মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান

লেখক: আইপিডিয়া সম্পাদনা পরিষদ

বিষয়: ইসলামের ইতিহাস, মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস

মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহুমা [1]

উমাইয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশিষ্ট সাহাবী মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহুকে। তিনি কুরাইশ গোত্রের শাখা বনু উমাইয়ার বংশধর।[2] তাঁর বংশধারা—

মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহুমা ইবনে হারব ইবনে উমাইয়া ইবনে আবদে শামস ইবনে আবদে মানাফ। এভাবে আবদে মানাফ পর্যন্ত পৌঁছে তাঁর বংশধারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত মিলিত হয়েছে।

জন্ম : তিনি হিজরতের পনেরো বছর পূর্বে (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওত প্রাপ্তির দুই-তিন বছর আগে) মক্কা নগরিতে জন্মগ্রহণ করেন।

ইসলাম গ্রহণ : ৬ষ্ঠ হিজরীতে মক্কা বিজয়ের সময় ২৩ বছর বয়সে নিজ বংশের অন্যদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন।

গুণপরিচয় : মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু শিক্ষিত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মেধা ও যোগ্যতা দেখে তাঁকে ওহি লেখকদের তালিকাভুক্ত করেন। এছাড়াও তার দায়িত্ব ছিল, মক্কার আশপাশ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে আগত প্রতিনিধি দলের আপ্যায়ন ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা করা।

খোলাফায়ে রাশেদার যুগে :

প্রথম খলীফার যুগ : তেরো হিজরীতে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতকালে তিনি সিরীয়া অভিমুখে বিভিন্ন বাহিনী প্রেরণ করে, তখন মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর বড় ভাই ইয়াযিদ ইবনে আবু সুফিয়ানের অধীনে দামেশকে এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করা হয়৷ তখন মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে তাঁর ভাইয়ের সাহায্যের জন্য পরবর্তীতে পাঠানো একটি বাহিনীর সেনাপ্রধান বানানো হয়।

সিরিয়ার উপকূলীয় শহর যথা সাইদা[3], আরফা[4], হাবীল[5] ও বৈরুত[6] বিজয়ের সময় তিনিই ছিলেন সেনাপ্রধান।[7] কায়সারীয়া বিজয়ের মুকুটধারীও ছিলেন তিনি। সে যুদ্ধে আশি হাজার রোমান সৈন্য নিহত হয়।

দ্বিতীয় খলীফার যুগ : ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর অসামান্য কাজ আঞ্জাম দেওয়ার কারণে অত্যন্ত খুশি হন। তাঁকে উরদুন-জর্ডানের গভর্নর মনোনীত করেন।

আমওয়াছ মহামারি[8]তে ইয়াযিদ ইবনে আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহুর ওফাত হয়ে যায়। এরপর তার স্থানে আমীরে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে দামশকের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। সাথে জর্ডানের দায়িত্বও বহাল থাকে।

তৃতীয় খলীফার যুগ : ইসলামের তৃতীয় খলীফা উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতকালে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে পুরো শাম[9] তথা সিরিয়ার গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। সেখানকার যে কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণের দায়িত্বও ছিল তাঁর ওপর।

চতুর্থ খলীফার যুগ : ৩৫ হিজরীতে উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতের পর ইসলামের চতুর্থ খলীফা নির্বাচিত হন আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি সংগত কোনো কারণে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে সিরিয়ার গভর্নরের পদ থেকে অপসারণ করেন।

এতে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি অসন্তুষ্ট হন। তিনি তাকে খলীফা হিসেবে সমর্থন করতে অস্বীকার করেন। সাথে তিনি উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর হত্যা ইস্যুতে ঘাতকদের সহায়তা প্রদানে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু দিকে সন্দেহের আঙ্গুল তোলেন।

সিরিয়ানরা উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের দাবিতে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাতে বাইআত গ্রহণ করে। সিফফীন[10] নামক স্থানে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু ও মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর বাহিনীর মধ্যে একটি অনাকাঙিক্ষত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়।

অবশেষে দুটি শর্তে সন্ধি স্থাপনের মাধ্যমে সে যুদ্ধ মুলতবী ঘোষণা করা হয়।

শর্ত দুটি ছিল এমন—

এক. উভয় পক্ষ থেকে দুজন সালিশ মনোনীত করা হবে।

দুই. তারা উভয়ে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, তা মেনে নেওয়া হবে।

সন্ধিচুক্তি মোতাবেক উভয় শালিশ এ বিষয়ে ঐক্যমতে উপনীত হয় যে, আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে অপসারণ করে দেওয়া হবে। আর খলীফা মনোনয়নের দায়িত্ব উম্মতের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে।

এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর সিরিয়ানরা মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে আর ইরাকের বাসিন্দারা আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে পৃথকভাবে খলীফা মনোনীত করে। উভয় বুযুর্গের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহ চলতে থাকে।

অবশেষে ৪০ হিজরীতে এক আততায়ী খারিজির আঘাতে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু শাহাদাত বরণ করেন।

ইসলামের খলীফা মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু

৪০ হিজরীর শুরুতেই আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতের পর তার অনুসারীগণ হাসান ইবনে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুমার হাতে বাইআত গ্রহণ করে। কিন্তু তিনি কিছুদিন অতিবাহিত হতেই খিলাফতের দাবি ছেড়ে আত্মত্যাগের অপূর্ব উদাহরণ পেশ করেন। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয়। এজন্য এ বছরকে বলা হয় “আমুল জামাআহ” বা “ঐক্যের বছর”। এ বছর থেকেই মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর একক খিলাফতের সূচনা হয়।

রাজনৈতিক দল

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করার সময় রাজনীতির ময়দানে তিনটি রাজনৈতিক দল বিদ্যমান ছিল।

এক. বনু উমাইয়া সমর্থক গোষ্ঠী।

দুই. শিয়ানে আলী।

তিন. খারিজী সম্প্রদায়।

এক. বনু উমাইয়াদের সমর্থক

যারা প্রথম থেকে উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর খুনের দাবি উত্থাপন করেছিল। এদের বাড়াবাড়ি ছিল, এরা আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর ‘হত্যাকারী’ বলে অভিযুক্ত করত। তাঁর খিলাফত ‘অবৈধ’ বলে ঘোষণা দিত। এরা মনে করত, উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর পর খলীফা হলেন, মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা ছিল সিরিয়াবাসী ও অন্যান্য শহরের অধিবাসী।

দুই. শিয়ানে আলী

এ দলের লোকেরা মনে করত, আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর বংশধরগণ আহলে বাইত-নবুওত তথা নবী পরিবারে লোক হওয়ায় খিলাফতের অধিকার তাদের জন্যই সংরক্ষিত। তারা মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে বৈধ খলীফা মানত না।

কিন্তু সময়ের প্রতিকূলতায় নিরুপায় হয়ে পরবর্তীতে তাঁকে খলীফা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় দূরদর্শিতা ও সহনশীলতার মাধ্যমে দ্রুতই তাদের মন জয় করে ফেলে ৷ তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ ছিল অনারব— ইরাক ও মিশরের অধিবাসী।

তিন. খারিজী সম্প্রদায়

সিফফীন যুদ্ধের পর এদের উদ্ভব হয়। এরা তৃতীয় গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বনু উমাইয়া সমর্থক ও শিয়ানে আলী উভয় দলকে তারা দ্বীন থেকে খারিজ ও হত্যা করা ওয়াজিব মনে করত। যদিও এ দলের সমর্থক সংখ্যায় অনেক কম ছিল। কিন্তু তারা নিজেদের বিশ্বাস ও কর্মে সুদৃঢ় এবং মজবুত ছিল। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত জীবন বাজি রেখে বিরোধীদের মোকাবেলা করতে প্রস্তুত থাকত। কোনো প্রকার সন্ধিচুক্তি, ভয়-ভীতি বা লোভ-লালসাকে স্থান দিত না। তারা উম্মতের বড় একটি রাজনৈতিক দল ছিল। কিন্তু তাদেরকে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তাই তাদের ধূলিস্যাৎ হতে বেশি সময় লাগেনি।

একটি বিষয় তাদের মাঝে সমানভাবে ছিল— তাদের সাহস ও বীরত্ব। তাদের প্রত্যেকেই এ দুই গুণের অধিকারী ছিল। কিন্তু তাদের এ উম্মত শাসন করা ও রাজ্যে শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার যথেষ্ট অভাব ছিল। মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন পূর্ণাঙ্গরুপে এ গুণের অধিকারী। তিনি এ সব রাজনৈতিক মতবাদের মোকাবেলায় অনেক সুন্দর সুন্দর কৌশল অবলম্বন করেন। অত্যন্ত ইবনেয়-নম্রতা ও সতর্কতার তিনি অগ্রসর হতে থাকেন। কৌশলের কারণে এ ধরনের বিশৃংখলতা ও নৈরাজ্য সহ্য করতেন। তবে মৌখিকভাকে তাদেরকে বাড়াবাড়ি করতে বারণ করতেন। তাঁর ধৈর্য্য ও সহনশীলতার নযীর পরবর্তী শাসকদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর।

তবে তাঁর আপোষমূলক মনোভাব খারিজীদের মোকাবেলায় সফলতা লাভ করতে পুরোপুরি সক্ষম হয়নি। তারা সর্বদা রাজ্যে বিশৃংখলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে থাকে। তাদের তরবারী মিল্লাতের ঐক্য ও সংহতিকে টুকরা টুকরা করার কাজে লিপ্ত ছিল। এ কারণে সর্বপ্রথম তাদের প্রতি মনোযোগ দিতে হয়।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু ও খারিজী ফেৎনা

খারিজীদের পুনোরুদ্দমে অগ্রসর

ইসলামের চতুর্থ খলীফা আলী রাযিয়াল্লাহু শাহাদাত বরণ করেন খারিজীদের হাতে। তাঁর শাহাদাতের পর তৎকালীন খারিজী প্রধান ফারওয়াহ ইবনে নাওফিল আশজাঈ[11] পাঁচ শ খারিজীকে সঙ্গে নিয়ে শহর থেকে দূরে চলে যায় এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।

তারা যখন জানতে পারে, হাসান ইবনে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুমা খিলাফতের দাবি ত্যাগ মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর ওপর পূর্ণ দায়িত্বভার সোপর্দ করেছেন, তখন তারা বলে উঠল, তরবারী কোষমুক্ত করার উপযুক্ত সময় এসে গেছে। রাফারওয়াহ ইবনে নাওফিল আশজাঈ নিজের অনুসারীদের নিয়ে মোকাবেলার জন্য ‘নাখলা’ নামক স্থানে অবস্থান নেয়।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর সাথে প্রথম যুদ্ধ

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের দমন করাতে সিরিয়াগামী একটি বাহিনী পাঠান। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, ফরওয়াহ তাদেরকে পরাজিত করে ফেলে।

কুফাবাসীদের সাথে খারিজীদের লড়াই

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু কুফায় বসবাসরতদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দেন—

যদি তোমরা আমার পক্ষ থেকে তাদের দমন করতে না পারো তাহলে আমি তোমাদের কোনো নিরাপত্তা দেব না

এ ঘোষণা শুনে কুফা-বাসিন্দারা ফরওয়ার মোকাবেলা করতে প্রস্তুত হয়। তখন খারিজীরা কুফাবাসীদের কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসে। বলে, হে কুফাবাসী! তোমরাই বলো, মুআবিয়া কি আমাদের উভয়ের দুশমন নয়? তবে আমরা একাই তাদের মোকাবেলা করতে চাই, তোমরা আমাদেরকে তার মোকাবেলা করতে দাও। যদি আমরা তাকে পরাজিত করতে পারি, তাহলে তোমরা তাদের নির্যাতন থেকে বেঁচে যাবে, আর যদি আমরা পরাজিত হই, তোমরা আমাদের থেকে নিরাপদ হয়ে গেলে।

কিন্তু কুফার বাসিন্দারা এ প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। তারা খারিজীদের মোকাবেলা করে এবং ফরওয়ারকে বন্দি করে জীবিত কুফায় নিয়ে আসে।

খারিজীদের নতুনভাবে জেড়ে ওঠা

এদিকে খারিজীদের যারা অবশিষ্ট ছিল তারা নিজেদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে আবুল হাওসা[12]কে দলনেতা নির্বাচিত করে। সে ছিল তাঈ গোত্রের লোক। কুফার বাসিন্দারা পুনরায় তাদের ওপর আক্রমন করে। তাদের দল নেতা ইবনে আবুল হাওসা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে নিহত হয়। এ ঘটনা ঘটে ৪1 হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে।

ইবনে আবুল হাওসা নিহত হওয়ার পর খারিজীরা পুনরায় সংঘটিত হতে শুরু করে। এবার তাদের নেতা হন মুছিরাহ ইবনে ওয়াদ্দা[13]

মুছিরা এক শ পঞ্চাশ জনের একটা দল নিয়ে ‘নাখলা’ নামক স্থানে পৌঁছে। আগের নেতা ইবনে আবুল হাওসার সন্তান-সন্তুতি ও সঙ্গী-সাথী একেবারে কম ছিল, তারাও তার সাথে মিলিত হয়।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লহু আনহুর চুড়ান্ত পদক্ষেপ

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু কুফায় বসবাসকারী মুছিরার পিতা আবু মুছিরাকে ডেকে এনে বলেন, তুমি তোমার ছেলেকে বুঝাও।

আবু মুছিরা ছেলেকে বারবার বুঝায়। কিন্তু সে পিতার কথা মানতে নারাজ। এবার আবু মুছিরা বলল, তোমার ছেলেকে তোমার সামনে নিয়ে আসছি। এতে হয়ত তোমার অন্তরে দয়া হবে এবং তুমি তোমার মনোভাব পরিবর্তন করে ফেলবে।

মুছিরা বলল, আমি আমার সন্তানকে কোলে রাখার চেয়ে কোনো কাফির-গায়রে খারিজীর বর্শার লক্ষ্যস্থল হওয়াকে বেশি পছন্দ করি।

আমি আবু মুছিরা ফিরে এসে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট নিজ ছেলের অভিমত ব্যক্ত করে। মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তোমার পুত্র তো ভীষণ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।

এবার তিনি মুছিরার বিরুদ্ধে আবদুল্লাহ ইবনে আহমারের নেতৃত্বে দুই হাজার সৈন্যের এক বাহিনী প্রেরণ করেন। স্বয়ং আবু মুছিরাও ঐ বাহিনীতে যোগ দেয়। যুদ্ধ শুরু হলে বাবা ছেলেকে মল্ল যুদ্ধের আহবান জানায়। মুছিরা উত্তরে বলে, আমি ছাড়াও আপনার মোকাবেলা করার আরো অনেক লোক আছে।

এরপর ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু হয়। খারিজিরা বীরত্বের সাথে লড়াই করে। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী খারিজীদের পঞ্চাশ জন বাদে প্রায় সবাই নিহত হয়। ওদের চলমান নেতা মুছিরাও এ যুদ্ধে নিহত হয়। পরে তারা মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর আনুগত্য স্বীকার করে। এ ঘটনা ঘটে ৪১ হিজরীর জমদিউল আখিরায়।

এভাবে প্রায় নিঃশেষ হয়ে খারিজী নামের নব উদ্ভবিত এ ফেৎনাটি।

নতুন ষড়যন্ত্র

খারিজী সম্প্রদায় নিঃশেষ পর্যায়ে। মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু তখনো কুফায় অবস্থান করছিলেন। এমন সময় একদিন হঠাৎ তাঁর দরবারে শাবীব ইবনে বাজারাহ নামের এক খারিজী উপস্থিত হয়। বলে, আমি ও ইবনে মুলজিম উভয়ে মিলে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে হত্যা করেছি।

এরপর তারা তাঁর কাছে এজন্য পুরস্কারও দাবি করে। তারা ভেবেছিল, আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু তো মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর শত্রুই ছিল। এটা বললে হয়ত মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু অনেক খুশি হবেন এবং তাদের পুরষ্কৃত করবেন। এভাবে তারা নতুনভাবে জেগে উঠতে পারবে।

তার এ আবেদন শুনে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু তৎক্ষণাত ঘরের ভেতর প্রবেশ করেন এবং আশজা গোত্রের লোকদের কাছে খবর পাঠান, তোমরা শাবীবকে এক্ষুণি শহর থেকে বহিষ্কার কর। অন্যথায় তোমাদের গোটা গোত্রের কিন্তু রক্ষা নেই। শাবীব ইবনে বাজারাহ অবস্থা বেগতিক দেখে পুরোনো হত্যাযজ্ঞের পন্থা অবলম্বন করে। রাত হতে সে তরবারী হাতে দাঁড়িয়ে যায়। যাকে সামনে দেখে তাকে হত্যা করে ফেলে।

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহুর দায়িত্বপালন

এভাবে খারিজী দল বিভিন্ন সময় অব্যাহত বিশৃংখলা নৈরাজ্য ও অশান্তি সৃষ্টি করতে থাকে। আর ইরাকের পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণরূপে অশান্ত করে তোলে। মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু চিন্তা করেন, ইরাকে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করতে হলে দূরদর্শি লোকের প্রয়োজন। তাঁর দৃষ্টি পড়ে যিয়াদ ইবনে সুমাইয়াহ[14] ও মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহুর ওপর। তাঁরা উভয়েই ছিল দূরদর্শি রাজনীতিবিদ।

অবশেষে যখন মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু কুফার গভর্নর নিযুক্ত হন, তখন তিনি খালিদ ইবনে আরফাতার নেতৃত্বে এক শ সৈন্যের এক বাহিরী প্রেরণ করেন। ঐ বাহিনীর হাতে শাবীব ও তার অনুসারী সকলে নিহত হয় ৷

যিয়াদ ইবনে আবীহিকে বশ করতে মুআবিয়া রা.-এর কৌশল

প্রথম কৌশল : মুগীরাকে প্রেরণ

যিয়াদ ইবনে আবিহী ছিল শিয়ানে আলীর দলভূক্ত এবং তাদের পক্ষ থেকে পারস্যের গভর্নর। মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু পারস্যে তার শাসন ব্যবস্থা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তখন মুআবিয়ার পক্ষ থেকে কুফার গভর্নর ছিলেন মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু।

তিনি যখন তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন, যিয়াদের ওপর সন্দেহের কথা প্রকাশ করেন। মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু যিয়াদকে বশ করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন।

মুগীরা যিয়াদের নিকট গিয়ে তাকে বলেন, হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের দাবি ত্যাগ করার পর এখন তো খিলাফত মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাতে এসে গেছে। তাই তোমার জন্য মঙ্গল হল, তুমি তাঁর সাথে সমঝোতা করে নাও তিনি নিজেও এ নিয়ে আগ্রহী। সুতরাং তোমার প্রস্তাব পাশ হয়ে যেতে পারে।

যিয়াদ মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহুর প্রস্তাব মেনে নেয়। মুগীরার প্রত্যাবর্তনের পর মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু তার জন্য ‘নিরাপত্তা পত্র’ পাঠিয়ে দেন। যিয়াদ মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর দরবারে এসে হাজির হয়। তিনি তার নিকট পারস্যের আয়-ব্যয়ের হিসাব জানতে চান। যিয়াদ যে হিসাব পেশ করে, মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু তা সঠিক বলে মেনে নেন ৷

যিয়াদ মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট কুফায় অবস্থান করার অনুমতি চায়। মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু তার আবেদন মঞ্জুর করেন। কিন্তু মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট পত্র প্রেরণ করেন যে, যিয়াদ ও আলীর অন্যান্য অনুসারী যেমন—হাজার ইবনে আদী, সোলাইমান ইবনে সামার, শীছ ইবনে রিবঈ এবং ইবনুল কাওয়ারের প্রতি খুব সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। এ ঘটনা ৪২ হিজরীর ৷

দ্বিতীয় কৌশল : ‘যিয়াদ তো আমার ভাই’

৪৪ হিজরীতে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু যিয়াদকে নিজের ‘ভাই’ বলে স্বীকৃতি দেন। প্রকৃত রহস্য হল, যিয়াদের মাতা সুমাইয়া ছিল হারছ ইবনে কালদাহ তাবীব সাকাফীর দাসী। হারেছের কাছে থাকাবস্থায় সুমাইয়ার দুই পুত্র জন্ম হয়। আবু বাকরাহ ও নাফী। এরপর আবু সুফিয়ান সুমাইয়াকে জাহিলী যুগের নিয়ম[15] অনুযায়ী বিবাহ করে। যদিও তা প্রকারান্তে ব্যভিচার হত।[16] তার ঔরসে জন্ম হয় যিয়াদের। কিন্তু যিয়াদের সাথে আবু সুফিয়ানের এ সম্পর্ক গোপন থাকে। প্রকাশ করা হয়নি ৷ পিতা অজ্ঞাত হওয়ার কারণে তাকে ‘ইবনে আবীহি-নিজ পিতার পুত্র’ বলা হয়।

যিয়াদের পূর্বপরিচয় : উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু খিলাফত কালে যিয়াদকে কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। যিয়াদ সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে ফিরে এসে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর খেদমতে হাজির হয়ে অসাধারণ এক ভাষণ দান করে। যা ছিল বাগ্মিতা ও অলংকারে ঠাসা।

উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং উপস্থিত আনসার-মুহাজির সকলেই তার ভাষণে মুগ্ধ হয়ে যায়। তখন আমর ইবনুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলল, যদি এ কৃতদাসের পিতা কুরাইশ বংশের হত, তাহলে সে নিজের লাঠির শক্তি দিয়ে গোটা আরববাসীকে তাড়িয়ে দিত।

তখন আবু সুফিয়ান বলল, আমি জানি তার প্রকৃত পিতা কে?

এ ঘটনার দ্বারা প্রমাণিত হয়, আবু সুফিয়ান জীবদ্দশায় যিয়াদকে পুত্র বলে স্বীকৃতি দেয়নি।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু যিয়াদকে খুশি করতে উপস্থিত সাক্ষী দ্বারা তাকে নিজের বৈ-মাত্রীয়[17] ভাই বলে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর এ স্বীকৃতি জনসাধারণের সমর্থন লাভ করেনি। মূলত এ ঘোষণা তো করার কথা ছিল আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহুর। এ অধিকার একমাত্র তারই ছিল। উচিত ছিল, জাহিলী যুগেই তা ঘোষণার। কিন্তু এরপর নববী যুগ শেষ হয়ে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগের সমাপ্তি হল। আবু সুফিয়ানেরও ইন্তেকাল হল। তাই মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর জন্য এ অধিকার প্রয়োগের আর কোনো পথ বাকি ছিল না।

একবার যিয়াদ আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার নিকট একটা চিঠি পাঠায়। তার শুরুতে লেখা ছিল, “যিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ানের পক্ষ থেকে।…” তার ধারনা ছিল সম্ভবত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা তাকে এ নামে সম্বোধন করবেন। আর এটা তার জন্য বিরাট প্রমাণ হবে।

কিন্তু আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা প্রেরিত পত্রে লেখেন, “সকল মুসলমানের মাতা আয়েশার পক্ষ থেকে পুত্র যিয়াদের নামে ৷”[18]

তৃতীয় কৌশল : গভর্নর পদে নিয়োগ

৪৫ হিজরীতে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু যিয়াদকে বসরার গভর্নর নিযুক্ত করেন। সাবেক গভর্নর আবদুল্লাহ ইবনে আমেরের যুগে এখানের অবস্থা শোচনীয় আকার ধারন করে ছিল। তিনি অত্যন্ত কোমল স্বভাবের লোক ছিলেন। কারো প্রতি কঠোরতা আরোপ পছন্দ করতেন না।

অন্যদিকে বসরাবাসীগণ স্বভাবত গণ্ডগোল প্রিয় ছিল। কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া তাদেরকে দমন করা অসম্ভব ছিল।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি

গভর্নর হিসেবে যিয়াদ ইবনে আবীহি

যিয়াদ ৪৫ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের শেষ দিন বসরা আগমন করে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখতে পায়। সে বসরা আসা মাত্র কুফার জামে মসজিদে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেয় ৷ তার ঐ ভাষণকে ‘খুৎবায়ে তাবাররা-সংশোধনের ভাষণ[19]’ নামে অভিহিত করা হয়।

খুৎবায়ে তাবাররা

কথিত আছে, তিনি তার ভাষণে হামদ ও ছানা কিছুই পাঠ করেননি। ঐ ভাষণের অংশ বিশেষ নিম্নে উল্লেখ করা হল-

 অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতা ছোট বড় সকলকে ঘিরে আছে এবং তা চরম আকার ধারণ করেছে মনে হয় তোমরা যেন আল্লাহ তাআলার কিতাব দেখনি আর তাতে আনুগত্যকারীদের জন্য যে মহাপুরস্কারের ঘোষণা ও বিরোধিতাকারীদের জন্য যে কঠোর শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে, তা পাঠ করনি

তোমরা ইসলামে নতুন রীতি চালু করেছ ৷ দুর্বলদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে চলছে অথচ তোমরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছ না সমাজের অসহায়অক্ষম অবলা নারীদের সম্পদ দিনদুপরে লুণ্ঠিত হচ্ছে অথচ তোমরা তাদের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করছ না তোমাদের মাঝে কি এমন কেউ নেই, যারা লুণ্ঠন ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে পারে? তোমরা আত্মীয়তার কথা ভাব, অথচ দ্বীনের তোয়াক্কা কর না ৷

আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যদি অবস্থার পরিবর্তন না হয়, তাহলে কৃতদাসের স্থলে মনিবকে, মুসাফিরের স্থানে মুকিমকে, নাফরমানের পরিবর্তে আনুগত্যকারীকে, রোগীর বদলে সুস্থ্যদেরকে পাকড়াও করা শুরু করব এবং কঠোর শাস্তি দেব, কারো ঘরে ডাকাতি হলে আমি নিজে মাল উসুল করব আর যে ব্যক্তি রাতে চলা ফেরা করবে, তাকে মৃত্যুঘাঁটে পৌঁছে দেওয়া হবে হাঁ এতটুকু সময় থাকবে, যে সময়ের মধ্যে দিনে যারা কুফা শহর থেকে বাইরে গিয়েছিলে তারা ফিরে আসতে পারে এরপর আর কোনো অভিযোগ শোনা হবে না

আমি কারো মুখ থেকে জাহিলী যুগের কোনো কথা শুনতে চাই না নতুবা তার মুখ চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে তোমরা নতুন অপরাধ ও সন্ত্রাস তৈরি করলে আমিও নতুন শাস্তির বিধান প্রবর্তন করব

স্মরণ রেখো! যে কাউকে ডুবাবে, অপদস্থ করবে তাকেও ঠিক তাই করা হবে যে কাউকে আগুনে পুড়ে মারবে, তাকেও আগুনে পুড়ে মারা হবে যে কারো ঘরে চুরির জন্য সিঁধ কাটবে, তার তার বুকে সিঁধ কাটা হবে যে অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়বে, তাকে জীবিত কবর দেওয়া হবে তোমরা নিজেদের হাত ও যবানকে আমার থেকে বাঁচিয়ে রাখ, তাহলে আমি আমার হাত ও যবানকে তোমাদের থেকে পৃথক করে রাখব

এখানে বসবাসরত কোনো কোনো জাতির সাথে আমারও কিছু শত্রুতা রয়েছে কিন্তু আজ আমি দায়িত্ব পালনের খাতিরে তাদের সে শত্রুতা নিঃশেষের ঘোষণা করছি এরপরও যদি আমি জানতে পারি, কোনো ব্যক্তি আমার সাথে ব্যক্তিগত শত্রুতা পোষণ করার কারণে যক্ষা ধরিয়ে ফেলেছে, তাহলে আমি তার প্রতি হস্তক্ষেপ করব না কিন্তু এরপরও যদি সে প্রকাশ্যে আমার বিরোধিতা করে তাহলে আর ছাড়ব না তোমরা তোমাদের কর্মপন্থা ঠিক করে নাও আর সদাচারী হও, নিজেকে সাহায্য করো

কিছু লোক আছে, যারা আমার আগমনে ব্যথিত হয়েছে কিন্তু পরবর্তীতে তারাও খুশি হয়ে যাবে আর কিছু লোক আছে, তারা আমার আগমনে খুশি হয়েছে, কিন্তু বিশ্বাস কর, দিন শেষে তারা ব্যথিত ও দুঃখিত হয়ে যাবে

হে কুফার লোকেরা! আমি তোমাদের শাসক এবং তোমাদের সংরক্ষক তাই তোমাদের একান্ত কর্তব্য হল, আমার আনুগত্য করা এবং আমাকে সাহায্য সহায়তা করা

আমার কর্তব্য হল, তোমাদের প্রতি ইনসাফ ও ন্যায় বিচার করা সুতরাং তোমরা আমার কল্যাণকামী হয়ে আমার ইনসাফের যোগ্য হয়ে যাও

আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের মতো অনেককে আমার এ হাতে নির্মূল করে দিয়েছি, তা তোমরা নিজ চোখে দেখেছ সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য হল, আমাকে ভয় করা যে আমাকে ভয় করবে তাকে আমি নির্মূল করব না

যিয়াদের পুলিশ মোতায়ন ও অন্যান্য কাজ

যিয়াদ আবদুল্লাহ ইবনে হিসানকে শহরের পুলিশ প্রধান নিয়োগ করে। ইশার নামায অনেক বিলম্বে পড়া হত। যিয়াদ কোনো কারীকে নির্দেশ দিত, সে যেন কিরাতে সূরা বাকরার মতো দীর্ঘ সূরা পাঠ করে। নামাযের জন্য এ পরিমাণ অপেক্ষা করা হত, যাতে সে সময়ের মধ্যে লোকজন কুফার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছতে পারে৷

এরপর যিয়াদ আবদুল্লাহ ইবনে হিসানকে শহরে টহল দেওয়ার আদেশ দিত। আবদুল্লাহ ইবনে হিসান শহরে টহল দেওয়ার সময়, যাকে ঘরের বাইরে দেখত, তাকে হত্যা করে ফেলত।

যিয়াদের কঠোরতা

এক বেদুইনকে হত্যা : একদিন এক পুলিশ সদস্য একজন বেদুইনকে গ্রেফতার করে তাকে যিয়াদের সামনে হাজির করে। যিয়াদ তাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি ঘোষণা শোননি যে, রাতে বাইরে থাকা নিষেধ?

বেদুইন বলল, আল্লাহর কসম! আমি তো আমার ছাগলের পাল নিয়ে শহরের পথে রওয়ানা হয়েছি কেবল। রাস্তায় দিন ফুরিয়ে রাতের আগমন হয়ে গেল। তাই ছাগলের পাল নিয়ে শহরের এক কোনে রাত কাটানোর জন্য বসে পড়ি। যেন সময়-সুযোগমতো ফিরতে পারি।

কিন্তু আল্লাহর কসম! মহামান্য আমীরের আদেশ আমার জানা ছিল না।

যিয়াদ বলল, মনে হয় তুমি সত্য কথা বলছ। কিন্তু তোমাকে হত্যার মাধ্যমে উম্মতের সংশোধন আশা করা যায়।

এরপর তিনি সেই বেদুঈনকে হত্যা করে ফেলেন। যিয়াদের এ বিচারের পর কুফায় ত্রাস ও ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। ভ্রান্ত মতাবলম্বীরাও ফিতনা-ফাসাদ থেকে বিরত হয়ে যায়। শহরে শান্তি ও নিরাপত্তার সূচনা হয়। অবস্থা এমন হয় যে, যদি কারো হাত থেকে কোন কিছু পড়ে যেত তাহলে অপর লোক তা উঠাতে যেত না। যার জিনিস সে এসে তা উঠিয়ে নিত। দোকানদার নিজের দোকান খোলা রেখে বাড়ি চলে যেত, এতে তার বিন্দু মাত্র ক্ষতি হত না। কেউ দোকানের দিকে চোখ তুলেও তাকানোর সাহস পেত না।

যিয়াদের নমনীয়তা

কঠোরতার পাশাপাশি তিনি যথাসম্ভব নমনীয়তার সাথেও কাজ করতেন।

ঘটনা এক. বুহাইনা ইবনে কুরাইশকে একবার তিনি আদেশ দেন, যেন অমুক খারিজীকে গ্রেফতার করা হয়। সে ছিল ‘বনু সাদ’ গোত্রের লোক ছিল।

বুহাইনা গিয়ে তাকে গ্রেফতার করে। খারিজী লোকটা বুহাইনার নিকট ওযু করার আবেদন করে।

বুহাইনা বলল, তুমি যে ওযু করে ফিরে আসবে তার নিশ্চয়তা কি?

খারিজী বলল, আমি আল্লাহকে জামিনদার বানাচ্ছি।

এরপর খারিজী তার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী ওযু করে ফিরে আসে ৷ তাকে যিয়াদের সামনে পেশ করা হয়। যিয়াদ হামদ নাত পাঠ করে তিন খলীফার প্রশংসা বর্ণনা করেন। তারপর খারিজীকে সম্বোধন করে বললেল, তুমি আমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছ। তোমার এ কাজ আমাদের অপছন্দ হয়েছে।

খারিজী হামদ ছানা পাঠ করার পর প্রথম দুই খলীফার প্রশংসা করল। তারপর বলল, আপনার নিজ প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা উচিত। আপনি নিজেই তো বলেছিলেন, যে আমার সাথে আর কোনো মোকাবেলা করবেন না, বিরক্ত বা জিজ্ঞাসাবাদও করবেন না।

যিয়াদ নিজের ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং খারিজীকে অনেক উপহার ও উপঢৌকন দিয়ে বিদায় করে দেয়।

ঘটনা দুই. আরেকবার যিয়াদের মনে প্রভাবশালী এক খারিজী আবুল খায়ের সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। যিয়াদ তাকে ডেকে নিয়ে ‘জুন্দিসাবুর[20]’ নামক এক স্থানের শাসক নিয়োগ করেন। মাসিক ভাতা চার হাজার দিরহাম। এছাড়া বার্ষিক এক লাখ দিরহাম পুরস্কার।

তখনও সে খারিজী বলত, দলের অন্তর্ভূক্ত থাকা উত্তম কাজ ৷

আবুল আব্বাস মুবাররাদের[21] মতানুসারে যিয়াদ এমন খারিজীকে হত্যা করে ফেলতেন, যে ময়দানে এসে তার বিরোধিতা করত; কিন্তু যে গোপনে বিরোধিতা করত তার সাথে বিরোধ করত না। আর অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তরবারী উন্মুক্ত করত না।

কুফার গভর্নর পদে নিয়োগ

৫০ হিজরীতে কুফার গভর্নর মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু ইন্তেকাল করেন। এরপর কুফার শাসনভারও যিয়াদের ওপর ন্যাস্ত করা হয়। যিয়াদ ছয় মাস বসরায় অবস্থান করতেন আর ছয় মাস কুফায়।

কুফাবাসীদের পাথর নিক্ষেপের ঘটনা : যিয়াদ প্রথম যখন গভর্নর হিসেবে কুফায় আগমন করেন তখন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে এক ভাষণ দান করে। কুফায় বিশৃঙ্খল-প্রিয় লোকজন নিজেদের অভ্যাস অনুযায়ী তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করে।

যিয়াদ তাৎক্ষণাত মসজিদের দরজা বন্ধ করে দেয় এবং নিজে মসজিদের দরজায় এসে উপস্থিত হয়। এরপর আদেশ করে, চার চারজন করে মসজিদ থেকে বের হয়ে যাও। তবে বের হওয়ার সময় কসম খেয়ে বল, আমি আল্লাহর কসম! কোনো ধরনের পাথর নিক্ষেপ করিনি।

যে ব্যক্তি শপথ করে কংকর নিক্ষেপ করতে অস্বীকার করত তাকে ছেড়ে দিত, আর যে শপথ করতে বিলম্ব করত তাকে আটক করত। এভাবে ত্রিশ ব্যক্তিকে আটক করা হয়। এরপর তাদের সকলের হাত কেটে দেওয়া হয়।

এ ঘটনার পর যিয়াদ মসজিদে তার নিজের জন্য একটি হুজরা নির্মাণ করান৷

হুজর ইবনে আদীকে হত্যা

পরিচয় ও পূর্ব ঘটনা : হুজর ইবনে আদী ছিলেন কুফায় আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর সমর্থক। যখন হাসান ইবনে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুমা মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন, তখন সর্বপ্রথম তিনি হাসান ইবনে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুমার নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর এ কাজের জন্য ভীষণ অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছিল, “হে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্নেহের নাতি! আমার আজকের দিন দেখার আগে মরে যাওয়েই ভালো ছিল। আপনি আমাদেরকে ইনসাফের জগত থেকে বের করে যুলুমের দুনিয়ায় নিক্ষেপ করলেন।

এখন আমাদের সত্য ত্যাগ ও বাতিল গ্রহণে বাধ্য করা হয়। আপনি ছাড়া যা থেকে পালানো আমাদের জন্য সত্যিই অসম্ভব।

হাসান ইবনে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুমা উত্তরে বলেছিল, হুজর শোনো! আমি আমার অনেক সাথীকে সন্ধি করতে আগ্রহী দেখেছি। তারা যুদ্ধ করার বিপক্ষে ছিল। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা আমার অপছন্দ ছিল। আমার সাথীদের কল্যাণ এই সন্ধির মাঝে নিহিত ছিল। তাই আমি সন্ধি স্থাপনের মাধ্যমে তাদের রক্ত হেফাজত করলাম।

হুজর ইবনে আদী নিরাশ হয়ে তখন হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট উপস্থিত হন। তাকে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর মোকাবেলায় তরবারী উত্তোলন করার পরামর্শ দান করেন। কিন্তু হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, শোনো হুজর! আমরা বাইআত গ্রহণ করার পর তা ভেঙে ফেলতে পারি না।

হুজর নিরাশ হয়ে ফিরে আসেন ৷

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু কুফায় একজন সরলপ্রাণ নেককার ব্যক্তি ছিলেন। তথাপি তিনি মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর নির্দেশে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু নিন্দা ও উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর জন্য দুআ করত। হুজর ইবনে আদী এবং তাঁর সাথীদের নিকট এ কাজ ভীষণ অপছন্দ ছিল। তাই তাঁরাও জনসমাবেশে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর প্রশংসা এবং উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর দুর্নাম প্রচার করতে শুরু করে। মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের প্রতিঘাত-প্রতিবাদ করতেন না। বরং উপহার ও উপঢৌকন প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের মুখ বন্ধ করার প্রচেষ্টা করতেন।

হত্যার প্রেক্ষাপট : একদিন মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর জীবনের শেষ ভাষণ দান করছিলেন। হঠাৎ কোথা থেকে হুজর ইবনে আদী হাজির হয়। এসেই দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলতে শুরু করেন, এই লোক আমাদের ভাতা বন্ধ করে দিয়েছ। হে মুগীরা! তোমার কিন্তু এমন করার কোনোই অধিকার ছিল না। তুমি আমাদের ভাতা জারি করে দাও! আর আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর কুৎসা রটনা থেকে নিবৃত হও।

এরপর উপস্থিত জনসমাগমের দুই তৃতীয়াংশ লোক দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে, হুজর ইবনে আদী সত্য কথাই বলছেন। আমাদের ভাতা জারি করে দাও।

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু মিম্বারের নিচে নেমে আসেন। মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহুর এ কাজ তার সাথীদের অপছন্দ হয়। তারা তাঁকে বলল, আপনি হুজর ইবনে আদীকে অসন্তুষ্ট করলেন। এভাবে সরকারের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ থাকে না।

এদিকে আমীরুল মুমিন পর্যন্ত এ খবর পৌঁছে যায়। তিনিও এ ধরনের আচরণ পছন্দ করতেন না।

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তোমরা বুঝতে পারছ না। আমি তো হুজর ইবনে আদীকে হত্যা করতে পারতাম। আমার নমনীয়তার সুযোগে সে আমীরুল মুমিনীন ও তার অধীনস্থ দায়িত্বশীল ব্যক্তিবের্গের বিরোধিতায় অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। আমার পরে যে গভর্নর হবে, তখনও তা এ ধরনের আচরণ চলতে থাকবে। তখন তোমরা দেখবে, সেই গভর্নর তাকে হত্যা না করে ছাড়বে না।

আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত চলে এসেছে। হয়তো আজ ছিল আমার জীবনের শেষ ভাষণ। এ সময় এসে আমি চাই না, নিজের হাতকে এ শহরের বুযুর্গদের রক্তে রঞ্জিত করে তাদেরকে সৌভাগ্যবান করতে আর নিজেকে হতভাগা বানাতে।

গ্রেফতার প্রক্রিয়া : মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহুর এ ধারনা সঠিক ছিল। তাঁর পর ইবনে যিয়াদ কুফার গভর্নর নিযুক্ত হন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে তিনি বছরের ছয় মাস কুফায় অবস্থান করতেন আর বাকি ছয় মাস বসরায়। কুফায় তার অনুপুস্থিতির সময় এ ছয় মাস আমর ইবনে হুরাইস[22] তার প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করত।

ঘটনার শুরু : এক জুমায় আমর ইবনে হুরাইস খুৎবা দেওয়ার জন্য দাঁড়াল। তখন হুজর ইবনে আদী পুরোনো অভ্যাস অনুযায়ী তার প্রতি পাথর নিক্ষেপ করে। আমর ইবনে হুরাইস মিম্বর থেকে নিচে নেমে এসে নিজ মহলে ঢুকে পড়ে এবং ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

পরে এ ঘটনা বসরায় অবস্থানরত তার উচ্চপদস্থ অফিসার যিয়াদকে জানিয়ে দেয়। সেই সাথে সে আরো জানায়, হুজরের ঘরে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর মিথ্যা অনুসারী[23]রা সমবেত হয়ে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে অভিশাপ দেয়। যিয়াদ বসরা থেকে সেদিনই কুফায় আগমন করে কুফার কেন্দ্রী জামে সমজিদে এক ভাষণ দেয়। সে ভাষণে সে কুফাবাসীদের সরকার-বিরোধিতার পরিণতি সম্পর্কে ভয় দেখায়। এরপর হুজর ইবনে আদীকে তলব করে।

হুজর ইবনে আদী হাজির হতে অস্বীকার করেন। যিয়াদ তাকে পুলিশের মাধ্যমে তলব করে। পুলিশ তার বাড়িতে উপস্থিত হলে তার অনুসারীরা পুলিশকে গালা গালি করে।

যিয়াদ কুফাবাসীদের সমবেত করে দারুণ এক ভাষণ দেন। সেখানে তিনি বলেন—

তোমাদের অবস্থাও ভীষণ শোচনীয় হয়ে গেছে তোমরা এক হাতে মাথায় আঘাত করছ আর অপর হাতে তাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধছ তোমাদের দেহ আমার সাথে আর অন্তর হুজরের সাথে হয় তোমরা সংশোধন হয়ে যাও নতুবা দেহ থেকে মাথা ছিন্ন করে ফেলা হবে

কুফার বাসিন্দারা এতে ভীষণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। পরস্পর বলতে শুরু করে— আল্লাহ না করুন! আমরা তার আনুগত্য না করে ঘাড় নিয়ে বাড়ি ফিরব কী করে!

যিয়াদ কঠোর ভাষণে আরো নির্দেশ জারি করেন, সবাই হুজর ইবনে আদীকে বয়কট করবে। প্রত্যেকে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনকে হুজরের সাথে মিলিত হতে মানা করবে।

এভাবে হুজর ইবনে আদীর অধিকাংশ সমর্থক তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপরও যারা হুজরের একান্ত খাস অনুচারী ছিল তারা তার সাথেই ছিল। যিয়াদ তাদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। হুজরকে তখনো তিনি গ্রেফতার করেননি। তাকে ধরার জন্য কিছু সাক্ষী-প্রমাণের অপেক্ষা করেন।

এরপর যিয়াদ হুজরের বিরুদ্ধে কুফার সম্ভ্রান্ত শ্রেণির সাক্ষী গ্রহণ করে। তারা প্রকাশ্যে সাক্ষ্যতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসে—

হুজর ও তার সমর্থকরা খলীফাকে গালি দেওয়ায় অভ্যস্ত, তারা সরকার বিরোধী। এ জন্য তারা পৃথক এক দলও গঠন করেছে।

হত্যা : যিয়াদ এবার সাক্ষ্য মোতাবেক প্রথমে হুজর ইবনে আদীকে গ্রেফতার করেন। এরপর হুজরসহ ১৪ জন বন্দি এবং সাক্ষীগণ সবাইকে দামশকে খলীফার কাছে পাঠিয়ে দেন। সাথে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে এ মর্মে চিঠি লিখে দেন যে, এসব লোকই ইরাকের অশান্তির কারণ। তাদেরকে হত্যা করে দেওয়া হলে ফিতনা সমূলে উৎপাটিত হয়ে যাবে।

আমীর মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু যিয়াদের পাঠানো সাক্ষীদের বক্তব্য শুনে হুজর ইবনে আদী ও তার সাতজন সমর্থককে হত্যা করে ফেলেন। বাকি ছয়জন যারা স্বীয় অভ্যাস পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেয়, তাদের ছেড়ে দেন।

আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার সুপারিশ : আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা যখন হুজর ইবনে আদীকে গ্রেফতার ও দামশকে প্রেরণের খবর অবগত হন তৎক্ষণাত তিনি আবদুর রহমান ইবনে হারেছের মাধ্যমে এক সুপারিশনামা লিখে পাঠান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আবদুর রহমান দামেশক পৌঁছার পূর্বে হুজরকে হত্যা করে ফেলা হয় ৷

হুজর ইবনে আদীর হত্যা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ছিল। মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু যা করার করেছেন। কিন্তু পরে এর জন্য তিনি নিজে আক্ষেপ করেছেন। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার দূত আবদুর রহমান তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে মুআবিয়া! হুজরকে হত্যা করার সময় আপনার বংশগত ধৈর্য ও সহনশীলতা কোথায় চলে গিয়েছিল?

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, যখন আপনাদের মতো ধৈৰ্য্যশীল লোকজন আমার নিকট থেকে দূরে সরে যায়, তখন আমাকে ইবনে সুমাইয়ার মতো লোকের কথা বাধ্য হয়ে মানতে হয়।”

পরবর্তীতে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার খেদমতে হাযির হলে তিনিও তাঁকে ঐ প্রশ্ন করেন। তিনি জবাব দেন, তখন আমার কোনো বুদ্ধিমান পরামর্শ দাতা ছিল না ৷

যিয়াদের মৃত্যু

৫৩ হিজরীতে যিয়াদের মৃত্যু হয়।

ঐতিহাসিক ইবনে আছীর[24] বলেন, যিয়াদ মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে লিখেছিল, আমি আমার বাম হাত দিয়ে পুরো ইরাক (কুফা ও বসরা) নিয়ন্ত্রণ করে নিয়েছি। আমার ডান হাত এখনো খালি রয়ে গেছে। আমাকে হিজাজের দায়িত্ব দিয়ে এই হাতটাও পূর্ণ করে দিন।

বাস্তবেই তিনি এর যোগ্য ছিলেন। মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে হিজাজের দায়িত্ব দিয়ে একটা ঘোষণাপত্রও লিখেছেন।

হিজাজবাসী এ খবর শোনার পর কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। তাদের এক প্রতিনিধি দল আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমার খেদমতে হাজির যিয়াদের ব্যাপারে অভিযোগ পেশ করে।

ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা কিবলামুখী হয়ে আল্লাহ তাআলার দরবারে দুআ করেন, হে আল্লাহ! আমাদেরকে যিয়াদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করুন।

তার এ দুআ আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই যিয়াদের ডান হাতের আঙ্গুলে প্লেগের গুটি দেখা দেয়। তাতেই সে মারা যায়।

তার মৃত্যুর সংবাদ যখন ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমার নিকট পৌঁছলে তিনি বললেন, আফসোস! হে ইবনে সুমাইয়া! তুমি না আখিরাত লাভ করেছ আর না তোমার জন্য দুনিয়া বাকি রয়েছে।

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাসন ব্যবস্থা ছিল নম্র ভদ্র। তিনি সন্ধিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। লোকদের ক্ষমা করতে পছন্দ করতেন। বিরোধিদের পিছনে পড়া তাঁর অপছন্দ ছিল।

জনগণ তার নিকট এসে অভিযোগ করত, অমুক ব্যক্তি খারিজী মতবাদে বিশ্বাসী; অমুক ব্যক্তি শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী। তিনি এ বলে তাদেরকে বিদায় করে দিতেন যে, আল্লাহ তাআলার হিকমতও তাঁর ইচ্ছার বহিজরীপ্রকাশ যে, তিনি তাঁর বান্দাদের ধ্যান-ধারনা বিরোধপূর্ণ করে দিয়েছেন। তিনিই কিয়ামতের দিন তাদের মতবিরোধের মীমাংসা করবেন।

খারিজীদের নতুন ষড়যন্ত্র

আদি অভ্যাস : কিন্তু মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহুর এ নীতি সত্ত্বেও কি খারিজীরা নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকবে? তারা তো সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুমকে হত্যা করতে সিদ্ধহস্ত ছিল। এত নরম নীতিতে কি তারা বসে থাকার লোক ছিল? তারা শান্তি, নিরাপত্তা ও আনুগত্য করাকে যেন গুনাহের কাজ মনে করত। আর ফিতনা-ফাসাদ ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করা ছিল তাদের নিকট অনেক পূণ্যের কাজ৷

খারিজীদের নতুন উদ্যেম : তারা মুস্তাওরিদ ইবনে আলকামা[25]কে তাদের নেতা বানিয়ে পুনরায় মোকাবেলা করার প্রস্তুতি শুরু করে। কুফা নগরীর হাইয়্যান ইবনে জাবয়ানে[26]র ঘরে গোপন পরামর্শ হত।

খারিজীদের নতুন সিদ্ধান্ত : ৪3 হিজরীর দিকে তাদের সিদ্ধান্ত হয় যে, ঈদুল ফিতরের দিন ময়দানে বের হতে হবে।

খারিজীদের বিরুদ্ধে তাঁর প্রথম পদক্ষেপ

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের এ গোপন পরামর্শের খবর অবগত হন। তার পুলিশ বাহিনী হাইয়্যানের ঘর চতুর্দিক থেকে অবরোধ করে ফেলে। মুস্তাওরিদ ও তার কয়েকজন অনুচর পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বাকিরা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে যায় ৷

এরপর মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু কুফাবাসীদের একত্রিত করে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। তাতে তিনি খারিজীদের বিশৃংখলা দমনের উদ্দেশ্যে সকলের সাহায্য কামনা করেন।

দ্বিতীয় অভিনব পদক্ষেপ

মাকিল ইবনে কায়েস রিবাহী[27] বললেন, মহামান্য আমীর! আমার খেয়াল এই যে, প্রত্যেক গোত্রের সরদার নিজ নিজ গোত্রের যিম্মাদারি নেবে। আমি আমার গোত্রের যিম্মাদারি গ্রহণ করলাম।

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু তার এ প্রস্তাব সমর্থন করেন এবং প্রত্যেক গোত্রের সরদারকে নির্দেশ দেন, তারা যেন নিজ নিজ গোত্রের লোকদের ফিতনার আগুন থেকে বাঁচিয়ে রাখে।

সকল গোত্রের সরদারগণ এ আদেশ মেনে নেন এবং গোত্রের লোকদের আল্লাহর শপথ দিয়ে বিশৃংখলা থেকে বিরত রাখেন ৷

খারিজীদের পুনঃপ্রস্তুতি : মুস্তাওরিদ কুফা থেকে বের হয়ে পুনরায় তার অনুচরদের সমবেত করে মোকাবেলার প্রস্তুতি শুরু করে।

মুস্তাওরিদ ঐ সময় ‘আবদে কায়েস’ গোত্রে[28]র সালিম ইবনে মামদুজে[29]র ঘরে আশ্ৰয় নেয়।

আবদে কায়েস গোত্রের ঘটনা : সাআসা ইবনে সাওহান আবদী[30] ছিলেন এ গোত্রের সরদার। তিনি নিজ গোত্রে আসেন এবং এক জোরালো ভাষণ দান করে গোত্রের লোকদের ফিতনা থেকে বিরত থাকার আহবান জানান।

গোত্রের সবাই সাআসার এ আবেদন মেনে নেয় এবং খারিজীদের সাথে সম্পর্ক না রাখার শপথ গ্রহণ করে।

মুস্তাওরিদ যখন গোত্র প্রধান সাআসার তৎপরতা সম্পর্কে অবগত হয়, তখন সেখান থেকে জলদি বিদায় হয়ে যায়।

তৃতীয় পদক্ষেপ

ধাওয়া ও আক্রমন প্রস্তুতি : অন্যত্র গিয়ে মুস্তাওরিদ তার লোকদের সংগঠিত করতে থাকে। তিন শ লোকের এক বাহিনী নিয়ে মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে সাওরা থেকে সূরাত অভিমুখে যাত্রা করে।

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন তাদের এ যুদ্ধ-যাত্রার খবর সম্পর্কে অবগত হন, তিনি কুফার সরদারদের নিয়ে পরামর্শ সভা করেন।

পরামর্শে দুটি বক্তব্য সামনে আসে।

প্রথম বক্তব্য : আদী ইবনে হাতিম[31] বললেন, হে আমাদের আমীর! আমরা সকলে তাদের ওপর অসন্তুষ্ট এবং আপনার আজ্ঞাবহ। আপনি যখনই আদেশ করবেন, তখনই আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বেরিয়ে পড়ব।

দ্বিতীয় বক্তব্য : মা‘কিল ইবনে কায়েস বলল, এখন কুফার সব অভিজাত লোকজন আপনার অনুগত এবং সে সব অত্যাচারীদের দুশমন। কিন্তু আমি সকলের আগে আগে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত আছি। আমাকে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দেওয়া হোক।

আক্রমন সিদ্ধান্ত : পরামর্শে সবার আনুগত্য প্রকাশ পাওয়ায় আক্রমনের সিদ্ধান্ত হয়।

মুগীরা ইবনে শোবা রাযিয়াল্লাহু আনহু তিন হাজার শিআ মতাবলম্বীদের মনোনীত ব্যক্তি মা‘কিল ইবনে কায়েসের নেতৃত্বে মুস্তাওরিদের মোকাবেলায় পাঠান।

আবু রিদাগ[32] তিন শ সৈন্যের এক দল নিয়ে মুকাদ্দামাতুল জুয়ুশ-অগ্রবর্তী বাহিনী হিসেবে আগে যাত্রা করেন। উভয় পক্ষের মাঝে একাধিক স্থানে সংঘর্ষ হয়। তাতে খারিজী দল বিজয়ী হয়।

অবশেষে ‘দাইলামা’[33] নামক স্থানে কঠিন যুদ্ধ হয়। উভয় দলই বীরত্বের সাথে প্রাণপণে যুদ্ধ করে।

ততক্ষণে মা‘কিলের বিরাট বাহিনী ময়দানে উপস্থিত হয়ে যায়। মুস্তাওরিদ ও মা‘কিল উভয়ে পরস্পরে সম্মুখ যুদ্ধে মুখোমুখি এসে যায়।

যুদ্ধের চরম উত্তেজনাকর মুহূর্তে মুস্তাওরিদের নিক্ষিপ্ত বর্শা মা‘কিলের বুকে এসে বিঁধে। তৎক্ষণাত মা‘কিল মুস্তাওরিদকে আক্রমন করে বসে। মা‘কিলের তরবারীর আঘাতে মুস্তাওরিদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

এ যুদ্ধে পাঁচজন খারিজী ছাড়া আর কেউ জীবিত থাকেনি। কিছুদিনের জন্য খারিজীদের দৌরাত্ম স্তিমিত হয়ে যায় ৷

মৃত্যু

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু সাত বছর কয়েক মাস কুফায় গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। ৫০ হিজরীতে তাঁর ওফাত হয়।

এরপর বসরাকে কুফার সাথে যিয়াদের শাসনাধীন করে দেওয়া হয়। যার আলোচনা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

মুগীরা রাযিয়াল্লাহু আনহুর গুণাবলি

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু কোমল স্বভাব, সন্ধিপ্রিয় ও বিচক্ষণ শাসক ছিলেন।

তিনি নিজেই বলতেন, আমি কুফাবাসীদের রক্ত-গঙ্গা বইয়ে দিয়ে তাদেরকে সৌভাগ্যবান আর নিজেকে হতভাগা বানাতে চাইনি। আমি সৎ লোকদের প্রতিদানে সদাচরণ করতে ইচ্ছুক। যে ভুল করবে তাকে আমি ক্ষমা করতে প্রস্তুত।

আমি উত্তম স্বভাবের লোকদের প্রশংসা করব, আর নির্বোধ লোকদের বুঝানোর চেষ্টা করব। এভাবেই একদিন ভাগ্যের হাত তাদের ও আমার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাবে।

আমার পর কুফাবাসীদেরকে অনেক শাসকের সম্মুখীন হতে হবে। তখন তারা আমাকে স্মরণ করবে।

তার সম্পর্কে বড়দের উক্তি

এক. তার ইনতেকালের পর কুফার জনৈক শায়খ বলেছিলেন, আল্লাহর কসম! আমরা তার ব্যাপারে গভীর পর্যবেক্ষণ করে তাকে উত্তম শাসক হিসেবে পেয়েছি। তিনি সদাচরণ কারীদের প্রশংসা করতেন, অপরাধীদের ক্ষমা করতেন। অপারগতা প্রকাশকারীর ওযর গ্রহণ করতেন।

দুই. ইমাম শাবী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহুর মতো উত্তম শাসক আর পাওয়া যাবে না। তিনি শেষ কাতারের সালেহীনদের অন্তর্ভূক্ত। যদিও আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে কথা বলাও উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর জন্য নেকদুআ করা তার অভ্যাস ছিল। কেননা সে যুগে বনু উমাইয়াদের হিতাকাংখী ও আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর অনুসারী উভয়ে এ ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। তারা কোনো দলই একে অপরের কুৎসা রটনা করা দোষণীয় মনে করত না।[34]

উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ[35]

দায়িত্বপ্রাপ্তি

যিয়াদের মৃত্যুর পর মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে খোরাসানের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। ৫৫ হিজরীতে উবাইদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে গাইলান[36]কে ইস্তেফা দিয়ে উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে বসরার শাসনকর্তা নিয়োগ করা হয়।

যিয়াদের মৃত্যুর পর পুনরায় খারিজী দলের আবির্ভাব দেখা দেয়। উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ স্বীয় পিতা থেকেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

ইবনে যিয়াদের কঠোরতা

ঘটনা : এক.

উরওয়ার উপদেশ : কথিত আছে, একবার সে ঘোড়দৌড়ে অংশ গ্রহণ করে। ঘোড়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এমন সময় উরওয়াহ ইবনে আদীরাহ[37] সুযোগ মনে করে তাকে উপদেশ দেওয়া শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনি পবিত্র কুরআন কারীমের নিম্নোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করতে শুরু করেন—

اَتَبۡنُوۡنَ بِکُلِّ رِیۡعٍ اٰیَۃً تَعۡبَثُوۡنَ ، وَتَتَّخِذُوۡنَ مَصَانِعَ لَعَلَّکُمۡ تَخۡلُدُوۡنَ، وَاِذَا بَطَشۡتُمۡ بَطَشۡتُمۡ جَبَّارِیۡنَ ۚ.

তোমরা কি প্রতিটি উঁচু স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার অহেতুক কাজ করছ। আর তোমরা এমন শিল্পমণ্ডিত ইমারত নির্মাণ করছ, যেন তোমরা চিরজীবী হয়ে থাকবে। আর যখন কাউকে ধৃত কর, তখন তাকে ধৃত কর কঠোর অত্যাচারীরূপে।[38]

উবাইদুল্লাহর পদক্ষেপ : উরওয়াহ খারিজী মতাবলম্বী ছিলেন। উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ বুঝতে পারে, তার পেছনে বিরাট শক্তিশালী দল রয়েছে। এ কারণেই হয়ত সে তার সামনে এমন বেয়াদবিমূলক বক্তব্য পেশ করেছে। উবাইদুল্লাহ ঘোড় দৌড় ছেড়ে দিয়ে তৎক্ষণাত ময়দান ত্যাগ করে। উরওয়াহকে গ্রেফতার করার নির্দেশ জারি করে।

উরওয়াহকে বন্দি করে নিয়ে আসার পর তার হাত পা কেটে দেওয়া হয়। এরপর ইবনে যিয়াদ তাকে জিজ্ঞেস করে, এখন তোমার কী ধারণা হচ্ছে?

উরওয়াহ বলল, আপনি আমার দুনিয়া ও আপনার পরকালকে বরবাদ করে দিয়েছেন।

এরপর ইবনে যিয়াদ তাকে হত্যা করার আদেশ করে। সঙ্গে তার কন্যাকেও হত্যা করে দেওয়া হয় ৷

ঘটনা : দুই.

এক মহিলার কুৎসা রটানো : ‘বনু ইয়ারবু’[39] গোত্রের এক মহিলা ইবনে যিয়াদের নামে অপবাদ ছড়িয়ে বেড়াত। গ্রাম্য মহিলাদের অভ্যাস যা হয় আরকি।

ইবনে যিয়াদ তাকে তলব করে। লোকজন তাকে আত্মগোপন করার পরামর্শ দেয়। সে মহিলা বলল, আমি নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য অন্যদের বিপদে ফেলতে চাই না।

ইবনে যিয়াদের শাস্তি : মহিলা ইবনে যিয়াদের সামনে হাজির হল। ইবনে যিয়াদ তারও হাত-পা কেটে হত্যা করে ফেলে।

খারিজীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ

গণহারে গ্রেফতারের নির্দেশ : ইবনে যিয়াদ দায়িত্বপালনের কিছুদিন পরই খারিজীদের গণহারে গ্রেফতার করার নির্দেশ জারি করেন। কয়েদি দিয়ে কারাগার পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

একজন আমানতদার কয়েদি : উরওয়াহ ইবনে আদীরার ভাই আবু হেলাল মিরদাসও বন্দি হয়৷ মিরদাস বড় ইবাদতগুজার ব্যক্তি ছিলেন। কারাগারের দারোগা তাকে প্রত্যেকদিন রাতে বাড়ি চলে যাওয়ার এবং সকালে ফিরে আসার অনুমতি দেন। এক রাতে ইবনে যিয়াদের মজলিশে খারিজীদেরকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঐ মজলিশে মিরদাসের এক বন্ধুও উপস্থিত ছিল। সে তার বন্ধুকে এ খবর জানিয়ে দেয় যে, তোমাদেরকে হত্যা করার আদেশ জারি করা হয়েছে। কিন্তু মিরদাস তার অভ্যাস অনুযায়ী কারাগারে পৌঁছে যায়।

কারাগারের দারোগা মিরদাসকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কি আপনার হত্যার খবর জানতে পারেননি?

মিরদাস বলল, আমি হত্যার নির্দেশ জারির খবর জানতে পেরেছি। তবে আমি আমার হিতাকাঙ্ক্ষি বন্ধুকে বিপদে ফেলতে চাই না।

মিরদাসের জবাব শুনে কারাগারের দারোগা প্রভাবান্বিত হয়ে যায়। সে ইবনে যিয়াদের নিকট সুপারিশ করে মিরদাসের জীবন বাঁচিয়ে দেয়।

এরপর মিরদাস ‘আহওয়াজ[40]’ শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায়।

খারেজী মিরদাসের অভিনব পন্থা : ‘আহওয়াজ’ শহরে পৌঁছে মিরদাস বিশেষ এক কর্ম পন্থা অবলম্বন করে। যখন সরকারী কর উসুলকারী ধন-সম্পদ নিয়ে রাজকোষে জমা দেওয়ার জন্য রওয়ানা হত, তখন সেখান থেকে মিরদাস তার নিজের সাথীদের ভাতা পরিমাণ অর্থ ছিনিয়ে নিত। আর বাকি অর্থ রেখে দিত।

ইবনে যিয়াদ তার সাথে মোকাবেলা করার জন্য আসলাম ইবনে জুরআ [41] নেতৃত্বে দুই হাজার সৈন্যের এক বহিনী প্রেরণ করে।

মিরদাস চল্লিশ জন সঙ্গীর সাহায্যে দুই হাজার সৈন্যে বাহিনীকে সম্পূর্ণ নাস্তানাবুদ করে দেয় ৷

উপসংহার : ইবনে যিয়াদ খারিজীদের বিদ্রোহের আগুন কখনো শাস্তির তরবারী দিয়ে স্তিমিত করতে সক্ষম হয়নি।[42]

অন্যান্য স্থানের শাসনকর্তা

মিশরের গভর্নর

মিশর বিজয়ী গভর্নর ছিলেন সেখানকার অবস্থা বিশেষজ্ঞ ও শান্তি-শৃংখলা কায়েমকারী দক্ষ রাজনীতিবিদ আমর ইবনুল আস[43] রাযিয়াল্লাহু আনহু। ৪৩ হিজরীতে তাঁর ইনতেকাল হয়।

তাঁর ইনতেকালের পর তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা মিশরের গভর্নর নিযুক্ত হন।

এরপর তাকে অপসারণ করে অপর একজনকে মিশরের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়৷ তার সম্পর্কে সামনে আলোচনা করা হবে।

হিজাজের গভর্নর

হিজাজের শাসনকর্তার পদ ‘বনু উমাইয়া’দের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত ছিল। কখনো মাওয়ান ইবনে হাকামকে মদীনার শাসনকর্তা মনোনীত করা হত। আবার কখনো সাঈদ ইবনে আসকে মনোনীত করা হত।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর নীতি ছিল, তিনি ‘বনু উমাইয়া’ গোত্রের নতুন কাউকে শাসনকর্তা নিয়োগ করলে প্রথমে তাকে তায়েফের শাসনকর্তা নিয়োগ করতেন। এখানে শাসনকার্যে সফল হলে তাকে এর সাথে মক্কার দায়িত্বও দেওয়া হত। সেখানেও সফল হলে তার ওপর মদীনার শাসনভারও ন্যাস্ত হত ৷

মদীনার গভর্নর সাধারণত আমীরে হজ্জের দায়িত্ব পালন করতেন।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর হজ্জ্ব পালন

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজ খিলাফতের যুগে দু-বার হজ্জ আদায় করতে পেরেছেন। প্রথমবার ৪৪ হিজরী, দ্বিতীয়বার ৫০ হিজরী।

জয় ও সীমানা বৃদ্ধি

পূর্বাঞ্চল

আমীরে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে পূর্বাঞ্চলে খূব সীমিত বিজয় লাভ হয়। পূর্বাঞ্চলে সর্বদা বিদ্রোহ চলতে থাকে।

কীকান আক্রমন

আবদুল্লাহ ইবনে সাওয়ার আবদি[44] যিনি সিন্ধু এলাকায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি দুবার ‘কীকান’ নামক স্থানে এলাকায় আক্রমণ করেন। দ্বিতীয়বার কীকনবাসী তুর্কিদের সাহায্যে তাকে হত্যা করে ফেলে।

সিন্ধু আক্রমন

৪৪ হিজরীতে মুহাল্লাব ইবনে আবি সুফরা[45] সিন্ধু এলাকায় আক্রমণ করেন। তিনি কাবুল[46] ও মুলতানের[47] মাঝে অবস্থিত তিব্বত[48] ও লাহোর[49] দখল করে নেন। এখানে শত্রুদের সাথে তাঁর মোকাবেলা হয়।

একবার বারো জন তুর্কি অশ্বারোহী মুহাল্লাবকে ঘেরাও করে ফেলে। তিনি একাই তাদের সকলকে হত্যা করেন।

উত্তর অঞ্চল

সে সময় মুসলমানদের বেশি মনোযোগ ছিল উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলেন দিকে। সেখানে পুরাশক্তি রোমানদের রাজত্ব ছিল। তারা বারবার মুসলমানদেরকে তাদের সাথে মোকাবেলা করার আহবান করছিল।

রোম বিজয়

রোমান দুই শাসক : রোমান শাসকদের মধ্যে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর সমসাময়িক দুজন বাদশাহ ছিল—

এক. কুসতুনতীন ইবনে দ্বিতীয় হিরাক্লিয়াস (দ্বিতীয়)। তার রাজত্বকাল ছিল ৬৪১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।

দুই. কুসতুনতীন বেগানাকাস (চতুর্থ)। তার রাজত্বকাল ছিল ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৮৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর প্রস্তুতি : উভয় বাদশাহের শাসনামলেই মিশর ও সিরিয় সীমান্তে রোমান ও মুসলমানদের মাঝে অনবরত খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু স্থল ও সামুদ্রিক উভয় দিক থেকে তাদের মোকাবেলা করার ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

নৌ প্রস্তুতি : নৌপথে আক্রমণ পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিনি ব্যাপক নৌবাহিনী গঠন করেন। সতেরো শ জাহাজের বিশাল এক বাহিনীকে সর্বদা সতর্ক রাখা হয়। এসব জাহাজ প্রস্তুতের জন্য সিরিয়াতে জাহাজ তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়। কাঠ সরবরাহ করা হয় লেবাননের পাহাড় থেকে।

নৌ সাফল্য : মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর এই নৌবাহিনী রোম সাগর অতিক্রম করে উপর্যোপুরী আক্রমণ করে ইসলামী সম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি করে। সাইপ্রাস[50]সহ বেশ কয়েকটি দ্বীপ যেমন, ইউনান[51] ও রোডাস দ্বীপ[52] পর্যন্ত বিজয় গৌরব অর্জন করে।

নৌ ঘাঁটি স্থাপন : এসব দ্বীপে নৌবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। পরবর্তী তা অনেক সুফল বয়ে আনে।

এরা রোমানদের জাহাজকে ইসলামী এলাকার দিকে অগ্রসর হতে বাঁধা দিত। মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু নৌ-বাহিনীর বেতনভাতা বাড়িয়ে দেন।

স্থল প্রস্তুতি : স্থলপথে মোকাবেলার উদ্দেশ্যে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু সাওয়াতী ও সাওয়াইক নামে দুটি পৃথক বাহিনী গঠন করেন। গ্রীষ্মকালের যুদ্ধাদেরকে সাওয়াতী বলা হত। আর শীতকালীন যুদ্ধাদেরকে সাওয়ায়িক বলা হত। এভাবে সর্বদা অব্যাহত আক্রমণ চলতে থাকে। ফলে দুশমনদের ইসলামী সম্রাজ্যের সীমানায় আসার আর সাহস হত না ৷

কনসটান্টিনোপল[53] আক্ৰমণ

৪৯ হিজরীতে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু পূর্বাঞ্চলীয় রোমান রাজধানী কনসটান্টিনোপল আক্রমণ করার জন্য বিরাট এক বাহিনী গঠন করেন। বহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন, সুফিয়ান ইবনে আউফ।

‘ফারকাদুনা’[54] নামক স্থানে ঐ বাহিনী জ্বর ও বসন্তে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজ ছেলে ইয়াযিদকেও ঐ বাহিনীতে যোগদান করার নির্দেশ প্রদান করেন।

সে অসুস্থতার ওযুহাত দেখিয়ে যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত থাকে। মুজাহিদ বাহিনীর রোগাক্রান্ত হওয়ার খবর জানতে পেরে সে একটি মাহফিলে এ কবিতা রচনা আবৃত্তি করে—

ما أن أبالي بما لاقت جموعهم

بالفرقدونة من حُمی ومن موم

إذا اتكأت على الأنماط مرتفقاً

بدیر مران عندي أم كلثوم

ফারকাদুনায় যুদ্ধরত লোকদের জ্বর ও বসন্ত হয়ে যাক!

তাতে বল, আমার কী আসে যায়?

আমি তো আনমাতে বালিশে হেলান দিয়ে

উম্মে কূলসমের সাথে গালিচার ওপর বসা।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু ইয়াযিদের এ অবস্থা জানার পর শপথ করে বললেন, আল্লাহর কসম! ইয়াযিদকে অবশ্যই রোম সম্রাজ্যে যেতে হবে। আজ মুসলিম বাহিনী যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছে, তাতে তাকেও অংশগ্রহণ করতে হবে।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর এ আদেশের পর আরেকটি দল যারা প্রথম দলের নুসরাতের জন্য রওয়ানা হচ্ছিল। তাদের সাথে তিনি ইয়াযিদকেও যাওয়ার হুকুম দিরেন। ইয়াযিদ ছাড়াও প্রবীন খ্যাতনামা সাহাবী আবু আইয়ূব আনসারী, ইবনে আববাস, ইবনে উমর, ইবনে যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুম এ কাফেলায় যোগদান করেন।

বাহিনী স্থলপথে ‘বসফরাস’[55] উপকূলে পৌঁছে। তাছাড়া নৌপথে বুসর ইবনে আরতাতে[56]র নেতৃত্বে আরেক দল সৈন্য যাত্রা করে। তারা ‘রোদবার দানিয়াল’[57] নামক এলাকা অতিক্রম করে কনসটান্টিনোপলের প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

রোমানদের প্রস্তুতি ও আক্রমন : রোমান শাসক কনসটান্টিনোপল রক্ষার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। গ্রীক মারাণাস্ত্র দিয়ে মুসলমানদের ওপর আগুনের গোলা বর্ষণ করতে থাকে।

মুসলমানগণ বিভিন্ন স্থানে নানা প্রতিকূলতায় জীবন বাজি রেখে আগুন ও রক্তের খেলা খেলতে থাকে। আব্দুল আজিজ বিন জুররাহ আল-কালাবী[58]র অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তিনি শাহাদাত লাভের আশায় বারবার সামনে অগ্রসর হয়ে শত্রুদের তুলার মতো উড়িয়ে দিতেন।

অবশেষে রোমান বাহিনী তাকে চতুর্দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে এবং বর্শা নিক্ষেপ করে তার পুরো দেহ চালনির মতো ছিদ্র করে ফেলে। এ অবস্থায় তিনি শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন।

এরপরও মুসলিম বাহিনী কনসটান্টিনোপলের সুউচ্চ মহল জয় না করেই ফিরে আসতে বাধ্য হয়। এর প্রাচীর ছিল বেশ উঁচু ও মজবুত। সেখান থেকে বারবার শত্রু বাহিনীর বাধা আসছিল। তাই তা জয় না করে ফিরে চলে আসে।

এ যুদ্ধে মুসলিম বহিনী এবং তাদের যুদ্ধ জাহাজের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।

আবু আইয়ূব আনসারী রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনার মেজবান আবু আইয়ূব আনসারী রাযিয়াল্লাহু আনহু এ যুদ্ধ চলাকালে ইনতেকাল করেন। তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে কনসটান্টিনোপলের প্রাচীরের নিচে দাফন করা হয়।

সাহাবীর কবরের প্রভাব : রোমান শাসকগণ তাদের রাজত্বকালে তাঁর কবরের নিকট হাজির হয়ে বৃষ্টি ইত্যাদির জন্য প্রার্থনা করত। উসমানী খিলাফতের যুগে কন্সটান্টিনোপলের বিজয়ের পর তাঁরা তার কবরের ওপর গম্বুজ নির্মান করেন এবং কবরের পাশে বিরাট এক শানদার মসজিদ তৈরি করেন। উসমানী খলীফাদের মুকুট পরিধানের অনুষ্ঠান ঐ মসজিদে অনুষ্ঠিত হত।

পশ্চিম অঞ্চল

উত্তর অঞ্চলের পাশাপাশি মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু পশ্চিম অঞ্চল তথা মিশর ও আফ্রিকার দেশগুলোর প্রতিও দৃষ্টি দেন। এবং ব্যাপক সাফল্য অর্জন হয়।

আফ্রিকা বিজয়

আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা মিশর ও আফ্রিকার আরো বেশ কিছু অঞ্চলে দুবছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এরপর ৪৭ হিজরীতে তাকে ইস্তেফা দেওয়া হয়। তার স্থানে মুআবিয়া ইবনে হুদায়জ[59]কে শাসক বানানো হয়।

৫০ হিজরীতে মুআবিয়া ইবনে খাদীজকে ইস্তেফা দিয়ে উকবা ইবনে নাফে আল-ফিহরি[60]র ওপর এ অঞ্চলের শাসনভার ন্যস্ত করা হয়।

উকবার পূর্ব পরিচিতি : উকবা আমর ইবনুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহুর যুগে আফ্রিকায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ‘বার্কা’[61] ও ‘খাদী’ নামক দুটি এলাকায় বসবাস করতেন।

আফ্রিকানদের বর্বরতা : আফ্রিকার বর্বর জাতিরা ভীষণ উশৃংখল ও বিদ্রোহী ছিল। যখনই কোনো শাসক তাদের বিরুদ্ধে সৈন্যবহিনী প্রেরণ করত, তখন তারা আনুগত্য প্রদর্শনের ভান করত। দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যেত। কিন্তু যখনই সৈন্য বাহিনী ফিরে আসত তখনই বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে ধর্মত্যাগ করে বসত।

উকবার কারনামা : মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর আদেশে উকবা ইবনে নাফে ফিরী দশ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং বিদ্রোহীদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেন। রাজ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেন।

কায়রোওয়ান শহর বিনির্মাণ : এ জরুরি কাজ সমাপ্ত করার পর তিনি মনে মনে ভাবলেন, এ এলাকায় এক ইসলামী শহর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যা ইসলামী শক্তির কেন্দ্র বিন্দু এবং বিপদের সময় মুসলমানদের আশ্রয়স্থল হবে।

সুতরাং তিনি নিবিড় অন্ধকার বন উজাড় করে ‘কায়রোওয়ান’ শহরের ভিত্তি স্থাপন করেন। সেখানে বিরাট আলীশান মসজিদও নির্মাণ করেন। দীর্ঘ পাঁচ বছরে এ শহর নির্মাণ করা হয়।

উকবার সাফল্য : কায়রোওয়ান শহর প্রতিষ্ঠার পর মুসলমানদের সৌভাগ্যের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়। তারা প্রশান্তি ও ধৈর্যের সাথে বর্বরদের মোকাবেলা করে এবং একের পর এক এলাকা দখল করতে থাকে। এভাবে মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে ৷ বিপুল সংখ্যক বর্বর জাতিও ইসলাম গ্রহণ করে।

নতুন শাসক : ৫৫ হিজরীতে মিশর ও আফ্রিকার শাসন ক্ষমতা মাসলামাহ ইবনে মুখাল্লাদ আনসারী[62]র ওপর ন্যাস্ত করা হয়। তিনি তার কৃতদাস আবুল মুহাজির[63]কে আফ্রিকার শাসক নিয়োগ করেন।

অসৌজন্য মূলক আচরণ : আবুল মুহাজির আফ্রিকা পৌঁছে দায়িত্বের পালা বদলের সময় উকবা ইবনে নাফের সাথে অসৌজন্য মূলক আচরণ করে বসে। উকবা সিরিয়া পৌঁছে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট আবুল মুহাজিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করেন।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে পুনরায় আফ্রিকার গভর্নর নিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তাঁর জীবন তাকে ঐ প্রতিশ্রুতি পালন করার অবকাশ দেয়নি।

ইয়াযিদ ইবনে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর মনোনয়ন

প্রেক্ষাপট

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু একবার দামশকে পৌঁছেন। তখন তিনি ইয়াযিদের হাতে বাইআত গ্রহণের প্রস্তাব পেশ করেন।

ঘটনা ছিল এমন—

তিনি ইয়াযিদের সাথে সাক্ষাৎকালে ইয়াযিদকে বললেন, আকাবিরে সাহাবায়ে কিরাম ও বুযুর্গানে আহলে বাইতগণ দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। এখন তাদের বংশধরাগণ জীবিত আছে। তুমি বংশগত বুযুর্গ। প্রজ্ঞাপূর্ণ অভিমত, রাজনৈতিক দূরদর্শিতায়ও কোনো অংশে কম নও। আমি বুঝতে পারছি না যে, আমীরুল মুমিনীন তোমাকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করতে বিলম্ব করছেন কেন?

তার এ প্রস্তাব শুনে ইয়াযিদ বলল, কীভাবে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে?

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, অবশ্যই সম্ভব।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর পরামর্শ

ইয়াযিদ এ আলোচনা সম্পর্কে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে জানিয়ে দেন।

তিনি মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু কে তলব করে বললেন, ইয়াযিদ এ সব কী বলছে?

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতের পর মুসলমানদের মধ্যে যে মতভেদ ও রক্তপাতের সূচনা হয়েছে, তা সকলেই জানে। এ সম্পর্কে কেউ আর অনবগত নয়। অতএব ইয়াযিদ যখন আপনার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন। সুতরাং তার স্বপক্ষে বাইআত গ্রহণ করে তাকে আপনার প্রতিনিধি ঘোষণা করুন। পরবর্তীতে কোনো বিপত্তি দেখা দিলে সে মুসলমানদের আশ্রয়স্থল হবে। খিলাফত নিয়ে মতবিরোধ ও রক্তপাতের সূচনা বন্ধ হয়ে যাবে।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এ গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পালন করবে কে?

ইবনে শো‘বা বললেন, কুফার দায়িত্ব স্বয়ং আমি গ্রহণ করলাম। বসরার দায়িত্ব যিয়াদের ওপর ছেড়ে দিন। এ দুই শহর দমন করতে পারলে রাজ্যের আর কোথাও বিদ্রোহের আওয়াজ ধ্বনিত হবে না।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর সিদ্ধান্ত

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ঠিক আছে। তাহলে তুমি তোমার কাজ শুরু কর। ভবিষ্যতে যা ভালো মনে হবে, তা করা হবে।

মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহুর পদক্ষেপ

আন্দোলনের সূচনা : মুগীরা ইবনে শো‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু কুফায় ফিরে এসে বনু উমাইয়া সমর্থকদের মাঝে ইয়াযিদের মনোনয়নের আন্দোলনের সূচনা করেন। তারা এ আন্দোলনে ঐক্যমত্য পোষন করে।

প্রতিনিধি দল প্রেরণ : অন্যদিকে কুফার সম্ভ্রান্ত শ্রেণির এক প্রতিনিধিদল মূসা ইবনে মুগীরা[64]র নেতৃত্বে দামেশক অভিমুখে যাত্রা করে। ঐ প্রতিনিধি দল মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর সামনে নিজেদের পক্ষ থেকে ইয়াযিদকে খিলাফতের উত্তরাধিকারী মনোনীত করার দাবি পেশ করে। পাশাপাশি ইয়াযিদের গুণাবলীও বর্ণনা করে।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর উত্তর : মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি তোমাদের প্রস্তাব সম্পর্কে চিন্তা করে দেখব। এ বিষয় তড়িঘড়ি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সমিচীন হবে না। আল্লাহর যা ইচ্ছা তা বাস্তবে প্রতিফলিত হবে।

ইয়াযিদের ব্যাপারে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর পত্রপ্রেরণ : প্রতিনিধি দলের আগমনে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর ইচ্ছা শক্তিশালী হয়। তিনি যিয়াদকে এ বিষয়ে অভিমত জানাতে পত্র প্রেরণ করেন।

যিয়াদের অভিমত : যিয়াদ তার উপদেষ্টা উবায়েদ ইবনে কাব নুমাইরী[65]কে ডেকে বলল, আমীরুল মুমিনিনের ইচ্ছা হল, ইয়াযিদকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করা। কিন্তু এটা ইসলামী সম্রাজ্যের ব্যাপার ও দ্বীনী দায়িত্ব পালনের কাজ। ইয়াযিদ ভবঘুরে দায়িত্ব জ্ঞানহীন এক নবযুবক। ভোগ-বিলাস, ভ্রমণ ও শিকার করা ব্যতীত কোনো কাজ তার পছন্দ নয়। সুতরাং আমার ইচ্ছা হল, তুমি আমীরুল মুমিনীনের সাথে সাক্ষাৎ করে ইয়াযিদের এ সব দোষ-ত্রুটির বিষয়ে তাকে জানিয়ে দাও। আর আমার পক্ষ থেকে তাঁকে জানিয়ে দেবে, এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তড়িঘড়ি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না।

উবায়েদ ইবনে কাবে পরামর্শ : উবায়েদ ইবনে কাব বললেন, আমীরুল মুমিনীনের অভিমতের বিরোধিতা করা এবং তার পুত্রের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা যথার্থ হবে না। তবে উত্তম হল, স্বয়ং আমি দামশকে গিয়ে ইয়াযিদের সাথে সাক্ষাৎ করব। তাকে বলব, তোমার পিতা যিয়াদের সাথে তোমাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করা সম্পর্কে পরামর্শের আহবান করেছেন। যিয়াদের অভিমত হল, যে যাবত তুমি তোমার বদ অভ্যাস পরিত্যাগ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে না। বর্তমান অবস্থায় মুসলমানগণ তোমার বিরোধিতা করবে। কিন্তু তুমি যদি নিজেকে সংশোধন করে নাও, তাহলে আর তোমার বিরুদ্ধে কারো আপত্তি করার অবকাশ থাকবে না। এভাবে আমীরুল মুমিনীনের কল্যাণ এবং উম্মতের নিরাপত্তা উভয় লাভ হবে।

যিয়াদ উবায়েদ ইবনে কাবের পদক্ষেপ : যিয়াদ উবায়েদ ইবনে কাবের অভিমতকে অত্যন্ত যুক্তিসংগত মনে করেন। তাকে এ কাজ সমাধা করার উদ্দেশ্যে দামেশক অভিমুখে পাঠিয়ে দেন। উবায়েদ দামশকে পৌঁছে ইয়াযিদকে অতি উত্তমরূপে উপদেশ দান করে।

ইয়াযিদের প্রতিজ্ঞা : ইয়াযিদ অনেক বদ অভ্যাস ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয় এবং তৎক্ষণা অনেক বদ অভ্যাস ছেড়েও দেয়।

উবায়েদ যিয়াদের পক্ষ থেকে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে এ পয়গাম প্রেরণ করে যে, এখনো এ কাজে আমি দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাই না ৷

হিজাজ বিষয়ে মুআবিয়ার রাযিয়াল্লাহু আনহুর চিন্তা

যিয়াদের মৃত্যুর পর মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিরিয়া তো তার রাজধানী আর বুসরা ও কুফা নিয়ন্ত্রণ করা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়।

আসল সমস্যা ছিল হিজাজ নিয়ন্ত্রণ করা। মুসলিম জাহানের সম্মানিত ব্যক্তিগণ এখানে বসবাস করতেন। তাছাড়া খিলাফতে রাশেদার যুগে হিজাজবাসীদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে খলীফা নির্বাচিত করা হত। হিজাজের সম্মানিত বরেণ্য ব্যক্তিদের মাঝে ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা ছিলেন জ্ঞান প্রজ্ঞায় তাকওয়া পরহেজগারীতে অতুলনীয়। এছাড়া তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও কখনো এ পদের আকাঙ্ক্ষা করেননি। এ কারণে মুয়াবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর মাধ্যমে এ কাজ বাস্তবায়নের করার ইচ্ছা করেন।

সে মতে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর নিকট এক দূত প্রেরণ করেন। দূত তাঁর সামনে এক লাখ দেরহাম পেশ করে। ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা রাজকীয় উপঢৌকন মনে করে তা গ্রহণ করেন। এরপর দূত যখন উদ্দেশ্য প্রকাশ করে, তখন ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বললেন— আমার দ্বীন এত সস্তা নয় যে, তা এক লাখ দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দেব![66]

এ বলে তিনি মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর দূতকে দিয়ে ঐ দিরহাম ফেরত পাঠিয়ে দেন।

মদীনায় পত্রপ্রেরণ

এরপর মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু মদীনার গভর্নর মারওয়ান ইবনে হাকামকে এক চিঠি পাঠান। সেখানে তিনি লিখেন,

আমার বয়স হয়েছে আমার শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিয়েছে আমার ভয় হচ্ছে, আমার পর উম্মতের মাঝে যেন পুনরায় মতবিরোধ রক্তপাতের সূচনা না হয় কাজেই আমার অভিমত হল, আমার জীবদ্দশায় কাউকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করা কিন্তু এ গুরুত্বপূর্ণ কাজ মদীনাবাসীদের পরামর্শ ছাড়া করা সমচীন হবে না আমার মতে তুমি এ বিষয়টি মদীনাবাসীদের সামনে উত্থাপন করবে সম্পর্কে তাদের অভিমত আমাকে জানাবে

মদীনাবাসীদের অভিমত

মারওয়ান মদীনার সম্মানিত বুযুর্গদের আহবান করে তাদের সামনে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর অভিমত পেশ করেন। কিন্তু সে ব্যক্তিগতভাবে কারো নাম উল্লেখ করেনি। তাই সকলে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর অভিমতে ঐক্যমত পোষণ করে বলে, আমাদের কথা হল, আমীরুল মুমিনীন যেন এ বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে আমাদের জন্য তাঁর স্থলাভিসিক্ত মনোনীত করেন।

মারওয়ান মদীনাবাসীদের এ অভিমত মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে অবহিত করেন।

এরপর মারওয়ানের নামে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর দ্বিতীয় পত্র আসে। তাতে ইয়াযিদকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করার বিষয় অবগত করানো হয়। মারওয়ান উক্ত পত্র পাওয়ার পর মদীনাবাসীদের সমবেত করে ঘোষণা করেন, আমীরুল মুমিনীন গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে আপনাদের কল্যাণে তার উত্তরাধীকারী মনোনীত করেছেন। আর তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারী হল, ইয়াযিদ।

আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাযিয়াল্লাহু আনহু[67] অভিমত : ইয়াযিদের নাম শোনা মাত্রই উপস্থিত জনতার মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সর্বপ্রথম আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাযিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে বললেন, হে মারওয়ান! না তুমি সত্য কথা বলছ, না মুআবিয়া সত্য কথা বলছেন! তোমাদের উভয়ের উদ্দেশ্য হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত থেকে খলীফা মনোনীত করার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া। খিলাফতকে রাজতন্ত্রে রূপান্তর করে দেওয়া। যখন এক কায়সার মারা যাবে তখন দ্বিতীয় কায়সার তার স্থলাভিষিক্ত হবে।

অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের ক্ষোভ : এরপর হুসাইন ইবনে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু, ইবনে উমর, আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

মারওয়ান ইবনে হাকাম পুরো ঘটনা মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে অবহিত করেন।

অন্যান্য অঞ্চলে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর পত্র প্রেরণ

এরপর মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু বিভিন্ন প্রাদেশিক গভর্নরদের নিকট লিখিত ঘোষণা প্রেরণ করেন যে, তোমরা নিজ নিজ প্রদেশে ইয়াযিদের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জোর প্রচেষ্টা চালাবে। আর সেখানকার উচ্চ শ্রেণির কর্মকর্তাদেরকে প্রতিনিধি হিসেবে খিলাফতের দরবারে পাঠাবে। উত্তরাধিকারী মনোনয়নের বিষয়ে তাদের সাথে আলোচনা করা হবে।

সুতরাং বিভিন্ন প্রদেশ থেকে প্রতিনিধি দল দামেশকে পৌঁছতে শুরু করে। মদীনার প্রতিনিধি দলের মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে আমর ইবনে হাজাম[68] আর বসরার প্রতিনিধি দলের মধ্যে আহনাফ ইবনে কায়েস[69]ও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

পরবর্তী খলীফা নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা

মদীনার প্রতিনিধি মুহাম্মাদ ইবনে আমরের বক্তব্য : যখন খিলাফতের দরবারে উত্তরাধিকারী মনোনয়নের বিষয়ে আলোচনা চলছিল, তখন মুহাম্মদ ইবনে আমর বলেন—

‘হে আমীরুল মুমিনীন! প্রত্যেক বাদশাহ তার প্রজা সাধারণের কল্যাণের যিম্মাদার। আপনি গভীর মনোযোগের সাথে চিন্তা-ভাবনা করে দেখুন যে, উম্মতে মুহাম্মাদীয়ার শাসনভার কার ওপর ন্যাস্ত করতে যাচ্ছেন।

বসরার প্রতিনিধি আনহাফ ইবনে কায়েসের বক্তব্য : আনহাফ ইবনে কায়েস বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! এটা অনেক জটিল ব্যাপার। যদি আমরা সত্য কথা বলি তাহলে তা আপনার ভয়। আর যদি আমরা মিথ্যা বলি, তাহলে আল্লাহর ভয়। আপনি নিজে ইয়াযিদের দৈনন্দিন কার্যাবলী ও তার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব বিষয় সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত আছেন। আপনি যদি এ বিষয় আল্লাহ ও উম্মতে মুহাম্মদীর সন্তুষ্টি লাভ করতে চান, তাহলে এ বিষয়ে অন্যদের সাথে পরামর্শ করার কোনো প্রয়োজন।

আর যদি তা না চান, তাহলে আপনার পরকালীন সফরের সময় তাকে দুনিয়ার পাথেয় দান করবেন না। মোটকথা, আপনি যা করবেন আমরা তা অবনত মস্তকে মেনে নেওয়ার জন্য আপনার দরবারে হাজির হয়েছি।

সিরিয় নেতার বক্তব্য : এ জবাব শোনার পর আমীর মুআবীয়া নীরব হয়ে যান। কিন্তু জনৈক সিরিয়া নেতা দাঁড়িয়ে বলল, ইরাকের এ লোক কী বলতে চাচ্ছে? আমরা সিরিয়াবাসীরা তো মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর সামনে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছি। আর তাঁর ইশারায় যুদ্ধের ময়দানে তরবারী উন্মুক্ত করার অপেক্ষায় রয়েছি।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর সিদ্ধান্ত

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু ইয়াযিদের পক্ষে বাইআত গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত স্থির করেই নিয়েছিলেন।

উপঢৌকন পেশ : তাঁর রাজ্য শাসনের রীতি ছিল, তিনি প্রচুর উপহার ও উপঢৌকনের দ্বারা আপন-পর সকলের মন জয় করে নিতেন। তিনি এ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে প্রথমে সিরিয়া ও ইরাকের বাসিন্দাদের বাইআত গ্রহণ করে নেন।

মদীনায় সৈন্য বাহিনী প্রেরণ : তার পর এক হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেন ৷ মদীনায় বসবাসরত সম্মানী বুযুর্গদের মুখ স্বর্ণ-রৌপ্য দ্বারা বন্ধ করা অসম্ভব ছিল।

সাহাবায়ে কেরামের মক্কা রওয়ানা : সুতরাং মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর মদীনা আক্রমণের খবর শোনার পর ইবনে উমর, আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর, ইবনে যুবায়ের ও ইমাম হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুমসহ অনেকে প্রমুখ মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর মদীনায় আগমন : এসব বুযুর্গানে ইসলাম মক্কা অভিমুখে যাত্রা করার পর মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু মদীনা বাসীদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন৷ ভাষণের শুরুতে ইয়াযিদ গুণাবলী বর্ণনা করেন। তারপর বললেন,

এমন কয়েকজন লোক আছে, যারা ইয়াযিদের বিরোধিতা করা থেকে বিরত হবে না আমি তাদেরকে সতর্ক করে দিতে চাই, যদি তারা তাদের কাজে বহাল থাকে তাহলে আমি তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেব

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর মক্কা গমন : মদীনা থেকে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন।

এ চার বুযুর্গ[70] মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর মক্কা আগমনের খবর শুনে মনোস্থির করেন-আমাদের আমীরের সাথে সাক্ষাৎ করা উচিত। সম্ভবত মদীনার অবস্থা দেখায় তার মনোভাব পরিবর্তন হয়ে যেতে পাবে। সুতরাং ‘বাতনে মার’[71] নামক স্থানে তাঁরা মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে স্বাগত জানান। মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত হৃদ্যতার সাথে তাদের সংগে মিলিত হন এবং তাঁদেরকে রাজকীয় বাহনে চড়িয়ে নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন। মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু মক্কায় অবস্থান কালে তাদের সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ করতে থাকেন।

সাহাবায়ে কেরামের সামনে সরাসরি বাইআতের প্রস্তাব : যখন তার মক্কা থেকে যাত্রা করার সময় নিকটবর্তী হয়, তখন তাদের সামনে বাইআতের বিষয় উত্থাপন করেন।

পরবর্তী খলীফা নির্বাচন বিষয়ে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর সাথে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুমার ঐতিহাসিক কথোপকথন

সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুকে তাদের নেতা মনোনীত করেন।

তার সাথে নিম্নোক্ত বিষয় আলোচনা করা হয়—

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু : আপনারা আমার সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন। আমি সর্বদা আপনাদের সাথে উত্তম আচরণ বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। আপনাদের বাড়াবাড়িকেও সর্বদা সহ্য করে আসছি। ইয়াযিদ আপনাদেরই ভাই। আপনাদের পিতৃব্য পুত্র। আমি চাই আপনারা তাকে নামে মাত্র খলীফা বানিয়ে দিন। আর রাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ড আপনাদের হাতে ন্যাস্ত থাকবে। সে আপনাদের আদেশের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবে। আপনারা কি এ কথা মঞ্জুর করতে পারবেন না?

আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুমা : আমরা আপনার সামনে তিনটি প্রস্তাব পেশ করব। আপনি তিনটি প্রস্তাবের কোনো এক প্রস্তাব মেনে নিন।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু : বলুন! আপনার প্রস্তাবগুলো কী?

ইবনে যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুমা : সর্বোত্তম হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের ওপর আমল করা। তিনি কাউকে নামেমাত্র খলীফা বানাননি। তাঁর ওফাতের পর উম্মত স্বতঃস্ফূর্তভাবে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে তাঁর খলীফা ও স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করেছেন। আর এটা আমাদের প্রথম প্রস্তাব

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু : কিন্তু বর্তমানে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর মতো ব্যক্তিত্ব কোথায় আছে বলুন?

ইবনে যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুমা : তা না হলে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর রীতি অনুসরণ করুন। তিনি এমন ব্যক্তিকে তার প্রতিনিধি মনোনীত করেছেন, যিনি আত্মীয় ছিলেন না। আর আমাদের দ্বিতীয় প্রস্তাব

(মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু নীরব হয়ে যান।)

আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুমা পুনরায় বললেন, এটাও যদি সম্ভব না হয়, তাহলে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর রীতি অনুসরণ করুন! তিনি খলীফা মনোনয়নের বিষয় ছয় সদস্যের মজলিসে শুরার ওপর ন্যস্ত করেছেন, যারা তাঁর অনাত্মীয় ছিল। আর এটা আমাদের তৃতীয় প্রস্তাব

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু : এ ছাড়া কি অন্য কোনো পন্থা হতে পারে না?

ইবনে যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুমা : জী না! এছাড়া চতুর্থ আর কোনো পন্থা হতে পারে না।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু : ঠিক আছে! তাহলে এখন আপনি আমার অভিমত শুনুন। এ পর্যন্ত কেবল এতটুকুই হয়েছে যে, আমি জনসমাবেশে ভাষণ দানের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়েছি। আর আপনার মতো কেউ দাঁড়িয়ে আমাকে মিথ্যাবাদী বলত। আমি আপনাদের ঐ বাড়াবাড়িকেও নীরবে সহ্য করেছি। কিন্তু এখন আর তা হবে না। আমি জনসমাবেশে ভাষণ দেব। যদি আপনাদের মতো কেউ এক শব্দও উচ্চারণ করে, তাহলে আমার এ উন্মুক্ত তরবারী বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। তাঁকে আর দ্বিতীয় শব্দ উচ্চারণ করার সুয়োগ দেওয়া হবে না। সুতরাং আপনাদের নিজ নিজ জীবনের প্রতি অনুগ্রহ করা উচিত।

সম্মানিত চার সাহাবীর বাইআত গ্রহণ

এরপর মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু ঐ চার বুযুর্গকে সাথে নিয়ে সমাবেশ স্থলে উপস্থিত হয়ে বলতে শুরু করেন, তাঁরা হলেন উম্মতের সম্মানী ব্যক্তি। তাদের পরামর্শ ব্যতিত গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় মীমাংসা করা সম্ভব নয়। তাঁরা সকলে ইয়াযিদের পক্ষে বাইআত গ্রহণ করেছেন। সুতরাং আপনারা সকলে আল্লাহর নাম নিয়ে তার বাইআত গ্রহণ করুন।[72]

সাধারণ মানুষের বাইআত গ্রহণ

জনসাধারণ এসব সম্মানিত বুযুর্গদের অভিমত জানার অপেক্ষায় ছিলেন। যখন তাদেরকে বলা হল, তাঁরা বাইআত গ্রহণ করেছেন, তখন মক্কাবাসীরা ইয়াযিদের পক্ষে বাইআত গ্রহণ করে নেয়।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু মক্কা থেকে মদীনা পৌঁছে মদীনা বাসীদের বাইআত গ্রহণ করেন। তারপর মদীনা থেকে সিরিয়াতে প্রত্যাবর্তন করেন।

ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমার ধমকি : এ ঘটনার পর থেকে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু বনু হাশেমের[73] বংশধরদের সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ করা বন্ধ করে দেন। ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা সিরিয়াতে গমন করে এ বিষয় মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট অভিযোগ পেশ করেন।

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আপনার সাথীগণ ইয়াযিদের পক্ষে বাইআত গ্রহণ করেনি। আর আপনিও এ ব্যাপারে তাদেরকে বুঝাননি ৷

ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বললেন, হে আমীর মুআবিয়া! আপনি নিশ্চয় জানেন যে, যদি উপকূল এলাকায় গমন করে আপনার বিরুদ্ধে একটু শব্দ করি তাহলে আপনার বাইআত গ্রহণের একটি সূতাও অবশিষ্ট থাকবে না।

ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমার এ ধমকি শোনার পর মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু ভীত হয়ে বলতে শুরু করেন, হে ইবনে আব্বাস! আপনি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হবেন না। আমি আপনার ভাতা প্রদানের আদেশ জারি করে দিচ্ছি। আপনাকে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সুযোগ দেব না ৷

মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যু

৬০ হিজরীর জমাদিউল উখরা মাসে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু মৃত্যু শয্যায় শায়িত হন।

মৃত্যুপূর্ব শেষ ভাষণ

মৃত্যু রোগে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে তিনি এক ভাষণে বলেছিলেন—

আমি এক জমিন যার ফসল কাটার সময় নিকটবর্তী হয়ে গেছে আমি দীর্ঘ দিন তোমাদের শাসন কার্য পরিচালনা করেছি তাতে তোমরা আমার ওপর বিরক্ত হয়ে উঠেছ আর আমিও তোমাদের ওপর বিরক্ত হয়ে পড়েছি কিন্তু আমার পর যে আমার স্থলাভিষিক্ত হবে, সে আমার থেকে উত্তম হবে না, যেভাবে আমি আমার পূর্ববর্তী খলীফাগণের চেয়ে উত্তম ছিলাম না

বর্ণিত আছেযে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়া পছন্দ করে, আল্লাহ তাআলা তার সাক্ষাৎকে পছন্দ করেন হে আল্লাহ! আমি তোমার সাথে সাক্ষাৎ করা পছন্দ করি তুমি আমার সাক্ষাৎকে পছন্দ কর আমার এ সাক্ষাৎকে আমার জন্য বরকতময় কর!

মৃত্যুরোগ : এ ভাষণের কিছুদিন পর তিনি মৃত্যু রোগে আক্রান্ত হন। ঐ সময় ইয়াযিদ দামেশকে উপস্থিত ছিলেন না।

অন্তিম ওসিয়ত

তিনি যখন নিজের জীবন সম্পর্কে নিরাশ হয়ে পড়েন তখন যাহ্হাক ইবনে কায়েস[74] ও মুসলিম ইবনে উকবা আল-মুরি[75]কে ইয়াযিদের নিকট নিম্নোক্ত উপদেশনামা পাঠিয়ে দেওয়ার আদেশ করেন—

বৎস! আমি তোমার পথের সব কাটা দূর করে তোমার ভবিষ্যৎ কাঁটা মুক্ত করে দিয়েছি। তোমার শত্রুদের নির্মমভাবে নির্মূল করে দিয়েছি। আরববাসীদের মস্তক তোমার সামনে অবনত করে দিয়েছি। তোমার জন্য এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ জমা করে রেখেছি, যার উদাহরণ দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না।

আমার এ সমস্ত উপকারের কৃতজ্ঞতা হল—

এক. তুমি হেজাজবাসীদের সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ করবে, তারাই তোমার আসল উৎস। যে কোনো হিজাজবাসী তোমার নিকট আসবে, তার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করবে।

দুই. ইরাকবাসীদের প্রতি সৌজন্যমূলক আচরণ করবে। যদি তারা চায় প্রতিদিন তাদের জন্য এক জন করে নতুন শাসক নিয়োগ করতে হবে, তাহলে তাই করবে। কেননা এক লাখ তরবারীর মোকাবেলা করা থেকে প্রতিদিন শাসনকর্তা পরিবর্তন করা অতি সহজ।

তিন. সিরিয়াবাসীদের সাথেও সৌজন্যমূলক আচরণ করবে। তাদেরকে নিজের গোপন কথাগুলো বলতে পার। যদি কোনো শত্রুর আশংকা দেখা দেয়, তাহলে তাদের সাহায্য নেবে।

কিন্তু যখন দুশমনকে নির্মূল করে ফেলবে, তখন তাদেরকে স্বদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। কেননা তারা অন্যত্র বসবাস করার কারণে তাদের আচার-আচরণে পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।

খিলাফতের বিষয়ে চার জন কুরাইশ বংশধর তোমার প্রতিদ্বন্ধী হয়ে আছে।

১. হুসাইন ইবনে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুমা।

২. আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা।

৩. আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুমা এবং

৪. আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা

আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা : ইবাদত-বন্দেগী করতে করতে তিনি দুর্বল হয়ে গিয়েছেন। সবাই যখন তোমার বাইআত গ্রহণ করে নেবে তখন তিনি তা অস্বীকার করবে না।

হুসাইন ইবনে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু : তিনি সরল প্রাণের লোক। ইরাকবাসীরা তাঁকে তোমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করায় নিয়োজিত থাকবে। যদি তিনি তোমার মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসেন। আর তুমি সফলকাম হও, তাহলে তুমি তার সাথে ক্ষমাসুন্দর আচরণ করবে। কেননা সে তোমার নিকটাত্মীয়। আমাদের ওপর তাঁর বিরাট শ্রেষ্ঠত্ব ও অধিকার রয়েছে। তাছাড়া তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কলিজার টুকরা।

আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা : তিনি আরামপ্রিয় লোক। অন্যদের যা করতে দেখবেন, তিনিও তা করবেন।

আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুমা : ইনিই একমাত্র ব্যক্তি যে তোমার ওপর সিংহের মতো আঘাত করবে, আর শিয়ালের মতো কৌশল করবে। যদি সে মোকাবেলা করতে এগিয়ে আসে, আর তুমি সফলকাম হয়ে যাও, তাহলে তাঁকে টুকরা টুকরা করে ফেলবে।

তবে শুনে রাখ, হে বৎস! সাধারণ লোকজনকে যথাসম্ভব রক্তপাত থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবে।[76]

অন্তিম মুহূর্ত : অন্তিম সময় নিকটবর্তী হলে বললেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে একটি জামা দান করেছেন। আমি সেটি স্বযত্নে গচ্ছিত রেখে দিয়েছি।

আরেকদিন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নখ কাটছিলেন, আমি তা এক বোতলে ভরে সংরক্ষণ করে রেখেছি। আমার মৃত্যুর পর যখন আমাকে কাফন পরিধান করাবে, তখন আমাকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামা পরিয়ে দেবে। আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঐ নখগুলো আমার চোখে ও মুখের ওপর ছাড়িয়ে দেবে। আশ্চর্য্যের কিছু নেই। আল্লাহ তাআলা হয়ত এর বরকতে আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিবেন।

মৃত্যুবরণ

অবশেষে ১ রজব ৬০ হিজরী মোতাবেক ৭ এপ্রিল ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইনতেকাল করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৭৫ বছর। তিনি মোট ১৯ বছর ৩ মাস ২৭ দিন রাজ্য শাসন করেন। তাঁর জানাযার নামায পড়ান যাহ্হাক ইবনে কায়েস।

ইয়াযিদকে অসুস্থতা বেড়ে যাবার খবর দেওয়া হয়। কিন্তু সে দাফনের পরে পৌঁছে। কবরের ওপর জানাযা আদায় করে ৷

[1] মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রা.। জন্ম : 15 হিজরী ও মৃত্যু : 60 হিজরী। ঈসায়ী সন হিসেবে জন্ম : 608 ঈসাব্দ ও মৃত্যু : 680 ঈসাব্দ। মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রা. 72 বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার খেলাফত সময়কাল : 41–60 হিজরী মোতাবেক ৬৬১– ৬৮০ ঈসাব্দ। 19 বছর খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন।

[2] এই গোত্রের বংশধরদের খিলাফতকে ‘খিলাফতে বনু উমাইয়া’ বলা হয়। ‘বনু’ আরবী শব্দ। অর্থ সন্তান ও বংশ। ‘খিলাফতে বনু উমাইয়া’-এর অর্থ— ‘উমাইয়া বংশধরদের খিলাফত’।

[3] ‘সাইদা’ (Sidon) তৎকালিন দামেশকের উপকূলীয় শহর। বর্তমান লেবাননের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে শহরটি অবস্থিত।

[4] আরফা (আরবি : عرفه) বর্তমান সিরিয়ার আল-হামরা জেলায় অবস্থিত একটি গ্রাম।

[5] হাবীল : বর্তমান সিরিয়ার দামেস্কের পশ্চিম পর্বতমালার নিকটবর্তী ‘জাবাদানি’ উপত্যকার কাছে অবস্থিত।

[6] বৈরুত : বর্তমান লেবাননের রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর।

[7] উমর ইবন খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতের শেষের দিকে অথবা উছমান ইব্‌ন আফ্ফান রাযিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতের প্রথম দিকে রোমকগণ এ সকল উপকূলীয় অঞ্চলের কোন কোনটির ওপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। কিন্তু মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু অভিযান চালিয়ে শহরগুলো পুনরাধিকার করেন। তিনি সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত দুর্গগুলোর মেরামত করেন। সেখানে প্রতিরক্ষা বাহিনী নিযুক্ত করে তাদেরকে জায়গীর প্রদান করেন।

[8] আমওয়াছ হল ফিলিস্তিনের একটি গ্রাম। ‘আমওয়াছ-এর ইতিহাস : রোমান যুগে, এর নাম ছিল ‘নিকোপলিস’, যার অর্থ বিজয়ের শহর। আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফত কালে আমওয়াছ বিজয় হয়। উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফত কালে হিজরী ১৮ সনে ‘আমওয়াস’ শহরে প্লেগ মহামারীর প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। পরে সেখান থেকে এটি সিরিয়ার বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেক মুসলমানের মৃত্যু হয়। যেহেতু এই প্লেগ মহামারী আমওয়াছ থেকে ছড়িয়ে পড়ে তাই একে ‘আমওয়াছ মহামারি’ বলা হয়।

[9] শাম অঞ্চল ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার একটি বৃহৎ প্রাচীন ঐতিহাসিক অঞ্চল। ইয়ারমুক যুদ্ধের পর বিলাদুল শাম মুসলিমদের হস্তগত হয়। পূর্বে এই অঞ্চল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উত্তরে বৃষ পর্বতমালা, পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণে আরব মরুভূমি ও পূর্বে মেসোপটেমিয়া দ্বারা সীমায়িত। উত্তরে তুরষ্কের বৃষ পর্বতমালা থেকে দক্ষিণে মিশরের সিনাই মরুভূমি পর্যন্ত প্রায় ৬৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্বে আরব মরুভূমি পর্যন্ত ১১০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার প্রশস্ত।

[10] সিফফিন : বর্তমান সিরিয়ার শহর রাক্কার আশেপাশে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে অবস্থিত স্থানের নাম।

[11] ফারওয়াহ ইবনে নাওফিল আশজাঈ (فَرْوَةُ بْنُ نَوْفلٍ الأَشْجَعِيُّ الْكُوفِيُّ) : ফারওয়া ইবনে নওফল ইবনে শারিক আল-আশজাই। (অজ্ঞাত -41 হি.= অজ্ঞাত -622 খ্রিষ্টাব্দ) খারেজী মতাবলম্বি ছিলেন।

[12] আবদুল্লাহ ইবনে আবুল হাওসা আল-তাই (মৃত্যু : 41 হিজরি=662 খ্রিষ্টাব্দ)। তিনি খারেজি ও কবি ছিলেন।

[13]

[14] যিয়াদ ইবনে সুমাইয়াহ, যিয়াদ ইবনে আবিহী-র অপর নাম। যিয়াদ ইবনে ওবায়েদ আল-সাকাফী নামেও পরিচিত।–সিয়ারু আলামিন নুবালা : 3/494।

[15] জাহিলিয়া যুগের বিবাহ প্রথা : উরওয়া ইবনু যুবায়র রাহ. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, তাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহধর্মিনী আয়িশা রা. বলেছেন, জাহিলী যুগে চার প্রকারের বিয়ে প্রচলিত ছিল। এক প্রকার হচ্ছে, বর্তমান যে ব্যবস্থা চলছে অর্থাৎ কোন ব্যাক্তি কোন মহিলার অভিভাবকের নিকট তার অধীনস্থ মহিলা অথবা তার কন্যার জন্য বিবাহের প্রস্তাব দিবে এবং তার মোহর নির্ধারণের পর বিবাহ করবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, কোন ব্যাক্তি তার স্ত্রীকে মাসিক ঋতু থেকে মুক্ত হওয়ার পর এই কথা বলত যে, তুমি অমুক ব্যাক্তির কাছে যাও এবং তার সাথে যৌন মিলন কর। এরপর তার স্বামী নিজ স্ত্রী থেকে পৃথক থাকত এবং কখনও এক বিছানায় ঘুমাত না, যতক্ষণ না সে অন্য ব্যাক্তির দ্বারা গর্ভবতী হত, যার সাথে স্ত্রীর যৌন মিলন হত। যখন তার গর্ভ সুস্পষ্টবাবে প্রকাশ হত তখন ইচ্ছা করলে স্বামী তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করত। এটা ছিল তার স্বামীর অভ্যাস। এতে উদ্দেশ্য ছিল যাতে করে সে একটি উন্নত জাতের সন্তান লাভ করতে পারে। এ ধরণের বিবাহকে ’নিকাহুল ইস্তিবদা’ বলা হত।

তৃতীয় প্রথা ছিল যে, দশ জনের কম কতিপয় ব্যাক্তি একত্রিত হয়ে পালাক্রমে একই মহিলার সাথে যৌনমিলনে লিপ্ত হত। যদি মহিলা এর ফলে গর্ভবতী হত এবং কোন সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর কিছুদিন অতিবাহিত হত, সেই মহিলা এ সকল ব্যাক্তিকে ডেকে পাঠাত এবং কেউই আসতে অস্বীকৃতি জানাতে পারত না। যখন সকলেই সেই মহিলার সামনে একত্রিত হত, তখন সে তাদেরকে বলত, তোমরা সকলেই জানো- তোমরা কি করেছ! এখন আমি সন্তান প্রসব করেছি, সুতরাং হে অমুক! এটা তোমারই সন্তান। ঐ মহিলা যাকে খুশি তার নাম ধরে ডাকত, তখন এ ব্যাক্তি উক্ত শিশুটিকে গ্রহণ করতে বাধ্য থাকত এবং ঐ মহিলা তার স্ত্রীরূপে গণ্য হত।

চতুর্থ প্রকারের বিবাহ হচ্ছে, বহু পুরুষ একই মহিলার সাথে যৌন মিলনে লিপ্ত হত এবং ঐ মহিলা তার কাছে যত পুরুষ আসত, কাউকে শয্যা-শায়ী করতে অস্বীকার করত না। এরা ছিল বারবনিতা (পতিতা), যার চিহ্ন হিসাবে নিজ ঘরের সামনে পতাকা উড়িয়ে রাখত। যে কেউ ইচ্ছা করলে অবাধে এদের সাথে যৌন মিলনে লিপ্ত হতে পারত। যদি এ সকল মহিলাদের মধ্য থেকে কেউ গর্ভবতী হত এবং কোন সন্তান প্রসব করত তাহলে যৌন মিলনে লিপ্ত হওয়া সকল কাফাহ্ পুরুষ এবং একজন ’কাফাহ্’ (এমন একজন বিশেষজ্ঞ, যারা সন্তানের মুখ অথবা শরীরের কোন অঙ্গ দেখে বলতে পারত- অমুকের ঔরসজাত সন্তান) কে ডেকে আনা হত সে সন্তানটির যে লোকটি সাথে এ সা’দৃশ্য দেখতে পেত তাকে বলত, এটি তোমার সন্তান। তখন ঐ লোকটি ঐ সন্তানকে নিজের হিসাবে অস্বীকার করতে পারত না। যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সত্য দ্বীনসহ পাঠানো হল তখন তিনি জাহেলী যুগের সমস্ত বিবাহ প্রথাকে বাতিল করে দিলেন এবং বর্তমানে প্রচলিত শাদী ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিলেন। – সহিহ ‍বুখারী : ৫১২৭

[16] আবু সুফিয়ান সুমাইয়াকে জাহিলী যুগের কোনো এক নিয়মে বিবাহ করেছিলেন। যদিও ইসলাম আসার পর জাহেলী যুগের সমস্ত বিবাহ প্রথা বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু যিয়াদের জন্মের ঘটনা যেহেতু ইসলামপূর্ব সেহেতু এখানে দোষারপ বা প্রকাশ্য ব্যাভিচার বলার সুযোগ নেই। (আল্লাহু আলাম) –তথ্য নিরীক্ষক।

[17] বৈমাত্রেয় বা বিমাতা। অর্থাৎ বাবা এক মা ভিন্ন ভিন্ন।

[18] আল-কামেল ফিত তারীখ : ৩/১৭৭

[19] খুতবাটির আরবী (সামান্য ভিন্নতাসহ) পাঠ নিম্নরুপ :

 

أما بعد : فإن الجهالة الجهلاء، والضلالة العـمياء، والغي الموفي بأهله على النار، ما فيه سفهاؤكم، ويشتمل عليه حلماؤكم، من الأمور التي يشب فيها الصغير، ولا يتحاشى عنها الكبير!

كأنكم لم تقرؤوا كتاب الله ولم تسمعوا ما أعد من الثواب الكريم لأهل طاعته، والعذاب الأليم لأهل معصيته!

قربتم القرابة وبعدتم الدين، كل امريء منكم يذب عن سفيهه صنع من لا يخاف عاقبة ولا يرجو معادًا، ما أنتم بالحلماء، وقد اتبعتم السفهاء!

حرام علي الطعام والشراب، حتى أُسويها بالأرض هدمًا وإحراقًا…. إني رأيت آخر هذا الأمر لا يصلح إلا بما صلح به أوله، لين في غير ضعف، وشدة في غير عنف.

وإني أقسم بالله لآخذن الولي بالمولى، والمقيم بالظاعن، والمقبل بالمدبر، والمطيع بالعاصي، والصحيح بالسقيم، حتى يلقى الرجل منكم أخاه فيقول : “أنج سعد، فقد هلك سعيد.” أو تستقيم قناتكم.

وإياي ودلج الليل، فإني لا أوتى بمدلج إلا سفكت دمه، وإياي ودعوى الجاهلية فإني لا أجد داعيًا بها إلا قطعت لسانه، ولقد أحدثتم أحداثًا لم تكن، ولقد أحدثنا لكل ذنب عقوبة، فمن غرَّق قومًا غرّقناه، ومن أحرق قومًا أحرقناه، ومن نقب بيتًا نقبنا عن قلبه، ومن نبش قبرًا دفناه فيه حيًا. وأيم الله إن لي فيكم لصرعى كثيرة، فليحذر كل منكم أن يكون من صرعاي.

[20] জুন্দিসাবুর (گندی‌شاپور) : দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের একটি শহর। বর্তমান দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের শুশতারের রাস্তা পর্যন্ত 14 কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি গ্রাম।

[21] আবুল আব্বাস মুবাররাদ ইবনে ইয়াযিদ ইবনে আবদুল আকবর। (জন্ম 10 জিলহজ্ব, 210 হিজরী /825 ঈসাব্দ, মৃত্যু : 285 হিজরী /899 ঈসাব্দ।)

[22] আমর ইবনে হারিস ইবনে আমর ইবনে উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে মাখজুম আল-কুরাশী। ডাকনাম আবু সাঈদ। বদরের দিন জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের সময় তার বয়স বারো বছর হয়েছিল। ৮৫ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

[23] যারা আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে একটু বেশিই ভালবাসতো বলে প্রচার করতো। তাদের ভালবাসার শরয়ী সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এজন্য লেখক রাহিমাহুল্লাহ ‘মিথ্যা অনুসারী’ বলে তাদের পরিচয় করিয়েছেন।

[24] নাম : আবুল হাসান আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ আশ-শায়বানি বা আলী ইজ্জউদ্দিন ইবনুল আসির আল-জাজারি। জন্ম : ৫৫৫ হিজরী মোতাবেক ১২৩৩ ঈসাব্দ; মৃত্যু : ৬৩০ হিজরি মোতাবেক ১১৬০ ঈসাব্দ। তিনি আরব-কুর্দি বংশোদ্ভূত ইতিহাসবিদ ও জীবনীলেখক ছিলেন।

[25] মুস্তাওরিদ ইবনে আলকামা : একজন খারেজী বিদ্রোহী। 42 হিজরির শেষে কিংবা ৪৩ হিজরি (৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দ) শাবানের শুরুতে টাইগ্রিসের তীরে মুগিরা বিন শো‘বা রা.-র বাহিনির হাতে নিহত হন।

[26] হাইয়্যান ইবনে জাবয়ান আস-সুলামী, একজন খারিজি কবি। মুস্তাওরিদ ও অন্যান্যদের তাকেও হত্যা করা হয়।

[27] মাকিল বিন কায়েস (বা আবদ কায়েস) আর-রিয়াহি। বনু তামিম গোত্রের বনু ইয়ারুবু শাখাগোত্রের অন্তর্ভুক্ত।

[28] বনু আবদুল কায়েস (আরবি : بنو عبد القيس) উত্তর আরব গোত্রের রবী’আ শাখা থেকে আগত একটি প্রাচীন আরব গোত্র। আব্দুল কায়স ইবন কুরায়্য ইবন আফসার নামে গোত্রটির নামকরণ করা হয়েছ।

[29]

[30] সাআসা ইবনে সাওহান আবদী (আরবি : صعصعة بن صوحان) আরবের কাতিফায় হিজরতের প্রায় 24 বছর আগে 598 খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। লেখক, একজন বক্তা এবং শিয়া ছিলেন। সাআসাকে মুআবিয়া রা. বাহরাইনে নির্বাসিত করেন। যেখানে তিনি 44 হিজরি মোতাবেক 666 খ্রিষ্টাব্দে মারা যান।

[31] আদি ইবনে হাতিম (عدي ابن حاتم الطائي) : আদি ইবনে হাতিম সাহাবী ও আরবের তায়ি গোত্রের নেতা। বিখ্যাত কবি হাতিম আত-তায়ি এর পুত্র, যিনি আরবদের মধ্যে তার দানশীলতা এবং উদারতার জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। 68 হিজরীতে কুফায় ইন্তেকাল করেন।

[32]

[33] দাইলামা : ইতিহাসে এরা দিলামাইটস বা ডাইলামাইটস নামে পরিচিত। মূল ফার্সি : (دیلمیان) ইরানী গোত্রের নাম। যারা কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে উত্তর ইরানের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করতো। বর্তমানে ইরানের গিলান প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অর্ধেক নিয়ে দাইলামা অঞ্চলে গঠিত।

[34] সংক্ষিপ্ত নোট : (০১) তাবারি ও আল-কামেল ফিত তারীখ গ্রন্থের বর্ণনায় আছে, হজরত মুয়াবিয়া রা. ৪১ হিজরিতে হজরত মুগিরা রা. কে কুফার গভর্নর হিসেবে প্রেরণ করেন। এসময় তাকে কিছু দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। যেমন : হজরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর খোলামেলা সমালোচনা, হজরত উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর জন্য সব সময় দোয়া ও মাগফেরাত করা, হজরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গী-সাথিদের জনসমক্ষে লাঞ্ছিত করা, তাদেরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া এবং হজরত উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গী-সাথিদের প্রশাসনিক দায়িত্বে রাখার বিষয়ে কোনো কসুর যেন না রাখা হয়। অর্থাৎ এসব কার্যক্রম পরিচালনায় যেন চেষ্টার কোনো কমতি না রাখা হয়। এ ব্যাপারে তিনি গভর্নর সাহাবিকে শক্ত দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।

এই বর্ণনার শেষাংশে রয়েছে, মহান সাহাবি গভর্নর হবার পর হজরত মুয়াবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর প্রদত্ত নির্দেশনাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন এবং সময়-অসময়ে হজরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর গালমন্দ ও সমালোচনা করতেন।

অথচ এই বর্ণনার সূত্রগুলোর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ রাবি মিথ্যুক, পরিত্যাজ্য, অপরিচিত এবং চরম স্মৃতিভ্রমের শিকার।

সংক্ষিপ্ত নোট : (২) : মুয়াবিয়া রা. কি হজরত আলীকে গালমন্দ করাতেন?

কোনো সহিহ বর্ণনামতে হজরত মুয়াবিয়ারা পক্ষ থেকে এমন আচরণ কোনোভাবেই প্রমাণিত নয়। আর যাচাই-বাছাইয়ের মৌলিক নীতি অনুযায়ী সম্মানিত ব্যক্তিদের চরিত্রহননের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দুর্বল বর্ণনা আমরা দলিল হিসেবে গ্রহণ করি না। – মাওলানা ইসমাইল রেহান, তারিখে উম্মতে মুসলিমা

[35] উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ : জন্ম : ৩২ হিজরি ; মৃত্যু ৬৭ হিজরি। ৩৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। প্রথম মুআবিয়া ও প্রথম ইয়াযিদ-এর শাসনাকালের বসরা, কুফা এবং খোরাসানের গভর্নর ছিলেন। খলিফা প্রথম মারওয়ান এবং আব্দুল মালিকের শাসনমলে সেনাবাহিনীর একজন অন্যতম সেনাপতি ছিলেন। ৪ রমযান ৫৩ হিজরি সালে তার পিতা যিয়াদ ইবনে আবিহির মৃত্যুর পর গভর্নরের দায়িত্ব পান।

[36] নাম : আমর বিন গাইলান বিন সালামাহ আস-সাকাফী। আমর বিন গাইলান-এর সাহাবী হওয়ার ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েচে। আল-ইসাবা গ্রন্থাকারের মতে তিনি সাহাবী নন। – আল-ইসাবা ফি তাময়িযিস সাহাবা : 4/554 (5942)।

[37] উরওয়াহ ইবনে আদীরাহ : উরওয়া বিন হুদায়র বিন আমের আল-তামিমি। আবু বিলাল। তিনি উরওয়া বিন আদিয়া (আদিয়া তার দাদী) নামেও পরিচিত। নাহরাওয়ানের অধিবাসী ছিলেন। 58 হিজরী মোতাবেক 678 খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

[38] সূরা শুআরা : (26) : ১২৮-১৩০

[39] বনু তামীম গোত্রের শাখা হল বনু ইয়ারবু। অরবের প্রসিদ্ধ গোত্রসমূহের অন্যতম। ইয়ারবু ইবনে হানজালা ইবনে মালিক আল-তামিমি বনু ইয়ারবু গোত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি একজন প্রাক-ইসলামী কবি ছিলেন।

[40] আহওয়াজ (Ahvaz) : আহওয়াজ বা আহবাজ (ফার্সি : اهواز) হল মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র অনারব দেশ। যা বর্তমান ইরানের খুজিস্তান প্রদেশের রাজধানী এবং পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ উষ্ণ তাপমাত্রার শহর।

[41] আসলাম ইবনে জুরআ আল-কালাবী : তৎকালীন খোরাসানের গভর্নর ছিলেন। 43 হিজরিতে খোরাসানের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

[42] আল-কামেল ফিত তারীখ : ৩/৩০৩

[43] আমর ইবনুল আস : পূর্ণাঙ্গ নাম, আবু আবদুল্লাহ আমর ইবনুল আস বিন ওয়ায়েল আল-সাহমি আল-কুরাশি আল-কিনানি (৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বা ৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ মোতাবেক ৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দ বা ৫৭৭ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। সিরিয়া বিজেতা নেতা। তিনি মিশর বিজয় করেন এবং বিজয়ের পর মিশরে প্রথম মুসলিম গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি আরবের মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং 1, শাওয়াল 43 হিজরি মোতাবেক 664 খ্রিষ্টাব্দের রাতে মিশরে মৃত্যুবরণ করেন।

[44] আবদুল্লাহ ইবনে সাওয়ার আবদি (عبد الله بن سوار العبدي) : তিনি ৪৭ হিজরিতে (প্রায় ৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দ) নিহত হন।

[45] আবু সাঈদ আল-মুহাল্লাব ইবনে আবি সুফরা আল-আজদী (আরবি : أَبْو سَعِيْد ٱلْمُهَلَّب ابْن أَبِي صُفْرَة ٱلْأَزْدِي)। যতদুর জানা ষষ্ঠ হিজরিতে তাঁর জন্ম। তিনি একজন তাবেয়ী, বেশকিছু হাদীসও তিনি বর্ণনা করেছেন। আজীবন তিনি জিহাদের ময়দানে কাটিয়েছেন। একজন জাত সেনাপতি ছিলেন। তিনি পারস্য, মসুল , আরমিনিয়া এবং আজারবায়জান এবং খুরাসান-এর গভর্নর হিসাবে ধারাবাহিক মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন।

[46] কাবুল : আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের একটি। বর্তমান আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল অবস্থিত।

[47] মুলতান : বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের একটি শহর। এই শহরটি চেনাব নদীর তীরে অবস্থিত এবং দক্ষিণ পাঞ্জাবের প্রধান সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র।

[48] তিব্বত : বর্তমান গণচীনের একটি স্বশাসিত অঞ্চল। মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত এ অঞ্চলটি তিব্বতীয় জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল।

[49] লাহোর : লাহোর হল বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী এবং করাচির পর পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর।

[50] সাইপ্রাস : সাইপ্রাস ভূমধ্যসাগরের একটি দ্বীপ দেশ। ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপগুলোর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ এটি। এর পশ্চিমে গ্রিস, পূর্বে লেবানন, সিরিয়া এবং ইসরাইল, উত্তরে তুরস্ক ও দক্ষিণে মিশর।

[51] ইউনান : বর্তমান পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্র গণচীনের দক্ষিণ-পশ্চিমভাগে অবস্থিত একটি প্রদেশ। এই প্রদেশের সাথে দক্ষিণ দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিনটি রাষ্ট্র মিয়ানমার, লাওস ও ভিয়েতনামের সীমান্ত রয়েছে। এই প্রদেশের পশ্চিম সীমানাতে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ অবস্থিত।

[52] রোডস দ্বীপ : রোডস হল গ্রীসের ডোডেকানিজ দ্বীপগুলির মধ্যে বৃহত্তম এবং তাদের ঐতিহাসিক রাজধানী। এটি ভূমধ্যসাগরের নবম বৃহত্তম দ্বীপ।

[53] কনস্টান্টিনোপল এর বর্তমান নাম ইস্তাম্বুল। ১৯৩০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইস্তাম্বুল নামে নামকরন করা হয়। বর্তমানে শহরটি তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের বৃহত্তম শহর এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্র। কন্সটান্টিনোপল ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ শহর।

[54] আমরা স্থানটি সনাক্ত করতে পরিনি।

[55] বসফরাস একটি জলপ্রণালী যা এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যবর্তী অঞ্চলের একটি অংশে সীমানা। এটিকে অনেক সময় ইস্তানবুল প্রণালীও বলা হয়। বসফরাস, মারমারা উপসাগর এবং দক্ষিণ পশ্চিমের দার্দেনেলাস প্রণালী মিলে তুর্কি প্রণালী গঠিত। বসফরাস প্রণালী বিশ্বের নৌ চলাচলে ব্যবহৃত সবচেয়ে সরু জলপথ। এটি কৃষ্ণ সাগরকে মারমারা উপসাগরের সাথে যুক্ত করেছে।

[56] বুসর ইবনে আবি আরতাত আল-আমিরি : বুসর ইবনে আবি আরতাতছিলেন বিশিষ্ট সেনাপতি। সিরিয়ার গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। সিরিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার মুসলিম বিজেতাদের একজন। দামেস্কে ৮৬ হিজরিতে (৭০৫ খ্রি.) মৃত্যুবরণ করেন।

[57] রোদবার দানিয়াল : কনসটান্টিনোপলের নিকটবর্তী একটি এলাকার নাম।

[58] আব্দুল আজিজ বিন জুররাহ আল-কালাবী (عبدالعزيز بن زرارة الكلابي) : ইসলামিক কবি ও সাহসী যোদ্ধা। কনস্টান্টিনোপল যুদ্ধে শহীদ হন।

[59] মুআবিয়া ইবনে হুদায়জ (معاوية بن حديج) : আবু নুয়াইম মুআবিয়া ইবনে হুদায়জইবনে জাফনা ইবনে কাতিরা আল-সাকুনি আল-তুজিবি আল-কিন্দি। মুআবিয়া সিরিয়া, সিসিলি এবং ইফ্রিকিয়াতে বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে এবং আল-কাদিসিয়ার যুদ্ধে সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মুসলিম বিজয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। 52 হিজরী মোতাবেক 670 খ্রিষ্টাব্দে ইস্তেকাল করেন।

[60] উকবা ইবনে নাফি ফিহরি (عقبة بن نافع) : উকবা ইবনে নাফি ছিলেন উমাইয়া খলিফা প্রথম মুআবিয়া ও প্রথম ইয়াযিদের শাসনামলের সেনাপতি। তিনি মাগরেব বিজয়ের সূচনা করেন। কুরাইশ বংশের বনু ফিহরি শাখার সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে তাকে অনেক সময় আল-ফিহরি পদবী দ্বারা সম্বোধন করা হয়। তার বংশধরদেরকে উকবি বা ফিহরি বলা হত। 63 হিজরি মোতাবেক 683 খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।

[61] বারকা : প্রচলিত ইংরেজি নাম : Cyrenaica বা Cyrenaica। গ্রীক দ্বীপে অবস্থিত একটি গ্রীক অঞ্চল যার নাম বারকাইয়া বা বারকাই। প্রাচিন বারকায় উত্তর আফ্রিকার বেশ কয়েকটি শহর অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার মধ্যে তুকরা শহর অন্যতম। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। বর্তমানে লিবিয়ার সমস্ত পূর্ব অংশকে সাইরেনাইকা অন্তর্ভুক্ত করে। ইসলামী যুগে বারকা শহরের নামানুসারে এলাকাটি বারকা নামে পরিচিতি লাভ করে।

[62] মাসলামাহ ইবনে মুখাল্লাদ আনসারী : মাসলামা ইবনে মুখাল্লাদ ইবনে আস-সামিত আল-আনসারী। আবু মা’ন বা সা’দ বা উমর এসব কুনিয়াতেও পরিচিত। রাসূল সা.-এর অন্যতম সাহাবী। মিশর বিজয়ে অংশ নিয়েছিলেন। মিশর বিজয়ের পরে থেকে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি মিশরে থেকে গেছেন। 62 হিজরির যুল-কাদাহ মোতাবেক 9 এপ্রিল, 682 খ্রিষ্টাব্দে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় ইন্তেকাল করেন।

[63] আবুল মুহাজির : আবুল মুহাজির দিনার আল-আনসারি। উত্তর আফ্রিকায় শাসক ছিলেন। 63 হিজরী মোতাবেক 683 খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।

[64] মূসা ইবনে মুগীরা হল মুগীরা ইবনে শো‘বা রা. এর ছেলে।

[65] উবায়েদ ইবনে কাব নুমাইরী (عبيد بن كعب النّميري) : তিনি ইরাকের অধিবাসী।

[66] এক লাখ দিরহাম প্রদানের এ ঘটনা আল্লামা ইবনে আসীর একজন শিআ বর্ণনাকারীর উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি মোটেই ঠিক নয়। কাতেবে ওহি সম্পর্কে এধরনের কথা অপবাদ ছাড়া আর কিছু নয়।

[67] আবদুর রহমান ইবনে আউফ (عبد الرحمن بن عوف) : আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা.-র জন্ম হস্তীবর্ষের দশম বছর। ইমাম বুখারীর মতে জাহিলী যুগে আবদুর রহমান ইবন ’আউফের নাম ছিল ’আবদু ’আমর। ইবন সা’দ তাঁর ‘তাবাকাতে’ উল্লেখ করেছেন, জাহিলী যুগে তাঁর নাম ছিল ’আবদু কা’বা। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল সা. তাঁর নাম রাখেন ‘আবদুর রহমান’। তাঁর মাতা-পিতা উভয়ে ছিলেন ‘যুহরা’ গোত্রের লোক। মাতার নাম শিফা বিনতু ’আউফ। দাদা ও নানা উভয়ের নাম ’আউফ। ৭২ বছর বয়সে ৩১ হিজরি মোতাবেক ৬৫২ খ্রিষ্টাব্দ সনে মৃত্যুবরণ করেন।

[68] মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে হাজাম : মুহাম্মাদ বিন আমর বিন হাযম আল-আনসারী। ডাকনাম আবু আবদুল মালিক। দশম হিজরীতে নাজরানে জন্মগ্রহণ করেন। তেষট্টি হিজরীতে সনে ইন্তেকাল করেন।

[69] আহনাফ ইবনে কায়েস : আরব মরুর এক মুজাহিদ। শৌর্য আর সাহসে তিনি ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। আরবি সাহিত্যের সমঝদার ব্যক্তি। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র চেহারা মোবারক দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। কিন্তু পেয়েছেন বহু সাহাবির একান্ত সান্নিধ্য। ৭২ হিজরী মোতাবেক ৬৯১ খৃস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

[70] চার বুযুর্গ হলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উমর, আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর, আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের ও ইমাম হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুম।

[71] বাতনে মার (وادي فاطمة و بطن مرّ و مر الظهران) : ওয়াদি ফাতিমা, যাকে পূর্বে বাতনে মার বলা হতো। বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা অঞ্চলে অবস্থিত তিহামা উপত্যকার একটি বড় উপত্যকা এটি। যার দৈর্ঘ্য 210 কিলোমিটার এবং এর গড় ঢাল 7 কিলোমিটার। উপত্যকাটি পূর্ব থেকে পশ্চিমেঢ ঢালু।

[72] আলোচ্য ঘটনায় বল প্রয়োগের যে কথা বলা হয়েছে, একথা আল্লামা ইবনে আসীর রহ. ছাড়া আর কেউ উল্লেখ করেননি। তাও তিনি সনদ ছাড়া উল্লেখ করেছেন। আল্লামা ইবনে আছীর রহ. এর প্রধান উৎস হলো তারীখে তাবারী। সেখানেও এ অলিক কাহিনীর কোনো সূত্র নেই। পক্ষান্তরে শিআ ঐতিহাসিক আহমাদ আল ইয়াকুবীও বল প্রয়োগের উক্ত ঘটনা খণ্ডন করে লিখেছেন, “তিনি সকলের মনোর নই করেছেন। বাইআত গ্রহণে কাউকে বাধ্য করেননি। ” বলা বাহুল্য, একজন কট্টরপন্থী শিআ ঐতিহাসিকের স্বীকৃতি উপেক্ষা করে ইবনে আসীর রহ.এর সনদবিহীন বর্ণনা উল্লেখ করার কোনো যৌক্তিকতাই নেই।

[73] বনু হাশিম : মক্কার কুরাইশ বংশের একটি গোত্র। নবি মুহাম্মাদ সা. পিতৃসূত্রে এই গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রপিতামহ হাশিম ইবনে আবদ মানাফের নামে এই গোত্রের নামকরণ করা হয়েছিল। গোত্রের নামানুসারে এই গোত্রের সদস্যদের হাশেমি বলা হত।

[74] যাহ্হাক ইবনে কায়েস : আবু আবদুর রহমান আয- যাহহাক বিন কায়েস বিন খালিদ বিন ওয়াহব আল-ফিহরি আল-কুরাশি। 4 হিজরী মোতাবেক 625 খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন। নবীজীর কনিষ্ঠ সাহাবী ছিলেন। 64 হিজরী মোতাবেক 684 খ্রিষ্টাব্দে ইনেতেকাল করেন।

[75] মুসলিম ইবনে উকবা আল-মুরি (আরবি : مسلم بن عقبة بن رباح المري الذبياني الغطفاني)। হিজরী প্রাক সময় মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। উমাইয়া খলিফা মুআবিয়ার শাসনামলে একজন জেনারেল ছিলেন। তিনি 63 হিজরী মোতাবেক 683 খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।

[76] আল-কামেল ফিত তারীখ : ৪/২-৩

শেয়ার করুন

সূচীপত্র

error: Content is protected !!