১১. (৬) আবু আফাক হত্যা – Killing of Abu Afak
৬.আবু আফাক হত্যা বা সারিয়্যা সালিম ইবনে উমায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কর্তৃক প্রেরিত সারিয়্যা : ৬ |
|||||||
|
|||||||
দুই পক্ষ | |||||||
সালিম ইবনে উমায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু | আবু আফাক নামক এক ইহুদি | ||||||
শক্তি | |||||||
১ জন | ১ জন | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
মুসলিম বাহিনীর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। | আবু আফাক নিহত হয়। |
পরিচিতি
ইবনে সাদ, ইবনে ইসহাক প্রমুখ ঐতিহাসিকের বর্ণনানুসারে জানা যায়, সারিয়্যা সালিম ইবনে উমায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু পরিচালিত হয়েছিল আবু আফাক নামক এক ইহুদির বিরুদ্ধে। তাকে হত্যা করাই ছিল এই সারিয়্যার উদ্দেশ্য।
সারিয়্যা সালিম ইবনে উমায়ের ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট অভিযান। সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র একজন। তিনি হলেন সালিম ইবনে উমায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু। আর তার নামানুসারেই উক্ত অভিযানের নামকরণ করা হয়েছে। আর প্রতিপক্ষও ছিল সংখ্যায় মাত্র একজন। খায়বার অঞ্চলের ইহুদি গোত্রের ইসলাম ও মুসলমানদের অন্যতম দুশমন আবু আফাক নামক এক ইহুদি। দ্বিতীয় হিজরির শাওয়াল মাস মোতাবেক এপ্রিল ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে উক্ত সারিয়্যা সংঘটিত হয়।[1]
আরো পড়ুন : সারিয়্যা ঈস/জায়েদ ইবনে হারিসা রা. – Expedition of Zayd ibn Harithah (Al-Is)
আরো পড়ুন : সারিয়্যা উক্কাশা ইবনে মিহসান রা. – Expedition of Ukasha bin Al-Mihsan
আরো পড়ুন : সারিয়্যা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. – Expedition of Umar ibn al-Khatab
মানচিত্র (১২) : আবু আফাক হত্যা অভিযানের পথ
উল্লেখ্য, সারিয়্যা সালিম ইবনে উমায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু অভিযানের প্রতিপক্ষ ইহুদি আবু আফাক ছিল খাইবারের বনু আমর ইবনে আওফ গোত্রের লোক। তার বয়স ছিল ১২০ বছর। যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারেস ইবনে সুওয়াইদ ইবনে সামিতকে হত্যা করেন, তখন থেকেই সে মুনাফিকি করতে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার জন্য সে মানুষকে উৎসাহিত করতে থাকে এবং কবিতার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমান এবং ইসলামের নিন্দাবাদ প্রচার করতে থাকে।[2]
আবু আফাক যেসকল কবিতার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম ও মুসলমানদের কুৎসা বর্ণনা করত, সেই কবিতাগুলো থেকে কয়েকটি শ্লোক নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো,
لَقَدْ عِشْتُ دَهْرًا وَمَا إنْ أَرَى … مِنْ النَّاسِ دَارًا وَلَا مَجْمَعَا
أَبَرَّ عُهُودًا وَأَوْفَى لِمَنْ … يُعَاقَدُ فِيهِمْ إذَا مَا دَعَا
مِنْ أَوْلَادِ قَيْلَةَ فِي جَمْعِهِمْ … يَهُدُّ الْجِبَالَ وَلَمْ يَخْضَعَا
فَصَدَّعَهُمْ رَاكِبٌ جَاءَهُمْ … حَلَالٌ حَرَامٌ لِشَتَّى مَعَا
فَلَوْ أَنَّ بِالْعِزِّ صَدَّقْتُمْ … أَوْ الْمُلْكِ تَابَعْتُمْ تُبَّعَا
(১) ‘আমি বহু যুগ ধরে বেঁচেছিলাম, তবুও মানুষের কোনো ঘর কোনো সমাবেশ আমি দেখিনি।
(২) অঙ্গীকার পালনে অধিক সত্যবাদী, যখন তাদের অঙ্গীকার পালনে আহ্বান করে, তারা যাদের সাথে অঙ্গীকার করেছে।
(৩) কায়লা নামের এক নারীর সন্তানগণ, তারা সকলেই মানুষের অন্তরকে আকর্ষণ করবে; কিন্তু অনুগত হবে না।
(৪) অতঃপর তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিল একজন আরোহী, একই সাথে হালাল-হারামের বিধান দিয়ে।
(৫) তোমরা বিশ্বাস করতে যদি সত্যিই তা সম্মানজনক হতো, নয়তো বাদশাহ হলো তোমরা বাদশাহ তুব্বার অনুসরণ করতে।’[3]
অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তার মুনাফিকি ও কুৎসা রটনার কথা জানতে পারলেন, তখন বললেন,
من لي بهذا الخبيث فخرج سالم بن عمیر اخو بنی عمروبن عوف.
‘এমন কে আছো, যে এই পাপিষ্ঠকে হত্যা করবে?’
তখন সালিম ইবনে উমায়ের তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বের হলেন। উল্লেখ্য, সালিম ইবনে উমায়ের ছিলেন গোত্রপ্রধান আমর ইবনে আওফ-এর ভাই। সালিম ইবনে উমায়ের ছিলেন অধিক ক্ৰন্দনকারীদের একজন। তিনি বদর, উহুদ ও খন্দকসহ সকল যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অবশেষে মুআবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ানের খেলাফতের সময় তিনি ইনতেকাল করেন।[4]
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব (1) – Expedition of Ali ibn Abi Talib
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব রা. (3) – Expedition of Ali ibn Abi Talib
আরো পড়ুন : সারিয়্যা ইবনে আবিল আওজা – Expedition of Ibn Abi Al-Awja Al-Sulami
সালিম ইবনে উমায়ের বলতেন,
على نزر آن اقتل ابا عفك او اموت دونه فاهمل بطلب له نمرة حتى كانت ليلة صائفة فنام ابو عفك بفناء بینه فعلم بذلك سالم فاقبل نحوه فوضع
‘আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম, হয়তো আবু আফাককে হত্যা করব, নাহয় নিজেই মৃত্যুবরণ করব। তাই আমি সেই সুযোগ খুঁজছিলাম। অবশেষে সে একদিন সুযোগ পেয়ে গেলাম। আবু আফাক একদিন গরমের রাতে তার ঘরের আঙিনায় ঘুমাচ্ছিল।’
আর সালিম সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং তা জানতেন। তারপর তিনি সুযোগ বুঝে ধীরে ধীরে তার দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন এবং তার বুকে তরবারি বসিয়ে দিলেন। আঘাত খেয়ে আল্লাহর দুশমন চিৎকার করে উঠল এবং সঙ্গে-সঙ্গে ধরাশায়ী হয়ে গেল। তার চিৎকার শুনে তার অনুসারীরা সেখানে এসে উপস্থিত হলো। ধরাধরি করে তাকে তারা ঘরের ভেতর নিয়ে গেল। অবশ্য ততক্ষণে তার প্রাণবায়ু বের হয়ে গেছে।’[5]
ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, ‘আবু আফাককে উহুদ যুদ্ধের পর হত্যা করা হয়।’[6] আবু আফাক-এর মৃত্যুর পর উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে উমামা আল-মুজাইরিয়া তাকে লক্ষ করে নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে,
تُكَذِّبُ دِينَ اللَّهِ وَالْمَرْءَ أَحْمَدَا … لَعَمْرُ الَّذِي أَمْنَاكَ أَنْ بِئْسَ مَا يُمْنِي
حَبَاكَ حَنِيفٌ آخِرَ اللَّيْلِ طَعْنَةً … أَبَا عَفَكٍ خُذْهَا عَلَى كِبَرِ السِّنِّ
(১) ‘তুমি মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে আল্লাহর দীনকে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো মহান ব্যক্তিত্বকেও। সেই জীবনের শপথ! যা তোমাকে আশান্বিত করেছে। তা তোমাকে যে আশা দিয়েছে তা কতই-না মন্দ।
(২) একজন মুসলিম রাতের শেষ প্রহরে তোমাকে কৃতকর্মের প্রতিদান দিয়েছে অতি লাঞ্ছিতভাবে (অর্থাৎ তোমার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছে। আর এটিই ছিল তোমার কৃতকর্মের যোগ্য প্রতিদান)। হে আবু আফাক! এই বৃদ্ধ বয়সে তুমি তাই সাদরে গ্রহণ করো।’[7]
উক্ত সারিয়্যা ছিল একটি সফল ও সার্থক অভিযান। যাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই অভিযান পরিচালিত হয়, সেই ইহুদি আবু আফাককে অতি সহজেই সালিম হত্যা করেন। তবে এই অভিযানে মুসলিম বাহিনীর তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সালিম তাকে হত্যা করে নিরাপদেই ফিরে আসেন।[8]
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলকামা ইবনে মুজাযিয আল-মুদলিজী – Expedition of Alkama Ibn Mujaziz Al-Mudliji
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আল-কুররা বি’র মাউনা – Expedition of Bir Maona
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব ( ) – Expedition of Ali ibn Abi Talib (2)
তথ্যসূত্র
[1]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৪/২১৩; আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ১/৩৪১; রাহমাতুল্লিল আলামিন : ২/২৩২; রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সরকার কাঠামো : ৩৬৪; মাদারিজুন নুবুওয়াত : ২/১৭৮
[2]. ইবনে সায়্যিদিন্নাস, উয়ুনুল আসার : ১/৩৪১; জুরকানি, শরহুল মাওয়াহিবুল-লাদুন্নিয়া : ১/৪৫৫
[3]. আর-রাউদুল উনুফ : ৭/৪৯৮; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৪/২১৪
[4]. ইবনু সাইয়্যিদিন নাস, উয়ুনুল আসার : ১/৩৪১; আল-মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যা : ১/৩৭৯; ইবনুল আসির, উসদুল গাবাহ : ২৩/৩১১
[5]. ইবনু সাইয়্যিদিন নাস, উয়ুনুল আসার : ১/৩৪১; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৪/২১৪; আস-সিরাতুল হালবিয়্যা : ৩২/১৫৮
[6]. জুরকানি, শরহুল মাওয়াহিবুল-লাদুন্নিয়া : ১/৪৫৬
[7]. আর-রাউদুল উনুফ : ৭/৪৯৯; ইবনু সাইয়্যিদিন নাস, উয়ুনুল আসার : ১/৩৪১; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২১৪; জুরকানি, শরহুল মাওয়াহিবুল-লাদুন্নিয়া : ১/৪৫৬
[8]. মাদারিজুন নুবুওয়াত : ২/১৭৮; রাহমাতুল্লিল আলামিন : ২/২৩২