সিরাত বিশ্বকোষ
সিরাত বিশ্বকোষ

১৩. (৭) গাজওয়া আস-সাবিক  – Invasion of Sawiq

লেখক: আহমাদ রিফআত

বিষয় : বিষয়ভিত্তিক সিরাত

১৩. (৭) গাজওয়া আস-সাবিক – Invasion of Sawiq

৭. গাজওয়া আস-সাবিক

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত গাজওয়া : ৭

তারিখ হিজরি দ্বিতীয় বর্ষের জিলহজ, মতান্তরে জিলকদ মাসের পাঁচ তারিখ রবিবার এই অভিযান পরিচালিত হয়।
স্থান কারকারাতুল কুদর পর্যন্ত ধাওয়া করেন।
ফলাফল কোনো যুদ্ধ হয়নি।
কারণ কুরাইশদের সৈন্য সাথে নিয়ে মদিনা আক্রমণ।
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ান
শক্তি
দুইশত অশ্বারোহী দুইশত আনসার ও মুহাজির

 

 

নামকরণ

 

সাবিক অর্থ ছাতু। আবু সুফিয়ান ও তার অনুচরগণ যেসকল রসদপত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছিল, তার অধিকাংশই ছিল ছাতু। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুজাহিদদের আগমনবার্তা শুনে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার সুবিধার্থে বোঝা হালকা করা এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তারা ছাতুর বস্তা ফেলে যায়। মুসলমানরা শত্ৰুদের না পেয়ে ওই ছাতু নিজেদের অধিকারে আনেন। এই কারণেই এই যুদ্ধ ইতিহাসে গাজওয়া সাবিক বা ছাতু যুদ্ধ নামে অভিহিত।[1]

সময়কাল

 

বদর যুদ্ধের দুই মাস পর হিজরি দ্বিতীয় বর্ষের জিলহজ, মতান্তরে জিলকদ মাসের পাঁচ তারিখ রবিবার এই অভিযান পরিচালিত হয়।[2] কারো মতে এই যুদ্ধ তৃতীয় হিজরিতে সংঘটিত হয়েছিল।[3]

বদর যুদ্ধের পর মুসলমানগণ তাদের শক্তিকে আরও কিছুটা সুসংহত করার সুযোগ পায়। তারা এই সুযোগের সদ্ব্যব্যবহার করেন, কিন্তু এই অবস্থা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বদরযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর আবু সুফিয়ান মুসলমানদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য একের পর এক পরিকল্পনা করতে থাকে। মক্কায় আরবদের মধ্যে সে এই প্রচারণা করছিল, কুরাইশগণ সারা আরবদেশে এখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। মুসলমানদের বিরুদ্ধে তারা এখন যেকোনো যুদ্ধে জয়ী হতে সক্ষম।

এমতাবস্থায় একদিন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা বদরযুদ্ধে স্বীয় পিতা ও ভাইয়ের মৃত্যুতে শোকাতুর হয়ে আবু সুফিয়ানের নিকটে হামজা ও আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে হত্যা করার জন্য প্ররোচিত করতে লাগল। তখন আবু সুফিয়ান কঠোর প্রতিজ্ঞা করল, বদর যুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণ না করা পর্যন্ত সে স্ত্রী স্পর্শ ও খোশবু ব্যবহার করবে না। আবু সুফিয়ান এই বলে মানত করল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যুদ্ধ না করা পর্যন্ত সে নাপাকির গোসলে মাথায় পানি ব্যবহার করবে না। মক্কা থেকে মদিনা অভিমুখে যাত্রা করার পূর্বে আবু সুফিয়ান কুরাইশদের উত্তেজিত করার জন্য কিছু কবিতা আবৃত্তি করেছিল,

كُرُّوا عَلَى يَثْرِبَ وَجَمْعِهِمْ … فَإِنَّ مَا جَمَعُوا لَكُمْ نَفْلٌ

إِنْ يَكُ يَوْمَ الْقَلِيبِ كَانَ لَهُمْ … فَإِنَّ مَا بَعْدَهُ لَكُمْ دُوَلٌ

آلَيْتُ لا أَقْرَبُ النِّسَاءَ وَلا … يَمَسُّ رَأِسي وَجِلْدِي الْغُسْلُ

حَتَّى تَبِيرُوا قَبَائِلَ الأوس و … الخزرج، إِنَّ الْفُؤَادَ مُشْتَعلٌ

(১) মদিনায় তাদের (শত্রুদের) আক্রমণ করো, তারা যে সম্পদ নিয়ে গেছে তা তোমাদের প্রাপ্য।

(২) বদরের যুদ্ধে, যদিও তাদের জয় হয়েছে, ভবিষ্যতে তোমাদের সকল সম্পদ ফিরে আসবে।

আরো পড়ুন : গাজওয়া মুরাইসি – Expedition of al-Muraysi’

আরো পড়ুন : গাজওয়া যাতুর-রিকা – Expedition of Dhat al-Riqa

আরো পড়ুন : গাজওয়া যি-কারাদ বা গাজওয়া গাবা – Expedition of Dhu Qarad

(৩) প্রতিজ্ঞা করেছি, স্ত্রী সহবাস করব না এবং গোসল করব না।

(৪) যতক্ষণ পর্যন্ত আওস এবং খাযরাজ তোমাদের হাতে ধ্বংস না হয়, প্রতিশোধের জন্য আমার প্রাণ জ্বলে।[4]

আস-সাবিক অভিযান স্থল
আস-সাবিক অভিযান স্থল

মানচিত্র (১৪) : আস-সাবিক অভিযান স্থল

 

তখন সে তার শপথ পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে অদম্য পিপাসা নিয়ে কুরাইশদের দুইশত অশ্বারোহী সৈন্য সাথে নিয়ে মদিনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে বের হলো। তারা নজদের পথ ধরে একটি নহরের উপরি অংশে সাবির পাহাড়ের পাদদেশে শিবির স্থাপন করল। আবু সুফিয়ান কুরাইশদের অশ্বারোহী দলকে সেখানে রেখে গভীর রাতে বনু নাজিরের নিকট পৌঁছালো এবং হুয়ায়্যি ইবনে আখতাবের ঘরে এসে দরজায় আঘাত করল; কিন্তু সে ভয় পেয়ে দরজা খুলতে অস্বীকার করল। তখন আবু সুফিয়ান সেখান থেকে ফিরে সাল্লাম ইবনে মিশকামের বাড়ি পৌঁছাল। সে ওই সময় বনু নাজিরের নেতা ও সঞ্চয় তহবিলের সংরক্ষক ছিল। আবু সুফিয়ান নিকটে এসে প্রবেশের অনুমতি চাওয়া মাত্রই সে অনুমতি দিল এবং যত্নের সাথে আপ্যায়ন করল আর মুসলমান ও মদিনার গোপন তথ্যাদি জানিয়ে দিল। তারপর আবু সুফিয়ান রাতের শেষাংশে সঙ্গীদের কাছে প্রত্যাবর্তন করে কুরাইশদের কতক ব্যক্তিকে মদিনায় পাঠিয়ে দিল। তারা মদিনার সীমান্তে উরায়েজ নামক স্থানে পৌঁছে সেখানকার দুটি বাড়ি এবং একটি খেজুর বাগানে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সেখানে তাদের সঙ্গে দুজন মুসলমানের সাক্ষাৎ হয়। তাদের একজন ছিলেন আনসারি, যার নাম সাদ ইবনে আমর। কারো কারো মতে আনসারির নাম ছিল মাবাদ ইবনে আমর, আর অন্যজন ছিল তারই মিত্র। কুরাইশরা তাদের উভয়কে হত্যা করল।[5]

এই ঘটনায় আবু সুফিয়ান এটি ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করল, সে বদরের যুদ্ধে নিহতদের প্রতিশোধ নেওয়ার যে শপথ করেছিল, তা বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে তার মনে এই আশঙ্কাও ছিল, মুসলমানরা তার পিছু ধাওয়া করতে পারে।

এদিকে এই সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুইশত আনসার ও মুহাজিরের একটি বাহিনী নিয়ে রওনা হলেন। মদিনার শাসনভার বাশির ইবনে আবদুল মুনজির ওরফে আবু লুবাবা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর ন্যস্ত করলেন।[6]

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভিযানের কথা জানতে পেরে শত্রুরা ভয়ে কম্পিত হয়ে তৎক্ষণাৎ পৃষ্ঠ প্রদর্শনপূর্বক পালিয়ে গেল। রসদ হিসেবে তাদের সঙ্গে বহু ছাতুর বস্তা ছিল, দ্রুত পালাবার উদ্দেশ্যে সেগুলো ফেলে যায়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘কারকারাতুল কুদর’ নামক স্থান পর্যন্ত এসে দেখতে পেলেন, শত্রুরা নাগালের বাইরে চলে গেছে। সুতরাং তিনি মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে মদিনায় ফিরে এলেন।[7]

আবু সুফিয়ানের এই ব্যর্থ অভিযান এবং পালিয়ে যাওয়ার খবর আরবে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মদিনা থেকে দূরে বসবাসকারী আরব গোত্রগুলোর মধ্যে এসকল ঘটনার তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার অনুসারীদের এই তৎপরতার প্রতি খুব একটা গুরুত্ব প্রদান করত না।

আরো পড়ুন : গাজওয়া বনু কুরাইজা – Invasion of Banu Qurayza

আরো পড়ুন : গাজওয়া বনু লিহ্য়ান – Invasion of Banu Lahyan

আরো পড়ুন : গাজওয়া মুতা – Battle of Mu’tah

এ সময় আবু সুফিয়ানের প্ররোচনায় বনু গাতফান ও বনু সুলাইম গোত্রের ইহুদিদের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিপক্ষে শত্রুতামূলক আচরণ আরম্ভ করে।

মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে মদিনায় ফিরে আসার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি কি মনে করেন, এই অভিযানটি জিহাদ হিসেবে গণ্য হবে?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ।’[8]

মক্কায় ফিরে যাওয়ার পর আবু সুফিয়ান সাল্লাম ইবনে মিশকামের অতিথিপরায়ণতা সম্পর্কে বলে,

وَإِنِّي تَخَيَّرْتُ الْمَدِينَةَ وَاحِدًا … لِحِلْفٍ فَلَمْ أَنْدَمْ وَلَمْ أَتَلَوَّمِ

سَقَانِي فَرَوَّانِي كُمَيْتًا مُدَامَةً … عَلَى عَجَلٍ مِنِّي سَلَامُ بْنُ مِشْكَمِ

(১) আমি মদিনায় মিত্রতার জন্য এক ব্যক্তিকে মনোনীত করেছি, তাতে আমি লজ্জিত ও নিন্দিত হইনি।

(২) সাল্লাম ইবনে মিশকাম আমাকে লাল ও কালো মদ পান করিয়েছে, অথচ তখন আমার তাড়া ছিল।[9]

আরো পড়ুন : গাজওয়া বদর আল-আখিরা – Expedition of Badr al-Maw’id

আরো পড়ুন : গাজওয়া বনি নাজির – Invasion of Banu Nadir

আরো পড়ুন : গাজওয়া বনু কায়নুকা – Invasion of Banu Qaynuqa 

তথ্যসূত্র

 

[1]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ১/৩০৪; ইবনে খালদুন : ২/২২; আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/১৮১-১৮২; ইবনুল আসির : ২/৩৯; ইবনে কাসির : ৩/৩৪৪; তাবারি : ১/৩০০; ইবনে কায়্যিম, যাদুল মাআদ,: ২/১৭৫

[2]. ইবনু সাদ, উর্দু তরজমা আবদুল্লাহ আল-বাদি : ১/৩৩০; মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতুল মুসতাফা; ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/১৮১

[3]. তাবারি : ১/৩০০

[4]. তাবারি : ১/৩০০; ইবনুল আসির, আল-কামিল ফিত তারিখ : ২/৩৬; ইবনু কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৩/৩৪৪

[5]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ১/৩০৪, ৩০৫; ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/১৮১

[6]. সুহাইলি : ৫/৩৯০

[7]. ইবনে ইসহাক, সিরাত, বঙ্গানুবাদ, শহিদ আখন্দ : ৩/২১৭

[8]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৩/৩৪৪; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ১/৩০৫; সুহাইলি : ৫/৩৯০

[9]. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া।

শেয়ার করুন

সূচীপত্র

error: Content is protected !!