সিরাত বিশ্বকোষ
সিরাত বিশ্বকোষ

১৯. (১১) গাজওয়া উহুদ  – Battle of Uhud

১৯. (১১) গাজওয়া উহুদ – Battle of Uhud

১১. গাজওয়া উহুদ

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত গাজওয়া : ১১

তারিখ ৩ হিজরির ৭ শাওয়াল (২৩শে মার্চ ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ হিজরি ৩ শনিবার)
অবস্থান উহুদ পর্বত
ফলাফল মুসলিমদের ক্ষয়ক্ষতি হয়, কিন্তু কুরাইশরাও মদিনা দখলে ব্যর্থ হয়।

 

 

বিবাদমান পক্ষ
মুসলমান (মদিনা) কুরাইশ (মক্কা)
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ান
শক্তি
৭০০ পদাতিক, ৫০ তিরন্দাজ, ৪টি ঘোড়া (মোট ১০০০) ৩০০০ পদাতিক, ৩০০টি উট, ২০০টি ঘোড়া
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
৭০ জন শহিদ ২২-৩৭ জন নিহত

 

পরিচিতি

 

(أٌحُد) হামজা ও হা বর্ণে পেশযোগে গঠিত, প্রসিদ্ধ এক পাহাড় বিশেষ, মদিনা থেকে তিন/সাড়ে তিন মাইল উত্তরে এটির অবস্থান।[1] মসজিদে নববি থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে দীর্ঘ এই পাহাড়টি শক্ত নুড়িযুক্ত মাটি দ্বারা আবৃত। এটির উত্তর দিক চওড়া পাথরবিশিষ্ট, যা দেখতে অনেকটা উচ্চ দেয়ালের মতো মনে হয়। লাল বেলে পাথর ও শক্ত পাথরের টুকরা পাহাড়টির প্রায় সর্বত্রই পরিদৃষ্ট হয়।[2] এটির পাশেই একটি ক্ষুদ্র পাহাড় আছে, যাকে জাবালুর রুমাত বা জাবালুল ‘আইনাইন’ বলা হয়। উক্ত পাহাড়ের পূর্বে একটি প্রাচীন সেতুর ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। তাতে অনুমিত হয়, অতীতে কোনো একসময় এখানে বন্যা হতো। ফলে শহর থেকে উহুদের শহিদদের জিয়ারতের উদ্দেশে আগত মুসলিমগণ উক্ত সেতু ব্যতীত জলাশয় পার হতে পারতেন না।

 হারুন আলাইহিস সালাম তার সহোদর ভাই মুসা আলাইহিস সালাম-এর সাথে হজ বা উমরা পালনের উদ্দেশ্যে ভ্রমণকালে এখানে ইনতেকাল করেন এবং এই পাহাড়ের পাদদেশেই তাকে দাফন করা হয়। মুসা আলাইহিস সালাম-এর কবরও এই পাহাড়ে অবস্থিত বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।[3]

এই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে যাতায়াতের কোনো রাস্তা ছিল না। মধ্যখানের দৈর্ঘ্য ছিল একদেড় ফার্লং (৮ ফার্লং সমান ১ মাইল)। এটির অভ্যন্তরীণ মাঠ যেহেতু সর্বদিক দিয়েই নিরাপদ ও অনেকটা সুরক্ষিত, তাই উহুদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী এখানে শিবির স্থাপন করেছিল।[4] প্রাচীনকাল থেকেই মদিনাবাসীদের নিকট উহুদ পাহাড় ছিল অত্যন্ত প্রিয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এটি (উহুদ) একটি পাহাড়, যা আমাদের ভালোবাসে এবং আমরাও একে ভালোবাসি।’[5]

এই পাহাড়কে উহুদ নামকরণের কারণ হলো, পার্শ্ববর্তী পাহাড়সমূহ থেকে এটি স্বতন্ত্র একটি পাহাড়বিশেষ। মদিনা নগরী থেকে দৃষ্টি দিলে এটিকে গাঢ় লাল বর্ণের বলে মনে হয়। খুব বেশি উদ্ভিদ এই পাহাড়ে জন্মায় না। তবে বর্ষায় পর্বত গুহার গর্তসমূহে পানি জমে যায় এবং বেশকিছু দিন তা পানিবদ্ধ অবস্থায় থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদ যুদ্ধে আহত হলে তার রক্তাক্ত ক্ষত স্থানসমূহ ধৌত করার জন্য আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু পাহাড়ের ওই প্রাকৃতিক গর্তসমূহ থেকে স্বীয় ঢাল পূর্ণ করে পানি এনেছিলেন বলে হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়।[6] এই ঐতিহাসিক পাহাড়ের পাদদেশে ইসলামের দ্বিতীয় বৃহৎ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বিধায় এটিকে ‘উহুদ যুদ্ধ’ নামে অভিহিত করা হয়।

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব (1) – Expedition of Ali ibn Abi Talib

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব রা. (3) – Expedition of Ali ibn Abi Talib

আরো পড়ুন : সারিয়্যা ইবনে আবিল আওজা – Expedition of Ibn Abi Al-Awja Al-Sulami

বদরযুদ্ধে মক্কার কুরাইশদের শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল, উহুদ যুদ্ধের এটিই অন্যতম কারণ। বদর প্রান্তরে সুসজ্জিত কুরাইশ বাহিনী চরমভাবে পরাজিত হওয়ায় এবং যুদ্ধে তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিহত হওয়ায় মক্কায় কান্নার রোল পড়ে ও শোকের ছায়া নেমে আসে। ক্ষোভ, বিদ্বেষ ও প্রতিশোধের স্পৃহা তাদের মাঝে তীব্রভাবে জ্বলে ওঠে। আর আরবরা ছিল প্রতিশোধপরায়ণ জাতি। প্রতিশোধ গ্রহণকে তারা তাদের অস্তিত্বের প্রশ্নের মতো একটি অপরিহার্য কর্তব্য বলে মনে করত। তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের ধরাপৃষ্ঠ থেকে চিরতরে সরিয়ে ফেলার অশুভ পায়তারা ও সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। বদরযুদ্ধে সংখ্যালঘু মুসলিম বাহিনী যে অসাধারণ রণনৈপুণ্য ও সাহসিকতার পরিচয় প্রদান করেছিল, আর কুরাইশ সৈন্যদের তা বিশেষভাবে স্মরণ ছিল। এই সকল দিকের প্রতি সার্বিক লক্ষ রেখেই কুরাইশগণ যুদ্ধের উদ্যোগ আয়োজনে ব্রতী হয়।

কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বাণিজ্যিক বহরে থাকার কারণে বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। কুরাইশ বাহিনীর পরিচালনার দায়িত্ব এবার তার উপরই ন্যস্ত হলো। সিরিয়া থেকে যে বাণিজ্য বহর নিয়ে আবু সুফিয়ান এসেছিল, তারা যখন দারুন-নাদওয়ায় বৈঠকরত, এমন সময় কুরাইশদের মধ্য থেকে আল-আসওয়াদ ইবনুল মুত্তালিব ইবনে আসাদ, জুবায়ের ইবনে মুতইম, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া, ইকরামা ইবনে আবু জাহল, হারেস ইবনে হিশাম, আবদুল্লাহ ইবনে রাবিআ প্রমুখ এবং বদরযুদ্ধে যাদের পিতা, পুত্র, ভাই নিহত হয়েছিল; তাদের সাথে নিয়ে আবু সুফিয়ান ও বাণিজ্য বহরে যাদের সম্পদের অংশ ছিল তাদেরকে লক্ষ করে বলতে লাগল,

يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ، إنَّ مُحَمَّدًا قَدْ وَتَرَكُمْ، وَقَتَلَ خِيَارَكُمْ، فَأَعِينُونَا بِهَذَا الْمَالِ عَلَى حَرْبِهِ.

‘হে কুরাইশ সম্প্রদায়! মুহাম্মাদ তোমাদের পরাজিত করেছে, তোমাদের নেতৃবর্গকে হত্যা করেছে। অতএব তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এই মাল দিয়ে আমাদের সাহায্য করো।’[7]

আবেদনটি ছিল অত্যন্ত সময় উপযোগী। উত্থাপন করার সাথে সাথেই তা গৃহীত হলো। ফলে বাণিজ্য বহরের পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা যুদ্ধের তহবিলে জমা দেওয়া হয়। তাদের ছিল আরও এক হাজার উট; ঐগুলোর মূল্যও যুদ্ধের ব্যয় তহবিলে জমা করা হয়।[8] অন্য বর্ণনায় তাৎক্ষণিকভাবেই আড়াই লক্ষ দিরহাম যুদ্ধ তহবিলে সংগৃহীত হয়। কুরাইশ বণিকগণ তাদের পূর্ণ মূলধন বা লভ্যাংশের সম্পূর্ণই যুদ্ধের ব্যয়খাতে প্রদান করে।[9] ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, ‘কোনো কোনো আলেম আমার নিকট বর্ণনা করেন, কুরাইশদের সম্পর্কেই নিম্নোক্ত আয়াত নাজিল হয় :[10]

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ فَسَيُنْفِقُونَهَا ثُمَّ تَكُونُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُونَ وَالَّذِينَ كَفَرُوا إِلَى جَهَنَّمَ يُحْشَرُونَ (৩৬)

আল্লাহর পথ থেকে লোককে নিবৃত্ত করার জন্য কাফেররা তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে। তারা ধন-সম্পদ ব্যয় করতেই থাকবে, অতঃপর তা তাদের মনের উত্তাপের কারণ হবে, এরপর তারা পরাভূত হবে এবং যারা কুফরি করে তাদের জাহান্নামে একত্র করা হবে।’[11]

যুদ্ধের ব্যয়ভার নির্বাহের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় অর্থ ও অস্ত্রসামগ্রী সংগ্রহের পর কুরাইশ নেতৃবৃন্দ জনসমর্থন ও জনশক্তি অর্জনের প্রতি মনোনিবেশ করল। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি ছাড়াও তারা নিজেদের নকিব ও প্রতিনিধি বিভিন্ন গোত্রে প্রেরণ করে তাদের মদিনা আক্রমণ করতে আহ্বান জানাল। সৈন্যবাহিনী গঠন ও লোকদের যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে চারটি ছোট দলও তারা বিভিন্ন গোত্রে প্রেরণ করল। এই চারটি দলের নেতৃত্বে ছিল যথাক্রমে আমর ইবনুল আস, হুবাইরা ইবনে আবু ওয়াহ, ইবনুয যিবআরা এবং আবু উযযা আল-জুমাহি।[12] আরববাসীদের যুদ্ধ বা অনুরূপ কোনো অভিযানে উদ্দীপিত করার প্রধানতম হাতিয়ার ছিল প্রাণস্পর্শী কবিতা।

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলকামা ইবনে মুজাযিয আল-মুদলিজী – Expedition of Alkama Ibn Mujaziz Al-Mudliji

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আল-কুররা বি’র মাউনা – Expedition of Bir Maona

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব ( ) – Expedition of Ali ibn Abi Talib (2)

কুরাইশদের মধ্যে আবু উযযা আমর আল-জুমাহি ও মুসআব নামে প্রসিদ্ধ দুজন কবি ছিল। আবু উযযা বদরের যুদ্ধে বন্দি হয়েছিল। সে ছিল বহু সন্তানের জনক ও দরিদ্র ব্যক্তি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দয়াপরবশ হয়ে বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া তার কাছে গিয়ে বলল, ‘হে আবু উযযা! তুমি একজন নামকরা কবি। যুদ্ধে চলো এবং কবিতার মাধ্যমে আমাদের সহায়তা করো।’ সে বলল, ‘মুহাম্মাদ আমার উপর অনুগ্রহ করেছেন। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তার বিরুদ্ধে আর কবিতা রচনা করব না। আমি ভয় করছি, দ্বিতীয়বার তার হাতে ধৃত হলে আর মুক্তি পাব না।’[13] সাফওয়ান তাকে বারবার বুঝাতে লাগল। বলল, ‘তুমি তো নিজের জীবন দিয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারো। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যদি তুমি নিরাপদে যুদ্ধ থেকে ফিরে আসতে পারো, তবে সম্পদ দিয়ে তোমাকে ধনী করে দেব। আর যদি মারা যাও, তবে তোমার মেয়েদের আমাদের মেয়েদের সাথে লালন-পালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করব।’[14] কিন্তু এতেও সে সম্মত না হলে সাফওয়ান নিরাশ হয়ে তার নিকট থেকে ফিরে এলো।

পরদিন সাফওয়ান ও জুবায়ের ইবনে মুতইম তার কাছে গিয়ে পূর্বের ন্যায় বুঝাতে লাগল। জুবায়ের ইবনে মুতইম বলল, ‘হে আবু উযযা! আমি তোমার কাছে এসেছি সহযোগিতার আশায়, তুমি তা অস্বীকার করবে বা ফিরিয়ে দেবে তা ধারণা করিনি।’ একপর্যায়ে সে রাজি হয়ে আরবের বিভিন্ন গোত্রকে সংঘবদ্ধ করার জন্য বের হয়ে পড়ল। বনু কিনানাকে কবিতার মাধ্যমে যুদ্ধের প্রতি আহ্বান জানাল—

أَيَا بَنِي عَبْدِ مَنَاةَ الرُّزَّامْ … أنتم حماة وأبو كم حَامْ

لَا يَعْدُونِي نَصْرُكُمْ بَعْدَ الْعَامْ … لَا تسلموني لا يحل إسلام

‘হে অবিচল যোদ্ধা বনু আবদ মানাত! তোমরা হলে গোত্রমর্যাদা রক্ষাকারী, যেমন ছিল তোমাদের পূর্বপুরুষগণ (সুতরাং এহেন পরিস্থিতিতে আমাদের সাহায্য করো)। এ বছরের পর আমাদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতির কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের শত্রুদের হাতে ছেড়ে দিয়ো না। কেননা এরূপ করা আদৌ সমীচীন নয়।’[15]

মুসাফি ইবনে আবদ মানাফ বনু মালিক ইবনে কিনানার কাছে গিয়ে তাদেরকেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে লাগল। জুবায়ের ইবনে মুতইম তার হাবশি গোলাম ওয়াহশিকে বলল, ‘লোকদের সঙ্গে যুদ্ধে চলো! যদি তুমি মুহাম্মাদের চাচা হামজাকে হত্যা করতে পারো, তবে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাবে।’[16]

মক্কার চারিদিকে প্রতিশোধ গ্রহণের তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। অল্প সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন গোত্র থেকে বহু দুর্ধর্ষ আরব যোদ্ধারা মক্কায় একত্র হলো। এভাবে কুরাইশগণ আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যের এক বিরাট শক্তিশালী বাহিনী গঠন করল। তন্মধ্যে সাতশত ছিল লৌহ বর্মধারী, দুইশত ছিল অশ্বারোহী। ইবনে হাজার আসকালানি ফাতহুল বারিতে অশ্বারোহী একশত বলে উল্লেখ করেন।[17] এই যুদ্ধে তারা তিন হাজার উট সঙ্গে এনেছিল। আবু সুফিয়ান ছিল যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। অশ্বারোহী বাহিনীর দায়িত্ব ছিল খালিদ ইবনুল ওয়ালিদের উপর। তার সহযোগী ছিল ইকরামা ইবনে আবু জাহল। যুদ্ধের পতাকা ছিল বনি আবদুদ দার-এর হাতে।[18]

নারী ছিল আরবদের যুদ্ধে উন্মাদনা ও উত্তেজনা সৃষ্টির প্রধান উপকরণ। যেসকল যুদ্ধে নারীরা উপস্থিত থাকত, সেগুলোতে আরব যোদ্ধারা জীবনপণ করে লড়াই করত। কেননা যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার সঙ্গে নারীদের কারণে লজ্জিত হওয়ার প্রশ্নও জড়িত থাকত।[19] তাই যুদ্ধে উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রদানের জন্য তারা নারীদেরকেও সাথে নিল। সেনাপতি আবু সুফিয়ান স্ত্রী হিনদ বিনতে উতবাকে, ইকরামা ইবনে আবু জাহল উম্মু হাকিম বিনতুল হারেসকে, হারেস ইবনে হিশাম ফাতিমা বিনতে ওয়ালিদকে, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া বারযা বিনতে মাসউদকে, আমর ইবনুল আস রিতাহ বিনতে মুনাব্বিহকে, আবু তালহা মুলাফা বিনতে সাদকে সাথে নিল।[20] এভাবে মোট পনেরোজন কুরাইশ নারী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল বলে জানা যায়।[21] সম্মিলিত সশস্ত্র এই বিশাল বাহিনী শাওয়াল মাসে মদিনা অভিমুখে যাত্রা করল।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতৃব্য আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব তখনো মক্কায়। তিনি ইসলাম গ্রহণ না করলেও ভাতিজা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তিনি কুরাইশদের যুদ্ধাভিযানের সংবাদ সিলমহরকৃত পত্রে জনৈক গিফারি দূতের মাধ্যমে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট প্রেরণ করেন। দূতকে তিনি তিন দিনের মধ্যে মদিনায় পৌঁছিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যুদ্ধের সংবাদ জানাতে নির্দেশ দেন। পত্রবাহক আদেশ মোতাবেক পাঁচশত কিলোমিটার পথ মাত্র তিন দিনে অতিক্রম করে মসজিদে কুবায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেয়ে পত্র হস্তান্তর করে। উবাই ইবনে কাব রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পত্র পাঠ করে শোনান। তিনি বিষয়টি গোপন রাখতে উবাই ইবনে কাব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে নির্দেশ দেন। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদ ইবনে আবুর রাবি-এর বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঘরে অন্য কেউ আছে কি না?’ সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘ঘরে অন্য কেউ নেই। বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি?’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে পিতৃব্য আব্বাসের পত্রের সংবাদ জানালেন। সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সংবাদ শুনে বললেন, ‘আমার ধারণা, তাতে কোনো মঙ্গল নিহিত রয়েছে।’ অতঃপর সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বিষয়টি গোপনীয়তা রক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্রুত মদিনায় চলে এলেন।[22] মক্কার কুরাইশ বাহিনী মদিনার পথে যাত্রা করে বার দিনের কঠিন ও বিপদ সংকুল পথ পাড়ি দিয়ে জঙ্গলের নিকট ছাউনি স্থাপন করল। যাত্রাকালে ‘আবওয়া’ নামক স্থানে পৌঁছালে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মা আমিনার কবর খনন করতে বললে বাহিনীর নেতৃবৃন্দ অশুভ পরিণতির আশঙ্কায় তা প্রত্যাখ্যান করে। তারা মদিনার নিকটবর্তী আকিক উপত্যকার সামান্য ডান দিকে উহুদ পাহাড় সংলগ্ন ‘আয়নাইন’ নামক স্থানে শিবির স্থাপন করল।[23]

এ দিকে খুজাআ গোত্রের লোকেরা কুরাইশদের যুদ্ধাভিযানের সংবাদ মদিনায় প্রেরণ করল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনাস ও মুনিস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দুজন সাহাবিকে শত্রুবাহিনীর সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করলেন। তারা ফিরে এসে জানালেন, কুরাইশ সৈন্য মদিনার নিকটে এসে পড়েছে এবং তাদের অশ্বপাল মদিনার চারণভূমির তৃণলতা খেয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশক্রমে হুবাব ইবনুল মুনজির রাযিয়াল্লাহু আনহু কুরাইশদের সৈন্যসংখ্যা তাকে অবহিত করেন। আক্রমণের আশঙ্কায় মদিনার চারিদিকে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়।

সাদ ইবনে উবাদা ও সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু হাতিয়ার নিয়ে সারা রাত মসজিদে নববির দরজায় পাহারারত থাকেন।[24]

পরদিন শুক্রবার প্রত্যুষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের নিয়ে পরামর্শ করতে বসলেন। তিনি উপস্থিত সকলের সামনে তার দেখা এক স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বললেন, ‘আমি স্বপ্নে একটি গাভী দেখতে পেলাম। আরও দেখলাম, আমার তরবারির অগ্রভাগের অংশবিশেষ ভেঙে গেছে এবং আমার হাত একটি মজবুত লৌহবর্মে ঢুকিয়ে নিয়েছি।’

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবুল হাদরাদ – Expedition of Abi Hadrad al-Aslami

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আমর ইবনুল আস – Expedition of Amr ibn al-As

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আমর ইবনে উমাইয়া আদ-দামরি রা. – Expedition of Amr bin Umayyah al-Damri

ইবনে হিশাম বলেন, ‘কোনো কোনো আলেম আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দেখলাম, আমার কিছু গাভী জবেহ করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গাভী দ্বারা উদ্দেশ্য আমার কিছু সাহাবি শহিদ হবেন। আর তরবারি ভাঙন এই ইঙ্গিত বহন করে যে, আমার বংশের এক ব্যক্তি শাহাদাত লাভ করবেন।’[25]

অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অভিমত সাহাবিদের জানালেন, এবার তারা মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করবেন না। যদি মক্কার বাহিনী মদিনা আক্রমণ করে, তবে তারাও পাল্টা আক্রমণ করবে। অধিকাংশ মুহাজির ও আনসার নারীদের বহিঃদুর্গে পাঠিয়ে দেওয়ার এবং শহরে অবস্থান করে শত্রু শক্তিকে প্রতিহত করার পক্ষে মত ব্যক্ত করলেন। তাদের কেউ কেউ বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা আমাদের সামনে কাঙ্ক্ষিত দিনটি এনে দিয়েছেন। অতঃপর আপনি আমাদের নিয়ে শত্রুদের দিকে বের হয়ে পড়ুন, যাতে তারা আমাদের কাপুরুষ ভাববার সুযোগ না পায়।’[26]

এই উৎসুক দলের অগ্রে ছিলেন হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু, সাদ ইবনে উবাদা, নুমান ইবনে মালিক ইবনে সালাবা রাযিয়াল্লাহু আনহু-সহ প্রমুখ সাহাবি। আবু সাঈদ খুদরি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পিতা মালিক ইবনে সিনান রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কসম! আমরা বিজয় অথবা শাহাদাত এই দুইটি কল্যাণের যেকোনো একটি অবশ্যই লাভ করব।’ হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু মদিনার বাইরে গিয়ে শত্রুদের সাথে যুদ্ধের পূর্বে কোনো খাদ্য গ্রহণ করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করলেন। বর্ণিত আছে, ‘হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু রোজা অবস্থাতেই যুদ্ধ করতে করতে শাহাদাত লাভ করেন।’[27]

অধিকাংশ সাহাবির প্রস্তাব যখন মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার পক্ষে এলো, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মতকেই সমর্থন করলেন। সকলের মধ্যে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘তোমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।’

জুমার পর তিনি জিহাদ সম্পর্কে সকলকে উপদেশ ও উৎসাহ দিলেন। রণক্ষেত্রে দৃঢ় থাকার আদেশ দিয়ে বললেন, ‘ধৈর্যধারণ ও যথাযথ কর্তব্য পালন করতে পারলে তোমরা বিজয়ী হবে।’ তিনি এই আয়াতটি পাঠ করলেন,

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়, যদি তোমরা ধৈর্যধারণ করো এবং সাবধান হয়ে চলো, তবে তারা দ্রুত গতিতে তোমাদের উপর আক্রমণ করলে আল্লাহ পাঁচ হাজার চিহ্নিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন।’[28]

এদিন মালিক ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু নামে একজন আনসার ইনতেকাল করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জানাজা শেষে সকলকে প্রস্তুত হয়ে আসতে বলেন।[29]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাদ আসর অস্তঃপুরে প্রবেশ করে রণসাজে সজ্জিত হতে লাগলেন। দুটি বর্ম দিয়ে অঙ্গ আচ্ছাদিত করলেন। অপরদিকে সাহাবায়ে কেরাম রণসাজে সজ্জিত হয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। সাদ ইবনে মুআজ ও উসাইদ ইবনে হুজাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসলিম সৈন্যদের বললেন, ‘হে লোকসকল! তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করা ঠিক হয়নি। সুতরাং ভেবে দেখো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সিদ্ধান্তের ভার ন্যস্ত করা যায় কি না।’ তখন সকলেই কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপূর্ব রণসাজে সজ্জিত হয়ে আবু বকর ও উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সাথে নিয়ে সাহাবিদের সম্মুখে উপস্থিত হলে সাহাবিগণ বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা লজ্জিত, আপনার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করা আমাদের সমীচীন হয়নি। আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। আপনি যুদ্ধের পোশাক খুলে ফেলুন।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, ‘কোনো নবীর পক্ষেই যুদ্ধের পোশাক পরিধান করার পর তা খুলে ফেলা শোভনীয় নয়, যতক্ষণ না আল্লাহ তায়ালা তার ও শত্রুদের মাঝে ফায়সালা করে দেন।’[30]

এই যুদ্ধ কোন তারিখে হয়—এ সম্পর্কে অনেক মতামত পাওয়া যায়। অধিকাংশের মতে, তৃতীয় হিজরি শাওয়াল মাসের এগারো তারিখের রাত অতিক্রান্ত হওয়ার পর এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সফিউর রহমান মোবারকপুরিসহ কোনো কোনো আলেমের মতে শাওয়ালের সপ্তম রাত অতিক্রান্ত হওয়ার পরে, আবার কেউ কেউ ১৫ শাওয়ালে উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।[31]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যবাহিনীকে তিনটি দলে বিভক্ত করলেন।

(ক) মুহাজিরদের দল : এই দলের পতাকা দিলেন মুসআব ইবনে উমায়ের আল-আবাদি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে। মুসআব শাহাদাত লাভ করলে আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তা দেবেন।

(খ) আনসারদের আওস গোত্রের পতাকা দিলেন উসাইদ ইবনে হুজাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে।

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ – Expedition of Abu Ubaidah ibn al Jarrah

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু কাতাদা ইবনে রিবঈ – Expedition of Abu Qatadah ibn Rab’i al-Ansari (Batn Edam)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু সালামা – Expedition of Qatan

(গ) আনসারদের খাযরাজ গোত্রের পতাকা দিলেন হুবাব ইবনুল মুনজির, মতান্তরে সাদ ইবনে উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে।[32]

আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে মদিনার দায়িত্বভার অর্পণ করে তিনি শত্রুর মোকাবিলায় বের হলেন। মুসলিম নারীদের সুরক্ষিত স্থানে প্রেরণ করলেন। অবশ্য আয়েশা, উম্মু উমারা, সাফিয়্যা বিনতে আবদুল মুত্তালিব, ফাতিমা, হামনা বিনতে জাহাশ রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ দশ পনেরাজন মুসলিম নারী আহত সৈন্যদের সেবা-শুশ্রুষা, তাদের পানি পান করানো এবং মদিনা থেকে খাবার সংগ্রহ করার জন্য যুদ্ধে শরিক হয়েছিলেন।

এই যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যসংখ্যা ছিল এক হাজার। তন্মধ্যে একশোজন বর্মধারী, পঞ্চাশজন তিরন্দাজ, পঞ্চাশজন অশ্বারোহী, বাকি সবাই পদাতিক। মুসা ইবনে উকবা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘এই যুদ্ধে মুসলমানদের সাথে কোনো অশ্ব ছিল না। ওয়াকিদির মতে দুটি অশ্ব ছিল। একটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের, অপরটি আবু বুরদা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর।’[33]

মদিনা সনদের শর্তানুযায়ী সেখানকার ইহুদিরা বহিঃআক্রমণে মুসলমানদের সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। কিন্তু তাদের ধর্মীয়শাস্ত্রে ‘সাব্ত’ তথা শনিবারে যুদ্ধ অবৈধ এই অজুহাত তুলে তারা সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকে। ইবনে সাদ-এর বর্ণনা অনুযায়ী, বনু কায়নুকার আত্মীয় কিছুসংখ্যক ইহুদি দুরভিসন্ধিমূলকভাবে মুসলমানদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলে সন্দেহপরায়ণ হয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সৈন্যভুক্ত করতে অসম্মত হলেন।[34]

মুসলিম বাহিনী মদিনা থেকে বের হয়ে যখন শাইখান নামক স্থানে পৌঁছাল, তখন সৈন্য পরীক্ষা করা হলো। অল্পবয়স্ক ও যুদ্ধের জন্য অনুপযুক্ত বলে যাদের ফেরত পাঠানো হলো, তাদের মধ্যে ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে উমর ইবনুল খাত্তাব, উসামা ইবনে জায়েদ, উসাইদ ইবনে হুদাইর, জায়েদ ইবনে সাবিত, জায়েদ ইবনে আরকাম, আরাবায়া ইবনে জুবাইর, আমর ইবনে হাজম, আবু সাঈদ আল-খুদরি, জায়েদ ইবনে হারিসা আল-আনসারি, সাদ ইবনে হুবাব, বারাআ ইবনে হাজম প্রমুখ।[35]

আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গকারীদের এমন বিস্ময়কর নমুনা ছিল, রাফে ইবনে খাদিজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে যখন বলা হলো, ‘তুমি বয়সে ছোট, বাড়ি ফিরে যাও’, তখন তিনি পায়ের আঙুলের উপর ভর করে বুক টান করে দাঁড়ালেন, যাতে উঁচু দেখা যায়। তার এই কৌশল ফলপ্রসূ হলো। তিনি সৈন্যবাহিনীতে থাকার অনুমতিপ্রাপ্ত হলেন।[36] অন্য বর্ণনায় উল্লেখ আছে, রাফে রাযিয়াল্লাহু আনহু অল্পবয়স থেকেই তির নিক্ষেপে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতে পেরে তাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দিয়েছিলেন। রাফে রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সমবয়সি ছিলেন সামুরা নামে অপর এক বালক। তিনি যুক্তি দাঁড় করালেন, ‘আমি কুস্তিতে রাফেকে পরাজিত করতে পারি। তাকে যদি যুদ্ধে নেওয়া হয়, তবে আমাকেও নিতে হবে।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দুজনকে কুস্তিতে লাগিয়ে দিলেন। সামুরা রাফেকে কুস্তিতে পরাস্ত করলে তাকেও সৈন্যদলে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হলো।[37] মুসলিম বাহিনী যাত্রাকালে এই শাইখান নামক স্থানেই সন্ধ্যা নেমে এলো। তারা মাগরিব ও পরে ইশার নামাজ আদায় করলেন এবং এখানেই রাত্রিযাপন করলেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা আল-আনসারির নেতৃত্বে পঞ্চাশজন সৈন্যের এক বাহিনীকে রাতের পাহারায় নিযুক্ত করেন। যাকওয়ান ইবনে আবদ কায়েস বিশেষভাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাকে পাহারা দেন।[38] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষরাতে আবার যাত্রা শুরু এবং শাওত নামক স্থানে পৌঁছে ফজরের নামাজ আদায় করলেন। মুসলিম বাহিনী শত্রু বাহিনীর নিকটবর্তী হয়ে গিয়েছিল। উভয় বাহিনী পরস্পরকে দেখছিল। মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তখন তিনশত সৈন্য নিয়ে এই বলে দল ত্যাগ করল, ‘আমরা জানি না কীসের জন্য নিজেদের হত্যার পথে ঠেলে দেব?’ সে আরও যুক্তি দেখাল, ‘মুহাম্মাদ তার মতামত প্রত্যাখ্যান করেন এবং অন্যদের মতামত গ্রহণ করেন।’ এই মুনাফিক নেতার কথা ছিল দুরভিসন্ধিমূলক অর্থাৎ মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে বিভেদ, আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। সে তার উদ্দেশ্যে কিছুটা সফলও হয়েছিল। বনু হারিসা ও বনু সালামা গোত্রের লোকেরা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের মনকে সুদৃঢ় করেন। এই সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

إِذْ هَمَّتْ طَائِفَتَانِ مِنْكُمْ أَنْ تَفْشَلَا وَاللَّهُ وَلِيُّهُمَا وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ

‘যখন তোমাদের মধ্যে দুই দলের সাহস হারাবার উপক্রম হয়েছিল এবং আল্লাহ উভয়ের সহায়ক ছিলেন, আর আল্লাহর প্রতিই যেন মুমিনগণ নির্ভর করে।’[39]

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পিতা আবদুল্লাহ ইবনে হারাম রাযিয়াল্লাহু আনহু এই কঠিন মুহূর্তে তাদের কর্তব্যের কথা স্মরণ করে দিতে থাকলেন এবং যুদ্ধে ফিরে আসার জন্য অনুপ্রাণিত করতে লাগলেন। কিন্তু তারা বলল, যদি জানতাম তোমরা যুদ্ধ করতে পারবে, তবে আমরা ফিরে যেতাম না। প্রত্যাবর্তন করাতে অপারগ হয়ে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম তাদেরকে লক্ষ করে বললেন, ‘হে দুশমনরা! আল্লাহ তোমাদের নিজ রহমত থেকে দূরে রাখুন। অচিরেই আল্লাহ তার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তোমাদের থেকে অমুখাপেক্ষী করে দেবেন।’[40] আল্লাহ তায়ালা মুনাফিকদের এই গোপন নিফাক স্পষ্ট করে দিয়ে ইরশাদ করেন,

فَمَا لَكُمْ فِي الْمُنَافِقِينَ فِئَتَيْنِ وَاللَّهُ أَرْكَسَهُمْ بِمَا كَسَبُوا أَتُرِيدُونَ أَنْ تَهْدُوا مَنْ أَضَلَّ اللَّهُ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ سَبِيلًا

‘তোমাদের কী হলো যে, মুনাফিকদের সম্বন্ধে দুই দল হয়ে পড়লে, যখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন—তোমরা কি তাকে সৎপথে পরিচালিত করতে চাও? আর আল্লাহ কাউকেও পথভ্রষ্ট করলে তুমি তার জন্য কখনো কোনো পথ পাবে না।’[41]

অবশিষ্ট সাতশত সৈন্য নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হলেন। শত্রুরা উহুদ প্রান্তরে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকার দরুন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এমন কে আছে, আমাদের শত্রু বাহিনীর পাশ কাটিয়ে বিকল্প পথ দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে?’ তখন আবু খায়সামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আমি পারব।’ অতঃপর তিনি বনু হারিসা গোত্রের শস্যক্ষেত্রের পাশ দিয়ে সংক্ষিপ্ত পথে কাফের বাহিনীকে পশ্চিমে রেখে সারবা ইবনে কায়নাতি নামক অন্ধ মুনাফিকের খেজুর বাগানের পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করতে লাগলেন। তখন ওই অন্ধ মুনাফিক মুসলমানদের মুখে মাটি নিক্ষেপ করে বলতে লাগল, ‘তুমি যদি রাসুল হও, তবে আমার বাগানে প্রবেশাধিকার তোমার নেই।’ মুসলমানগণ এই কথা শুনে তাকে হত্যার জন্য উদ্‌গ্রীব হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাকে হত্যা কোরো না। কারণ সে চোখ এবং অন্তর উভয় দিকেই অন্ধ।’

অতঃপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদ পাহাড় সংলগ্ন উপত্যকায় ওই সংক্ষিপ্ত পথ দিয়ে গিয়ে অবতরণ করেন। মদিনাকে সামনে রেখে উহুদ পাহাড়কে পেছনে রেখে এমনভাবে সৈন্য মোতায়েন করেন, কাফের বাহিনী মদিনা ও মুসলমানদের মধ্যখানে পড়ে যায়।[42] পাহাড়ের অর্ধবৃত্ত ময়দানের অভ্যন্তরে অধিকতর সংরক্ষিত স্থানে মুসলিম বাহিনী ছাউনি স্থাপন করলেন। সৈন্যদের তিরের ন্যায় সোজা সারিবদ্ধ করা হলো। উহুদ পাহাড়ের পূর্ব পাদদেশকে পশ্চাতে রাখা হয় যাতে সকালের সূর্যরশ্মি চোখে না পড়ে। জাবাল রুমাতের গিরিপথে পশ্চাৎ দিক থেকে আক্রমণের আশঙ্কায় দূরদর্শী সেনানায়ক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের ইবনে নুমান আনসারি আল-আওসি আল-বদরি রাযিয়াল্লাহু আনহু- এর নেতৃত্বে পঞ্চাশজনের এক তিরন্দাজ বাহিনী সেখানে মোতায়েন করেন। এই জাবাল রুমাতটি মুসলিম সৈন্য শিবিরের ১৫০ মিটার পূর্ব-দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত ছিল। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জয়-পরাজয় যেকোনো অবস্থাতেই পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত এই স্থান ত্যাগ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে লক্ষ করে বলেন,

إِنْ رَأَيْتُمُونَا ظَهَرْنَا عَلَيْهِمْ فَلَا تَبْرَحُوا وَإِنْ رَأَيْتُمُوهُمْ ظَهَرُوا عَلَيْنَا فَلَا تُعِينُونَا

‘যদি তোমরা দেখো, আমরা তাদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছি, তা হলেও তোমরা এই স্থান থেকে সরবে না। আর যদি দেখো, তারা আমাদের উপর বিজয় লাভ করেছে, তা হলেও তোমরা স্বীয় স্থান ত্যাগ করে আমাদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসবে না।’[43]

বুখারি শরিফের অন্য বর্ণনায় আছে,

إِنْ رَأَيْتُمُونَا تَخْطَفُنَا الطَّيْرُ فَلَا تَبْرَحُوا مَكَانَكُمْ هَذَا حَتَّى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ وَإِنْ رَأَيْتُمُونَا هَزَمْنَا الْقَوْمَ وَأَوْطَأْنَاهُمْ فَلَا تَبْرَحُوا حَتَّى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ

‘যদি তোমরা দেখো, পাখিরা আমাদের গোশত ছিড়ে ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে, তবু তোমরা পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তোমাদের স্থান ত্যাগ করবে না। আর যদি দেখো আমরা শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করে এবং তাদের বিতাড়িত করেছি, তবু পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই স্থান ত্যাগ করবে না।’[44]

বাকি সৈন্য বাহিনী থেকে মুনজির ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডানপাশে এবং জুবাইর ইবনুল আওয়াম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বামপাশে দাঁড় করালেন। বনু আবদুদ দারের মুসআব ইবনে উমায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের পতাকা দিলেন। জুবাইর ইবনুল আওয়াম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত করে হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে বর্মহীন সৈন্যদের পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পণ করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে শুধু ধর্ম প্রচারকই নন, অসাধারণ রণকুশলী এবং শ্রেষ্ঠ সমরনেতাও বটে। উহুদ যুদ্ধে সামরিক কায়দায় সৈন্যদের সুশৃঙ্খলভাবে সারিবদ্ধ করা থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।[45]

কুরাইশগণ বদরের যুদ্ধে উপযুক্ত শিক্ষা পেয়েছিল। তাই এবার তারা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলার সাথে কাতারবন্দি হলো। দক্ষিণে খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ, পেছনে আবু জাহলের পুত্র ইকরামাকে সৈন্যসহ নিযুক্ত করা হলো। কুরাইশ বংশের নামকরা ধনী সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া নিযুক্ত হলো অশ্বারোহী বাহিনীর পরিচালক। তিরন্দাজ বাহিনীর প্রধান ছিল আবদুল্লাহ ইবনে আবু রাবিআ। পতাকা ছিল তালহার হাতে। অতিরিক্ত হিসেবে দুইশত ঘোড়াও প্রস্তুত রেখেছিল।[46]

আরো পড়ুন : সাফওয়ানা অভিযান – First Expedition to Badr (Safwan)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস রা. – Expedition of Abdullah Ibn Unais

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা রা. – ‘Abdullah ibn Hudaffa

যুদ্ধের প্রারম্ভে কুরাইশ নারীরা দফ বাজনার তালে তালে নৃত্য করে কবিতা আবৃত্তি করতে করতে অগ্রসর হলো। এসব কবিতার মূল বিষয় ছিল বদরযুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের উপর শোক প্রকাশ করা এবং তাদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কুরাইশ বাহিনীকে উত্তেজিত করা। তাদের কবিতার শ্লোক ছিল এই ধরনের,

إنْ تُقْبِلُوا نُعَانِقْ … وَنَفْرِشُ النَّمَارِقْ

أَوْ تُدْبِرُوا نُفَارِقْ … فِرَاقَ غَيْرَ وَامِقْ

‘যদি তোমরা অগ্রসর হও, তবে তোমাদের জন্য শয্যা রচনা করব। তোমাদের আলিঙ্গন করব। আর যদি পশ্চাৎপদ হও, তবে তোমাদের সাথে বিচ্ছেদ, অসন্তোষের চিরবিচ্ছেদ।[47]

উভয় পক্ষ উহুদ প্রান্তরে মুখোমুখি হলে মদিনার আওস গোত্রীয় প্রবীণ ধর্মযাজক আবু আমের প্রথম যুদ্ধের সূত্রপাত করে। সে ছিল মদিনার শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। পরে মক্কায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন। জাহিলি যুগে পবিত্রতা ও ধার্মিকতার জন্য মদিনাবাসীগণ তাকে সম্মানের চোখে দেখত। তার ধারণা ছিল, মদিনার আনসারগণ তাকে দেখামাত্রই মুহাম্মাদের দীন ও সঙ্গ ছেড়ে তার অনুগত হবে ৷ সে যুদ্ধের ময়দানে এসে উচ্চ আওয়াজে বললেন, ‘হে আওস সম্প্রদায়! অমি আবু আমের, আমাকে চিনতে পেরেছ কি?’ আনসারগণ বললেন, ‘হ্যাঁ পাপিষ্ঠ! আমরা তোমাকে চিনতে পেরেছি। আল্লাহ তোমার আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণই রাখবেন।’[48]

আক্রমণের পূর্বে কুরাইশদের পতাকা বেষ্টন করে হিন্দ তার অনুগামীদের সাথে নিয়ে চিৎকার করে বলছিল, ‘হে আবদুদ দারের সন্তানগণ! হে মাতৃভূমির প্রহরীগণ! শত্রুর উপর আঘাতের পর আঘাত হানো।’[49]

অতঃপর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল৷ কুরাইশ পক্ষের পতাকাবাহী তালহা ইবনে আবু তালহা এগিয়ে এসে আহ্বান জানাল, ‘হে মুসলমানগণ! তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে আমাকে তাড়াতাড়ি জাহান্নামে পাঠিয়ে দেবে অথবা আমার হাতে নিহত হয়ে জান্নাতে চলে যাবে!’ তালহার এই প্রতিবাদে আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু এগিয়ে এসে তরবারির আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করলেন। অতঃপর যুদ্ধের পতাকা তার ভাই আবু শাইবা উসমান ইবনে আবু তালহা তুলে নিল এবং এই বলে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হলো, ‘পতাকাবাহীর কর্তব্য হলো বল্লমকে রক্তে রঞ্জিত করা অথবা তা টুকরা টুকরা হয়ে যাওয়া।’[50]

হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে প্রতিহত করতে এগিয়ে এলেন এবং তার তলোয়ারের আঘাত তার নাভী পর্যন্ত পৌঁছাল। এরপর তার ভাই আবু সাদ ইবনে তালহা যুদ্ধের পতাকা তুলে ধরলে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে হত্যা করলেন। পরে মুসাফা ইবনে তালহা ইবনে আবু তালহা পতাকা তুলে নিলে আসেম ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে তির নিক্ষেপের মাধ্যমে হত্যা করলেন। এরপর তার ভাই কিলাব ইবনে তালহা ইবনে আবু তালহা পতাকা উঠালে জুবাইর ইবনুল আওয়াম রাযিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধ করে তাকে নিহত করলেন। অতঃপর তার ভাই জাল্লাস ইবনে তালহা ইবনে আবু তালহা পতাকা উঠালে তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে আঘাত করে হত্যা করলেন। আবু তালহা আবদুল্লাহ ইবনে উসমান ইবনে আবদিদ দার-এর পরিবারের এই ছয়জন পতাকাধারী পর্যায়ক্রমে নিহত হওয়ার পর বনু আবদুদ দারের আরতাত ইবনে শুরাহাবিল পতাকা তুলে ধরলে আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু মতান্তরে হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে নিহত করলেন। পরে শুরাইহ ইবনে কুরজ পতাকা উঠালে কুজমান (সে মুনাফিক ছিল, কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য মুসলমানদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল) তাকে হত্যা করল। এরপর পর্যায়ক্রমে আবু যায়, আমর ইবনে আবদে মানাফ আল-আবদারি এবং ইবনে হিশাম আল-আবদারি পতাকা বহন করলে কুজমান তাদের উভয়কে পরপর হত্যা করল। বনি আবদুদ দারের আর কেউ পতাকা বহন করার মতো অবশিষ্ট ছিল না। অবশেষে ‘সাওয়াব’ নামে তাদের এক হাবশি গোলাম পতাকা উঠিয়ে যুদ্ধ করলে তার হাত কেটে যায়। ঘাড় ও বুক দিয়ে পতাক উড্ডীন রাখতে সে চেষ্টা করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিহত হয়।[51]

উভয় পক্ষের যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন একটি তরবারি হাতে নিয়ে সাহাবিদের লক্ষ করে বললেন, ‘কে আছো এটি গ্রহণ করবে? কে আছো এটির মর্যাদা রক্ষা করবে?’ শত শত বাহু তরবারি গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বে উত্তোলিত হলো। আবু দুজানা বললেন, ‘এটির দাবি কী ইয়া রাসুলাল্লাহ,’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, ‘বক্র না হওয়া পর্যন্ত দুশমনকে আঘাত করাই হলো এটির দাবি।’ আবু দুজানা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বিশেষ আবেদনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাতেই এই তরবারি অর্পণ করলেন। তিনি ছিলেন প্রথিতযশা আনসারি মুজাহিদ। উপরন্তু তার হাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরবারি এই অপ্রত্যাশিত গৌরব লাভে তিনি আত্মহারা হয়ে পড়লেন। মাথায় রুমাল বেঁধে সদর্পে বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গিতে বের হয়ে এলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এই ধরনের চলন আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয়, কিন্তু তা যুদ্ধের ময়দানে নয়।’[52]

ইবনে জুবাইর বলেন, ‘আমি মনে মনে ভাবলাম, আল্লাহর কসম! নিশ্চয় আমি দেখব আবু দুজানা কী করে? আমি তার পেছনে থাকলাম। শুনতে পেলাম, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও যুদ্ধের দৃঢ় মনোবল নিয়ে নিম্নের কবিতাটি আবৃত্তি করতে করতে অগ্রসর হচ্ছেন,

أَنَا الَّذِي عَاهَدَنِي خَلِيلِي … وَنَحْنُ بِالسَّفْحِ لَدَى النَّخِيلِ

أَلَّا أَقَوْمَ الدَّهْرَ فِي الْكَيُّولِ … أَضْرِبُ بِسَيْفِ اللَّهِ وَالرَّسُولِ

আমি সেই ব্যক্তি, যাকে আমার বন্ধু (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং আমরা খেজুর বাগানের পাশে যুদ্ধরত আছি। আমি পেছনের সারিতে কখনো অবস্থান করব না এবং আল্লাহ ও রাসুলের তরবারি দ্বারা আঘাত হানব।’[53]

আবু দুজানা রাযিয়াল্লাহু আনহু তরবারি নিয়ে শত্রুসৈন্য নিপাত করতে করতে অগ্রসর হচ্ছেন। ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, আবু দুজানা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘আমি দেখলাম একটা লোক দুশমনদের উত্তেজিত করছে, প্রাণপণে চিৎকার করছে। আমি তার দিকে ছুটে গিয়ে তরবারি দ্বারা আঘাত করতে গেলে সে চিৎকার দিয়ে উঠল! আমি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলাম সে এক নারী। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেওয়া তরবারির উপর আমার অগাধ শ্রদ্ধা। তাই তার দ্বারা কোনো নারীকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকলাম।[54]

হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছেন। তিনি দুই হাতে দুটি তরবারি নিয়ে শত্রু বাহিনীর ব্যুহের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। তার নেতৃত্বে মুসলিমগণ প্রচণ্ড আক্রমণ সাহসিকতার সাথে প্রতিহত করলেন। শত্রুপক্ষের বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে তাদের নিপাত করতে করতে আতঙ্কের সৃষ্টি করলেন। ইমাম বুখারির রহ.-এর বর্ণনায় ওয়াহশি বলল, ‘আমার মাওলা জুবায়ের ইবনে মুতইম আমাকে বলল, “তুমি যদি আমার চাচার প্রতিশোধস্বরূপ হামজাকে হত্যা করতে পারো, তবে তুমি আজাদ।”’ রাবি (আদি ইবনে খিয়ার) বলেন, সেই বছর উহুদ পাহাড় সংলগ্ন আয়নাইন পাহাড়ের উপত্যকায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে আমি সকলের সঙ্গে রওনা হলাম। এরপর লড়াইয়ের জন্য সকলেই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালে (কাফের সৈন্যদলের মধ্য থেকে) সিবা নামক এক ব্যক্তি ময়দানে এসে বলল, ‘দ্বন্দ্ব যুদ্ধের জন্য কেউ প্রস্তুত আছো কি?’ ওয়াহশি বলেন, তখন হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব রাযিয়াল্লাহু আনহু তার সামনে গিয়ে বললেন, ‘হে মেয়েদের খতনাকারিণী উম্মু আনমারের পুত্র সিবা! তুমি কি আল্লাহ ও তার রাসুলের সাথে দুশমনি করছো?’ বর্ণনাকারী বলেন, এরপর তিনি প্রচণ্ড আঘাত করলে সে নিহত হলো। ওয়াহশি বলল, ‘সেদিন আমি একটি পাথরের নিচে আত্মগোপন করে ওত পেতে বসে রইলাম। যখন তিনি (হামজা) আমার নিকটবর্তী হলেন, তখন আমি আমার অস্ত্র দ্বারা এমন জোরে আঘাত করলাম, তার মুত্রথলি ভেদ করে নিতম্বের মাঝখান দিয়ে বের হয়ে গেল। এটাই হলো তার শাহাদাতের মূল ঘটনা।’[55]

আরো পড়ুন : মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রা.-এর অভিযান – Expedition of Muhammad ibn Maslamah

আরো পড়ুন : যুল ক্বাসসাহর দ্বিতীয় অভিযান – Second expedition of Zul Qassah

আরো পড়ুন : যুল ক্বাসসাহর প্রথম অভিযান – First expedition of Dhul Qassah

আবু আমের কাফেরদের পক্ষে যুদ্ধ করছিল। অথচ তার পুত্র হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পছন্দ করলেন না। অতঃপর তিনি এক দুঃসাহসিক আক্রমণে কাফের সেনাধ্যক্ষ আবু সুফিয়ানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তলোয়ারের আঘাতে তাকে যখন হত্যা করার জন্য উদ্যত হলেন, ঠিক এমন সময় এক পার্শ্ব থেকে শাদ্দাদ ইবনে আসওয়াদ দ্রুত গতিতে তার তরবারির আঘাতকে প্রতিরোধ করে। এবং তার প্রতি আক্রমণে হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু শহিদ হন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘ফেরেশতাগণ হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে গোসল দিচ্ছেন, এটির কারণ অনুসন্ধান করো। তার স্ত্রী জামিলা এসে সংবাদ দিলেন, তিনি জুনুবী (তার উপর গোসল ওয়াজিব ছিল) অবস্থায় এসে যুদ্ধে শরিক হয়েছিলেন।’[56] মুসলিম বাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ করতে লাগল ও পাল্টা আক্রমণ প্রতিহত করতে লাগল। আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু, আবু দুজানা ও তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু-সহ অন্যান্য মুজাহিদদের বলিষ্ঠ ও দুর্জয় আক্রমণ মুসলিম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। খালিদ ইবনুল ওয়ালিদের অশ্বারোহী সেনাদল তিন তিনবার গিরিপথের পশ্চাৎ দিক থেকে আক্রমণের চেষ্টা করল। কিন্তু মোতায়েনকৃত তিরন্দাজ বাহিনীর বলিষ্ঠ প্রতিরোধের মুখে তারা ব্যর্থ হলো।[57]

মুসলিম বাহিনী ঈমানি জোশে উদ্বুদ্ধ হয়ে উপর্যুপরি আক্রমণে শত্রুদের দিশেহারা করে তুলল। অতঃপর মুসলমানদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ (রহমত) নাজিল হলো। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্যে পরিণত হলো।

মুসলমানদের ভাগ্যাকাশ থেকে বিপদের কালো মেঘ কেটে যাওয়ার লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে উঠল। তীব্র আক্রমণের সামনে কুরাইশ বাহিনী টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যেতে লাগল। নারীরাও হতোদ্যম হয়ে পিছু হটতে লাগল। মুসলমানগণ বিজয় প্রত্যক্ষ করলেন। বুখারি শরিফের হাদিসে বারাআ ইবনে আজেব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমরা তাদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে তারা পালাতে আরম্ভ করল। এমনকি আমরা দেখতে পেলাম, নারীরা দ্রুত দৌঁড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিচ্ছে। তারা পায়ের গোছা থেকে বস্ত্র টেনে উপরে তুলছে। ফলে তাদের পায়ের অলঙ্কারগুলো পর্যন্ত বের হয়ে পড়ছে।’[58]

 

মানচিত্র (২০) : উহুদ ময়দানের সাম্ভব্য নকশা

 

অতি উৎসাহের বশে মুসলিম সৈন্যগণ পলায়নপর শত্রুদের ফেলে যাওয়া মালে গনিমত আহরণে প্রবৃত্ত হলেন। গিরিপথে নিয়োজিত তিরন্দাজ সৈন্যগণও বিজয়ের উল্লাসে তাদের কঠিন কর্তব্যের কথা ভুলে গেলেন। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে ভেবে তারাও গনিমত সংগ্রহের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। গনিমত সংগ্রহের আকাঙ্ক্ষা তাদের মধ্যে দেখা দিল। মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَلَقَدْ صَدَقَكُمُ اللَّهُ وَعْدَهُ إِذْ تَحُسُّونَهُمْ بِإِذْنِهِ حَتَّى إِذَا فَشِلْتُمْ وَتَنَازَعْتُمْ فِي الْأَمْرِ وَعَصَيْتُمْ مِنْ بَعْدِ مَا أَرَاكُمْ مَا تُحِبُّونَ مِنْكُمْ مَنْ يُرِيدُ الدُّنْيَا وَمِنْكُمْ مَنْ يُرِيدُ الْآخِرَةَ ثُمَّ صَرَفَكُمْ عَنْهُمْ لِيَبْتَلِيَكُمْ وَلَقَدْ عَفَا عَنْكُمْ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ

আল্লাহ তোমাদের সাথে তার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলেন, যখন তোমরা আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদের বিনাশ করছিলে, যে পর্যন্ত না তোমরা সাহস হারালে এবং নির্দেশ সম্বন্ধে মতভেদ সৃষ্টি করলে এবং যা তোমরা ভালোবাসো, তা তোমাদের দেখানোর পর তোমরা অবাধ্য হলে। তোমাদের কেউ ইহকাল চাচ্ছিল এবং কতক পরকাল চাচ্ছিল। অতঃপর তিনি পরীক্ষা করার জন্য তোমাদের তাদের থেকে ফিরিয়ে দিলেন। অবশ্য তিনি তোমাদের ক্ষমা করলেন এবং আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহশীল।’[59]

তারা পরস্পরকে বলতে লাগলেন, এই যে গনিমত! তিরন্দাজ বাহিনীর নেতা আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই স্থান ত্যাগ না করার নির্দেশ স্বরণ করিয়ে দিলেন। কিন্তু তারা সেই কথা অগ্রাহ্য করলেন। তাদের চল্লিশজন সৈন্য ময়দানে নেমে এসে গনিমত সংগ্রহ করতে লাগলেন। আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু-সহ মাত্র ১০ জন, মতান্তরে ১২ জন সৈন্য গিরিপথে অবশিষ্ট রইলেন।

আরো পড়ুন : বদরের যুদ্ধ – Battle of Badr

আরো পড়ুন : বনু সুলাইম অভিযান – Al Kudr Invasion

আরো পড়ুন : বাতনে রাগিব অভিযান – Expedition of Ubaydah ibn al-Harith

গিরিপথ শূন্যতায় দেখে সুচতুর খালিদ ইবনে ওয়ালিদ এই সুযোগ কাজে লাগাল। সে পশ্চাৎ দিক থেকে অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে আকস্মিক আক্রমণ করল। আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু নয়জন সৈন্য নিয়ে বাধা দিতে গিয়ে শহিদ হলেন। খালিদের অশ্বারোহী বাহিনী সজোরে চিৎকার করে কুরাইশ সৈন্যদের আহ্বান জানাল। পলায়নপর কাফের সৈন্যদল আবার ফিরে এলো। উমারা বিনতে আলকামা আল-হারিসা মাটিতে পড়ে থাকা কুরাইশদের যুদ্ধ পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরল। একজন অন্যজনকে আহ্বান করতে লাগল। ফলে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আবার একত্র হলো এবং মুসলিম বাহিনীকে অগ্র-পশ্চাৎ উভয় দিক থেকে বেষ্টন করে ফেলল।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন নয়জন সাহাবি সাথে নিয়ে মুসলিম সৈন্যবাহিনীর পেছনে থেকে তাদের রণনৈপুণ্য ও কাফেরদের পর্যুদস্ত করার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছেন। এমতাবস্থায় খালিদ ইবনে ওয়ালিদের আকস্মিক হামলায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল; (ক) হয় তিনি নয়জন সাথিকে নিয়ে একটি নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করবেন এবং তার সৈন্যবাহিনীকে তাদের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেবেন; অথবা (খ) সকলকে তার নিকট একত্র হওয়ার আহ্বান জানাবেন এবং কাফের বাহিনী কর্তৃক বেষ্টিত মুসলিম সৈন্যদের উহুদে নিয়ে আসার জন্য একটি রাস্তা বের করার শক্তি অর্জন করবেন। এখানেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অতুলনীয় বীরত্ব প্রকাশ পায়। তিনি উচ্চকণ্ঠে ‘ইয়া ইবাদাল্লাহ’ (হে আল্লাহর বান্দাগণ!) বলে মুসলমানদের আহ্বান জানালেন। অথচ তিনি জানতেন, মুসলমানগণ তার ধ্বনি শোনার পূর্বেই কাফেররা শুনতে পাবে। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি এই ভয়াবহ অবস্থাতেই তাদের আহ্বান করলেন। কার্যত তার অবস্থানের ব্যাপারে কাফেররা জানতে পারল এবং মুসলমানগণ তার কাছে পৌঁছার পূর্বেই কাফের কর্তৃক তিনি আক্রান্ত হলেন।[60]

আকস্মিক বিপদে কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুসলিম সৈন্যগণ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়লেন। কেউ মদিনার দিকে ধাবিত হলেন, আবার কোনো দল পাহাড়ে আরোহণ করতে লাগলেন। অনেকেই আবার কাফের বাহিনীর ভেতরে পড়ে গেলেন। এই অবস্থায় তরবারি চালাতে গিয়ে নিজ সৈন্যদের উপরও কেউ কেউ আঘাত হেনেছেন। শত্রু-মিত্র একাকার হয়ে গেল। এই সময় হুজায়ফা রাযিয়াল্লাহু আনহু দেখতে পেলেন, মুসলিমগণ তার পিতা ইয়ামানের উপর আঘাত করছেন। তখন তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! ইনি তো আমার পিতা, তাকে আঘাত করবেন না।’ বর্ণনাকারী আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আল্লাহর কসম! তাতে তারা বিরত হলেন না; বরং তাকে হত্যা করলেন।’ তখন হুজায়ফা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।’ উরওয়া রহ. বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত হুজাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মনে এই ঘটনার অনুতাপ বাকি ছিল।’[61] এহেন বিভীষিকাময় মুহূর্তে মুসলিম সৈন্যগণ শুনতে পেলেন, জনৈক ব্যক্তি চিৎকার করে বলছে, ‘মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে।’ এই সংবাদে মুসলমানদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এলো। তাদের মানসিক মনোবল ভেঙে পড়ল। আনাস ইবনে নাদর রাযিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধ করছেন। তিনি এক স্থানে গিয়ে দেখলেন, উমর ও তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু কিছুসংখ্যক সৈন্য নিয়ে হতাশ হয়ে বসে আছেন। আল্লাহর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ায় নেই, যুদ্ধ করে আর কী হবে? আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘জীবিত থেকেই বা তোমরা কী করবে! নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পথে জীবন দিলেন, তোমরাও সেই পথে কুরবান হও।’ এরপর তিনি বললেন, যা বুখারির বর্ণনায় এভাবে এসেছে,

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعْتَذِرُ إِلَيْكَ مِمَّا صَنَعَ هَؤُلَاءِ يَعْنِي الْمُسْلِمِينَ وَأَبْرَأُ إِلَيْكَ مِمَّا جَاءَ بِهِ الْمُشْرِكُونَ فَتَقَدَّمَ بِسَيْفِهِ فَلَقِيَ سَعْدَ بْنَ مُعَاذٍ فَقَالَ أَيْنَ يَا سَعْدُ إِنِّي أَجِدُ رِيحَ الْجَنَّةِ دُونَ أُحُدٍ فَمَضَى فَقُتِلَ فَمَا عُرِفَ حَتَّى عَرَفَتْهُ أُخْتُهُ بِشَامَةٍ أَوْ بِبَنَانِهِ وَبِهِ بِضْعٌ وَثَمَانُونَ مِنْ طَعْنَةٍ وَضَرْبَةٍ وَرَمْيَةٍ بِسَهْمٍ.

‘হে আল্লাহ! এই সমস্ত লোক অর্থাৎ মুসলমানগণ যা করল, আমি এর জন্য তোমার নিকট ওজরখাহি করছি এবং মুশরিকগণ যা করল, তা থেকে আমি আমার সম্পর্কহীনতা ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছি। এরপর তিনি তলোয়ার নিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে শত্রুদের মাঝে ঢুকে পড়লেন। এই সময় সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে তার সাক্ষাৎ হলো। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, হে সাদ! তুমি কোথায় যাচ্ছ? আমি উহুদের অপর প্রান্ত থেকে জান্নাতের খোশবু পাচ্ছি। এই বলে তিনি যুদ্ধ করলেন এবং শহিদ হলেন। যুদ্ধ শেষে তাকে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। অবশেষে তার ভগ্নি তার শরীরের একটি তিল অথবা আঙ্গুলের মাথা দেখে তাকে শনাক্ত করলেন। তার শরীরে ৮০টিরও বেশি বর্শা, তরবারি ও তিরের আঘাত ছিল।’[62]

আরো পড়ুন : গাজওয়া হুনাইন – Battle of Hunayn

আরো পড়ুন : গাজওয়াতুল বুহরান – Invasion of Buhran

আরো পড়ুন : নাখলা অভিযান – Nakhla Raid

কিছুসংখ্যক মুসলিম সৈন্যের এহেন হতাশাব্যঞ্জক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ تَوَلَّوْا مِنْكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ إِنَّمَا اسْتَزَلَّهُمُ الشَّيْطَانُ بِبَعْضِ مَا كَسَبُوا وَلَقَدْ عَفَا اللَّهُ عَنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ حَلِيمٌ

‘যেদিন দুই দল পরস্পর সম্মুখীন হয়েছিল, সেদিন তোমাদের মধ্য থেকে যারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল, তাদের কৃতকর্মের জন্য শয়তানই তাদের পদস্খলন ঘটিয়েছিল। অবশ্য আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন। আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ ও পরম সহনশীল।’[63]

সাবিত ইবনুদ দাহদাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার কওমকে লক্ষ করে বলতে লাগলেন, ‘হে আনসারগণ! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি নিহতও হয়ে থাকেন, আল্লাহ তো অমর, চিরঞ্জীব। তোমরা তোমাদের ধর্মকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করো। আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন ও বিজয় দান করবেন।’ তার আহ্বানে আনসারদের একটি দল খালিদ ইবনে ওয়ালিদের একটি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে লাগলেন, কিন্তু খালিদ তাকে ও তার সাথিদের বর্শার আঘাতে শহিদ করল।[64] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের একমাত্র লক্ষ্যস্থল হয়ে দাঁড়ালে তিনি আল্লাহর রাহে নিবেদিতপ্রাণ কয়েকজন সৈন্য নিয়ে শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করছেন। সাহাবিগণ নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করার জন্য ব্যূহ রচনা করেছিলেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মাত্র নয়জন সৈন্য অবশিষ্ট ছিল। ইমাম মুসলিম আনাস ইবনে মালিক রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বর্ণনায় উল্লেখ করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে উহুদের এই কঠিন মুহূর্তে সাতজন আনসার ও দুইজন কুরাইশ মুহাজির অবশিষ্ট ছিলেন। শত্রুবাহিনী আক্রমণ করলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

«مَنْ يَرُدُّهُمْ عَنَّا وَلَهُ الْجَنَّةُ؟ -» أَوْ «هُوَ رَفِيقِي فِي الْجَنَّةِ» -، فَتَقَدَّمَ رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ، فَقَاتَلَ حَتَّى قُتِلَ، فَلَمْ يَزَلْ كَذَلِكَ حَتَّى قُتِلَ السَّبْعَةُ،

‘কে আছো, আমাদের পক্ষ থেকে তাদের প্রতিহত করবে, বিনিময়ে সে জান্নাত লাভ করবে অথবা জান্নাতে আমার বন্ধু হবে। তখন একজন আনসার এগিয়ে এসে যুদ্ধ করলেন এবং শাহাদাত লাভ করলেন। এভাবে পরপর সাতজন আনসার শহিদ হলেন।’[65]

আনসারদের ওই সপ্তম ব্যক্তি ছিলেন আম্মারা ইবনে ইয়াজিদ ইবনে আস-সাকান রাযিয়াল্লাহু আনহু। এরপর তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে ছিলেন। তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু এই কঠিন বিপদে নিজের শরীরকে ঢাল বানিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করতে লাগলেন। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে যুদ্ধের অবস্থা দেখতে চান। আর তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু চমকিত হয়ে বলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, আপনি মাথা উঁচু করবেন না। হঠাৎ তাদের নিক্ষিপ্ত তির আপনার শরীরে লেগে যেতে পারে। আপনার বক্ষ রক্ষা করার জন্য আমার বক্ষই রয়েছে।’[66]

কাফেররা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে তির, বর্শা নিক্ষেপ করতে লাগল। উতবা ইবনে আবু ওয়াক্কাসের নিক্ষিপ্ত পাথরে তার ডান পাশের একটি দাঁত (رُباَعِيَّةْ) পড়ে গেল এবং নিচের ঠোঁট আঘাতপ্রাপ্ত হলো। কোনো কোনো বর্ণনায় উপরের এবং নিচের দুটি দাঁত অথবা চারটি দাঁত ভেঙে যায়। অন্য বর্ণনায় দাঁত চারটি সামান্য ভেঙে যায়, কিন্তু মাড়ি থেকে পড়ে যায়নি।[67] হাদিসে রুবাঈ দাঁত ভাঙার বর্ণনা উল্লেখ আছে। আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি রহ. বলেন,

وَهِي السن الَّتِي تلِي الثَّنية من كل جَانب، وللإنسان أَربع رباعيات.

‘সানিইয়্যার প্রত্যেক পার্শ্বস্থ দাঁতকেই রুবাঈ দাঁত বলে। প্রত্যেক মানুষের চারটি রুবাঈ দাঁত রয়েছে।’

হাদিসে রুবাঈ শব্দটিকে একবচন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাতে বুঝা যায়, একটি দাঁতই ভেঙেছিল। আরও পরিষ্কার করে বলা হয়েছে আবু সাঈদ খুদরি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদিসে। তিনি বলেন, উতবা ইবনে আবু ওয়াক্কাস বর্ণনা করেন,

هُوَ الَّذِي كسر ربَاعِية النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم السُّفْلى

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিচের পাটির রুবাঈ দাঁত ভেঙেছিল বলে বর্ণনা করেন।’[68] আর-রাহিকুল মাখতুমে আরও সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিচের পাটির ডান পাশের একটি দাঁত ভেঙে গিয়েছিল।’[69] এই কাজের দরুন উযযার বংশে কোনো ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি এবং তার মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হতো। সন্তান হলে এরূপ হতো যে, তাদের সামনের চার দাঁত উঠতো না।[70]

আরো পড়ুন : গাজওয়া যু-আমর – Dhu Amarr raid

আরো পড়ুন : গাজওয়া সারিয়্যা আর-রাজি – Expedition of Al Raji

আরো পড়ুন : গাজওয়া হামরাউল আসাদ – Battle of Hamra al-Asad

আবদুল্লাহ ইবনে শিহাব জুহরি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে অগ্রসর হয়ে তার কপালে আঘাত করে। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে কামিয়্যা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাঁধে প্রচণ্ড আঘাত হানে, পরে প্রথমবারের মতো মাথার পাশে আঘাত হানে। ফলে তার শিরোস্ত্রাণ ভেঙে গিয়ে তার দুটি কড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কপালে ঢুকে যায়। তিনি স্বীয় মুখমণ্ডল থেকে রক্ত পরিষ্কার করছিলেন আর বলছিলেন, ‘আমার এই রক্ত যদি জমিনে পতিত হয়, তবে তাদের উপর আকাশ থেকে আজাব নাজিল হবে।’[71] সহিহ বুখারিসহিহ মুসলিম-এর বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছিলেন,

«كَيْفَ يُفْلِحُ قَوْمٌ شَجُّوا نَبِيَّهُمْ، وَكَسَرُوا رَبَاعِيَتَهُ، وَهُوَ يَدْعُوهُمْ إِلَى اللهِ؟»، فَأَنْزَلَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ: {لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ}

‘যারা তাদের নবীকে আঘাত করে জখম করেছে, তার দাঁত ভেঙেছে, কেমন করে তাদের কল্যাণ হবে? তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন। তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়—“তিনি তাদের প্রতি ক্ষমাশীল হবেন অথবা তাদের শাস্তি দেবেন এই বিষয়ে আপনার করণীয় কিছুই নেই। কারণ তারা জালিম।”[72]

ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন, ‘তাবারানির বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বলছিলেন, যারা আল্লাহর রাসুলের চেহারা থেকে রক্ত ঝরিয়েছে, তাদের উপর আল্লাহর গজব খুব কঠিন হয়ে থাকে। এরপর তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন,

«اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِقَوْمِي فَإِنَّهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ»

হে আল্লাহ! আমার জাতিকে ক্ষমা করো, কেননা তারা জানে না।’[73]

অন্য বর্ণনায় আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«اللَّهُمَّ اهْدِ قَوْمِي فَإِنَّهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ »

‘হে আল্লাহ! আমার জাতিকে সৎপথে পরিচালিত করো, কেননা তারা অজ্ঞ।’[74]

তালহা ও সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত বীরত্বের সাথে কুরাইশদের আক্রমণ প্রতিহত করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করছেন। তারা উভয়ে ছিলেন আরবের প্রসিদ্ধ ও দক্ষ তিরন্দাজ। সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে তির তুলে দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

«ارْمِ فِدَاكَ أَبِي وَأُمِّي»

 

‘আমার পিতা-মাতা তোমার জন্য কুরবান হোক, তুমি তির নিক্ষেপ করো।’[75]

ইমাম বুখারি রহ. কায়েস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বর্ণনায় উল্লেখ করেন, তিনি বলেন,

رَأَيْتُ يَدَ طَلْحَةَ شَلَّاءَ وَقَى بِهَا النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ أُحُدٍ

‘আমি দেখলাম, তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাত অবশ হয়ে গেছে, তিনি ওই হাত উহুদ যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষার জন্য ব্যবহার করেন।’[76]

তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘হে আবু মুহাম্মাদ! তোমার আঙুলে কী হয়েছিল?’ তিনি বললেন, ‘মালিক ইবনে জুহাইর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে তির নিক্ষেপ করেছিল। তার লক্ষ্যও ঠিক ছিল। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করতে গিয়ে তিরের সামনে ঢালস্বরূপ নিজের হাত দ্বারা আড়াল করে রাখি। সেই তির এসে আমার আঙুলে লাগে এবং হাড় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে আঙুল কেটে যায়।’[77]

আরো পড়ুন : গাজওয়া মুরাইসি – Expedition of al-Muraysi’

আরো পড়ুন : গাজওয়া যাতুর-রিকা – Expedition of Dhat al-Riqa

আরো পড়ুন : গাজওয়া যি-কারাদ বা গাজওয়া গাবা – Expedition of Dhu Qarad

ইমাম তিরমিজি রহ. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু সম্বন্ধে ওই দিন বলেছিলেন,

مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى شَهِيدٍ يَمْشِي عَلَى وَجْهِ الأَرْضِ, فَلْيَنْظُرْ إِلَى طَلْحَةَ بْنِ عُبَيدِ اللهِ.

‘যে ব্যক্তি পৃথিবীতে কোনো শহিদকে বিচরণরত অবস্থায় দেখতে চায়, সে যেন তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহকে দেখে।’[78]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে কামিয়্যার প্রচণ্ড আঘাতে আবু আমেরের খননকৃত এক গর্তে পড়ে যান। কাব ইবনে মালিক রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বপ্রথম দেখতে পেলেন। তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘হে মুসলমানগণ! সুসংবাদ গ্রহণ করো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত আছেন।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ করতে নিষেধ করলেন। ইতিমধ্যে আবু বকর, উমর, আলি, হারেস, সাহল ইবনে হুনাইফ, মালিক ইবনে সিনান রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ মুহাজির ও আনসার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে এসে দাঁড়ালেন। বিক্ষিপ্ত মুজাহিদগণও সংবাদ পেয়ে একত্র হতে থাকলেন।

আঘাতের চোটে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিরস্ত্রাণটি কেটে গিয়ে তার দুটি কড়া তার কপালে ঢুকে গিয়েছিল। আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কপাল থেকে ওই কড়াদ্বয় বের করার জন্য প্রস্তুতি নিতেছিলাম, এমন সময় আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “হে আবু বকর! এই কাজটি করার সুযোগ আমাকে দিন। অতঃপর তিনি স্বীয় দাঁত দিয়ে শক্তভাবে কড়াদ্বয় কামড়িয়ে ধরে বের করলেন। তাতে তার দুটি দাঁত পড়ে গিয়েছিল।”’[79]

মুসলিম সৈন্যগণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বেষ্টন করে কাফেরদের আক্রমণ প্রতিহত ও পাল্টা আক্রমণ করতে লাগলেন। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য এলো। সহিহ বুখারিতে সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,

رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ أُحُدٍ وَمَعَهُ رَجُلَانِ يُقَاتِلَانِ عَنْهُ عَلَيْهِمَا ثِيَابٌ بِيضٌ كَأَشَدِّ الْقِتَالِ مَا رَأَيْتُهُمَا قَبْلُ وَلَا بَعْدُ.

‘আমি উহুদ যুদ্ধের দিন দেখলাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষে সাদা পোশাক পরিহিত দুই ব্যক্তি প্রচণ্ডবেগে যুদ্ধ করছে। ইতিপূর্বে এবং পরে তাদের আমি আর দেখিনি।’[80]

সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় আরও আছে, তারা ছিলেন জিবরাইল ও মিকাইল আলাইহিস সালাম।

এই সময় মুসলিম সৈন্যগণ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। তা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ। তাতে তাদের অবসাদ ও ক্লান্তি দূরীভূত হয়ে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় হয়েছিল। এই সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

ثُمَّ أَنْزَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ بَعْدِ الْغَمِّ أَمَنَةً نُعَاسًا يَغْشَى طَائِفَةً مِنْكُمْ وَطَائِفَةٌ قَدْ أَهَمَّتْهُمْ أَنْفُسُهُمْ يَظُنُّونَ بِاللَّهِ غَيْرَ الْحَقِّ ظَنَّ الْجَاهِلِيَّةِ يَقُولُونَ هَلْ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ مِنْ شَيْءٍ قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ يُخْفُونَ فِي أَنْفُسِهِمْ مَا لَا يُبْدُونَ لَكَ يَقُولُونَ لَوْ كَانَ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ مَا قُتِلْنَا هَاهُنَا قُلْ لَوْ كُنْتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ لَبَرَزَ الَّذِينَ كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقَتْلُ إِلَى مَضَاجِعِهِمْ وَلِيَبْتَلِيَ اللَّهُ مَا فِي صُدُورِكُمْ وَلِيُمَحِّصَ مَا فِي قُلُوبِكُمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ

‘অতঃপর দুঃখের পর তিনি তোমাদের প্রদান করলেন প্রশান্তি তন্দ্রারূপে, যা তোমাদের এক দলকে আচ্ছন্ন করেছিল এবং একদল জাহিলি যুগের অজ্ঞের মতো আল্লাহ সম্বন্ধে অবাস্তব ধারণা করে নিজেরাই নিজদের উদ্বিগ্ন করেছিল এই বলে যে, আমাদের কি কোনো অধিকার আছে বলো, সমস্ত বিষয় আল্লাহরই ইখতিয়ারে। যা তারা তোমাদের নিকট প্রকাশ করে না, তারা তাদের অন্তরে তা গোপন রাখে আর বলে, এই ব্যাপারে আমাদের কোনো অধিকার থাকলে আমরা এই স্থানে নিহত হতাম না। বলো, যদি তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থান করতে তবু নিহত হওয়া যাদের জন্য অবধারিত ছিল, তারা নিজেদের মৃত্যুস্থানে বের হতো। এটি এজন্য যে, আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা আছে, তা পরীক্ষা করেন এবং তোমাদের অন্তরে যা আছে তা পরিশোধন করেন, অন্তরে যা আছে আল্লাহ সেই সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত।’[81]

 আবু তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘উহুদ যুদ্ধে যাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেছিল, আমি ছিলাম তাদের একজন। আমার হাত থেকে বারবার তরবারি পড়ে যাচ্ছিল। আর আমি তা উঠাচ্ছিলাম।’[82]

আরো পড়ুন : গাজওয়া বনু কুরাইজা – Invasion of Banu Qurayza

আরো পড়ুন : গাজওয়া বনু লিহ্য়ান – Invasion of Banu Lahyan

আরো পড়ুন : গাজওয়া মুতা – Battle of Mu’tah

শত্রুপক্ষের উসমান ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে আল-মুগিরা নামে এক অশ্বারোহী সৈন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে অগ্রসর হয়ে বলতে লাগল, ‘মুহাম্মাদ বেঁচে গেলে আমার নিস্তার নেই।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মোকাবেলা করার জন্য বললেন, ‘কিন্তু দেখা গেল তার ঘোড়াটি পা পিছলে একটি গর্তে পড়ে গেল। অতঃপর হারেস ইবনে আস-সিম্মা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে প্রতিহত করলেন। তার পায়ে আঘাত করে তাকে বসিয়ে দিলেন, এবং তার তরবারি কেড়ে নিলেন।’[83]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিগণকে নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করতে লাগলেন, তখন উবাই ইবনে খালাফ বলতে লাগল, ‘মুহাম্মাদ কোথায়? মুহাম্মাদ নাজাত পেয়ে গেলে আমি স্বস্তি পাব না।’ অতঃপর এই নরাধম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করার ইচ্ছায় সামনে অগ্রসর হতে থাকে। মুসলিম সৈন্যগণ তাকে বাধা দিতে চাইলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাকে আসতে দাও।’ সে নিকটবর্তী হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারেস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছ থেকে একটা বর্শা নিয়ে তার অগ্রভাগ শুধু তার ঘাড়ে স্পর্শ করলেন, তাতে সামান্য একটু আঁচড় লাগল। কিন্তু তাতেই সে চিৎকার করতে করতে নিজ বাহিনীর দিকে প্রত্যাবর্তন করল। সকলে তাকে বলতে লাগল, ‘কোথাও তো কোনো আঘাত দেখছি না, তুমি এমনভাবে চিৎকার করছো কেন?’ উবাই ইবনে খালাফ উত্তরে বলল, ‘তোমরা জানো না, স্বয়ং মুহাম্মাদ আমাকে আঘাত করেন। তিনি যদি আমার প্রতি থুথুও নিক্ষেপ করতেন, তবু আমি মারা যেতাম।’ অবশেষে সে কুরাইশ বাহিনীর সাথে মক্কা যাওয়ার পথে সারিফ নামক স্থানে মারা যায়।[84] মুষ্টিমেয় মুসলিম বীর যোদ্ধার অসাধারণ শৌর্য-বীর্য ও অনুপম আত্মত্যাগের ফলে কুরাইশ বাহিনীর আক্রমণের বেগ প্রশমিত হলো।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিগণকে নিয়ে উহুদের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি উচ্চঘাঁটিতে আরোহণ করলেন। সেখানেও আবু সুফিয়ান ও খালিদের একটি দল আক্রমণ চালাল, কিন্তু নিরাপদ স্থানে আশ্রিত মুসলিম সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ প্রস্তরাঘাতে তারা পেছনে সরে যেতে বাধ্য হলো।

কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান নিকটস্থ এক পাহাড়ে আরোহণপূর্বক চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ বেঁচে আছে কি?’ সাহাবিগণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে কোনো উত্তর দিলেন না। সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাদের মাঝে ইবনে কুহাফা (আবু বকর) জীবিত আছে কি?’ এবারও সে কোনো উত্তর পেল না। আবার প্রশ্ন করল, ‘উমর ইবনুল খাত্তাব জীবিত আছে কি?’ এবারও সে কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে বলে উঠল, ‘তাহলে তো সবাই শেষ হয়ে গেছে।’ এটি শুনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। তিনি উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহর দুশমন! যাদের কথা তুমি উল্লেখ করলে তাদের সবাইকে আল্লাহ জীবিত রেখেছেন।’ আবু সুফিয়ান বলল, ‘তোমরা নিহতদের মধ্যে কতককে অঙ্গ বিকৃত অবস্থায় পাবে। আমি এই কাজ করতে আদেশ দিইনি। তাতে আমি সন্তুষ্টও নই, অসন্তুষ্টও নই।’ অতঃপর তাদের অন্যতম মূর্তি হুবালকে লক্ষ করে সে বলল, (أُعْلُ هُبَلْ أُعْلُ هُبَلْ) ‘হে হুবাল, ‘তুমি ঊর্ধ্বে থাকো।’

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমরা কি আবু সুফিয়ানের এই কথার জবাব দেবে না?’ তারা বললেন, ‘আমরা কী বলে উত্তর দেব?’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (اللَّهُ أَعْلَى وَأَجَلُّ) ‘বলো, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বোচ্চ।’ আবু সুফিয়ান বলল, ‘আমাদের উযযা (দেবী) আছে, তোমাদের উযযা নেই।’

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবারও সাহাবিদের বললেন, তোমরা কি এটির উত্তর দেবে না? সাহাবিগণ বললেন, ‘আমরা কী বলব?’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

اللَّهُ مَوْلَانَا وَلَا مَوْلَى لَكُمْ

 

‘বলো, আল্লাহ আমাদের প্রভু, কিন্তু তোমাদের কোনো প্রভু নেই।’ আবু সুফিয়ান বলল, (يَوْمٌ بِيَوْمِ بَدْرٍ وَالْحَرْبُ سِجَالٌ) ‘আজ বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ নিলাম। যুদ্ধে জয়-পরাজয় আছে।’ উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এই উক্তির জবাব দিতে গিয়ে বললেন, (قَتْلَانَا فِي الْجَنَّةِ وَقَتْلَاهُمْ فِي النَّارِ) ‘কখনো তোমরা আমাদের সমান নও। আমাদের মধ্য থেকে যারা শহিদ হয়েছেন তারা জান্নাতে থাকবেন, আর তোমাদের মৃতরা থাকবে জাহান্নামে।’

অতঃপর আবু সুফিয়ান বলল, ‘হে উমর! আমার নিকটে এসো।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তার কাছাকাছি গিয়ে দেখো তার কী অবস্থা।’ উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু নিকটবর্তী হলে আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করল, ‘হে উমর! তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, আমরা কি মুহাম্মাদকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছি?’ উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আল্লাহর কসম! কখনো নয়; বরং তিনি তোমার বাক্যালাপ শুনছেন।’ আবু সুফিয়ান বলল, ‘ইবনে কামিয়্যা থেকে তুমি আমার নিকট অধিক সত্যবাদী ও সৎকর্মশীল।’[85]

আবু সুফিয়ান উহুদ প্রান্তর ত্যাগ করার সময় মুসলমানদের বলেছিল, ‘আগামী বছর বদর প্রান্তরে তোমাদের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হবে।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক সাহাবিকে বললেন, ‘বলো, তোমাদের ও আমাদের মধ্যে এই প্রতিশ্রুতিই রইল।’[86]

কুরাইশগণ সত্যিই মক্কায় ফিরে যাচ্ছে কি না, এই সংবাদ সংগ্রহের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রেরণ করলেন এবং বলে দিলেন, ‘যদি দেখো তারা উটের পিঠে আরোহণ করেছে তা হলে বুঝবে, তারা মক্কার দিকে ফিরে যাচ্ছে। আর যদি দেখো, তারা ঘোড়ায় সওয়ার হচ্ছে, তবে ধরে নেবে, তারা মদিনা আক্রমণে আসছে। তারা যদি মদিনার দিকে আসে, তবে সেই সত্তার কসম করে বলছি যার হাতে আমার প্রাণ! শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও তাদের সাথে যুদ্ধ করব।’ সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ফিরে এসে জানালেন, কুরাইশগণ মক্কার দিকে চলে যাচ্ছে।[87]

আরো পড়ুন : গাজওয়া বদর আল-আখিরা – Expedition of Badr al-Maw’id

আরো পড়ুন : গাজওয়া বনি নাজির – Invasion of Banu Nadir

আরো পড়ুন : গাজওয়া বনু কায়নুকা – Invasion of Banu Qaynuqa 

কুরাইশগণ মক্কার দিকে চলে যাওয়ার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহত মুজাহিদ ও শহিদগণকে খুঁজে বের করার জন্য লোক পাঠালেন। জায়েদ ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদ যুদ্ধশেষে সাদ ইবনুর রাবিকে খুঁজে বের করার জন্য আমাকে পাঠালেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলে দিলেন, যদি তার দেখা পাও, তবে আমার সালাম জানিয়ে জিজ্ঞাসা কোরো কেমন আছে?’ জায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি শহিদদের মধ্যে তাকে খুঁজতে লাগলাম এবং মুমূর্ষু অবস্থায় সাক্ষাৎ পেলাম। তার শরীরে তির, বর্ষা ও তরবারির সত্তরটির মতো আঘাত ছিল।’ আমি বললাম, ‘হে সাদ! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে সালাম জানিয়েছেন এবং কেমন আছো জানতে চেয়েছেন।’ তিনি বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার সালাম জানিয়ো এবং বোলো, আমি জান্নাতের খোশবু পাচ্ছি। এরপর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।’[88]

মদিনার অবশিষ্ট মুসলমানগণ তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সন্ধানে উহুদ প্রান্তরে আসতে থাকে। বনু আবদুল আশহাল গোত্রের লোকেরা যখন শহিদদের লাশ দেখছিল, তখন স্ব-গোত্রীয় উয়ায়মিরকে মৃতপ্রায় অবস্থায় দেখে আশ্চর্যান্বিত হলো। তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি তো ইতিপূর্বে ইসলামের বিপক্ষে ছিলে, কী করে যুদ্ধে এলে?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘হঠাৎ আমার হৃদয়ে ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস জন্মাল। আমি তরবারি উন্মোচন করে মুসলমানদের পক্ষে যুদ্ধ করলাম এবং এই অবস্থায় উপনীত হলাম।’ এরপরই তিনি ইনতেকাল করেন। আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘জীবনে সে এক ওয়াক্ত নামাজও পড়ার সুযোগ পায়নি, তবু মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের এই বলিষ্ঠ ঈমানের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জান্নাতি বলে ঘোষণা করলেন।’[89] শহিদদের মৃতদেহ নিয়ে কুরাইশ নারীরা এক বীভৎস দৃশের অবতারণা করল। অপমানচ্ছলে তারা তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে বিকৃত করেছিল। ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, ‘হিন্দ ও তার সাথিরা শহিদদের নাক, কান ও বিশেষ অঙ্গ কেটে হার বানিয়েছিল। হিন্দ খুশি হয়ে ওয়াহশিকে তার গলার সোনার হার প্রদান করেছিল।’[90] হিন্দ তার পূর্ব প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বুক চিরে কলিজা বের করে তা চিবিয়েছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দৃশ্য দেখে অত্যন্ত শোকাভিভূত হলেন। ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

‘হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক কেঁদেছিলেন, এরূপ আর কখনো তাকে কাঁদতে দেখিনি।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘একজনের পরিবর্তে সত্তরজন মুশরিকের এ ধরনের অঙ্গ বিকৃত করা হবে।’ অতঃপর তার উপর সুরা নাহলের শেষ অংশ–

وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُمْ بِهِ وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ

নাজিল হলে তিনি তার সিদ্ধান্ত রহিত করলেন। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এই জখমকৃত বান্দাদের কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা এমনভাবে উঠাবেন যে, তাদের ক্ষতস্থান থেকে লাল রক্ত বের হতে থাকবে এবং তার সুগন্ধ হবে মেশকের মতো।’[91]

আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু যেসকল নারী খবর সংগ্রহের জন্য মদিনা থেকে এসেছিলেন তাদের নিকট গেলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বোন হিন্দ বিনতে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে তার সাক্ষাৎ হলো। তিনি তার শহিদ স্বামী আমর ইবনুল জামুহ রাযিয়াল্লাহু আনহু, পুত্র খাল্লাদ ইবনে আমর ও ভাই আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে উটের উপর বহন করে মদিনার দিকে রওনা হয়েছিলেন। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোনো সংবাদ আছে কি? তোমার পেছনে কারা?’ হিন্দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘সংবাদ ভালো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত আছেন। তিনি জীবিত থাকলে সকল বিপদই তুচ্ছ। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের মধ্য থেকে অনেককে শহিদ হিসেবে গ্রহণ করেন।’ বললেন, ‘এরা হলেন আমার স্বামী, ছেলেও তাই।’ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’ বললেন, ‘মদিনায় দাফন করার জন্য।’ তিনি স্বীয় উটকে খুব তাড়া দিতে লাগলেন, ‘উট মদিনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল না, কিন্তু উহুদের দিকে হাঁকালে দ্রুত ধাবিত হচ্ছিল। অতঃপর তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে এসে এই ঘটনা বর্ণনা করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘উট তো আদিষ্ট প্রাণী। আমর কি কিছু বলেছিল?’ হিন্দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আমর উহুদের দিকে যাত্রার পূর্বে কেবলামুখী হয়ে বলেছিলেন—

اللهُمّ لَا تَرُدّنِي إلَى أَهْلِي خِزْيًا وَارْزُقْنِي الشّهَادَةَ!

হে আল্লাহ! আমার পরিজনের কাছে আমাকে অপমানিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনিও না, শাহাদাত আমার নসিব কোরো।’

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এজন্যই উট অগ্রসর হচ্ছে না। হে আনসারগণ! তোমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছে যারা আল্লাহর নামে কোনো শপথ করলে তা পূর্ণ করে দেওয়া হয়। আমর ইবনুল জামুহ তাদের একজন। হে হিন্দ! তোমার ভাই শহিদ হওয়ার পর থেকেই ফেরেশতাগণ তাকে ছায়া প্রদান করছেন। তাদের (শহিদ) সকলকে জান্নাত দান করা হবে।’ হিন্দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি দোয়া করুন যেন আল্লাহ আমাকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন।’[92]

হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ভগ্নি সাফিয়্যা রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসলমানদের বিপর্যয়ের সংবাদ শুনে মদিনা থেকে বের হয়ে পড়লেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পুত্র জুবাইর ইবনুল আওয়াম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডেকে আদেশ করলেন, ‘সাবধান! তোমার মা যেন লাশ দেখতে না পায়। জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই নির্দেশ তার মাকে শোনালেন।’ তিনি বললেন, ‘ভাইয়ের শাহাদাত ও তার লাশ বিকৃতির সংবাদ আমি শুনেছি। এটি তো আল্লাহর রাস্তায় হয়েছে। ইনশাআল্লাহ, আমি ধৈর্যধারণ করব।’ এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে লাশ দেখার অনুমতি প্রদান করলেন। তিনি কাছে গিয়ে ভাইয়ের ক্ষত-বিক্ষত দেহটি দেখলেন। তার রক্ত উথলে উঠতে থাকল। কিন্তু তিনি ধৈর্যধারণ করে দোয়া করতে থাকলেন।[93]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদের শহিদদের পবিত্র লাশ হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু- এর লাশের পাশে একত্র করতে বললেন এবং তাদের জানাজার নামাজ পড়লেন। অবশ্য এই ব্যাপারে মতভেদ আছে। উহুদের শহিদদের জানাজা পড়া-সংক্রান্ত সহিহ বুখারিতে দুটি বিপরীতমুখী হাদিস রয়েছে। একটি ইতিবাচক, অপরটি নেতিবাচক। ফলে ইমামদের মাঝে মতভেদ দেখা দিয়েছে। ইমাম শাফিয়ি, মালেক, আহমাদ ও ইসহাক রহ.-এর মতে শহিদদের জানাজা পড়ার প্রয়োজন নেই। তাদের দলিল জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদিস,

يَجْمَعُ بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ مِنْ قَتْلَى أُحُدٍ فِي ثَوْبٍ وَاحِدٍ ثُمَّ يَقُولُ أَيُّهُمْ أَكْثَرُ أَخْذًا لِلْقُرْآنِ فَإِذَا أُشِيرَ لَهُ إِلَى أَحَدِهِمَا قَدَّمَهُ فِي اللَّحْدِ وَقَالَ أَنَا شَهِيدٌ عَلَى هَؤُلَاءِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَأَمَرَ بِدَفْنِهِمْ فِي دِمَائِهِمْ وَلَمْ يُغَسَّلُوا وَلَمْ يُصَلَّ عَلَيْهِمْ.

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদের শহিদদের কাফন পরিয়ে বলতেন, এদের মধ্যে কার বেশি কুরআন মুখস্থ আছে? যখন একজনের প্রতি ইঙ্গিত করা হতো, তাকে আগে কবরে নামিয়ে বলতেন, আমি কেয়ামতে এদের সাক্ষী হবো। অতঃপর বিনা গোসলে রক্ত সহকারেই তাদেরকে দাফনের নির্দেশ দিতেন, তাদের জানাজা পড়তেন না।’[94]

আরো পড়ুন : গাজওয়া তায়েফ – Siege of Ta’if

আরো পড়ুন : গাজওয়া দুমাতুল জানাদাল – Expedition of Dumat al-Jandal

আরো পড়ুন : গাজওয়া ফাতহ মক্কা (মক্কা বিজয়) – Conquest of Mecca

অপরপক্ষে ইমাম আবু হানিফা, আবু ইউসুফ, মুহাম্মাদ, আওজায়ি, সাওরি, আহমাদ, ইসহাক রহ.-এর অপর বর্ণনামতে, শহিদদের জানাজা পড়তে হবে। আহলে হিজাজেরও এই অভিমত। তারা উকবা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করেন। একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে উহুদের শহিদদের জানাজার নামাজ পড়লেন, অতঃপর মিম্বারে ফিরে এলেন।[95]

আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি রহ. বলেন, ‘উলামায়ে আহনাফ শহিদদের জানাজা পড়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।’ তাদের আরও দলিল যা ইমাম তাহাবি রহ. বর্ণনা করেন,

خَرَجَ يَوْمًا فَصَلَّى عَلَى أَهْلِ أُحُدٍ صَلَاتَهُ عَلَى الْمَيِّتِ، ثُمَّ انْصَرَفَ إِلَى الْمِنْبَ.

‘একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে উহুদের শহিদদের জানাজার নামাজ পড়লেন, অতঃপর মিম্বারে ফিরে এলেন।’[96]

আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি রহ. বলেন, ‘উলামায়ে আহনাফ শহিদদের জানাজা পড়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।’ তাদের আরও দলিল হলো যা ইমাম তাহাবি রহ. বর্ণনা করেন,

«أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُوضَعُ بَيْنَ يَدَيْهِ يَوْمَ أُحُدٍ عَشَرَةٌ فَيُصَلِّي عَلَيْهِمْ, وَعَلَى حَمْزَةَ, ثُمَّ يُرْفَعُ الْعَشَرَةُ, وَحَمْزَةُ مَوْضُوعٌ, ثُمَّ يُوضَعُ عَشَرَةٌ, فَيُصَلِّي عَلَيْهِمْ, وَعَلَى حَمْزَةَ مَعَهُمْ»[97]

হাকেম, তাবারানি ও বায়হাকির বর্ণনায় হানাফিগণ তাদের মতকে নিম্নের বিষয়গুলোর বিচারে প্রধান্য দিয়ে থাকেন,

أَمر رَسُول الله، صلى الله عَلَيْهِ وَسلم، بِحَمْزَة يَوْم أحد فهيىء للْقبْلَة ثمَّ كبر عَلَيْهِ سبعا، ثمَّ جمع إِلَيْهِ الشُّهَدَاء حَتَّى صلى عَلَيْهِ سبعين صَلَاة[98]

উকবা ইবনে আমের রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদিস ইতিবাচক, আর জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদিস নেতিবাচক। এই ক্ষেত্রে ইতিবাচক হাদিস প্রাধান্য পেয়ে থাকে।

জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু তার শহিদ পিতা ও মামার দাফনের ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন এবং তাদের মদিনায় নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু যখন আহ্বানকারীর আহ্বান শুনলেন, শহিদদের শহিদ হওয়ার স্থানেই দাফন করতে হবে, তখন তিনি তাদের দাফনকাজ সম্পাদনের জন্য ফিরে আসতে তড়িঘড়ি করলেন। সুতরাং বুঝা যায়, তিনি জানাজার নামাযের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।

মৃত ব্যক্তির জানাজা পড়াই ইসলামের বিধান। এটি ফরজে কিফায়া। যদি শহিদদের উপর জানাজা পড়ার বিধান না থাকত, তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা যথেষ্ট করে বলে যেতেন, যেমনিভাবে তাদের গোসল না দেওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে গেছেন।[99]

খাব্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দাফন করতে গেলে একটি চাদর ছাড়া অন্য কাপড় পাওয়া যাচ্ছিল না। এই চাদর দিয়ে তার মাথা ঢাকতে গেলে পা বের হয়ে হয়ে যায়। পা ঢাকতে গেলে মাথা বের হয়ে যায়। অতঃপর তার মাথাই ঢাকা হলো এবং পায়ের উপর ইজখির ঘাস রাখা হলো।’[100] অনুরূপ বর্ণনা সহিহ বুখারির হাদিসে আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে মুসআব ইবনে উমায়ের সম্পর্কেও বর্ণিত আছে।[101]

হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কবরে আবু বকর, উমর, আলি ও জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু অবতরণ করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কবরে দাফন করা হয়। হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অনুরূপ তার অঙ্গও বিকৃত করা হয়েছিল।[102]

আমর ইবনুল জামুহ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাঝে বন্ধুত্ব থাকায় তাদের উভয়কে এক কবরে দাফনের নির্দেশ দেওয়া হয়।[103]

ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেন, মুশরিকগণ উহুদ প্রান্তর ছেড়ে চলে গেলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের বললেন, ‘তোমরা দাঁড়াও! আমি আল্লাহর প্রশংসা করে নিই।’ মুজাহিদগণ কাতারবন্দি হয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে দাঁড়ালে তিনি নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করলেন :[104]

اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ كُلُّهُ، اللَّهُمَّ لاَ قَابِضَ لِمَا بَسَطْتَ، وَلاَ بَاسِطَ لِمَا قَبَضْتَ، وَلاَ هَادِيَ لِمَا أَضْلَلْتَ، وَلاَ مُضِلَّ لِمَنْ هَدَيْتَ، وَلاَ مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ، وَلاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ، وَلاَ مُقَرِّبَ لِمَا بَاعَدْتَ، وَلاَ مُبَاعِدَ لِمَا قَرَّبْتَ، اللَّهُمَّ ابْسُطْ عَلَيْنَا مِنْ بَرَكَاتِكَ وَرَحْمَتِكَ وَفَضْلِكَ وَرِزْقِكَ، اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ النَّعِيمَ الْمُقِيمَ الَّذِي لاَ يَحُولُ وَلاَ يَزُولُ، اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ النَّعِيمَ يَوْمَ الْعَيْلَةِ وَالأَمْنَ يَوْمَ الْخَوْفِ، اللَّهُمَّ إِنِّي عَائِذٌ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا أَعْطَيْتَنَا وَشَرِّ مَا مَنَعْتَ، اللَّهُمَّ حَبِّبْ إِلَيْنَا الإِيمَانَ وَزَيِّنْهُ فِي قُلُوبِنَا، وَكَرِّهْ إِلَيْنَا الْكُفْرَ، وَالْفُسُوقَ، وَالْعِصْيَانَ، وَاجْعَلْنَا مِنَ الرَّاشِدِينَ، اللَّهُمَّ تَوَفَّنَا مُسْلِمِينَ، وَأَحْيِنَا مُسْلِمِينَ، وَأَلْحِقْنَا بِالصَّالِحِينَ غَيْرَ خَزَايَا وَلاَ مَفْتُونِينَ، اللَّهُمَّ قَاتِلِ الْكَفَرَةَ الَّذِينَ يُكَذِّبُونَ رُسُلَكَ، وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِكَ، وَاجْعَلْ عَلَيْهِمْ رِجْزَكَ وَعَذَابَكَ، اللَّهُمَّ قَاتِلِ الْكَفَرَةَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَهَ الْحَقِّ.

‘উহুদ যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যদের মধ্য থেকে সত্তরজন সৈন্য শহিদ হয়েছিলেন। এটিই নির্ভরযোগ্য এবং অধিকাংশের মত। শহিদদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন আনসার মুজাহিদ। তাদের মধ্যে খাযরাজ গোত্রের ৪১ জন শাহাদাতবরণ করেন। ইহুদিদের মধ্য থেকে একজন এবং মুহাজিরদের মধ্য থেকে ৪ জন শহিদ হয়েছিলেন। অপরপক্ষে ইবনে ইসহাক রহ.-এর বর্ণনানুযায়ী কুরাইশদের ২২ জন সৈন্য নিহত হয়েছিল। কিন্তু সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কুরাইশদের ২২ জন নয়; বরং ৩৭ জন বা আরও অধিক সৈন্য নিহত হয়েছিল।’[105]

ইবনে মান্দা উবাই ইবনে কাব রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, ‘আনসারদের মধ্য থেকে ৫৯ জন ও মুহাজিরদের মধ্য থেকে ৬ জন, মোট ৬৫ জন মুসলিম সৈন্য শহিদ হয়েছিলে। ইবনে হিব্বান এই রেওয়ায়েতকে বিশুদ্ধ বলেছেন। মুশরিকদের মধ্য থেকে ২৩ জন নিহত হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে উবাই ইবনে খালাফকে আঘাত করেন।’[106]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৈন্যবাহিনী নিয়ে মদিনায় ফিরে এলেন। ইহুদি ও মুনাফিকরা মুসলমানদের ঠাট্টা করে বলতে লাগল, ‘তারা যদি আমাদের কাছে থাকত, তবে মারাও যেত না, নিহতও হতো না।’[107] এই সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ كَفَرُوا وَقَالُوا لِإِخْوَانِهِمْ إِذَا ضَرَبُوا فِي الْأَرْضِ أَوْ كَانُوا غُزًّى لَوْ كَانُوا عِنْدَنَا مَا مَاتُوا وَمَا قُتِلُوا لِيَجْعَلَ اللَّهُ ذَلِكَ حَسْرَةً فِي قُلُوبِهِمْ وَاللَّهُ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ

‘হে মুমিনগণ, তোমরা তাদের মতো হোয়ো না, যারা কুফুরি করে ও তাদের ভাইগণ যখন দেশে দেশে সফর করে বা যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন তাদের সম্পর্কে বলে, তারা যদি আমাদের নিকট থাকত, তবে তারা মরত না এবং নিহত হতো না। ফলে আল্লাহ এটিই তাদের মনস্তাপে পরিণত করেন, আল্লাহই জীবন দান করেছেন ও মৃত্যু ঘটান। তোমরা যা করো, আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।’[108]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় এসে এক রাত অবস্থান করে আশঙ্কা করতে লাগলেন, কুরাইশগণ যেহেতু এই যুদ্ধে তেমন লাভবান হতে পারেনি—তাই তারা দ্বিতীয়বার মদিনা আক্রমণ করতে পারে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত্রুর সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য মুসলিম সেনাদের আহ্বান জানালেন। তিনি ঘোষণা করলেন,

لا يخرج معنا إلا من شهد القتال

‘যারা উহুদযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছ, কেবল তারাই এই যুদ্ধে আমাদের সাথে অংশ গ্রহণ করবে।’ ক্ষত-বিক্ষত মুজাহিদগণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আনুগত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বিনীত অনুমতি প্রার্থনা করে বললেন,

يا رسول الله، إني أحب أن لا تشهد مشهدا إلا كنت معك، وإنما خلفني أبي على بناته، فأذن لي، أسير معك.

‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি প্রতিটি যুদ্ধেই আপনার সাথে থাকা পছন্দ করি। কিন্তু আমার পিতা তার কন্যা সন্তানদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়ায় উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এই সংগত কারণ বিবেচনাপূর্বক তাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অনুমতি প্রদান করলেন।[109]

আরো পড়ুন : গাজওয়া ওয়াদিল কুরা – Third Expedition of Wadi al Qura

আরো পড়ুন : গাজওয়া খায়বার – Battle of Khaybar

অপরদিকে কুরাইশ বাহিনী মক্কা যাওয়ার পথে মদিনা থেকে ৩৬ মাইল দূরে রাহা নামক স্থানে পৌঁছিয়ে পরস্পর পরস্পরকে ভর্ৎসনা করতে লাগল। তারা বলতে লাগল, ‘তোমরা কিছুই করতে পারোনি। মহাসুযোগ পেয়েও তার সদ্ব্যবহার করতে অর্থাৎ মদিনা আক্রমণ করতে পারোনি। মুসলমানদের অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ জীবিত রয়েছে। তারা পুনরায় একত্র হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। সুতরাং চলো, আবার ফিরে গিয়ে তাদের অবশিষ্টদের খতম করে আসি।’

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৈন্যদের নিয়ে মদিনা থেকে ৮ মাইল দূরে মক্কার পথে হামরাউল আসাদ নামক স্থানে এসে অবস্থান গ্রহণ করলেন। পুনরায় মদিনা আক্রমণের সিদ্ধান্তকে কুরাইশ সৈন্যদের সবাই গ্রহণ করতে পারল না। সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া এই বলে বিরোধিতা করল যে, ‘হে লোকসকল! তোমরা পুনরায় আক্রমণ কোরো না। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, মুসলমানগণ মদিনার অবশিষ্ট লোকদের নিয়ে যুদ্ধের জন্য বের হয়ে আসবে এবং তোমাদের পরাজিত করবে।’

কিন্তু অধিকাংশ সৈন্য তার এই অভিমত প্রত্যাখ্যান করে মদিনার দিকে পুনরায় যাত্রা শুরু করল। আবু সুফিয়ানের সাথে এ সময় মাবাদ ইবনে আবু মাবাদ আল-খুজায়ির সাক্ষাৎ হলো। তিনি ইসলাম কবুল করেছিলেন, কিন্তু আবু সুফিয়ান তা জানত না। আবু সুফিয়ান তার নিকট থেকে গোপন কথা জানতে চেষ্টা করল। মাবাদ বললেন, ‘আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৈন্যসহ মদিনা থেকে কয়েক মাইল দূরে বের হয়ে আসতে দেখেছি। তাদের মনোবল অত্যন্ত সুদৃঢ়। কৃত ভুলের জন্য তারা অনুতপ্ত। উহুদ যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করতে পারেনি, এবার তারাও প্রতিশোধ গ্রহণকারী এই দলে অংশ নিয়েছে। তাদের এই ধরনের রণপ্রস্তুতি ইতিপূর্বে আর আমি কখনো দেখিনি।’

একদিকে মাবাদের এই পরামর্শ, অন্যদিকে পর্যন্ত বাহিনীর জবাবি হামলা ও প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্য তাৎক্ষণিকভাবে মদিনা থেকে জোশ ও জযবার সাথে বের হওয়ার এই সংবাদ আবু সুফিয়ান ও মুশরিকদেরকে হতভম্ব ও ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলল। তারা অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে মক্কায় ফিরে যাওয়াকেই নিরাপদ মনে করল। এ সময় আবদুল কায়েস গোত্রের একটি কাফেলা মুশরিকদের নিকট দিয়ে মদিনার দিকে আসছিল। আবু সুফিয়ান তাকে বলল, ‘তুমি আমার পক্ষ থেকে মুহাম্মাদকে এই পয়গাম পৌঁছিয়ে দাও, আমার বাহিনী মুসলমানদের পুনরায় আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল, কিন্তু এখন আমরা সেই ইচ্ছা ত্যাগ করেছি। ঘোষণা মোতাবেক আগামী বছর বদর প্রান্তরে তাদের সঙ্গে মোকাবেলা হবে।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এই সকল সংবাদ পেলেন এবং গুপ্তচরদের প্রেরিত তথ্যের মাধ্যমে নিশ্চিত হলেন, শত্রুবাহিনী মক্কার দিকে ফিরে গেছে, তখন তিনি হামরাউল আসাদে তিন রাত অবস্থান করে মদিনা ফিরে এলেন।[110] আল্লাহ তায়ালা এই প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন,

الَّذِينَ اسْتَجَابُوا لِلَّهِ وَالرَّسُولِ مِنْ بَعْدِ مَا أَصَابَهُمُ الْقَرْحُ لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا مِنْهُمْ وَاتَّقَوْا أَجْرٌ عَظِيمٌ (১৭২) الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ (১৭৩) فَانْقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ لَمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللَّهِ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ (১৭৪)

‘জখম হওয়ার পর যারা আল্লাহ ও রাসুলের ডাকে সাড়া দিয়েছে তাদের মধ্যে যারা সকার্য করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে চলে, তাদের জন্য মহাপুরস্কার রয়েছে। তাদের লোকে বলেছিল, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জমায়েত হয়েছে। সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় করো। কিন্তু এটি তাদের ঈমানকে দৃঢ় করেছিল এবং তারা বলেছিল, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্ম বিধায়ক। অতঃপর তারা আল্লাহর নেয়ামত অনুগ্রহসহ ফিরে এসেছিল। কোনো অনিষ্ট তাদেরকে স্পর্শ করেনি এবং আল্লাহ যাতে রাজি তারা তারই অনুসরণ করেছিল। আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।’[111]

হামরাউল আসাদ থেকে ফেরার পথে দুজন কুরাইশ সৈন্য মুসলমানদের হাতে ধৃত হয়ে প্রাণ হারায়। একজন হলো কবি আবু উযযা, বদরযুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকে ক্ষমা করেছিলেন। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা এবং উহুদযুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক ভূমিকা পালন করার দরুন তিনি তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। সে এবারও কাকুতিমিনতির স্বরে ক্ষমা প্রার্থনা করলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

لا يلدغ المؤمن من جحر مرتين، ثم أمر الزبير أو عاصم بن ثابت فضرب عنقه.

‘মুমিন ব্যক্তি এক গর্ত থেকে দুবার দংশিত হয় না। হে আসিম ইবনে সাবিত! তুমি তার শিরচ্ছেদ করো।’ তিনি তাই করলেন।

অপরজন হলো মুআবিয়া ইবনুল মুগিরা ইবনে আবিল আস। সে তার চাচাতো ভাই উসমান ইবনে আফফান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট এসে নিরাপত্তা চাইলে উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমীপে উপস্থিত হয়ে তার পক্ষে সুপারিশ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে এই শর্তে মুক্তি দিলেন, সে তিন দিনের মধ্যে মদিনা ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু সেই নরাধম তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও মদিনায় রয়ে গেল এবং মুসলমানদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করতে লাগল। মুসলমানগণ তিন দিন পর তাকে দেখে ফেলল। সে পালাতে চেষ্টা করে, কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জায়েদ ইবনে হারিসা ও আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে তাকে ধরে আনার জন্য প্রেরণ করেন। পরিশেষে তারা তাকে গ্রেফতার করে হত্যা করেন।[112]

উহুদের যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রণনৈপুণ্য বিভিন্ন দিক থেকে প্রমাণিত হয়। তিনি উপত্যকার পানির ঝর্ণার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে মুশরিকদের পানি থেকে বঞ্চিত করেন। এটি ছিল তার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার বড় রকমের সাফল্য। সক্রেটিসের মতে একজন সফল সেনানায়কের যে গুণাবলি থাকা উচিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে তা পুরোপুরি বিদ্যমান ছিল।[113]

উহুদ যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ভিন্নমত পরিলক্ষিত হয়। পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিক W. Montgomery Watt তার Muhammad: Prophet and Statesman গ্রন্থে বলেন, It (battle of Uhud) was a very serious defeat for the Muslims and a great victory for the Meccans.[114]

তার এই মন্তব্য প্রকৃত বিচারে যথার্থ নয়। এই যুদ্ধে সত্তরজন মুসলিম সৈন্য শহিদ হয়েছিলেন। অপরপক্ষে কুরাইশ সৈন্য নিহত হয়েছিল মাত্র তেইশ বা সাঁইত্রিশজন। ঐতিহাসিকদের এই ধরনের মন্তব্যের কারণেই পাশ্চাত্যের পণ্ডিতগণ এই যুদ্ধে কুরাইশদের বিজয় বলে ধরে থাকেন। অথচ তাদের এই পরিসংখ্যান সঠিক নয়। কেননা এই যুদ্ধে হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতেই ৩১ জন এবং আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে আটজন কাফের সৈন্য নিহত হয়েছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন : গাওয়া খন্দক আহজাব – Battle of the Trench

আরো পড়ুন : গাওয়া তাবুক – Battle of Tabouk

আরো পড়ুন : গাজওয়া আস-সাবিক – Invasion of Sawiq

মুসলমানগণ সংখ্যার বলে যুদ্ধ করে না, যুদ্ধ করে ঈমানের বলে। বদরযুদ্ধে সৈন্যের অনুপাত ছিল ১:৩ এবং উহুদ যুদ্ধে ১:৪। কিন্তু বদরযুদ্ধে মুসলমান ও কাফেরদের নিহতের অনুপাত ছিল ১৪:৭০ অর্থাৎ ১৪:৫। বদরি সাহাবিগণই উহুদযুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং ৭০ জন মুসলিম সৈন্য নিহত হলে তার পাঁচ গুণ কাফের সৈন্য নিহত হওয়ার কথা। প্রকৃত প্রস্তাবে এই যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ী করা যুদ্ধে ফেরেশতাদের অংশগ্রহণই তার প্রমাণ। প্রথম পর্যায়ে যুদ্ধ সম্পূর্ণ মুসলমানদের অনুকূলে ছিল। তাদের ঈমানী চেতনা, আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং তাওহিদে উদ্বুদ্ধ আল্লাহর সৈনিকদের কাছে কুরাইশদের সুসজ্জিত বাহিনী বিপর্যস্ত হলো। উপর্যুপরি তীব্র আক্রমণের মোকাবেলায় তারা টিকতে না পেরে দ্রুত পশ্চাৎপদ হতে লাগল। আল্লাহ পাক এই বিজয় প্রসঙ্গে বলেন,

وَلَقَدْ صَدَقَكُمُ اللَّهُ وَعْدَهُ إِذْ تَحُسُّونَهُمْ بِإِذْنِهِ حَتَّى إِذَا فَشِلْتُمْ وَتَنَازَعْتُمْ فِي الْأَمْرِز.

‘আল্লাহই তোমাদের সাথে তার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলেন যখন তোমরা আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদের বিনাশ করছিলে, যে পর্যন্ত না তোমরা সাহস হারালে এবং নির্দেশ সম্বন্ধে মতভেদ সৃষ্টি করলে।’[115]

বাহ্যিক দৃষ্টিতে এই যুদ্ধে মুসলমানগণ ক্ষতিগ্রস্ত ও সামরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল বটে, কিন্তু এটির অন্তর্নিহিত শিক্ষা ছিল উপযুক্তভাবে যুদ্ধের জন্য তাদের পুনর্গঠন ও সামরিক প্রশিক্ষণ এবং কোথায় কোথায় তাদের দুর্বলতা ও ত্রুটিবিচ্যুতি রয়েছে তা চিহ্নিতকরণ ও সংশোধন। নেতার আদেশ লঙ্ঘন কিংবা তার ভুল ব্যাখ্যাও যে অশুভ পরিণতি ডেকে আনে, তা তারা প্রত্যক্ষ করতে পারল। মুসলিম বাহিনী এই যুদ্ধে দুটি ভুল করে : (১) তিরন্দাজ বাহিনীর গিরিপথ পরিত্যাগ। তারা যদি গিরিপথ ছেড়ে না দিত, তবে উহুদের ময়দান মুশরিকদের জন্য বদরের চেয়েও অধিকতর বিপর্যয়কর প্রমাণিত হতো। (২) দুশমনদের পশ্চাৎপসরণের মুহূর্তে তাদের পশ্চাদ্ধাবন না করে গনিমতের প্রতি ধাবিত হওয়া।

উহুদের বিপর্যয় মুসলমানদের জন্য শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ এনে দেয়। বিপদের সময় কীভাবে আত্মরক্ষা করতে হয়, কর্তব্য পালন ও ধৈর্যধারণ করতে হয়, মুসলমানগণ উহুদ যুদ্ধে সেই শিক্ষা লাভ করে। কুরাইশগণ এই যুদ্ধে সত্যিকার অর্থে কোনো বিজয় লাভ করেনি। তারা যে নিষ্ঠুরতাকে বিজয় মনে করেছিল, তা তাদের পাপের পেয়ালাকে পূর্ণ করেছে। এই নিষ্ঠুরতা তাদের নিজেদের বিবেকবান ও নেতৃস্থানীয় লোকদের সমর্থন হারাতে সাহায্য করেছে, যা শেষ পর্যন্ত আরবের পৌত্তলিকতার ধ্বংস ডেকে আনে।[116] সকল নবী আলাইহিস সালাম-কে সাময়িক বিপর্যয়ের মাধ্যমে পরীক্ষায় ফেলা হয়, কিন্তু শেষ পরিণামফল তারই অনুকূলে থাকে। এটির তাৎপর্য হলো, মুমিন ও মুনাফিকদের মধ্যে পার্থক্য করা। যদি নবীগণ সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত হতেন, তবে মুমিনদের সারিতে মুনাফিকরা অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেত। তাদেরকে চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ থাকত না। যেহেতু মুনাফিকরা মুসলমানদের সাথে গোপনে মিশে থাকে, সেহেতু এই ধরনের বিপর্যয়ের সময়ই তাদের আসল চেহারা ধরা পড়ে। ফলে মুসলমানগণ তাদের শত্ৰুদের চিহ্নিত করতে পারে এবং সাবধানতা অবলম্বন করতে পারে।[117] আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَمَا أَصَابَكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ فَبِإِذْنِ اللَّهِ وَلِيَعْلَمَ الْمُؤْمِنِينَ . وَلِيَعْلَمَ الَّذِينَ نَافَقُوا وَقِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا قَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوِ ادْفَعُوا قَالُوا لَوْ نَعْلَمُ قِتَالًا لَاتَّبَعْنَاكُمْ هُمْ لِلْكُفْرِ يَوْمَئِذٍ أَقْرَبُ مِنْهُمْ لِلْإِيمَانِ يَقُولُونَ بِأَفْوَاهِهِمْ مَا لَيْسَ فِي قُلُوبِهِمْ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا يَكْتُمُونَ .

‘যেদিন দুই দল পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল, সেদিন তোমাদের উপর যে বিপর্যয় ঘটেছিল, তা আল্লাহরই হুকুমে, এটি মুমিনগণকে জানার জন্য এবং মুনাফিকদের জানার জন্য এবং তাদেরকে বলা হয়েছিল, এসো, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো অথবা প্রতিরোধ করো। তারা বলেছিল, আমরা যদি যুদ্ধ জানতাম, তবে নিশ্চিতভাবে তোমাদের অনুসরণ করতাম। সেদিন তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরির নিকটতর ছিল। যা তাদের অন্তরে নেই, তারা তা মুখে বলে। তারা যা গোপন রাখে আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবহিত।’[118]

কুরাইশদের পরাজিত করার পূর্ণ সুযোগ পেয়েও যে মুসলমানগণ তার সদ্ব্যবহার করতে পারেননি; বরং তারাই আহত হয়েছেন, তাতে হয়তো মুসলমানদের মনে খানিকটা দুঃখের সঞ্চার হয়ে থাকবে। কিন্তু এতেও দুঃখ করার কিছুই নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

إِنْ يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِثْلُهُ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَدَاءَ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ

‘যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে, তবে অনুরূপ আঘাত তাদেরও তো লেগেছে। মানুষের মধ্যে এই দিনগুলোর পর্যায়ক্রমে আমি আবর্তন ঘটাই, যাতে আল্লাহ মুমিনগণকে জানতে পারেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে কতককে শহিদরূপে গ্রহণ করতে পারেন। আল্লাহ জালেমদের পছন্দ করেন না।’[119]

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিহত হওয়ার সংবাদে মুসলমানদের মাঝে যে হতাশা ও নিরাশার সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ.

‘মুহাম্মাদ একজন রাসুল মাত্র, তার পূর্বে বহু রাসুল গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা নিহত হয়, তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করবে না; বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করবেন।’[120]

আল্লাহ তায়ালা কুরাইশদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে চান না। শুধু দলপতিদের ধ্বংস করে অন্যান্য সকলকে সুপথে আনাই যে তার উদ্দেশ্য ছিল, তা তিনি নিজেই বলেছিলেন। আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

لِيَقْطَعَ طَرَفًا مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَوْ يَكْبِتَهُمْ فَيَنْقَلِبُوا خَائِبِينَ

‘কাফেরদের এক অংশকে নিশ্চিহ্ন করার অথবা লাঞ্ছিত করার জন্য; ফলে তারা নিরাশ হয়ে ফিরে যায়।’[121]

বলা বাহুল্য, বদর ও উহুদযুদ্ধে আল্লাহর উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে। যেসব নেতা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল, তাদের প্রায় সকলেই নিহত হয়েছিল। বাকি ছিল আবু সুফিয়ান, জুবায়ের ইবনে মুতইম ও হাকিম ইবনে হিজাম। এই তিনজন পরবর্তীকালে ইসলাম কবুল করেছিলেন। উহুদ যুদ্ধের এই বিপর্যয় মুসলমানদের জন্য ছিল এক বিশেষ পরীক্ষাস্বরূপ। The Life of Muhammad গ্রন্থে বলা হয়েছে, The day of Uhud was a day of trial, calamity and heart sourching on which God tested the believers and put the hypocrites on trial, those who professed faith with their tongue and hid unbelief in their hearts and a day in which God honoured with martyrdom those whom he willed[122]

এই যুদ্ধে মুসলমানদের সাময়িক বিপর্যয়ের পশ্চাতে শয়তানের চালবাজিও কিছুটা দায়ী ছিল। তাফসিরে রুহুল মাআনিতে খাজ্জাজ রহ. থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, শয়তান তাদেরকে এমন কতিপয় পাপের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেগুলো নিয়ে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়া সমীচীন মনে হয়নি। সেই কারণেই তারা জিহাদ থেকে সরে পড়ে যাতে নিজেদের অবস্থার সংশোধন করে পছন্দনীয় অবস্থায় জিহাদ করে শহিদ হয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে পারে।[123]

আরো পড়ুন : ইহুদি নেতা আবু রাফে-এর হত্যা অভিযান – Killing of Abu Rafi’

আরো পড়ুন : কাব ইবনুল আশরাফ হত্যা অভিযান – Killing of Ka’b ibn al-Ashraf

আরো পড়ুন : খাররার অভিযান – Expedition of al-Kharrar

এই যুদ্ধে মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের তিনশত সৈন্য নিয়ে পথিমধ্যে দলত্যাগ এবং শয়তানি প্ররোচনায় মুসলমানদের মাঝে পারস্পরিক মতভেদের কারণে তাদের ঈমানি চেতনা ও মনোবলে কিছুটা ভাটা নেমে আসে। এই বিপর্যয়কে পাশ্চাত্য গবেষক A. Guillaume মুসলমানদের ঈমানি দুর্বলতার ফল বলে উল্লেখ করতে গিয়ে মন্তব্য করেন, The battle of Uhud was not a Military defeat for Muhammad, it might almost be called a spiritual defeat[124]

বিবরণটি মুনাফিকদের সম্পর্কে প্রযোজ্য। ঈমানের কঠোর এই পরীক্ষায় মুসলিম বাহিনী দৃশ্যত পূর্ণ বিজয় অর্জন করতে না পারলেও ভবিষ্যতের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় তারা এটি থেকে লাভ করেন, যা পরবর্তীকালে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে তাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হয়েছিল। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক সৈয়দ আমির আলি উহুদযুদ্ধে মদিনাবাসীদের বিপর্যয়ের কথা বললেও মক্কাবাসীদের পর্যাপ্ত ক্ষতির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, Abu Sufian, son of Harb, son of Ommeya, the great rival of the Hashimides, with a large army of the Meccans and their allies, entered the Medinite territories, the Muslim force which proceeded to repeat the attack, was. smaller in member. The loss of the Meccans, however, was too great to allow them to attack the city and they retreated to Mecca[125]

উহুদযুদ্ধ সম্বন্ধে সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করলে এটিই প্রমাণিত হয়, মুসলমানদের এই যুদ্ধে জয় হয়েছিল। তৎকালীন আরবের প্রথা ছিল বিজিত অঞ্চলে শত্রুবাহিনীকে বিতাড়িত করে তিন দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করা। অথচ কুরাইশ সৈন্যগণ তা করতে সক্ষম হয়নি; বরং তারা মুসলমানগণ ময়দান পরিত্যাগ করার পূর্বেই ময়দান ছেড়ে চলে যায়। কোনো দলের একক আধিপত্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিজয় হয়েছে তা বলা যায় না। অপরপক্ষে কোনো দল পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ না করা পর্যন্ত এবং যাবতীয় সৈন্য ও রসদ নিয়ে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের পরাজয় হয়েছে তা বলা যায় না। উহুদ যুদ্ধের ক্ষেত্রে এ সকল দিক বিবেচনা করে Brigadier Gulzar Ahmed বলেন, It is difficult to credit the Maccans victory. At best it can be said that the Muslims failed to make good initial successes gained by them and the Makkans saved themselves from a defeat[126]

যুদ্ধের পট পরিবর্তন হওয়ার পর কুরাইশরা মুসলিম সৈন্যদের পশ্চাদ্ধাবন করতে পারেনি। পারেনি তাদের কাউকেও বন্দি করতে এবং কোনো সম্পদও লুণ্ঠন করতে পারেনি। তাদের ব্যর্থতার কথা ও মুসলিম সৈন্যদের বিজয়ের কথা পরোক্ষভাবে তারা নিজেরাই স্বীকার করেছে। মক্কার দিকে ফিরে যাওয়ার পথে তারা পরস্পর পরস্পরকে ভর্ৎসনা করে বলেছিল,

لم تصنعوا شيئا، أصبتم شوكتهم وحدهم، ثم تركتموهم، وقد بقي منهم رؤوس يجمعون لكم، فارجعوا حتى نستأصل شأفتهم.

‘তোমরা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারোনি; বরং তাদের তোমরা ছেড়ে দিয়েছ, তাদের নেতৃবৃন্দ জীবিত রয়েছে, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে আবার একত্র হচ্ছে।’[127]

মুসলমানগণ আল্লাহর সাহায্যে খুব শীঘ্রই তাদের এই ক্ষণস্থায়ী বিপর্যয় কেটে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন। W. Watt যথার্থই বলেছেন, Muhammad had managed to hold his own aganist the Meccans and that was all he needed to do at the moment for the future much would depend on how many men he could attract to his community whether he could maetion its fighting qualities[128]

যুদ্ধের শেষ অবস্থার উপরই তার ফলাফল নির্ভর করে। যেহেতু কুরাইশ বাহিনী মদিনা আক্রমণ না করে ময়দান ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তাই এই যুদ্ধের বিজয় যে মুসলমানদের তা সহজেই অনুমেয়। উপরন্তু কাফের বাহিনীর মোকাবেলায় যুদ্ধের পরপরই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘হামরাউল আসাদ’ অভিযান থেকে শত্ৰুবাহনী উপলব্ধি করল, মুসলমানগণ খুব বেশি হলেও যুদ্ধের একপর্যায়ে বিপর্যস্ত হয়েছে, পূর্ণ যুদ্ধে নয়। প্রত্যাবর্তনরত কুরাইশ বাহিনীর পিছু ধাওয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু উহুদযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আহত, ক্ষতবিক্ষত মুজাহিদদেরকেই সাথে নিয়েছিলেন কাফের বাহিনীকে এই কথা বুঝাতে, মুসলমানগণ পরাজিত হননি। তাদের মনোবল ভেঙে যায়নি, যুদ্ধের সাময়িক ক্ষয়ক্ষতি তাদের দুর্বল করতে পারেনি, বরং তাদের শক্তি, সাহস, মনোবল সম্পূর্ণ অটুট রয়েছে, যেকোনো ধরনের মোকাবেলায় তারা পূর্ণ সক্ষম। আল্লাহর অনুগ্রহে তারা বিজয়ী হয়েই ফিরে এসেছে।

এ সকল দিক বিবেচনা করে মুফাসসির শিরোমণি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন, ‘উহুদযুদ্ধে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেরূপ জয়লাভ হয়েছিল, সেরূপ বিজয় আর কখনো ঘটেনি।’[129]

আরো পড়ুন : আল-আবওয়া অভিযান – Patrol of Wa ddan (al-Abwa)

আরো পড়ুন : আল-উশাইরা অভিযান – Patrol of Zul Al-Ushairah

আরো পড়ুন : আসমা বিনতে মারওয়ান হত্যা – Killing of Asma Bint Marwan

অতএব উপরের আলোচনা থেকে এটিই প্রতিভাত হয়, উহুদ যুদ্ধের ফলাফল মুসলমানদের অনুকূলে ছিল।

তথ্যসূত্র

[1]. দাইরাতুল মাআরিফ ইসলামিয়া : ২/৫৬১

[2]. দ্য স্পিরিট অব ইসলাম : ১৪২

[3]. উমদাতুল কারি : ১৭/১৩৭; সিরাতে মুহাম্মাদিয়া : ১/২, ৩৫৪

[4]. ইসলামী বিশ্বকোষ : ৬/১৭৫

[5]. সহিহ আল-বুখারি, কিতাবুল মাগাজি : ৫৮৫

[6]. সহিহ আল-বুখারি : ৫৮৪

[7]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ১/৬০; কিতাবুল মাগাজি লিল-ওয়াকিদি : ১/১৯৯

[8]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৪৮

[9]. ইসলামী বিশ্বকোষ : ৬/১৭৫

[10]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৩/১০

[11]. আল-আনফাল, ৩৬

[12]. আল-কামিল ফিত- তারিখ : ২/১৪৯

[13]. নুরুল ইয়াকিন ফি সিরাতে সায়্যিদিল মুরসালিন : ১২

[14]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৩/১০

[15]. কিতাবুল মাগাজি লিল-ওয়াকিদি : ২০১; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৩/১০

[16]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৫৪

[17]. ফাতহুল বারি : ৭/৩৪৬; ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ২/৯২

[18]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৪৯

[19]. সিরাতুন-নবী, শিবলি নোমানি : ১২, ২১৬

[20]. আসাহহুস সিয়ার : ১০১-১০২

[21]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৪৮-২৪৯

[22]. কিতাবুল মাগাজি লিল-ওয়াকিদি : ২০৪

[23]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৫০

[24]. শিবলি নোমানি, সিরাতুন-নবী : ২১৭

[25]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/৬২

[26]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৫১

[27]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/২১১

[28]. সুরা আলে ইমরান : ১২৫

[29]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/২৩৪

[30]. মুখতাসার সিরাতুর রাসুল : ১১৯

[31]. মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যা : ২/৩৫৪

[32]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৫২

[33]. ফাতহুল বারি : ৭/৩৫০

[34]. ইসলামী বিশ্বকোষ : ৬/১৭৬

[35]. তারিখুত তাবারি : ২/১৯১; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/১৬

[36]. তারিখুল-উমাম ওয়াল-মুলুক : ২/১৯১

[37]. শিবলি নোমানি, সিরাতুন নবী : ১/২১৮; মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৫৩

[38]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৫৩

[39]. আলে ইমরান, ১২২

[40]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৬৪; ইবনে কাসির : ১৪

[41]. আদ-দুখান, ৮৮

[42]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩৫৪-২৫৫

[43]. সহিহ আল-বুখারি, কিতাবুল মাগাজি : ২/৫৭৯

[44]. সহিহ আল-বুখারি, কিতাবুল জিহাদ : ১/৪২৬

[45]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৫৬

[46]. শিবলি নোমানি রহ., সিরাতুন নবী : ১/২১৮

[47]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৬৮

[48]. শিবলি নোমানি, সিরাতুন নবী : ১৯৯

[49]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৬৮

[50]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৫৯

[51]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৫৯-২৬০

[52]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৬৭

[53]. সিরাতে মুহাম্মাদিয়া : ৩৫৯

[54]. শিবলি নোমানি, সিরাতুন নবী : ১৯৯

[55]. সহিহ আল-বুখারি, কিতাবুল মাগাজি : ২/৫৮৩

[56]. মুখতাসার সিরাতুর রাসুল : ১২২

[57]. ফাতহুল বারি : ৭/৩৪৬; মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৬২

[58]. সহিহ আল-বুখারি : ১/৪২৬

[59]. আলে ইমারান, ১৫২

[60]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৬৪-২৬৫

[61]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৮১

[62]. সহিহ বুখারি, মাগাজি : : ৪০৪৮; ইমাম তিরমিজি, জামে তিরমিজি : ৩২০০; ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ : ১৩১১৬

[63]. সুরা আলে ইমরান : ১৫৫

[64]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৬৬

[65]. সহিহ মুসলিম : ২৬, ১০৭, কিতাবুল জিহাদ ওয়াস-সিয়ার।

[66]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৮১, কিতাবুল মাগাজি

[67]. সিরাতে মুহাম্মাদিয়া, তরজমা মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া : ২/৩৬৩

[68]. উমদাতুল কারি : ১৪/১৫৩

[69]. আর- রাহিকুল মাখতুম : ২৬৭

[70]. সিরাতে মুহাম্মাদিয়া : ৩৬৩

[71]. সিরাতে মুহাম্মাদিয়া : ৩৬৫

[72]. আলে ইমরান, ১২৮; সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৮২; সহিহ মুসলিম : ২/১৮০

[73]. ফাতহুল বারি : ৭/৩৭৩

[74]. কিতাবুশ শিফা বিতারিফ হাক্কুল আল-মুসতাফা : ১/৮২

[75]. সহিহ আল-বুখারি : ১/৪০৭, ২/৫৮১

[76]. সহিহ আল-বুখারি : ১/৫২৭, ৫৮১

[77]. সিরাতে মুহাম্মাদিয়্যা : ২৫৪

[78]. ইমাম তিরমিজি, জামে তিরমিজি : ৩৭৩৯; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ১২, ৮৬

[79]. ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ২/৯৫

[80]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৮০

[81]. আলে ইমরান, ১৫৪

[82]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৮২

[83]. আর-রাহিকুল-মাখতুম : ২৭৩

[84]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৮২, কিতাবুল মাগাজি; আসাহ্হুস সিয়ার : ১০৭

[85]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৭৯; ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ৯৪

[86]. তারিখ ইবনে খালদুন : ১/১১১; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৯৪

[87]. ফাতহুল বারি : ৭/৩৪; আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৭৯

[88]. ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ২/৯৬

[89]. মুখতাসার সিরাতুর রাসুল : ১২২; আসাহহুস সিয়ার : ১০৮

[90]. আসাহুস সিয়ার : ১০৯

[91]. সিরাতে মুহাম্মাদিয়া : ৩৭০

[92]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ২৬৬

[93]. তারিখ আত-তাবারি : ১৪২১

[94]. সহিহ আল-বুখারি, কিতাবুল জানাইয : ১/১৭৯

[95]. সহিহ আল-বুখারি, কিতাবুল জানাইয : ১/১৭৯

[96]. সহিহ আল-বুখারি, কিতাবুল জানাইয : ১/১৭৯

[97]. শরহু মাআনিল আসার : ২৮৮৫; উমদাতুল কারি : ৮/১৫৪

[98]. উমদাতুল কারি : ৮/১৫৫

[99]. উমদাতুল কারি : ৮/১৫৫

[100]. ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ : ৫/১১১ (২১০৭২)

[101]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৭৯-৫৮৪

[102]. সিরাতে মুহাম্মাদিয়্যা : ৩৭০

[103]. তারিখুল কামিল : ২/১৬৩

[104]. ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ : ৩২, ৪২৪; মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮২

[105]. ফাতহুল বারি : ৭/৩৫১; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ১২২-২৩

[106]. সিরাতে মুহাম্মাদিয়্যা : ৩৭২

[107]. মুহাম্মাদ আল-খিদরি বেক, নুরুল ইয়াকিন ফি সিরাতে সায়্যিদিল মুরসালিন : ১৩৩

[108]. সুরা আলে ইমরান : ১৫৬

[109]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৫

[110]. শিবলি নোমানি, সিরাতুন নবী : ২২৫

[111]. সুরা আলে ইমরান : ১৭২-১৭৪

[112]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৭

[113]. মহানবীর প্রতিরক্ষা কৌশল : ২১৩

[114]. Muhammad: Prophet and Statesman : ১৪০

[115]. সুরা আলে ইমরান : ১৫২

[116]. আবদুল হামীদ সিদ্দিকী, মহানবী : ১৭১

[117]. ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ২/৯৯-১০৮; মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৯

[118]. সুরা আলে ইমরান : ১৬৬-১৬৭

[119]. সুরা আলে ইমরান : ১৪০

[120]. সুরা আলে ইমরান : ১৪৪

[121]. সুরা আলে ইমরান : ১২৭

[122]. A Guillaume, The Life of Muhammad, p. ৩৯১

[123]. রুহুল মাআনি : ৪/৯২-৯৮; মাআরিফুল কুরআন : ২/২১১

[124]. Muhammad: Prophet and Statesman, P. ১৪২

[125]. A Short history of the Saracens, p. ১২

[126]. The Battles of the Prophet of Allah, p. ২৪৩-২৪৪

[127]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩১৯

[128]. Muhammad: Prophet and Statesman, ১৪২

[129]. ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ২/৩৪৫

শেয়ার করুন

সূচীপত্র

error: Content is protected !!