কুরআনের নাম ও নামকরণের তাৎপর্য
আল্লামা আবুল মাআলী রাহিমাহুল্লাহ [1] স্বীয় কিতাবে কুরআনের ৫৫টি নাম উল্লেখ করেছেন।[2] কেউ কেউ আবার কুরআনের নাম ৯০-এর চেয়েও অধিকের কথা বলেছেন। বস্তুত তারা কুরআনের সিফাত বা গুণগত নামসমূহ যেমন- মাজীদ (مجید), কারীম (کریم), ইত্যাদিকেও আসল নাম গণনা করত এগুলোর সংখ্যা ৯০ পর্যন্ত দাড় করিয়েছেন। অন্যথায় প্রকৃত অর্থে কুরআনের নাম সর্বমোট ৫টি। যথা-
১. আল-কুরআন (القرأن)৷
২. আল-ফুরকান (الفرقان)।
৩. আয-যিকর (الذكر)।
৪. আল-কিতাব (الكتاب)।
৫. আত-তানযীল (التزيل)।[3]
কেননা পবিত্র কুরআনুল কারীম স্বয়ং ৫টি নামে নিজের পরিচয় দিয়েছে।[4] এ সকল নামের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ নাম হলো ‘আল-কুরআন’ ৷ এমনকি স্বয়ং মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনই একষট্টি স্থানে নিজের কালামকে এ নামেই পরিচয় দিয়েছেন।[5]

কুরআন এর মাসদার বা মূল উৎস
উৎসগত দিক থেকে ‘কুরআন’ শব্দটি ‘ক্বরআ-ইয়াক্বরউ’ (قر یقرا) থেকে নির্গত। যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে একত্রিত করা।[6]
পরবর্তীতে এ শব্দটি ‘পাঠ করা’ অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকে। কেননা, পাঠ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অক্ষর ও শব্দমালাকে একত্রিত করতে হয়।
কুরআন এর মাসদার বা মূল উৎস ‘কিরাআতুন’ (قراءَۃٌ) ব্যতীত – (الْقُرْآنِ -কুরআন) শব্দেও ব্যবহৃত হয়। যেমন মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ
‘নিশ্চয়ই এর সংরক্ষণ ও পাঠ আমার দায়িত্বে। [সূরা আল-ক্বিয়ামাহ্ : (৭৫) : ১৯]
আর আরবী ভাষায় মাসদার কখনো কখনো ইসমে মাফউল (اسم مفعول) বা (past participle) এর অর্থে ব্যবহার করা হয়। আর এই অর্থেই আল্লাহর কালামকে ‘কুরআন’ (পঠিত কিতাব) [7] বলা হয় ।
পবিত্র কুরআনুল কারীমকে ‘কুরআন’বলে নামকরণের অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হলো, মুলত আরবের কাফের সম্প্রদায়ের বক্তব্যকে প্রতিহত করার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত এই গ্রন্থকে ‘কুরআন’ বলে নামকরণ করা হয়েছে। কেননা তারা বলত,
لا تَسْمَعُوا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ
তোমরা এই কুরআন শ্রবণ করোনা এবং তা আবৃত্তি কালে শোরগোল সৃষ্টি করো যাতে তোমরা জয়ী হতে পারো।’ [সূরা হা-মীম আস-সিজদাহ্ /(ফুছছিলাত) : (৪১) : ২৬]
এখানে কাফেরদের প্রত্যাখ্যানমূলক শব্দের বিপরীতে ‘কুরআন’ নামকরণ করে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কুরআনের দাওয়াতকে এই ধরণের হীন আওয়াজ দ্বারা দাবিয়ে রাখা যাবে না।
বস্তুত এই কিতাব পাঠ করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত পাঠ করা হবে। আর একারণেই এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, সমগ্র বিশ্বে পবিত্র কুরআনুল কারীমই হচ্ছে সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ।
কুরআনের পারিভাবিক সংজ্ঞা
কুরআনের পারিভাবিক সংজ্ঞা এভাবে করা হয়ে থাকে,
المنزل علي الرسول المكتوب في المصاحف المنقول الينا نقلاً متواتراً بلا شبهة
অর্থাৎ ‘মহান আল্লাহর সেই মহাবাণী যা মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে, মাসাহিফের মধ্যে লিপিবদ্ধ রয়েছে, এবং সন্দেহাতীতভাবে ধারাবাহিক সূত্র পরম্পরায় আমাদের কাছে পৌছেছে।’[8]
প্রকাশ থাকে যে, এ সংজ্ঞাটি সকল আহলে ইলমের সর্বসম্মত সংজ্ঞা। এতে কারো কোনো দ্বিমত নেই।
তথ্যসূত্র
[1] আবুল মাআলী হলো তার উপনাম ৷ পূর্ণনাম আযীযি ইবনে আবদুল মালিক। উপাধি ‘শাইযালা’। তিনি হিজরী পঞ্চম শতকের শাফেঈ মাযহাব অনুসারী একজন বিজ্ঞ আলেম। তার রচিত গ্রন্থ ‘আল-বুরহান ফী মুশকিলাতিল কুরআন’ থেকেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে আল্লামা যারকাশী রাহিমাহুল্লাহ ও আল্লামা জালালুদ্দীন সুযূতী রাহিমাহুল্লাহ উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তিনি ৪৯৪ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। (‘ওফায়াতুল আইয়ান’ ইবনে খাল্লিকান : ১/৩১৮)
[2] ‘আল ইতকান ফী উলূমিল কুরআন’: ১/৫১) আল্লামা সুযূতী রচিত মাতবাআ হিজাযী, কায়রো ১৩৬৮ হিজরী।
[3] ‘মানাহিলুল ইরফান’: ১/৮, আল্লামা যুরকানী রাহিমাহুল্লাহ রচিত মাতবাআ ঈসা আল বাবী আল হালাবী ১৩৭২ হিজরী।
[4] আল-ফুরকান-এর জন্য সূরা আ-লু ইমরান : (০৩) : ২, ‘আয-যিকর’-এর জন্য সূরা আ-লু ইমরান : (০৩) : ৫৮, সূরা আল-হিজ্র : (১৫) : ৬ এবং সূরা ছ্বদ : (৩৮) : ৮ আয়াত। ‘আল-কিতাব’-এর জন্য সূরা আল-বাকারা : (০২) : ১, সূরা আন- নাহ্ল : (১৬) : ৬৪ ও ৮৭, ‘আত-তানযীল’-এর জন্য সূরা ইয়াসীন : (৩৬) : ৫, সূরা আল-ওয়াক্বিয়াহ্ : (৫৬) : ৮ এবং সূরা আল-হাক্কাহ : (৬৯) : ৬৯ আয়াত দেখুন।
[5] ‘ফাতহুর রহমান লিতালিবি আয়াতিল কুরআন’: ৩৫৮-৩৫৯, ইলমী যাদাহ আল-হাসানী: মাকতাবাতুল আহলিয়া, বৈরুত,১২২৩ হিজরী।
[6] ‘আল-মুফরাদ ফী গরীবিল কুরআন’: 8১১ আর রাগীব ইসফাহানী, আসাহহুল মাতাবি, করাচী ১৩৮০ হিজরী।
[7] আল ইতকান: ৫২ ও ‘মানাহিলুল ইরফান’ ১/৭) এই শব্দটির মূল ধাতু নিরূপণে আরো বেশ কয়েকটি মতামত রয়েছে। তবে কোনোটিই বিতর্কের উর্ধ্বে নয়।
[8] আত-তালবীহ্ মাআত তাওযীহ্’ ১/২৬, মাতবাআ মুসতফা আল-বাবী, মিসর।