ইসলামিক নাম
ইসলামিক নাম

ইসলামিক নাম : পরিচিতি ও ইসলামের নির্দেশনা

ইসলামিক নাম পরিচিতি

মুসলিম জাতির স্বাতন্ত্র্যতা

প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ঐতিহ্য, বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতি রয়েছে — যার মাধ্যমে জাতি তার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতি সমুন্নত রাখা উন্নত জাতির বৈশিষ্ট্য। মুসলিম জাতি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি। প্রতিটি মুসলিমের কথাবার্তা, আচার-আচরণ, ক্রিয়াকর্ম ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলামী বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন একান্ত অপরিহার্য। ইসলামের সোনালি যুগের মুসলিমগণ এই আদর্শের উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন— পরবর্তীকালে এ দৃঢ়তা যতই শিথিল হয়েছে জাতীয় অবক্ষয় ততই বৃদ্ধি পেয়েছে।

বর্তমান মুসলিম সমাজ

বলা বাহুল্য, বর্তমানে মুসলিম সমাজ নিজস্ব সংস্কৃতির মোকাবিলায় বিজাতীয় সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে— এমনকি নিজ সন্তান-সন্ততির নামকরণে ইসলামী ঐতিহ্যবর্জিত শব্দ নির্বাচন করে নিজেদের জাতীয় সত্তার বিলুপ্তি সাধনে সহায়তা করছে।

অর্থবহ ও ঐতিহ্যবাহী নামের প্রভাব অনস্বীকার্য। সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে স্বীয় নামের অর্থ অনুধাবন করে তদনুসারে তারা জীবন গড়তে সচেষ্ট হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তির অবচেতন মনে অর্থবহ ও ঐতিহ্যবাহী নাম গভীরভাবে রেখাপাত করে এবং ব্যক্তির অলক্ষ্যেই নাম নিজ বৈশিষ্ট্য বাস্তবায়নে ক্রিয়াশীল থাকে। এ জন্যই প্রাথমিক যুগের উলামা-ই-কিরাম আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামের সাথে মিলিয়ে নামকরণের তাগিদ দিয়েছেন এবং বিশ্বব্যাপী মুসলিম হিসেবে পরিচিতি লাভের জন্য আরবী শব্দে নামকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। পরবর্তীকালে ফারসী শব্দেও নামকরণের প্রচলন হয়।

মানুষের নামকরণের ইতিহাস

মানুষের নামকরণের ইতিহাস অতটা অস্পষ্ট নয়। আদি পিতা হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত মানুষ সৃষ্টি হয়েছে তাদের সবারই একটা নির্দিষ্ট নাম আছে। বস্তুত নামের মাধ্যমেই কোন ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। বিভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশ, ধর্ম, কৃষ্টি, গোষ্ঠী, বংশ ইত্যাদির প্রেক্ষিতে নামের বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে ধর্ম একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। শুধুমাত্র নাম শুনেই বুঝতে পারা যায় উক্ত নামের অধিকারী ব্যক্তি হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান না অন্য কোন ধর্মের লোক।

নাম রাখার ব্যাপারে সতর্কতা

নাম মানুষের পরিচয় বহন করে এবং নামের মাধ্যমেই মানুষের ধর্ম-কৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। তাই নাম রাখার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এ সম্পর্কে আমাদের জন্য দিক নির্দেশ রয়েছে।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,

{وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ}

এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না, ঈমান আনার পর কোন ব্যক্তিকে খারাপ নাম ধরে ডাকা অত্যন্ত গুনাহের কাজ এবং যারা এ ধরনের আচার হতে নিবৃত্ত না হয়, তারা অবশ্যই জালিম। (আল-কুরআন, সূরা আল-হুজরাত, ৪৯ : ১১)

নাম রাখার ব্যাপারে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়া সাল্লাম আমাদের জন্যে আদর্শ রয়েছে। তিনি বলেন,

إنّكم تُدعَوْنَ يومَ القيامَةِ باسمائِكُم وأسماءِ آبائكُم، فاحسِنُوا أسماءكم.

নিশ্চয় তোমাদেরকে কিয়ামতের দিন তোমাদের নাম এবং তোমাদের পিতার নামে ডাকা হবে। অতএব তোমরা নিজেদের নামকে সুন্দর করে রাখবে। (আল-হাদীস, সুনানে আবু দাউদ: ৪০৪৮ )

অন্য হাদীসসে বর্ণিত আছে,

تَسَمَّوْا بأسَماءِ الأنبياء، وأحَبُّ الأسماءِ إلى الله: عَبدُ الله وعبدُ الرحمن، وأصدَقُها: حارِثٌ وهَمَّامٌ، وأقْبَحُها: حَرْبٌ ومُرَّة.

তোমরা নাম রাখবে নবীদের নামের মত নাম এবং আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় নাম হল আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান, উৎকৃষ্ট নাম হল হারিস ও হুমাম এবং সবচেয়ে খারাপ নাম হল হরব (যুদ্ধ) এবং মুররা (তিক্ত)। (আল-হাদীস, সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৫০)

উল্লেখ্য, প্রত্যেক নামের পূর্বে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম সংযুক্ত করা উচিত। পুরুষ নামের নামের শেষে  (আকার) এবং উ (উকার) যোগ করে মেয়েদের নাম রাখা যায়।

আমাদের বাংলাদেশে এমন অসংখ্য পিতা-মাতা আছেন, যাঁরা নিজেদের সন্তান-সন্ততির ইসলামী নামকরণে আগ্রহী। কিন্তু আরবী ভাষায় প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং নাম নির্বাচনে কোন নির্দেশিকা না থাকার কারণে তাদের পক্ষে তা হয়ে ওঠে না। ভবিষ্যৎ বংশধরকে ইসলামী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত করার জন্য ইসলামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ আরবী নামের একটি সংকলন প্রকাশ করা একান্ত প্রয়োজন।

এ প্রয়োজনকে সামনে রেখে আইপিডিয়া-ipaedia.org বাংলা ভাষাভাষী পিতা-মাতার জন্য ইসলামিক নাম উপহার দিচ্ছে। প্রায় ৬০০০ (ছয় হাজার) ইসলামিক নাম আমদের সংকলনে রয়েছে।

আমরা বিভিন্ন শিরোনাম ও উপশিরোনামে আপনাদের জন্য ৬০০০(+) ইসলামিক নাম তুলে ধরেছি। সকল নামসমূহ বিস্তারিত পাবেন, আইপিডিয়া-র ইসলামিক নাম -এ।

আইপিডিয়া - ipaedia.org ইসলামিক নাম সংকলনে রয়েছে ছয় হাজারের অধিক আরবি বাংলা, ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় ছেলে-মেয়েদের ইসলামিক নাম।
আইপিডিয়া – ipaedia.org ইসলামিক নাম সংকলনে রয়েছে ছয় হাজারের অধিক আরবি বাংলা, ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় ছেলে-মেয়েদের ইসলামিক নাম।

ইসলামিক নাম এ আমাদের মূল শিরোনামগুলো হলো,

ছেলে-মেয়েদের ইসলামিক নাম অর্থসহ [বাছায়কৃত]
ছেলে-মেয়েদের ইসলামিক নাম অর্থসহ [নির্বাচিত]
ছেলে-মেয়েদের ইসলামিক নাম অর্থসহ [পরিমার্জিত]
ছেলে-মেয়েদের ইসলামিক নাম অর্থসহ [বিস্তারিত]
বিষয়ভিত্তিক ইসলামিক নাম

এছাড়াও আমার আরো বিভিন্ন শিরোনামে ইসলামিক নাম-সমূহ আপনাদের জন্য সাজিয়েছি।

সংযুক্তি- ০১ সন্তানের নামকরণে ইসলামের নির্দেশনা

[গবেষণামূলক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর মুখপত্র মাসিক আল-কাউসার-এর বর্ষ: ১৭, সংখ্যা: ০৪ শাওয়াল ১৪৪২ || মে ২০২১ থেকে সংগৃহীত]

মুহাম্মাদ—ছোট একটি শব্দ। একটি নাম। পৃথিবীর দেড়শ কোটি মুসলমানের আবেগ ও ভালোবাসা যে বিন্দুটিতে এসে একত্রিত হয়, এক হয়, তা—মুহাম্মাদ। আরবে-আজমে, সেকালে-একালে সমান প্রিয় এ শব্দ, এ নাম। নামটি আমাদের প্রিয় নবীজীর। তাঁর নামটি যখনই আমরা উচ্চারণ করি, হৃদয়ের সবটুকু ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রেম ও ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে আমরা দরূদ পড়ি—সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মুহাম্মাদ অর্থ—চির প্রশংসিত। নাম যেমন, বাস্তবেও তেমন। সত্যিই তিনি চির প্রশংসিত। তাঁর প্রশংসায় অঞ্চল দেশ সমাজ কাল গোত্র ভাষা এমনকি ধর্মও কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ঔদ্ধত্য ও বক্রতায় সীমালঙ্ঘনকারী না হলে চরম শত্রুরাও তাঁর প্রশংসা করতে বাধ্য, করেও চলছে। তাঁরই আরেকটি নাম আহমাদ। এর অর্থও অতি প্রশংসিত। আবার অধিক মাত্রায় প্রশংসাকারীও হতে পারে। বিশ্বজগতের প্রভু রাহমানুর রাহীমের প্রশংসা তাঁর মতো আর কে করতে পেরেছে! চির প্রশংসিত চির সুন্দর মুহাম্মাদ নামটি যখন রাখা হয় তাঁর জন্যে, তাঁর জন্মের পরপর, নামটি ছিল আরবের সে সমাজে প্রায় নতুন, একেবারেই নতুন। আর আহমাদ নামটির সূচনা তাঁকে দিয়েই হয়েছিল। এ নামদুটি জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষের নাম, এ নামদুটি তাই সর্বশ্রেষ্ঠ নামও।

নাম কী—এর উত্তরে বলা যায়, নাম আমাদের পরিচয় বহন করে। নাম আমাদের স্বাতন্ত্র্যকে ফুটিয়ে তোলে। নাম একজন ব্যক্তিকে অন্য অনেকের মধ্য থেকে পৃথক ও স্পষ্ট করে দেয়। নাম রাখার এ রেওয়াজ অনেক পুরনো। যখন থেকে ইতিহাসের সূচনা, নামের সূচনাও তখন থেকেই। জগতের প্রথম মানুষ প্রথম নবী—আদম আলাইহিস সালাম। তাঁর সঙ্গিনী প্রথম নারী—হাওয়া রা.। তারা দুজন, আদম-হাওয়া, আমাদের আদি পিতা ও আদি মাতা। এখান থেকেই শুরু মানুষের যাত্রা। নামকরণের প্রথা তাই নতুন কিছু নয়।

সন্তানের প্রতি ভালবাসা কি কখনো মাপা যায়! কিংবা কোনো শব্দে কি আসলেই তা কখনো প্রকাশ করা যায়! প্রকাশ-অসম্ভব! এ ভালোবাসার পাত্র, হৃদয়ের ধন, আদরের সন্তানের জন্যে যখন কেউ কোনো নাম নির্বাচন করে, সবটুকু ভালবাসা মিশিয়েই তা করে। সেরা সুন্দর আকর্ষণীয় নামটি বেছে নিতে চায় সকলেই। সুন্দর নাম নির্বাচনের এ আকাক্সক্ষাও মানুষের স্বভাবজাত, সৃষ্টিগত। কথা হল, এ সৌন্দর্যের মাপকাঠি কী? শ্রুতিমধুর হওয়া? সুন্দর অর্থবোধক হওয়া? প্রিয় মানুষের নাম হওয়া? না অন্য কিছু? প্রাচীন আরবের লোকদের নাম রাখার ক্ষেত্রে এ রুচি-বৈচিত্র্যের কথা লিখেছেন ইমাম ইবনুল কায়্যিম রাহ.। তার ভাষায়—‘সন্তানের নামকরণের ক্ষেত্রে তাদের বিভিন্ন রীতি ছিল। কেউ কেউ এমন নাম রাখতেন, যা শত্রুর বিরুদ্ধে জয়লাভের আশা সঞ্চার করে। যেমন, গালিব (বিজয়ী), গাল্লাব (অতিমাত্রায় বিজয়ী), মালিক (অধিকারী), যালিম (অন্যায়কারী, আক্রমণকারী), মুকাতিল (যোদ্ধা) ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার শান্তি লাভের প্রত্যাশায় নাম রাখতেন—সালিম (নিরাপদ), সাবিত (অবিচল) ইত্যাদি। কেউ লক্ষ রাখতেন সৌভাগ্যের দিকে এবং তারা এভাবে নাম রাখতেন—সা‘দ, সাঈদ, আস‘আদ, মাসউদ ইত্যাদি। এসব নামের অর্থ সৌভাগ্যবান, সুখী। কেউ আবার শত্রুর মনে ভীতি সঞ্চার করতে নির্বাচন করতেন—আসাদ (সিংহ), লায়ছ (সিংহ) ইত্যাদি সাহসী পশুর নাম। কেউ পছন্দ করতেন এমন নাম, যা কঠোরতা ও শক্তিপ্রকাশক, যেমন, হাজার (পাথর)। আবার এমনও হত, স্ত্রীর প্রসববেদনা শুরু হলে কেউ ঘর থেকে বের হত, এরপর সামনে প্রথম যা পেত তা দিয়েই সন্তানের নাম রাখত। তা কোনো হিংস্র পশু, খেঁকশিয়াল, গুইসাপ, কুকুর, হরিণ ইত্যাদি যাই হোক। এমন পরিস্থিতিতেই আরবের সমাজে ইসলামের সূচনা হয়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন ঘটে। …’ [ইবনুল কায়্যিম, মিফতাহু দারিস সাআদাহ, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৪৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ বৈরুত সংস্করণ (সংক্ষেপিত)]

ইসলামে সুন্দর নাম

মুসলমানদের নিকট নাম কেবলই ব্যক্তি-পরিচয়বাহক নয়। ব্যক্তির নাম তার চিন্তাচেতনা ও রুচি-অভিরুচির একটি আয়না। নাম তার আকীদা-বিশ্বাসও প্রকাশ করে। ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে যেমন সে শিরক ও কুফর থেকে দূরে থাকে, এ দূরত্ব টিকে থাকে নামকরণের ক্ষেত্রেও। এমন কোনো শব্দ কোনো মুসলমানের নাম হতে পারে না, যা শিরকের সংশয় সৃষ্টি করে কিংবা যেখানে কুফুরির আভাস পাওয়া যায়। যেসব শব্দ নিজেদের ঈমান-আমল ও ইসলামী চেতনাবিরোধী, সেসবও আমাদের নাম নয়। ইসলাম আমাদেরকে সর্বত্রই সুন্দরের শিক্ষা দেয়। মানুষ হিসেবে যা সুন্দর, যতটুকু সুন্দর, যেভাবে সুন্দর, তা আমাদেরকে ঠিক সেভাবেই ততটুকু করার নির্দেশ দেয় আমাদের পবিত্র ধর্ম। সন্তানের নামকরণের বিষয়টিও এর ব্যতিক্রম নয়। বরং বলা যায়, একটি সুন্দর ও ভালো নাম রাখা—সন্তানের প্রতি মা-বাবার প্রথম কর্তব্য।

পরকালে বিশ্বাসী একজন মুমিনের কাছে দুনিয়ার এ জীবন তো যাত্রাবিরতি মাত্র। পরকালই তার আসল গন্তব্য। মুমিনমাত্রই বিশ্বাস করে—পরকালের সুখই প্রকৃত সুখ, সেখানকার বিপদই আসল বিপদ। স্বাভাবিকভাবেই তার নাম কেবল এ দুনিয়ার বিষয় নয়। জন্মের পর আদর করে বাবা-মা যে নামটি নির্বাচন করবেন, দুনিয়ার এ জীবনে যেমন তাকে এ নাম নিয়েই চলতে হয়, এ নাম তার সঙ্গী হবে পরকালেও। সুন্দর নাম রাখার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই পরকালের বিষয়েও সজাগ করেছেন—

إِنّكُمْ تُدْعَوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِأَسْمَائِكُمْ، وَأَسْمَاءِ آبَائِكُمْ، فَأَحْسِنُوا أَسْمَاءَكُمْ.

কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে তোমাদের নাম ও তোমাদের বাবাদের নাম ধরেই ডাকা হবে। তাই তোমরা সুন্দর নাম রাখো। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৫০

বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের নিকট নাম কেবলই নাম নয়। নাম কেবলই এ দুনিয়াতে আমাদের পরিচয়বাহক নয়। এ নাম যেমন দুনিয়াতে আমাদের ব্যক্তিসত্তা, আমাদের আকীদা-বিশ্বাস, আমাদের রুচি ও মেযাজের পরিচায়ক, পরকালে এ নাম ধরেই আমাদের ডাকা হবে। সুন্দর নাম রাখা কেবলই আমাদের একটি সৌন্দর্যের বিষয় নয়, এটি আমাদের জন্যে শরীয়তের নির্দেশনাও।

ইসলাম আমাদেরকে যেমন সুন্দর নাম রাখার নির্দেশ দিয়েছে, সুন্দর নামের মাপকাঠিও এখানে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নোক্ত হাদীসটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য—

تَسَمّوْا بِأَسْمَاءِ الْأَنْبِيَاءِ، وَأَحَبّ الْأَسْمَاءِ إِلَى اللهِ عَبْدُ اللهِ، وَعَبْدُ الرّحْمَنِ، وَأَصْدَقُهَا حَارِثٌ، وَهَمّامٌ، وَأَقْبَحُهَا حَرْبٌ وَمُرّةُ.

তোমরা নবীদের নামে নাম রেখো। আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় নাম আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান। সবচেয়ে সত্য নাম হারেস ও হাম্মাম আর সবচেয়ে খারাপ নাম হারব ও মুররাহ। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৫২

এ হাদীসে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়—

এক. নবীদের নামে সন্তানের নামকরণ করা।

দুই. আল্লাহ তাআলার সর্বাধিক প্রিয় নাম।

তিন. সবচেয়ে সত্য নাম এবং

চার. সবচেয়ে খারাপ নাম।

নবীগণ ছিলেন জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবদের এক মহান কাফেলা। তাঁরা সকলেই ছিলেন নিষ্পাপ। তাঁরা সকলেই আল্লাহ তাআলার বিশেষভাবে নির্বাচিত বান্দা। হযরত আদম আলাইহিস সালামের মধ্য দিয়ে এ কাফেলার শুরু, আর এর পরিসমাপ্তি ঘটে রাহমাতুল লিল আলামীন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের মধ্য দিয়ে। মহান আল্লাহ নিজের বান্দাদেরকে মুক্তির পথ দেখানোর জন্যে, অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষকে আলোর পথে তুলে আনার জন্যে মহামানবদের এ কাফেলাকে নির্বাচন করেছিলেন। তাদের প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি পদক্ষেপ—মানব জাতির জন্যে অনুপম আদর্শ। সঙ্গত কারণেই আল্লাহ তাআলার বিশেষ নির্বাচিত এ কাফেলার নামগুলোও তাঁর নিকট পছন্দনীয় হবে, নামগুলো সুন্দর ও অনুকরণীয় হবে। উপরোক্ত হাদীসের প্রথম বাক্যে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নির্দেশনা দিয়েছেন তাঁদের নামে সন্তানের নামকরণ করতে। নবীগণ সংখ্যায় ছিলেন অনেক। কিন্তু তাঁদের অনেকের নামই আমরা জানি না। জানি কেবল কয়েকজনের নাম। পবিত্র কুরআনে ও হাদীসের সহীহ বর্ণনায় ২৫-৩০জন নবীর নাম আলোচিত হয়েছে। সন্তানের নাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে এটি প্রথম নির্দেশনা।

আর স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভিত্তিতে নিজ সন্তানের নাম রেখেছেন—তাঁর সন্তান ইবরাহীম জন্ম নিলে তিনি বললেন—

وُلِدَ لِي اللّيْلَةَ غُلَامٌ فَسَمّيْتُهُ بِاسْمِ أَبِي إِبْرَاهِيمَ.

আজ রাতে আল্লাহ আমাকে একটি পুত্র সন্তান দান করেছেন। আমি পিতা ইবরাহী আলাইহিস সালামের নামানুসারে তার নাম রেখেছি—ইবরাহীম। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩১৫

হাদীসের দ্বিতীয় বাক্যে বলা হয়েছে আল্লাহ তাআলার নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয় নামের কথা। এখানে দুটি নাম উল্লেখিত হয়েছে—আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান। আবদুল্লাহ অর্থ আল্লাহর বান্দা, আর আবদুর রাহমান অর্থ পরম দয়াময় সত্তা (আল্লাহ্)র বান্দা। ‘আল্লাহ’ শব্দটি আল্লাহ তাআলার সত্তাগত নাম, আর ‘রহমান’ তাঁর গুণগত নাম। এ নাম দুটি অধিক প্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ—এতে বান্দার বন্দেগি ও দাসত্বের ঘোষণা রয়েছে। মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয়—মানুষ আল্লাহর বান্দা। এটিই তার সবচেয়ে মর্যাদাকর পরিচয়। এ পরিচয়ের মধ্যেই নিহিত তার সকল সুখ ও শান্তি, সৌভাগ্য ও সফলতা। দ্বিতীয়ত, এ নামকরণের মধ্য দিয়ে আল্লাহ তাআলার নামটি অধিক পরিমাণে উচ্চারিত হবে। এ নামের কাউকে যখন কেউ ডাকবে, অবচেতনভাবেই আল্লাহর নামটি সে উচ্চারণ করবে, যাকে ডাকবে, সেও শুনবে আল্লাহর নাম। এর বরকত অস্বীকার করার নয়।

কথা হল, এ নামদুটির শ্রেষ্ঠত্ব কি এখানেই সীমিত, না ব্যাপক? আল্লাহ তাআলার আরও যত গুণবাচক নাম, সেগুলোর সঙ্গে ‘আবদ’ শব্দটি যোগ করে যদি কারও নাম রাখা হয় তবে সেখানেও কি এ শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে, না তা এ দুটি নামের মধ্যেই পাওয়া যাবে? এ নিয়ে আলেমগণ দুরকম মতই প্রকাশ করেছেন—এক. এ শ্রেষ্ঠত্ব এ নামদুটিতেই সীমাবদ্ধ। কারণ আল্লাহ তাআলার এ নাম দুটি—আল্লাহ ও রাহমান—অনেকটাই ব্যতিক্রম। এ দুটি কেবলই আল্লাহ তাআলার জন্যে ব্যবহার করা যায়। অন্য অনেক নামই মানুষের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। পবিত্র কুরআনে মানুষকে আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরিচিত করানোর জন্যে এ দুটি নামই ব্যবহৃত হয়েছে—কোথাও আল্লাহর বান্দা, কোথাও রহমানের বান্দা। তাই এ শ্রেষ্ঠত্ব এ নামদুটিতেই সীমিত।

দুই. আল্লাহ তাআলার যে কোনো নামের সঙ্গে ‘আবদ’ যোগ করে যে নাম রাখা হয় তাও এ শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। কারণ সেখানেও নিজের দাসত্বের পরিচয় প্রকাশিত হয়।

হাদীসের তৃতীয় ও চতুর্থ বাক্যে দুটি সত্য নাম ও দুটি মন্দ নাম বর্ণিত হয়েছে। সত্য নাম মানে বাস্তব নাম। যে নামের অর্থের সঙ্গে মানুষের চরিত্রের মিল রয়েছে তাই সত্য নাম। সত্য নাম দুটি—হারিস ও হাম্মাম। হারিস অর্থ উপার্জনকারী, কাজে নিয়োজিত, কর্মব্যস্ত আর হাম্মাম অর্থ ইচ্ছাপোষণকারী। প্রতিটি মানুষই কাজে নিয়োজিত, প্রতিটি মানুষই কোনো কিছুর ইচ্ছা পোষণ করে। তাই মানুষ মাত্রই হারিস, হাম্মাম। এ বিবেচনায়ই নামদুটি সবচেয়ে সত্য ও বাস্তব নাম। এর বিপরীতে দুটি মন্দ নামও এখানে বর্ণিত হয়েছে—হারব ও মুররা। হারব অর্থ যুদ্ধ আর মুররা অর্থ তিক্ত। অর্থের বিবেচনায় নামদুটিতে কোনো সৌন্দর্য নেই। এ থেকে বোঝা যায়, নামকরণের ক্ষেত্রে নামটি সুন্দর অর্থবোধক হওয়াও নামের শ্রেষ্ঠত্বের একটি মানদণ্ড।

নেককার বুযুর্গদের নামে নাম রাখা

বড়দের নামে নাম রাখার ক্ষেত্রে এ রীতিটিও অনেক প্রাচীন। হাদীসের কিতাবে এ সংক্রান্ত একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের মায়ের নাম ছিল মারইয়াম। তাঁর জন্মের কাহিনী পবিত্র কুরআনে আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা যখন নিজের কুদরতের প্রকাশ ঘটিয়ে কোনো পুরুষের সংস্পর্শ ছাড়াই হযরত মারইয়ামের গর্ভ থেকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম দিলেন, তার গোত্রের লোকেরা তাকে বলেছিল—(তরজমা) ‘হে হারূনের বোন! তোমার বাবা তো মন্দ মানুষ ছিলেন না, তোমার মাও অসৎ চরিত্রের কোনো নারী ছিলেন না।’ [সূরা মারইয়াম (১৯) : ২৮] আবার নবী হযরত মূসা আলাইহিস সালামের ভাইয়ের নামও ছিল হারূন। তিনিও ছিলেন নবী! অথচ মূসা আলাইহিস সালাম ছিলেন হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের চেয়ে অনেক আগের। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, সময়ের বিস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও পবিত্র কুরআনে এভাবে মারইয়ামকে হারূনের বোন বলে উল্লেখ করা হল কেন? সাহাবী হযরত মুগীরা ইবনে শো‘বা রা. গিয়েছিলেন খ্রিস্টানদের এলাকা নাজরানে। নাজরানবাসী তখন তাকে এ প্রশ্ন করে—তোমরা তো পড়—হে হারূনের বোন, অথচ মূসা ও ঈসার মধ্যে কী দুস্তর ব্যবধান! এরপর তিনি মদীনায় ফিরে এসে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্নটি করেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন—

إِنّهُمْ كَانُوا يُسَمّونَ بِأَنْبِيَائِهِمْ وَالصّالِحِينَ قَبْلَهُمْ.

তারা তাদের নবীদের নামে ও তাদের পূর্বসূরি নেককার লোকদের নামে নামকরণ করত। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৩৫

আমরা উপরে নবীদের নামে নামকরণের বিষয়টি উল্লেখ করেছি। পূর্বসূরি নেককার ব্যক্তিদের তালিকায় প্রথমেই তো নবীগণ, এরপর তাঁদের অনুসারী সাহাবীগণ, এরপর উম্মাহর পরবর্তীকালের বুযুর্গ ব্যক্তিগণ। নবীদের পর সাহাবীগণ শ্রেষ্ঠ মানবকাফেলা। তাদের সকলকে নিয়েই পবিত্র কুরআনের ঘোষণা—

رضي الله عنهم ورضوا عنه.

আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট, তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট।

তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্য লাভ করেছেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র মুখে তাদের নাম উচ্চারিত হয়েছে। তাদের সেসব নাম ধরে তিনি তাদের ডেকেছেন—একটি নাম বরকতময় হওয়ার জন্যে আর কী চাই!

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যের বরকতে সাহাবীগণ সকলেই ছিলেন এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। যে সাহাবী জীবনে মাত্র একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন, তিনিও পরবর্তী কালের সকল ওলী-বুযুর্গের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন অতি বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। মর্যাদাবান এ কাফেলার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ খোলাফায়ে রাশেদীন। সাহাবীদের কারও কারও সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন বিশেষ ফযীলতের কথা। কেউ কেউ ছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্য, আত্মীয়, বংশের লোক। কেউ আবার তাঁর পক্ষ থেকে আরোপিত বিশেষ কোনো দায়িত্ব পালন করেছেন। কেউ ওহীলেখক ছিলেন, কেউ ছিলেন কাজী কিংবা মুআল্লিম। তাঁর খাদেম ও আজাদকৃত দাস যারা, তাদের কথাও আলাদাভাবে আলোচিত হয়েছে সাহাবীদের জীবনী নিয়ে রচিত গ্রন্থসমূহে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যে কোনোভাবেই হোক, একটি বিশেষ সম্পর্ক থাকার কারণে তাদের মর্যাদা একটু ভিন্ন। স্বাভাবিক কথা, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি যার ভালোবাসা নিখাঁদ, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি ব্যক্তির প্রতিও তার থাকবে ভক্তি ও শ্রদ্ধা।

মুহাম্মাদ নামের প্রতি আমাদের সম্মান

মুহাম্মাদ নামটির প্রতি ভালবাসা হৃদয়ের গভীরে আমরা লালন করি। নামকরণের ক্ষেত্রে এ ভালবাসা আমরা সাধারণত দুইভাবে প্রকাশ করি—

এক. সরাসরি মুহাম্মাদ নাম রাখার মধ্য দিয়ে। ইসলামের শুরুর যুগ থেকে আজকের আধুনিক যুগ পর্যন্ত প্রতি যুগেই এ নামটি মুসলমানদের মধ্যে সমান জনপ্রিয়।

দুই. মূল নাম না হলেও নামের শুরুতে কিংবা শেষে ‘মুহাম্মাদ’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে। প্রচলিত আছে, এককালে এ অঞ্চলে মুসলমানদের নামের শুরুতেও হিন্দুদের মতো শ্রী শ্রী ব্যবহার করা হত। এর বিকল্প হিসেবে চালু হয়েছে ‘মুহাম্মাদ’ যোগ করার রীতি। নবীনামের প্রতি এ সম্মান মুসলমান মাত্রই হৃদয় দিয়ে ধারণ করে। (অবশ্য মুহাম্মাদ নাম যুক্ত হওয়ার সাথে এ নাম রাখার ফযীলত সংক্রান্ত কিছু জাল বর্ণনারও প্রভাব রয়েছে। যেমন, ‘মুহাম্মাদ নামের সকল ব্যক্তি জান্নাতে যাবে’। বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : এসব হাদীস নয়, পৃ. ১৫৩)

তবে লক্ষণীয়, যাদের নামের সাথে ‘মুহাম্মাদ’ শব্দটি রয়েছে তারা যখন নামটি লিখি তখন যেন সংক্ষিপ্ত কোনো রূপে তা না লিখি। স্পষ্ট অক্ষরে পুরোটিই লিখব, সংক্ষেপিত কোনো রূপে নয়।

একাধিক নাম

আমাদের সমাজের আরেকটি প্রচলন—নামে একাধিক অংশ থাকতে হবে। আবার একাধিক অংশও যথেষ্ট নয়, নাম হতে হবে দুটি। একটি আসল নাম, আরেকটি ডাক নাম। আসল নামটি হবে সুন্দর অর্থবোধক, আর ডাকনামটি হবে অনেকটা অর্থহীন। এ রেওয়াজও পরিত্যাজ্য। নামে একাধিক অংশ থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। একাধিক নামও হতে পারে। তবে সবটাই হতে হবে সুন্দর অর্থবোধক। উপরে আমরা সুন্দর নামের যে নীতি বলে এসেছি, আসল নাম আর ডাক নাম—সর্বত্রই তা লক্ষণীয়।

নাম কখন রাখবে

শিশুর নাম রাখবে কখন—এ নিয়েও আমাদের সমাজে চলে একপ্রকার ঢিলেমি। নাম পছন্দ ও বাছাই করতেই চলে যায় সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি মাসও। এটি উচিত নয়। জন্মের সপ্তম দিনে নাম রাখা মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

كُلّ غُلَامٍ رَهِينَةٌ بِعَقِيقَتِهِ تُذْبَحُ عَنْهُ يَوْمَ سَابِعِهِ وَيُحْلَقُ وَيُسَمّى.

প্রতিটি সন্তান আকীকার সাথে আবদ্ধ থাকে। সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু যবাই করবে, তার মাথা মুণ্ডিয়ে দেবে এবং তার নাম রাখবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮৩১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০০৮৩

নাম রাখার ক্ষেত্রে সতর্কতা

আমাদের সমাজে আরবী শব্দে সন্তানের নাম রাখার বিষয়টি বেশ প্রচলিত, এটি কাম্যও। সে শব্দটি কোনো নবী-সাহাবী কিংবা বুযুর্গ কারও নামও হতে পারে, আবার সুন্দর অর্থবোধক যে কোনো আরবী শব্দও হতে পারে। বলার কথা হল, এক্ষেত্রে কেউ কেউ একটি ভুলের শিকার হন। কোনো আরবী শব্দ শুনতে ভালো লাগলেই তা দিয়ে সন্তানের নাম রেখে দেন, বিশেষত যদি তা কুরআনের শব্দ হয় তবে তো আর কোনো কথাই নেই! অথচ এক্ষেত্রে দেখা যায়, কখনো নামটি আরবী ভাষার বিবেচনায় শুদ্ধই হয় না। এক তো ভাষাগত শুদ্ধাশুদ্ধির বিষয়। কখনো আকীদাগত সংকটও সৃষ্টি হয়। একজনের নাম শুনলাম—আল্লাহুস সামাদ, আরেকজনের নাম—যুল জালালি ওয়াল ইকরাম। সন্দেহ নেই, পবিত্র কুরআনের প্রতি অত্যন্ত ভক্তি ও ভালবাসা নিয়েই সন্তানের জন্যে এ নাম দুটি নির্বাচন করেছিলেন দুইজন বাবা। কিন্তু এগুলো যে আল্লাহর নাম! এবং এ নাম দিয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নামকরণ করা জায়েযই নয়। নাম হবে আবদুস সামাদ—সামাদ বা অমুখাপেক্ষী সত্তার বান্দা। নাম রাখতে দেখা যায়—মুরসালীন। কুরআনের শব্দ। অথচ নামটি ভাষাগত ও আকিদাগত—দুই দিক থেকেই অশুদ্ধ। একে তো মুরসালীন মানে রাসূলগণ। রাসূলের ধারা তো শেষ হয়ে গেছে দেড় হাজার বছর পূর্বেই। এখন আবার কেউ রাসূল হয় কী করে! তাও একজন নয়, অনেক রাসূল! পবিত্র কুরআন আল্লাহর কালাম। তাই বলে সেখানকার সব শব্দই যে নাম রাখার মতো—বিষয়টি এমন নয়। কুরআনে তো শয়তান, ফেরাউন, হামান, কারূনের নামও এসেছে। তাই বলে তাদের নামেও কি নাম রাখা যাবে! একটি শব্দ—মাহীন। কুরআনের শব্দ। তাই বলে কি নাম রাখা যাবে? এর অর্থ—তুচ্ছ, লাঞ্ছিত। এবার ভাবুন তো!

আল্লাহ তাআলার নাম নয়, কিন্তু শব্দটি একমাত্র তাঁর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে—এমন কোনো শব্দ দিয়েও মানুষের নাম রাখা ঠিক নয়। একটি উদাহরণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

أَخْنَى الأَسْمَاءِ يَوْمَ القِيَامَةِ عِنْدَ اللهِ رَجُلٌ تَسَمّى مَلِكَ الأَمْلاَكِ.

কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সবচেয়ে অপছন্দনীয় নাম হবে ঐ ব্যক্তির নাম, যে ‘মালিকুল আমলাক’ নাম ধারণ করেছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬২০৫

মালিকুল আমলাক—অর্থ রাজাধিরাজ। সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস সুফিয়ান ছাওরী রাহ. এর ব্যাখ্যা করেছেন ‘শাহান শাহ’ শব্দে। মালিকুল আমলাক, রাজাধিরাজ আর শাহান শাহ—যাই বলি, এ শব্দগুলো কোনো মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা বৈধ নয় এবং এজাতীয় অন্য কোনো শব্দ দিয়েও নাম রাখা জায়েয নয়।

নামকরণের সময় পরিবেশও বিবেচনায় রাখুন

নাম সুন্দর হওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশেরও দখল রয়েছে। আরবি একটি সুন্দর শব্দ বাংলায় ভিন্ন অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে। উদাহরণ দিই—আরবী শব্দ فاضل (ফাযিল)। অর্থ—সম্মানিত, মর্যাদাবান। অথচ বাংলা ভাষায় শব্দটি ঠিক এর বিপরীত অর্থ ধারণ করে। বাংলায় ফাজিল মানে দুষ্টু। এ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা উচিত। এতে পরবর্তীতে অনেক অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি থেকে বেঁচে থাকা যাবে।

এর পাশাপাশি নামটি যাদের মুখে বেশি উচ্চারিত হবে, তারা যেন সহজে উচ্চারণ করতে পারেন—তাও লক্ষণীয়। তা যদি না হয়, তবে নামটি ভুল উচ্চারিত হবে। নামের সৌন্দর্য তখন ক্ষুণ্নই হয়!

নামে কি ভুল নেই?

নামে কি কোনো ভুল নেই? অনেককেই বলতে শোনা যায়—নামে কোনো ভুল নেই। কথাটি আংশিক মেনে নেয়া যেতে পারে। নামে ভুল নেই—এর অর্থ হচ্ছে, কেউ নিজের নাম যেভাবে লেখে, অন্য সকলেই তা সেভাবেই লিখবে। নাম পরিবর্তন করবে না, সংশোধন করতে যাবে না। হাঁ, সংশোধন করতে চাইলে ঐ ব্যক্তিকেই বলা উচিত, আপনার নাম এরকম হবে, ওরকম নয়। এতটুকু ঠিক আছে। অসুন্দর কিংবা অশুদ্ধ নাম সংশোধন করে দেয়া প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলও। হাদীস শরীফে আছে, তিনি অসুন্দর নাম পরিবর্তন করে দিতেন। আবদুশ শামসকে করে দিয়েছেন আবদুল্লাহ, বাররাকে পরিবর্তন করে রেখেছেন যায়নাব ইত্যাদি। কিন্তু নামে ভুল নেই বলে কেউ যদি বলতে চায়—নাম একভাবে রাখলেই হল, তবে তা হবে নিতান্তই ভুল। ভুল ভুলই। তা নামের মধ্যে হলেও ভুল। আমাদের দৃষ্টিতে, এ ভুল হতে পারে নামের নির্বাচনের ক্ষেত্রে, অর্থগত, উচ্চারণগত, এমনকি আকিদাগত দিক থেকেও ভুল হতে পারে। তাই নাম রাখার সময়ই সঠিক নামটি নির্বাচন করতে হবে। মূল শব্দটি কী—তা জেনে নাম রাখতে হবে। আমরা অনেকসময় আরবী শব্দের ইংরেজি উচ্চারণ দেখে বাংলায় নাম রাখি। এতে যে কী হযবরল হয়—ভাবতে পারেন! একটি উদাহরণ লক্ষ করুন—আরবি নাম ثابت। এর বাংলা উচ্চারণ সাবিত। কিন্তু ইংরেজিতে ‘সা’ কে লেখা হয় ঞয দিয়ে। ফলে নামটি হয়ে যাচ্ছে ঞযধনরঃ। এখন ইংরেজি এ শব্দকে যখন আমরা বাংলায় নিয়ে আসি তখন হয়ে যায় থাবিত, আরেকটু পরিবর্তন হয়ে তাবিথ। এবার দেখুন, কোথায় সাবিত, আর কোথায় তাবিথ! অথচ আরবী নামটি আরবী ভাষার সঙ্গে মিলিয়ে রাখলে এ ঘটনার সুযোগ ছিল না।

আবার যখন দুই শব্দ মিলিয়ে এভাবে নাম রাখা হয়—আশরাফুল ইসলাম, তাওহীদুল আলম, তখন আমরা সংক্ষেপে ডাকতে গিয়ে বলি—আশরাফুল, তাওহীদুল। অথচ এটা ভুল। হবে—আশরাফ, তাওহীদ। আরবী ভাষা যারা জানেন তাদের নিকট এর কারণ স্পষ্ট।

শেষ কথা, সন্তানের জন্যে একটি সুন্দর ও ভালো নাম নির্বাচন করা কেবলই একটি রেওয়াজ নয়। একটি দায়িত্বও। ইসলামের দৃষ্টিতেও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নামের মধ্য দিয়েই মানুষ টিকে থাকে। দুদিনের এ জীবন শেষ হয়ে গেলেও কাজে-অবদানে মানুষ বেঁচে থাকে দীর্ঘদিন। সেখানেও পরিচয়ের মাধ্যম—এ নামটিই। তাই প্রয়োজন সতর্কতা ও সচেতনতা। মুমিন তো সচেতনই হয়।

শেয়ার করুন

সূচীপত্র

error: Content is protected !!