সিরাত পাঠের প্রয়োজনীয়তা, উৎস ও ক্রমবিকাশ (সংক্ষিপ্ত)
সিরাত পাঠ
মানুষ স্বভাবগতভাবেই বড্ড অনুকরণপ্রিয়। জন্মলগ্ন থেকেই শিশু অনুকরণ করে তার পিতা-মাতাকে। একটু বড় হলে অনুকরণ করে তার খেলার সাথী বা বন্ধু-বান্ধবকে। আরো বড় হলে জীবন চলার পথে অনুকরণ করে পছন্দের কোনো মানুষকে। এই অনুকরণ-অনুসরণ, এটি মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই তার স্বভাবে বহন করে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো, সত্যিকারার্থে এমন মানুষ আছে কি? যিনি মানুষের জন্য অনুসরণীয়-অনুকরণীয় হতে পারেন। হ্যাঁ, আছেন! তিনি হলেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মুহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَإِنَّكَ لَعَلَى خلق عظیم
আর নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত। (সূরা ২৪ আন-নূর, আয়াত ৫৬)
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে:
لا يُؤْمِنُ أحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ اجمعين
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের মাঝে কেহ (পূর্ণ) ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা, সন্তান ও সমস্ত মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হব। (বোখারী শরীফ) আরেকটি হাদীসে ইরশাদ রয়েছে:
لا يؤمن أحدكم حتى يكون هواه تبعا لما جئت به
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের মাঝে কেহ (পূর্ণ) ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার প্রবৃত্তি আমি যা আনয়ন করেছি তার অনুগামী না হয়। (মিশকাত শরীফ)
সিরাত শব্দের শাব্দিক অর্থ
সিরাত سيرة একটি আরবী শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ পথ অনুসরণ করা। এমন প্রশস্ত পথ, যা গমন করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। সিরাত অর্থ ভ্রমণ করাও হয়। কারণ একজন ব্যক্তি যে পথ দিয়ে চলে গেছে সেই পথ দিয়ে আপনি তার জীবনী পড়ছেন। তার মানে আপনিও তার পথ দিয়ে ভ্রমণ করছেন। আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনী পড়ছি, এর মানে আমরা তাঁকে অনুসরণ করছি। তাঁর জীবনীর পথে ভ্রমণ করছি। সিরাতের আরেক অর্থ হলো, আসল অবস্থা। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন:
قبال خُذْهَا وَلَا تَخَفْ سَعِيدُهَا سِيرَتَهَا الأولى
তিনি (আল্লাহ) বললেন (মুসাকে), ওটা ধরো এবং ভয় করো না, আমি ওকে ওর পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেব। (সূরা ২০ ত্বহা, আয়াত ২১)
সিরাত এর পারিভাষিক অর্থ
পারিভাষিক অর্থে সিরাত অর্থ জীবনী বা Biography তবে সিরাত বলতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনীই বোঝানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনে যা কিছু ঘটেছে তার সাথে সম্পক্ত সরাসরি বা পরোক্ষভাবে তার সকল দিক তথা শারীরিক দিক, চারিত্রিক দিক, পারিবারিক জীবন, সামরিক জীবন, এককথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সকল দিক সিরাতের অন্তর্ভুক্ত।
আরো পড়ুন:
আরো পড়ুন:
সিরাত পাঠের প্রয়োজনীয়তা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সিরাত পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। খুব সংক্ষেপে সিরাত পাঠের অল্প কয়েকটি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছি,
১. সিরাত অধ্যয়ন একটি উত্তম আমল বা সাওয়াবের কাজ।
২. সিরাত পাঠ মুমিনের ঈমানকে মজবুত করে।
৩. সিরাত অধ্যয়ন কোরআন বোঝার জন্য সহায়ক।
৪. সিরাত অধ্যয়ন হাদীস বোঝার জন্যও সহায়ক।
৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন মুমিনদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ বা নমুনা। তাই সিরাত পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
৬. মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা সিরাত অনুসরণের মাঝেই নিহিত।
৭. পৃথিবীর সকল ইতিহাসের মাঝে সিরাত একটি শ্রেষ্ঠ ইতিহাস।
৮. ইসলামের জীবনী শক্তি বুঝতে চাইলে সিরাত পাঠের কোনো বিকল্প নেই।
৯. সিরাত একটি উত্তম সাহিত্যও বটে।
১০. আল-কোরআন হলো আল্লাহর বাণী, আর এই বাণীর জীবস্ত নমুনা হলো সিরাত।
১১. নবীজির মুহাব্বত লাভের জন্য সিরাত পাঠ অপরিহার্য।
১২. সকল উত্তম চরিত্রের সমাহার সিরাত, তাই সিরাত পাঠে উন্নত চরিত্র সৃষ্টি হয়।
১৩. সিরাত পাঠে মানুষের জীবনের সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়।
১৪. সিরাত পাঠ মানুষের মনকে চাঙ্গা করে।
১৫. সিরাত মানুষকে নম্র হতে শেখায়।
১৬. ইসলামী আইন বিজ্ঞানচর্চায় সিরাত একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
১৭. জীবন দর্শনে সিরাত পাঠের গুরুত্ব অনেক।
১৮. তর্কশাস্ত্র চর্চায় সিরাত পাঠ তার্কিকের বাচনিক ভঙ্গিকে আরো শাণিত করে।
আমরা কেন সিরাত পাঠ করবো?
আমরা সিরাত পাঠ করেবো,
আমরা সিরাত পাঠ করেবো, বহিরঙ্গের পরিপাট্যের জন্য।
আমরা সিরাত পাঠ করেবো, অন্তর্জগত আলোকিত করার জন্য।
আমরা সিরাত পাঠ করেবো, আচার-আচরণকে শিষ্টতাপূর্ণ করার জন্য।
আমরা সিরাত পাঠ করেবো, বিশুদ্ধভাষী ও সদালাপী হওয়ার জন্য।
আমরা সিরাত পাঠ করেবো, চরিত্রের ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য।
আমরা সিরাত পাঠ করেবো, আদর্শ পেশাজীবী হওয়ার জন্য।
আমরা সিরাত পাঠ করেবো, দায়িত্বসচেতন হওয়ার জন্য।
আমরা সিরাত পাঠ করেবো, সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি আস্থা ও মনোবল সৃষ্টির জন্য।
আমরা সিরাত পাঠ করেবো, শোকে-দুঃখে সান্ত্বনা লাভের জন্য।
প্রিয় পাঠক! মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিরাতগ্রন্থ পাঠের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এটা একটা সংক্ষিপ্ত সারণী মাত্র। তাঁর গোটা জীবনই আপনার-আমার জীবন রচনার জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। কুরআন মাজীদের ভাষায়-
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তার জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (সূরা আহযাব : ২১)
সিরাতের উৎসসমূহ
সিরাতের উৎস হিসেবে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করতে পারি।
১. আল-কুরআন।
২. আল-হাদীস।
৩. সাহাবীদের বাণী।
৪. শামায়েল বা নবীজির দৈহিক গঠন।
৫. দালায়েল বা নবীজির মুজিযাসমূহ।
৬. সাহাবীদের জীবনী।
৭. ইতিহাস।
আরো পড়ুন:
আরো পড়ুন:
সিরাতের ক্রমবিকাশ
সিরাতের ক্রমবিকাশকে আমরা নিম্নোক্ত পর্যায়ে ভাগ করতে পারি।
প্রথম যুগ: সাহাবায়ে কেরামের যুগ
সাহাবায়ে কেরামের যুগ শুরু হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়াত লাভ থেকে এবং শেষ হয়েছে ১০৫
হিজরীতে।
দ্বিতীয় যুগ: তাবেঈ ও তাবেতাবেঈদের যুগ
তাবেঈ ও তাবেতাবেঈদের যুগ ১০৫ হিজরীতে শুরু হয়ে ২১০ অথবা ২১৫ হিজরীতে শেষ হয়েছে।
তৃতীয় যুগ: তাবেতাবেঈদের পরবর্তী যুগ
তাবেতাবেঈদের পরবর্তী যুগ ২১০ অথবা ২১৫ হিজরী থেকে ৪০০ হিজরীব্যাপী।
চতুর্থ যুগ: ইস্তিকসা ও ইসতিয়াবের যুগ
ইস্তিকসা ও ইসতিয়াবের যুগ ৪০০ হিজরী থেকে নিয়ে ৬০০ হিজরী সনব্যাপী। ইস্তিকসা ও ইস্তিয়াব অর্থ সিরাত বিষয়ে যেখানে যা কিছু পাওয়া যায়, সেসব একত্রে সংকলনেরযুগ।
পঞ্চম যুগ: Diversification বা বৈচিত্র্যতার যুগ
Diversification বা বৈচিত্র্যতার যুগ শুরু হয়েছে ৬০০ হিজরী থেকে এবং শেষ হয়েছে ১২৮০ হিজরীতে।
ষষ্ঠ যুগ: নতুন-নতুন প্রশ্ন উত্থাপনের যুগ
নতুন-নতুন প্রশ্ন উত্থাপনের যুগ আধুনিক যুগ ১২৮০ হিজরীর পর থেকে নিয়ে এখনো চলমান।
আরো পড়ুন:
আরো পড়ুন:
আধুনিক যুগে সিরাতের কিছু দৃষ্টিভঙ্গি
আধুনিক যুগে এখন সিরাতকে বিশেষ বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। নিম্নে ক্ষুদ্র পরিসরে তা তুলে ধরা হলো,
১. হাদীসের দৃষ্টিকোণ
মুহাদ্দেসানা দৃষ্টিভঙ্গি বা হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে সিরাত রচনা: সিরাতের সকল বিষয় ইলমে হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে সনদের মান পরখ করে শুদ্ধতা, দুর্বলতা ইত্যাদি দিকগুলো বিবেচনায় এনে সিরাত রচনা করা,
২. ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি
ইতিহাসের আলোকে সিরাত রচনা করা, অর্থাৎ ইতিহাস রচনায় যেমন ধারাবাহিকতা রক্ষা করে স্থান, কাল, পাত্র ফুটিয়ে তোলা হয় অনুরূপভাবে সিরাতের ঘটনাসমূহকে বিন্যাস করা,
৩. সংকলনগত দৃষ্টিভঙ্গি
ইতিপূর্বে রচিত বিভিন্ন সিরাতগ্রন্থ সামনে রেখে একটি সমন্বিত সিরাত রচনা করাকে আমরা সংকলনগত দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি।
৪. ইসলামী আইন বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি
ফকিহানা দৃষ্টিভঙ্গি বা ইসলামী আইন বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সিরাত রচনা: এর মানে হলো সিরাতের যেসব ঘটনা থেকে ফিকহী মাসআলা বের হয় অথবা ইসলামী আইনের কোনো উৎস খুঁজে পাওয়া যায়, সেসব বিষয় সামনে রেখে যে সিরাত রচনা করা হয় এমন সিরাতগ্রন্থকে আমরা ফকিহানা দৃষ্টিভঙ্গি বা ইসলামী আইন বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সিরাতগ্রন্থ বলতে পারি।
৫. দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি
সিরাতের মাঝে দর্শনের যেসব উপকরণ পাওয়া যায় সেসব উপকরণ চিহ্নিত করে যে সিরাত রচনা করা হয় এমন সিরাতগ্রন্থকে আমরা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সিরাত বলতে পারি।
৬. সাহিত্যগত দৃষ্টিভঙ্গি
আরবী সাহিত্য বা বিশ্বসাহিত্যের অসংখ্য অগণিত বিষয় সিরাতের কিতাবসমূহে মণি-মুক্তার মতো চকচক করছে, এমন সাহিত্যের উপজীব্য বিষয়াদি সামনে রেখে যে সিরাতগ্রন্থ রচনা করা হয় তাকে আমরা সাহিত্যগত দৃষ্টিভঙ্গির সিরাতকর্ম বলে আখ্যায়িত করতে পারি,
৭. তার্কিক দৃষ্টিভঙ্গি
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দীর্ঘ ৬৩ বছরের জীবনে তর্কশাস্ত্রের অনেক উপকরণ বিদ্যমান। যেসব সিরাতগ্রন্থের মাঝে তর্কশাস্ত্রের এমন উৎসের সন্ধান পাওয়া যায়, সেসব গ্রন্থকে আমরা তার্কিক দৃষ্টিভঙ্গির সিরাতগ্রন্থ বলতে পারি।
আসুন, তাঁর সে আদর্শ জানার লক্ষ্যে আমরা সিরাতবিষয়ক গ্রন্থসমূহ পাঠ করি এবং তার আলোকে নিজেদেরকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি।
আরো পড়ুন:
আরো পড়ুন: