ইসলামী আইনের উৎস, ক্রমবিকাশ ও প্রয়োগ

লেখক: আহমাদ রিফআত

বিষয়: বর্তমান বিশ্ব, ইসলামী আইন, ইসলাম

ইসলামী আইনের উৎস, ক্রমবিকাশ ও প্রয়োগ

ইসলামী আইনের উৎস, ক্রমবিকাশ ও প্রয়োগ

শুরুর কথা

আজকের বিশ্ব অগণিত সমস্যার সম্মুখীন। অন্তহীন সমস্যার আবর্তে মানব ‘সভ্যতা আজ জর্জরিত, ক্ষতবিক্ষত ও পর্যুদন্ত। মানব জীবনকে আজ সমস্যার স্তূপ বললে একটুও অতিরঞ্জিত হবে না। বিশ্বমানবৰতা আজ এ সর্বাত্মক ও সামগ্রিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চায়, চায় তারা সমস্যামুক্ত, শোষণহীন, সুখী, সমৃদ্ধিশালী, প্রগতিশীল ও শাস্তিপূর্ণ বিশ্ব সমাজ গড়ে তুলতে। কিছু ১৬শ শতাব্দী থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যায় পর্যন্ত মানব জীবনে শাস্তি স্থাপনের জন্য ব্যাঙের ছাতার মতো মানব সৃষ্ট বহু মতবাদ গড়ে উঠেছে। কিন্তু এসব মানব রচিত মতবাদ শান্তি স্থাপনের ও সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে জীবনকে করে তুলেছে আরো সংকটময়, সমস্যাসংকুল। ১৬ শ শতাব্দীতে গির্জা ও সিংহাসনের সংঘাত জন্ম দিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র আর এ ধর্মহীন গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পরিণতিতে উদ্ভব হয়েছে চরম নির্যাতনমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদ।

লাগামহীন পুঁজিবাদী অর্থাব্যবস্থার ঘোড়ার দাপটে পিষ্ট হয়েছে মানবতা, নির্যাতিত হয়েছে বঞ্চিতের দল। বিদায় নিয়েছে নৈতিকতা, উদারতা, মহানুভবতা, কল্যাণ কামনার মহান মানবীয় গুণাবলী। মানুষ নিকৃষ্ট পশুর চেয়েও ঘৃণ্যতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছে। হারিয়েছে মানুষ অনু, বস্ত্র, যক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মৌলিক অধিকার। সমাজের সমস্ত সম্পদ–গুটিকতক পুঁজিপতি জালিমের হাতে হয়েছে কুক্ষিগত। গণতান্ত্রিক ব্যক্তি-স্বাধীনতার নামে একশ্রেণীর মানুষ পেলো গগনচুম্বী প্রাসাদ তৈরি ও বিলাসের প্লাবনে ভেসে যাওয়ার অবাধ স্বাধীনতা।

 

ইসলামী আইনের উৎস, ক্রমবিকাশ ও প্রয়োগ
ইসলামী আইনের উৎস, ক্রমবিকাশ ও প্রয়োগ

 

আর সমাজের অগণিত বঞ্চিত, সর্বহারা, বুভৃক্ষু ও দরিদ্র জনগণ পেলো নগ্নদেহে বিনা চিকিৎসায় ফুটপাথে পড়ে থেকে না খেয়ে মরার স্বাধীনতা। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশ পর্যন্ত বিশ্বের কল্যাণকামী চিন্তানায়কগণ এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য চিন্তা গবেষণা শুরু করলেন। অবশেষে হেগেল ও ডারউইনের চিন্তার উচ্ছিষ্ট দ্বান্দবিক বস্তুবাদের নির্যাস থেকে মহাত্মা কার্ল মার্কস আবিষ্কার করলেন মুক্তির এক নতুন মতবাদ সমাজবাদ৷ পুঁজিবাদের স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে শাস্তি ও মুক্তির শ্লোগান নিয়ে জন্ম নিল সমাজবাদ। বিপুল যুবশক্তিকে আকৃষ্ট করলো এ প্রান্তিক অবাস্তব সমাজবাদী চিন্তাধারা। নৈতিকতা, ধার্মিকতা, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকার, সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে মানুষকে আরো নিন্নস্তরের পশু বানিয়ে লাখো লাখো মানুষের খুনের সমুদ্র সৃষ্টি করে বিশ্বের একাংশে বিপুল জনতার উপর চাপিয়ে দেওয়া হলো সমাজতন্ত্রের বিভীষিকা। কার্ল মার্কস অত্যন্ত লোভনীয় ও চিত্তাকর্ষক বর্ণনার মাধ্যমে বিশ্বের সামনে তুলে ধরলেন তার এ প্রান্তিক চিন্তাধারা। তার এ মতবাদে দীক্ষা গ্রহণ করলেন লেলিন ও স্তালিন। অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে পেশ করলেন ব্যক্তি-মালিকানার বিরুদ্ধে যুক্তি। পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী পোপ ও ধর্মযাজকেরা যুক্তি পেশ করলেন তার বিরুদ্ধে যে, ধর্মও তো ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এবার মার্কসবাদীরা তড়িত গতিতে জবাব দিলেন, ‘ধর্মের নামে এ আফিম আমরা আর জনগণকে সেবন করতে দেব-না। ধর্মযাজকেরা প্রতি-উত্তরে বললেন, ‘ধর্ম তো স্রষ্টার তরফ হতে নিয়ে এসেছেন প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত মহামানব ও স্বীয় দূতেরা।’ এবার মার্কসবাদীরা জরাব দিলেন যে, এঙ্গেলস ও প্রফেটগণ নির্যাতনমূলক পুঁজিবাদী ব্যক্তি-মালিকানার স্বীকৃতিষূলক ধর্ম নিয়ে এসেছে। ওরা পুঁজিবাদের দালাল।

ধর্মযাজকেরা বললেন, স্বগীয় দূত ও প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত মহামানবগণ নিজে নিজে আসেন নি, তাদেরকে বিশ্বস্রষ্টা প্রেরণ করেছেন। এবার মার্কসপদ্থীরা তাদের প্রান্তিক চিন্তার চূড়াস্ত ফসল নাস্তিক্যবাদের প্রচারে নেমে আসলেন। তারা বললেন, ‘কোন স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই, মানুষই কাষ্পনিকভাবে স্রষ্টার বিশ্বাস নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করে রেখেছে‘; আর যদি এমন কোন স্রষ্টা থেকেও থাকেন যিনি পুঁজিবাদভিত্তিক ধর্ম ব্যবস্থা দিচ্ছেন, তিনি মানুষের কল্যাণকামী নন বরং তিনি সর্বহারা মানুষের দুশমন। নাস্তিক্যবাদী সমাজবাদ গোটা বিশ্বে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে; মুক্তি, শাস্তি ও প্রগতির শ্লোগানে মুগ্ধ হয়ে কোটি কোটি মানুষ এ ভ্রান্ত মতাদর্শকে গ্রহণ করেছে।

কিন্তু এ অবাস্তব সমাজবাদ মানব জীবনে শাস্তি স্থাপনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তাই আজ সারা বিশ্বে মানব রচিত মতবাদের যাতাকল থেকে মুক্তি লাভ করে খোদায়ী জীবন দর্শন ইসলামী আদর্শের বুনিয়াদে জীবন পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দিকে দিকে ইসলামী বিপ্লবের গগনবিদারী আওয়াজ উতিত হয়েছে৷ মানব রচিত ভ্রান্ত মতবাদকে উৎখাত করে আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় জীবনে বাস্তবায়িত করার ও বিজয়ী আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চলছে সিরিয়ায় এমনকি বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্বে। দেশে দেশে গড়েছে বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন।

আরো পড়ুন:

ইসলামী আইনের অপরিহার্যতা

মানুষ সসীম, মানুষের বুদ্ধি-জ্ঞানও সসীম। সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী মানুষ কখনও মানব জাতির জন্য অসীম কল্যাণকর বিধান প্রণয়ন করতে পারে না। তাই আজকের বিশ্বের সর্বব্যাপী সমস্যার সমাধান একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে। তাই তো বিশ্বের সর্বত্র এ দাবি আজ অত্যন্ত জোরদার হয়ে দেখা দিয়েছে। হিজরী চতুর্দশ শতাব্দী আজ বিদায় নিয়েছে। পঞ্চদশ শতাব্দী আজ ইসলামী বিপ্লবের পয়গাম নিয়ে সমাগত। আজ ঈমানের প্রত্যয়ে একান্ত দৃঢ়তার সাথে আমরা ঘোষণা করতে পারি যে, হিজরী চতুর্দশ শতাব্দী ছিল ইসলামের পুনর্জাগরণ আন্দোলনের দাওয়াত ও সংগঠনের শতাব্দী; আর হিজরী পঞ্চদশ শতাব্দী হচ্ছে ইসলামের পুনঃ প্রতিষ্ঠার, শতাব্দী। মানব রচিত মতবাদগুলো মানব জাতির সমস্যা সমাধানে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তাই ইতিহাসের বাস্তব প্রয়োজনেই আজ ইসলামের পুনঃ প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

ইতিহাসের এ অপরিহার্য প্রয়োজন ও দাবিকে আজ বিশ্ব মুসলিমকে পূরণ করতেই হবে। আজ এটি প্রমাণিত সত্য যে ইসলাম ছাড়া মানুষের মুক্তির জন্য আর কোন পথ নেই।

যুগে যুগে ইসলামই মানব জাতিকে মুক্তির সন্ধান দিয়েছে। হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সকল আম্বিয়ায়ে-কিরামই আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামী মূল্যবোধকেই মানব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিশ্বনেতা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের সর্বশেষ পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠাতা, তার যুগ থেকে আজ পর্যন্ত ইসলাম বিভিন্ন উথ্থান ও পতনের মধ্য দিয়েও তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও আদর্শিক স্বকীয়তার সংরক্ষণ করেছে। মানব সভ্যতার উৎকর্ষের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক অবদান্ব রেখেছে। আজ বিশ্বমানবতার মুক্তি ও কল্যাণের ক্ষেত্রে একমাত্র ইসলামই ঐতিহাসিক শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণিত করে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হবে। আজ বিশ্ব ধ্বংসপ্রাপ্ত না হলে আগামী দিনের সূর্যোদয় যতটা সত্য ও বাস্তব, ইনশাআল্লাহ আগামী দিনগুলোতে ইসলামের পুনঃ প্রতিষ্ঠাও তেমনি সত্য ও বাস্তব। ইসলামের এ পুনঃ প্রতিষ্ঠার সুসংবাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যেও করে গেছেন। হাদীসে বর্ণিত রয়েছে,

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার যুগ হচ্ছে নবুয়ত ও রহমতের যুগ এবং আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী.এর স্থিতি হবে। অতঃপর নবুয়তের যুগের পরিসমাপ্তি খিলাফতে রাশেদার যুগ শুরু হবে এবং আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী এর স্থিতির পর পুনঃ এ যুগের অবসান ঘটবে। এরপর শুরু হবে দুষ্ট রাজতন্ত্রের যুগ, আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী এর স্থিতির পর পুনঃ অবসান ঘটবে, অতঃপর শুরু হবে একনায়কত্বের যুগ, আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী স্থিতির পর জুলুমমূলক একনায়কত্বের অবসান ঘটে আবার খিলাফতে রাশেদার যুগ পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকারী প্রশাসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ রাসূলের পদ্ধতি অনুসারে দেশ পরিচালনা করবেন। আসমান যমীনের অধিবাসীরা তাদের ব্যবহারে সন্তুষ্ট হবে। আকাশ মুক্ত হৃদয়ে বরকত বর্ষণ করবে, যমীন তার উৎপাদন বরকত ও তার গর্ভ-স্থিত গোপন সম্পদরাজি উদগীরণ করে দেবে। 

ইতিহাসের কষ্টিপাথরে আলোচ্য হাদীসটিকে বিশ্লেষণ করলে কি এ সত্য উদ্ভাসিত হয় না যে রাসূলের যুগ নবুয়তের ও রহমতের যুগ হিসেবে অতিবাহিত হয়ে গেছে। হযরত আবু বকর (রা.), হযরত উমর্‌ (রা.), হযরত উসমান (রা.), হযরত আলী (রা.), হাসান (রা.) ও হযরত উমর বিন আবদুল আযীয (রহ.)-এর যুগ খিলাফতে রাশেদার যুগ হিসেবে অতিবাহিত হয়েছে। উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতিমীয়া, উসমানিয়া খিলাফত ও মোগল যুগ ইত্যাদি রাজতন্ত্রের যুগ হিসেবে অতিবাহিত হয়ে গেছে। আর বর্তমানে যবরদস্তিমূলক একনায়কত্বের যুগ অতিবাহিত হচ্ছে। কারণ একনায়কত্ বলতে শুধু ব্যক্তির শাসনকেই বোঝায় না, জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যক্তি, গোষ্ঠির দলীয় শাসনকে রাষ্ট্রনীতির পরিভাষায় একনায়কত্ব বলা হয়।

ইতিহাসের ৪টি যুগের ভবিষ্যদ্বাণী যদি আমাদের সামনে বাস্তব বলে প্রমাণিত হয়ে থাকে, তবে চতুর্থটি সত্য হওয়ার ব্যাপারেও কোন দ্বিধা-সংকোচ ও সন্দেহ থাকতে পারে না। আজ বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে একাস্ত স্বতঃস্কূর্ততাবেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, বিশ্ব ইতিহাস দ্রুতগতিতে ইসলামী জীবনাদর্শের পুনঃ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হচ্ছে এবং গোটা বিশ্বের বিভিনন সংস্থা ইতিহাসের দাবিকে পূরণের জন্যই আজ ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ইসলামী বিপ্লবের ক্রমাগত প্রভাব ও বাতিল শক্তির মিথ্যা প্রচারণা ও আতঙ্কগ্রস্ত মানসিকতার অসহনীয় প্রকাশ ইসলামের পুনঃ প্রতিষ্ঠার শুভ ইঙ্গিতই বহন করছে।

আইনের সংজ্ঞা

আইন বা কানূন শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে নিয়ম-পদ্ধতি, বিধি-বিধান। সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন স্তরে, প্রাকৃতিক জগতে, জীবজগতে, সামাজিক জীবনে–সৌরমণগ্ডলে যে নিয়ম চালু রয়েছে আভিধানিক দিক থেকে তাকেও আইন বলা হয়। পাখির ডিম প্রসব, ডিম থেকে বাচ্চার জন্য, ক্রমবিকাশের মাধ্যমে তা আবার একটি বড় পাখির রূপ ধারণ করা৷ রীজকে মাটিতে পুঁতে রাখা, তা থেকে কচি চারা গাছের উদ্‌গম হওয়া, চারাগাছ এক বিরাট বৃক্ষে পরিণত হওয়া, শুক্রকীট থেকে ভ্রমবিকাশের মাধ্যমে একটি পরিপূর্ণ জীবে রূপান্তরিত হওয়া-এর সবকিছুই এক চিরন্তন নিয়মের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাই আভিধানিক অর্থে এগুলোই আইন। এসব কিছুকে প্রাকৃতিক আইন বলা হয়ে থাকে। সৃষ্টিজগতে প্রাথমিকভাবে আইনকে দুভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। ১. প্রাকৃতিক আইন ও ২. নৈতিক আইন। প্রাকৃতিক বিধান অপরিবর্তনীয় ও অলংঘনীয়। কোন সৃষ্টি এ প্রাকৃতিক আইনের বিরোধিতা করতে পারে না।

কিন্তু নৈতিক আইন পালন করা না করার ক্ষেত্রে মানুষের ইচ্ছা ও কর্মশক্তির সীমাবদ্ধ স্বাধীনতা রয়েছে। মানুষের সামগ্রিক জীবনধারা যে সামগ্রিক বিধি-বিধান ও নিয়ম-পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত হয় তাই আইন। এ আইন আবার প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দুভাগে বিভক্ত। ১. ফৌজদারী আইন ও ২. দেওয়ানী আইন। সামগ্রিক দিক থেকে আইনের আরো বহু বিভাগ রয়েছে। যেমন, পারিবারিক আইন, সামাজিক আই,; রাষ্ট্রীয় আইন ও আন্তর্জাতিক আইন। সমস্ত জীবনধারা বা নিয়ম-কানূনকে আইন বলা হলেও রাষ্ট্রনীতির পরিভাষায় আইনের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে৷ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় অনুশাসনকে আইন বলে। অন্য অর্থে যে সকল নিয়ম পদ্ধতি বিধি-বিধান রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভ করে এবং যা অমান্য করলে অমান্যকারীদেরকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি প্রয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করে রাষ্ট্র দর্শনে তাকেই আইন বলা হয়। কোন কোন রাষ্ট্রনীতিবিদ শুধু সার্বভৌম শক্তির নির্দেশকেই আইন বলে উল্লেখ করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইনের সংজ্ঞা হচ্ছে সমাজে যে সকল ধ্যান-ধারণা, অভ্যাস, রীতিনীতি ও পদ্ধতি সার্বজনীন নিয়মের আকারে সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভ করেছে ও সরকারী অধিকার ও ক্ষমতা তথা সার্বভৌমত্বের দ্বারা জীবনধারাকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বলবৎ করা হয়েছে তা-ই হচ্ছে আইন।

আরো পড়ুন:

 

ইসলামী আইনের সংজ্ঞা

খোদায়ী সার্বভৌমত্বের বুনিয়াদে কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত কুরআন ও সু্ন্নাহ-র আলোকে গবেষণাপ্রসূত যে সার্বজনীন নিয়ম-পদ্ধতি, ধ্যান-ধারণা ও বিধি-বিধান গণ-জীবনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতার মাধ্যমে গৃহীত ও বলবৎ করা হয়, তাকেই ইসলামী শরীয়ত বা ইসলামী আইন বলা হয়।

সমাজ গঠনে আইনের অপরিহার্যতা

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোন সুসভ্য সমাজ গড়ে উঠা সম্ভব নয়, আইন স্বাধীনতার রক্ষাকবচ, আইন সুসভ্য সমাজ গঠনের সোপান, আইন মানবাধিকার রক্ষা করার গ্যারান্টি। আইন সুষু ও সংঘবদ্ধ সমাজ গঠনের নির্ভুল মাধ্যম। আইন অত্যাচার, জুলুম ও নির্যাতন প্রতিরোধের একমাত্র বৈজ্ঞানিক পন্থা। নির্ভুল ও সুষ্ঠ আইন সার্বজনীন কল্যাণের উৎস। আইন সামাজিক স্বার্থ সংরক্ষণ ও সুষম বণ্টন পদ্ধতির একমাত্র মাধ্যম। সুসভ্য সমাজ গঠনে ও মজবুত স্থিতিশীল নিয়ম-পদ্ধতির মাধ্যমে উন্নত মানব সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে নির্ভূল আইনের অপরিহার্য প্রয়োজন রয়েছে। সুশৃঙ্খলিত আইনের বন্ধনহীন সমাজ পশুর চেয়েও নিকৃষ্টতম।

আইনের লক্ষ্য

মানব জাতির সার্বিক কল্যাণ সাধন, ধ্বংস, পতন ও ক্ষতির হাত থেকে মানব, সভ্যতাকে রক্ষা করা আইনের অন্যতম লক্ষ্য। আইন মানব জাতিকে কল্যাণ ও প্রগতির পথে পরিচালিত করে, আইন চক্রান্ত ও স্বার্থপরতা থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করে। আইন মানুষের যোগ্যতা ও প্রতিভা বিকাশের পথকে সহজতর ও উন্মুক্ত করে। সর্বোপরি আইন নৈতিক দেউলিয়াপনা ও অবক্ষয় থেকে সমাজ জীবনকে রক্ষা করে মানবীয় মূল্যবোধের উৎকর্ষ সাধন করে।

বস্তুবাদী জীবন দর্শন

বর্তমানে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী জীবন দর্শনের বুনিয়াদে রচিত মানুষের মনগড়া আইন, আইনের উপরোক্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতারই প্রমাণ দিয়েছে। পাশ্চাত্য দর্শনে রচিত আইন মানুষের মৌলিক গুণাবলী ও মানবীয় মূল্যবোধকে সমাধিস্থ করেছে। মানুষকে হিংস্র পশুতে পরিণত করেছে। মানুষে মানুষে হানাহানী, মারামারি সৃষ্টি করেছে। নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের পরিবর্তে নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি করেছে। অপরাধ দমনের পরিবর্তে অপরাধ প্রবণতাকে আরো বৃদ্ধি করেছে। এ অবস্থায় আইনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করতে হলেও ইসলামী আইন কার্যকর করা ছাড়া তা কোন দিনই সম্ভব নয়।

আমরা এখানে ইসলামী আইনের উৎস, বৈশিষ্ট্য, ভ্রমবিকাশ ও প্রয়োগ পদ্ধতিকে পর্যায়ক্রমে পেশ করবো।

প্রচলিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইনের উৎস

ইসলামী আইনের উৎস তুলে ধরার পূর্বে প্রসঙ্গক্রমে আমরা এখানে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইনের উৎসগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করছি। প্রকৃতপক্ষে পাশ্চাত্য দর্শনে রচিত আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মানবীয় শক্তির ইচ্ছা অভিরুচি, অভ্যাসকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছে। আর ইসলামী জীবন দর্শনে আল্লাহর নির্দেশকেই আইনের প্রকৃত উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছে। প্রচলিত রাষ্ট্রদর্শনে আইনের ৬টি উৎসকে গ্রহণ করা হয়েছে।

১. প্রচতিল প্রথা: সমাজের দীর্ঘকালের প্রচলিত অভ্যাস ও প্রথাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে আইনের মর্যাদা দান করা হয়।

২. ধর্ম: ধর্মীয় বিধানকে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে আইনের মর্যাদা দান করা হয়।

৩. বিচারক প্রণীত আইন: লিপিবদ্ধ আইনে কোন ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট বিধান না পাওয়া গেলে বিচারকগণ পূর্ববর্তী কোন বিচারকের রায়ের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন৷ এ ধরনের উৎস থেকে গৃহীত আইনকে বিচারক প্রণীত আইন বলা হয়।

৪. আইনবিদদের অভিমত ও বিচারকের রায়: বিশিষ্ট আইনবিদদের সুদক্ষ আলোচনা ও সুচিত্তিত অভিমত অনেক সময় বিচারক কর্তৃক আইন হিসাবে গৃহীত হয়। অনেক সময় রুয়েকজন আইনবিদদের সম্মিলিত অভিমতের আলোকে বিচারকগণ রায় প্রদান করেন। এ ধরনের ব্যাখ্যা ও রায় রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত হলে তা আইনের মর্যাদা লাভ করে।

৫. ন্যায়-নীতিবোধ: বিচারকের বিবেকগ্রসূত ন্যায় নীতিবোধও অনেক সময় আইনের মর্যাদা লাভ করে। বিচারালয়ে আনীত যে সকল মামলা মোকদ্দমা প্রচলিত আইনের বিচারের উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন বিচারকগণ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ন্যায়নীতির বুনিয়াদের রায় প্রদান করেন এবং সিদ্ধান্ত পরবর্তী পর্যায়ে আইনের মর্যাদা লাভ করে।

৬. আইন পরিষদ: প্রচলিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইন পরিষদই আইনের প্রধান উৎস। জনগনের কল্যাণার্থে দেশের শাসন-শৃঙ্খলা জনগণ ও সরকারের কর্তব্য নির্ধারণ ও গোটা জীবনধারার নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন পরিষদে প্রস্তাবাকারে উত্থাপিত হয় এবং আইন পরিষদে তা সর্বসম্মতভাবে বা অধিকাংশ সদস্যের সম্মতিক্রমে গৃহীত হলে রাষ্ট্রীয় আইনের মর্যাদা লাভ করে এবং তা সার্বজনীন আইনে পরিণত হয়।

ইসলামী জীবন দর্শনে আইনের উৎস

ইসলামী জীবন দর্শনে আইনের প্রধান উৎস হচ্ছে ওহী। ইসলামী রাষ্ট্রদর্শনে একমাত্র আল্লাহ তাআলাই হচ্ছেন সার্বভৌম শক্তির মালিক। মানুষ এ বিশ্বে তার খলীফা হিসেবে সার্বভৌম শক্তির অধিকারী মহাপ্রভুর ইচ্ছাকে কার্যকরী ক্রাই হচ্ছে মানব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। সমগ্র সৃষ্টির একচ্ছত্র অধিপতি, নিরংকুশ মালিক হচ্ছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তাই একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ ও তার ইচ্ছা হবে আইনের একমাত্র নির্ভুল উৎস। এ কারণে ইসলাম আল্লাহর ওহীকেই আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছে।

ওহী দুভাগে বিভক্ত, যে ওহীর ভাব ও ভাষা সব কিছুই আল্লাহর তরফ হতে এসেছে কুরআন। আর যার লক্ষ্য ও ভাব আল্লাহর তরফ হতে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিজের ভাষায় রূপদান করেছেন তা হচ্ছে সুন্নাহ। মোট কথা, ইসলামী আইনের চিরন্তনী নির্ভুল উৎস হচ্ছে ২টি- আল-কুরআন ও সুন্নাহ। মানুষের জীবন অত্যন্ত ব্যাপক। এমনটি হওয়া বিচিত নয়, অনেক নব উদ্ভূত সমস্যা যার সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত বিধান কুরআন ও সুন্নাহতে খুঁজে না পাওয়া যেতে পারে, তাই কুরআন ও সুন্নাহ অনেক মূলনীতি পেশ করেছে। ইসলাম এক চিরন্তন গতিশীল জীবন ব্যবস্থা। এ অবস্থায় ইসলাম জীবনের এ সকল খুটিনাটি সমস্যার সমাধানও দিয়েছে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবোদ্ভূত সমস্যার সমাধান কল্প বা গবেষণাকে ইসলামী আইনের তৃতীয় উৎস বলে উল্লেখ করেছেন। এ পর্যায়ে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, কুরআন ও সু্ন্নাহ-র আলোকে ইসলামী আইনের উৎস হচ্ছে, ৩টি কুরআন, সুন্নাহ ও ইজতিহাদ।

এই ইজতিহাদ বা গবেষণালব্ধ সমাধানের ক্ষেত্রে যখন সাহাবায়ে কিরাম বা আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীন অথবা গোটা উম্মত যদি ঐকমত্য পোষণ করে তবে তা হবে ইজমা ও ভিন্নমত পোষণ করলে তা হবে কিয়াস।

উপরোক্ত আলোচনার আলোকে যদিও, ইসলামী আইনের উৎস তিনটিই প্রমাণিত হয়। যথা- কুরআন, সুন্নাহ ও ইজতিহাদ, কিছু বিশ্লেষণ ও শ্রেণীবিন্যাসের মাধ্যমে ইসলামী আইনের উৎস ৪ টিই বলা যেতে পারে। ২টি হচ্ছে ওহীভিত্তিক- কুরআন ও সুন্নাহ। আর ২টি হচ্ছে ইজতিহাদ ভিত্তিক ইজমা ও কিয়াস। তাই এখন থেকে পরবর্তী পর্যায়ে ইসলামী আইনের উৎস ৪টি বলেই উল্লেখ করবো- কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস।

এ পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে ইসলামী আইনের ৪টি উৎসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরছি।

আরো পড়ুন:

 

ইসলামী আইনের ৪টি উৎসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

মানুষ এ সৃষ্টিজগতে আল্লাহর প্রতিনিধি। এর প্রকৃত মালিক হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তাআলা। তাই মালিক ও মনিবের বিশাল রাজত্বে তারই হুকুম মুতাবিক জীবন যাপন করতে হবে। তারই হুকুম মুতাবিক বিশ্বজগত পরিচালনার জন্য হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত অগণিত নবী ও রাসূল বিভিন্ন সহিফা ও আসমানী গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন৷ এর মধ্যে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সর্বশেষ গ্রন্থ হচ্ছে আল-কুরআন। রাসূলের যিন্দেগীতে ইসলামী সমাজ গড়ার জন্য আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট ওহী আকারে আল-কুরআন নাযিল করেছেন। কুরআন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী আইনের মূলনীতি সহকারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জিবরাঈল আলাইহিস সালাম-এর মারফত অবতীর্ণ হয়েছে।

আর এ কুরআনের বিধানকে কার্যকরী করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আর এক ধরনের গোপন প্রত্যাদেশ এসেছে, যার নাম হচ্ছে সুন্নাহ। কুরআন ও সু্ন্নাহ-র আইনের নির্ভুল উৎস হওয়ার ব্যাপারে রাসূলের যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে কোন মতভেদ নাই। আর রাসূলের যিদ্দেগীতে দীন সম্পর্কীয় যত কথা তিনি বলেছেন, যত কাজ তিনি করেছেন, আর যত কথা ও কাজকে তিনি দীনের কাজ ও কথা হিসেবে অনুমোদন বা সমর্থন দিয়েছেন, তা যে আল্লাহর ইঙ্গিতেই করেছেন এ ব্যাপারে কোন মতবিরোধ নেই। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে,

রাসূল নিজের প্রকৃতি অনুসারে কথা বলেন নি বরং আল্লাহর ওহীর বুনিয়াদেই কথা বলেছেন।

আল-কুরআন ও সুন্নাহকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ আল-কুরআনেই রয়েছে। আল-কুরআনের বিভিন্ন অধ্যায়ের উল্লেখ,

আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার বুনিয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনা করুন; কারও বিবেকের অনুসরণ করবেন না।

যারা আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করে না তারা কাফির।

যারা আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করে না, তারা জালিম।

যারা আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করে না, তারা ফাসিক।

তোমাদের নিকট যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাছাড়া অন্য কিছুর অনুসরণ করো না।

আল্লাহ ও তার রাসূল কর্তৃক কোন সিদ্ধান্ত প্রদানের পর কোন মুমিন পুরুষ বা মহিলার এর বিপরীত কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা নেই৷ – সূরা আহ্যাব

হুকুম দেওয়ার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা একমাত্র মহান ও শ্রেষ্ঠ আল্লাহ তাআলারই। – সূরা মুমিন

বিশ্বাসী জাতির জন্য আল্লাহ ছাড়া আর উত্তম হুকুমদাতা কে হতে পারে। – সূরা মায়িদা

হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন আমি তোমাদের ২ টি নির্ভুল জগতের উৎস রেখে যাচ্ছি। যতদিন, তোমরা দৃঢ়ভারে এ দুটাকে আকড়ে ধরে থাকবে (ততদিন) তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হবে না। তা হচ্ছে আল্লাহ-র কুরআন ও তার রাসূলের সুন্নাহ।

কুরআন ও সুন্নাহতে আইনের নির্ভুল উৎস এ ব্যাপারে এর চেয়ে বেশি আর উদ্ধৃতি তুলে ধরার প্রয়োজন নেই।

আল-কুরআনের সংজ্ঞা

এ পর্যায়ে আমরা আইনের প্রথম উৎস আল-কুরআনের সংজ্ঞা তুলে ধরছি ইসলামী আইন শাস্ত্রের মূলনীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ আইন বিশারদগণ আল-কুরআনের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে বলেছেন,

কুরআন হচ্ছে সেই ঐশী গ্রন্থ যা (লওহ মাহফুজ থেকে) আল্লাহ তাআলা হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম মারফত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অবতীর্ণ করেছেন এবং তা বহু সংখ্যক লোক সন্দেহাতীতভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সংরক্ষণ করেছেন এবং ধাল্পাবাহিকভাবে উদ্ধৃত হয়ে আসছে এবং কুরআন প্রকৃতপক্ষে তার শব্দরাজি, অর্থ ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য সবকিছু নিয়েই কুরআন। (নূরুল আনোয়ার: ৯-১০)

ক. ইসলামী আইনবিদগণ ৪8টি পদ্ধতির মাধ্যমে আল-কুরআনের উৎস থেকে আইন গ্রহণ করেছেন। যখন কুরআনের কোন সুস্পষ্ট বিধান দিয়ে কোন আয়াত অবতীর্ণ করা হয়েছে, তার বুনিয়াদে যে আইন গ্রহণ করা হয়েছে তারে বলা হয় ইবারাতুন নস।

খ. যখন শব্দের পরিবর্তে অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে কোন আইন গ্রহণ করা হয়, ওঁ পদ্ধতিকেই ইশারাতুন নস বলা হয়।

গ. অর্থ গ্রহণকালীন আভিধানিক অর্থকে গুরুত্ব দিয়ে সে আইন গ্রহণ করা হয়েছে, এ পদ্ধতিকে বলা হয়েছে দালালাতুন্নস।

ঘ. আর অর্থ গ্রহণ করতে যখন চিন্তা ও জ্ঞানের আলোকে আইন গ্রহণ করা হয়েছে এ পদ্ধতিকে বলা হয়েছে ইকতেজাউন নস।

সু্ন্নাহ-র সংজ্ঞা

ইসলামী আইনের দ্বিতীয় উৎস হচ্ছে সুন্নাহ। ইসলামী আইনবিদগণ সুন্নাহর সংজ্ঞা পেশ করে বলেছেন,

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা-কাজ ও অনুমোদন এবং সাহাবায়ে কিরামদের কথা ও কার্যাবলীকে সুন্নাহ বলা হয়। সাধারণ প্রচলিত অর্থে সুন্নাহ বলতে শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা, কর্ম ও সমর্থনকেই বোঝায়।

বর্ণনার দিক থেকে সুন্নাহ তিন ধরনের, ১. মুতাওতির, ২. মশহুর এবং ৩. ওয়াহেদ বা আহাদ।

১. বিপুল সংখ্যক বর্ণনাকারী যে হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং যাদের বিশ্বস্ততার কারণে তাদের বর্ণনার সত্যতা সম্পর্কে কোন প্রকার দ্বিধা ও সন্দেহের অবকাশ থাকে না এমন ধরনের হাদীসকে মুতাওতির বলা হয়।

২. যে হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবাদের যুগে একজন ছিলেন কিছু পরবর্তীকালে তাবেয়ীনগণের ও তাবে-তাবেয়ীনদের যুগে এমনি বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি কর্তৃক তা বর্ণিত হয়েছে, যাদের বিশ্বস্ততার কারণে তাদের বর্ণনার সত্যতা সম্পর্কে আর.কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ থাকে না, তাকে মশহুর বলা হয়।

৩. যে হাদীসের বর্ণনার যূল্যমান মুতাওতির ও মশহুরের সমপর্যায়ের নয় এবং যার বর্ণনার প্রথম দিকে বা মধ্যভাগে ও শেষ পর্যায়ে একজন বা দুইজন বর্ণনাকারী হতে একজন বর্ণনা করেছেন৷ তাকে ওয়াহেদ বা আহাদ বলা হয়।

এখানে প্রস্গত্রমে উল্লেখ করা দরকার যে কুরআনের অনুরূপ সুন্নাহকে ইসলামী জীবন দর্শন তথা ইসলামী আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করা না হলে ইসলামী জীবনধারার আনুগত্য করাই সম্ভব নয়। রাসূলে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, এমন একদিন আসবে যখন কিছু লোক বলা শুরু করবে যে, আমরা কুরআনে যা পেয়েছি তাই মানুষের জন্য যথেষ্ট সাবধান কুরআন হালাল ও হারাম বলে ঘোষণা রুরেছে। তা যেমনি অনুসরণযোগ্য, ঠিক তেমনি আমি যা বৈধ ও অবৈধ বলে ঘোষণা করেছি, তাও তেমনি অনুসরণযোগ্য। -ইবনে মাজাহ্‌

অপর একটি হাদীসে উল্লেখ আছে যে, ‘এমন একদিন আসবে যখন লোকেরা সোফাসেটে হেলান দিয়ে বসে হাদীস অমান্য করার ঘোষণা দেবে, তোমরা কখনও তাদের অনুসরণ করো না। তারা আমার নিকট হতে দূরে এবং আমিও তাদের নিকট হতে দূরে। -ইবনে মাজাহ্‌

প্রকৃতপক্ষে সুন্নাহকে আইনের উৎস হিসাবে গ্রহণ করা না হলে কুরআনকে আইনের উৎস হিসাবে গ্রহণ করার কোন পথ থাকে না। কারণ কুরআনে অনেক ক্ষেত্রে জীবনের বিভিন্ন আইনের মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে এবং হাদীস তার কার্যকর করার ব্যাপক বিধান পেশ করেছে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ নামায ও যাকাতের কথাই ধরা যেতে পারে। কুরআনে অসংখ্য আয়াতে নামাযের উপর আলোচনা রয়েছে এবং বহু আয়াতে যাকাতের কথা বর্ণিত হয়েছে কিছু নামায আদায়ের বিস্তারিত বিবরণ ও বিভিন্ন দ্রব্য ও জীবের যাকাতের পরিমাণ একমাত্র সুন্নাহ মারফত জানা যায়। তাই কুরআনকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করার সাথে সাথে সুনাহ্কে অবশ্যই আইনের অন্যতম উৎস হিসেবে গ্রহণ করতে হয়।

আইনগত মর্যাদার দিক থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জিন্দিগীকে চার ভাগে বিভক্ত করা যায়.

(ক) এমন কাজ যা হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন এবং অপরকে করার জন্য তাকীদ করেছেন এবং কখনও পরিত্যাগ করেননি, ইসলামী শরীয়তে তাকে ওয়াজিব বলা হয়ে থাকে।

(খ) কোন কাজ হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন এবং অপরকে করার জন্য তাকীদ করেছেন। মাঝে মাঝে নিজে পরিত্যাগও করেছেন, আইনের পরিভাষায় একে বলা হয়ে থাকে সুন্নাতে যুয়াক্কাদাহ্‌।

(গ) কোন কোন কাজ হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন কিন্তু অপরকে করার জন্য তাকীদ করেননি। শুধু ফযীলত বর্ণনা করেছেন৷ ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় একে বলা হয় মুস্তাহাব।

(ঘ) কোন কোন কাজ মানুষ হিসেবে ও আরবের বাসিন্দা হিসেবে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন৷ অপরকে করার জন্য তাকীদও করেননি, এবং ফযীলত বর্ণনাও করেননি। ইসলামী পরিভাষায় এর মর্যাদা সুন্নাত নয় বরং আদাত। আদাতুন নবীর অনুসরণের ক্ষেত্রে কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুহব্বতে যদি কেউ অনুসরণ করে তবে তাকে বিদ্রূপ করা চলবে না, বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মহব্বতে আদাতুননবীর অনুসরণ করা উত্তম। ইসলামে সর্ববাদী সম্মত আইনের নির্ভুল উৎস হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ।

ইজমা ও কিয়াসের শুরুত্ব ও সংজ্ঞা

আইনের ৩য় ও 4র্থ উৎস ইজমা ও কিয়াস সম্পর্কে কোন কোন মহল আপত্তি উত্থাপন করে থাকেন, এবং তারা বলেন ওহী ছাড়া কোন মানুষের মতকে ইসলামী আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে না! প্রকৃতপক্ষে ইজমা ও কিয়াসকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করার নীতিও কুরআন ও সু্ন্নাহ-র বহির্ভূত নয়। কেননা ইজমা ও কিয়াস তথা ইজতিহাদকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করার নীতিও কুরআন ও সুন্নাহ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে,

হে জ্ঞানী ব্যক্তিগণ! তোমরা এসব ঘটনা থেকে চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো।

হাদীসে ইরশাদ হয়েছে যে, ‘বৃহত্তম দলকে তোমরা অনুসরণ করো।’

হাদীসে উল্লেখ রয়েছে, বিস্বনবী.হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুআজ-কে ইয়ামেনের শাসক হিসেবে প্রেরণের সময় জিজ্ঞেস করলেন,

‘হে মুআজ! কোন্‌ আইনের দ্বারা তুমি তথায় বিচার ফায়সালা করবে?’ তদুত্তরে তিনি বললেন, আল্লাহর.কিতাব। রাসূল বললেন, ‘যদি তাতে না পাও তিমি বললেন, ‘রাসূলের সুন্নাহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি.তাতে না পাও তিনি বললেন, আমি কুরআন ও সু্ন্নাহ-র আলোকে নিজের বিবেক বুদ্ধিমত গবেষণা করে সিদ্ধান্তে পৌছাবো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব শুনে বললেন, আমি সে আল্লাহর প্রশংসা আদায় করছি যিনি তার রাসূলের প্রতিনিধিকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছার তওফিক দিয়েছেন যাতে আল্লাহর রাসূল সন্তুষ্ট হতে পারেন৷

আরও অনেক হাদীস থেকে ইজতিহাদকে আইনের উৎস-হিসেবে গ্রহগের অনুমোদন পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম এক গতিশীল চিরন্তন জীবন পদ্ধতি। আর মানুষের জীবনে অসংখ্য সমস্যার উদ্ভব হয় এবং কুরআন ও সু্ন্নাহ-র মূলনীতির বুনিয়াদে গবেষণার মাধ্যমে নবোদ্ভূত সমস্যার সমাধানে ইজতিহাদের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। ইজতিহাদ আকাশ থেকে কোন দরজা দিয়ে অবতীর্ণ হয় না। তাই ইজতিহাদের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথাটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক। কিনতু তাই বলে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিদের জন্য মুক্ত ইজতিহাদের অধিকার উন্মুক্ত অতীতের চিস্তাবিদদেরসমস্ত গবেষণাকে বাতিল করার জন্যই জরতিহাদের প্রয়োজন নেই। নবীণ অজ্ঞদের গবেষণার চেয়ে প্রবীণ বিজ্ঞদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত অনেক কল্যাণকর আল্লামা ইকবাল বলেন,

চিন্তা ও দৃষ্টির অধিকারী এ যুগের অনভিজ্ঞ গবেষকের চেয়ে পুরাতন যুগের বিজ্ঞ পত্তিতদের,গবেষণালন্ধ সিদ্ধান্ত অনেক উত্তম। এখানে প্রসঙ্গত্রমে উল্লেখযোগ্য গবেষণারও ৩টি দিক রয়েছে

কোন জীবনাদর্শ বা ধর্মসত্য এ নিয়ে গবেষণা করাকে ইজতিহাদ ফিদ্দীন বলা হয়; ইসলাম এ ধরনের কোন গবেষণার পথ উন্মুক্ত রাখেনি। আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দীন হচ্ছে একমাত্র ইসলাম। এ ঘোষণার পর কোন্‌ দীন সত্য এ ব্যাপারে গবেষণার আর কোন অবকাশ নেই।

বিভিনন আয়িস্মায়ে মুজতাহিদীনের অভিমতের ‘মধ্যে কৌন্টি নির্ভুল এ ব্যাপারে গবেষণা করাকে ইজতিহাদ ফিল মাযাহিব বলা ইয়, এক্ষেত্রে বিজ্ঞ ইমামদের উপর আস্থা রেখে অনুসরণ করার পন্থাই উত্তম, তবে কোন কোন ইমামের.সিদ্ধান্ত যদি কিয়াসের বুনিয়াদে হয়ে থাকে, তবে তার খেলাফে কোন হাদীস পাওয়া গেলে হাদীসের অনুসরণ উত্তম, আর যদি ইমামের সিদ্ধান্ত কোন দুর্বল হাদীসের ভিত্তিতে হয়ে থাকে এবং এর বিপরীত কোন সহীহ্‌ হাদীস পাওয়া যায়, তবে এ ক্ষেত্রে সহীহ্‌ হাদীসের অনুসরণ করাই উত্তম, যেমন ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) বলেছেন- যখন আমার কথার বিপরীত কোন হাদীস পাওয়া যাবে, তাকে আমর মাযহার বলে ধরে নেবো। হযরত ইমাম শাফেয়ী যথন আমার কথার বিরুদ্ধে বিশুদ্ধ হাদীস তুমি পাবে, তখন আমার কথাকে প্রাচীর গাত্রে ছুঁড়ে ফেলবে। রত ইজতিহাদ ফিল মাযাহেবের আজকে তেমন কোন প্রয়োজন নেই।

মানব জীবনে নবোদ্ভূত কোন সমস্যার সমাধানে গবেষণায় নিয়োজিত হওয়াকে বলা হয় ইজতিহাদ ফিল মাসায়েল এবং এ ধরনের গবেষণার দ্বার ততদিন উন্মুক্ত থাকবে, যতদিন ইসলাম দুনিয়ায় টিকে থাকবে, এর দ্বার বন্ধ করার মানে হলো ইসলামের গতিশীলতাকে রুদ্ধ করে দেওয়া। মানব জীবনের নবোদ্ভূত সমস্যাবলীর সমাধানের জন্যই ইজতিহাদকে ইসলামী: আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। গবেষণা লব্ধ ইসলামী আইনের ক্ষেত্রে আইনবিদ যখন ঐকমত্য পোষণ করেন, তাকে বলা হয় ইজমা। আর যখন আইনবিদগণ ভিন্নমত পোষণ করেন, তাকে বলা হয় কিয়াস। যেমন ইসলামী আইনের নীতিশাস্তরে উল্লেখ করা হয়েছে,

ইজমার সংজ্ঞা কুরআন ও সুন্নাহ হতে এটি প্রমাণিত সত্য যে, ইসলামী আইনের তৃতীয় উৎস হচ্ছে ইজমা। ইজমার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ঐক্য। ইসলামী আইন শাস্ত্রের পরিভাষায় একই যুগের একনিষ্ঠ সৎ বিজ্ঞ মুজতাহিদদের শরীয়ত সংক্রান্ত কোন কাজ ও কথায় ঐকমত্য গ্রহণ করাকেই ইজমা বলা হয়।

এ প্রসঙ্গে এ কথাটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ইজমা বলতে মূলত মুসলিমের ইজমাকেই বুঝায়। ইজমার সিদ্ধান্তে ইসলামী-জীবন দর্শনে ইলমে মদীনাধীসীদের ইজমা, সমস্ত সাহাবায়ে কিরামের ইজমা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আওলাদের ইজমা, সমস্ত সাহাবায়ে মুজতাহিদীনের ইজমাকে বুঝায়। কিয়াসের সংজ্ঞা কিয়াসের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, তুলনামূলকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বা একটা দেখে আর একটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত করা অন্য অর্থে নিয়ন্ত্রিত করা। আর ইসলামী আইন শাস্ত্রের পরিভাষায় মূল-বিষয়ের সাথে তুলনা করে শাখা প্রশাখা বা অনুরূপ কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাকেই কিয়াম বলা হয়। আর- সাধারণ প্রচলিত অর্থে মানুষের জীবনের কোন সমস্যার ব্যাপারে চিন্তা ও গবেষণা করে কুরআন ও সু্ন্নাহ-র কোন বিশেষ বিধানের উপর তুলনা করে অপর কোন নবোদ্ভূত সমস্যার ব্যাপারে শরীয়তের শর্তানুস্মরে ইজতিহাদের পর যখন মুজতাহিদগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন,.এ ধরনের সিদ্ধান্তকে কিয়াসের উৎস থেকে গৃহীত আইন বল হয়। কিয়াসকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ মূলত সুন্নাহ থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে ইজতিহাদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত এ্রহণের অনুমতি দিয়ে বলেছেন ‘যদি তুমি গবেষণার মাধ্যমে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর, তবুও তুমি গবেষণার পরিশ্রমের এক সওয়াবের অধিকারী হবে। আর যদি নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হও, তবে তুমি দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী হবে।’

ইসলামের আইনের উৎস:হিসেবে ইজতিহাদকে হণ ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে যে, কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা নির্ধারিত কোন আইনকে ইজতিহাদের মাধ্যমে পরিবর্তন করার ইখতিয়ার কারও নেই। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে যে সব সমস্যার সুস্পষ্ট সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না, একমাত্র আইনের সে সব ক্ষেত্রেই ইজমা ও কিয়াসকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করা হবে।

আরো পড়ুন:

 

ইসলামী আইনের বৈশিষ্ট্য

ইসলামী আইনের উৎস সম্পর্কে জানার পর এ পর্যায়ে আমরা ইসলামী আইনের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোই লিপিবদ্ধ করছি।

মানব রচিত আইন ও ইসলামী আইনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যে বৈশিষ্ট্য ইসলামী আইনে রয়েছে তা মানব রচিত আইনে কখনও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে না।

মানব রচিত আইন ও ইসলামী আইনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য

১. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব

১. ইসলামী আইনের প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, মানব রচিত আইনে মানবীয় সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি রয়েছে। মানব রচিত আইন তা রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র যে তন্ত্রই হোক না কেন, এতে মানুষকেই সার্বভৌম শক্তি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কখনও রাজা কখনও প্রেসিডেন্ট বা চেয়ারম্যান, কখনও আইন পরিষদ, কখনও জনগণ আবার কখনও প্রধানমন্ত্রী কখনও কোন বিশেষ সংগঠনের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে। ইসলামী আইনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ আইন কোন মানুষকেই সার্বভৌম শক্তি হিসেবে স্বীকার করে না। ইসলাম চূড়ান্তভাবে একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামীনকেই সার্বভৌম শক্তি বলে ঘোষণা দিয়েছে। মানুষ মরণশীল, মানুষ সসীম; মানুষের জীবন ভূল-ত্রান্তিতে গড়া মানুষ সৃষ্টি জগতেয় কোন কিছুর উপরই সর্বময় কর্তৃত্বের দাবি করতে পারে -না। তাই যুক্তির কষ্টিপাথরেও মানবীয় সার্বভৌমত্কে এহণ করা যেতে পারে না।’

২. চিরন্তন, কালজয়ী ও অপরিবর্তনশীল

ইসলামী আইনের দ্বিতীয় গুরুত্পূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ আইন চিরন্তন, কালজয়ী ও অপরিবর্তনশীল। মানব রচিত আইন বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বর্ণের মানুষের ইচ্ছা অনুসারে বারংবার পরিধর্তিত হতে থাকে৷ অপর পক্ষে ইসলামী আইনকে মানুষের ইচ্ছানুযায়ী পরিবর্তন করা যায় না। ইসলামী আইনের মূল উৎস যেহেতু কুরআন ও সুন্নাহ এবং এর বুনিয়াদ হচ্ছে ওহী, সুতরাং চিরঞ্জীব, অসীম জ্ঞানময়, নির্ভুল, সর্বময়-কর্তৃত্‌ ও নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ প্রদ্ত আইনের মধ্যে কোন পরিবর্তন সাধনের ইখতিয়ার রাজা, প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট বা জনগণের নেই। বরং আল্লাহর খলীফা হিসেবে সব কালে সব যুগে সব দেশে একমাত্র আল্লাহর আইন কার্যকরী করাই হচ্ছে মানুষের প্রধানতম দায়িত্ব। আজক্কাল অনেকের মুখেই ইসলামকে যুগোপযোগী করার কথা শুনা যায়, প্রকৃতপক্ষে এর চেয়ে হাস্যকর অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক কথা আর কিছুই হতে পারে না। যে জনগোষ্ঠী ইসলামকে নিজেদের জীবন-দর্শন হিসেবে গ্রহণ করবে, তারা ইসলামকে যুগের দাসে পরিণত করার দায়িত্ব পালন করবে না। বরং যুগকেই ইসলামের দাবি অনুসারে গড়ে তোলার জন্য সংগ্রাম করবে। সভ্যতার স্রষ্টা যুগ নয় সভ্যতার সৃষ্টি মানুষ যুগ মানুষদ্ুক গড়ে তোলে না বরং মানুষই যুগ্কে গড়ে তোলে। ইসলাম গতিশীল বৈজ্ঞানিক জীবন-দর্শন। সকল যুগের প্রয়োজন পূরণ করার যোগ্যতা একমাত্র ইসলামী জীবন-দর্শনের মধ্যেই রয়েছে। যুগে যুগে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান যুগে যুগে আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক শক্তি ও সম্পদকে মানব-কল্যাণের জন্য ব্যবহারের চিরন্তন মূলনীতি একমাত্র ইসলামী মূল্যবোধের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। তাই ইসলামী আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এই যে, ইসলাম এক চিরন্তন ও কালজয়ী আদর্শ। কালের স্রোতে ভেসে যাওয়া ইসলামের কাজ নয়। কালকে ইসলামী আদর্শ মুতারিক.গড়ে তোলাই হচ্ছে ইসলামের অন্যতম কাজ।

৩. পরিপূর্ণ জীবন পদ্ধতি

ইসলামী আইনের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই-যে, ইসলাম .এক পরিপূর্ণ জীবন পদ্ধতি। মানুষের পূর্ণ জীবনের সামগ্রিক বিধি-বিধান ও তার মূল নীতি ইসলাম পেশ করেছে। মানব রচিত আইনের বিচার-বিশ্লেষণে এ সত্য একান্ত সুস্পষ্টভাবে ধরা দেবে যে, মানুষের চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে যে জীবন ধারা ও আইন রচিত হয়েছে তন্মধ্যে একই দার্শনিকের, কাছে জীবনের সকল দিক ও বিভাগের সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন দার্শনিকদের চিন্তাধারা মতবাদ ও সমাধান সম্পর্কে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, কেউ শুধু রাজনৈতিক সমাধ্যনু দিয়েছেন। আবার কেউ শুধু অর্থনীতি নিয়েই চিন্তা ও গবেষণা করেছেন। আবার কেউ শুধু যৌন জীবনের উপরই গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সমস্ত মতাদর্শের মধ্যে একমাত্র ইন্নুলামই হচ্ছে এমন জীবন ধারা যা মানুষের পরিপূর্ণ জীবন্রে সমাধান পেশ করেছে। আসলে কোন মানুষ ছা ব্যক্তিই হোক আর সমষ্টি হোক বা সংগঠনই হোক না, মানুষের পরিপূর্ণ জীবনের সম্যক উপলব্ধি কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই মানব রচিত মৃতাদর্শ মানুষের পরিপূর্ণ জীবনের সমাধান দিতে পারে না।

৪.অসীম কল্যাণকর ও নির্ভুল

ইসলামী আইনের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ইসলামী আইন অসীম, কল্যাণময় ও নির্ভুল। ইসলামী আইনের মূল উৎস ওহী। আর ওহী বা প্রজ্ঞা একমাত্র আল্লাহর তরফ হুতৈই অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ অসীম ও তীর নির্ভুল জ্ঞানের পরিধি: সীমিত নয়। ভাই অসীমের তরফ থেকে অবতীর্ণ ওহীভিত্তিক ইসলামী আইনই একমাত্র মানুষের নির্ভুল ব্যবস্থা ও অসীম কল্যাণের বিধান দিতে পারে।

৫. সার্বজনীন

ইসলামী আইনের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, এ আইন সার্বজনীন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেহেতু সমগ্র সৃষ্টির মালিক, মনির, স্রষ্টা ও দ্রষ্টা, সমস্ত মাখলুকাতের তিনিই একচ্ছত্র অধিপতি, সমগ্র সৃষ্টির কল্যাণ-অকল্যাণ তার চেয়ে বেশি কারো জ্ঞাত নয়। তিনি যুগ, কাল ও ভৌগলিক সীমার উর্ধ্বে। তার প্রদত্ত আইনই একমাত্র সার্বজনীন আইনের মর্যাদা পেতে পারে। মানব রচিত কোন আক্টুন প্রকৃতপক্ষে সার্বজনীন মর্যাদা লাভ করতে পারে না। লে ৬, নিরপেক্ষ ও উদার

৬. নিরপেক্ষ এবং উদার

ইসলামী আইনের ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য, এ আইন নিরপেক্ষ এবং উদার। আল্লাহ তাআলার প্রাকৃতিক অনুগ্রহ যেমনি সকল মানুষের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করেছেন এবং তার রচিত আইন সকল জাতি সকল মানুষের জন্য সমৃভাবে সুরিচারের দিক্ত়তা বিধান করেছে, কোন গোষ্ঠী বা অঙ্ল বা নী দিদ্যতস্ত মানসিকতার ফলফ্রুতি এ বিধান নয়। তাই এ আইন সমস্ত সং ও পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত। এ কারণেই কুরআন ও সুন্নাহর বুনিয়াদে রচিত ইসলামী আইনই হচ্ছে একমাত্র নিরপেক্ষ ও উদার আইন।

ইসলামী আইনের সংজ্ঞা, উৎস ও বৈশিষ্ট্য জ্ঞানলাভের পর ইসলামী আইনের ক্রমবিকাশের উপর আমাদের জ্ঞান অর্জনও অপরিহার্য।

ইসলামী আইনের ক্রমবিকাশ

প্রকৃতপক্ষে ইসলাম হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত চিরন্তন জীবন বিধান। আম্বিয়ায়ে কিরামগণের প্রতিষ্ঠিত দীন হচ্ছে ইসলাম। ইসলামের আবির্ভাব শুধু ৬ষ্ঠ শতকেই ঘটেনি। হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সমস্ত যুগের নবী ও রাসূলগ্ণ তওহীদ, রিসালত ও আখিরাতের বিশ্বাসের বুনিয়াদে ইসলামী মূল্যবোধ বাস্তবায়িত করেছেন। তবে ক্রমবিকাশের ধারানুসারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে এ পরিপূর্ণতা অর্জন করেছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ ব্যবস্থাকে মানবগোষ্ঠীর জন্য একমাত্র অনুসরণযোগ্য মুক্তির আদর্শ হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জ্বীবদ্দশায় পর্যায়ত্রুমে কুরআনের সূরা ৪ আয়াতগুলো তেইশ বছরের নবুওতের জিন্দিগীতে অবতীর্ণ হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক ও ইসলামী আইনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনের বিভিন্ন স্তরে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা করেন এবং আল্লাহর ওহী অনুসারেই তা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় পর্যন্ত মহাগ্রন্থ আল-কুরআনও গ্রন্থ আকারে লিপিবদ্ধ হয়নি, তবে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম কর্তৃক তা বর্তমান তারতীব অনুসারে অনেক হাফিজের নিকট মুখস্ত আকারে রক্ষিত ছিল। মুসায়লামার যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক হাফিজ শহীদ হলে, কুরআন করীম গ্রদ্থাকারে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার পর হযরত আবূ বকর (রা.)-এর খিলাফতকালেই গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করা হয়। এ গ্রন্থ হযরত আবূ বকর (রা.)-এর পর হযরত উমর (রা.)-এর নিকট রক্ষিত ছিল। অতঃপর হযরত উসমান (রা.)-এর আমলে এর বিপুল সংখ্যক কপি প্রস্তুত করে বিভিন্ন মুসলিম অঙ্গরাজ্যে প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল।

খুলাফায়ে রাশিদীনের যুগ পর্যন্ত কিছু কিছু হাদীস বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট লিখিত ছিল। কিছু হাদীস তখনও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি৷ কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও সাহাবাদের ‘স্মৃতিতে রক্ষিত হাদীসের মাধ্যমেই ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালিত এবং কুরআন, সুন্নাহ ও ইজতিহাদের মাধ্যমেই ইসলামী আইন ব্য কযা ক্মাইয়া যুগে সর্বপ্রথম হাদীস লিখিতভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা এ্রহণ করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে ইমাম মালিক (রহ.) মুয়াত্তা নামে এক বড় হাদীস্র্থ রচনা করেন। সিহাহ্‌ সিত্তাহ্‌ প্রকাশের আগ পূর্যস্ত মুয়াত্তাই ছিল সবচেয়ে প্রামাণ্য ও প্রসিদ্ধ হাদীসখ্রন্থ। পরবর্ত পর্যায়ে বিভিন্ন মুহাদ্দিস অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনার য্নাধ্যমে বহু হাদীস গ্রন্থ যার মধ্যে সহীহ্‌ বুখারী, সহীহ্‌ মুসলিম, সূনানে নাসায়ী, সূনানে আবু দাউদ, সূনানে তিরমিযী ও সূনানে ইবনে মাজাহ্‌ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

উপরোক্ত ছয়খানা-গ্রন্থকেই সিহাহ্‌ সিত্তা বলা হয়। এছাড়া মুসনাদে ইমাম সুন্নাহ, শরহে মায়ানিয়ল আসার হাদীস শা্ত্রের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এতত্তিনন যুগে যুগে হাদীস শান্ত্রের উপর বহু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে। তা কুরআন ও সু্ন্নাহ-র প্রমাণের ভিত্তিতে পরবর্ত স্তরে ইসলামী আইদ ধ্রইও প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। ইমাম মালিক (রহ.)-এর যুগে সর্বপ্রথম একাজ শুরু হয়। ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর যুগে ইসলামী আইন-গ্রন্থ প্রণয়নের কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হয়। যা আইনের বিভিন্ন শাখার উপর মূল্যবান গ্রন্থ রচিত হয়, ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর বিশিষ্ট শাগরিদ ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.), ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) ও ইমাম যুফার (রহ.) এ ব্যাপারে বিশেষ উল্লেখযোগ্য খেদমত আঞ্জাম দেন। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) ও তার অনুসারিগণ এ ব্যাপারে অনেক কাজ করেছেন।

ইসলামী আইনের কভ্রমবিকাশে ও পরিপূর্ণ আইনের রূপদানের ক্ষেত্রে হযরত ইমাম আবু হানীফা, হযরত ইমাম মালিক, হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল ও হযরত ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর নামই শীর্ষস্থানীয়। ইমাম চতুষ্টয়ের অনুসারিগণ আইন গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন। এক্ষেত্রে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কাইয়েম ও উপমহাদেশে হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ্‌ র(রহ.)-এর খেদমত অবিস্মরণীয়।

উমাইয়া যুগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রখ্যাত আইনবিদগণ ইসলামী আইনকে সুবিন্যস্তভতাবে গ্রন্থাবদ্ধ করেন। দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনগুলোকে বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভক্ত করে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন৷ ইসলামী আইন বিষয়ক এসব গ্রন্থের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গ্র্থাবলী হচ্ছে বাহ্রুর রায়েক, দূররুল মুখতার, নাইনুল আওতার, শামী, আলমগীরী, কাজী খান, হিদায়া, শরহে বেকায়া, কান্যুদ্‌ দাকায়েক, মনিয়াতুল মুসাল্লী আল ফিকাহ্‌ আলা মাযাহিবিল আরবায়াহ্‌, জামেউস্‌ সগীর, জামে কবীর, শরহে মুআজউল আসার, ফিক্হুস্‌ সুন্নাহ মুনতাকা ইত্যাদি। ইসলামী আইন বাস্তবায়নে সমস্যা উপসংহারে আধুনিক বিশ্বে ইসলামী আইনের বাস্তব প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু প্রস্তাবনা রেখেই এ নিবদ্ধ সমাপ্ত করছি,

আধুনিক বিশ্বে ইসলামী আইনের বাস্তব প্রয়োগ পদ্ধতি

১. অজ্ঞতা দূরীকরণ

প্রকৃতপক্ষে বর্তমান বিশ্বে ইসলামী আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা আমরা নিজেরাই। সারা বিশ্বে একশ কোটির উর্ধ্বে মুসলমান রয়েছে।

ইসলামী আইন প্রয়োগের ব্যাপারে আমরা মুসলমানরাই ঐক্যবদ্ধ নই এবং এ অনৈক্যের মূল কারণ হচ্ছে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা। অজ্ঞতার চেয়ে বড় দুশমন অজ্ঞতার চেয়ে বড় অভিশাপ আর কিছুই হতে পারে না। আজকের মুসলিম বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যেও অনেকে ইসলামী আইন প্রয়োগের বিরোধিতা করে.থাকেন। সমন লোকদের মতে ইসলাম কোন রাষ্ট্রনেতিক দর্শন নয়৷ বরং একটি ব্যক্তিগত ধর্ম। প্রকৃতপক্ষে মুসলমানগণ যতক্ষণ পর্যন্ত সচেতনভাবে ইসলামকে একটি পরিপূর্ণ জীবন দর্শন হিসেবে উপলকব্ধি.না করবে যতদিন পর্যন্ত একটি রাষ্ট্র দর্শন হিসেবে স্বতঃস্কূর্ভভাবে গ্রহণ না করবে ততদিন পর্যন্ত মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর ইসলামী আইন প্রয়োগ সম্ভব্‌ নয়। ট এজন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর প্রথম.দায়িত্ব হরে মুসলিম দেশগুলোর শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধন করে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা! অজ্ঞতা দূর করে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করাই হচ্ছে মুসলিম জাহানে আজকের সবচেয়ে প্রয়োজন। এ পথেই ইসলামী আইন প্রয়োগের বাস্তব পথ উন্মুক্ত হতে পারে।

২. ইসলামী ঐক্য প্রতিষ্ঠা

ইসলামী আইন প্রতিষ্টার ও প্রয়োগের দ্বিতীয় বাস্তব পন্থা হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের ঐক্য। আদর্শগত গঐক্য স্থাপনে মুসলিম রাষ্ট্রনায়ক ও জনগণ যদি ঐক্যবদ্ধ হয় তবে ইসলামী আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোন সংকটই থাকতে পারে না। বরং মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করলে বর্তমান বিবদমান বিশ্বে শাস্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও মুসলিম বিশ্ব এক উল্লেখযোগ্য অবদান সৃষ্টি করতে পারে।

৩. আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন সংস্থা

ইসলামী আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তৃতীয় বাস্তব পন্থা হচ্ছে, সমগ্র মুসলিম বিশ্বে বিশিষ্ট ইসলামী আইনবিদগণের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা কায়েম করা। এ সংস্থা মুসলিম রাষ্ট্রওলোকে ইসলামী আইন কার্যকরী করণ সম্পর্কে বাস্তবভিত্তিক পরামর্শ ও পরিকল্পনা দান করবে। বর্তমান প্রতিষ্ঠিত রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর একটি শাখা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ সংস্থা গঠিত হতে পারে।

আরো পড়ুন:

আরো পড়ুন:

আরো পড়ুন:

error: Content is protected !!