প্রথম ইয়াযিদ ইবনে মুআবিয়া[1]
পরিচয়
নাম : আবু খালিদ ইয়াযিদ।
পিতার নাম : মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহুমা।
মাতার নাম : বাইসূন বিনতে বাখদাল।
বংশ পরম্পরা : মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহুমা ইবনে হারব ইবনে উমাইয়া ইবনে আবদে শামস ইবনে আবদে মানাফ।
জন্ম : ২৩ রমজান ২৬ হিজরীতে উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফত কালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
তিনটি বিষয়ে নিমগ্নতা : সে সময় মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু পুরো সিরিয়া অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। এ কারণে এক ধরনের সচ্ছলতার মধ্যেই তার জীবনযাত্রা শুরু হয়। যৌবনের শুরুতে তিনটি বিষয় নিয়ে একটু বেশিই জড়িয়ে পড়েন।
এক. বিলাসিতা।
দুই. কাব্য রচনা।
তিন. শিকার।
তিনি বিলাসিতায় মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। বাবার ক্ষমতা ও পারিবারিকভাবে অঢেল সম্পত্তির কারণে তার এ সুযোগ সামনে চলে এসেছিল।
তাছাড়া কাব্য ও কবিতা রচনায় বেশি উৎসাহী ছিলেন। এ বিষয়ে তার যথেষ্ট পারদর্শিতাও ছিল।
ভ্রমণ ও শিকারের নেশায় ঘুরে বেড়ানোর সখ ছিল প্রবল।
বাবার সংশোধনের চেষ্টা : তবে যুদ্ধের ময়দানের ধকল অসহনীয় ছিল। পিতা তার চরিত্র সংশোধনের চেষ্টায় ত্রুটি করেনি। কনসটান্টিনোপল অভিযানে তাকে অনেকটা জোর করেই পাঠানো হয়েছিল। দুই বার আমীরে হজ্জ মনোনীত করা হয়।
কিন্তু এত প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও পুরোনো স্বভাব কিছু রয়েই গিয়েছিল। তালীম-তরবিয়তে খুব একটা আছর পড়েনি।
খিলাফত লাভ
খিলাফত প্রাপ্তির সন : মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু ইন্তেকালেন পর ৬০ হিজরীতে তিনি মুসলিম উম্মাহর খলীফা হন।
পূর্বেই বাইআতের পক্রিয়া ও কয়েকজন সাহাবীর অস্বীকৃতি : মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু জীবদ্দশায়ই তার উত্তরাধিকারীর বাইআত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু নেতৃস্থানী কুরাইশ বংশধর হিজাজবাসীদের প্রানপ্রিয় চার সরদার এ বাইআত গ্রহণ করেনি।
১. হুসাইন ইবনে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুমা।
২. আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা।
৩. আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা এবং
আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা।
তাদের সাথে আরো অনেকে ইয়াযিদের বাইআত গ্রহণ করেননি। এ বিস্তারিত বিবরণ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
এটা তো স্পষ্ট যে, এ চার মণীষীকে নিজের ব্যক্তিত্ব ও বংশগত মর্যাদার কারণে মুসলিম উম্মাহ গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখত। তাই তাঁদের এ মতবিরোধ এবং বাইআত না হওয়া কোনো সাধারণ ব্যাপার ছিল না।
ইয়াযিদের প্রথম পদক্ষেপ
সিংহাসনে আরোহন করার পর ইয়াযিদকে প্রথমেই উপরোল্লিখিত চার মণীষীকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হয়।
মদীনার গভর্নরের কাছে বার্তা প্রেরণ
সে সময় মদীনার শাসনকর্তা ছিলেন ওয়ালিদ ইবনে উতবা ইবনে আবু সুফিয়ান। ইয়াযিদ তাকে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর ইন্তেকালের খবর অবহিত করে এবং সব বুযুর্গগণের বাইআত গ্রহণের জন্য তিনি জোর তাকিদ দেন।
ওয়ালিদ ইবনে উতবার পদক্ষেপ
পরামর্শ সভা : ওয়ালিদ ইবনে উতবা এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়ার জন্য মারওয়ান ইবনে হাকামের সাথে এ নিয়ে পরামর্শ করেন। তিনি সে সময় মদীনাতেই ছিলেন।
মারওয়ানের পরামর্শ : মারওয়ান পরামর্শ দিয়ে বললেন, আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা ও আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমার সম্পর্কে চিন্তার কিছু নেই। তাঁরা ক্ষমতা গ্রহণের দাবিদার হবে না। তবে হুসাইন ইবনে আলী ও আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহুমকে এক্ষুনি আহবান করে তাঁদেরকে ইয়াযিদের বাইআত গ্রহণে বাধ্য করুন। তারা বাইআত গ্রহণ করতে রাজি না হয় তাহলে জীবিত ছেড়ে দেবেন না।
মারওয়ানের শঙ্কা : মারওয়ান আরো বলেন, যদি আমীরের মৃত্যুর খবর প্রচার হয়ে যায়। আর তাঁরা বাইআত গ্রহণ না করে তাহলে তাঁরা নিজ নিজ অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে প্রকাশ্যে ময়দানে এসে যাবে। তখন চতুর্দিকে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়বে।
পরামর্শ বাস্তবায়নের প্রয়াস :
হুসাইন ও ইবনে যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহুম প্রথমেই ইয়াযিদের বাইআত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে দেন। ওয়ালিদ হুসাইন যুবাইর রাযিয়াল্লাহু ও ইবনে যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহুমাকে ডেকে পাঠান।
বুযুর্গদ্বয় তখন মসজিদে অবস্থান করছিলেন। অসময়ে তাঁদের উভয়কে তলব করায় তারা উভয়ে পরিস্থিতি অনুধাবন করতে সক্ষম হন। তাঁরা পরস্পর আলোচনা করেন, কিছু হোক না হোক, আমীরের ইন্তেকাল হয়ে গেছে। আর আমাদেরকে বাইআত গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে তলব করা হচ্ছে।
হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুর সতর্কতা : হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু কয়েকজন লোকজন সাথে নিয়ে ওয়ালিদের নিকট পৌঁছেন। তিনি সাথীদের বাইরে বসিয়ে বললেন, যদি তোমরা কোনো রকম জোর আওয়াজ শোন, তাহলে তৎক্ষণাত ভিতরে প্রবেশ করবে।
ভেতরে প্রবেশের পর ওয়ালিদ হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুকে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যুর সংবাদ দিলেন। হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু এ খবর শুনে ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়েন এবং আমীরের জন্য মাগফিরাতের দুআ করেন।
বাইআতের প্রস্তাব পেশ ও হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুর উত্তর : ওয়ালিদ এবার নিজের মূল উদ্দেশ্য প্রকাশ করে বাইআতের আহবান করেন।
তার প্রস্তাব শুনে হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমার মতো মানুষ তো গোপনে বাইআত গ্রহণ করতে পারে না। আপনি একটি সাধারণ সভা আহবান করুন। আমিও সেখানে থাকব। উপস্থিত জনসমাগম যে রায় দেবে, তাই গ্রহণ করা হবে।
ওয়ালিদ দুষ্টু প্রকৃতির লোক ছিলেন না। তিনি তখন বললেন, আপনার প্রস্তাব যথার্থ হয়েছে। আপনি বিদায় নিতে পারেন।
ওয়ালিদের আক্ষেপ : হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু চলে যাবার পর ওয়ালিদ মারওয়ানকে বললেন, আফসোস, তোমাদের মনোভাব হচ্ছে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় নাতিকে শহীদ করে ফেলি। আল্লাহর কসম! কিয়ামতের দিন যাকে হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুর খুনের ব্যপারে জবাবদিহি করা হবে সে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহুর পদক্ষেপ : আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু ওয়ালিদের কাছে একদিন সময় চান। কিন্তু তিনি সেই রাতেই মদীনা থেকে মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যান। ওয়ালিদ এই খবর জানার পর কয়েকজনের একটা বাহিনী নিয়ে তার পেছনে ধাওয়া করে।
ইবনে যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা নির্জন এক পথে যাত্রা করেন। ফলে তারা আর তাকে খুঁজে পায়নি, ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে।
একটি জরুরি নোট
সামনে আমরা দুই সাহাবীর ধারাবাহিক আলোচনা করে যাব। প্রথমে হুসাইন ইবনে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুমা। এরপর আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুমা।
যদিও তারা বনু উমাইয়ার কোনো খলীফা বা শাসক ছিলেন না, তবুও তারা ছিলেন প্রকৃত খিলাফতের হকদার। অনেক মানুষ তাদের সমর্থনও করেছিল। তারা কিছুটা চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু উমাইয়ার শাসকগণ তাদেরকেও কঠোর হাতে দমন করেছে। উমাইয়া শাসকদের ঘটনার পরতে পরতে তো এমন অনেক কাহিনী আমরা জানবই। এছাড়াও তারা যেহেতু একটু বেশিই অগ্রসর ছিলেন, তাই তাদের আলোচনা স্বতন্দ্র অধ্যায় রাখার দাবি রাখে।
রেফারেন্স :
[1] ইয়াযিদ ইবনে মুআবিয়া। জন্ম : 23 রমযান 26 হিজরী ও মৃত্যু : ১৪ রবিউল আউয়াল ৬৪ হিজরী। ঈসায়ী হিসাবে জন্ম : 20 জুলাই, 647 ঈসাব্দ ও মৃত্যু : 12 নভেম্বর, 683 ঈসাব্দ। ইয়াযিদ ইবনে মুআবিয়া 36 বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার খেলাফত সময়কাল : ৬০ – ৬৪ হিজরী মোতাবেক ৬৮০–৬৮৩ ঈসাব্দ। 4 বছর খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন।