর্ট অফ ডিরেক্টরস- Court of Directors’-এর নিকট সিরাজউদ্দৌলাকে কেন সিংহাসনচ্যুত করা হয় তার বিস্তারিত বিবরণ সংবলিত যে পত্র প্রেরণ করেন, তাতেও অন্ধকূপ হত্যার কোনো বিবরণ সন্নিবেশিত হয়নি।
কোর্ট অফ ডিরেক্টরস-কে লেখা হলওয়েলের পত্র থেকে প্রমাণিত হয়, সিরাজের কলকাতা আক্রমণের পূর্বে কলকাতা দুর্গে মাত্র ৬০ জন ইউরোপিয়ান ছিল। ওই ষাটজনের মধ্যে গভর্নর ড্রেক, সেনাপতি মিলচিন, চার্লস ডগলাস, হেনরি ওয়েডারব্যারন, লেঃ মেপলটফট, রেভারেন্ড ক্যান্টন, ম্যাকেট, ফ্রাঙ্কল্যান্ড, মানিবৃহাম, ক্যাপ্টেন গ্রান্ট প্রমুখ দশজন ‘বীরপুরুষ’ পালিয়েছিল অর্থাৎ হলওয়েলের বর্ণানেই সাক্ষ্য প্রদান করে, সিরাজের হাতে বড়োজোর পঞ্চাশজনের প্রাণহানি হতে পারে। (Holwell’s Letter to the Hon’ble Court of Directors, ৩০th November, ১৭৫৬. p. ৩৬)
কল্পনাপ্রসূত অন্ধকূপ হত্যার সমর্থনে দাবি করা হয়, ড্রেকের কলকাতা দুর্গ পরিত্যাগের পর ১৭০ জন ইউরোপিয়ান ওই দুর্গে জীবিত ছিল, যাদের মধ্যে ১৪৬ জনকে একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখা হয়; কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী যে বলেন, ১৯শে জুন রাতে একজন ইংরেজ সৈন্য ৫৭ জন ওলন্দাজ সৈন্যসহ শত্রুপক্ষে যোগদান করে (Gray’s Letter Hill, vol. ১. P. ১০৮)।
উপরন্তু হিলের বর্ণনা থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয়, ড্রেকের দুর্গ ভ্যাগের পর ও দুর্গের পতনের পূর্ব পর্যন্ত প্রাচীরের উপরেই নিহত হয় ৫০ জন সৈন্য। (Hill, ibid, vol. ১, p.৮৮)
‘অক্সফোর্ড হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া- ‘The Oxford History of India’ গ্রন্থেও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে,
‘We owe the traditional story of the Black Hole: to the descriptive powers of V.Z. Holwell, the defender of Calcutta and a plausible and none too reliable man (T.G.P. Spear’s ‘Note on the Black Hole’. The Oxford History of India, ৩rd ed., p. ৪৭৯)
The Oxford History of India এই মর্মেও সাক্ষ্য প্রদান করে যে,
‘For fifty years little notice was taken of the incident, but it then became a convenient material for the compilers of an imperialist hagiology.’
অর্থাৎ ‘দীর্ঘ ৫০ বছরে ওই ঘটনার খুব সামান্যই জানা গেছে; কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের জীবনীকারদের জন্য এসব তথ্য সুবিধাজনক হয়ে ওঠে।’ (T.G. P. Spear ibid, p. ৪৭৯)
শ্রী অক্ষয় কুমার মৈত্র (Maitreya, Akshay Kumar) যথার্থই উল্লেখ করেছেন,
‘মুসলমানদের কথা ছেড়ে দাও। তারা না হয় স্বজাতির কলঙ্ক বিলুপ্ত করার জন্য স্বরচিত ইতিহাস থেকে এই শোচনীয় কাহিনি সযত্নে দূরে রাখতে পারে। কিন্তু যারা নিদারুণ যন্ত্রণায় মর্মপীড়িত হয়ে অন্ধকূপ কারাগারে জীবন বিসর্জন করল, তাদের স্বদেশীয়-স্বজাতীয় সমসাময়িক ইংরেজদের কাগজপত্রে অন্ধকূপ হত্যার নাম পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায় না কেন?’
এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা- (Encyclopedia Britannica)-র বর্ণনানুযায়ী ১৯১৫ সালে ঐতিহাসিক জে. এইচ. লিটল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেন, হলওয়েলের বর্ণনার আদৌ কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই এবং তার কল্পকাহিনি ত্রুটি-বিচ্যুতিতে ভরপুর। ব্রিটানিকার ভাষায়,
‘According to Holwell, ১৪৬ people were shut up, and ২৩ emerged alive. The incident was held up as evidence of British heroism and the Nawab’s callousness. In ১৯১৫ J.H. Little pointed out Holwell’s unreliability as a witness and other discrepancies and it became clear that the Nawab’s part was one of negligence only. There is no foundation to the charge that the Nawab was personally responsible for the incident… The details of the incident were thus opened to doubt.’
(হলওয়েলের মতে ১৪৬ জনকে বন্দি করা হয় এবং ২৩ জন মাত্র জীবিত থাকে। এই ঘটনাকে ব্রিটিশ বীরত্ব ও নবাবের ঔদাসীন্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯১৫ সালে জে. এইচ. লিটল সাক্ষী হিসেবে হলওয়েলের অনির্ভরযোগ্যতা ও অন্যান্য অসামঞ্জস্য তুলে ধরেন এবং এ কথা স্পষ্ট হয়, এই ঘটনার জন্য নবাবের শুধু অবহেলাই ছিল। নবাব যে ব্যক্তিগতভাবে এই ঘটনার জন্য দায়ী, এ অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই…ফলে এই ঘটনার বিবরণীসমূহ সন্দেহের উদ্রেক করে)।
স্বভাবতই ইতিহাসবেত্তা লিটল তথাকথিত অন্ধকূপ হত্যাকে ‘A gigantic hoax’ বা ‘সুবিশাল ধোঁকা’ বলে বর্ণনা করেছেন।
এ কথা সহজেই প্রতীয়মান হয়, নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে একজন নৃশংস, বিবেক বিবর্জিত, মানবতাহীন ব্যক্তিরূপে জনসম্মুক্ষে উপস্থাপন করার ঘৃণিত প্রয়াসে হলওয়েল এই মিথ্যা রটনা শুরু করে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক, নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হেয় প্রতিপন্ন করার অপপ্রয়াস আজও অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত Tower of London-এ (যেখানে Crown Jewels-এর সঙ্গে কোহিনুর হীরকটিও সংরক্ষিত আছে) পলাশীর ঐতিহাসিক যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একটি হাতির অবয়বের নিম্নে লিপিবদ্ধ আছে, ফরাসিদের সঙ্গে চক্রান্ত করে সিরাজউদ্দৌলা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অন্যায় অভিযান চালান (The Nobab conspired with the French against the British)। অথচ এ কথা সর্বজনবিদিত মীরজাফর, রাজবল্লভ, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ প্রমুখ বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে চক্রান্ত করে ব্রিটিশরাই সেই অমিততেজা ও স্বাধীনচেতা নবাবকে পরাজিত করে অন্যায়ভাবে এই দেশ দখল করে।
শুধু বাংলার ইতিহাসেই নয়; বরং পৃথিবীর ইতিহাসেও নবাব সিরাজউদ্দৌলা এক অনন্য অসাধারণ ব্যক্তিত্ব বলে বিবেচিত। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েও তিনি স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টা করেন। অন্যায়, ভয়ভীতি; লোভ-লালসা বা চক্রান্তের কাছে কোনোদিনও তিনি মাথা নত করেননি। যুক্তরাজ্য ও এই উপমহাদেশের নগণ্যসংখ্যক ইতিহাসবেত্তা এই মহান চরিত্রে হলওয়েলের মতো কল্পিত কাপুরুষতা এবং অযথা অত্যাচারের চিহ্ন আবিষ্কার করে কলংক লেপনে প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য প্রদান করে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতা এবং সেই সঙ্গে ইংরেজদের দুর্ব্যবহার ও ঔদ্ধত্য সত্ত্বেও তাদের প্রতি নজিরবিহীন সহিষ্ণুতা, ধৈর্য ও ঔদার্য প্রদর্শন করেছেন।
S.C. Hill তার Bengal in 1756-57 শিরোনামীয় গ্রন্থে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করেছেন, নবাব হিসেবে সিরাজউদ্দৌলার অভিষেকের ক্ষেত্রে এবং তৎকর্তৃক ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের গভর্নর রজার ড্রেকের নিকট প্রেরিত পত্রের উত্তরে ব্রিটিশরা অত্যন্ত অসৌজন্যমূলক ও শৃঙ্খলা পরিপন্থি আচরণ করে।
William Tooke তার পত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন,
‘I have already observed by which means Seir Raja Doulet (Sirajuddoulah) came to the Nababship, upon which occasion it is usual according to an old Eastern custom on being appointed Prince of the country to be visited by the different foreign nations and proper presents made him. This in the first. place we neglected doing, and gave him no small vexation.’ (S.C. Hill, Bengal in 1756-57, Vol. I, p. ২৭৮)
হলওয়েল শুধু মিথ্যা রচনা করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং কোম্পানির বিজয়োত্তর ১৭৬০ সালে সে কলকাতার গভর্নর হলে অন্ধকূপ উপাখ্যানকে চিরস্মরণীয় করার জন্য রাইটার্স বিল্ডিং-এর পশ্চিমে ‘ব্লাকহোল মনুমেন্ট’ স্থাপন করে। তা পরে ভারতীয়দের নিকট ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হেয় করার মানসে হলওয়েল যে মিথ্যা রটনা শুরু করে, তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নবাব বাহিনী কলকাতা ত্যাগ করলে সে কলকাতাস্থ রাইটার্স বিল্ডিং-এর পশ্চিম দিকে একটি ‘স্মৃতিসৌধ’ গড়ে তোলে। তদানীন্তন ভারতবাসী এই অবমাননাকর ‘মনুমেন্ট’-এর অস্তিত্ব মেনে নিতে কোনোদিনও সম্মত হয়নি। তাদের সুতীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে লর্ড হেস্টিংস ১৮২১ সালে উক্ত ‘মনুমেন্ট’ অপসারণ করেন। কিন্তু ব্রিটিশ চক্রান্তকারীদের প্রবল চাপের মুখে লর্ড কার্জন ১৯০২ সালে পূর্বের স্থানেই একটি নতুন মার্বেল পাথর নির্মিত ‘স্মৃতিসৌধ’ স্থাপন করেন।
লর্ড কার্জন কর্তৃক সংস্থাপিত ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’-এর বিরুদ্ধে দেশবাসীর ক্ষোভ ও ঘৃণা পুঞ্জীভূত থেকে থাকে। ১৯৪০ সালে তা বিস্ফোরণ হয়ে ওঠে এবং একটি গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। এই গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (Subhas Chandra Bose)। ১৯৪০ সালের ২৯ জুন কলকাতার Albert Hall-এ অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন, ৩ জুলাইয়ের মধ্যে কুখ্যাত হলওয়েল মনুমেন্ট সরকার কর্তৃক অপসারিত না হলে–জনগণই তা অপসারিত করবে। এই আন্দোলন নস্যাৎ করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ২ জুলাই সুভাষচন্দ্র বসুকে গ্রেফতার করে। কিন্তু আন্দোলন স্তিমিত হওয়া তো দূরের কথা, তা অধিকতর বেগবান হয়ে ওঠে। সুভাষচন্দ্র বসুর সাময়িক অনুপস্থিতিতে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের সুযোগ্য সহকর্মী সৈয়দ বদরুদ্দোজা।
মিছিলের পর মিছিল স্রোতের মতো ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ অভিমুখে এগিয়ে গেলে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ বাহিনী নৃশংস অত্যাচার চালায়। সম্মিলিত হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত এসব মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের সিংহভাগই ছিল মুসলমান। ১৩ জুলাই, ১৯৪০ তারিখে সৈয়দ বদরুদ্দোজার নেতৃত্বে ইসলামিয়া কলেজ প্রাঙ্গণে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ পুলিশ সেখানেও নৃশংসতার স্বাক্ষর রাখে। এর প্রতিবাদে সৈয়দ বদরুদ্দোজা ২৩ জুলাই বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে একটি ভাষণ প্রদান করেন। ব্রিটিশ সরকারের এহেন অমানবিক ও অসভ্য আচরণ তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা প্রদান করেন, কুখ্যাত ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ অপসারণ করা হবে। অতএব কুখ্যাত ও জনধিকৃত ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ চিরতরে অপসারিত হয়।
পরিশেষে বলা যায়, অন্ধকূপ হত্যা ঘটনা ছিল একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার মাধ্যমে নবাব সিরাজকে নরঘাতক, রক্তপিপাসু ও জঘন্য চরিত্রের লোক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। অন্ধকূপ ছাড়াও আরও বহু মিথ্যা অপবাদ রচনা করে নবাবের চরিত্রকে কলংকিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষ গবেষণা ইংরেজদের সকল ষড়যন্ত্রের দ্বার উন্মোচন করলেও পলাশীর নির্মম পরিণতি রোধ করা কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি (আরও জানার জন্য দ্রষ্টব্য : নবাব সিরাজউদ্দৌলা, পলাশীর যুদ্ধ ইত্যাদি নিবন্ধ।)
গ্রন্থপঞ্জি
(১) অধ্যাপক কে. আলি, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস, আলি পাবলিকেশন্স, ঢাকা ১৯৮৫ সাল, পৃষ্ঠা : ৪৬৫-৪৬৬;
(২) তপন মোহন চট্টোপাধ্যায়, পলাশির যুদ্ধ, নাভানা, কলকাতা, জুন ১৯৮১ সাল, পৃষ্ঠা : ১১৮-১২৭;
(৩) সিরাজুল ইসলাম, বাংলার ইতিহাস, ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো, ১৭৫৭-১৮৫৭, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪, পৃষ্ঠা : ১৮-২৪;
(৪) Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah and the East India Company. ১৯৬৬, পৃষ্ঠা : ৫৩-৮০;
(৫) মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ, আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, বাংলা একাডেমি, ঢাকা ১৯৭৮ সাল, পৃষ্ঠা : ১৬-১৮;
(৬) মুস্তাফা নুর-উল ইসলাম, সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত, ১৯০১-১৯৩০, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭, পৃষ্ঠা : ৪২৪;
(৭) সৈয়দ আশরাফ আলি, ‘হলওয়েল ও অন্ধকূপ হত্যা’ শীর্ষক নিবন্ধ প্র., ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ৪২ বর্ষ ১ম সংখ্যা, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০২ সাল, পৃষ্ঠা : ২৯-৩৫