সিরাত বিশ্বকোষ
সিরাত বিশ্বকোষ

২০. (১২) গাজওয়া হামরাউল আসাদ  – Battle of Hamra al-Asad

২০. (১২) গাজওয়া হামরাউল আসাদ – Battle of Hamra al-Asad

১২. গাজওয়া হামরাউল আসাদ

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত গাজওয়া : ১২

তারিখ ১৬ই শাওয়াল, ৩য় হিজরি/৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ
অবস্থান  হামরাউল আসাদ।
ফলাফল মুসলমানের বিজয়।

 

কুরাইশদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার।

 

২ জন কুরাইশ সৈন্য নিহত হয়।

বিবাদমান পক্ষ
মদিনার মুসলমান মক্কার কুরাইশ
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ান ইবনে হারব
শক্তি
৭০০-১০০০ পদাতিক,
২-৪ অশ্বারোহী।
৩,০০০ পদাতিক,
২০০ অশ্বারোহী।
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
কোনো হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কোনো হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

ভৌগোলিক অবস্থান

 

মদিনা মুনাওয়ারা থেকে দক্ষিণে আট মাইল দূরের একটি প্রস্তরময় এলাকার নাম ‘হামরাউল আসাদ’। উত্তরে রিওয়া পর্বত, দক্ষিণে ম্যুরা। পূর্বে সফরা পর্বত ও সফরা উপত্যকা, পশ্চিমে লোহিত সাগর। মদিনা থেকে মক্কার দিকে যুল-হুলায়ফার পথে বাম পার্শ্বে এটির অবস্থান। এখানে একটি প্রাচীন মৌসুমি বাজার ছিল। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট মৌসুমে এখানে আরবদের বাজার ও মেলা বসত।[1]

আরো পড়ুন : বুওয়াত অভিযান – Patrol of Buwat

আরো পড়ুন : আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার অভিযান – Expedition Abdullah ibn Rawaha

আরো পড়ুন : আবু আফাক হত্যা – Killing of Abu Afak

 

মানচিত্র (২১) : গাজওয়া হামরাউল আসাদ-এর অবস্থান

 

প্রেক্ষাপট

 

১১ই শাওয়াল, ৩য় হিজরি/৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ ঐতিহাসিক উহুদ প্রান্তরে মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইতিহাসে এটি উহুদের যুদ্ধ নামে খ্যাত। এই যুদ্ধে মুসলমানগণ প্রথমে বিজয় লাভ করলেও কতিপয় তিরন্দাজ মুজাহিদ সাহাবির একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে যুদ্ধের গতি পাল্টে যায়। মুসলমানগণ কিছুক্ষণের জন্য আক্রমণকারীর ভূমিকা থেকে আক্রান্তের ভূমিকায় অবতীর্ণ। ফলে মুসলমানগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যান এবং সত্তরজন সাহাবি শাহাদাতবরণ করেন।[2]

রণাঙ্গনে গুটিকয়েক মুসলমান অবশিষ্ট ছিলেন। তারাও কম বেশি আহত হয়েছেন। এই অবস্থায় কুরাইশ বাহিনী মুসলমানদের উপর আক্রমণ করলে অতি সহজেই তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারত। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দিলেন। তাই কুরাইশগণ রণাঙ্গনে কিছুসংখ্যক আহত মুসলমানের উপরও আক্রমণ করতে সাহস পেল না, বরং তারা দ্রুতপদে রণাঙ্গন ত্যাগ করে মক্কার দিকে ছুটে চলল। তারা কয়েক মাইল পথ অতিক্রম করার পর ‘রাওহা’ নামক স্থানে পৌঁছে যাত্রা বিরতি করল।

দিনটি ছিল ১৫ই শাওয়াল শনিবার। সন্ধ্যার পর কাফেলার অনেকেই বলতে লাগল, আমরা কী করতেই-বা এলাম আর কী করেই ফিরলাম। এলাম মুসলমানদের সমূলে ধ্বংস করতে, মদিনা আক্রমণ করে সর্বশান্ত করতে; কিন্তু তা হলো কোথায়? এমন সুযোগও কি কেউ ছাড়ে? মুসলমানগণ এখন আঘাত-জর্জরিত, আর মদিনা এখন অরক্ষিত। তবে কেন আমরা ফিরে যাচ্ছি? চলো আমরা পুনরায় মদিনায় ফিরে যাই এবং মদিনার উপর অতর্কিত হামলা করে মুসলমানদের পর্যুদস্ত করে দিই।

কুরাইশদের বিশিষ্ট নেতা সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া বলল, ‘না, মদিনায় আক্রমণ করলে বিপদ আছে। মুসলমানগণ এখন চরম ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত। দেখোনি মুসলমানদের কী অপূর্ব শৌর্য-বীর্য? মদিনায় গেলে আর প্রাণে ফিরতে পারবে না; কাজেই মক্কায় ফিরে চলো।’[3]

কুরাইশ দলপতি আবু সুফিয়ান সকলের মতামত শোনার পর মুসলমানদের সমূলে ধ্বংস করার মানসে পুনরায় মদিনায় আক্রমণ করার দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করল।

মদিনায় পুনরায় যুদ্ধ যাত্রার ঘোষণা

 

শনিবার দিবাগত রাত। শাওয়ালের ১৬তম রজনী। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৭০ জন সাহাবিকে উহুদে দাফন করে সজল নয়নে আঘাত জর্জরিত দেহে শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে মাত্র মদিনায় পদার্পণ করেন। এমন সময় তিনি ওহির মাধ্যমে কুরাইশদের পুনরায় মদিনা আক্রমণের অভিপ্রায় জানতে পারলেন। কেউ কেউ বলেছেন, ‘আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাযিয়াল্লাহু আনহু রাওহা থেকে আসছিলেন। তিনি কুরাইশদের এই অভিপ্রায় জানতে পেরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবহিত করেন।’[4] কেউ কেউ এই সংবাদবাহক সাহাবির নাম আবদুল্লাহ ইবনে আমর আল-মুজানি বলে উল্লেখ করেন।[5]

আরো পড়ুন : সিফুল বাহার অভিযান – Expedition of Hamza ibn Abdul-Muttalib

আরো পড়ুন : হুদাইবিয়ার সন্ধি – Treaty of Hudaybiyyah

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সংবাদের যথার্থতা যাচাই এবং কুরাইশদের গতিবিধি জানার জন্য বনু আসলাম গোত্রের তিনজনের একটি অগ্রবর্তী বাহিনী প্রেরণ করেন। এই অগ্রবর্তী দলটি হামরাউল আসাদে এসে পৌঁছালে অজ্ঞাত শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হন এবং তাদের দুজন শাহাদাতবরণ করেন।[6] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলাল রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দিয়ে মদিনায় ঘোষণা করে দিলেন, ‘এখনই সকলে প্রস্তুত হয়ে যাও। কুরাইশদের পশ্চাদ্ধাবন করতে হবে। যারা উহুদ যুদ্ধে যোগদান করেছিল শুধু তারাই এই যুদ্ধে যোগদান করতে পারবে।’ একদিকে পুনরায় যুদ্ধ যাত্রার ঘোষণা হয়েছে, অপরদিকে মুসলমানদের অবস্থা হলো, উহুদে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক সাহাবি কোনো না কোনোভাবে আহত হয়েছেন। উসাইদ ইবনে হুদাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দেহে ছিল নয়টি জখম, আর তুফাইল ইবনে নুমান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দেহে আঘাত ছিল তেরোটি। তখনো অনেকের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। সকলেই চরমভাবে ক্লান্ত-শ্রান্ত। এটি ছাড়া মদিনার ঘরে ঘরে স্বজন হারাবার বেদনায় কান্নার রোল শোনা যাচ্ছিল। এমন কঠিন মুহূর্তে ঘোষিত হলো পুনঃযুদ্ধযাত্রার আহ্বান! মুসলমানগণ অবনত মস্তকে রাসুলের নির্দেশ মেনে নিলেন।[7] আল্লাহ তায়ালা সাহাবায়ে কেরামের এই অকুণ্ঠ আনুগত্যের কথা এভাবে বর্ণনা করেন,

الَّذِينَ اسْتَجَابُوا لِلَّهِ وَالرَّسُولِ مِنْ بَعْدِ مَا أَصَابَهُمُ الْقَرْحُ لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا مِنْهُمْ وَاتَّقَوْا أَجْرٌ عَظِيمٌ

‘জখম হওয়ার পর যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের ডাকে সাড়া দিয়েছে তাদের মধ্যে যারা সকার্য করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে চলে তাদের জন্য মহাপুরস্কার রয়েছে।’[8]

মদিনা থেকে যুদ্ধযাত্রা

 

১৬ই শাওয়াল রবিবার। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদে অংশগ্রহণকারী সাহাবিগণকে সঙ্গে নিয়ে পূর্ব ঘোষণানুসারে কুরাইশদের পশ্চাদ্ধাবনের উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। তিনি সাবিত ইবনুদ দাহহাক রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে রাহবার (পথপ্রদর্শক) এবং আলি, মতান্তরে আবু বকর সিদ্দিক রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে পতাকাধারী নিযুক্ত করলেন।[9] রসদপত্রের মধ্যে ছিল সাদ ইবনে উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রদত্ত ত্রিশটি উট সওয়ারি হিসেবে আর কিছু পশু কাফেলার আহারের জন্য। মুসলমান সৈন্যের সংখ্যা ছিল উহুদ ফেরত ছয়শত ত্রিশজন।[10]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওনা হয়ে গেলেন। উহুদে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একজনও বাদ থাকলেন না। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার পিতার আদেশে তার সাতটি বোনের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত থাকায় উহুদে শরিক হতে পারেননি। তার পিতা উহুদে শাহাদাত লাভ করেন। এবার যুদ্ধযাত্রার ঘোষণা শুনে তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু তার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘মুজাহিদদের মধ্যে কেবল আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে পূর্ব দিনের যুদ্ধে (উহুদে) শরিক ছিল না।’

মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইতিপূর্বে উহুদ যুদ্ধে যাত্রাপথ থেকে ফিরে গিয়েছিল। সে-ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে উপস্থিত হয়ে এই যুদ্ধে শরিক হওয়ার অনুমতি চাইল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রার্থনা ফিরিয়ে দিলেন।[11]

মদিনার শাসনভার আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর ন্যস্ত করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওনা হলেন। আঘাতে জর্জরিত দেহ নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবিগণ অতিকষ্টে পথ চলছিলেন। যন্ত্রণা, ক্লান্তি ও দৌর্বল্যের কারণে তাদের পায়ে হাঁটার শক্তি নেই। আল্লাহ তায়ালা তাদের উৎসাহ দান করে ইরশাদ করলেন,

لَا تَهِنُوا فِي ابْتِغَاءِ الْقَوْمِ إِنْ تَكُونُوا تَأْلَمُونَ فَإِنَّهُمْ يَأْلَمُونَ كَمَا تَأْلَمُونَ وَتَرْجُونَ مِنَ اللَّهِ مَا لَا يَرْجُونَ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا

‘শত্রু সম্প্রদায়ের সন্ধানে তোমরা হতোদ্যম হোয়ো না। যদি তোমরা যন্ত্রণা পাও, তবে তারাও তো তোমাদের মতোই যন্ত্রণা পায় এবং আল্লাহর নিকট তোমরা যা আশা করো, তারা তা আশা করে না; আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’[12]

হামরাউল আসাদে শিবির স্থাপন

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হামরাউল আসাদে পৌঁছে শিবির স্থাপন করলেন। কাফেরদের ভয় প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক রাতে মুসলমানগণ অগ্নিকুণ্ডলী প্রজ্বলিত করে রাখতেন। অগ্নিকুণ্ডলীর আলোয় বহু দূর আলোকিত হয়ে পড়ত। দূর থেকে মনে হতো যেন সেখানে সহস্র সহস্র সৈন্যবাহিনী অবস্থান করছে। প্রতিদিন এমন পাঁচশত অগ্নিকুণ্ডলী প্রজ্বলিত করা হতো। এটি ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি দূরদর্শী রণকৌশল। তাতে আরও একটি উপকার ছিল, প্রত্যেক সাহাবিই কিছু না কিছু আহত ছিলেন। তারা এই আগুন দ্বারা নিজেদের ক্ষত স্থানটি সেঁক দিতেন।[13]

মাবাদ খুজাঈর আগমন

 

খুজাআ গোত্র তখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি। তবে তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। একটি সূত্রে জানা যায়, খুজাআ গোত্রের সাথে রাসুলের এই মর্মে সন্ধি ছিল, তিহামায় যা কিছু ঘটবে তা তারা রাসুল থেকে গোপন রাখবে না। এই কারণে মুসলমানদের সাথে তাদের একটি হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল।[14]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা ফাদাক, ফাদাকের দ্বিতীয় অভিযান – Expedition of Muhaysa ibn Massud (Fadak)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা ফাদাক, ফাদাকের প্রথম অভিযান – Expedition of ʿAlī ibn Abī Ṭālib (Fadak)

আরো পড়ুন : সারিয়্যায়ে ওয়াদিউল কুরা (প্রথম) – Expedition of Zayd ibn Harithah (Wadi al-Qura)

উহুদ প্রান্তরে মুসলমানদের বিপদের কথা শুনে খুজাআ গোত্রের সর্দার মাবাদ ইবনে আবু মাবাদ আল-খুজাঈ সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য হামরাউল আসাদে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি রাসুলের খেদমতে এসে বললেন, ‘মুহাম্মাদ! আপনার ও আপনার সঙ্গীগণের বিপদে আমরা মর্মান্তিক জ্বালা অনুভব করছি। আমরা আশাবাদী, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে অচিরেই শত্রুদের আক্রমণ থেকে নিষ্কৃতি দান করবেন।’ উল্লেখ্য, মাবাদ তখনো মুশরিক ছিলেন।[15]

কুরাইশদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার

 

মাবাদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে কুরাইশদের দুরভিসন্ধির কথা জেনে খুবই উৎকণ্ঠিত হলেন এবং কোনো ছলে ও কৌশলে কুরাইশদের তাড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ানের নিকট গমন করলেন। আবু সুফিয়ান মাবাদের নিকট মুসলমানদের অবস্থা জানতে চাইলে মাবাদ বললেন, ‘প্রাণ বাঁচাতে হলে কালবিলম্ব না করে অতিসত্বর পলায়ন করো। আমি দেখে এসেছি, মুহাম্মাদ বিশাল সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে তোমাদের আক্রমণ করার জন্য আসছেন। তারা এসে পড়লে তোমাদের আর রক্ষা নেই। মুসলমানগণ এখন প্রচণ্ড ক্ষোভ ও উত্তেজনার মধ্যে রয়েছেন। তাই আর বিলম্ব কোরো না, পালাও। মুসলমানদের ক্ষোভ ও উত্তেজনার তীব্রতা বুঝাবার জন্য মাবাদ একটি কবিতাও আবৃত্তি করে শোনালেন।’[16]

মাবাদের বক্তব্য শুনে আবু সুফিয়ান ভীত হয়ে গেল এবং আল্লাহ তায়ালা তার ও তার সহচরদের অন্তরে চরম ভীতির সঞ্চার করে দিলেন। ফলে, তারা আর মদিনা আক্রমণের সাহস করল না; বরং ভীত হয়ে দ্রুতপদে মক্কার দিকে পলায়নের প্রস্তুতি নিলো। এ সম্পর্কেই অবতীর্ণ হয় কুরানের আয়াত,

سَنُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ بِمَا أَشْرَكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَمَأْوَاهُمُ النَّارُ وَبِئْسَ مَثْوَى الظَّالِمِينَ

‘অচিরেই আমি কাফেরদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করব, যেহেতু তারা আল্লাহর শরিক করেছে, যার সপক্ষে আল্লাহ কোনো সনদ পাঠাননি। জাহান্নাম তাদের আবাস, কত নিকৃষ্ট আবাসস্থল জালেমদের জন্য।’[17]

আবু সুফিয়ানের চতুরতা ও মুসলমানদের দৃঢ়তা

 

মক্কার দিকে পলায়নকালে আবু কায়েস গোত্রের মদিনাগামী একটি কাফেলার সাথে আবু সুফিয়ানের সাক্ষাৎ হলো। আবু সুফিয়ান বলল, ‘তোমরা দয়া করে আমাদের উপকারার্থে একটি কাজ করো, তাহলে আমরা আগামী দিন উকায বাজারে তোমাদের বিনিময়স্বরূপ একটি উট বোঝাই কিসমিস দান করব। কাজটি হলো, তোমরা মুহাম্মাদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে এই বলে ভীত করে দিও, কুরাইশগণ মুসলমানদের সমূলে ধ্বংস করার জন্য বিরাট সমরায়োজন করেছে। শীঘ্রই তারা মদিনা আক্রমণ করবে।’[18]

আবু কায়েস গোত্রের লোকজন যখন মুসলমানদের এই ভীতিপ্রদ সংবাদ শোনাল, তখন মুসলমানগণ দৃঢ় কণ্ঠে সমস্বরে উত্তর করলেন,

{حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ}

‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্ম-বিধায়ক।’[19]

 আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট’ এই উক্তিটি আল্লাহর প্রতি আস্থা ও নির্ভরতার এমন একটি ঘোষণা, যা ইবরাহিম আলাইহিস সালাম বলেছিলেন যখন তাকে নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আর এটি বলেছিলেন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিগণ, যখন তাদেরকে হামরাউল আসাদে কুরাইশ বাহিনীর ভয় প্রদর্শন করা হয়েছিল। এটির ফলে তাদের ঈমান আরও বহু গুণ বেড়ে গেল।[20] এ সম্পর্কেই অবতীর্ণ হয়,

الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ

‘এদের লোকে বলেছিল, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক সংঘবদ্ধ হয়েছে। সুতরাং তোমরা তাদের ভয় করো। কিন্তু এটি তাদের (মুসলমানদের) বিশ্বাস দৃঢ়তর করেছিল। তারা বলল, “আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক।”’[21]

হামরাউল আসাদ বাজারে ব্যবসা ও মুনাফা অর্জন

 

প্রাচীনকাল থেকেই হামরাউল আসাদে আরবদের মৌসুমি বাজার বসত। এই সময়টি ছিল বাজারের মৌসুম। বিভিন্ন বণিক কাফেলা বিচিত্র পণ্যসম্ভার নিয়ে তাই এখানে সমবেত হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিকট থেকে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য পাইকারি মূল্যে ক্রয় করে তা খোলা বাজারে খুচরা বিক্রয় করলে আল্লাহর অনুগ্রহে এটি থেকে প্রচুর মুনাফা অর্জিত হলো। তিনি সমস্ত মুনাফা সাহাবিগণের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

فَانْقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ لَمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللَّهِ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ

‘তারপর তারা আল্লাহর অবদান ও অনুগ্রহসহ ফিরে এসেছিল, অনিষ্ট তাদের স্পর্শ করেনি এবং আল্লাহ যাতে রাজি তারা তাই অনুসরণ করেছিল। আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।’[22]

তাফসিরে রুহুল মাআনিতে (২/৩৪০) পণ্যদ্রব্য ক্রয় ও লাভবান হওয়ার এখানেই সংঘটিত হয়েছিল বলে বর্ণিত হয়েছে এবং এটিই অধিকাংশ মুফাসসিরের মত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর এক বছর পর বদর সুগরার অভিযানেও অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেই ঘটনাটি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কুরআনে তার উল্লেখ নেই।[23]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা গালিব ইবনে আবদুল্লাহ, ফাদাকের চতুর্থ অভিযান – Expedition of Ghalib ibn Abdullah al-Laithi (Fadak)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা তারাফ – Expedition of Zayd ibn Harithah (At-taraf)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা ফাদাক, ফাদাকের তৃতীয় অভিযান – Expedition of Bashir Ibn Sa’d al-Ansari (Fadak)

মদিনায় প্রত্যাবর্তন

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হামরাউল আসাদে কুরাইশ বাহিনীর অপেক্ষায় তিন দিন (সোম, মঙ্গল ও বুধবার) অবস্থান করলেন। এরপর তিনি শুনতে পেলেন, আবু সুফিয়ান তার দলবলসহ মক্কার দিকে পালিয়ে যায়ছে। এই সংবাদ শুনে মহনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

لَقَدْ سُوِّمَتْ لَهُمْ حِجَارَةٌ، لَوْ صُبِّحُوا بِهَا لَكَانُوا كَأَمْسِ الذَّاهِبِ.

‘সেই সত্তার শপথ যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! যদি তারা সেখানে প্রভাত পর্যন্ত অবস্থান করত, তাহলে তাদের নামাঙ্কিত প্রস্তরাঘাতে তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হতো।’[24]

অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিরাপদে প্রচুর ব্যবসায়িক মুনাফাসহ মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন।

তথ্যসূত্র

[1]. সিরাতে হালাবিয়া : ২৬/১৫; হজরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : সমাকালীন পরিবেশ ও জীবন, মক্কা মদিনার ভৌগোলিক চিত্র : ৬৬১

[2]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/৪২৪

[3]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/৪২৬; তাফসির রুহুল মাআনি : ২/৩৩৭

[4]. সিরাতে হালাবিয়া : ২৬/১৩

[5]. মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ২০৭

[6]. সিরাতে হালাবিয়া : ২৬/১৬; মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ২০৮

[7]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/২৪৬

[8]. সুরা আলে ইমরান : ১৭২

[9]. সিরাতে হালাবিয়া : ২৬/১৫১৬

[10]. তাফসিরে মাজহারি : ৩/১৭৫; ফাতহুল বারি : ৭/৩৭০

[11]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/৪২৬

[12]. সুরা নিসা : ১০৪; তাফসিরে মাজহারি : ২/১৮০

[13]. সিরাতে হালাবিয়া : ২৬/১৬-১৭; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/৪২৬

[14]. তাফসিরে ইবনে কাসির : ১/৩৭৮

[15]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/৪২৭

[16]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/৪২৭; আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩২১

[17]. সুরা আলে ইমরান : ১৫১; তাফসিরে বয়ানুল কুরআন : ২/৩

[18]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/৪২৭

[19]. সুরা আলে ইমরান : ১৭৩; তাফসিরে ইবনে কাসির : ১/৩৭৯; তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন : ২/২৪০

[20]. তাফসিরে ইবনে কাসির : ১/৩৭৯; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/৪২৮

[21]. সুরা আলে ইমরান : ১৭৩

[22]. সুরা আলে ইমরান : ১৭৪

[23]. তাফসিরে বয়ানুল কুরআন : ২/৭৪; তাফসিরে ইবনে কাসির : ১/৩৭৯

[24]. তাফসিরে ইবনে কাসির : ১/৩৭৯

শেয়ার করুন

সূচীপত্র

error: Content is protected !!