রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভাষণ ও খুতবার বৈশিষ্ট্য
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুতবা ও খুতবার বৈশিষ্ট্য
খুতবা বা ভাষণ পরিচিতি
ভাষণ শব্দটির প্রচলিত অর্থ বক্তৃতা। আভিধানিক অর্থে ওয়াজ, বক্তৃতা, আলোচনা ও ভাষণকে আরবি ভাষায় ‘খুতবা’ বলা হয়। পারিভাষিক অর্থে জনগণের সামনে দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক ধর্মীয় ও নৈতিক দিক-নির্দেশনামূলক যে ভাষণ প্রদান করা হয়, তাই খুতবা। খুতবা প্রদানকারী খতিব (বক্তা) নামে পরিচিত। খুতবার ইংরেজি পরিভাষা হচ্ছে Sermon Discourse।[1]
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুতবার পরিধি
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ২৩ বছরের নবুওয়াতি জীবনে অনেক মূল্যবান খুতবা দিয়েছেন। ইসলামের পথে দাওয়াত থেকে শুরু করে মৃত্যুশয্যা পর্যন্ত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুতবার পরিধি ছিল বিস্তৃত।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে তিনি যোদ্ধাদের সামনে খুতবা প্রদান করতেন। অধিকাংশ খুতবা মসজিদকেন্দ্রিক হলেও মাঠে-ময়দানে প্রদত্ত খুতবার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। মসজিদ যেহেতু সেসময় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, তাই সঙ্গত কারণে বৈদেশিক দূতদের আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ, ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গ ও যুদ্ধে গমনকারী সেনানায়কদের এবং নিয়োগপ্রাপ্ত স্বীয় রাষ্ট্রদূতদের সামনে মসজিদে তিনি দিক-নির্দেশনামূলক খুতবা দিতেন।
কীভাবে, কোন বিষয়ে ও কখন খুতবা দিতেন
মিম্বার ও অনুচ্চ স্থানে দাঁড়িয়ে অথবা উট ও ঘোড়ার উপর বসে জনগণের উদ্দেশ্যে রাসুল খুতবা প্রদান করতেন। পরিস্থিতির প্রয়োজন অনুসারে তাঁর খুতবা কখনো দীর্ঘ বা কখনো স্বল্পস্থায়ী হতো।
আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ঈমান আনার মাঝে পার্থিব জীবনের সার্বিক কল্যাণ ও পারলৌকিক জীবনের মুক্তি নিহিত। এককথায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের এমন কোনো বিষয় নেই—যা সম্পর্কে তিনি দিক-নির্দেশনামূলক খুতবা প্রদান করেননি।
যখনই আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনসম্মুখে উপস্থিত হয়ে ভাষণ প্রদান করেন। জনগণকে উদ্দেশ্য করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রদত্ত খুতবাসমূহ আরব উপদ্বীপের মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুতবাসমূহ তাঁর নবুওয়াতি শিক্ষা ও আদর্শের নির্যাস বলে অভিহিত করা যায়। একটি কল্যাণমুখী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাঁর প্রদত্ত খুতবার আবেদন সর্বজনীন। ইংল্যান্ড কর্তৃক ঘোষিত ‘ম্যাগনা কার্টা’-এর চৌদ্দশত বছর পূর্বে আরাফার ময়দানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত ঐতিহাসিক খুতবা বিশ্বজনীন মানবাধিকারের দলিল হিসেবে স্বীকৃত।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুতবা ও ভাষণ-দক্ষতা
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি খুতবা ছিল যৌক্তিক, বুদ্ধিদীপ্ত ও সমাধানমূলক। তাঁর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভাষণ-দক্ষতা শ্রোতাদের চেতনাকে শানিত করত। ভাষণ-দক্ষতা আল্লাহর অন্যতম দান, যার মাধ্যমে মানুষ সমৃদ্ধ হয়েছে। এই দক্ষতার উন্মেষের মাধ্যমে শুধু আধুনিক যুগে নয়; বরং প্রাচীনকালেও গ্রিস ও রোমসহ অন্যান্য দেশে বাগ্মীগণ জনমতকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং তাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব লাভে সক্ষম হয়েছেন। দীর্ঘকাল ধরেই আরব জনগণের সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য ও জীবনধারায় তাদের মাতৃভাষার প্রভাব-প্রতিপত্তি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় অত্যধিক। তাদের জীবন ও ভাষা যেন একইসূত্রে গাথা। ঐতিহাসিক পি.কে. হিট্টির মতে,
‘The Arabians created or developed no great art of their own. Their artistic nature found expression through one medium only speech. By virtue of its peculiar structure Arabic lent itself admirably to a terse, trenchant, epigrammatic manner of speech.’
‘আরবরা নিজেরা মহান কোনো শিল্প সৃষ্টি করেনি। তাদের শৈল্পিক প্রকৃতি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল একটি মাধ্যম দ্বারা, তা হলো বক্তৃতা। আরবি ভাষা তার বিচিত্র বিন্যাসের কারণে বাহুল্যবর্জিত, মর্মভেদী ও সুতীক্ষ্ণ ব্যঞ্জনাপূর্ণ বক্তৃতার নিকট ঋণী।’[2]
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুতবা ও আরবি ভাষা
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের এমন এক ঐতিহাসিক স্থানে আবির্ভূত হন, যার অধিবাসী প্রকৃতিগতভাবে সব দক্ষতা ও কর্মশক্তি তাদের নিজস্ব ভাষা আরবির চর্চা ও উৎকর্ষ সাধনে ব্যয় করেছে। আরবের জনগোষ্ঠীর উপর এই ভাষার প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক।
আরবি ভাষা তার কাব্যিক শৈলীর কাছে ঋণী এবং ইতিপূর্বে আরবি ছাড়া অন্য কোনো ভাষা এত ব্যাপকভাবে অনুশীলিত হয়নি। প্রাক-ইসলামি যুগে ভাষণদক্ষ ব্যক্তি আরবে অত্যন্ত সম্মানিত ও মর্যাদাসম্পন্ন হতেন। আরবগণ প্রকৃতিগতভাবে বাকপটু, সরলভাষী এবং বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। ভাষণ-দক্ষতা ছিল যেন তাদের জন্মগত বৈশিষ্ট্য।
আল্লামা জাহিজ যথার্থই বলেন,
‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক জাতির কাছে প্রেরিত হন, যাদের সুনামের বিশিষ্টতা হলো বাকপটুতা ও বাগ্মিতা। নিঃসন্দেহে আরবগণ বাকপটুতা, উপস্থাপনা, শব্দালংকার ও বাগ্মিতার জন্য গৌরব বোধ করতেন। হঠাৎ সমাজে কোনো ব্যক্তি যদি এগুলো থেকে বঞ্চিত হতেন, তিনি সম্মানিত ও মর্যাদাবান হতেন না।’[3]
নবীগণের বাগ্মিতা
এখানে একটি বিষয় খেয়াল করা উচিত, সকল রাসুল ও নবী দীনের দাওয়াত পৌঁছাতে বক্তৃতার মতো প্রত্যয় উৎপাদক ও শিল্পকৌশলের সাহায্য নিয়েছিলেন। তাঁরা চেয়েছেন, যেসব নীতি ও আদর্শ বোধ তাঁরা প্রচার করেছেন তা মানুষকে বিশ্বাস করাতে ও সে অনুযায়ী তাদের অনুশীলন করাতে। এক্ষেত্রে তাঁরা বল প্রয়োগ করেননি।
তবে এ কথা সত্য, সকল রাসুল চমৎকার বাগ্মিতার ঐশীগুণে সমৃদ্ধ ছিলেন। প্রত্যয় উৎপাদক ও আন্তরিক বাকপটুতাই ছিল তাঁদের একমাত্র মাধ্যম। আরবের অধিবাসীগণ নিজেদের ‘আরাব’ অর্থাৎ অত্যন্ত বাকপটু ও বুদ্ধিমান এবং অন্যান্যদের ‘আজাম’ অর্থাৎ বোবা (বাকপটু ও বুদ্ধিমানের বিপরীত) হিসেবে অভিহিত করতেন।
আরবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বাগ্মী
আরবদের মধ্যে কুরাইশ ও হাওয়াজিন গোত্রদ্বয় এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন এবং শৈশবকাল অতিবাহিত করেন হাওয়াজিন গোত্রে। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন,
انا أفصح العرب بيد اني من قريش ونشات في بني سعد.
‘আমি আরবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বাগ্মী। অধিকন্তু কুরাইশ গোত্রে আমার জন্ম এবং বনু সাদ-এর ভাষাই আমার ভাষা।’[4]
বনু হাওয়াজিন গোত্রের একটি শাখা হলো বনু সাদ, যারা সুন্দর বাচনভঙ্গি ও ভাষণ-দক্ষতার জন্য বিখ্যাত ছিল। এ ছাড়াও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃতিগত ধী-শক্তি, তাঁর পরিবার ও সমাজের কারণে আরও অধিকতর বিকশিত হয়েছে এবং আল্লাহ তাঁকে এই মহৎ গুণে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন,
‘আমি সংক্ষিপ্ত; কিন্তু ব্যাপকার্থক বাকশক্তিসহ প্রেরিত হয়েছি।’
জাওয়ামে আল-কালিম পদের বিশ্লেষণে আল্লামা জাহিজ বলেন,
وهو (الكلام) قليل الجامع للكثير
‘শব্দ হবে কম; কিন্তু প্রাচুর্যপূর্ণ অর্থবহ হবে।’[5]
তথ্যসূত্র
[1] আল-মুনজিদ ফিল-লুগাহ ওয়াল-আ’লাম, পৃষ্ঠা : ১৮৬; মিসবাহুল লুগাত, পৃষ্ঠা : ২০৮ ২০৯; আল-মুজামুল-ওয়াফি, পৃষ্ঠা : ৩৭১; Standard Twentieth Century Dictionary . পৃষ্ঠা : 288
[2] হিস্ট্রি অব দ্যা আরবস, Philip K. Hitti, পৃষ্ঠা : ৯০-৯১
[3] আল-বায়ান ওয়াত-তাবয়িন : ২/২৪-২৭
[4] ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ১/১৬৭; ইবনে সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ১/৭১; শিবলি নোমানি, সিরাতুন-নবী : ১/১৭৪
[5] আল-বায়ান ওয়াত-তাবয়িন : ৪/২৯
আরো পড়ুন: মক্কায় নবূওয়াতের প্রাথমিক জীবনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভাষণ
আরো পড়ুন: খালিদ ইবন সাঈদের উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভাষণ