শুরুর কথা
অসংখ্য প্রশংসা মহান আল্লাহ তাআলার, যিনি আসমান ও যযীনের সমস্ত সম্পদ ও শক্তিকে মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানব জাতিকে সৃষ্টি করে আম্বিয়ায়ে কিরাম মাধ্যমে তাদের হিদায়তের জন্য নিখুঁত, নির্ভুল ও চির-কল্যাণকর জীবন-বিধান ও আইন পেশ করেছেন।
দরূদ ও সালাম সকল আম্বিয়ায়ে কিরাম ও খাস করে শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি, যিনি মানব জাতিকে মানুষের মনগড়া ভ্রান্ত মতবাদের জিঞ্জির থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দেয়া আইনের বুনিয়াদে পুনর্গাঠিত করেছেন। যিনি মিথ্যা মাবুদের পেশকৃত ব্যবস্থাকে পরাজিত ও পরাতুত করে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আরো পড়ুন:
গোটা বিশ্ব যখন মানব রচিত আইনের অক্টোপাশে আবদ্ধ হয়ে চরম অশাস্তি ও অস্থিরতার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে; মানুষ যখন বিভিন্ন মতবাদের স্ষীমরোলারে চরমভাবে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছে; দুনিয়ার চিস্তাশীল দার্শনিকগণ যখন মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের জন্য এক চির-কল্যাণকর আদর্শের সন্ধানে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষারত, নতুন নতুন মত গজিয়ে উঠা প্রাচ্য প্রতীচ্যের ধ্বংসাত্মক মতবাদের দাবানলের তীব্র শিখা মানবতাকে পুড়িয়ে ছারখার করে চলেছে; এমনি যুগ সন্ধিক্ষণে আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার এক বাস্তব উদ্যোগ হিসেবে এই ইসলামী আইনের রূপরেখা বিন্যাসের প্রয়াস।
বর্তমান বিশ্ব
বর্তমান বিশ্ব ও ইসলামী আইনের সম্যক পরিচিতি তুলে ধরা একান্ত প্রয়োজন। সর্বপ্রথমে বর্তমান বিশ্বের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ প্রয়োজন।
বর্তমান বলতে এখানে কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিট বা বছরকে বুঝানো হয়নি, বরং বর্তমান বলতে বর্তমান শতাব্দীকেই বুঝানো হয়েছে। আর বিশ্ব বলতে গোটা পৃথিবীকে বুঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান বিশ্ব প্রাচীন বিশ্ব বলতে আলাদা কোন বন্ধুকে বুঝায় না, প্রাচীন বিশ্ব ও বর্তমান বিশ্বের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অতীতে পৃথিবীতে যে নিয়মে বায়ু প্রবাহিত ছিল, বৃষ্টি বর্ষণ হতো, গাছপালা উৎপাদিত ও দিনরাতের পরিবর্তন হতো, বর্তমান বিশ্বে সে শাশ্বত নিয়মই রয়েছে। আদিকাল থেকে মানব সৃষ্টির যে নিয়ম ছিল আজও এখনও তাই, এর কোন পরিবর্তন নেই। তবুও বর্তমান বিশ্ব শব্দটির একটি আলাদা তাৎপর্য রয়েছে।
প্রাচীন বিশ্ব ও বর্তমান বিশ্ব
প্রাচীন বিশ্বে মানুষ- ঢাল-তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করতো, আজকের বিশ্বে হাইড্রোজেন, এটমবোম, মেশিনগান, আর স্টেনগান দিয়ে যুদ্ধ চলে। বর্তমানে আরো মারাত্মক অস্ত্র তৈরির অশুভ প্রতিযোগিতা চলছে। আগের বিশ্বে এক গ্রামের এক অংশে দুর্ঘটনা ঘটলে গ্রামাঞ্চলে মানুষ সহজে তা জানতে পারত না, আজকের বিশ্বের এক প্রান্তে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তা অপর প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে৷ প্রাচীন বিশ্বের লোকচক্ষুতে যে সব মহিলা নেচে গেয়ে বেড়াতো তাদেরকে নটী বলে আখ্যায়িত করতো, আজকের বস্তুবাদী দর্শনে বিভ্রান্ত,লোকেরা তাদেরকে শিল্পী ও তারকা বলে আখ্যায়িত করে। আগের বিশ্বে নগ্নতা ও অর্ধনগ্নতাকে বর্বরতা ও পাশবিকতা বলে আখ্যায়িত করতো, আজকের বিশ্বে এটা সভ্যতা বা প্রকৃতির নিদর্শন বলে স্বীকৃত লাভ করেছে। বিবর্তনের হেরফেরে নৈতিকতা প্রশ্নে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে।
আরো পড়ুন:
প্রাচীন বিশ্বে যারা ধার্মিক নীতিবান ছিলেন, তাদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখা হতো, বর্তমান বিশ্বে পাশ্চাত্য দর্শনের অনুসারীরা তাদেরকে অন্ধ বিশ্বাসী, প্রতিক্রিয়াশীল ও গৌড়া বলে আখ্যা দিয়ে থাকে। বর্তমান বিশ্ব যাস্ত্রিক- উন্নয়নের যুগ হয়েও বিভিন্ন মতবাদ, হিংসা, বিদ্বেষ, মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা ও ব্যবহার বর্তমান পৃথিবীকে এক বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে, মানব জাতি হয়ে পড়েছে দিশেহারা। তাই আজকের বিশ্বে ইসলামী মূল্যবোধ ও ইসলামী আইন প্রয়োগযোগ্য কিনা ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাস্তব অসুবিধাগুলোই বা কি ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার সংকটই বা কোথায় এসব বিষয়ের উপরই আমাদেরকে দৃষ্টিপাত করতে হবে।
ইসলাম ও পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলামী আইনের সংজ্ঞা তুলে ধরার পূর্বে আমাদেরকে প্রথমে উপলব্ধি করতে হবে ইসলাম কি আজকের পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সত্যতার পূজারী ও বৈরাগ্যবাদীদের মতবাদ হচ্ছে, ‘ইসলাম একটি ধর্ম মাত্র’। ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনীতির কোন অস্তিত্ব নেই। এমনকি রাজনৈতিক দলের নেতা, সাহিত্যিক, কবি সাংবাদিকদের মধ্যেও এ ধরনের যথেষ্ট সংখ্যক ব্যক্তি রয়েছেন, যারা ইসলামী রাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী নয়, মুসলিম জাতির মধ্যে এমন ধরনের লোক রয়েছেন, যারা প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিশ্বাসী এমন লোকেরা ক্ষমতাসীন হয়ে, ক্ষমতা ও প্রশাসন যন্ত্রের অপব্যবহারের মাধ্যমে ধর্ম থেকে রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন রাখার পদ্থাও গ্রহণ করে থাকেন৷ ইসলাম সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান থাকলেও তারা মুসলমান হয়ে ইসলামকে শুধু ব্যক্তি জীবনের ধর্মমত বলে প্রচার করতে পারতেন না।
আরো পড়ুন:
মূলত ইসলাম মানব জাতির জন্য এক পরিপূর্ণ জীবন বিধান। আল-কুরআন ও হাদীসে ব্যক্তি, সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র, ব্যবসায়-বাণিজ্য, যুদ্ধনীতি, আন্তর্জাতিক তথা জীবনের সামগ্রিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবন এক অবিভাজ্য সত্তা। মানুষের বুনিয়াদে ইবাদতের নিয়ম কানুন কুরআন হাদীসে যেমন রয়েছে, তেমনি সমাজ, রাষ্ট্র, লেনদেন, বিচার, শাসন, শাস্তি প্রভৃতি আইন বিধানের ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। ইবাদত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের মধ্যে ইসলাম কোন পার্থক্য সৃষ্টি করেনি বরং পরিপূর্ণ জীবনে ইসলামী মূল্যবোধের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার, প্রশাসন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় বিধান সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে।
ইসলাম নিছক কোন ব্যক্তি জীবনের ধর্মমত নয়, ইসলাম হচ্ছে গোটা মানব জীবনের জন্য এক সার্বজনীন চিরন্তন চিরকল্যাণকর, ভারসাম্যমূলক, সামঞ্জস্যশীল ও সুবিচারপূর্ণ জীবন বিধান। ব্যবস্থা, জনগণ ও সরকারের অধিকার ও কর্তব্য তথা জীবনের সকল দিক ও বিভাগের জন্য কুরআন ও সুন্নাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থার নামই হচ্ছে ইসলামী শরীয়ত বা আইন।
ইসলামী আইনের মূল উৎস
ইসলামী আইনের মূল উৎস হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ এবং কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক ইজতিহাদলব্ধ ইজমা ও কিয়াস। আইন মানুষের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ, মনুষ্য অধিকারের দ্বাররক্ষী, সুশৃঙ্খল সমাজ প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি। মুসলিম মিল্লাত হিসেবে মুসলমানদের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে পরিপূর্ণ জীবনকে আল্লাহর আইনের আনুগত্য করা। জীবনধারাকে ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে গড়ে তোলা ও ইসলায়ী জীবনাদর্শকে বাস্তবায়িত করে সামগ্রিক জ্বীবন থেকে ইসলাম বিরোধী ব্যবস্থাকে অপসারণ ও আল্লাহর বিধানকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
আরো পড়ুন:
আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করে তাদেরকে বাধাহীন অশ্বের মতো ছেড়ে দেননি। তাদের জীবনকে শাশ্বত হিদায়েতের বুনিয়াদে পরিচালনা করার জন্য যে ব্যবস্থা তাওহীদ, রিসালত ও আখিরাতের ঈমানের বুনিয়াদে দিয়েছেন তাই হচ্ছে দীন। আর দীনকে পরিপূর্ণ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে বিধি-বিধান ও ব্যবস্থা প্রদান করেছেন তাই হচ্ছে ইসলামী শরীয়ত বা ইসলামী আইন। ইসলামী আইনকে স্বতঃস্কূর্তভাবে নিঃসংকোচে যে সমাজে ও রাষ্ট্রে ইসলামী জীবনধারা তথা ইসলামী শরীয়ত ও আইনকে কার্যকর ও বাস্তবায়িত করে পরিপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামী অনুশাসনকে মেনে চলে, তাকেই বলা হয় ইসলামী সমাজ ও ইসলামী রাষ্ট্র।
ইসলামী রাষ্ট্রনীতি ও আইন ব্যবস্থার গুরুত্ব
ইসলামী রাষ্ট্রনীতি ও আইন ব্যবস্থার গুরুত্ব ও ইসলামী জীবন দর্শনের মৌল বিশ্বাস হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করে তাদের সমষ্টিগত জীবন ধারাকে নির্ভুল আদর্শের বুনিয়াদে পরিচালনা করার হিদায়েতের ব্যবস্থা দিয়েছেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাম-কে পৃথিবীতে প্রেরণের সময় এ চিরন্তন ফরমান জারী করে পাঠানো হয়েছে
قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى
‘আমি বললাম, তোমরা আমার এ জান্নাত থেকে বেরিয়ে বিশাল যমীনে ছড়িয়ে পড়; অতঃপর অবশ্যই তোমাদের জীবন পরিচালনার জন্য আমার তরফ থেকে আসবে নির্ভুল হিদায়েত।’ (আল-কুরআন, সূরা আল-বাকারা: ০২ : ৩৮)
ইসলামের এই হিদায়েতের উল্লেখ কোন ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয় বরং গোটা মানব জাতির জন্য। প্রকৃতপক্ষে শুধু ব্যক্তির পেশকৃত কোন নীতিকে মানবতার নীতি হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে না।
আরো পড়ুন:
মাতৃক্রোড় থেকে শিশুর বিচ্ছিন্নতার কল্পনা যেমনি অবান্তর ঠিক সমাজ জীবন থেকে ব্যক্তি জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখাও তেমনি অসম্ভব। ইসলামের কোন বিধানই শুধু ব্যক্তিকে সম্বোধন করে অবতীর্ণ করা হয়নি। এমনকি বুনিয়াদী ঈমান ও ইবাদতের আহ্বান ও সমষ্টিকে ঘোষণা করে নাযিল করা হয়েছে। আল-কুরআনের বিধানকে সমষ্টিগতভাবে মেনে চলার ঘোষণা দিয়ে ইরশাদ হচ্ছে,
اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ
যা তোমাদের নিকট অবতীর্ণ করা হয়েছে তার বিধান মেনে চলা ছাড়া অন্য কোন নেতার বা পৃষ্ঠপোষকদের অনুসরণ করো না। (আল-কুরআন, সূরা আল-আরাফ : ০৭ : ১৫১)