১৫. (৭) কাব ইবনুল আশরাফ হত্যা অভিযান – Killing of Ka’b ibn al-Ashraf
৭. সারিয়্যা মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বা মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামার অভিযান
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কর্তৃক প্রেরিত সারিয়্যা : ৭ |
|||||||
|
|||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু | কাব ইবনুল আশরাফ | ||||||
শক্তি | |||||||
৪ জন | ১ জন | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। | কাব ইবনুল আশরাফকে হত্যা করা হয়। |
পরিচয়
কাব ইবনুল আশরাফ ছিল বনু নাজির গোত্রের প্রসিদ্ধ ইহুদি কবি। তার পিতা আশরাফ ছিল আরবের তাই গোত্রের উপশাখা বনু নাহবানের সদস্য। জাহিলি যুগে সে মদিনায় এসে বনু নাজির গোত্রের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে। সে নিজ যোগ্যতায় তাদের বিশ্বাসভাজন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং ইহুদি নেতা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবু রাফে ইবনে আবুল কায়ক-এর কন্যাকে বিবাহ করে। কাব এই কন্যারই গর্ভজাত সন্তান।[1]
কাব-এর পিতৃকুল আরব এবং মাতৃকুল ইহুদি হওয়ায় উভয় সম্প্রদায়ের সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। অনন্য কাব্য প্রতিভার সুবাদে সকল গোত্রের উপর, বিশেষত নিজ কওমের উপর ছিল তার যথেষ্ট প্রভাব।[2]
কবি হিসেবে আরবে তার বিশেষ খ্যাতি ছিল। সে ‘ফাহলুন ফাসিহি’ (অলঙ্কার ও মার্জিতভাষী) উপাধিতে ভূষিত ছিল।[3] উপরন্তু অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি হওয়ার কারণে সে ইহুদিদের উপর এক প্রভাব বিস্তার করে। সে ছিল বেশ লম্বা ও বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী।[4] মদিনার দক্ষিণে বনু নাজির গোত্রের আবাস ভূমির পশ্চাতে তার দুর্গ অবস্থিত ছিল।[5]
আরো পড়ুন : ইহুদি নেতা আবু রাফে-এর হত্যা অভিযান – Killing of Abu Rafi’
আরো পড়ুন : কাব ইবনুল আশরাফ হত্যা অভিযান – Killing of Ka’b ibn al-Ashraf
আরো পড়ুন : খাররার অভিযান – Expedition of al-Kharrar
কাব ইবনুল আশরাফ দীন ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি তীব্র শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করত। সে প্রকাশ্যে সর্বদা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত থাকত। সে ইহুদি ধর্মগুরুদের আর্থিক সাহায্য প্রদান করত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনায় হিজরতের পর কোনো ইহুদি পণ্ডিত তার বিরুদ্ধাচরণ না করলে সে তার আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দিত।[6]
বদরযুদ্ধে কুরাইশদের পরাজয়ে কাব-এর প্রতিক্রিয়া
বদরযুদ্ধে (২য় হিজরি) মুসলমানদের বিজয় এবং কুরাইশদের পরাজয়ের সংবাদ নিয়ে যায় জায়েদ ইবনে হারিসা রাযিয়াল্লাহু আনহু মদিনার নিম্নভূমির লোকদের নিকট এবং আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাযিয়াল্লাহু আনহু উচ্চ ভূমির লোকদের নিকট আগমন করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার মুসলমানদের কাছে বিজয় বার্তা এবং মুশরিক নৈতৃবৃন্দের নিহত হওয়ার সংবাদ প্রেরণ করলেন।[7] কুরাইশদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিহত হওয়ার খবর শুনে কাব আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, ‘সত্যিই কি এমনটা ঘটেছে? এরা তো আরবের সম্ভ্রান্ত লোক এবং জনগণের রাজা। আল্লাহর শপথ! যদি সত্যিই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে হত্যা করে থাকে, তবে পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগ তার উপরিভাগ থেকে উত্তম।’[8] কাব যখন নিশ্চিত হলো, বদরযুদ্ধে কুরাইশদের শোচনীয় পরাজয় ও নেতৃবৰ্গের নিহত হওয়ার সংবাদ সত্য, তখন সে ক্ষোভে, দুঃখে ও বিদ্বেষে ফেটে পড়ল। সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের ভর্ৎসনা ও নিন্দা করতে এবং ইসলামের শত্রুপক্ষের প্রশংসা ও তাদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে লাগল। সে তার তৎপরতার অংশ হিসেবে মক্কায় গমন করে আবদুল মুত্তালিব ইবনে আবি ওয়াদাআর গৃহে উঠল, তার স্ত্রী আতিকা বিনতে আবু আয়াস ইবনে উমাইয়া কাবের যথেষ্ট সেবা-যত্ন ও সমাদর করল। অতঃপর সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে কুরাইশদের প্ররোচিত করতে লাগল। সে বদরযুদ্ধে নিহত কুরাইশ নেতাদের সম্পর্কে শোকগাথা রচনা করে তাদের শোকাভিভূত আত্মীয়-স্বজনদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উত্তেজিত করে তুলল।[9] বদরে নিহত কুরাইশ সর্দারদের এবং পর্বতের গুহায় নিক্ষিপ্ত তাদের লাশসমূহ সম্পর্কে তার রচিত শোকগাথার কিছু অংশ নিম্নরূপ—
طَحَنَتْ رَحَى بَدْرٍ لِمَهْلِكِ أَهْلِهِ … وَلِمِثْلِ بَدْرٍ تَسْتَهِلُّ وَتَدْمَعُ
قُتِلَتْ سَرَاةُ النَّاسِ حَوْلَ حِيَاضِهِمْ … لَا تَبْعَدُوا إنَّ الْمُلُوكَ تُصَرَّعُ
كَمْ قَدْ أُصِيبَ بِهِ مِنْ أَبْيَضَ مَاجِدٍ … ذِي بَهْجَةٍ يَأْوِي إلَيْهِ الضُّيَّعُ
طَلْقُ الْيَدَيْنِ إذَا الْكَوَاكِبُ أَخْلَفَتْ … حَمَّالُ أَثْقَالٍ يَسُودُ وَيَرْبَعُ
وَيَقُولُ أَقْوَامٌ أُسَرُّ بِسَخَطِهِمْ … إنَّ ابْنَ الْأَشْرَفِ ظَلَّ كَعْبًا يَجْزَعُ
صَدَقُوا فَلَيْتَ الْأَرْضُ سَاعَةَ قُتِّلُوا … ظَلَّتْ تَسُوخُ بِأَهْلِهَا وَتُصَدَّعُ
صَارَ الَّذِي أَثَرَ الْحَدِيثَ بِطَعْنِهِ … أَوْ عَاشَ أَعْمَى مُرْعَشًا لَا يَسْمَعُ
نُبِّئْتُ أَنَّ بَنِي الْمُغِيرَةِ كُلَّهُمْ … خَشَعُوا لِقَتْلِ أَبِي الْحَكِيمِ وَجُدِّعُوا
وَابْنَا رَبِيعَةَ عِنْدَهُ وَمُنَبِّهٌ … مَا نَالَ مِثْلَ الْمُهْلِكِينَ وَتُبَّعُ
نُبِّئْتُ أَنَّ الْحَارِثَ بْنَ هِشَامِهِمْ … فِي النَّاسِ يَبْنِي الصَّالِحَاتِ وَيَجْمَعُ
لِيَزُورَ يَثْرِبَ بِالْجُمُوعِ وَإِنَّمَا … يَحْمَى عَلَى الْحَسَبِ الْكَرِيمُ الْأَرْوَعُ
‘বদরের যাতা আপন লোকদেরকে পিষে মারল। বদরের অনুরূপ ঘটনায় চক্ষুগুলো অশ্রু ঝরায় এবং ঝরতে থাকে।
জনগণের নেতৃবৃন্দ নিজেদেরই হাওজের পাশে নিহত হলো। তবে এটি অস্বাভাবিক কিছু মনে কোরো না, কারণ বাদশাহগণও পরাজিত হয়ে থাকে।
কত শান্ত, শুভ্র চেহারাবিশিষ্ট ও জাঁকজমকপূর্ণ ব্যক্তিরা বিপদগ্রস্ত হয়েছে, যাদের কাছে নিঃস্ব লোক আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে।
অনাবৃষ্টির সময় (দুর্ভিক্ষে) দুই হাতে দানকারী অন্যের বোঝা নিজের মাথায় বহনকারী সর্দার, যারা খাজনা আদায় করে থাকে।
জাতির লোকেরা বলে, তাদের ক্ষোভে আমি সন্তুষ্ট হই (এটি মোটেই ঠিক নয়, বরং) কাব ইবনে আশরাফ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে।
তারা সত্যই বলেছে, কিন্তু যখন তারা নিহত হয়েছিল, তখন জমিন যদি তার লোকদের ধ্বসিয়ে দিত এবং টুকরা টুকরা হয়ে যেতো, তাহলে কতই-না উত্তম হতো!
এই কথা সে প্রচার করেছে, হায়, যদি সে-ই বর্শার লক্ষ্যবস্তু হয়ে যেত কিংবা অন্ধ হয়ে বেঁচে থাকত অথবা বধির হয়ে যেত, কিছুই শুনতে না পেত, কতই-না ভালো হতো।
খবর পেয়েছি, আবুল হাকামের নিহত হওয়ার কারণে গোটা মুগিরা বংশের নাক কাটা গেছে এবং তারা অপদস্থ ও লাঞ্ছিত হয়েছে।
আর রবিআর দুই পুত্রও তার নিকট চলে গেছে, আর মুনাব্বিহও।
আরো পড়ুন : আল-আবওয়া অভিযান – Patrol of Wa ddan (al-Abwa)
আরো পড়ুন : আল-উশাইরা অভিযান – Patrol of Zul Al-Ushairah
আরো পড়ুন : আসমা বিনতে মারওয়ান হত্যা – Killing of Asma Bint Marwan
এই নিহত ব্যক্তিরা ছিল এমন যে, কেউ তাদের মতো (মর্যাদা ও গুণ) অর্জন করতে পারেনি, আর না (ইয়ামানের বাদশাহ) তুব্বাও। শুনলাম, তাদের মধ্যকার হারেস ইবনে হিশাম জনতার মধ্যে সকর্ম করেছে এবং লোকদের একত্র করেছে, সৈন্যদল নিয়ে ইয়াসরিবের (মদিনা) মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে। সত্য কথা এই যে, অভিজাত মহৎ লোকেরাই পিতৃপুরুষের মর্যাদা রক্ষা করে থাকে।’[10]
ইবনে ইসহাক বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সভাকবি হাসসান ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু কাবের কবিতার জবাবে নিম্নোক্ত কবিতা রচনা করেন,
أَبَكَى لِكَعْبٍ ثُمَّ عُلَّ بِعَبْرَةٍ … مِنْهُ وَعَاشَ مُجَدَّعًا لَا يَسْمَعُ؟
وَلَقَدْ رَأَيْتُ بِبَطْنِ بَدْرٍ مِنْهُمْ … قَتْلَى تَسُحُّ لَهَا الْعُيُونُ وَتَدْمَعُ
فَابْكِي فَقَدْ أَبَكَيْتَ عَبْدًا رَاضِعًا … شِبْهَ الْكُلَيْبِ إلَى الْكُلَيْبَةِ يَتْبَعُ
وَلَقَدْ شَفَى الرَّحْمَنُ مِنَّا سَيِّدًا … وَأَهَانَ قَوْمًا قَاتَلُوهُ وَصُرِّعُوا
وَنَجَا وَأُفْلِتَ مِنْهُمْ مَنْ قَلْبُهُ … شَغَفٌ يَظَلُّ لِخَوْفِهِ يَتَصَدَّعُ
‘কাব তার শোকগাথা পাঠ করেছে। এটির পরও তাকে আবার অশ্রু ঝরাতে হয়েছে এবং সে এমন লাঞ্ছিত জীবন অতিবাহিত করে, সে কিছুই শোনেনি।
আমি বদরের নিম্নভূমিতে তাদের নিহতদের দেখেছি, যাদের জন্য চক্ষু ক্রন্দন করছে এবং অশ্রুধারা ঝরছে।
তুমি তো ইতর গোলামদের অনেক কাঁদালে, এবার তুমি নিজেই কাঁদো, যেমন ছোট কুকুর ছোট কুকুরনির জন্য চিৎকার করে ডাকে।
দয়াময় আল্লাহ আমাদের নেতৃবৃন্দের হৃদয় শান্ত করে দিয়েছেন, আর যারা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদের লাঞ্ছিত করেন এবং তারা পরাজিত হয়েছে।
তাদের মধ্যে যে বেঁচে পালিয়ে গেছে, তার অন্তর দগ্ধিভূত ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বিদীর্ণ হচ্ছে।’[11]
ইবনে হিশাম বলেন, ‘অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ এই কবিতাগুলো হাসসান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নয় বলে মন্তব্য করেন।’[12]
ইবনে ইসহাক বলেন, ‘বনু বালির শাখা বনু মুরাদ-এর মাইমুনা বিনতে আবদুল্লাহ নামী এক মুসলিম নারী কাবের কবিতার জবাবে নিম্নোক্ত কবিতা রচনা করেন,
تَحَنَّنَ هَذَا الْعَبْدُ كُلَّ تَحَنُّنٍ … يُبَكَّى عَلَى قَتْلَى وَلَيْسَ بِنَاصِبِ
بَكَتْ عَيْنُ مَنْ يَبْكِي لِبَدْرٍ وَأَهْلُهُ … وَعُلَّتْ بِمِثْلِيِّهَا لُؤَيُّ بْنُ غَالِبِ
فَلَيْتَ الَّذِينَ ضُرِّجُوا بِدِمَائِهِمْ … يَرَى مَا بِهِمْ مَنْ كَانَ بَيْنَ الْأَخَاشِبِ
فَيَعْلَمُ حَقًّا عَنْ يَقِينٍ وَيُبْصِرُوا … مَجَرَّهُمْ فَوْقَ اللِّحَى وَالْحَوَاجِبِ
‘এই গোলাম নিহতদের উদ্দেশ্যে প্রদর্শনীমূলক বিলাপ করেছে এবং অন্যদেরও কাঁদিয়েছে, আসলে সে মোটেই চিন্তিত ও দুঃখিত নয়। বদর ও বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের যাদের জন্য সে কাঁদছে, তাদের চক্ষু তো কাঁদছে, কিন্তু লুওয়াই ইবনে গালিবদের তাদের অশ্রুর দ্বিগুণ দান করানো হয়েছে।
হায়! যারা স্বীয় রক্তে রঞ্জিত হয়েছে, মক্কার দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী লোকেরা যদি তাদের দুরবস্থা দেখতে পেত, তা হলে তারা নিশ্চিতভাবে জানতে সক্ষম হতো এবং তারা তাদের অধঃমুখে উপুড় অবস্থায় দেখতে পেত।’[13]
অবশ্য অনেকেই এই কবিতাগুলো কাবের উদ্দেশ্যে এবং মাইমুনার রচিত নয় বলে অভিমত প্রকাশ করেন।[14]
কাব ইবনে আশরাফ মাইমুনার কবিতার উত্তরে যে কবিতা রচনা করে তার সারমর্ম নিম্নরূপ :
أَلَا فَازْجُرُوا مِنْكُمْ سَفِيهًا لِتَسْلَمُوا … عَنْ الْقَوْلِ يَأْتِي مِنْهُ غَيْرَ مُقَارِبِ
أَتَشْتُمُنِي أَنْ كُنْتُ أَبْكِي بِعَبْرَةٍ … لِقَوْمٍ أَتَانِي وُدُّهُمْ غَيْرَ كَاذِبِ
فَإِنِّي لَبَاكٍ مَا بَقِيتُ وَذَاكِرٌ … مَآثِرَ قَوْمٍ مَجْدُهُمْ بِالْجَبَاجِبِ
لَعَمْرِي لَقَدْ كَانَتْ مُرَيْدٌ بِمَعْزِلٍ … عَنْ الشَّرِّ فَاحْتَالَتْ وُجُوهَ الثَّعَالِبِ
فَحُقَّ مُرَيْدٌ أَنْ تُجَدَّ أُنُوفُهُمْ … بِشَتْمِهِمْ حَيِيِّ لُؤَيِّ بْنِ غَالِبِ
وَهَبْتُ نَصِيبِي مِنْ مُرَيْدٍ لِجَعْدَرٍ … وَفَاءً وَبَيْتُ اللَّهِ بَيْنَ الْأَخَاشِبِ
‘শোনো! আপন নির্বোধদের তিরস্কার করো, যাতে এমন সকল উক্তি থেকে বাঁচতে পারো—যা অসঙ্গত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সে কি আমাকে এজন্য তিরস্কার করেছে যে, আমি ওই সম্প্রদায়ের জন্য অশ্রু বিসর্জন দিয়েছি, যাদের প্রতি আমার ভালোবাসা কৃত্রিম নয়। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন কাঁদবই এবং তাদের গুণাবলি স্মরণ করবই, যাদের শান-শওকত মার প্রতিটি স্থানে সুস্পষ্ট।’[15]
এমনিভাবে একের পর এক কাব্য রচনার মাধ্যমে কাব কুরাইশদের বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য উত্তেজিত করে। আবু সুফিয়ান ও মুশরিকরা তাকে মক্কায় অবস্থানকালে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নিকট আমাদের ধর্ম বেশি পছন্দনীয়, না মুহাম্মাদ ও তার সাথিদের ধর্ম?’ কাব বলল, ‘তোমরাই তাদের চাইতে অধিক হেদায়েতপ্রাপ্ত এবং উত্তম।’[16] এই ব্যাপারেই আল্লাহ তায়ালা নিম্নের আয়াত নাজিল করেন,[17]
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُونَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوتِ وَيَقُولُونَ لِلَّذِينَ كَفَرُوا هَؤُلَاءِ أَهْدَى مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا سَبِيلًا
‘তুমি কি তাদের দেখোনি যাদের কিতাবের এক অংশ দেওয়া হয়েছিল, তারা জিব্ত ও তাগুতে বিশ্বাস করে। তারা কাফেরদের সম্বন্ধে বলে, এদেরই পথ মুমিনদের অপেক্ষা প্রকৃষ্টতর।’[18]
ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘অত্র আয়াতে জিব্ত ও তাগুত বলতে কাব ইবনে আশরাফ ও হুয়াই ইবনে আখতাবকে বুঝানো হয়েছে।’[19]
কাব-এর প্ররোচনায় আবু সুফিয়ান হারাম শরিফের পর্দা ধরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করার প্রতিজ্ঞা করল।[20] অন্য বর্ণনামতে, মক্কার চল্লিশজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের নিকট গিয়ে বদরের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তাকে উত্তেজিত করে তুললে আবু সুফিয়ান সকলকে নিয়ে হারাম শরিফে এসে কাবা ঘরের পর্দা ধরে বদরের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রতিজ্ঞা করল। এমনকি তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গুপ্তহত্যা করারও সংকল্প করল।[21]
এরপর কাব ইবনে আশরাফ মদিনায় প্রত্যাবর্তন করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করতে লাগল এবং লোকদের তার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলতে শুরু করল। আবু দাউদের বর্ণনা,
وكان كعْب بن الأشرفِ يَهجُو النبىَّ – صلَّى الله عليه وسلم – ويُحرَّضُ عليه كفارَ قريشٍ.[22]
‘সে মুসলিম নারীদের দুর্নাম করে অত্যন্ত আপত্তিজনক কবিতা রচনা করতে লাগল এবং তাদের ভীষণভাবে কষ্ট দিতে শুরু করল।’[23]
আরো পড়ুন : বুওয়াত অভিযান – Patrol of Buwat
আরো পড়ুন : আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার অভিযান – Expedition Abdullah ibn Rawaha
আরো পড়ুন : আবু আফাক হত্যা – Killing of Abu Afak
A Guillaume এই সম্পর্কে বলেন, Then he composed amatory verses of insulting nature about the Muslim women.[24]
আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের ধৈর্যধারণের উপদেশ দিলেন এবং ইহুদিদের সম্বন্ধে নিম্নের আয়াত নাজিল করেন :[25]
وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا أَذًى كَثِيرًا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
‘তোমাদের পূর্বে যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছিল তাদের এবং মুশরিকদের নিকট থেকে তোমরা অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে।’[26]
ইমাম জুহরি বলেন, ‘এই আয়াতে (وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا) দ্বারা কাব ইবনে আশরাফকে বুঝানো হয়েছে।’[27]
আল্লামা ইয়াকুবি তার তারিখ গ্রন্থে বলেন,
وكان رسول الله صلى الله عليه وسلم بعث إليهم بعد أن وجه من يقتل كعب بن الأشرف اليهودي الذي أراد أن يمكر برسول الله.
‘ইহুদি কাব ইবনুল আশরাফ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধোঁকা দিয়ে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল।’[28]
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি বলেন, ‘কাব ইবনুল আশরাফ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিবাহভোজের অনুষ্ঠানে যোগদানের দাওয়াত দিল এবং কয়েক ব্যক্তি এই উদ্দেশ্যে নিযুক্ত করল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করলে তারা তাকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হত্যা করবে।[29] এখানে ঘটনাটি সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে।
কাব ইবনে আশরাফ হত্যার পরিকল্পনা
কাব ইবনে আশরাফ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের অব্যাহতভাবে ভর্ৎসনা ও কাব্যিক কটূক্তির মাধ্যমে ভীষণভাবে কষ্ট দিতে লাগল। তার সীমাহীন কাব্যাত্যাচার ও দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি বললেন, ‘কাব ইবনে আশরাফকে কে দমন করতে পারবে? সে আল্লাহ ও তার রাসুলকে কষ্ট দিয়েছে।’[30]
বনু আবদুল আশহালের মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি এটির জন্য প্রস্তুত আছি। আমি কি তাকে হত্যা করব?’ নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সম্ভব হলে তাই করো।’[31]
মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু ফিরে এসে চিন্তিত অবস্থায় খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে তিন দিন অতিবাহিত করলেন। এটি অবগত হয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পানাহার ত্যাগ করলে কেন?’ তিনি বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার সামনে একটি কথা বলে ফেলেছি সত্য, কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে পারব কি না জানি না।’ নবী কারিম বললেন, ‘চেষ্টা করাই দায়িত্ব।’[32]

মানচিত্র (১৬) : কাব ইবনে আশরাফের অবস্থান স্থল
পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু আওস গোত্রীয় আরও চার ব্যক্তিকে সঙ্গে নিলেন। তারা হলেন : মিলকান ইবনে সালামা ইবনে ওয়াশ আবু নায়লা, কাব ইবনে আশরাফের দুধভাত্রা; আবাদ ইবনে বিশর ইবনে ওয়াশ রাযিয়াল্লাহু আনহু; হারেস ইবনে আওস ইবনে মুআজ এবং আবু আবস ইবনে জাবর রাযিয়াল্লাহু আনহু।[33]
কাব ইবনে আশরাফের হত্যাকাণ্ডের যে বর্ণনা হাদিসের বিভিন্ন কিতাবে (সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে) উল্লিখিত হয়েছে তা নিম্নরূপ,
حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ قَالَ عَمْرٌو سَمِعْتُ جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ لِكَعْبِ بْنِ الْأَشْرَفِ فَإِنَّهُ قَدْ آذَى اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَامَ مُحَمَّدُ بْنُ مَسْلَمَةَ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَتُحِبُّ أَنْ أَقْتُلَهُ قَالَ نَعَمْ قَالَ فَأْذَنْ لِي أَنْ أَقُولَ شَيْئًا قَالَ قُلْ فَأَتَاهُ مُحَمَّدُ بْنُ مَسْلَمَةَ فَقَالَ إِنَّ هَذَا الرَّجُلَ قَدْ سَأَلَنَا صَدَقَةً وَإِنَّهُ قَدْ عَنَّانَا وَإِنِّي قَدْ أَتَيْتُكَ أَسْتَسْلِفُكَ قَالَ وَأَيْضًا وَاللَّهِ لَتَمَلُّنَّهُ قَالَ إِنَّا قَدْ اتَّبَعْنَاهُ فَلَا نُحِبُّ أَنْ نَدَعَهُ حَتَّى نَنْظُرَ إِلَى أَيِّ شَيْءٍ يَصِيرُ شَأْنُهُ وَقَدْ أَرَدْنَا أَنْ تُسْلِفَنَا وَسْقًا أَوْ وَسْقَيْنِ و حَدَّثَنَا عَمْرٌو غَيْرَ مَرَّةٍ فَلَمْ يَذْكُرْ وَسْقًا أَوْ وَسْقَيْنِ أَوْ فَقُلْتُ لَهُ فِيهِ وَسْقًا أَوْ وَسْقَيْنِ فَقَالَ أُرَى فِيهِ وَسْقًا أَوْ وَسْقَيْنِ فَقَالَ نَعَمِ ارْهَنُونِي قَالُوا أَيَّ شَيْءٍ تُرِيدُ قَالَ ارْهَنُونِي نِسَاءَكُمْ قَالُوا كَيْفَ نَرْهَنُكَ نِسَاءَنَا وَأَنْتَ أَجْمَلُ الْعَرَبِ قَالَ فَارْهَنُونِي أَبْنَاءَكُمْ قَالُوا كَيْفَ نَرْهَنُكَ أَبْنَاءَنَا فَيُسَبُّ أَحَدُهُمْ فَيُقَالُ رُهِنَ بِوَسْقٍ أَوْ وَسْقَيْنِ هَذَا عَارٌ عَلَيْنَا وَلَكِنَّا نَرْهَنُكَ اللَّأْمَةَ قَالَ سُفْيَانُ يَعْنِي السِّلَاحَ فَوَاعَدَهُ أَنْ يَأْتِيَهُ فَجَاءَهُ لَيْلًا وَمَعَهُ أَبُو نَائِلَةَ وَهُوَ أَخُو كَعْبٍ مِنْ الرَّضَاعَةِ فَدَعَاهُمْ إِلَى الْحِصْنِ فَنَزَلَ إِلَيْهِمْ فَقَالَتْ لَهُ امْرَأَتُهُ أَيْنَ تَخْرُجُ هَذِهِ السَّاعَةَ فَقَالَ إِنَّمَا هُوَ مُحَمَّدُ بْنُ مَسْلَمَةَ وَأَخِي أَبُو نَائِلَةَ وَقَالَ غَيْرُ عَمْرٍو قَالَتْ أَسْمَعُ صَوْتًا كَأَنَّهُ يَقْطُرُ مِنْهُ الدَّمُ قَالَ إِنَّمَا هُوَ أَخِي مُحَمَّدُ بْنُ مَسْلَمَةَ وَرَضِيعِي أَبُو نَائِلَةَ إِنَّ الْكَرِيمَ لَوْ دُعِيَ إِلَى طَعْنَةٍ بِلَيْلٍ لَأَجَابَ قَالَ وَيُدْخِلُ مُحَمَّدُ بْنُ مَسْلَمَةَ مَعَهُ رَجُلَيْنِ قِيلَ لِسُفْيَانَ سَمَّاهُمْ عَمْرٌو قَالَ سَمَّى بَعْضَهُمْ قَالَ عَمْرٌو جَاءَ مَعَهُ بِرَجُلَيْنِ وَقَالَ غَيْرُ عَمْرٍو أَبُو عَبْسِ بْنُ جَبْرٍ وَالْحَارِثُ بْنُ أَوْسٍ وَعَبَّادُ بْنُ بِشْرٍ قَالَ عَمْرٌو جَاءَ مَعَهُ بِرَجُلَيْنِ فَقَالَ إِذَا مَا جَاءَ فَإِنِّي قَائِلٌ بِشَعَرِهِ فَأَشَمُّهُ فَإِذَا رَأَيْتُمُونِي اسْتَمْكَنْتُ مِنْ رَأْسِهِ فَدُونَكُمْ فَاضْرِبُوهُ وَقَالَ مَرَّةً ثُمَّ أُشِمُّكُمْ فَنَزَلَ إِلَيْهِمْ مُتَوَشِّحًا وَهُوَ يَنْفَحُ مِنْهُ رِيحُ الطِّيبِ فَقَالَ مَا رَأَيْتُ كَالْيَوْمِ رِيحًا أَيْ أَطْيَبَ وَقَالَ غَيْرُ عَمْرٍو قَالَ عِنْدِي أَعْطَرُ نِسَاءِ الْعَرَبِ وَأَكْمَلُ الْعَرَبِ قَالَ عَمْرٌو فَقَالَ أَتَأْذَنُ لِي أَنْ أَشُمَّ رَأْسَكَ قَالَ نَعَمْ فَشَمَّهُ ثُمَّ أَشَمَّ أَصْحَابَهُ ثُمَّ قَالَ أَتَأْذَنُ لِي قَالَ نَعَمْ فَلَمَّا اسْتَمْكَنَ مِنْهُ قَالَ دُونَكُمْ فَقَتَلُوهُ ثُمَّ أَتَوْا النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَخْبَرُوهُ.
জাবির ইবনে আবদিল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘কাব ইবনে আশরাফের নিধনের জন্য কে আছে? কারণ সে আল্লাহ ও তার রাসুলকে খুবই কষ্ট দিচ্ছে।’ মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি যদি তাকে হত্যা করি, তবে তা কি আপনি পছন্দ করবেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘তাহলে আমাকে কিছু এদিক-ওদিক কিছু বলার অনুমতি দিন।’ তিনি বলেন, ‘বোলো।’ তখন মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু তার নিকট গিয়ে বলল, ‘এই লোকটি আমাদের নিকট সদকা (জাকাত) দাবি করেছে। সে আমাদেরকে উত্যক্ত করে তুলেছে। আমি তোমার নিকট কিছু ঋণ চাওয়ার জন্য এসেছি।’ সে বলল, ‘আরও দেখো! আল্লাহর শপথ! সে তোমাদের অতিষ্ঠ করে তুলবে।’ ইবনে মাসলামা বলেন, ‘যাহোক, আমরা তো তার আনুগত্য স্বীকার করেছি। শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়ায় তা না দেখা পর্যন্ত এখনই তাকে ত্যাগ করা উত্তম মনে করি না। আমি তোমার নিকট এক বা দুই ওয়াসাক খাদ্যশস্য ধার চাই।’ সে বলল, ‘আচ্ছা! আমার নিকট কিছু বন্ধক রাখো।’ তারা বললেন, ‘কী জিনিস বন্ধক চাও?’ সে বলল, ‘তোমাদের স্ত্রীলোকদের আমার নিকট বন্ধক রাখো।’ তারা বললেন, ‘তোমার নিকট আমাদের স্ত্রীলোকদের কীভাবে বন্ধক রাখতে পারি? অথচ তুমি আরবের সর্বাধিক সুশ্রী পুরুষ।’ সে বলল, ‘তা হলে তোমাদের সন্তানদের আমার নিকট বন্ধক রাখো।’ তারা বললেন, ‘আমরা কী করে আমাদের সন্তানদের তোমার নিকট বন্ধক রাখতে পারি? তাতে তাদেরকে গালমন্দ করা হবে এবং বলা হবে, এক বা দুই ওয়াসাক-এর জন্য (তাদেরকে) বন্ধক রাখা হয়েছিল। এটি আমাদের জন্য অপমানজনক; বরং আমরা তোমার নিকট আমাদের যুদ্ধাস্ত্র বন্ধক রাখবো।’ তখন ইবনে মাসলামা পুনরায় তার নিকট আসার ওয়াদা করলেন।
এক রাতে তিনি কাব-এর দুধাভাত্রা আবু নাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সঙ্গে নিয়ে এলেন। সে তাদের দুর্গের মধ্যে ডেকে নিল এবং সেও (উপর থেকে) তাদের নিকট নেমে এলো। তার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, ‘এই মুহূর্তে তুমি কোথায় বের হচ্ছো?’ সে বলল, ‘এ তো মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা এবং আমার ভাই আবু নাইলা।’ স্ত্রী বলল, ‘আমি এই ডাকের মধ্যে রক্তের গন্ধ পাচ্ছি।’ সে বলল, অভিজাত ব্যক্তিকে রাত্রিবেলা বর্শাবিদ্ধ করার জন্য ডাকা হলেও সে অবশ্যই সাড়া দেয়। মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু আবু আবস ইবনে জাবর, হারেস ইবনে আওস ও আব্বাদ ইবনে বিশর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সঙ্গে নিয়ে প্রবেশ করলেন। ইবনে মাসলামা বললেন, ‘সে এসে পৌঁছালে আমি তার মাথার চুল ধরে শুঁকতে থাকি। তোমরা যখন দেখবে, আমি তার মাথা শক্ত করে ধরেছি, তখনই তোমরা তাকে হত্যা করবে।’
আরো পড়ুন : সিফুল বাহার অভিযান – Expedition of Hamza ibn Abdul-Muttalib
আরো পড়ুন : হুদাইবিয়ার সন্ধি – Treaty of Hudaybiyyah
কাব চাদর পরিহিত অবস্থায় তাদের নিকট এলো এবং তার দেহ থেকে সুগন্ধি ছড়াচ্ছিল। ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি আজকের মতো এত উত্তম খোশবু কখনো দেখিনি।’ তিনি বললেন, ‘তুমি কি আমাকে তোমার মাথার ঘ্রাণ নেওয়ার অনুমতি দেবে?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ! তখন তিনি তার মাথার ঘ্রাণ শুঁকলেন, অতঃপর তার সঙ্গীগণকেও শোঁকালেন।’ পুনরায় তিনি বললেন, ‘আমাকে পুনর্বার ঘ্রাণ নেওয়ার অনুমতি দেবে কি?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ!’ এ সুযোগে তিনি তার মাথা শক্ত করে ধরে বললেন, ‘এবার আঘাত হানো।’ নিমিষেই তারা কাব ইবনে আশরাফকে হত্যা করল, অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে অবহিত করলেন।[34]
সিরাত ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলিতে উক্ত ঘটনা কিছুটা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে। তদনুসারে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমীপে আরজ করলেন, ‘আমাকে অস্বাভাবিক কিছু বলার অনুমতি দেবেন কি?’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি বলতে পারো।’ ঐতিহাসিকগণ বলেন, এই কথার দ্বারা তারা কাবের সাথে মিথ্যা বাক্যালাপের অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন।[35] নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের অনুমতি দিলেন। কেননা যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে ফাঁকি দেওয়া বৈধ।[36]
অতঃপর মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু কাব ইবনে আশরাফের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশ্রয় দিয়ে ভীষণ অসুবিধায় পড়েছি। এই ব্যক্তি আমাদের নিকট সদকা চাচ্ছে। এখন আমরা অভাবী হয়ে পড়েছি। সে আমাদের কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’ এই কথা শুনে কাব বলল, ‘আল্লাহর কসম! সে তোমাদের আরও দুর্ভোগে ফেলবে।’ মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আমরা যেহেতু তার অনুসারী হয়েই গিয়েছি, এখন আকস্মিক তার সঙ্গ ত্যাগ করা সমীচীন মনে করছি না। অপেক্ষা করে দেখি, পরিণামে কী হয়? আমি আপনার নিকট এক ওয়াসক বা দুই ওয়াসক (এক ওয়াসক ১৫০ কেজি) খাবার ধার চাচ্ছি।’
কাব বলল, ‘আমার নিকট কিছু বন্ধক রাখো।’ মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘তুমি কী জিনিস বন্ধক রাখা পছন্দ করো?’ কাব বলল, ‘তোমাদের স্ত্রীলোকদের আমার নিকট বন্ধক রাখো।’ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘তুমি আরবের সর্বাপেক্ষা সুদর্শন পুরুষ। সুতরাং কীভাবে আমাদের স্ত্রীদের তোমার নিকট বন্ধক রাখতে পারি?’ সে বলল, ‘তাহলে তোমাদের পুত্রদের বন্ধক রাখো।’ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘এরূপ করলে তাদের এক বা দুই ওয়াসক খাদ্যদ্রব্যের বিনিময়ে বন্ধক রাখা হয়েছিল বলে গালি দেওয়া হবে। এটি আমাদের জন্য খুবই লজ্জাজনক হবে। আমরা অবশ্য তোমার নিকট অস্ত্র বন্ধক রাখতে পারি।’[37] এরপর উভয়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত হলো, ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু অস্ত্র নিয়ে তার নিকট আসবেন। অপরদিকে কাবের দুধভাই আবু নাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু-ও তার নিকট এসে গল্পগুজব শুরু করলেন এবং একজন অন্যজনকে কবিতা শোনাতে লাগলেন। একপর্যায়ে আবু নাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘ভাই কাব! বিশেষ প্রয়োজনে আমি তোমার নিকট এসেছি। গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি পেলে তা ব্যক্ত করব।’ কাব বলল, ঠিক আছে, ‘বলো।’ আবু নাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘মুহাম্মাদের আগমন আমাদের জন্য পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমগ্র আরব বিশ্ব আমাদের শত্রু হয়ে গেছে। আমাদের রাস্তাঘাট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। পরিবার-পরিজন ধ্বংসের মুখোমুখি, সন্তান-সন্ততি ভীষণ কষ্টে নিপতিত। আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।’[38]
এরপর তিনি মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অনুরূপ কিছু আলোচনা করলেন। বাক্যালাপের মধ্যে আবু নাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু এ কথাও বলেছিলেন, ‘আমার কয়েকজন বন্ধু আছে, যারা আমার মতোই চিন্তাধারা লালন করে। আমি তাদেরকেও তোমার নিকট হাজির করতে আগ্রহী। তুমি তাদের নিকটও কিছু খাদ্য বিক্রয় করো।’[39]
মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা ও আবু নাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজ নিজ বাক্যালাপে উদ্দেশ্য সাধনে সফল হলেন। কেননা এরপর সশস্ত্রভাবে তাদের আগমনে কাবের কোনো সংশয় থাকবে না।[40]
আরো পড়ুন : সারিয়্যা ফাদাক, ফাদাকের দ্বিতীয় অভিযান – Expedition of Muhaysa ibn Massud (Fadak)
আরো পড়ুন : সারিয়্যা ফাদাক, ফাদাকের প্রথম অভিযান – Expedition of ʿAlī ibn Abī Ṭālib (Fadak)
আরো পড়ুন : সারিয়্যায়ে ওয়াদিউল কুরা (প্রথম) – Expedition of Zayd ibn Harithah (Wadi al-Qura)
মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্ব এই ক্ষুদ্র বাহিনী তৃতীয় হিজরির রবিউল আওয়াল মাসের ১৪ তারিখ মোতাবেক ৩রা বা ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ রাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট একত্র হলেন। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাকিউল গারকাদ পর্যন্ত তাদের সহগামী হয়ে বললেন, ‘আল্লাহর নামে রওনা হও।’ অতঃপর তিনি তাদের জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনাপূর্বক গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন।[41] ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী কাব ইবনে আশরাফের দুর্গের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছালে আবু নাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু উচ্চৈঃস্বরে তাকে ডাক দিলেন। সে ছিল সদ্য বিবাহিত। ডাক শুনেই বাইরে আসতে উদ্ধত হলে তার স্ত্রী তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘তুমি একজন যোদ্ধা, আর যোদ্ধাদের এই সময় বাইরে যাওয়া সমীচীন নয়। আমি শুনতে পাচ্ছি, এই আওয়াজ থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে।’ অন্য বর্ণনামতে, ‘আল্লাহর কসম! আমি তার আহ্বানে অনিষ্ট অনুভব করছি।’
স্ত্রীর এই আপত্তি শুনে কাব বলল, ‘আগন্তুক তো আমার ভাই মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা এবং দুধভাই আবু নায়লা। সম্ভ্রান্ত লোককে সশস্ত্র যুদ্ধে যোগদানের আহ্বান জানানো হলে সেই ডাকেও সে সাড়া দেয়।’ এরপর সে বাইরে এলো। তার দেহ ও মাথা থেকে অপূর্ব সুঘ্রাণ বিকশিত হচ্ছিল।[42] আবু নাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু তার সাথিদের পূর্বেই বলে রেখেছিলেন, ‘সে বের হয়ে এলে আমি তার মাথার চুল ধরে শুঁকব। তোমরা যখন বুঝতে পারবে, আমি তার মাথা ধরে তাকে আমার আয়ত্তে নিয়ে এসেছি, সেই সুযোগে তোমরা তাকে হত্যা করবে।’[43]
কাব তাদের নিকট আসার পর বেশ কিছুক্ষণ তারা বিভিন্ন গল্পগুজবে মেতে থাকল। এরপর আবু নাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হে ইবনে আশরাফ! চলো আজুয ঘাঁটি পর্যন্ত যাই। অবশিষ্ট রাত আমরা সেখানেই গল্প করে অতিবাহিত করব।’ সে বলল, ‘তোমাদের যদি ইচ্ছা হয় চলো।’ তারা কাবকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে লাগল। পথিমধ্যে আবু নাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে বললেন, ‘আজকের মতো এত উত্তম সুগন্ধি আমি আর কখনো অনুভব করিনি। এটি শুনে কাবের হৃদয় গর্বে ফুলে উঠল। সে বলল, ‘আমার নিকট আরবের সর্বাপেক্ষা অধিক সুগন্ধি ব্যবহারকারিণী রয়েছে।’ আবু নাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘সদয় অনুমতি পেলে আপনার মাথাটি একটু শুঁকবো।’ সে বলল, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়!’ আবু নাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু তখন কাবের মাথায় হাত রাখলেন, অতঃপর তার মাথা শুকলেন এবং সঙ্গীদেরকের শোঁকালেন। কিছুদূর অতিক্রম করার পর আবু নাইলা বললেন, ‘ভাই! আর একবার শুঁকতে পারি কি?’ কাব ইতিবাচক উত্তর দিলে তিনি আবার তার মাথা শুঁকলেন। ফলে সে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল।[44]
কিছুক্ষণ চলার পর আবু নাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু পুনরায় বললেন, ‘ভাই! আর একবার শুঁকব কি?’ কাব বলল, ‘হ্যাঁ, শুঁকতে পারো।’ এইবার আবু নাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু তার মাথায় হাত রেখে তাকে পূর্ণরূপে আয়ত্তে নিয়ে এলেন এবং সাথিদের বললেন, ‘আল্লাহ ও রাসুলের এই শত্রুকে খতম করো।’ সকলে একযোগে তাকে আঘাত করলেন, কিন্তু তাদের তরবারির আঘাত পরস্পরের তরবারির উপর পড়ছিল। ফলে কোনো কাজ হলো না। মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন আমি লক্ষ করলাম, আমাদের তরবারিগুলো কোনো কাজে আসছে না, তখন আমার তরবারিতে রাখা ছুরিটির কথা আমার মনে পড়ল। আমি তা তার নাভীর নিচে পূর্ণ শক্তিতে চেপে ধরলাম এবং তা নাভী ভেদ করে পেটের ভেতর পৌঁছে গেল।
আক্রান্ত হয়ে সে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করল এবং চর্তুদিকে তার শব্দ পৌঁছে গেল। এমন কোনো দুর্গ বাকি ছিল না যেখানে অগ্নি প্রজ্বলিত করা হয়নি। কিন্তু তা আমাদের কোনো ক্ষতির কারণ হয়নি।[45]
এভাবে কাব নিহত হলো। হারেস ইবনে আওস ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-ও আহত হলেন। তার মাথা কিংবা পায়ে আমাদের তরবারির আঘাত লেগেছিল। এরপর আমরা রওনা হয়ে বনু উমাইয়া ইবনে জায়েদ, বনু কুরাইজা ও বুআস-এর এলাকা অতিক্রম করে হাররাতুল উরাইজে এসে পৌঁছালাম। আমাদের সঙ্গী হারেস ইবনে আওস রাযিয়াল্লাহু আনহু আহত হওয়ার কারণে পেছনে পড়ে গেলেন। আমরা তার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে তিনি আমাদের পদচিহ্ন ধরে আমাদের পর্যন্ত এসে পৌঁছালেন। আমরা তাকে সঙ্গে নিয়ে পুনরায় যাত্রা করলাম।[46]
আরো পড়ুন : সারিয়্যা তারাফ – Expedition of Zayd ibn Harithah (At-taraf)
আরো পড়ুন : সারিয়্যা ফাদাক, ফাদাকের তৃতীয় অভিযান – Expedition of Bashir Ibn Sa’d al-Ansari (Fadak)
রাতের শেষাংশে মুসলিম বাহিনী বাকিউল-গারকাদে পৌঁছে এমন জোরে তাকবির ধ্বনি দিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তা শুনতে পেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, কাব নিহত হয়েছে। তখন তিনিও তাকবির ধ্বনি দিতে লাগলেন। অতঃপর এই মুসলিম বাহিনী তার সমীপে উপস্থিত হলে তিনি বললেন, এই চেহারাগুলো সফল থাকুক। তারাও বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনার চেহারাও সফলতা লাভ করুক।’ তারা কাবের কর্তিত মস্তক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে রেখে দিলেন। তিনি আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করলেন।[47]
অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারেস ইবনে আওস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ক্ষতস্থানে নিজ মুখ নিঃসৃত লালা লাগিয়ে দিলেন এবং সঙ্গে-সঙ্গে তিনি আরোগ্য লাভ করলেন।
ইবনে আশরাফের নিহত হওয়ার পর কাব ইবনে মালিক রাযিয়াল্লাহু আনহু নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন,
فَغُودِرَ مِنْهُمْ كَعْبٌ صَرِيعًا … فَذَلَّتْ بَعْدَ مَصْرَعِهِ النَّضِيرُ
عَلَى الْكَفَّيْنِ ثَمَّ وَقَدْ عَلَتْهُ … بِأَيْدِينَا مُشْهَرَةٌ ذُكُورُ
بِأَمْرِ مُحَمَّدٍ إذْ دَسَّ لَيْلًا … إلَى كَعْبٍ أَخَا كَعْب يسير
فماكره فَأَنْزَلَهُ بِمَكْرٍ … وَمَحْمُودٌ أَخُو ثِقَةٍ جَسُورُ
‘অবশেষে তাদের মধ্যকার কাবকে ধরাশায়ী করা হলো এবং তার ধরাশায়ী হওয়ার পর বনু নাজির অপদস্থ হলো।
সে সেখানে তার দুই হাতের উপর পড়েছিল এবং আমাদের হাতের তীক্ষ্ণ তরবারি তাকে আঘাত করেছিল।
যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশক্রমে বনু কাবের জনৈক ব্যক্তি রাতের অন্ধকারে গোপনে কাবের দিকে যাচ্ছিল। সে কৌশলে তাকে ঘর থেকে বের করে আনল। আত্মনির্ভরশীল ও সাহসী ব্যক্তি প্রশংসার উপযুক্ত হয়ে থাকে।’[48]
সকালবেলা ইহুদিদের নিকট কাব ইবনে আশরাফের নিহত হওয়ার সংবাদ প্রচারিত হলে তাদের শঠতাপূর্ণ অন্তরে ভীতি, আতঙ্ক ও ত্রাসের সৃষ্টি হলো। তারা বুঝতে পারল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন অনুধাবন করবেন, শান্তি ভঙ্গকারী, বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারীদের উপদেশ দিয়ে কোনো ফলোদয় হচ্ছে না, তখন তিনি তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতেও দ্বিধাবোধ করবেন না। এজন্যই ইহুদিদের তাদের স্বগোত্রীয় এই নেতার নিহত হওয়ার প্রতিবাদে কোনো কিছু করার সাহস পায়নি। তারা একেবারে নীরব হয়ে গেল। তারা পুনরায় মুসলমানদের অঙ্গীকার পূরণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করল। প্রত্যেক ইহুদি নিজ নিজ জীবনের আশঙ্কা করতে লাগল। তারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধাচরণের সাহস সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলল।[49] যেহেতু এই অভিযানে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাই এটি সারিয়্যা মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা নামে অভিহিত হয়েছে।
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. – Expedition of Abu Ubaidah ibn al Jarrah
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু বকর সিদ্দিক রা. – Expedition of Abu Bakr As-Siddiq
কাব ইবনে আশরাফের এই হত্যাকাণ্ড ইসলামের ইতিহাসে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার বিরুদ্ধে বহিরাক্রমণের মোকাবেলা করার অপূর্ব সুযোগ লাভ করলেন এবং মুসলমানগণ অভ্যন্তরীণ গোলযোগ থেকে অনেকাংশে নিরাপদ হয়ে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করলেন। ক্রমান্বয়ে ইসলামের অগ্রযাত্রা সুগম ও প্রসারিত হলো। বিরুদ্ধবাদীদের শক্তি ও সাহস দুর্বল হয়ে পড়ল। বিশেষত ইহুদিদের ইসলাম বিরোধী অপতৎপরতা হ্রাস পেল।
তথ্যসূত্র
[1]. তারিখুল খামিস : ৪৬৪; শিবলি নোমানি, সিরাতুন নবী : ১/২৩৬
[2]. শিবলি নোমানি, সিরাতুন নবী : ১/২৩৬
[3]. ইসলামী বিশ্বকোষ : ৬/৬২৮
[4]. ফাতহুল বারি : ৩/৩৩৭
[5]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৬৯
[6]. জুরকানি, শরহুল মাওয়াহিবুল-লাদুন্নিয়া : ২/১
[7]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৭
[8]. তারিখুত তাবারি : ২/১৭৮; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৮; মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ২/১৭৫
[9]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৮; মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৬৯
[10]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৮; ইবনে ইসহাক : ৩/২২৩
[11]. ইবনে ইসহাক : ৩/২২৪; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯
[12]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩২, ৯
[13]. ইবনে ইসহাক : ৩/২২৪
[14]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯
[15]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯
[16]. আল-বিদায়া : ২/৭
[17]. কুরতুবি : ৫/২৪৯
[18]. আন নিসা, ৫১
[19]. আল-জামে লি আহকামিল কুরআন : ৫/২৪৮
[20]. ইসলামী বিশ্বকোষ : ৬/৬২৮
[21]. ফাতহুল বারি : ৭/২৫৯; সিরাতে শিবলি নোমানি রহ. : ১/২৩৭
[22]. সুনানে আবু দাউদ, কিতাবুল খারাজ ওয়াল-ইসারা, বাব কাইফা কানা ইখরাজুল ইয়াহুদ মিনাল মাদিনা : ২/৪২২ (৩০০০)
[23]. আল-কামিল ফিত-তারিখ : ২/১৪৩; আল-জামে লি আহকামিল কুরআন : ৩/৩০৩
[24]. The Life of Mohammad, P. ৩৬৭
[25]. ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১৮৪
[26]. আলে ইমরান, ১৮৬
[27]. ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ২/৩৩; তাফসিরে কুরতুবি : ৩/৩০৩
[28]. শিবলি, সিরাতুন নবী : ১/২৩৭
[29]. ফাতহুল বারি : ৭/৩৩৮
[30]. ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ২/৬
[31]. আল-কামিল ফিত-তারিখ : ২/১৪৩
[32]. তারিখুত তাবারি : ২/১৭৯
[33]. তাবাকাতুল কুবরা : ২/৩২
[34]. সহিহ বুখারি, কিতাবুল মাগাজি, বাব কাতলি কাব ইবনিল আশরাফ : ৪০৩৭; মুসলিম, জিহাদ, বাব ঐ : ৪৬৬৪/১১৯; আবু দাউদ, জিহাদ, বাব ১৫৭, হাদিস নং : ২৭৬৮
[35]. নুরুল ইয়াকিন : ১২২
[36]. শিবলি নোমানি : ১/২৩৮
[37]. জুরকানি, শরহুল মাওয়াহিবুল-লাদুন্নিয়া : ২/১৩; ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ২/৩৩-৩৪
[38]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১০
[39]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৭১
[40]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১০
[41]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১১
[42]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১১
[43]. মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ২/১৭৮
[44]. ইবনে ইসহাক : ৩/২২৮
[45]. ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ২/৮-৯
[46]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১১-২২; মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৭১
[47]. ফাতহুল বারি : ৭/২৬২; মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ২/১৭৯; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ২/৯
[48]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩২/১২
[49]. ইবনে ইসহাক : ৩/২২৯; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১২