আইন ও ইসলামি আইন | Law and Islamic Law
আইন শব্দ পরিচিতি
আইন শব্দটি বহু পুরাতন ফারসি শব্দ। আব্বাসি যুগে সাধারণভাবে এ শব্দ ‘কানুন, প্রথা, দেশাচার ও নিয়ম’ অর্থে ব্যবহৃত হতো।[1]
আইন-এর প্রাচীন উৎস
হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীতে (সালে অষ্টম শতাব্দী) ইবনুল মুকাফ্ফা কর্তৃক সংকলিত পাহলবি থেকে আরবিতে অনূদিত গ্রন্থসমূহের তালিকায় আইন নামাহ নামক একটি গ্রন্থেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। এই নামের অনুবাদ অনেক সময় আরবিতে ‘কিতাবুর রুসুম’ করা হয়েছে। খুদাঈ নামাহর মতো এই গ্রন্থও অর্ধ-সরকারি মর্যাদাসম্পন্ন ছিল। এতে সম্ভবত সাসানি শাসন ব্যবস্থা ছাড়াও উচ্চতর শ্রেণির লোকদের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ অধিকারের উল্লেখ ছিল। এতে দরবারি জীবনের ও দরবারি আদব-কায়দা ও রীতিনীতির বিস্তারিত বর্ণনাও ছিল। এজন্যই Christensen এই শব্দকে পুরাতন বাদশাহি কর্মসূচি (L’Almanach royal) নামকরণ করেছেন। এর অধিকাংশ প্রবন্ধই শিক্ষাপ্রদ ও উপদেশমূলক ছিল। ইবনে কুতায়বা রচিত উয়ূনুল আখবার’ নামক গ্রন্থে আইন নামাহর উপরিউক্ত অনুবাদের কয়েকটি উদ্ধৃতি রক্ষিত আছে। Inostranzev এই গ্রন্থে আলোচিত যুদ্ধবিদ্যা, তিরন্দাজি, পোলো খেলা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন।
এটা সম্ভব যে, এই বিরাট সরকারি আইননামার সঙ্গে বিন্যস্ত বিশিষ্ট বিষয়সমূহ সংবলিত পৃথক পৃথক সংক্ষিপ্ত পুস্তিকা বর্তমান ছিল যাতে দরবারি জীবনের শিক্ষার প্রতিটি দিকের উপর স্বতন্ত্র আলোচনা ছিল। আল-ফিহরিও-এ উল্লিখিত আরও কয়েকখানি গ্রন্থের নাম পাঠ করলে উপরিউক্ত ধারণাই জন্মে। উদাহরণ, আইনুর-রাম্ই’ (তিরন্দাজির নিয়ম) ও আইনুদ-দাব বিস-সাওয়ালিজা (গল্ফ খেলার নিয়ম)। এটাও ধারণা করা যায়, এগুলো বৃহৎ আইন নামাহ-র খণ্ড বা তা থেকে সংকলিত গ্রন্থ। আল-মাসউদিও[2] সাসানি আইননামা উল্লেখ করেছেন। আল-জাহিজ-এর ‘কিতাবুত-তাজ ফি আলাকিল মুলুক’-এ যেখানে সাসানিদের আইন ও আদব সম্বন্ধে বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়, সেখানে আইনুল ফুস নামক গ্রন্থেরও উল্লেখ দেখা যায়, যদিও তা থেকে সরাসরি কোনো উদ্ধৃতি দেওয়া হয়নি।
পরবর্তীকালে ফারসি ভাষায় রচিত অন্যান্য গ্রন্থও আইন নামে অভিহিত হয়েছিল। এই সমস্ত গ্রন্থের বিষয়বস্তু ছিল ইসলামি ইতিহাস, ইসলামি নিয়মকানুন ও প্রথা। যথা, আবুল ফাদল কর্তৃক ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত আকবরনামা’র ওই অংশের নাম আইনে আকবরি’ যেখানে বাদশাহ আকবরের দরবারের আদব ও রীতিনীতির বর্ণনা আছে।
ইসলামি আইনের লিখিত ব্যাখ্যার সূচনা
কিন্তু বহু পূর্বেই ইসলামি আইনের লিখিত ব্যাখ্যা প্রদানের কাজ শুরু হয়েছে, বাদশাহ আকবরের সময় থেকে নয়। ‘আল-মাওয়ারদি আশ-শাফিয়ির আল আহকামুস সুলতানিয়্যা’ ও তার সমসাময়িক আবু ইয়ালা আল-ফারা আল-হাম্বলির একই নামীয় (আল-আহকামুস সুলতানিয়্যা) গ্রন্থেও হিজরি পঞ্চম শতাব্দীর এবং আরও পরবর্তীকালের নজির রয়েছে। সর্বপ্রথম ইসলামি আইন স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগেই প্রথম হিজরি সালে তার মদিনায় আগমনের সঙ্গে-সঙ্গেই বিধিবদ্ধ ও কার্যকরী হয়েছিল। এটাই ছিল কোনো শাসনকর্তার পক্ষ থেকে বিধিবদ্ধ ও জারিকৃত পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত আইন। অ্যারিস্টটলের আইনগ্রন্থ অ্যাথেন্সে পাওয়া যায়, কিন্তু এটা কোনো শাসনকর্তার পক্ষ থেকে জারিকৃত আইন ছিল না। এটা এক দার্শনিকের অভিজ্ঞতা ও আইন-সংক্রান্ত প্রথা সম্বন্ধে পূর্বোল্লিখিত আইনগুলোকে ইতিহাস রক্ষা করেছে। তার পাঠ ইবনে ইসহাক, ইবনে খায়সামা ও আবু উবায়দের বর্ণনা পরম্পরায় বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। ৫২তম দফায় এই সংবিধান দেশে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক জাতি প্রতিষ্ঠার উল্লেখ রয়েছে। এই জাতি মুসলিম ও অমুসলিম প্রজা দ্বারা গঠিত হয়েছিল। এরপর, পরিচালক ও পরিচালিতদের অধিকার, কর্তব্য, সুবিচার আইন গঠন, বিদেশের সাথে সন্ধি ও যুদ্ধ, ধর্মীয় স্বাধীনতা, অমুসলিম প্রজাদের অধিকার ও বৈশিষ্ট্য, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অপর এমন সমস্ত সমস্যা সম্বন্ধে এমনসব বিধান এতে রয়েছে—যা সেসময় মদিনার নাগরিক জীবনব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন ছিল। সুবিচার স্থাপনের এমন একটি বৈপ্লবিক আদেশও দৃষ্টিগোচর হয় যে, বিচারক আদালতের কাজ শুধু সত্য প্রকাশের জন্যই করবেন না; বরং সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যও করবেন। পাশাপাশি অধিকার প্রদান শুধু ব্যক্তি বিশেষের কাজ নয়; বরং তা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনের কাজ। আইন রচনার কাজে প্রথা, দেশাচারের ও পঞ্চায়েতের মত প্রদানের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় বিধানদাতাকে প্রতিটি ব্যাপারে আইন গঠন ও আদেশ প্রদানের অধিকারপ্রাপ্ত ও ক্ষমতাসম্পন্ন বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
আধুনিক যুগে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের লিখিত সংবিধানের রচনা শুরু করা হয় তুর্কি সুলতানগণ কর্তৃক। রাজনৈতিক পরাধীনতার ফলে মানসিক পরাধীনতা সৃষ্টি হওয়ায় কতক মুসলিম রাষ্ট্রে পাশ্চাত্যনীতিকে ভিত্তি করে সংবিধান প্রণয়ন ও কার্যকরী করা হয়। কিন্তু ক্রমশ ওগুলোর অনৈসলামিক অংশগুলোর সংশোধনের দিকে মনোযোগ আকৃষ্ট হয়ে চলেছে।
ইসলামি আইন
ইসলামি আইন পরিচিতি
ধর্মই হলো আইনের মূল ও আদি উৎস। ধর্মই মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে আইন মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। ধর্মই মানুষকে সুষ্ঠু, সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে। আদি মানব হযরত আদম আলাইহিস সালাম-কে আল্লাহ তাআলা প্রয়োজনীয় জ্ঞান দান করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। যেমন, কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে, আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম (বস্তুজগতের জ্ঞান) শিক্ষা দিলেন’।[3]
কারণ তিনি ছিলেন পৃথিবী নামক এই জগতে তার প্রেরিত প্রতিনিধি। যেমন, কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে,
আর যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই’।[4]
সুতরাং পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করতে হলে এই পার্থিব সমাজ পরিচালনার জন্য আদম আলাইহিস সালাম-এর প্রয়োজন ছিল কিছু নিয়মকানুন ও বিধিব্যবস্থার। তাই আদম দম্পতিকে পৃথিবীতে প্রেরণকালে আল্লাহ তাআলা বললেন,
‘যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট পথনির্দেশ আসবে, তখন যারা আমার পথনির্দেশ অনুসরণ করবে–তাদের জন্য কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না’।[5]
বস্তুত এই পথনির্দেশই (হিদায়াত বা Guide) হলো আধুনিক পরিভাষায় আইন বা নিয়ম-কানুন। পৃথিবীতে মানবজাতির বিস্তৃতির সঙ্গে-সঙ্গে আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করে তাদের মাধ্যমে মানুষের প্রয়োজনমাফিক নিয়ম-কানুন পাঠাতে থাকেন। নবীগণের উপর নাযিলকৃত আসমানি কিতাবসমূহই হলো উক্ত আইনের সমষ্টি। আদি আসমানি কিতাবসমূহের মধ্যে যেগুলোকে বর্তমানেও আসমানি কিতাব বলে শনাক্ত করা যায়, যেমন তাওরাত, যাবূর, ইনজিল ইত্যাদি, সেগুলোর মধ্যেও প্রচুর সামাজিক বিধিমালা বিদ্যমান আছে। এই আসমানি কিতাবসমূহের সর্বশেষ হলো আল-কুরআন। আল-কুরআন মানবজাতির জন্য আইনের এক ব্যাপক ভিত্তি রচনা করেছে, ইসলামের পরিভাষায় এটা ইসলামি আইন নামে পরিচিত।
বর্তমান কালে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে যে আইন কাঠামো দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, দেশ-কাল ও জাতিভেদ সত্ত্বেও তাদের মধ্যকার প্রচলত আইনের মধ্যে ব্যাপক আন্তঃসামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। এর প্রধান কারণ হলো, প্রথমত গোটা মানবজাতি আল্লাহর পক্ষ থেকে একইরূপ বিধান লাভ করেছিল। তারা ছিল এক অভিন্ন উম্মত।
‘মানবজাতি ছিল এক উম্মতভুক্ত’।[6]
কালের প্রবাহে তারা পথভ্রষ্ট হয়ে উক্ত ঐশী আইনে হস্তক্ষেপ করে নিজেদের পছন্দমতো তাতে রদবদল করতে থাকে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে প্রচলত বিধিমালার মধ্যে যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, তার প্রধানতম কারণ হলো ঐশী আইনে মানুষের উক্ত হস্তক্ষেপ । কুরআন মাজিদে এর সাক্ষ্য বিদ্যমান।
‘ইহুদিদের মধ্যে কতক লোক কথাগুলো স্থানচ্যুত করে বিকৃত করে’[7]; আরও দ্রষ্টব্য সূরা আল-মায়িদাহ : ( ০৫ ) : ১৩, ৪১; সূরা আল-বাকারা : ( ০২ ) : ৭৫ ।
দীন ইসলামই হলো একমাত্র জীবনব্যবস্থা যা মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনকে একই সূত্রে ধরে রাখে। মানুষের এই দ্বিবিধ সম্পর্কের পরিগঠন ও পরিশীলনের জন্য ইসলামি শরিআতে যেসকল নিয়ম-কানুন ও নীতিমালা বিধিবদ্ধ রয়েছে তাই ‘ইসলামি আইন’।
ইসলামি আইনের প্রধানতম দুটি উৎস : মহান আল্লাহর কিতাব আল-কুরআন’ ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘হাদিস’। প্রথমোক্ত উৎসে সমাধান না পাওয়া গেলে দ্বিতীয় উৎসে তা অনুসন্ধান করতে হবে। এই উৎসেও সমাধান না পাওয়া গেলে ইজতিহাদের পালা আসবে। প্রথমোক্ত উৎসদ্বয়ের সাথে প্রায় সকলেই পরিচিত। তাই আমরা এখানে আলোচনা করব ক্রমানুসারে ‘ইজমা, কিয়াস, ইসতিহসান, মাসালিহ মুরসালা, উরফ (প্রথা), ইজতিহাদ ও ইসতিদলাল সম্পর্কে। শেষোক্ত দুটি বিষয় আইনের উৎস নয়; বরং ইজতিহাদ বলতে আইন-সংক্রান্ত গবেষণা বুঝায় এবং ইসতিদলাল বলতে গবেষণার অনুকূলে যুক্তি প্রদানকে বুঝায়।
ইজমা
ইসলামি আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো ইজমা। এর সংজ্ঞা নির্ধারণে ফকিহগণের মতভেদ আছে। ‘নির্দিষ্ট কোনো যুগে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে সমকালীন ফকিহগণের ঐকমত্যকে ইজমা বলে’।
কুরআন মাজিদ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ দ্বারা ইজমার বৈধতা প্রমাণিত। মহান আল্লাহর বাণী :
‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসূলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের মধ্যকার কর্তৃত্বের অধিকারীগণের।’[8]
‘তোমরা যদি না জানো, তবে জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা করো।’[9]
নবীজি সা. বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لَا يَجْمَعُ أُمَّتِي أَوْ قَالَ: أُمَّةَ مُحَمَّدٍ عَلَى ضَلَالَةٍ وَيَدُ اللَّهِ عَلَى الْجَمَاعَةِ وَمَنْ شَذَّ شَذَّ فِي النَّار.
আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতকে কখনো অন্যায়ের উপর ঐক্যবদ্ধ করবেন না। আল্লাহ (হেফাজতের) হাত ঐক্যবদ্ধদের উপর প্রসারিত।[10]
‘সাবধান! তোমরা বিচ্ছিন্ন (গিরি) পথে যাবে না। তোমরা অবশ্যই ঐক্যবদ্ধভাবে এবং জনসাধারণের সাথে থাকবে।’[11]
مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ شبْرًا فقد خلع رقة الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ .
‘যে ব্যক্তি মুসলিম সমষ্টি থেকে বিঘত পরিমাণও পৃথক হয়ে গেল–সে নিজের ঘাড় থেকে ইসলামের বন্ধন ছিন্ন করল।’[12]
ইজমার সমর্থনে কুরআন-সুন্নাহতে অনুরূপ অনেক উক্তি বিদ্যমান আছে। আল্লাহ তাআলা ইসলামকে পরিপূর্ণ ও চিরস্থায়ী একমাত্র দীন এবং হযরত মুহাম্মাদ সা.-কে সর্বশেষ নবী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। মানবজাতির দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রতিনিয়ত যে অসংখ্য আইনের প্রশ্ন উত্থিত হচ্ছে, কুরআন-সুন্নাহতে তার প্রত্যক্ষ ও ব্যাপক সমাধান বিদ্যমান নেই। এই অবস্থায় উক্ত দুটি উৎসের আলোকে উদ্ভূত বিষয় সম্পর্কে আইন প্রণয়নের এখতিয়ার মানুষকে দেওয়া হয়েছে। এমন অনেক বিষয় আছে যে, সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহ নীরব। এই নীরবতা সরাসরি এই কথার প্রমাণ বহন করে, মহান আইনদাতা আল্লাহ এক্ষেত্রে মানুষকে নিজস্ব রায় বা বুদ্ধির প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার প্রদান করেছেন।
হানাফি, মালিকি, শাফিয়ি ও হাম্বালি মাযহাবমতে সমকালীন মুজতাহিদ ফকিহগণের সকলে কোনো বিষয়ে একমত হলে চূড়ান্ত ইজমা গঠিত হয়। অবশ্য অধিকাংশ ফকিহ একমত হলেও ইজমা গঠিত হতে পারে। হানাফি, শাফিয়ি ও মালিকিগণ মনে করেন, ‘যার একমত হতে পারেননি, তারা সংখ্যায় খুব বেশি না হলে অধিকাংশের ঐকমত্য ইজমা হিসেবে গণ্য হবে। এটাকে চূড়ান্ত ইজমা বলা যাবে না বটে; কিন্তু এটা মান্য করা বাধ্যতামূলক। রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে একজন ফকিহ হয়তো ভুল করতে পারেন, কিন্তু যখন বহুসংখ্যক ফকিহ একত্র হয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন তাদের মতের বিশুদ্ধতা মেনে নেওয়া যায়।’
হানাফি, মালিকি ও অধিকাংশ শাফিয়ি ফকিহর মতে যথেষ্ট সময় নিয়ে মুজতাহিদ ফকিহগণ পূর্ণ বিচার-বিবেচনা করে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে-সঙ্গে তা ইজমায় পরিণত হয়। এমতাবস্থায় তাদের মত পরিবর্তনের আর অবকাশ থাকে না এবং তারাও তা মানতে বাধ্য। হাম্বালি ও কতিপয় শাফিয়ি ফকিহ বলেন, ‘ঐকমত্যে উপনীত হওয়া ব্যক্তিগণের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তা ইজমার মর্যাদা লাভ করবে না। কারণ তাদের কেউ বা সকলে জীবদ্দশায় যেকোনো সময় স্বীয় মত পরিবর্তন করতে পারেন। সুতরাং তাদের সকলের মৃত্যুর পরই তাদের সিদ্ধান্ত ইজমার মর্যাদা লাভ করবে।’
এককালের ইজমা প্রয়োজনবোধে পরবর্তীকালের ইজমা দ্বারা রহিত হতে পারে। এটি ইসলামি আইনের স্থিতিস্থাপকতা প্রমাণ করে। বস্তুত স্থানিক, কালিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত মুজতাহিদ ফকিহগণের উপর প্রভাব ফেলতে বাধ্য। কারণ তারা সর্বপরিণামদর্শী নন। স্থান-কাল ও প্রেক্ষিত পরিবর্তিত হলে পূর্ববর্তী ইজমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবি রাখে। এরূপ অবস্থায় পূর্ববর্তী ইজমার কার্যকারিতা থাকবে না। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবিগণের ইজমা পরবর্তীকালেও রহিত করা যায় না। তাদের ইজমার অনুসরণ উম্মতের জন্য বাধ্যতামূলক।
ইমাম শাফিয়ি রহ. বলেন, ‘যেসকল বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবিগণ একমত হতে পারেননি, সেসকল বিষয়ে পরবর্তীকালের ইজমা বৈধ নয়। কিন্তু হানাফি ফকিহগণের মতে কোনো বিষয়ে সাহাবিগণ একমত থেকে না পারলে–পরবর্তীকালের মুজতাহিদগণের সেই বিষয়ে একমত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। মালিকি ফকিহগণও অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন। তবে তাদের মতে এরূপ ঘটনা বিরল। কোনো বিশেষ যুগে একটি বিষয় সম্পর্কে দুটি মত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে সেই বিষয়ে তৃতীয় মত গ্রহণ সংগত নয়। যেমন, গর্ভবর্তী বিধবার ইদ্দতের মেয়াদ সম্পর্কে দুটি মত বিদ্যমান :
(১) সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তার ইদ্দত শেষ হয়ে যাবে।
(২) সন্তান প্রসব অথবা স্বামীর মৃত্যুর তারিখ থেকে চার মাস দশ দিন—এই দুটি মেয়াদের মধ্যে দীর্ঘতর মেয়াদটি হবে উক্ত নারীর ইদ্দতকাল।
ইজমা বাচনিকও হতে পারে, আচরণগতও হতে পারে। ফকিহগণ একত্রে বসে আলোচনার মাধ্যমে কোনো বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত হলে–তা বাচনিক (কাওলি) ইজমা হিসেবে গণ্য। একই সমাবেশে একদল ফকিহ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করোলে এবং উপস্থিত অপর দল ফকিহ নীরব থাকলে সেই অবস্থায়ও মৌখিক ইজমা গঠিত হতে পারে। কোনো বিষয়ে সকল মুজতাহিদ একইরূপ আচরণ করলে এবং অপরাংশ তার প্রতিবাদ না করলে; এই অবস্থায় যে ইজমা গঠিত হয়–তাকে কর্মগত (ফে’লি) ইজমা বলে। এই উভয় প্রকার ইজমার প্রথম অবস্থাকে আযিমাত (অটল) এবং দ্বিতীয় অবস্থাকে রুখসাত (ঐচ্ছিক) ইজমা বলে। হানাফি, মালিকি ও কিছুসংখ্যক শাফিয়ি ফকিহ আযিমাত ও রুখসাত উভয় প্রকার ইজমার অনুসরণ বাধ্যতামূলক বলেন।
খুলাফায়ে রাশিদিনের মধ্যে কোনো খলিফা কোনো আইন প্রবর্তন করলে, আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করলে বা সমাবেশে ভাষণে সেটার ঘোষণা দিলে, তার প্রতিবাদ না হয়ে থাকলে ধরে নিতে হবে, উক্ত বিষয়ে ওই সময়ে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালের শাসকদের বেলায় এরূপ অবস্থায় অনুরূপ আচরণ ইজমা হিসেবে গণ্য হবে না। কারণ খুলাফায়ে রাশিদিনের সামনাসামনি মানুষ যেভাবে নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে, নির্ভয়ে ও নিরাপদে তাদের মতের প্রতিবাদ করতে পারত, সেরূপ অবস্থা তাদের পরে আর অবশিষ্ট থাকে নেই । ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ-এর মতে ইজমাকে কোনো কালের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। যেকোনো কালে পূর্বতন ইজমার অনুরূপ কোনো সমস্যার উদ্ভব হলে পরবর্তী যুগেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে।
কিয়াস
কিয়াস হলো ইজতিহাদের অন্তর্ভুক্ত এবং ইসলামি আইনের ব্যাপকতর ও নেহায়েত গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে স্বীকৃত। কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার পরে কিয়াস হলো ইসলামি ফিকহ-এর একটি উৎস। উদ্ভূত কোনো বিষয়ের সমাধান কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমার মধ্যে পাওয়া না গেলে সেই বিষয়ে কিয়াসের আশ্রয় গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ে অর্থাৎ পূর্বোক্ত তিনটি উৎসে উদ্ভূত কোনো বিষয় সম্পর্কিত বিধান না পাওয়া গেলে কিয়াসের আশ্রয় গ্রহণ করে তৎসম্পর্কিত বিধান প্রণয়ন করা হয় ।
কিয়াস শব্দের আভিধানিক অর্থ অনুমান করা, সামঞ্জস্যপূর্ণ করা, সমন্বিত করা, যুক্ত করা, শুরু হওয়া ইত্যাদি। ফিকহশাস্ত্রে সাদৃশ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নাম কিয়াস (এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Analogy)। যেমন, এমন কতগুলো বিষয় উদ্ভূত হয়েছেগুলো সম্পর্কিত বিধান শরিআতে সরাসরি বিদ্যমান নেই বটে, কিন্তু উক্ত বিষয়গুলোর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কতগুলো বিষয় সম্পর্কিত বিধান বিদ্যমান আছে। এই অবস্থায় প্রথমে বিদ্যমান বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধানাবলির কারণসমূহ নির্ণয় করতে হবে। অতঃপর উক্ত কারণগুলো উদ্ভূত বিষয়ের মধ্যেও বিদ্যমান পাওয়া গেলে সেক্ষেত্রে ওই একই বিধান প্রযোজ্য হবে।
শহিদ আবদুল কাদির আওদাহ বলেন, ‘কিয়াস এই, যে বিষয় সম্পর্কে শরিআতের নস বিদ্যমান নেই, সেই বিষয়কে কারণসমূহের অভিন্নতার ভিত্তিতে এমন একটি বিষয়ের সাথে মিলানো–যার সম্পর্কে শরিআতের নসভিত্তিক বিধান বিদ্যমান আছে।’[13]
আল্লামা বায়যাবি রাহিমাহুল্লাহ লিখেছেন, ‘কারণসমূহের অভিন্নতার ভিত্তিতে একটি বিষয়ের নির্দেশকে অপর বিষয়ের নির্দেশ সাব্যস্ত করার নাম কিয়াস’। মালিকি মাযহাবের ফকিহগণ নিম্নোক্ত সংজ্ঞা প্রদান করেছেন, ‘কারণসমূহ বিবেচনাপূর্বক নির্গত বিধানকে মূল বিধানের সাথে সংগতিপূর্ণ করার প্রক্রিয়াকে কিয়াস বলে।’[14]
যারা কিয়াসকে আইনের উৎস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন, তাদের মধ্যে চার মাযহাবের ইমামগণ উল্লেখযোগ্য। ইবনে হাযমসহ একদল হাম্বালি ফকিহ কিয়াসকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অবশ্য কিয়াস শরিআতের দলিল হওয়ার বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমার অনুকূল সমর্থন বিদ্যমান। মহান আল্লাহর বাণী :
‘অতএব হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।’[15]
অনন্তর কুরআন মাজিদের আরও যেসব আয়াতে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করার আহ্বান জানানো হয়েছে, সেসব আয়াত হতেও কিয়াসের পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়। এই বিষয়ে হাদিস হতেও সমর্থন পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে হাদিসে মুআয ইবনে জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[16]
খুলাফায়ে রাশিদিনের কার্যক্রম হতেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন, হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বিচারপতি শুরায়হ রাহিমাহুল্লাহ-কে লিখিত পত্রে বলেন,
‘কিতাব, সুন্নাত ও প্রবীণদের সিদ্ধান্তের মধ্যেও কোনো সমাধান না পাওয়া গেলে নজিরের অনুসরণ করো।’ (সুনানে নাসায়ি)
যার মধ্যে ইজতিহাদের শর্তাবলি পূর্ণরূপে বিদ্যমান আছে, তিনিই কিয়াস করার যোগ্য বিবেচিত হবেন। কোনো বিষয়ে নসভিত্তিক নির্দেশ বিদ্যমান না থাকলে কেবল সেক্ষেত্রে কিয়াসভিত্তিক নির্দেশ গ্রহণযোগ্য হবে।
ইসতিহসান
ফকিহগণের পরিভাষায় কোনো বিষয়ের দুটি দিকের মধ্যে কোনো একটি দিককে যুক্তিসংগত দলিলের ভিত্তিতে অপর দিকের উপর অগ্রাধিকার প্রদানকে ইসতিসান বলে। ইমাম আবু হানিফা, মালিক ও আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ কোনো বিধান প্রণয়নের জন্য ইসতিহসানকে শরিআতের দলিল (হুজ্জা) মনে করেন। ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত আছে,
‘ইসতিহসান জ্ঞানের উনিশ ভাগের এক ভাগ।’[17]
ইমাম শাফিয়ি রাহিমাহুল্লাহ ইসতিহসানের সমর্থক নন; বরং ঘোর বিরোধী, কঠোর সমালোচক। ইসতিহসান শব্দের অভিধানিক অর্থ কোনো কাজ বা বিষয়কে কল্যাণকর বা ফায়দামূলক মনে করা (আদ্দুশ শায় হাসানান)। সদরুশ শরিআর মতে সুস্পষ্ট কিয়াসের বিপরীত দলিল ইসতিহসান হিসেবে গণ্য (হওয়া দালিল বিমাকাবিলিল কিয়াসিল জালিয়্যি)। ইমাম সারাখসি বলেন, ‘কিয়াস পরিত্যাগ করে মানুষের কল্যাণের সাথে সংগতিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হলো ইসতিহসান (ছওয়া তারকুল কিয়াস ওয়াল-আখযু বিমা হুওয়া আওফাকু লিন্নাস)।’
ইসতিহসানের সমর্থনে অথবা এর প্রতি ইঙ্গিতবাহী আয়াত কুরআন মাজিদে বিদ্যমান আছে। যেমন :
‘অতএব সুসংবাদ দাও আমার বান্দাগণকে, যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে এবং সেগুলোর মধ্যে যা উত্তম, তা গ্রহণ করে।’[18]
‘এবং তোমার সম্প্রদায়কে তার মধ্যে যা উত্তম তা গ্রহণের নির্দেশ দাও।’[19]
নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ থেকে ইসতিহসানের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায় :
‘তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি।’[20]
আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর–তা চান না।’[21]
আল্লাহ কারো উপর তার সাধ্যাতীত কোনো কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না।’[22]
সুন্নাহ থেকেও ইসতিহসানের অনুকূলে সমর্থন পাওয়া যায়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সূত্রে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে,
‘মুসলমানগণ যা উত্তম বিবেচনা করে তা আল্লাহর নিকটও উত্তম।’
হানাফি ফকিহগণের মতে ইসতিহসান ইসলামের সাধারণ নীতিমালারই অনুগত, তার বিপরীত কিছু নয়। যেমন ইসলামের সাধারণ মূলনীতি হলো :
১. ক্ষতিগ্রস্ত হোয়ো না এবং ক্ষতিগ্রস্ত কোরো না।
২. অনিবার্য পরিস্থিতি নিষিদ্ধকে সিদ্ধ করে।
৩. কষ্ট-কাঠিন্য সহজের প্রসূতি।
এই কারণেই প্রসিদ্ধ হানাফি ফকিহ ও মুজতাহিদ আবু বকর আল-জাসসাস রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘যেসব বিষয়ে আমাদের হানাফি ফকিহগণ ইসতিহসানের সমর্থক–তার সবই যুক্তি ও মূলনীতির উপর ভিত্তিশীল। তার কোনোটির মধ্যেই তাদের ব্যক্তিগত ঝোঁক প্রবণতা ও লালসার লেশমাত্র নেই।’
ইসতিহসানের আলোচনা করতে গিয়ে ফকিহগণ কিয়াসকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন, কিয়াসে জালি ও কিয়াসে খাফি। এই বিষয়ে ইমাম সারাখসি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘ইসতিহসান মূলত কিয়াসেরই দুটি দিক। এর একটি হলো জালি–যার প্রভাব দুর্বল এবং একে বলে কিয়াস; অপরটি খাফি–যার প্রভাব শক্তিশালী এবং একে বলে ইসতিহসান।’ (আল-মাবসুত : ১০ খণ্ড : পৃষ্ঠা : ১৪৫)
১. কিয়াসে জালির বিপরীতে নস-এর দৃষ্টান্ত
কিয়াসে জালির বিপরীতে নস-এর প্রমাণ হিসেবে বায়’ সালাম (অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয়)-এর উদাহরণ পেশ করা যায়। কিয়াসে জালি অনুযায়ী এই প্রকারের ক্রয়-বিক্রয় বৈধ হওয়া উচিত নয়। কারণ, যে পণ্য বিক্রয় করা হয়, তা তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্যমান থাকে না, অথচ ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি বৈধ হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট পণ্য বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। কিন্তু এক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিম্নোক্ত বাণীর (নস) ভিত্তিতে কিয়াসকে পরিহার করে ইসতিহসান-কে অনুসরণ করা হয়েছে :
‘যে ব্যক্তি অগ্রিম (ক্রয় করার জন্য) মূল্য প্রদান করে, সে যেন ওজন ও মাপ নির্দিষ্ট করে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য তা প্রদান করে।’[23]
২. কিয়াসে জালির বিপরীতে ইজমা ও প্রথার দৃষ্টান্ত
কিয়াসে জালির বিপরীতে ইজমা ও প্রথার দৃষ্টান্ত : যেমন মূল্য নির্ধারণ করার পর কোন ব্যক্তি মুচিকে জুতা তৈরি করার নির্দেশ প্রদান করল। কিয়াসে জালি অনুযায়ী এই লেনদেনও বৈধ হওয়া উচিত নয়। কারণ জুতা পরে তৈরি করা হবে এবং তা লেনদেন চুক্তি অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় অস্তিত্বহীন। কিন্তু এ জাতীয় লেনদেন সমাজে এতই ব্যাপক যে, মনে হয় এর বৈধতার উপর তাদের ঐকমত্য (ইজমা) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং এই জাতীয় লেনদেনের ক্ষেত্রেও কিয়াস পরিহার করে ইসতিহসানের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে। এই উদাহরণের মধ্যে ‘প্রচলত প্রথা’র দৃষ্টান্তও বিদ্যমান ।
৩. কিয়াসে জালির বিপরীতে প্রয়োজনের দৃষ্টান্ত
কিয়াসে জালির বিপরীতে প্রয়োজনের দৃষ্টান্ত : কূপের পানি নাপাক হয়ে গেলে কিয়াস অনুযায়ী উক্ত কূপকে নাপাকমুক্ত করা সম্ভব নয়। কারণ যতই পরিষ্কার করা হোক না কেন, নাপাকির কিছু না কিছু কূপে অবশিষ্ট থেকেই যাবে। আবার কূপ ভেঙে ফেলে নতুন করে গড়িতে হলে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন থেকে হয়। এই অবস্থায় কিয়াস পরিত্যাগ করে ক্ষতি দূরীভূত করার জন্য ইসতিহসানের আশ্রয় গ্রহণ করে ধৌত করার পর কূপের পানি পাক গণ্য করা হয়েছে।
৪. কিয়াসে জালির বিপরীতে কিয়াসে খাফির দৃষ্টান্ত
কিয়াসে জালির বিপরীতে কিয়াসে খাফির দৃষ্টান্ত : যে জীবের গোশত হারাম তার উচ্ছিষ্টও হারাম। কারণ উচ্ছিষ্টের মধ্যে তার দেহ থেকে নির্গত তার মুখের লালা মিশ্রিত হয়ে গেছে। এই নীতির ভিত্তিতে নখ বা থাবাযুক্ত শিকারী পাখির উচ্ছিষ্টও হারাম হওয়া উচিত। কারণ তার গোশতও হারাম। কিন্তু কিয়াসে খাফি (সূক্ষ্ম বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি) হলো, পাখি ঠোঁট দ্বারা আহার করে এবং ঠোঁট হলো শক্ত (যৎকিঞ্চিৎ)। তাই তার ঠোঁট খাদ্য বা পানীয়ে ডুবালে ইসতিহসান অনুযায়ী তা নাপাক গণ্য হবে না।
কিয়াসকে পরিহার করে ইসতিহসানকে গ্রহণ করতে হলে কয়েকটি শর্ত অবশ্যই মেনে চলতে হয়। যেমন, কিয়াস-এর বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত উভয় দিক অযথার্থ (ফাসিদ) হলে–সেক্ষেত্রে ইসতিহসান গ্রহণযোগ্য হবে। কিয়াস-এর কোনো একটি দিক অযথার্থ হলে এবং তার বিপরীতে ইসতিহসানের উভয় দিক যথার্থ হলে, অথবা কিয়াস-এর বাহ্যিক দিক যথার্থ; কিন্তু অন্তর্নিহিত দিক অযথার্থ এবং ইসতিহসানের বাহ্যিক দিক অযথার্থ কিন্তু অন্তর্নিহিত দিক যথার্থ হলে ইসতিহসানই গ্রহণযোগ্য হবে। এটা ব্যতীত অন্য সকল ক্ষেত্রে কিয়াসই গ্রহণযোগ্য।
ইসতিহসানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
স্থান-কাল-পরিস্থিতি ও ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে নিত্য নতুন সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে। এর সমাধান চারটি স্থায়ী উৎসে পাওয়া গেলে তো যথেষ্ট, অন্যথায় এর সমাধান পেশ করা একটি কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থার সুরাহা করার জন্য হানাফি ফকিহগণ প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় গ্রহণ করে শরিআতের এমন দলিল-প্রমাণের প্রবর্তন করেন, যা মানুষের জন্য যথেষ্ট উপকারী সাব্যস্ত হয়েছে এবং যা তাদের কর্মকে সহজতর করতে অবদান রেখেছে। ইসতিহসান এই প্রকারের দলিলেরই অন্তর্ভুক্ত। হানাফি ফকিহগণের মতে যদিও তা কিয়াস-এর শ্রেণিভুক্তই (কিয়াসে খাফি), কিন্তু তথাপি কিয়াসে জালির (সারিহ) স্থায়ী নীতিমালা অনুযায়ী কোনো কোনো বিষয়ের সমাধান মানুষের কষ্টকর ও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। তাই সামগ্রিক কল্যাণ, প্রয়োজন, রেওয়াজ ও প্রথার কথা বিবেচনা করে এই ক্ষতি ও অসুবিধার প্রতিরোধের জন্য ইসতিহসান-এর আশ্রয় নেওয়া হয়। ইমাম সারাখসি রাহিমাহুল্লাহ-এর ভাষায়, ‘জনগণের সর্বাধিক উপকারের কথা বিবেচনা করে কিয়াসকে গ্রহণ অথবা পরিত্যাগ করার নামই হচ্ছে ইসতিহসান।’ (তারকুল কিয়াস ওয়াল-আখযু বিমা হুওয়া আওফাকুন-নাস)
মাসালিহ মুরসালা
ইমাম গাযালি রাহিমাহুল্লাহ-এর মতে এটি ইসতিসলাহ, ইমামুল হারামাইন ও ইবনে সামআনির মতে ইসতিদলাল, অপর একদল আলেমের মতে ‘ইসতিদলাল মুরসাল’ নামে পরিচিত। যে মূলনীতির সমর্থনে অথবা বিরুদ্ধে শরিআতের কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান বিদ্যমান নেই—তাকে মাসালিহ মুরসালা বলে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘মুজতাহিদ যে কর্মের মধ্যে অগ্রাধিকারযোগ্য কল্যাণ নিহিত আছে বলে অনুভব করেন এবং শরিআতে উক্ত কর্মের বিপরীত কোনো নির্দেশ বিদ্যমান নেই, তাকে মাসালিহ মুরসালা বলে।’[24]
ইমাম গাযালি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার দাবি অনুযায়ী যথোপযুক্ত সিদ্ধান্তই হলো মাসালিহ মুরসালার ভিত্তি এবং তার প্রমাণের জন্য কোনো সর্বসম্মত মূলনীতি বিদ্যমান নেই।’ খাওয়ারাযমি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘জনগণের অসুবিধা দূরীভূত করে শরিআতের উদ্দেশ্যের হেফাজত করাই মাসালিহ মুরসালার লক্ষ্য।’ মালিকি মাযহাবের ফকিহগণের মতে সার্বিক জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো সাধারণ অর্থবোধক নস বিদ্যমান না থাকা অবস্থায় গৃহীত সিদ্ধান্তকে এমন কোনো মৌলিক নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট করে দেওয়ার নাম মাসালিহ মুরসালা, যার ফলে তা জনস্বার্থ ও শরিআতের উদ্দেশ্য উভয়টির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে। মাসালিহ মুরসালা হলো সেই সার্বিক কল্যাণকর জিনিস—যা আমাদের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
অতএব, শুধু কল্যাণকে ভিত্তি করে বিধান রচনা করার নাম হচ্ছে মাসালিহ মুরসালা। ইসতিহসানের ক্ষেত্রেও জনস্বার্থ ও জনকল্যাণের দিকটি বিবেচনায় রাখতে হয়। তবে ইসতিহসানের তুলনায় মাসালিহ মুরসালার পরিধি অধিক বিস্তৃত। যে বিষয়ে শরিআতের সুস্পষ্ট দলিল বিদ্যমান আছে, সেই বিষয়টি মাসালিহ মুরসালার আওতাভুক্ত হবে না। কোনো বৃহত্তর জাতীয়স্বার্থ সংরক্ষণ করা অথবা কোনো মারাত্মক ক্ষতি প্রতিরোধ বা দূরীভূত করা, শরিআতের উদ্দেশ্য পূর্ণ করা, ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত করা এবং যেসব মূলনীতির উপর শরিআতের ভিত্তি স্থাপিত তার পূর্ণতা সাধন করাই মাসালিহ মুরসালার উদ্দেশ্য। এর অর্থ আইন প্রণয়নের অবাধ অনুমতি নয়; বরং মাসালিহ মুরসালার আওতায় আইন প্রণয়নকালে তিনটি শর্ত অপরিহার্যভাবে মেনে চলতে হয়। যথা :
১. এই পন্থায় যে আইন প্রণয়ন করা হবে, তা শরিআতের উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থেকে হবে, তার পরিপন্থি থেকে পারবে না।
২. যখন তা জনগণের সামনে পেশ করা হবে, তখন তা সাধারণ বুদ্ধি-বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য থেকে হবে।
৩. তা কোনো প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ অথবা কোনো প্রকৃত অসুবিধা দূর করার জন্য প্রণীত থেকে হবে।[25]
উক্ত শর্তত্রয় অনুসরণ পূর্বক তিন পর্যায়ে মাসালিহ মুরসালার আওতায় আইন প্রণীত হয়ে থাকে। যেমন,
(১) কোনো বিষয় যথার্থ হওয়ার ব্যাপারে শরিআতের সমর্থন বিদ্যমান আছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রবল বৃষ্টির কারণে অথবা সফররত থাকার কারণে দুই ওয়াক্তের নামায (যুহর ও আসর এবং মাগরিব ও ইশা একই সময়ে পরপর) একত্রে পড়ার বিষয়টি শরিআত অনুমোদন করেছে। যেমন, হজের সময় আরাফাত ময়দানে যুহর-আসর এবং মুযদালিফায় মাগরিব ও ইশা একসাথে পড়া হয়।
(২) কোনো বিষয় অযথার্থ হওয়ার ব্যাপারে শরিআতের সাক্ষ্য বিদ্যমান আছে। যেমন, রোযার কাফফারাস্বরূপ দাসমুক্ত করার নির্দেশ প্রদানের পরিবর্তে অপরাধীর প্রতি কঠোরতা আরোপের উদ্দেশ্যে তাকে রোযা রাখার নির্দেশ প্রদান করা। যেমন, ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ-এর শাগরিদ ইয়াহইয়া রাহিমাহুল্লাহ আবদুর রহমান ইবনুল হাকামকে রোযা ভঙ্গের কাফফারাস্বরূপ দাসমুক্তির পরিবর্তে রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
(৩) এমনও কিছু বিষয় আছে, যার যথার্থ বা অযথার্থ হওয়ার পক্ষে শরিআতের কোনো সাক্ষ্য বা সমর্থন বিদ্যমান নেই। এই অবস্থাটিই সাধারণভাবে মাসালিহ মুরসালার ব্যাপক প্রয়োগের পথ প্রশস্ত করে।
মাসালিহ মুরসালা ব্যক্তিগত অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট হলে সেক্ষেত্রে বিষয়টি উপকার’ ও ‘ক্ষতি’ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত উপকার’, যেমন সুস্বাস্থ্য, সচ্ছলতা, আনন্দ, বুদ্ধিজ্ঞান, লাভ ইত্যাদি এবং ব্যক্তিগত ‘ক্ষতি’, যেমন স্বাস্থ্যহানি, বিপদাপদ, লোকসান, অজ্ঞতা ইত্যাদি। মাসালিহ মুরসালা কোনো শরয়ি অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট হলে, তা ‘নির্দেশ’ অথবা ‘নিষেধাজ্ঞা’র মানদণ্ড হিসেবে গণ্য হয়।
একটি সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধিশালী সমাজ গঠনের জন্য কতগুলো বিষয়ের সংরক্ষণ বা হেফাজত অত্যন্ত জরুরি। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : (১) ধর্মের হেফাজত, (২) জীবনের হেফাজত, (৩) বুদ্ধি বা মেধার হেফাজত, (৪) মানব বংশধারার হেফাজত ও (৫) সম্পদের হেফাজত। এই পাঁচটি বিষয়ের কোনো একটির অনুপস্থিতিতে সমাজ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়; বরং সমাজ ব্যবস্থার পতন ত্বরান্বিত হয়।
অতএব, মানব সমাজের সুষ্ঠু বিকাশ, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য উক্ত বিষয়গুলোর হেফাজতের লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, তাই ইসলামি আইনের দৃষ্টিতে কল্যাণ (মাসালিহ) হিসেবে গণ্য হবে এবং যেসব বিষয় তার প্রতিবন্ধক সাব্যস্ত হবে, তাই অকল্যাণ (ক্ষতি) হিসেবে গণ্য হবে। উক্ত পাঁচটি বিষয়ের পূর্ণতা ও হেফাজতের লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তা গুরুত্ব ও প্রয়োজন অনুসারে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত। যথা :
(১) আবশ্যকীয় পদক্ষেপ
যেমন মানব জীবনের হেফাজতের লক্ষ্যে অন্যায় হত্যাকাণ্ডের শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদণ্ড, জ্ঞান ও বোধশক্তির হেফাজতের লক্ষ্যে মাদক গ্রহণের শাস্তিস্বরূপ বেত্রাঘাত, মানব বংশের সুষ্ঠু ধারাবাহিকতা ও পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রাখার লক্ষ্যে ব্যভিচারের শাস্তিস্বরূপ ক্ষেত্রভেদে বেত্রাঘাত বা মৃত্যুদণ্ড এবং জানমালের হেফাজতের লক্ষ্যে চুরি, ডাকাতি, আত্মসাৎ, জবরদখল ইত্যাদি অপরাধের শাস্তিস্বরূপ ক্ষেত্রভেদে হাত কর্তন ও জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
(২) পরিপূরক পদক্ষেপ
পরিপূরক পদক্ষেপ বলতে বুঝায়, উপরিউক্ত পাঁচটি বিষয়ের হেফাজতের জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ অতি আবশ্যকীয় না হলেও প্রয়োজনীয়। এই জাতীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে উদ্দেশ্য অর্জন ও তার পূর্ণতা সাধন সহজতর হয় এবং বাধা-বিপত্তি, কষ্ট-কাঠিন্য ও অসুবিধা দূরীভূত করা হয়। যেমন, শরিআতে যেসব জিনিস হারাম করা হয়নি–তার ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয় না হলেও মানব জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ও সমৃদ্ধির জন্য তা দ্বারা উপকৃত হওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
(৩) সৌন্দর্য বা পূর্ণতা বিধায়ক পদক্ষেপ
যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে কোনো ক্ষতি বা লোকসান হয় না ঠিকই; কিন্তু মানবীয় ভদ্রতা ও সৌজন্য উক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করাকে উত্তম বিবেচনা করে। যেমন ক্ষমা, উদারতা, উত্তম আচরণ, নম্র ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়সমূহ আবশ্যকীয় না হলেও মানবজীবনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। তাই ইসলামি শরিআতে এই জাতীয় বিষয়সমূহ অবলম্বনের জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। এই তিন ধরনের প্রয়োজনকে সামনে রেখেই মাসালিহ মুরসালার আওতায় আইন প্রণীত হয়ে থাকে।
প্রথা
প্রথাকে শরিআতের ভাষায় আদাহ, উরফ বা তাআমুল বলে। উরফ অর্থ প্রচলত রীতি বা প্রথা, আদাহ অর্থ অভ্যাস এবং তাআমুল অর্থ (অভ্যাসগত) কাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে কুরআন মাজিদ নাযিল হওয়াকালে আরব সমাজে যুগ যুগ ধরে প্রচলত অনেক প্রথাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও তা সরাসরি নিষিদ্ধ করেননি। খুলাফায়ে রাশিদিনের শাসনামলে বহু অমুসলিম এলাকা মুসলিম রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং স্থানীয় অধিবাসীগণ ব্যাপক হারে ইসলাম গ্রহণ করে। তাদের মধ্যে প্রচলত কোনো প্রথা যদি ইসলামি শরিআতের পরিপন্থি না হতো, তবে তদনুযায়ী আচরণ করতে জনগণকে বাধা দেওয়া হতো না।
কয়েক ব্যক্তি বা কয়েক শ্রেণির মানুষ বা কয়েক মহল্লার মানুষ যে আচরণ করে—আইনের দৃষ্টিতে তা প্রথা নয়। একটি গ্রামের বা একটি শহরের আচরণও প্রথা হতে পারে না। মাঝে মাঝে মানুষ যা করে, তাও প্রথা নয়। সমগ্র দেশে অথবা কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের সমগ্র মানবমণ্ডলীর মধ্যে সর্বজনস্বীকৃতভাবে যে অভ্যাস প্রচলত থাকে, তাকে প্রথা হিসেবে গণ্য করা যায়। কত কাল প্রচলত থাকলে কোনো আচরণকে প্রথা বলা যায়, এর কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। স্মরণকালের মধ্যে যে আচরণের উদ্ভব হয় এবং সেসময় থেকে অব্যাহতভাবে মুসলমানগণ তা অনুসরণ করতে থাকলে, তাকে প্রথার মর্যাদা দেওয়া যায়। রদ্দুল মুহতার গ্রন্থকারের যা সর্বদা আচরণ করা হয়–তাই প্রথা।
কোনো আচরণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা তার সাহাবিগণের যুগ থেকে প্রচলত হলেই তা প্রথা রূপ পাবে, এরূপ কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। কুরআন, সুন্নাহ ও ইসলামি জীবনব্যবস্থার প্রকৃতির পরিপন্থি না হলে প্রথাভিত্তিক আইন সকলে মানতে বাধ্য। অবশ্য ইজমার মধ্যে মুজতাহিদ ফকিহগণের গবেষণার অবদান বিদ্যমান আছে, যা প্রথার মধ্যে নেই। তাই প্রথার তুলনায় ইজমার মর্যাদা অনেক বেশি। তবে কিয়াস ভিত্তিক আইনের তুলনায় প্রথাভিত্তিক আইনের উচ্চতর মর্যাদা স্বীকৃত। ইসলামি আইনের গবেষকগণ লক্ষ্য করেছেন, ইসলামি আইনের বিকাশে প্রথার অবদান অতি বৃহৎ। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবিয়িনের আমলে যেসব প্রথা সম্মানের সাথে প্রতিপালিত হতো, সেগুলো আইনরূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে। হানাফি আইনতত্ত্ববিদগণ প্রথাকে আইনের একটি উৎস মনে করেন। কুরআনের যেসব আয়াত ও যেসব সুন্নাহ দ্বারা ইজমাকে প্রামাণ্য গণ্য করা হয়, প্রথাকেও ওগুলোর ভিত্তিতে প্রামাণ্য বলা হয়। ‘হিদায়া’ গ্রন্থকারের মতে স্পষ্ট আয়াত বা সুন্নাহর অনুপস্থিতিতে প্রথাকে ইজমার সমস্থানীয় মনে করা হয়।
ইসতিদলাল
ইসতিদলাল শব্দের অর্থ দলিল বা যুক্তি প্রদান, এক বস্তু থেকে অন্য বস্তু অনুমান করা। কুরআনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে হানাফিগণ এই শব্দটির ব্যবহার করে থাকেন। শাফিয়ি ও মালিকিগণের মতে ইসতিদলাল বলতে যা বুঝায়, তা কুরআনের ব্যাখ্যা বা কিয়াসের আওতায় আসে না। তাকে যুক্তির মাধ্যমে নির্ণীত সিদ্ধান্ত বলা যায়।
ইসতিদলালের তিনটি পর্যায়
ইসতিদলাল তিন পর্যায়ে হতে পারে। যথা :
(১) একটি বিষয়ের সাথে অন্য বিষয়ের যোগ ঘটলে এবং সেই যোগের পশ্চাতে কোনো কার্যকরী কারণ বিদ্যমান না থাকলে, সেই যোগের প্রকাশকে এক ধরনের ইসতিদলাল বলা হয়।
(২) কোনো বস্তু বা তার অবস্থা যতক্ষণ পর্যন্ত বিলুপ্ত বা স্থগিত না করা যায়, ততক্ষণ ধরে নিতে হবে উক্ত বস্তু বা তার অবস্থা বহাল আছে।
(৩) ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে যে আইন প্রত্যাদিষ্ট তা প্রামাণ্য।
প্রথম পর্যায়ের ইসতিদলাল চার শ্রেণিভুক্ত
(১) যখন দুটি ইতিবাচক বিষয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়, তখন এক প্রকার ইসতিদলাল কার্যকরী হয়। যেমন, কোনো ব্যক্তি আইনসিদ্ধ তালাক প্রদানের যোগ্য হলে সে আইনসিদ্ধ যিহারও করতে পারে।
(২) যখন দুটি নেতিবাচক বিষয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়, তখন একপ্রকার ইসতিদলাল কার্যকরী হয়। যেমন, নিয়ত ব্যতীত উযু সিদ্ধ হওয়ায় নিয়ত ব্যতীত তায়াম্মুমও সিদ্ধ।
(৩) একটি ইতিবাচক বিষয়ের সাথে একটি নেতিবাচক বিষয়ের সংযোগ ঘটলে এক প্রকারের ইসতিদলাল কার্যকরী হয়। যেমন, যা হালাল তা হারাম হতে পারে না।
(৪) একটি নেতিবাচক বিষয়ের সাথে একটি ইতিবাচক বিষয়ের সংযোগ ঘটলে এক প্রকারের ইসতিদলাল কার্যকরী হয়। যেমন, যা হারাম তা হালাল নয়।
যার বিরতি বা বিলোপ প্রমাণ করা হয়নি, তা বহাল থাকার নীতি সম্পর্কিত একটি উদাহরণ হলো, এক ব্যক্তি নিখোঁজ হয়ে গেছে, কোনোক্রমেই তার খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না। শাফিয়ি মাযহাবমতে আইনত ওই ব্যক্তিকে জীবিত গণ্য করতে হবে, তার মৃত্যুসংবাদ পাওয়া গেলে ভিন্ন কথা। এই ব্যক্তির সম্পত্তি তার ওয়ারিশগণের মধ্যে বণ্টিত হবে না। কিন্তু সে তার নিখোঁজকালে মৃত আত্মীয়ের ওয়ারিশ হবে। হানাফি মাযহাবমতে বিরতি বা বিলোপ প্রমাণের অভাবে বিদ্যমানতার নীতি আইন বর্তমান স্বত্বকে রক্ষা করলেও ভবিষ্যৎ স্বত্ব সৃষ্টি করে না। সুতরাং ওই ব্যক্তির সম্পত্তি তার ওয়ারিশগণের মধ্যে যেমন বণ্টিত হবে না, তেমনই সে-ও কারো ওয়ারিশ হবে না।
ইজতিহাদ
ইজতিহাদ শব্দটির অর্থ অধ্যবসায়, প্রচেষ্টা, প্রয়াস, কঠোর শ্রম ইত্যাদি। কুরআন-সুন্নাহর মধ্যে কোনো বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট বিধান পাওয়া যাচ্ছে না। এসময় সেই বিষয়ে সঠিক বিধান নির্ণয়ের জন্য মুজতাহিদ ফকিহ যখন তার সার্বিক শক্তি যোগ্যতা ও সামর্থ্য নিয়োগ করেন, তখন উক্ত বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়াসকে ইজতিহাদ বলে। ইজতিহাদ আইনের স্বতন্ত্র কোনো উৎস নয়; বরং আইন সম্পর্কিত গবেষণা। ইজতিহাদ প্রসূত অভিমত সাধারণত সঠিক বলে গণ্য হয়, তবে তা নির্ভুল নাও হতে পারে। এই কারণে ইজতিহাদ প্রসূত অভিমতকে অনুমানভিত্তিক ব্যবস্থা বলা হয়। কোনো মুজতাহিদ সততার সাথে আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হলে তিনি অপরাধী গণ্য হবেন না। কারণ তিনি তার চেষ্টায় ত্রুটি করেননি, যদিও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। তা দুর্ভাগ্যজনক হলেও অপরাধজনক নয়। উসূলের মূলনীতি হলো : ‘মুজতাহিদ ভুলও করতে পারেন এবং সঠিক সিদ্ধান্তেও পৌঁছতে পারেন।’
অবশ্য ইজতিহাদ ও গবেষণা শব্দদ্বয়ের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। ইসলামি শরিআত-সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণাকে ইজতিহাদ বলা হয়। এক্ষেত্রে গবেষণাকারীকে অপরিহার্যরূপে মুসলমান থেকে হয়। কিন্তু গবেষণা যেকোনো বিষয়ে হতে পারে এবং এক্ষেত্রে গবেষকের মুসলমান হওয়া শর্ত নয়। অতএব, গবেষণা শব্দটি ব্যাপকার্থক এবং ইজাতিহাদ শব্দটি বিশিষ্টার্থক। ইসলামি আইন প্রণয়নে মানববুদ্ধির প্রয়োগ
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে ওহির ভিত্তিতে ফয়সালা হতো। এই ওহি দুই ধরনের ছিল। কুরআন মাজিদকে ‘ওহি মাতলু’ এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসকে ‘ওহি গায়রে মাতলু’ বলা হয়। অতএব, আল্লাহ ও তার রাসূল কর্তৃক কোনো বিষয়ে বিধান প্রদত্ত হলে সেক্ষেত্রে মুসলমানগণের নিজস্ব বুদ্ধিপ্রসূত বিকল্প বিধান প্রণয়নের এখতিয়ার নেই। মহান আল্লাহ বলেন,
আল্লাহ ও তার রাসূল যখন কোনো ব্যাপারে ফয়সালা করে দেন, তখন কোনো মুমিন পুরুষ বা কোনো মুমিন স্ত্রীলোকের নিজেদের সেই ব্যাপারে ভিন্নরূপ ফয়সালা করার এখতিয়ার নেই। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্যতা করে, সে নিশ্চয় সুস্পষ্ট গোমরাহিতে নিমজ্জ্বিত হলো।’[26]
ওহি গায়রে মাতলূ অর্থাৎ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বিধান প্রদানের বিষয়টিও আল্লাহ তাআলা কর্তৃক অনুমোদিত এবং তার অনুসরণ অপরিহার্য। মহান আল্লাহর বাণী,
‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেয়, তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে, তা থেকে বিরত থাকো।’[27]
‘এবং সে মনগড়া কথা বলে না; তা তো ওহি, যা তার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট হয়।’[28]
অতএব, কুরআন-সুন্নাহ (হাদিস) থেকে প্রাপ্ত আইনের বিপরীত আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করলে মুসলমানরা সৎ পথের পরিবর্তে ভ্রান্ত পথে ধাবিত হবে। এক্ষেত্রে বুদ্ধির ভূমিকা এই হবে, সংশ্লিষ্ট বিধানের সফল বাস্তবায়ন কীভাবে করা যেতে পারে–তা উদ্ভাবন করা। যেখানে কুরআন-সুন্নাহ নীরব, একাধিক অর্থবাহী বা অস্পষ্ট বা স্থানিক ও কালিক, সেখানে মানববুদ্ধির প্রয়োগে আইন প্রণয়নকে নিষিদ্ধ করা হয়নি; বরং তাকে আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত নীতি-বিধানের প্রাধান্য দ্বারা সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। এই সর্বোচ্চ আইনের আনুগত্য স্বীকার করে মানুষের বুদ্ধির প্রয়োগে আইন প্রণয়নের স্বাধীনতা রয়েছে।
মানুষের ব্যবহারিক জীবনের যাবতীয় বিষয়ের মধ্যে এমন কতগুলো বিষয় রয়েছে, যে সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর বিধান বিদ্যমান আছে অথবা উপরিউক্ত উৎসদ্বয় কোনো মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। আবার এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যে সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহ সম্পূর্ণ নীরব। এই নীরবতা সরাসরি এই কথার প্রমাণ বহন করে, মহান আইনদাতা আল্লাহ এক্ষেত্রে মানুষকে নিজস্ব রায় বা বুদ্ধির প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুমতি প্রদান করেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের কাজ এমনভাবে পরিচালিত হবে–যেন তা ইসলামের প্রাণশক্তি ও এর মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তার মেজাজ-প্রকৃতি ইসলামের মেজাজ-প্রকৃতির বিপরীত না হয়, তা যেন ইসলামি জীবনব্যবস্থায় সঠিকভাবে সংস্থাপিত হতে পারে। আইন প্রণয়নের এই কাজ ইসলামের আইনব্যবস্থাকে গতিশীল রাখে এবং যুগের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে-সঙ্গে তার ক্রমবিকাশে সহায়তা করে। এক বিশেষ ইলমি তাহকিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানের মাধ্যমেই এই কাজ করা যেতে পারে। ইসলামের পরিভাষায় এরূপ কর্মতৎপরতাকেই ইজতিহাদ বলে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের কার্যক্রম দ্বারা ইজতিহাদের অধিকার ও প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত।
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুআয ইবনে জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ইয়ামানে পাঠান, তখন জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কীভাবে ফয়সালা করবে? তিনি বললেন,আল্লাহর কিতাবে যে হিদায়াত রয়েছে তদনুযায়ী। তিনি বললেন, যদি আল্লাহর কিতাবে না পাওয়া যায়? তিনি বললেন, তা হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত অনুযায়ী। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর রাসূলের সুন্নাতেও যদি না পাওয়া যায়? তিনি বললেন, আমি আমার বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে (যথার্থ সত্যে পৌঁছার) পূর্ণ চেষ্টা করব এবং মোটেই অবহেলা করব না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আল্লাহ রাসূলের প্রতিনিধিকে এমন পন্থা অবলম্বনের তাওফিক দিয়েছেন, যা আল্লাহর রাসূলের পছন্দনীয়।’[29]
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘কিন্তু যদি এমন কোনো বিষয় উপস্থিত হয়, যার বিধান আল্লাহর কিতাবেও নেই, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুরূপ সিদ্ধান্তও নেই এবং সালিহিনের (উম্মতের যোগ্য ও সৎ কর্মপরায়ণ লোক) নিকট হতেও অনুরূপ বিষয়ের সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় না, তা হলে সেই বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার পূর্ণ চেষ্টা (ইজতিহাদ) করবে। কিন্তু এই কথা বলবে না, আমি ভয় করছি, আমি ভয় পাচ্ছি।’[30]। বিচারপতি শুরায়হ রাহিমাহুল্লাহ-এর নামে প্রেরিত একটি পত্রেও হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু অনুরূপ কথা বলেছেন।[31] যে ইজমা ও কিয়াস ইসলামি আইনের তৃতীয় ও চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে স্বীকৃত, তার বিষয়বস্তুও মূলত ইজতিহাদপ্রসূত।
মানববুদ্ধি প্রয়োগের শর্তাবলি
ইজতিহাদ অর্থাৎ মানববুদ্ধি প্রয়োগে আইন প্রণয়ন করতে হলে বুদ্ধি প্রয়োগকারীর মধ্যে কতগুলো অপরিহার্য গুণ বা যোগ্যতা থাকতে হবে। ইজতিহাদের দরজা উন্মুক্ত করা যতটুকু প্রয়োজনীয়, তার চেয়েও সতর্কতা অবলম্বন করা আরও জরুরি।
(১) আল্লাহ প্রদত্ত শরিআতের উপর বুদ্ধি প্রয়োগকারীর দৃঢ় ঈমান থাকতে হবে, তা মেনে চলার একনিষ্ঠ সংকল্প থাকতে হবে, তার বন্ধন ছিন্ন করার খায়েশমুক্ত থেকে হবে এবং ইসলামি শরিআত থেকে পথনির্দেশ লাভ করতে হবে।
(২) আরবি ভাষা, তার ব্যাকরণ ও সাহিত্য সম্পর্কে বুদ্ধি প্রয়োগকারীর সম্যক জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক। কারণ কুরআন এই ভাষায় নাযিল হয়েছে এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত ও ইসলামি আইনের উপর যে কাজ হয়েছে, এই ভাষাই সেই সম্পর্কে অবহিত হওয়ার বাহন।
(৩) বুদ্ধি প্রয়োগকারীর জন্য কুরআন-সুন্নাহর এমন জ্ঞান থাকা প্রয়োজন–যার মাধ্যমে শরিআতের মর্মমূলে যাওয়া যায় ।
(৪) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খুলাফায়ে রাশিদার যুগে ইসলামি আইনের উপর যে কাজ হয়েছে, মুজতাহিদগণ যুগের পর যুগ ধরে যেভাবে ইসলামি আইনের ক্রমবিকাশ সাধন করেছেন—সেই সম্পর্কেও বুদ্ধি প্রয়োগকারীর গভীর জ্ঞান থাকতে হবে। ইজতিহাদের প্রশিক্ষণের জন্য শুধু এই জ্ঞানের প্রয়োজন নয়; বরং আইনের ক্রমবিবর্তন ও ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্যও এর প্রয়োজন। এর মাধ্যমে জানা যাবে, বিভিন্ন যুগে সমসাময়িক পরিস্থিতির সাথে কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশসমূহকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য কী কী পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল এবং ব্যাপক ভিত্তিতে কী কী আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।
(৫) বাস্তব জীবনের অবস্থা পরিস্থিতি ও সমস্যা সম্পর্কে বুদ্ধি প্রয়োগকারীর গভীর প্রজ্ঞা থাকতে হবে। কারণ এগুলোর উপরই শরিআতের নির্দেশ ও মূলনীতি প্রযোজ্য হবে।
(৬) বুদ্ধি প্রয়োগকারীকে নৈতিকতার মানদণ্ড অনুযায়ী উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী থেকে হবে। চরিত্রহীন লোকের ইজতিহাদ জনগণের নিকট বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই চরিত্র ভ্রষ্টকারী প্রভাবসমূহ থেকে নিরাপদ অবস্থানে থাকার শক্তি তার থাকতে হবে।
উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহের অধিকারী আলেম ব্যক্তির ইজতিহাদের মাধ্যমেই সঠিক কাঠামো অনুযায়ী ইসলামি আইনের ক্রমবিকাশ হতে পারে। ইসলামি আইনের একটি মূলনীতি হলো, আইন বিধিবন্ধকরণের ক্ষেত্রে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তার অনুসরণ করো, যা থেকে বিরত রাখা হয়েছে তা থেকে বিরত থাকো এবং যা সম্পর্কে শরিআত প্রণেতা (আল্লাহ ও তার রাসূল) নীরব, সেই সম্পর্কে তোমরা নিজেদের সঠিক দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী কাজ করার জন্য স্বাধীন।’[32]
আইন প্রণয়নে শূরার ভূমিকা
আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে উদ্ভূত সমস্যাবলি সম্পর্কে ‘শূরা’ আইন বিধিবদ্ধ করবে। অবশ্য এক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন করার সময় তিনটি শর্ত। অবশ্যই পালন করতে হবে, (১) আইন প্রণয়নকালে ইসলামের ব্যাপক উদ্দেশ্য ও সার্বিক স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে অর্থাৎ আইন এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যে, প্রয়োজনও পূর্ণ হবে এবং সঙ্গে-সঙ্গে ইসলামের সামগ্রিক ব্যবস্থার লক্ষ্য ও মেজাজ-প্রকৃতির (Spirit) সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, এর পরিপন্থি হবে না।
(২) উক্ত আইন যখন জনগণের সামনে পেশ করা হবে তখন তা সাধারণ জ্ঞানের কাছে গ্রহণযোগ্য থেকে হবে।
(৩) কোনো প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ করার উদ্দেশ্যে অথবা কোনো প্রকৃত
অসুবিধা দূরীভূত করার জন্য উক্ত আইন প্রণীত হবে।
খুলাফায়ে রাশিদার শাসনামলে এই জাতীয় আইন অধিকাংশ ক্ষেত্রে শূরা বা সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রণীত হতো। যেমন, কুরআন মাজিদে মাদক দ্রব্য হারাম ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু এর ব্যবহারজনিত অপরাধের শাস্তির সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও এর কোন সুনির্দিষ্ট পরিমাণ শাস্তি নির্ধারণ করেননি; বরং তিনি যে অপরাধীকে যতটুকু শাস্তি প্রদান উপযুক্ত মনে করেছেন তাকে তদনুরূপ শাস্তি দিয়েছেন । হযরত আবু বাকু ও উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজ নিজ শাসনামলে চল্লিশ বেত্রাঘাত শাস্তি নির্ধারণ করেন, কিন্তু রীতিমত আইন প্রণীত হয়নি। হযরত উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শাসনামলে এই অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে তিনি সাহাবিগণের পরামর্শ পরিষদে বিষয়টি উত্থাপন করেন। হযরত আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে আশি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেন। পরামর্শ পরিষদ তার প্রস্তাব গ্রহণ করে তাকে আইনে পরিণত করে।[33]
শিল্পী, কারিগর, ধোপা, দর্জি ইত্যাকার পেশাজীবীর নিকট কোনো জিনিস তৈরি করার জন্য কোনো মাল অর্পণ করা হলে এবং তার নিকট থেকে তা হারিয়ে গেলে এর ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে কোনো বিধান ছিল না। হযরত আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু তার ভাষণে বললেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কোনো অবহেলা বা অপতৎপরতা ব্যতীত তা হারিয়ে গেলে সেক্ষেত্রে তাকে দায়ী করা উচিত নয়; কিন্তু তাকে দায়ী না করা হলে তার প্রতি অবহেলার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই সামগ্রিক কল্যাণের দাবি অনুযায়ী তাকে উক্ত জিনিসের জামানতদার সাব্যস্ত করা হবে এবং তা হারিয়ে গেলে তার উপর ক্ষতিপূরণ ধার্য হবে। তার এই মতও ঐক্যবদ্ধভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে।[34]
অতএব, শূরা যখন নস-এর কোনো ব্যাখ্যা ও ফকিহ বা মুজতাহিদের কোনো কিয়াস, ইজতিহাদ, ইসতিহসান অথবা মাসালিহ মুরসালা প্রসূত কোনো রায় আহলুল-হাল ওয়াল-আকদ (শূরার সদস্যবৃন্দ)-এর সকলের বা অধিকাংশের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গ্রহণ করবে, তখনই তা মুসলিম রাষ্ট্রের আইন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে।
ইসলামি আইনের বৈশিষ্ট্য
১. আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি
ইসলামি আইনে আল্লাহ তাআলাই হলেন সকল ক্ষমতার উৎস। পাশ্চাত্যপন্থি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যাকে ‘সার্বভৌমত্ব’ বলা হয়, তার নিরংকুশ মালিক হলেন আল্লাহ। মানুষ তার প্রতিনিধি (খলিফা) হিসেবে কেবল ওই ক্ষমতার (প্রশাসনিক) বাস্তবায়ন করে মাত্র। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন :
‘কর্তৃত্ব তো আল্লাহরই, তিনি সত্য বিবৃত করেন এবং ফয়সালাকারীদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ।’[35]
২. ইসলামি আইন অবিভাজ্য
ইসলামি আইন মানব জীবনের যাবতীয় আচরণকে নিজের আওতাভুক্ত করেছে। এখানে পার্থিব ও পারলৌলিক, ইবাদত-বন্দেগি, ব্যক্তিগত আচরণ, আকিদা-বিশ্বাস, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি সামগ্রিক বিষয় ইসলামি আইনের আওতাভুক্ত। সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা-সংক্রান্ত আইনসমূহ যেমন ইসলামি আইনের অন্তর্ভুক্ত, তদ্রূপ নামায, রোযা, হজ, যাকাত ইত্যাদি ‘ইবাদত-সংক্রান্ত বিধি-বিধানও ইসলামি আইনের অন্তর্ভুক্ত। এই আইনের আওতায় মানুষের গোটা জীবনই তার ধর্মীয় জীবন। এই আইনের কিছু অংশের প্রতি ঈমান পোষণ ও কিছু অংশ অস্বীকার ও অমান্য করা কুফরি। এই সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শান্তিতে নিক্ষিপ্ত হবে।’[36]
৩. ইসলামি আইন বিশ্বজনীন
ইসলামি আইন কাঠামো গোটা বিশ্বের যেকোনো দেশের পরিবেশ-অবস্থা এবং যেকোনো কালের সাথে সামঞ্জস্যশীল; অর্থাৎ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের মানুষের জন্য ইসলামি আইনের অনুসরণ সহজেই সম্ভব। ইসলামের বিধানও গোটা বিশ্ববাসীর জন্য সহজে অনুসরণযোগ্য করা হয়েছে
‘বলো, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসুল।’[37]
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
আমি সাধারণভাবে সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছি।’[38]
অতএব, যিনি সমগ্র সৃষ্টিকুলের জন্য প্রেরিত হয়েছেন, তার আনীত বিধানাবলিও তাদের সকলের অনুসরণ উপযোগী হওয়াই স্বাভাবিক।
৪. ইসলামি আইন পূর্ণাঙ্গ
মানবজীবনের সার্বিক দিক পরিচালনার জন্য ইসলামি আইন পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ। ইসলামের গণ্ডিতে জীবনযাপনের জন্য দীন ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো মতবাদ থেকে কিছু ধার করার প্রয়োজন নেই। আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে মানবজাতির ক্রমবিকাশের স্তর অনুসারে আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ তথা কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজন মোতাবেক এতে পূর্ণাঙ্গতা ও চিরন্তনতা দান করা হয়েছে।
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম।’[39]
উপরিউক্ত আয়াতে প্রমাণিত হয়, আল্লাহ তাআলা শেষ নবীর মাধ্যমে মানবজাতির জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ দীন বা জীবনব্যবস্থা দান করেছেন। এই জীবনব্যবস্থা অপর সকল প্রকারের জীবনব্যবস্থা ও মতবাদকে বাতিল করেছে।
৫. ইসলামি আইন স্থায়ী
ইসলামি আইনের যে অংশ কুরআন মাজিদে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নায় বিধৃত হয়েছে, সেগুলো অপরিবর্তনীয় ও স্থায়ী। স্থান-কালের পরিবর্তনে তাতে সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই। উদাহরণস্বরূপ মানুষ হত্যার শাস্তিস্বরূপ কুরআন মাজিদে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে এবং পাশাপাশি বাদী ও বিবাদীর মধ্যে সমঝোতার সুযোগও রাখা হয়েছে। পক্ষদ্বয়ের মধ্যে সমঝোতা না হলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। শাসনকর্তার এতে রদবদল করার কোনো এখতিয়ার নেই।
৬. নমনীয়তা
ইসলামি আইনের উপরিউক্ত অংশ চিরকালের জন্য অপরিবর্তনীয় হলেও মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করত, এতে নমনীয়তার সুযোগ রাখা হয়েছে, যাতে উদ্ভূত নতুন সমস্যার সমাধানে পূর্ণাঙ্গ মানবজীবন অচল ও স্থবির হয়ে না যায়। উদাহরণস্বরূপ, কুরআন মাজিদে মৃত জীব, রক্ত ও শূকরের গোশত হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।[40] কিন্তু নিরুপায় অবস্থার ক্ষেত্রে উক্ত নির্দেশের পরপরই বলা হয়েছে,
‘কিন্তু যে ব্যক্তি অনন্যোপায় অথচ বিদ্রোহী বা সীমালঙ্ঘনকারী নয়, তার কোনো পাপ হবে না। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’[41]
৭. পরিবর্তনশীলতা
ইসলামি আইনের এমন একটি অধ্যায়ও আছে, যা স্থান-কাল-পাত্র ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনযোগ্য। ইসলামি আইনের আদি ও মৌল উৎস কুরআন-সুন্নাহ, এর পর এতদুভয়ের উপর ভিত্তিশীল আইনের অপরাপর উৎস যেমন, ইজমা, কিয়াস, মাসালিহ মুরসালা, ইসতিহসান ও ইসতিদলাল ইত্যাদির আলোকে যেসব আইন প্রণীত হয়ে থাকে, সেগুলোর কোনো কোনো অংশ স্থান-কাল-পরিস্থিতি ও সমাজের চাহিদার প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, রাষ্ট্র জনগণের নিকট থেকে যাকাত ও উশর (কৃষিজ উৎপাদনের এক-দশমাংশ) আদায় করে। এ ছাড়াও রাষ্ট্রীয় সংগঠন পরিচালনা, জরুরি অবস্থা মোকাবিলা, প্রতিরক্ষা ও সামরিক অভিযানের ব্যয়বহন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচলনার জন্য তাদের উপর বিভিন্ন প্রকার কর আরোপ করতে পারে। সরকার প্রয়োজন মনে না করলে যেকোনো সময় উক্ত কর মওকুফও করতে পারে।
৯. সমঝোতার ব্যবস্থা
বিবদমান বিষয় আদালতে পেশ করার পূর্বে সমঝোতায় মীমাংসা করার সুযোগ প্রদান—এটি ইসলামি আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিবদমান বিষয় আদালতে পেশ করার পরও বিচারকের সহায়তায় বা মধ্যস্থতায়ও পক্ষবৃন্দ সমঝোতার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে।[42]
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিবাদ মীমাংসার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে,
‘তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধের আশঙ্কা করলে তোমরা তার (স্বামীর) পরিবার থেকে একজন এবং এর (স্ত্রীর) পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করো। তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন।’[43]
এই সমঝোতার সুযোগ বিশেষভাবে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত।
৮. বিশ্বাসের স্বাধীনতা
ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসকারী বিধর্মী নাগরিকগণ (যিম্মি) স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারে। ইসলামি রাষ্ট্রে আগত বিধর্মীরা মুসতামান। ইসলামি আইনের আওতায় তারা ব্যাপকভাবে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতা ভোগ করে।
৯. গতিশীলতা
ইসলামি আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ইঁহার গতিশীলতা, স্থান-কালের ব্যবধান এর গতিকে রুদ্ধ বা স্তব্ধ করতে পারে না। সমস্যা যতই কঠিন ও সর্বাধুনিক হোক, যতই ক্ষুদ্র বা বৃহৎ হোক, সব ক্ষেত্রেই ইসলামি আইনের একটি স্পষ্ট বক্তব্য আছে। কুরআন-হাদিসে উদ্ভূত বিষয়ের আইন বিধৃত না থাকলে অবশ্যই তাতে আইনের একটি ব্যাপক ও স্পষ্ট মূলনীতি বিদ্যমান আছে, যার ভিত্তিতে মুজতাহিদ আইনজ্ঞগণ (ফকিহগণ) উদ্ভূত পরিস্থিতির সাথে সংগতিপূর্ণ আইন প্রণয়ন করতে সক্ষম। এখানেই আইন প্রণয়নে মানববুদ্ধি প্রয়োগের সুযোগ ব্যাপক।
এভাবে কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মূলনীতির অধীনে বিশেষজ্ঞ আইনবিদগণ তাদের গবেষণা তথা ইজতিহাদের মাধ্যমে ইসলামি আইনকে সচল, সক্রিয় ও গতিশীল রাখেন।
১০. সংগতি
ইসলামি আইনে কোন অসংগতি নেই, এর গোটা আইনব্যবস্থাই স্থান-কালের ঊর্ধ্বে মানবজাতির জন্য সংগতিপূর্ণ। উক্ত আইনব্যবস্থা মানবসমাজে দীর্ঘকালের বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে পরীক্ষিত। ইতিহাস সাক্ষী, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খিলাফতে রাশেদার পরও উমাইয়া শাসন, বৃহৎ আব্বাসি, উসমানি ও মোগল শাসনব্যবস্থা শত শত বছর পরিচালিত হয়েছে এই আইন দ্বারা। এমনকি মোগল শাসনের পূর্বেও উপমহাদেশের সুলতানি শাসনব্যবস্থাও পরিচালিত হয়েছে সম্পূর্ণরূপে ইসলামি আইন দ্বারা। শুধু তাই নয়, ইউরোপ মহাদেশের স্পেনীয় জনগণ দীর্ঘ আটশত বছর ইসলামি আইন দ্বারা শাসিত হয়েছে। স্থান-কাল-পাত্রের এই দীর্ঘ পরীক্ষায় ইসলামি আইন সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে।
ইসলামি আইনের অনুরূপ আরও বহু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি, মানবজাতির উন্নতি, অগ্রগতি ও আখিরাতের মুক্তি নির্ভর করে ইসলামি আইন ব্যবস্থার বাস্তবায়নের উপর।
গ্রন্থপঞ্জি
(১) Inostranzev Sasanidskie Etiudi, St. Petersburgh, ১৯০৯, পৃষ্ঠা : ২৫-৮০
(২) F. Gabrieli, Lopera di Ibn al-Muqaffa, RSO, ১৯৩২, বিশেষত পৃ ২১৩-২১৫
(৩) মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ, আল-ওয়াছাইকুস সিয়াসিয়্যা, ১ম ওয়াসিকা ও সেখানে বর্ণিত সূত্র
(৪) মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ, আহদ-ই নাবাবি কা নিজাম-ই হুরানি, ২য় সংস্করণ, হায়দারাবাদ (দাক্ষিণাত্য), পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান শিরোনামে;
(৫) মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ, The First Written Constitution of the World, Islamic Review, আগস্ট-নভেম্বর ১৯৪১ খৃষ্টাব্দ, ওকিং ১৯৪১
তথ্যসূত্র
[1] আল-ফিহরিস্ত, পৃষ্ঠা : ১১৮
[2] আত-তানবিহ ওয়াল ইশরাফ, পৃষ্ঠা : ১০৪-১০৬
[3] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-বাকারা : ( ০২ ) : ৩১
[4] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-বাকারা : ( ০২ ) : ৩০
[5] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-বাকারা : ( ০২ ) : ৩৮
[6] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-বাকারা : ( ০২ ) : ২১৩
[7] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আন- নিসা : ( ০৪ ) : ৪৬
[8] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আন- নিসা : ( ০৪ ) : ৫৯
[9] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আন- নাহ্ল : ( ১৬ ) : ৪৩; সূরা আল-আম্বিয়া : ( ২১ ) : ৭
[10] ইমাম তিরমিযী রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু: ২৭৯ হি.), ‘আল জামিউল কাবীর’: 2166, মিশকাতুল মাসাবীহ: 173
[11] ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ, মুসনাদে আহমাদ: ২২০২৯ ; মিশকাতুল মাসাবীহ: ১৮৪
[12] ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ, মুসনাদে আহমাদ: ২১৫৬১ ও আবু দাউদ: ৪৭৫৮, মিশকাতুল মাসাবীহ: ১৮৫
[13] আত-তাশরিউল জিনাইল ইসলামি, ১২/১৮২, ধারা নং ১৩৫
[14] আল-মুখতাসার, খণ্ড : ২ , পৃষ্ঠা : ২০৪
[15] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-হাশ্র : ( ৫৯ ) : ২
[16] দ্রষ্টব্য : সুনান আবি দাউদ : ৩৫২৯
[17] আল-ইতিসাম, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১১৮
[18] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আয-যুমার : ( ৩৯ ) : ১৭-১৮
[19] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-আরাফ : ( ০৭ ) : ১৪৫
[20] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-হাজ্জ্ব : ( ২২ ) : ৭৮
[21] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-বাকারা : ( ০২ ) : ১৮৫
[22] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-বাকারা : ( ০২ ) : ২৮৬
[23] সহিহ বুখারি, ২২৪০
[24] মাজমুআতুর রাসাইল ওয়াল-মাসাইল, খণ্ড : ৩ , পৃষ্ঠা : ২২
[25] ইমাম শাতিবির আল-ইতিসাম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ১১০-১১৪
[26] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-আহ্যাব : ( ৩৩ ) : ৩৬
[27] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-হাশ্র : ( ৫৯ ) : ৭
[28] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আন-নাজ্ম : ( ৫৩ ) : ৩-৪
[29] জামে তিরমিজি : ১৩২৭; আবু দাউদ : ৩৫৯২
[30] সুনানে নাসায়ি, কিতাবু আদাবিল কুদাত
[31] সুনানে নাসায়ি : ৫৪০১
[32] দ্রষ্টব্য : শাতিবী, আল-ইতিসাম, ২৯/১১৫
[33] আল-ইতিসাম, ২৯/১০১
[34] আল-ই’তিসাম, খণ্ড : ২ , পৃষ্ঠা : ১০২
[35] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-আন-আম : ( ০৬ ) : ৫৭
[36] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-বাকারা : ( ০২ ) : ৮৫; আরও দ্রষ্টব্য : সূরা আল-বাকারা : ( ০২ ) : ১৫৯-৬০; ১৭৪-১৭৫; সূরা আন- নিসা : ( ০৪ ) : ১৫০-১৫১ ও সূরা আল-মায়িদাহ : ( ০৫ ) : ৪৪-৪৫,৪৭
[37] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-আরাফ : ( ০৭ ) : ১৫৮
[38] সহিহ বুখারি : ৩৩৫,৪৩৮; সুনানে নাসায়ি : ৪৩২; সুনানুদ দারিমি : ১৩৮৯
[39] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-মায়িদাহ : ( ০৫ ) : ৩
[40] দ্রষ্টব্য : সূরা আন- নাহ্ল : ( ১৬ ) : ১৭৩ এবং সূরা আন- নাহ্ল : ( ১৬ ) : ১১৫
[41] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-বাকারা : ( ০২ ) : ১৭৩; আরও দ্রষ্টব্য : সূরা আন- নাহ্ল : ( ১৬ ) : ১১৫
[42] দ্রষ্টব্য : আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আল-বাকারা : ( ০২ ) : ১৭৮
[43] আল-কুরআনুল কারিম, সূরা আন- নিসা : ( ০৪ ) : ৩৫