১৪. (৮) বনু সুলাইম অভিযান – Al Kudr Invasion
৮. গাজওয়া বনু সুলাইম বা কুদর অভিযান
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত গাজওয়া : ৮ |
|||||||||
|
|||||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||||
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানগণ | বনু সুলাইম ও গাতফান | ||||||||
শক্তি | |||||||||
দুইশত সৈন্যের এক বাহিনী | অজ্ঞাত | ||||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||||
কোনো হতাহত হয়নি, কোনো ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি | ৫০০ উট ফেলে রেখে যায়, যা মুসলমানগণ গনিমত হিসেবে লাভ করেন। |
পরিচিতি
গাজওয়া বনু সুলাইম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের ২৮টি গাজওয়ার মধ্যে ৮ম গাজওয়া।[1] বদর এবং উহুদ যুদ্ধের মাঝে যে কতিপয় স্বল্প পরিসরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তার একটি হলো গাজওয়া বনু সুলাইম। সুলাইম গোত্রের নামানুসারে এই গাজওয়ার নামকরণ করা হয়েছে।
বনু সুলাইম মদিনার চার মাইল পূর্বে অবস্থিত একটি গোত্র।[2] মদিনার পূর্বাঞ্চলীয় গোত্রসমূহের মধ্যে প্রধান প্রধান গোত্রগুলো ছিল গাতফান, আসাদ, সুলাইম, হাওয়াজিন, আশজা, তায়ি, কায়েস আয়লান প্রভৃতি। তন্মধ্যে বনু সুলাইম মূলত গাতফানের অন্যতম শাখাগোত্র। প্রকৃতপক্ষে মদিনার নিকটবর্তী অঞ্চল হিসেবে তার পূর্বাঞ্চলীয় গোত্রগুলো প্রথম থেকেই ইসলামের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা সত্ত্বেও ওই সকল গোত্রের প্রায় সকলে দীর্ঘকাল যাবত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ইসলাম প্রচারের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় হিজরতের পরপরই এই বিরোধিতা শুরু হয় এবং ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিক পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছোট-বড় অভিযানগুলোর একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রায় ৯০টি অভিযানের মধ্যে ২৮টিই মদিনার পূর্বাঞ্চলীয় গোত্রগুলোর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়।[3]
সিরাতের কিতাবসমূহে এই গাজওয়াকে একাধিক নামে অভিহিত করা হয়েছে। সিরাতের প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহের মধ্যে ইবনে কাসির তার আল-ফুসুল ফি সিরাতির রাসুল, মাহমুদ শাকির তার আত-তারিখুল ইসলামি, সফিউর রহমান মোবারকপুরি তার আর-রাহিকুল মাখতুম, মুহাম্মাদ রিদা তার মুহাম্মাদুর রাসুল প্রভৃতি কিতাবে বনু সুলাইম গোত্রের নামানুসারে এই গাজওয়াকে গাজওয়া বনু সুলাইম নামে অভিহিত করেছেন। তবে ইবনে সাদ তার আত-তাবাকাতে বনু সুলাইম শিরোনামে একটি গাজওয়ার বিবরণ দিয়েছেন, কিন্তু তার বর্ণিত ঘটনার সাথে প্রসিদ্ধ ও প্রকৃত ঘটনার ভিন্নতা রয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধের গাজওয়ার বিবরণস্থলে এই সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। সিরাতের অন্যান্য কিতাবে এই গাজওয়ার আরও একাধিক নাম পাওয়া যায়। যেমন,
(ক) গাজওয়া কারকারাতি আল-কুদর।[4]
(খ) গাজওয়া কুদর।[5]
আরো পড়ুন : গাজওয়া তায়েফ – Siege of Ta’if
আরো পড়ুন : গাজওয়া দুমাতুল জানাদাল – Expedition of Dumat al-Jandal
আরো পড়ুন : গাজওয়া ফাতহ মক্কা (মক্কা বিজয়) – Conquest of Mecca
মূলত ঘটনার অঞ্চল এবং স্থানের নামের ভিন্নতার কারণেই গাজওয়ার নামে এই ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু ঘটনাটি বনু সুলাইম, তদনুসারে তার নাম গাজওয়া বনু সুলাইম এবং ঘটনাস্থলের নাম কারকাতুল কুদর বা কারারাতুল কুদর অথবা শুধু কুদর, সেই অনুযায়ী গাজওয়ার নাম বিভিন্ন হয়েছে।
গাজওয়ার তারিখ
গাজওয়া বনু সুলাইমের তারিখের ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ যে মতগুলো পাওয়া যায় তা হলো,
(ক) বদরের যুদ্ধের ৭ দিন পরে ২য় হিজরিতে।[6]
(খ) ১ম শাওয়াল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের নামাজ শেষে।[7]
(গ) শাওয়ালের প্রথম দিকে।[8]
(ঘ) ১১ই মুহাররম, তৃতীয় হিজরি।[9]
(ঙ) ইবনে সাদ তার আত-তাবাকাতে উল্লেখ করেন ১৫ই মুহাররম তৃতীয় হিজরি।[10]
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ইবনে সাদ গাজওয়া বনু সুলাইম (তার শিরোনামানুসারে গাজওয়া কারকারাতিল কুদর)-কে অন্যান্য সকল ঐতিহাসিক থেকে ভিন্নভাবে গাজওয়া বনু কায়নুকা এবং গাজওয়া সাবিকের পরে উল্লেখ করেন। গাজওয়া বনু কায়নুকা সংঘটিত হয়েছিল হিজরতের ২০ মাস পর ১৫ই শাওয়াল শনিবার এবং গাজওয়া সাবিক হিজরতের ২২ মাস পর ২৫শে জিলহজ রবিবার।[11]
সুতরাং ইবনে সাদের বর্ণনা দ্বারা স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয়, গাজওয়া বনু সুলাইম বা গাজওয়া কারকারাতুল কুর, গাজওয়া বনু কায়নুকা এবং গাজওয়া সাবিকের পরে সংঘটিত হয়েছিল। তবে অন্যান্য ঐতিহাসিক এই মতের সমর্থক নয়; বরং সফিউর রহমান তার কিতাবে সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেন, বদরের যুদ্ধের পর মদিনার তথ্য বিভাগ সর্বপ্রথম যে সংবাদ সংগ্রহ করে তা হলো, বনু সুলাইম এবং গাতফান গোত্রের লোকেরা মদিনায় হামলা করার জন্য সৈন্য সমাবেশ করেছে।[12]

মানচিত্র (১৫) : বনু সুলাইমের অবস্থান স্থল
গাজওয়ার প্রেক্ষাপট
এমনিতেই দীন ইসলামের আবির্ভাবই যেন বজ্ররূপে পতিত হয়েছিল পথভ্রষ্ট, ধর্মভ্রান্ত, মূর্তিপূজারী, মুশরিক, অন্ধ ও সত্য বিবর্জিত আরব জনগোষ্ঠীর উপর। তার উপর আবার এই সত্য দীনের ক্রমবর্ধমান উন্নতি দেখে হিংসায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল গোটা আরব। প্রতিরোধ স্পৃহায় মেতে এই দীনকে সমূলে ধ্বংস করার পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে একবার তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তখন আল্লাহ তায়ালা মদিনায় হিজরতের পথ উন্মোচন করেছে। মদিনা হিজরত সত্য দীনের উন্নতির ধারাকে আরও বেগবান করলে মক্কাবাসী হিংসুকদের অন্তর্জ্বালা অদম্য হয়ে ওঠে। ফলে তারা বদর যুদ্ধের পরিকল্পনা হাতে নেয়, উদ্যত হয় ইসলাম ও মুসলিমদের ধুলায় লুটিয়ে দিতে। সৈন্য, শক্তি ও সরঞ্জামের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও এই যাত্রায়ও তারা কোনো সুফল লাভ করতে পারেনি; বরং পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বিমূঢ় হয়ে ছিটকে পড়তে বাধ্য হয়েছিল শক্তির দম্ভে উদ্ভ্রান্ত আরব জাতি। জনবল ও সম্পদ হারানোর পরিণাম নিয়ে প্রত্যেকে নিজ ভূমিতে পালিয়ে কোনো রকমে জান বাঁচাতে চেষ্টা করল। কিন্তু এই পরাজয়ও তাদের দমিয়ে সত্য দীনের প্রতি অবনমিত করাতে পারেনি। ক্ষোভে-জেদে উত্তেজিত হয়ে মুশরিক-ইহুদি সমবেতভাবে এক প্রতিশোধ স্পৃহায় অস্থির হয়ে উঠেছিল। এই সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন,
لَتَجِدَنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَدَاوَةً لِلَّذِينَ آمَنُوا الْيَهُودَ وَالَّذِينَ أَشْرَكُوا
‘অবশ্য মুমিনদের প্রতি শত্রুতায় মানুষের মধ্যে ইহুদি ও মুশরিকদেরই তুমি সর্বাধিক উগ্র দেখবে।’[13]
এক্ষেত্রে মক্কার মুশরিকরা হলো বদরের যুদ্ধে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত, ইহুদিরা ছিল নিজেদের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কাগ্রস্ত।[14] এটি ছাড়া বনু সুলাইম এবং গাতফানসহ কতিপয় অঞ্চল ছিল মক্কায় বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার স্বীকার। এরা মক্কাকেন্দ্রিক ব্যবসা দ্বারা উপকৃত হতো।[15] তারা প্রতিশোধ গ্রহণের হুমকি দিতে লাগল এবং হুমকির পাশাপাশি যুদ্ধ প্রস্তুতিও শুরু করল।
এমন এক পরিস্থিতিতে সর্বপ্রথম যে সংবাদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছাল তা হলো, প্রতিশ্রুতিবদ্ধভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বনু সুলাইম ও গাতাফানের কুদর নামক স্থানে সমবেত হওয়া। এই সংবাদের ভিত্তিতে তাদের হামলার পূর্বেই হামলা করে তাদের সূচনাতেই দমিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গাজওয়া বনু সুলাইমের কর্মসূচি হাতে নেন।[16]
ঘটনাস্থল
অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে গাজওয়া বনু সুলাইম সংঘটিত হয়েছিল মদিনার পূর্ববর্তী অঞ্চলসমূহের অন্তর্গত বনু সুলাইম এলাকার কুদর নামক একটি স্থানে। কুদর (কাফ বর্ণটি পেশবিশিষ্ট) প্রকৃতপক্ষে ধুসর রঙের একটি পাখি। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বনু সুলাইম গোত্রের একটি রূপকে বুঝানো হয়েছে। মক্কা থেকে সিরিয়া যাওয়ার বাণিজ্যিক পথে তা অবস্থিত।[17] স্থানটিকে কুদর বলা হয় এজন্য যে, কথিত আছে, সেখানে ওই পাখির বসবাস ছিল, সেই নামেই স্থানটির নামকরণ করা হয়েছে।[18]
আরো পড়ুন : গাজওয়া উহুদ – Battle of Uhud
আরো পড়ুন : গাজওয়া ওয়াদিল কুরা – Third Expedition of Wadi al Qura
আরো পড়ুন : গাজওয়া খায়বার – Battle of Khaybar
এটি ছাড়া নির্ভরযোগ্য অন্যান্য সব বর্ণনার মধ্যে ঘটনাস্থলের নাম কারকারাতুল কুর বা কারারাতুল কুদর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারকারাতুল কুর-এর বর্ণনা প্রসঙ্গে ওয়াকিদি রহ. বলেন, ‘তা মাদানে বনু সুলাইম-এর দিকের আরহাদিয়া নামক স্থানের নিকটবর্তী একটি স্থান, মদিনা এবং তার মধ্যে প্রায় ৯৬ মাইলের দূরত্ব।’[19] কেউ কেউ সেটাকে বিরে মাউনা-এর নিকটবর্তী স্থান বলেও উল্লেখ করেন।[20]
গাজওয়ার বিবরণ
অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতানুসারে বদর যুদ্ধের অব্যবহিত পরই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনায় ফিরে আসার পর মাত্র সাত দিন অতিবাহিত হয়েছে, এমতাবস্থায় সংবাদ এলো, বনু সুলাইম এবং গাতফান গোত্র মুসলমানদের উপর আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে কুর নামক স্থানে সমবেত হয়েছে। তাদের ষড়যন্ত্রকে সূচনাতেই প্রতিহত করার নিমিত্তে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুইশত সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে মদিনা থেকে বনু সুলাইম অভিমুখে রওনা হন। এ সময় তিনি মদিনার দায়িত্বে সিবা ইবনে উরফুতা রাযিয়াল্লাহু আনহু, মতান্তরে আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে রেখে যান। কারো মতে সিবা ইবনে উরফুতা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে রাষ্ট্রের সাধারণ কাজের এবং ইবনে উম্মে মাকতুম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ইমামতির দায়িত্বে রেখে যান।[21] এই অভিযানে আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে পতাকা ছিল এবং পতাকার রং ছিল সাদা।[22]
যাত্রার একপর্যায়ে তিনি বনু সুলাইমের কুদর নামক স্থানে পৌঁছালেন। স্থানটি একটি সমতল ভূমি। ওয়াকিদি রহ. বলেন, ‘সেখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটের এবং উট চলাচলের চিহ্ন পেলেন, কিন্তু ঘটনাস্থলে কাউকেও পেলেন না।’[23] মাহমুদ শাকির বলেন, ‘শত্রুরা অতর্কিত হামলার কথা বুঝতে পেরে পালিয়ে গেল। কারণ তারা এই আকস্মিক হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। যাওয়ার সময় তারা উপত্যকার মাঝে ৫০০ উট রেখে যায়, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গনিমত হিসেবে লাভ করেন।’[24] অপর বর্ণনায় ইবনে খালদুন তার আত-তারিখে বলেন, বনু সুলাইমের লোকজনকে ঘটনাস্থলে না পেয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গালিব ইবনে আবদুল্লাহ আল-লায়সির নেতৃত্বে একটি সারিয়্যা পাঠান। উক্ত সারিয়্যা শত্রুদের পরিত্যক্ত বহুসংখ্যক উট গনিমত হিসেবে লাভ করে নিয়ে আসে। ওই গনিমতের মালের মধ্যে ইয়াসার নামক একটি গোলামও ছিল।[25] ইবনে সাদ এবং ওয়াকিদির বর্ণনায় গনিমত লাভের প্রসঙ্গটি এভাবে বলা হয়েছে, যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাউকে পেলেন না, তখন কয়েকজন সাহাবিকে উপত্যকার ঊর্ধ্বদিকে পাঠালেন এবং তিনি স্বয়ং তাদের প্রতি লক্ষ রেখে উপত্যকার মধ্যভাগ পর্যন্ত অগ্রসর হলেন। সেখানে তিনি কিছু রাখালকে পেলেন, যাদের মধ্যে একটি ছেলের নাম ছিল ইয়াসার। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিকট লোকজন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে ইয়াসার বলল, ‘তাদের সম্পর্কে আমার জানা নেই, আমরা উট চরানোর জন্য বিদেশি রাখাল মাত্র।’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটগুলো গ্রহণ করে ফিরে এলেন।[26]
অধিকাংশ সিরাতের কিতাবে এই অভিযানে কোনো যুদ্ধ সংঘটিত না হওয়ার কথা বলা হলেও ইবনুল আসির উল্লেখ করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুদর নামক স্থানে পৌঁছিয়ে গালিব ইবনে আবদুল্লাহর নেতৃত্বে যে সারিয়্যাটি বনু সুলাইম ও গাতফানের বিরুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং তাতে তিনজন মুসলমান শহিদ হন।’[27] অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু সুলাইমে তিন দিন অবস্থান করলেন, কারো মতে দশ দিন।[28] অতঃপর তিনি গনিমতের মালসহ মদিনা অভিমুখে রওনা হলেন। যখন তিনি মদিনা থেকে তিন মাইল দূরবর্তী সিরার নামক স্থানে পৌঁছালেন, তখন গনিমতের মাল বণ্টন করলেন। ইবনে সাদ রহ. বলেন, ‘যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিরার নামক স্থানে পৌঁছালেন, তখন সৈন্যরা বললেন, “এই উটগুলো একসাথে চালিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য খুব কঠিন হচ্ছে। যদি প্রত্যেকের অংশ তাকে দিয়ে দেওয়া হয়, তবে তা চালিয়ে যাওয়া সকলের জন্য সহজ হবে।” তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক-পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকি চার-পঞ্চমাংশ সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। তাতে প্রত্যেকেই দুটি করে উট পেয়েছিলেন। যেহেতু মোট উটের সংখ্যা ছিল পাঁচশত। ওয়াকিদির বর্ণনায় উটের সংখ্যা অনেক বেশি। তার বর্ণনামতে প্রত্যেক ব্যক্তি ৭টি করে উট পেয়েছিল।’[29] গনিমতের মধ্যে ইয়াসার নামক যে গোলামটি ছিল, সে নামাজি হওয়ায় সাহাবিরা তাকে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক গ্রহণ করার জন্য আবেদন জানালে তিনি তাকে গ্রহণ করে আজাদ করে দিলেন।[30] অবশেষে মদিনা থেকে বের হওয়ার পর পনেরো দিন অতিবাহিত করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় ফিরে আসেন।
গাজওয়া বনু সুলাইম সম্পর্কে প্রায় সকল ঐতিহাসিক উপরিউক্ত ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু ইবনে সাদ তার তাবাকাতে গাজওয়া বনু সুলাইম শিরোনামে যে ঘটনার বিবরণ উল্লেখ করেন, তা উপরিউক্ত গাজওয়া বনু সুলাইমের ঘটনার বিবরণ নয়; বরং তার ‘গাজওয়া বনু সুলাইম’ শিরোনামে বর্ণিত ঘটনাটি অন্যান্য ঐতিহাসিক ‘গাজওয়া বুহরান’ শিরোনামে বর্ণনা করেন, যা একটি ভিন্ন গাজওয়া এবং তা ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ১২তম গাজওয়া।[31] অর্থাৎ ইবনে সাদ ‘গাজওয়া বনু সুলাইম’ শিরোনাম দিয়ে উল্লেখ করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গাজওয়া বনু সুলাইম ২৪শে জুমাদাল উলা ‘বুহরান’ নামক স্থানে সংঘটিত হয়। এটির কারণ ছিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত স্থানে সুলাইম গোত্রের লোকদের একত্র হওয়ার সংবাদ পেয়েছিলেন। ফলে তিনি তিনশত সৈন্য নিয়ে ইবনে উম্মে মাকতুম রহ.-কে প্রতিনিধি হিসেবে রেখে মদিনা থেকে বের হয়ে পড়লেন।[32] অপরদিকে অন্যান্য ঐতিহাসিকের বর্ণনানুযায়ী, ‘গাজওয়া বনু সুলাইম’ শিরোনামের বক্ষ্যমাণ আলোচনাকে ইবনে সাদ ‘গাজওয়া কারকারাতিল কুদর’ নামে আলোচনা করেন।[33]
এমতাবস্থায় উভয় বর্ণনার সামঞ্জস্য বিধানে আমরা এই কথা বলতে পারি, গাজওয়া বনু সুলাইম সম্পর্কে প্রায় সকল ঐতিহাসিক উপরিউক্ত বর্ণনা দিলেও ইবনে সাদ তার আত-তাবাকাতে গাজওয়া বনু সুলাইম শিরোনামে যে গাজওয়ার বিবরণ দিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ঘটনার বিবরণ। অর্থাৎ তিনি গাজওয়া বনু সুলাইমের বর্ণনায় উল্লেখ করেন, তা ২৪শে জুমাদাল উলা বুহরান নামক স্থানে সংঘটিত হয়। ইবনে সাদ বর্ণিত গাজওয়া বনু সুলাইম-এর এই বর্ণনা অন্যান্য সিরাতের কিতাবে ‘গাজওয়া বুহরান’ শিরোনামে উল্লিখিত হয়েছে। অবশ্য অধিকাংশ ঐতিহাসিকের বর্ণিত গাজওয়া বনু সুলাইম এবং ইবনে সাদের বর্ণিত গাজওয়া বনু সুলাইম একই নামের হলেও মূলত পৃথক দুটি গাজওয়া। দুটি পৃথক স্থানে সংঘটিত হওয়ার কারণে কেউ গাজওয়ার নামকরণে স্থানের নামের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। এই হিসেবে গাজওয়া দুটির শিরোনামে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়; গাজওয়া কারকারাতিল কুদর এবং গাজওয়া বুহরান। কিন্তু স্থান দুটি একই অঞ্চল অর্থাৎ বনু সুলাইম অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার কারণে এতদুভয়ের নামকরণে অঞ্চলের নামের অনুসরণ করাতেও কোনো ত্রুটি নেই বিধায় উভয় গাজওয়াই গাজওয়া বনু সুলাইম শিরোনামে আখ্যায়িত হতে পারে। এজন্যই ঐতিহাসিক ভেদে উভয় গাজওয়াই গাজওয়া বনু সুলাইম নামে আখ্যায়িত হয়েছে। তবে এই কথা সত্য, অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে গাজওয়া কুদর বা গাজওয়া কারকারাতুল কুদরই গাজওয়া বনু সুলাইম নামে প্রসিদ্ধ।
আরো পড়ুন : গাওয়া খন্দক আহজাব – Battle of the Trench
আরো পড়ুন : গাওয়া তাবুক – Battle of Tabouk
আরো পড়ুন : গাজওয়া আস-সাবিক – Invasion of Sawiq
গাজওয়ার ফলাফল
গাজওয়া বনু সুলাইম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গাজওয়াসমূহের মধ্যে অত্যন্ত স্বল্প পরিসরের একটি গাজওয়া। এই গাজওয়ায় পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে, মুসলমান এবং কাফের সৈন্যদের মাঝে কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। কেবল গালিব ইবনে আবদুল্লাহর নেতৃত্বে পাঠানো সারিয়্যার ব্যাপারে কিছুটা সংঘর্ষের কথা জানা যায়। তারা পালিয়ে যাওয়ায় মুসলিমগণ বিপুল পরিমাণে গনিমত পেয়ে আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হন। তা ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপে মদিনা দুশমনদের হাত থেকে রক্ষা পায়। তবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই আকস্মিক হামলায় কাফেররা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলেও বদর যুদ্ধের কারণে তাদের অন্তরে যে জ্বালা আর হয়েছিল তা প্রশমিত হতে পারেনি; বরং সেই সঞ্চিত জ্বালারই প্রকাশ পরবর্তী সময়ে বহু যুদ্ধে ঘটেছিল।
তথ্যসূত্র
[1]. মুহাম্মাদ ইয়াসিন মাজহার সিদ্দিকি, রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সরকার কাঠামো : ১৫৩
[2]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৩৭
[3]. মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সরকার কাঠামো : ৬০
[4]. ইবনুল আসির, আল-কামিল ফিত-তারিখ : ২/৩৫; ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ২/৩১
[5]. ইবনে খালদুন, আত-তারিখ : ২/২২; ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/১৮২
[6]. ইবনে কাসির, আল-ফুসুল ফি সিরাতির রাসুল : ২/১৪০
[7]. জুরকানি, শরহুল মাওয়াহিবুল-লাদুন্নিয়া : ১/৩৪২
[8]. প্রাগুক্ত
[9]. ইমাম শিহাবুদ্দিন, মুজামুল বুলদান : ৫/৪৪২
[10]. আত-তাবাকাত, ২/৩১
[11]. আত-তাবাকাত : ২/৩১
[12]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৬০
[13]. সুরা মায়েদা : ৮২
[14]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৩৭
[15]. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী বিশ্বকোষ : ৪২৫
[16]. ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১৮২; অনুরূপ বর্ণনার জন্য আরও দ্রষ্টব্য আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৬০; আত-তাবাকাত : ২৬৫; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৩/৪১৪
[17]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৩৮
[18]. মুহাম্মাদ আলি, সিরাতে মুহাম্মাদিয়া।
[19]. ইমাম শিহাবুদ্দীন, মুজামুল বুলদান : ৫/৪৪২
[20]. প্রাগুক্ত : ১/১৪৪
[21]. মুহাম্মাদ বিদা, মুহাম্মাদুর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ২২১; অনুরূপ বর্ণনার জন্য আরও কিতাবুল মাগাজি : ১/১৮৪; আত-তারিখুল ইসলামি : ২/২২৮
[22]. মুহাম্মাদুর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আল-মাওয়াহিব-এর উর্দু অনুবাদ।
[23]. মাগাজি : ১/১৮২
[24]. আত-তারিখুল ইসলামি : ২৩/২১৮
[25]. ইবনে খালদুন, আত-তারিখ : ২/২২
[26]. আত-তাবাকাত, মাগাজি, প্রাগুক্ত।
[27]. আল-কামিল ফিত-তারিখ : ২/৩৫
[28]. সিরাতে মুহাম্মাদিয়া : ১/৩৪২
[29]. আল-মাগাজি : খ/১৮৩
[30]. আত-তাবাকাত : ২/২৬৬
[31]. রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সরকার কাঠামো : ১৫৩
[32]. ইবনু সাদ, আত-তাবাকাত : ২/৩৫
[33]. আত-তাবাকাত : ২/৩১