কুরআন বিশ্বকোষ
কুরআন বিশ্বকোষ

সর্বত্র শুধুই মূর্তি

সংকলক : বিজ্ঞ সম্পাদক মন্ডলী

বিষয় : বিষয় ভিত্তিক তাফসীরুল কুরআন

সর্বত্র শুধুই মূর্তি

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে সময়ে ইসলামী দাওয়াতের সূচনা করেছিলেন সে সময়ে আরবে নানা ধরণের ধর্মমত প্রচলিত ছিল। এক আল্লাহর দাসত্ব করার লোক সংখ্যা ছিল হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন। কেউ আকাশের চাঁদকে, কেউ আকাশের তারকা মালার, এর মধ্যে আবার ছোট তারকার ও বড় তারকার পূজারী ছিল। কেউ সূর্যকে, কেউ বাতাশকে, কেউ সাগর-মহাসাগরের, কেউ মাটির পুতুলের, কেউ বৃক্ষ-তরু-লতার দাসত্ব করতো।
কেউ আল্লাহকে বিশ্বাস করতো বটে, কিন্তু সে বিশ্বাস ছিল অংশীদারির ঘৃণ্য স্পর্শে কলংকিত। তারা ধারণা করতো, আল্লাহর মাতা-পিতা, সন্তান-সন্ততি রয়েছে। কেউ ‘ধারণা করতো আল্লাহ নিরংকুশভাবে শক্তিশালী নন, এ কারণে তিনি তাঁর ফেরেস্তা বাহিনী দিয়ে তাঁর রাজত্বের কর্মকান্ড সমাধা করান।
অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি তাদের বিশ্বাস ছিল শিক মিশ্রিত। অধিকাংশ গোত্র ‘পাখর বা মাটির বানানো পুতুলের পূজা-আরাধনা করতো। আরবের বুকে সর্ব প্রথম মূর্তি পূজার প্রচলন করে রাবিয়া ইবনে হারিসা নামক এক লোক। তাঁর আরেক নাম ছিল আমর ইবনে লুয়াই। এই লোকটা ভীষণ প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ছিল। আরবের কুজায়া গোত্রের সমস্ত কিছুর উৎস-ই ছিল সে।
সে সময়ে মক্কার ঘরের দেখাশোনা করাটা বর্তমান যুগের ন্যায় অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার কাজ ছিল। কাবাঘর কে বা কোন গোত্র দেখা শোনা করবে, তা নিয়েও যুদ্ধ দাঙ্গা হাঙ্গামা হতো। ইতিহাসে দেখা যায়, জুরহাম নামক এক ব্যক্তি কাবাঘরের খেদমত করতো অর্থাৎ জুরহাম ছিল মক্কার ঘরের মোতাওয়াল্লী। আমর ইবনে লুহাই শক্তি প্রয়োগ করে, যুদ্ধ করে জুরহামকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে কাবাঘরের দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। অর্থৎ সে জোর পূর্বক কাবা ঘরের খাদেম সেজেছিল। আর এই লোকই গোটা আরবে মূর্তি পূজার প্রচলন করেছিল। আমর ইবনে হুয়াই একবার সিরিয়া ভ্রমণে যেয়ে সেখানের মানুষদেরকে মূর্তি পূজা করতে দেখে তাদেরকে সে প্রশ্ন করেছিল, তোমরা এসব মূর্তির পূজা করছো কেন? তারা জবাব দিয়েছিল, এসব মূর্তি আমাদের দেবতা, এরা আমাদের সব ধরণের প্রয়োজন পূরণ করে। যুদ্ধে আমাদেরকে বিজয়ী করে, বৃষ্টির প্রয়োজন হলে বৃষ্টি বর্ষন করে, আমাদেরকে নানাভাবে লাভবান করে।
আমর এই সমস্ত কথা শুনে অনেকগুলো মূর্তি সাথে করে এনে কাবাঘরের আশেপাশে স্থাপন করেছিল। গোটা আরবের প্রাণ কেন্দ্র ছিল কাবাঘর। আরবের সমস্ত গোত্র কাবাঘরে হজ্জ করতে আসতো। তারা ফিরে যাবার সময়ে মক্কা থেকে একটা করে পাথর সাথে করে নিয়ে যেত। সে সমস্ত পাথরে মূর্তি খোদাই করে সেগুলোর পূজা করতো।
কাবাঘরের আশেপাশে যেসব মূর্তি ছিল তার ভেতর একটা পুরনো মুর্তি ছিল যার নাম দেয়া হয়েছিল মানাত। এই মানাত মূর্তি সমুদ্রের কাছে কাদিদ নামক স্থানে বেদীতে স্থাপন করা হয়েছিল। মদীনার আউজ ও খাজরাজ গোত্র, হুযাইল গোত্র এবং খুজায়া গোত্র এই মানাত দেবতার পূজা করতো। তারা এই মূর্তির সামনে কোরবানী দিত। কারাঘরে হজ্জ করতে আসার সময় তারা এই মূর্তির কাছে এহরাম খুলতো।
তায়েফে একটা বিশাল মূর্তি ছিল। সেটার নাম দেয়া হয়েছিল লাত। ছাকিফ গোত্র এই লাতের পূজা আরাধনা করতো। মক্কায় উজ্জা নামে একটা বিশাল মূর্তি স্থাপন করে তার পূজা করতো কুরাঈশ ও কেনানা গোত্র। দুমাতুল জান্দাল নামক স্থানে উদ নামক একটা মূর্তি স্থাপন করে তার পূজা করতো কলব গোত্র। হুওয়া, ইয়াগুস ও ইয়াউক মূর্তিও ছিল দুমাতুল জান্দালে। এসব মূর্তির পূজা করতো হুজায়েল গোত্র, মাজহচ্ছু গোত্র, ইয়েমেনের কয়েকটি গোত্র, হামাদান গোত্র।
সবচেয়ে বড় যে মূর্তি ছিল তার নাম হুবল। এই হুবলকে স্থাপন করা হয়েছিল একেবারে কাবাঘরের ছাদের ওপরে। মক্কার কুরাঈশ গোত্র ছিল হুবল মূর্তির পূজাড়ী। তারা বিভিন্ন সময়ে হুবলের নামে উচ্চস্বরে শ্লোগান দিত। ওদিকে ইয়েমেনের হামীর গোত্র সূর্যের পূজা করতো। কেনানা গোত্র করতো চাঁদের পূজা। এককথায় আরবের সর্বত্র ছিল মূর্তি পূজার প্রচলন।
প্রতিটি ঘরে ঘরে ছিল মূর্তি আর মূর্তি। এক একটি বংশ ও গোত্রের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মূর্তি ছিল। সেযুগের মূর্তি পূজার অবস্থা কল্পনা করে কবি একটা চিত্র অংকন করেছেন- প্রতিটি গোত্র, প্রতিটি কবিলা এবং বংশের জন্য একটা করে খোদা ছিল। এভাবে তারা তাদের প্রতিটি ঘরের জন্য একটা করে খোদা বানিয়ে নিয়েছিল। আর এভাবেই প্রতিটি ঘরে ঘরে মূর্তির আরাধনা চলতো।

শেয়ার করুন

সূচীপত্র

error: Content is protected !!