১২. (৬) গাজওয়া বনু কায়নুকা – Invasion of Banu Qaynuqa
৬. গাজওয়া বনু কায়নুকা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত গাজওয়া : ৬ |
|||||||||
|
|||||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||||
মদিনার মুসলমান | বনু কায়নুকা গোত্রের ইহুদি | ||||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||||
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম | |||||||||
শক্তি | |||||||||
সাতশো। চারশো ছিল বর্মবিহীন এবং তিনশো ছিল বর্মধারী। | |||||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||||
পরিচিতি
বনু কায়নুকা ইয়াসরিবের একটি ইহুদি গোত্রের নাম। ‘কায়নুকা’ শব্দটি আরবি নামের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়; বরং তা আরবি শব্দ গঠনরূপ থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলে প্রতীয়মান হয়। হিব্রু ভাষার সাথেও এটির সাদৃশ্য নেই। যদিও ‘বনু কায়নুকা’ ছিল হিব্রু বংশোদ্ভূত। এই গোত্রের নামে মদিনায় একটি বাজার ছিল, যা ‘বনু কায়নুকা’ বাজার নামে পরিচিত। তারা ছিল মদিনার খাযরাজ গোত্রের মাওলা (আশ্রিত) এবং উবাদা ইবনুস সামিত ও আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুলের হালিফ (মিত্র)।
আরবের ইহুদিদের কোনো নির্ভরযোগ্য ইতিহাস নেই। তাদের রচিত কোনো গ্রন্থ কিংবা শিলালিপিও পাওয়া যায় না, যার উপর ভিত্তি করে তাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে আলোকপাত করা সম্ভব। হিজাজের বাইরের কোনো ইহুদি ইতিহাসবিদ, পণ্ডিত কিংবা গ্রন্থ প্রণেতা আরবের ইহুদিদের সম্পর্কে আলোচনা করেননি। কারণ এখানকার ইহুদিদের আরব উপদ্বীপে আগমনের পর তাদের স্বজাতি অন্যান্য গোত্র থেকে অনেকাংশেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে দুনিয়ার অন্যান্য ইহুদিরা তাদের নিজেদের স্বজাতিও সমাজের লোক বলে মনেই করত না। কেননা তারা হিব্রু (ইব্রীয়) সভ্যতা, ভাষা, এমনকি নামকরণও পরিত্যাগ করে সর্বক্ষেত্রে আরবতন্ত্র গ্রহণ করে। হিজাজে প্রাপ্ত শিলালিপি কিংবা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদিতে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর পূর্বে আরবেই ইহুদিদের নাম-চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায় না; বরং তাদের এখানে আগমন-সম্পর্কিত ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহের অধিকাংশই ইহুদিদের কর্তৃক মৌখিকভাবে শ্রুত ও সংরক্ষিত।[1] এসব বর্ণনা নিচে তুলে ধরা হলো,
ক. হিজাজের ইহুদিদের দাবি করত, তারা সর্বপ্রথম মুসা ইবনে ইমরান আলাইহিস সালাম-এর জীবদ্দশার শেষ অধ্যায়ে এখানে আগমন করে। মুসা আলাইহিস সালাম ফিরআউনের উপর বিজয় লাভ করার পর স্বীয় অনুসারীদের সমন্বয়ে কিনআনিদের বিরুদ্ধে এক অভিযান পরিচালনা করেন। তারা সিরিয়ায় এসে এখানকার অধিবাসীদের ধ্বংস করে দেয়। অতঃপর মুসা আলাইহিস সালাম আমালিকাদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে হিজাজে আরেকটি বাহিনী প্রেরণ করেন। তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়, ইহুদি ধর্ম গ্রহণকারী ব্যতীত বনু আমালিকার সর্বশেষ ব্যক্তিকেও যেন হত্যা করা হয়। বনু ইসরাঈলের এই বাহিনী হিজাজে এসে মুসা আলাইহিস সালাম-এর নিদের্শ বাস্তবায়ন করে, এমনকি তাদের সম্রাট আরকাম ইবনে আবুল আরকামকেও হত্যা করে। কিন্তু তারা সম্রাটের একটি অত্যন্ত সুশ্রী সুদর্শন সন্তানকে হত্যা না করে তাকে বন্দি করে ফিলিস্তিনে নিয়ে যায়। ইতিমধ্যে মুসা আলাইহিস সালাম ইনতেকাল করেন। এই বাহিনী ফিলিস্তিনে ফিরে এসে মুসা আলাইহিস সালাম-এর স্থলাভিষিক্ত বনু ইসরাঈলের নিকট অভিযানের বিশদ বিবরণ দেয়। তাতে বনু ইসরাঈল তাদের উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় এবং নবীর নির্দেশ পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন না করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাদের ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কার করে। ফলে তারা হিজাজে আগমন করে ইয়াসরিব অঞ্চলে বসবাস শুরু করে।[2] এই বর্ণনার উপর ভিত্তি করে হিজাজের ইহুদিদের দাবি করত, তারা খ্রিষ্টপূর্ব চারশত বছর থেকে এখানে বসবাস করে আসছে।
খ. ইহুদিদের হিজাজ অঞ্চলে আগমন সম্পর্কিত অপর একটি বর্ণনা হলো—খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৭ সালে ব্যাবিলনের সম্রাট বাখ্ত নসর বাইতুল মুকাদ্দাস ধ্বংস করে অনেক ইহুদিকে হত্যা করে এবং অবশিষ্টদের সেই স্থান থেকে বিতাড়িত করে। ফলে অনেক ইহুদি গোত্র হিজাজের ওয়াদিউল-কুরা, তামা, ইয়াসরিব, আয়লা, মান্না, ফাদাক, তালুক, খায়বার প্রভৃতি অঞ্চলে এসে পুনর্বাসিত হয়। আগত এসব ইহুদি স্থানীয় জুরহুম ও আমালিকাদের সাথে মিশে যায়। ক্রমে ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরবর্তী সময়ে তারা এই দুই গোত্রকে ইয়াসরিব থেকে বহিষ্কার করে মদিনায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।[3]
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবুল হাদরাদ – Expedition of Abi Hadrad al-Aslami
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আমর ইবনুল আস – Expedition of Amr ibn al-As
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আমর ইবনে উমাইয়া আদ-দামরি রা. – Expedition of Amr bin Umayyah al-Damri
গ. তালমুদের বর্ণনানুযায়ী খ্রিষ্টীয় প্রথম কয়েক শতাব্দীতে আরবের উত্তরাঞ্চলে ইহুদি বসতি ছিল। তারমা, হিজর, খায়বার, ওয়াদিউল-কুরা, ফাদাক, মানা প্রভৃতি মরুদ্যানে বসবাসরত ইহুদিদের সাথে মদিনাবাসী ইহুদিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এসব মরুদ্যানে তারা কৃষি পণ্য উৎপন্ন করত। সম্ভবত তাদের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন বসতিগুলো সন্নিবেশিত হয়ে একটি নগরীতে পরিণত হয়। ইয়াসরিব-এর আরামি বা এ্যারামীয় নাম Minta (এলাকাভুক্ত ক্ষেত্র) থেকে এই মতের সত্যতা পাওয়া যায়। সাহাবি কবি হাসসান ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কবিতা থেকে জানা যায়, ইহুদিদের ইয়াসরিবে অসংখ্য দুর্গ নির্মাণ করে।[4] হাররা অঞ্চলে প্রাপ্ত কারখানা ও নালা-নর্দমার ধ্বংসাবশেষ এ কথার প্রমাণ বহন করে, এই অঞ্চলে ইহুদি আওস গোত্রের সুসভ্য জাতি অবস্থান করত।[5]
ঘ. ইহুদিদের ইয়াসরিব আগমন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, ৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমকগণ ফিলিস্তিনে ইহুদিদের হত্যা করতে এবং তাদের দেশান্তরিত করতে শুরু করে এবং ১৩২ খ্রিষ্টাব্দে তাদের এই ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণরূপে বহিষ্কার করে।
ফলে এ সময়ের মধ্যে অনেক ইহুদি গোত্র ফিলিস্তিন থেকে দক্ষিণে নিকটবর্তী হিজাজ অঞ্চলে এসে শস্য-শ্যামল এলাকায় আশ্রয় নেয়। এই স্থানে এসে তারা আয়লা, মাকনা, তাবুক, তায়মা, ওয়াদিউল-কুরা, ফাদাক, খায়বার প্রভৃতি অঞ্চলের উপর স্থায়ী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। বনু কুরায়জা, বনু নবির ও বনু কায়নুকা প্রভৃতি গোত্র এ সময় ইয়াসরিব আগমন করে।[6] ক্রমে তারা কথাবার্তা, চালচলন, আচার-আচরণ এবং জীবনাচারে আরব বংশোদ্ভূতদের মতো হয়ে যায় এবং আরবদের সাথে বিবাহ-শাদি ও সামাজিক সম্পর্ক প্রভৃতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে, এমনকি অনেক ইহুদি হিব্রু নামের পরিবর্তে আরবি নাম গ্রহণ করে। তাদের মুষ্টিমেয়-সংখ্যক ব্যতীত অন্যান্যরা হিব্রু ভাষা জানত না। এতৎসত্ত্বেও তারা সম্পূর্ণরূপে আরবদের মাঝে বিলীন হয়ে যায়নি। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তারা ইহুদিদের আত্মাভিমানকে অক্ষুণ্ণ রাখে। মূলত আরবদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্যই তারা বাহ্যত আরবত্ব গ্রহণ করে। মদিনায় বসবাসকারী এসব ইহুদি আরবীয় ভাবধারা গ্রহণ করলেও নিজেদের ইসরাইলি ও ইহুদি ভেবে তারা গর্ব করত, আর আরবদের মনে করত উম্মি (নিরক্ষর/বেদুঈন)। ইহুদি বনু কায়নুকা গোত্রের যেসকল ব্যক্তিবাচক নাম পাওয়া যায়, তার অধিকাংশই আরবি। কিন্তু এগুলো দ্বারা তাদের মূল বাইবেলীয় নাম কী ছিল—তা জানা যায় না। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।
ঙ. ইতিহাসবিদ ইয়াকুত আল-হামাবি বলেন, ইহুদি পণ্ডিতগণ তাওরাত গ্রন্থে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হয়। তারা জানতে পারে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঙ্করময় মরু অঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থানে হিজরত করবেন, যেখানে প্রচুর খেজুর বাগান বিদ্যমান। সুতরাং তারা কঙ্করময় মরু অঞ্চলের খোঁজে সিরিয়া থেকে বের হয়ে তায় নামক স্থানে এসে তাওরাতের বর্ণনার সাথে উক্ত স্থানের মিল দেখতে পেয়ে এ স্থানে বসবাস করতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে তুব্বা জাতি ও বনু আমর ইবনে আতিক এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।[7]
ইহুদিদের যখন ইয়াসরিবে এসে বসবাস শুরু করেছিল, তখন সেখানে অন্যান্য কয়েকটি আরব গোত্রও বাস করত। ইহুদিদের তাদের নিজেদের অধীনস্থ বানিয়ে নিয়েছিল। ৪৫০/৪৫১ খ্রিষ্টাব্দে ইয়ামানে সংঘটিত মহাপ্লাবনে (আল-কুরআনের সুরা আস-সাবার ১০-২১ নং আয়াতে এর উল্লেখ রয়েছে) সাবা জাতির বিভিন্ন গোত্র সেখান থেকে বের হয়ে আরবের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। গাসসানিরা সিরিয়ায়, লাখমিরা হিরায় (ইরাকে), বনু খুজাআ জেদ্দা ও মক্কার মধ্যবর্তী স্থানে এবং আওস ও খাযরাজ গোত্র ইয়াসরিবে বসবাস করতে থাকে। ইহুদিদের যেহেতু পূর্ব থেকেই ইয়াসরিবে প্রভাব ও কর্তৃত্ব স্থাপন করে রেখেছিল, সেই কারণে তারা আওস ও খাযরাজ গোত্রকে কোনো প্রকার কর্তৃত্ব করার সুযোগ দিল না। ফলে এই দুই আরব গোত্র অনুর্বর ভূমিতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। এই স্থানে তাদের খুব কষ্ট করে জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতে হয়েছিল। পরিশেষে মালিক ইবনে আজলান নামক জনৈক গোত্রপতি ইহুদি নেতা ফিতয়ুনকে হত্যা করে সিরিয়া চলে গেল এবং গাসসানি শাসক আবু জুবায়লার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করল। ফলে সিরিয়া থেকে একটি সৈন্যবাহিনী এসে জুল-হারুদ নামক স্থানে এক ভোজসভায় সকল ইহুদি নেতৃস্থানীয় লোকদের হত্যা করে। এভাবে ইয়াসরিবে ইহুদিদের শক্তি কিছুটা খর্ব হয় এবং আওস ও খাযরাজ গোত্রের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এটির ফলে ইহুদি বনু কুরায়জা ও বনু নাজির নগরীর বাইরে গিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হয়। কিন্তু বনু কায়নুকার সাথে বনু কুরায়জা ও বনু নাজিরের পূর্ব থেকেই মনোমালিন্য থাকায় তারা নগরীর অভ্যন্তরে অবস্থান করতে লাগল। এজন্য তাদের খাযরাজ গোত্রের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়।[8]
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ – Expedition of Abu Ubaidah ibn al Jarrah
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু কাতাদা ইবনে রিবঈ – Expedition of Abu Qatadah ibn Rab’i al-Ansari (Batn Edam)
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু সালামা – Expedition of Qatan
মানচিত্র (১৩) : বনু কায়নুকার অবস্থান
বনু কায়নুকার আর্থিক অবস্থা
আরব গোত্রসমূহের তুলনায় ইহুদি বনু কায়নুকার আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই সচ্ছল। ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার সুসভ্য অঞ্চল থেকে এসেছিল বলে তারা এমন সব শিল্পে পারদর্শী ছিল, যা আরবদের মধ্যে প্রচলিত ছিল না। তাদের কোনো কৃষিভূমি ও ফলের বাগান ছিল না। এই গোত্রের অধিকাংশ লোক ছিল ব্যবসায়ী। তারা ছিল মদিনার ধনাঢ্য শ্রেণির অন্তর্গত। তারা পেশায় ছিল প্রধানত স্বর্ণকার। এটি ছাড়াও তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, লৌহজাত সামগ্রী ও তৈজসপত্র নির্মাণশিল্পে দক্ষ ছিল। এই কারণে তাদের অধিকাংশ লোকই ছিল সশস্ত্র। আর্থিক সমৃদ্ধি ও ব্যবসায়িক সাফল্য প্রভৃতি কারণে মদিনার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধনে তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল বলে এই গোত্র মদিনার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। ফলে মদিনার রাজনীতিতে এই গোত্রের বিরাট ভূমিকা ছিল। তারা একদিকে সুদের উপর টাকা লগ্নি করত, অপরদিকে ইয়াসরিবে বসবাসকারী গোত্রসমূহের পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে বিবাদমান গোত্রসমূহকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা প্রদান করে তাদের ঋণের দায়ে জর্জরিত করে ফেলত। এভাবে তারা আরবদের উপর স্থায়ী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলে আরবগণ সিরীয়দের সহযোগিতায় তাদের শক্তি খর্ব করে। ফলে তারা খাযরাজ গোত্রের আশ্রয়ে ইয়াসরিব নগরীর অভ্যন্তরে বসবাস করতে থাকে। খাযরাজ গোত্রের পক্ষ অবলম্বন করে তারা বুআস যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে এখানে বসবাসকারী অপর প্রধান দুই ইহুদি গোত্র তথা বনু কুরায়জা ও বনু নাজির-এর সাথে তাদের প্রকাশ্য শত্রুতা শুরু হয়। বনু কায়নুকা ইয়াসরিব নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে মুসাল্লার নিকটবর্তী ওয়াদি বুতহান-এর উপর স্থিত সেতুর সন্নিকটে বাস করত। সেই স্থানে তারা দুটি সুরক্ষিত দুর্গের অধিকারী ছিল। ইবনে খালদুন বলেছেন, ‘বনু কায়নুকা মদিনার এক প্রান্তে বসবাস করত।’
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াসরিব তথা মদিনায় হিজরত করে এলে ইয়াসরিবের ইহুদিদের তাকে অভ্যর্থনা জানায়। হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় যেই সনদ জারি করেন, তাতে মুসলিম সম্প্রদায় ও ইহুদিদের মধ্যে সুস্পষ্ট কতিপয় শর্ত ছিল, যা মান্য করার স্বীকৃতি প্রদান করে মদিনার ইহুদিদের তাতে স্বাক্ষর প্রদান করে। এই সনদ জারির সময় তাতে যেসব ইহুদি গোত্রের নাম পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে বনু কায়নুকার নাম উল্লেখ নেই। এই সনদে সকল গোত্র ও তাদের মিত্র শক্তিকে এবং যারা পরবর্তী সময়ে সংযুক্ত হবে তাদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি উন্মুক্ত রাখা হয়। সম্ভবত ‘বনু কায়নুকা’ পরবর্তী সময়ে এই সনদের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রতিপন্ন হয়। এই সনদে উভয় সম্প্রদায়ের পূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাধীনতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় এবং তাদের মধ্যে কোনো প্রকার অভ্যন্তরীণ কলহ দেখা দিলে তা মীমাংসার দায়িত্ব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অর্পণ করা হয়। এই সনদে আরও নিশ্চিত করা হয়, মদিনার মুসলিম সম্প্রদায় বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে মুসলিম ও ইহুদি উভয় পক্ষ সম্মিলিতভাবে এই আক্রমণ প্রতিহত করবে এবং এক্ষেত্রে প্রত্যেক পক্ষ স্ব স্ব ব্যয়ভার বহন করবে।[9]
ইসলাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক আচরণ
রমজান ২ হিজরি/মার্চ ৬২৪ সালে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর ইহুদি বনু কায়নুকা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ইসলাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক আচরণ শুরু করে। এর মূলে প্রধান কারণ ছিল চারটি।
এক. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতের বিশ্বজনীন আবেদন তাদের বংশভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ধারাকে তৃণ খণ্ডের মতো ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং তার নবুওয়াতের আওতা ও পরিধি সুপ্রশস্ত হচ্ছিল। তাতে ইহুদি বনু কায়নুকার ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় সংকোচন পরিলক্ষিত হচ্ছিল।
দুই. ইহুদি বনু কায়নুকাসহ অন্যান্য ইহুদি গোত্র এতদিন বিভক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে মদিনায় যেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাসমূহ ভোগ করে আসছিল, মদিনা সনদের মাধ্যমে ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে তাদের সেই সুবিধাসমূহ চিরতরে তিরোহিত হওয়ার উপক্রম হলো।
তিন. ইসলামে আয়-উপার্জন, ব্যবসায়-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক লেনদেন প্রভৃতি ক্ষেত্রে সুদভিত্তিক কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার ফলে ইহুদি বনু কায়নুকার অর্থনৈতিক বিপর্যয় সুনিশ্চিত হয়ে পড়ল।
চার. ইহুদিদের কিবলা হলো বায়তুল মুকাদ্দাস, যা ২ হিজরি সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত মুসলিমদেরও কিবলা ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনা হিজরতের ১৬-১৭ মাস পর মুসলমানদের কিবলা বায়তুল্লাহর দিকে পরিবর্তিত হলে ইহুদিরা রুষ্ঠ হয় এবং প্রকাশ্যে মুসলমানদের বিরোধিতা করতে থাকে।
উপরোল্লিখিত কারণে ইহুদি বনু কায়নুকা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ইসলাম ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরোধিতা করাকে নিজেদের লক্ষ্যে পরিণত করে। তারা একদিকে মুসলিমদের দৈহিকভাবে অপদস্থ করার পথ বেছে নেয়, অপরদিকে সরলপ্রাণ মুসলিম সম্প্রদায়ের মনে ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টির মানসে বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতা চালাতে থাকে। সমাজে অশান্তি ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তারা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইসহ প্রমুখ মুনাফিকের সাথে হাত মেলায়। মুসলমানদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য তারা নানা অপকৌশল অবলম্বন করে। ইহুদিদের এসব অপতৎপরতা ছিল ইতিপূর্বে সম্পাদিত মদিনা সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
আরো পড়ুন : সাফওয়ানা অভিযান – First Expedition to Badr (Safwan)
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস রা. – Expedition of Abdullah Ibn Unais
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা রা. – ‘Abdullah ibn Hudaffa
মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত বদর যুদ্ধের পর মুসলমান মদিনায় ইহুদিদের মধ্যকার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। এই যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের কারণে ইহুদি বনু কায়নুকা মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে শুরু করে। ক্রমে তাদের এই মনোভাব প্রকাশ্য বৈরিতার রূপ নেয়। ওয়াকিদি রহ. বলেন, ‘ইহুদিরা বিদ্রোহ করল এবং তাদের ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে বিদ্যমান চুক্তি ভঙ্গ করল।’[10] আর এই বৈরী মনোভাব প্রকাশ্য রূপ লাভের পেছনে কতিপয় ঘটনা ক্রিয়াশীল ছিল। ঘটনাগুলো হলো,
১. ইবনে হিশাম বলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে জাফর ইবনে মিসওয়ার ইবনে মাখরামা আবু আওন সূত্রে বর্ণনা করেন। আবু আওন বলেন, বনু কায়নুকার ঘটনাটি ছিল এই, জনৈকা আরব নারী (তিনি জনৈক আনসারির স্ত্রী) তার অলঙ্কার বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে বনু কায়নুকার বাজারে উপস্থিত হন এবং জনৈক স্বর্ণকারের নিকট গিয়ে বসেন। কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী মাকবুল বালাজুরি নামক জনৈকা মুসলিম নারী বনু কায়নুকার জনৈক ইহুদি স্বর্ণকারের দোকানে স্বর্ণালঙ্কার তৈরির উদ্দেশ্যে গমন করেন। আবার কোনো বর্ণনায় উল্লেখ আছে, জনৈকা আরব নারী দুধ বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে গমন করেন।[11] এই স্থানে শব্দগত পার্থক্যের কারণে অর্থগত পার্থক্য সূচিত হয়েছে বলে মনে হয়। শব্দটি মূলত হিলইয়া (অলঙ্কার), হালবা (দুধ) নয়। মুদ্রণজনিত (নুসখার) ভুলের কারণে এই পার্থক্য দেখা দিয়েছে।
স্বর্ণকার লোকটি নারীর মুখের নেকাব খুলে তার চেহারা দেখতে চায়। কিন্তু নারী তাতে সম্মত হননি। লোকটি কৌশলে নারীর কাপড়ের একটি অংশ পেছনের একটি আংটার সাথে বেঁধে দেয়। ওয়াকিদির মতে, অপর এক ইহুদি এসে নারীর পেছনে বসে, যা সে জানত না। সে নারীর কাপড়ের একটি অংশ পেছনের একটি আংটার সাথে বেঁধে দেয়।[12] নারী বসা থেকে উঠতে গেলে তার কাপড় খুলে যায়। তাতে তার মুখমণ্ডল ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রকাশিত হয়ে পড়লে স্বর্ণকার উপস্থিত অন্যান্য ইহুদিরা অট্টহাসিতে মেতে ওঠে। এই সময় নারীটি চিৎকার দিয়ে উঠলে একজন মুসলিম তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন এবং স্বর্ণকারের উপর আক্রমণ করে তাকে হত্যা করেন। যেহেতু নিহত লোকটি ছিল ইহুদি, তাই অন্যান্য ইহুদিরা উক্ত মুসলমানের উপর আক্রমণ করে তাকে শহিদ করে। ফলে মুসলিম সম্প্রদায় ক্রোধে ফেটে পড়ে এবং অন্যান্য মুসলিমদের প্রতিশোধ গ্রহণের নিমিত্তে ইহুদিদের উপর আক্রমণ করার জন্য আহ্বান জানায়। এভাবে মদিনার মুসলিম সম্প্রদায় ও ইহুদি বনু কায়নুকার মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ শুরু হয়।[13] এই ঘটনার মাধ্যমে মদিনা সনদের ধারা লঙ্ঘিত হয় এবং প্রকারান্তরে কৃত চুক্তি ভঙ্গ হয়ে যায়। ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক, ইবনে সাদ এবং ইবনে জারির আত-তাবারি প্রমুখ তাদের গ্রন্থে এই ঘটনা উল্লেখ করেননি। অপর দিকে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সূত্র এই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত নারী নিহত ইহুদি এবং শহিদ মুসলিম লোকটির নাম উল্লেখ করেনি।
২. ইবনে ইসহাক বলেন, ইহুদি বনু কায়নুকা চুক্তি ভঙ্গ করে বিশ্বাসঘাতকতা করলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই গোত্রের লোকদের একটি স্থানে সমবেত করে তাদের উপদেশ প্রদান করার চিন্তা করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কায়নুকার উন্মুক্ত বাজার এলাকায় সমাবেশ আয়োজন করে বলেন, ‘হে ইহুদি সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে সেসব শাস্তিকে ভয় করো, যা বদরযুদ্ধে কুরাইশদের উপর আপতিত হয়েছে। তোমাদের উপর তা আপতিত হওয়ার পূর্বেই তোমরা ইসলাম কবুল করো। কেননা ইতিমধ্যেই তোমরা জেনেছ, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসুল। তোমরা তোমাদের উপর নাজিলকৃত কিতাবেও এই বিষয়টি পেয়ে থাকবে।’
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বক্তব্য শুনে বনু কায়নুকার ইহুদিরা বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! সম্ভবত আপনি আমাদের আপনার জাতি তথা কুরাইশ সম্প্রদায়ের মতোই মনে করে থাকেন। বিষয়টি যেন আপনাকে প্রতারিত না করে। আপনি এমন এক জাতির সাথে যুদ্ধ করেন, যাদের যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আপনি এই সুযোগটি গ্রহণ করলেন। আর আমাদের অবস্থা হলো, আপনি যদি আমাদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, তাহলে আপনি অবশ্যই বুঝতে পারবেন আমাদের শৌর্যবীর্য এবং শক্তি-সামর্থ্য কতটুকু।’[14] মদিনা সনদের ধারা অনুযায়ী ইহুদিদের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্ব মেনে নেওয়া সত্ত্বেও এই ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাব প্রদান করে প্রকারান্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যুদ্ধের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। ইবনে হাজার আসকালানির মতে এটি হাসান হাদিস।[15] এই হাদিসের সনদে জায়েদ ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আজাদকৃত গোলাম মুহাম্মাদ ইবনে আবু মুহাম্মাদকে ইবনে হাজার আল-আসকালানি অজ্ঞাত রাবি হিসেবে উল্লেখ করেন।[16] ইউনুস ইবনে বুকাইর ইবনে ইসহাক সূত্রে রেওয়ায়েত করেন, ‘তিনি জায়েদ ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাওলা মুহাম্মাদ ইবনে আবু মুহাম্মাদ সূত্রে রেওয়ায়েত করেন, তিনি সাঈদ ইবনে জুবাইর অথবা ইকরিমা সূত্রে এবং তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা সূত্রে রেওয়ায়েত করেন।’ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘বদরযুদ্ধে কুরাইশদের পরাজিত করার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কায়নুকার ইহুদিদের বনু কায়নুকা বাজারে একত্র করে তাদের ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান। তারা নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের দম্ভ দেখিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাব দেয়।’ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা সূত্রে ইকরিমা রেওয়ায়েত করেন, আল-কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত দুটি এই প্রসঙ্গে নাজিল হয়,
قُلْ لِلَّذِينَ كَفَرُوا سَتُغْلَبُونَ وَتُحْشَرُونَ إِلَى جَهَنَّمَ وَبِئْسَ الْمِهَادُ (১২) قَدْ كَانَ لَكُمْ آيَةٌ فِي فِئَتَيْنِ الْتَقَتَا فِئَةٌ تُقَاتِلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأُخْرَى كَافِرَةٌ يَرَوْنَهُمْ مِثْلَيْهِمْ رَأْيَ الْعَيْنِ وَاللَّهُ يُؤَيِّدُ بِنَصْرِهِ مَنْ يَشَاءُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَعِبْرَةً لِأُولِي الْأَبْصَارِ
‘যারা কুফরি করে তাদের বলো, তোমরা শীঘ্রই পরাভূত হবে এবং তোমাদের একত্র করে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। আর তা কত নিকৃষ্ট আবাসস্থল! দুটি দলের পরস্পর সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে তোমাদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। একদল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছিল; অন্য দল কাফের ছিল; তারা তাদের চোখের দেখায় দ্বিগুণ দেখছিল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন। নিশ্চয় তাতে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকের জন্য শিক্ষা রয়েছে।’[17]
আরো পড়ুন : মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রা.-এর অভিযান – Expedition of Muhammad ibn Maslamah
আরো পড়ুন : যুল ক্বাসসাহর দ্বিতীয় অভিযান – Second expedition of Zul Qassah
আরো পড়ুন : যুল ক্বাসসাহর প্রথম অভিযান – First expedition of Dhul Qassah
অর্থাৎ বনু কায়নুকা প্রথম গোত্র যারা বদর যুদ্ধের পরবর্তী এক মাসের মধ্যেই মদিনা সনদের ধারা লঙ্ঘন করে। ইবনে ইসহাক আসিম ইবনে উমর ইবনে কাতাদা সূত্রে রেওয়ায়েত করেন,
أَنَّ بَنِي قَيْنُقَاعَ كَانُوا أَوَّلَ يَهُودَ نَقَضُوا مَا بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ رَسُول الله صلّى الله عَلَيْهِ وَسلم، وَحَارَبُوا فِيمَا بَيْنَ بَدْرٍ وَأُحُدٍ.
‘বনু কায়নুকা প্রথম ইহুদি গোত্র, যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাদের মধ্যকার স্বাক্ষরিত চুক্তি ভঙ্গ করে এবং বদর-উহুদ যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে তারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়।’[18]
উল্লিখিত কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা ফিরে এসে আবু লুবাবা বশির ইবনে আবদুল মুনজির আল-আনসারিকে মদিনায় তার খলিফা (স্থলাভিষিক্ত) নিযুক্ত করেন এবং ইহুদি বনু কায়নুকাকে শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে মুসলিম মুজাহিদদের সঙ্গে নিয়ে বনু কায়নুকা অবরোধ করেন।[19] এই অভিযানে সাদা পতাকা বহন করেন হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব রাযিয়াল্লাহু আনহু। ওয়াকিদি রহ. বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরতের ২০ মাসের মাথায় শাওয়াল মাসের মধ্যভাগে শনিবার তাদের অবরোধ করেন। আর এই অবরোধ জিলকদ মাসের প্রথম দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’[20] এই অবরোধের মেয়াদ ছিল ১৫ দিন।
বনু কায়নুকা মদিনার খাযরাজ গোত্রের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার কারণে তারা পারস্পরিক দ্বন্দ্বে বনু কায়নুকা খাযরাজ গোত্রের পক্ষ অবলম্বন করত। ইবনে হিশাম বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বনু কায়নুকার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের পেছনে সম্ভবত এটিই কারণ ছিল, তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বারা আক্রান্ত হলে তাদের মিত্রশক্তি তথা খাযরাজ গোত্রের পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া যাবে। বাস্তবিকপক্ষে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ব্যতীত আর কারো নৈতিক সমর্থন তারা লাভ করতে পারেনি। বনু কায়নুকার এই আচরণের কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের পক্ষ থেকে বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা করেন।’ এটির প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা নিম্নোক্ত আয়াত নাজিল করেন,
وَإِمَّا تَخَافَنَّ مِنْ قَوْمٍ خِيَانَةً فَانْبِذْ إِلَيْهِمْ عَلَى سَوَاءٍ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْخَائِنِينَ
‘যদি তুমি কোনো সম্প্রদায়ের চুক্তি ভঙ্গের আশঙ্কা করো, তবে তোমার চুক্তিও তুমি যথাযথ বাতিল করবে; নিশ্চয় আল্লাহ চুক্তি ভঙ্গকারীদের পছন্দ করেন না।’[21]
এই নির্দেশের উপর ভিত্তি করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কায়নুকার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। অবরোধ চলাকালীন বনু কায়নুকা দুর্গে আশ্রয় নেয়। এ সময়ে তারা তাদের সকল মিত্রশক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাদের কেউ বাইরে আসতে পারেনি এবং বাইরে থেকেও কেউ তাদের জন্য খাবার পৌঁছিয়ে দিতে সক্ষম হয়নি। এই অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করেন। অবস্থার নাজুকতা উপলব্ধি করে তারা এই শর্তে আত্মসমর্পণ করে, তাদের স্ত্রী-পুত্র-পরিজন তাদের সাথেই থাকবে আর তাদের ধন-সম্পদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের হবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বন্দি করেন এবং দুই হাত পেছনের দিক থেকে বেঁধে ফেলার নির্দেশ দেন। তিনি এই কাজের দায়িত্ব অর্পণ করেন বনু আসলাম গোত্রের মুনজির ইবনে কুদামার উপর। তারা সংখ্যা ছিল সাতশত। চারশত ছিল বর্মবিহীন এবং তিনশত ছিল বর্মধারী। মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের সাথে মৈত্রীচুক্তি থাকার কারণে এ সময় সে তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। সে মুনজিরকে বলে, ‘এদের ছেড়ে দাও।’ মুনজির বলেন, ‘আমি কি এমন জাতিকে ছেড়ে দেব, যাদের বাঁধার নির্দেশ স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন! আল্লাহর শপথ! যে ব্যক্তি তাদের ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসবে, আমি তার গর্দান কেটে ফেলব।’ তখন সে বনু কায়নুকার লোকদের মুক্ত করে দেওয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সুপারিশ করে এবং বলে, ‘হে মুহাম্মাদ! মিত্র গোত্রের লোকদের প্রতি অনুগ্রহ করুন।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লৌহ বর্মের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমাকে ছেড়ে দাও।’ এ সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারায় অসন্তোষের চিহ্ন ফুটে ওঠে। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বলল, ‘আমি ছেড়ে দেব না, যতক্ষণ পর্যন্ত মিত্র গোত্রের লোকদের প্রতি অনুগ্রহ করা না হয়। তারা আমাকে বিভিন্ন সময় সাহায্য করেছে। আপনি কি তাদের এত শীঘ্রই ধ্বংস করে দেবেন? হে মুহাম্মাদ! আমি বিপদের আশঙ্কা করছি।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাদের ছেড়ে দাও। আল্লাহ তাদের উপর লানত বর্ষণ করুন এবং আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের উপরও লানত বর্ষণ করুন।’
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কায়নুকার ইহুদিদের হত্যা না করে মদিনা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন এবং এই নির্দেশ কার্যকর করার দায়িত্ব অর্পণ করেন তাদেরই মিত্র গোত্রের অন্তর্গত উবাদা ইবনে সামিত রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর, যিনি তখন বনু কায়নুকার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। তিনি তাদের সন্তান-সন্ততিসহ মদিনার যুবাত পর্বত পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তোমরা অনেক দূরে চলে যাও। তখন তারা সিরিয়ার আফরিআত নামক এলাকায় চলে যায়।’
আরো পড়ুন : বদরের যুদ্ধ – Battle of Badr
আরো পড়ুন : বনু সুলাইম অভিযান – Al Kudr Invasion
আরো পড়ুন : বাতনে রাগিব অভিযান – Expedition of Ubaydah ibn al-Harith
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ধন-সম্পদ, সমুদয় সমরাস্ত্র এবং স্বর্ণলঙ্কার নির্মাণের সকল যন্ত্রপাতি গনিমত হিসেবে গ্রহণ করেন। এই সম্পদ হস্তগত করার দায়িত্ব অর্পণ করেন মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা আল-আনসারি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর। তাদের ধন-সম্পদ পাঁচ ভাগ করা হয়। চার ভাগ মুসলিম মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। অপর এক ভাগ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহণ করেন। এগুলো হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক গ্রহণকৃত সর্বপ্রথম গনিমতের সম্পদ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তিনটি ধনুক ও দুটি লৌহবর্ম। ধনুকগুলোর নাম হলো,
১. কাতুম (الكَتومُ) এটি উহুদ যুদ্ধে ভেঙে যায়।
২. রাওহা (الرَّوحاءُ),
৩. বাইদা (البَيضاءُ)।
লৌহবর্ম দুটির নাম হলো,
সুগদিয়া (الصُّغديَّةُ) ও ফিদ্দাহ (فِضَّةٌ)
বর্ণিত আছে, সুগদিয়া হলো সেই বর্ম, যা জালুতের সাথে যুদ্ধ করার সময় দাউদ আলাইহিস সালাম পরিধান করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বর্ম মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে এবং অপরটি সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রদান করেছেন। মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে একটি বর্ম প্রদান করেছেন, আর একটি প্রদান করেছেন সাদ ইবনে মুআজকে।
এই অভিযানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি তরবারিও হস্তগত করেন। এগুলোর মধ্যে একটির নাম কালাঈ (سَيفٌ قَلَعيُّ), অপর একটির নাম বাত্তার (بَتّارٌ)। তৃতীয়টির নাম পাওয়া যায় না।[22] বনু কায়নুকা অভিযানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গনিমতের সম্পদ থেকে এক-পঞ্চমাংশ গ্রহণের পাশাপাশি সাফিয়্যা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কেও গ্রহণ করেন।’[23]
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কায়নুকাকে বহিষ্কার করার দায়িত্ব অর্পণ করেন উবাদা ইবনে সামিত রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর। বনু কায়নুকা বলল, আমরা কি আওস ও খাযরাজ গোত্রের নিকট থেকে চলে যাব? আমরা তো আপনার মিত্রপক্ষ। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি মিত্রদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলেন।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে আবুল হুবাব! হৃদয় পরিবর্তন হয়েছে, ইসলাম সকল চুক্তি বাতিল করেছে। তারা আগামীকালই চলে যাবে।’ বনু কায়নুকা বলল, ‘লোকদের নিকট আমরা অনেক ঋণ পাওনা আছি।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাদের তাড়াতাড়ি যেতে বলো।’ ইবনুল আসির বলেন, উবাদা ইবনে সামিত রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে যুবাব পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেন। অতঃপর তারা আরিআত চলে যায়। আযরিআত হলো সিরিয়ার অন্তর্গত একটি শহর। এটি বালকা ও আম্মান সংলগ্ন একটি স্থান।[24] কিছুকাল অতিবাহিত হতেই তারা ধ্বংস হয়ে যায়।[25] সারাহ বলেন, আমি সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় আকিক উপত্যকায় ফালজাহ নামক স্থানে ছিলাম। আমি এই স্থানে বনু কায়নুকার সাক্ষাৎ পেলাম। তারা নিজেদের সন্তান-সন্ততি ও স্ত্রী-পরিজনকে উটের পিঠে উঠিয়ে পুরুষরা হেঁটে চলে যাচ্ছিল। আমি তাদের অবস্থা জিজ্ঞাসা করলে তারা বলল, ‘মুহাম্মাদ আমাদেরকে বিতাড়িত করে দিয়েছে এবং আমাদের ধন-সম্পদ রেখে দিয়েছে।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমরা এখন কোথায় যাবে?’ তারা বলল, ‘আমরা সিরিয়া যাব।’ পরবর্তীকালে তারা ওয়াদিউল কুরায় অবতরণ করে এই স্থানে এক মাস অবস্থান পূর্বক শক্তি সঞ্চয় করে। অতঃপর তারা আযরিআতে চলে যায় এবং সেই স্থানে অবস্থান করে। কিন্তু সেখানেও তারা স্থায়ী হতে পারেনি।[26]
উবাদা ইবনে সামিত বলেন, ‘বনু কায়নুকা যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, তখন তাদের মিত্র আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাদের সহযোগিতায় দাঁড়িয়ে গেলেও তাদের অপর মিত্র আওফ ইবনে আল-খাযরাজ গোত্রের উবাদা ইবনে সামিত রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহ তায়ালা এবং তার রাসুলের সাথে সম্পর্ককে সুদৃঢ় করেন।’ উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি বনু কায়নুকার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহ তায়ালা এবং তার রাসুলের সঙ্গে সম্পর্ককে গ্রহণ করলাম এবং মহান আল্লাহ, তার রাসুল এবং মুমিনদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলাম, আর কাফেরদের সঙ্গে ইতিপূর্বের সকল সহযোগিতা ও মিত্রতার চুক্তি ছিন্ন করলাম।’ অতঃপর উবাদা ইবনে সামিত রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং আবদুল্লাহ ইবনে উবাই সম্পর্কে নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ নাজিল হয়,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ. فَتَرَى الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَى أَنْ تُصِيبَنَا دَائِرَةٌ فَعَسَى اللَّهُ أَنْ يَأْتِيَ بِالْفَتْحِ أَوْ أَمْرٍ مِنْ عِنْدِهِ فَيُصْبِحُوا عَلَى مَا أَسَرُّوا فِي أَنْفُسِهِمْ نَادِمِينَ . وَيَقُولُ الَّذِينَ آمَنُوا أَهَؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمُوا بِاللَّهِ جَهْدَ أَيْمَانِهِمْ إِنَّهُمْ لَمَعَكُمْ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَأَصْبَحُوا خَاسِرِينَ. يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ. إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ. وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ .
‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বন্ধুরূপে গ্রহণ কোরো না। তারা পরস্পর পরস্পরের। তোমাদের মধ্যে কেউ তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন হবে। নিশ্চয় আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না। এবং যাদের অন্তঃকরণে ব্যাধি রয়েছে, তুমি তাদের সত্বর তাদের সাথে মিলিত থেকে দেখবে এই বলে, আমাদের আশঙ্কা হয় আমাদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটবে। হয়তো আল্লাহ বিজয় অথবা তার নিকট থেকে এমন কিছু দেবেন, যাতে তারা তাদের অন্তরে যা গোপন রেখেছিল, তার জন্য অনুতপ্ত হবে। এবং মুমিনগণ বলবে, এরাই কি তারা, যারা আল্লাহর নামে দৃঢ়ভাবে শপথ করেছিল যে, তারা তোমাদের সঙ্গেই আছে? তাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে গেছে এবং তারা অকৃতকার্য হয়েছে। হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্য কেউ দীন থেকে ফিরে গেলে নিশ্চয় আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন, যাদের তিনি ভালোবাসবেন এবং যারা তাকে ভালোবাসবে। তারা মুমিনদের প্রতি কোমল ও কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে; তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি দান করেছেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তার রাসুল ও মুমিনগণ—যারা বিনীত হয়ে নামাজ কায়েম করে ও জাকাত দেয়। কেউ আল্লাহ, তার রাসুল এবং মুমিনদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে আল্লাহর দলই তো বিজয়ী হবে।’[27]
আরো পড়ুন : গাজওয়া হুনাইন – Battle of Hunayn
আরো পড়ুন : গাজওয়াতুল বুহরান – Invasion of Buhran
আরো পড়ুন : নাখলা অভিযান – Nakhla Raid
উক্ত আয়াতসমূহে (فَتَرَى الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ) (তুমি দেখবে সেই সমস্ত লোককে, যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে) বলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে বুঝানো হয়েছে। কারণ সে বলেছিল,
أَنِيْ خْشَى الدَوَائِرَ
(আমি বিপদের আশঙ্কা করছি) যা বিবৃত করে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
يَقُولُونَ نَخْشَى أَنْ تُصِيبَنَا دَائِرَةٌ
(তারা বলে, আমরা আমাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছি)। পক্ষান্তরে,
وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا
‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহ, তার রাসুল এবং ঈমানদার লোকদের নিজের বন্ধু বানাবে;’ শীর্ষক আয়াত দ্বারা উবাদা ইবনে সামিতকে বুঝানো হয়েছে। কারণ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বনু কায়নুকার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহ তায়ালা, তার রাসুল এবং মুমিনগণকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলাম।’[28]
বনু কায়নুকা গোত্রের কতিপয় লোক দীন ইসলাম গ্রহণ করে এবং তারা মদিনাতেই থেকে যায়। ইবনে হিশাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিপক্ষ হিসেবে ৩০ জন বনু কায়নুকার তালিকা প্রদান করেছেন। হয়তো এটি দ্বারা নির্বাসন-পূর্ব সময়কে বুঝানো হয়েছে। তালিকার ৫-৬টি নাম ওয়াকিদির বর্ণনায় পাওয়া যায়। ৬৩১ সালে ইবনে উবাইয়ের দাফনের সময় বনু কায়নুকা এবং অন্য গোত্রের কিছুসংখ্যক ব্যক্তি ভিড় ঠেলে লাশের খাটিয়া পর্যন্ত গিয়েছিল।[29] কায়নুকা গোত্রের আরেক ব্যক্তি ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (প্রকৃত নাম আল-হুসাইন)। ইনি ছিলেন একজন ধর্মীয় নেতা এবং সুশিক্ষিত ব্যক্তি। ইবনে ইসহাক কর্তৃক প্রদত্ত তালিকার উপসংহারে তার নাম উল্লিখিত হয়েছে। তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনায় হিজরতের পরই ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। Horovitz বলেন, ‘তিনি হিজরতের ৮ বছর পর এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের দুই বছর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন।’[30]
বনু কায়নুকার যুদ্ধ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও সিরাত রচয়িতাগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। বালাজুরি ও ইবনে খালদুন প্রমুখ ঐতিহাসিকের মতে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২য় হিজরির শাওয়াল মাসে। কিন্তু ইবনে কাসির রহ. বলেন, ‘এটি হিজরি ৩য় সালে সংঘটিত হয়েছিল।’ এই বর্ণনাটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এটি নিশ্চিত, এই যুদ্ধ বদরের যুদ্ধের পর ও উহুদ যুদ্ধের পূর্বে সংঘটিত হয়। কোনো এক বর্ণনা থেকে জানা যায়, ৩য় হিজরির মুহাররম মাসে গাতফান গোত্রের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনার ফলে আমররা-র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান ইবনে আফফান রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মদিনায় তার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন এবং স্বয়ং নজদ অভিমুখে যাত্রা করেন। তিনি সেখানে সফর মাস অতিবাহিত করেন এবং বিনা যুদ্ধেই প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর ৩য় হিজরির রবিউল আওয়াল মাসে একদল সৈন্য নিয়ে হিজাজে বুহরান নামক স্থান পর্যন্ত গমন করেন। কিন্তু কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে কিছুদিন অতিবাহিত করার পর মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। যেহেতু বনু কায়নুকার যুদ্ধ এরপর সংঘটিত হয়, সেহেতু এটির তারিখ ৩য় হিজরি নির্ধারিত করা যেতে পারে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বনু কায়নুকা অভিযান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি এই গোত্রের ইহুদিদের ইসলাম কবুল করার এবং তার নবুওয়াতের স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান। বিষয়টি তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতেও উল্লিখিত হয়েছে। তারা মুসলমানদের পাশাপাশি মদিনায় অবস্থান করত। তারা ছিল মদিনা সনদের আওতাভুক্ত গোত্রসমূহের অন্তর্গত। এতৎসত্ত্বেও তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহ্বানের ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাব দেয়, নিজেদের বীরত্ব ও বাহাদুরি প্রকাশ করে এবং এক্ষেত্রে কোনো প্রকার সমীহ ও সৌজন্য প্রকাশ করেনি। এটির মাধ্যমে বাহ্যত মনে হয়, তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সংঘর্ষে জড়িত হওয়ার জন্য মানসিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল এবং এক্ষেত্রে তারা মিত্রশক্তি খাযরাজ গোত্রের সহযোগিতার উপর অধিক নির্ভর করেছিল। নতুবা বনু কায়নুকার ন্যায় একটি ক্ষুদ্র গোত্র মুসলমানদের কুরাইশদের বিপক্ষে বিজয়ী ও মদিনার শাসনকার্য পরিচালনাকারী একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা করার সাহস দেখাতে পারে না।
আরো পড়ুন : গাজওয়া যু-আমর – Dhu Amarr raid
আরো পড়ুন : গাজওয়া সারিয়্যা আর-রাজি – Expedition of Al Raji
আরো পড়ুন : গাজওয়া হামরাউল আসাদ – Battle of Hamra al-Asad
কেবল ইসলাম কবুল করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কায়নুকাকে বহিষ্কার করেছিলেন বলে মনে করার সঙ্গত কোনো কারণ নেই। কেননা মদিনা সনদের ভিত্তিতে ইহুদিদেরকে মুসলিমদের পাশাপাশি মদিনায় শান্তিতে বসবাস করার অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল। আর এক্ষেত্রে তাদের ইসলাম কবুল করার কোনো শর্ত আরোপ করা হয়নি; বরং মদিনা সনদে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছিল। আমরা মনে করি, বদরযুদ্ধে কুরাইশদের পরাজয় বরণ করার পর মদিনার ইহুদিদের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। এটির প্রকাশ ঘটে তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও আগ্রাসী জবাব প্রদানের মধ্য দিয়ে। এর মাধ্যমে মদিনার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিধিমালা লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। সনদের শর্ত অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন। তাদের এই চ্যালেঞ্জ প্রকারান্তরে মদিনা সনদের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপলব্ধি করেছিলেন, ইহুদিদের সঙ্গে মদিনায় একত্রে বসবাস করা সম্ভব নয়। তারা মদিনার অভ্যন্তরে বসবাস করত বলে তাদের এই মনোভাব যেন অন্যান্য গোত্রে সম্প্রসারিত হতে না পারে, সেজন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদি বা কায়নুকার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে তাদের অবরোধ করেন এবং মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক গৃহীত এই পদক্ষেপের মাধ্যমে মদিনায় অন্যান্য ইহুদি গোত্রের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অন্যান্য অমুসলিম জনগোষ্ঠীও এখানে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করার সাহস প্রদর্শন করেনি।
তথ্যসূত্র
[1]. আবদুল কাদের, ইমাম মালিক রহ. ও তাঁর ফিকহচর্চা : ১২
[2]. আহমাদ ইবরাহিম আশ-শারিফ, মক্কা ওয়াল-মাদিনা ফিল জাহিলিয়্যাতি ওয়া আহদুর-রাসুল : ৩২৮-২৯; আবুল ফারাজ আল-ইসফাহানি, কিতাব আল-আগানি : ১৯/৯৪; ইয়াকুত আল-হামাবি, মুজামুল-বুলদান : ৫/৮৪
[3]. আবুল হাসান আল-বালাজুরি, ফুতুহুল বুলদান : ২৫
[4]. হাসসান ইবনে সাবিত, দিওয়ান : ২/৬৩
[5]. আহমাদ ইবরাহিম আশ-শারিফ, মক্কা ওয়াল-মাদিনা ফিল জাহিলিয়্যাতি ওয়া আহদুর রাসুল : ৩১২
[6]. আবদুল কাদের, ইমাম মালিক রহ. ও তার ফিকহ চর্চা : ১৪
[7]. ইয়াকুত আল-হামাবি, মুজামুল-বুলদান : ৫/৮৪
[8]. ড. আ. ক. ম. আবদুল কাদের, ইমাম মালিক রহ. ও তার ফিকহ চর্চা : ১৪-১৬
[9]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/১৯৯-১২৩
[10]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/১৭৬
[11]. ইবনে কাসির, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৬
[12]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/১৭৬
[13]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : আস-সিরাতুন্নাবাবিয়্যা : ২/৪৮
[14]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/১৭৬
[15]. ইবনে হাজার আল-আসকালানি, ফাতহুল বারি : ৭/৩৩২
[16]. তাকরিবুত-তাহজিব : ২/২০৫
[17]. আলে ইমরান, ১২-১৩
[18]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৫১
[19]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/৩-৪
[20]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/১৭৭; আল-বায়হাকি, দালাইলুন-নুবুওয়াহ : ৩/১৮৩
[21]. আল-আরাফ, ৫৮
[22]. ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ২/২৮-৩৩; আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/১৭৮-৭৯
[23]. আত-তাবারি, তারিখ আল-উমাম ওয়াল-মুলক : ১/১৭৪
[24]. আল-হামাবি, মুজামুল বুলদান : ১/১৬২১
[25]. ইবনুল আসির, আল-কামিল ফিত তারিখ : ২/১৩৮
[26]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি, কিতাবুল-মাগাজি : ১/১৮০
[27]. আল-মায়দাহ, ৫১-৫৬
[28]. আল-বায়হাকি, দালাইলুন নুবুওয়াহ : ৩/৭৩-৭৫; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/৪৭-৫০
[29]. Wellhausen, ৪১৫
[30]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি, ইসাবাহ : ২/৭৮০-২১