সিরাত বিশ্বকোষ
সিরাত বিশ্বকোষ

কুবা থেকে মদীনা যাওয়ার পথে সুলায়ম গোত্রের মসজিদে প্রদত্ত ভাষণ

লেখক: আহমাদ রিফআত

বিষয় : বিষয়ভিত্তিক সিরাত

কুবা থেকে মদীনা যাওয়ার পথে সুলায়ম গোত্রের মসজিদে প্রদত্ত ভাষণ

মসজিদে কুবা ইসলামের ইতিহাসের প্রথম নির্মিত মসজিদ। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সময় মদিনার অদূরে কুবায় এ মসজিদ নির্মাণ করেন। এর আগে মক্কায় তিনি কোনো মসজিদ নির্মাণ করেননি। হিজরতের প্রথম দিন কুবা অবস্থানকালে এই মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। মসজিদের নির্মাণকাজে সাহাবিদের সঙ্গে স্বয়ং রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অংশগ্রহণ করেন।

এখানে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১৪ দিন (কেউ বলেন ১০ দিন) অবস্থান করেন। অবস্থান শেষে কুবা থেকে মদিনা যাওয়ার পথে সুলাইম গোত্রের মসজিদে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি ব্যপক অর্থপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণয় রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। আমি তাঁর প্রশংসা করছি, তাঁর নিকট সাহায্য চাচ্ছি, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তাঁর কাছে হিদায়াত কামনা করছি। আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি, তাঁর অবাধ্য হইনি। যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্য হয়, আমি তার শত্রু। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো শরিক নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছেন হিদায়াত, নুর আর সত্য দীন সহকারে, উপদেশ নিয়ে পূর্বের রাসূলদের আগমনের বিরতির পর। আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছেন জ্ঞানের স্বল্পতা, মানুষের গোমরাহি, সময়ের ব্যবধান, কেয়ামতের নৈকট্য আর মৃত্যু ঘনিয়ে আসার পর। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করবে, সে নিশ্চিত সঠিক পথের সন্ধান লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাফরমানি করবে, সে নিশ্চিত বিপথগামী হবে, স্থানচ্যুত হবে এবং গোমরাহীর অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হবে। আল্লাহকে ভয় করে চলার জন্য আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি। কারণ এক মুসলমান অপর মুসলমানকে যে বিষয়ে উপদেশ দিতে পারে, তার মধ্যে তাকওয়া হচ্ছে সর্বোত্তম। এক মুসলমান অপর মুসলমানকে আখেরাতের জন্য উদ্বুদ্ধ করবে, আল্লাহকে ভয় করার হুকুম করবে। সুতরাং আল্লাহ তাঁর নিজের সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করছেন, তোমরা সেই ব্যাপারে সতর্ক হও। তার চেয়ে উত্তম কোনো নসিহত নেই, নেই তারচেয়ে উত্তম কোনো উপদেশ। আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে কাজ করাই হলো তাকওয়া। পরকালের ব্যাপারে তোমরা যে সহায়তা সহযোগিতা তালাশ করতে পারো, সত্যিকার অর্থে তা হলো এই তাকওয়া। যে ব্যক্তি নিজের এবং আল্লাহর মধ্যকার গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় সংশোধন করে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে কার্য সম্পাদন করে এবং এক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কিছু কামনা করে না, তার শুভ পরিণাম তার মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে হবে (তার জন্য) জিকির ও সঞ্চয়স্বরূপ, যখন মানুষ যা অগ্রে প্রেরণ করেছে তার মুখাপেক্ষী হবে, হবে সেজন্য কাঙ্গাল। আর যে কাজ হবে তার বিপরীত, সেজন্য সেই ব্যক্তি কামনা করবে—হায়, যদি তার এবং সেই কর্মের মধ্যে দীর্ঘ দূরত্ব সৃষ্টি হতো। আল্লাহ তোমাদের হুঁশিয়ার করছেন তাঁর নিজের সম্পর্কে। আর বান্দাদের প্রতি আল্লাহ অতিশয় দয়ালু। আল্লাহ তাঁর বাণী সত্য করে দেখান, পূরণ করেন তাঁর ওয়াদা অঙ্গিকার, কোনো বরখেলাফ করেন না, করেন না ব্যতিক্রম। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

مَا يُبَدَّلُ الْقَوْلُ لَدَيَّ وَمَا أَنَا بِظَلَّامٍ لِلْعَبِيدِ

‘আমার কথার রদবদল হয় না এবং আমি বান্দাদের প্রতি অবিচার করি না।’ (সুরা কাফ, ৫০ : ২৯)।

ইহকাল ও পরকাল-সংক্রান্ত সকল ক্ষেত্রে গোপনে ও প্রকাশ্যে কেবল আল্লাহকেই ভয় করবে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهِ وَيُعْظِمْ لَهُ أَجْرًا

‘আল্লাহকে যে ভয় করে, তিনি তার পাপমোচন করবেন এবং তাকে দেবেন মহাপুরস্কার।’ (সুরা আত-তালাক, ৬৫ : ৫)।

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا

‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করে, তারা অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করবে।’ (সুরা আহযাব, ৩৩ : ৭১)।

কারণ আল্লাহর ভয় তাঁর ক্রোধ থেকে রক্ষা করে, তাঁর শাস্তি থেকে রক্ষা করে, রক্ষা করে আল্লাহর বিরাগভাজন থেকে। আর আল্লাহর ভয় চেহারাকে উজ্জ্বল করে, পালনকর্তার সন্তুষ্টি আকর্ষণ করে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে। তোমরা আল্লাহর প্রতি কর্তব্যে শৈথিল্য প্রদর্শন  কোরো না। কেননা আল্লাহ তো তোমাদের তাঁর কিতাব শিক্ষা দিয়েছেন, তোমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁর পথ, যাতে তিনি জানতে পারেন কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী। সুতরাং অন্যদের প্রতি তোমরা অনুগ্রহ করো, যেমন আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আল্লাহর দুশমনের সাথে তোমরাও দুশমনি করো। তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে যেমন জিহাদ করা উচিত। তিনি তোমাদের বাছাই করে নিয়েছেন এবং তোমাদের মুসলিম নামকরণ করেছেন। যাতে যারা ধ্বংস হওয়ার তারা যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট হওয়ার পর ধ্বংস হয়, আর যারা বেঁচে থাকার তারা যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট হওয়ার পর বেঁচে থাকে। আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কিছু করার কোনো শক্তি নেই। তোমরা আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করবে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করবে। কারণ কেউ তাঁর ও আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্ক সুন্দর ও সংশোধন করলে তাঁর এবং মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট হবে। আল্লাহ মানুষের বিচার-ফয়সালা করেন, মানুষ আল্লাহর বিচার করতে পারে না। আল্লাহ মানুষের মালিক, মানুষের কোনো আধিপত্য নেই। আল্লাহু আকবার, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ও মহান আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি নেই।’ (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, যিকরু ভাষণতি রাসূলিল্লাহি (সা.) ইয়াওমাইযিন, ৩/২১৩)

আরো পড়ুন: দ্বিতীয় হিজরীর  শাওয়াল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভাষণ

আরো পড়ুন: দুনিয়া ও আখিরাতের তাৎপর্য সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভাষণ

শেয়ার করুন

সূচীপত্র

error: Content is protected !!