সিরাত বিশ্বকোষ
সিরাত বিশ্বকোষ

২৩. (১১) গাজওয়া সারিয়্যা আর-রাজি – Expedition of Al Raji

২৩. (১১) গাজওয়া সারিয়্যা আর-রাজি – Expedition of Al Raji

১১. গাজওয়া আর-রাজি

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কর্তৃক প্রেরিত সারিয়্যা : ১১

তারিখ তারিখ ৪র্থ হিজরি/৬২৫ খ্রি., উহুদ যুদ্ধের পর।
অবস্থান আল-রাজি।
ফলাফল মুসলমানদের হত্যা করা হয়।
বিবাদমান পক্ষ
মুসলিম বনু লাহিয়ান গোত্র
শক্তি
১০ জন অজানা
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
১০ জন শহিদ অজানা

নামকরণ

 

আর-রাজি الرَّجِيعِ একটি কূপের নাম।[1] এটির অপর নাম মুআবিয়া;[2] মতান্তরে একটি খেজুর বাগানের নাম;[3] মতান্তরে একটি স্থানের নাম।[4] সেখানে এই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার কারণে এটির নামকরণ হয়েছে ‘আর-রাজি’-এর যুদ্ধ।

উল্লেখ্য, ইমাম বুখারি রহ. এটিকে ‘গাজওয়া আর-রাজি’ غَزْوَةُ الرَّجِيعِ নামকরণ করেন।[5] ইবনুল আসিরও এই ঘটনাটিকে ‘গাজওয়াতুর রাজি’ غَزْوَةُ الرَّجِيعِ বর্ণনার অধ্যায় শিরোনামে আলোচনা করেন।[6] ইবনে হিশাম এটির নাম দিয়েছেন ইয়াওমুর রাজি বা ‘আর-রাজি-এর দিন’ يَوْمُ الرَّجِيعِ।[7] শিবলি নোমানি রহ. বলেছেন, ‘রাজি’-এর ঘটনা বা ‘ওয়াকিআতুর রাজি’ وَقِعَةُ الرَّجِيعِ।[8] মোবারকপুরি ও ইবনে হাজম-এর ভাষায় এটি ‘আর-রাজি’-এর মিশন বা বাআসুর রাজি بَعْثُ الرَّجِيعِ[9]

মূলত এই নামগুলোর কোনোটিও একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। তবে সেখানে সাহাবিগণের রাযিয়াল্লাহু আনহু সাথে যেহেতু প্রতিপক্ষের সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেজন্য আমরা এটিকে আর-রাজি যুদ্ধ হিসেবে নামকরণকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। কেননা এই নামকরণের ভেতরেই ঘটনাটির বাস্তবচিত্র যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে, উপরোল্লিখিত অন্য নামের মাধ্যমে তার প্রকাশ সম্ভব নয়।

বিজ্ঞাপন

ভৌগোলিক অবস্থান

 

আর-রাজি হিজাজের প্রান্তে,[10] উসফান (عُسْفانْ) ও মক্কাতুল মুকাররমার মধ্যখানে,[11] উসফান থেকে আট মাইল[12] বা সাত মাইল[13] বা যে পথ অতিক্রম করতে দুবার বিশ্রাম করতে হয় অর্থাৎ দুই মনজিল দূরে অবস্থিত।[14] এটিকে কেউ কেউ স্থানের নাম বললেও[15] মূলত এটি হুজাইল গোত্রের একটি কূপের বা খেজুর বাগানের নাম।[16] স্থানটির নাম হলো আল-হাদআহ (اَلْهَدْأةُ);[17] এটি কিন্তু আল-হাদাতু (اَلْهَدَةُ)[18] অথবা আল-হাদ্দাতু (اَلْهَدَّةُ)[19] নয়।

আরো পড়ুন : সারিয়্যা কাআব ইবনে উমায়ের আল-গিফারি – Expedition of Ka’b ibn ‘Umair al-Ghifari

আরো পড়ুন : সারিয়্যা কাআব ইবনে উমায়ের আল-গিফারি রা. – Sariya Ka’ab ibn Umair al-Ghifari

আরো পড়ুন : সারিয়্যা কুতবা ইবনে আমের – Expedition of Qutbah ibn Amir

মানচিত্র (২৪) : গাজওয়া আর-রাজি-র অবস্থান স্থল

 

উল্লেখ্য, উর্দু দায়েরায়ে মাআরিফ ইসলামিয়া[20] ও ইসলামি বিশ্বকোষ[21] আল-হাদআ-এর ভৌগোলিক অবস্থানকে মক্কা ও তাইফের মধ্যবর্তী স্থলে চিহ্নিত করেছে। তবে সন্দেহাতীতভাবে সত্য, এই তথ্যটি ভুল। কেননা মক্কা ও তাইফের মধ্যখানে অবস্থিত জায়গাটির নাম আল-হাদা (اَلْهَدَةُ) যা হামজা সহকারে লেখা হয় না। আর-রাজি যে স্থানটিতে অবস্থিত, তা হলো আল-হাদা (اَلْهَدْأةُ) যা হামজা সহকারে লেখা হয়। এটির অবস্থান উসফান ও মক্কার মধ্যখানে। সম্ভবত উর্দু দাইরায়ে মাআরিফ ইসলামিয়া ও ইসলামি বিশ্বকোষ দুটি পৃথক পৃথক স্থানকে একই স্থান মনে করে এই ভুল তথ্যটি দিয়েছে। আসলে দুটি ভিন্ন ভিন্ন স্থান।[22] স্থানটি রাবিগ (رَابِغْ) ও জিদ্দা (جِدَّة) -এর মধ্যখানে বলে উল্লেখ করেন। বর্তমানে মানচিত্রেও দেখা যায়, আর-রাজি মক্কা থেকে কিছুটা উত্তর-পশ্চিম কোণে জিন্দা ও রাবিগের মধ্যখানেই অবস্থিত।

যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার কাল

 

এই যুদ্ধ যে উহুদ যুদ্ধের পরে সংঘটিত হয়েছিল এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও সিরাতবেত্তাগণ একমত। তবে নির্ধারিত কোন সময়ে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল, তাতে মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, আর-রাজি যুদ্ধ তৃতীয় হিজরির[23] শেষদিকে[24] হিজরতের ঠিক ৩৬ মাসের মাথায়[25] সফর মাসে[26] অনুষ্ঠিত হয়। তবে অধিকাংশ মনীষীর মতে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল চতুর্থ হিজরি সনের সফর মাসে।[27]

এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য, উল্লিখিত দুটি মতামতেই আর-রাজি যুদ্ধ সফর মাসেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই। মতভেদ হচ্ছে কোন হিজরি সনে এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল—তাকে কেন্দ্র করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত প্রাপ্তির চতুর্দশ বৎসরে ২৭শে সফর তারিখে মক্কা থেকে হিজরত করে গারে সাওরে পৌঁছান।[28] মূলত এই সন থেকে হিজরি সন গণনা করাই ছিল বাস্তবতার দাবি। এই বাস্তবতার আলোকে কোনো কোনো ঐতিহাসিক কিন্তু এদিন থেকেই হিজরি সন গণনা করেন। তবে ১৭ হিজরিতে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শাসনামলে যখন হিজরি সন প্রবর্তিত হয়, উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পরামর্শে সফর মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস হিসেবে ধরে মুহাররমকেই প্রথম মাস হিসেবে গ্রহণ করা হয়।[29] সুতরাং এই দুই ধারায় হিজরি সন গণনার কারণেই সম্ভবত আর-রাজি যুদ্ধের সময়কাল নির্ধারণে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। যারা মুহাররম মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস গণ্য করেন তাদের নিকট আর-রাজি যুদ্ধ চতুর্থ হিজরিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর যারা হিজরত সফর মাসেই অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে সেই মাসকেই হিজরি সনের প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করেন তাদের নিকট আর-রাজি যুদ্ধ তৃতীয় হিজরি সনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাহ্যিক দিক থেকে উভয় মতের মধ্যে এক বছরের পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও মূলত কোনো পার্থক্যই নেই। অধিকাংশ ঐতিহাসিক উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পরামর্শ অনুযায়ী মুহাররম মাসকে যেহেতু হিজরি সনের প্রথম মাস মনে করেন এবং এই মতই সর্বত্র অনুসৃত হয়, সেই আলোকে আর-রাজি যুদ্ধ চতুর্থ হিজরিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার মতের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। সুতরাং এই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার সময় হচ্ছে চতুর্থ হিজরি সনের সফর মাস।

হাদিসে আর-রাজি যুদ্ধ

 

বুখারি শরিফে ভিন্ন ভিন্ন তিনটি স্থানে জিহাদ, মাগাজি ও তাওহিদ অধ্যায়ে এই যুদ্ধের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। রাজি যুদ্ধ অধ্যায়ে হাদিসটি নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ হয়েছে,

حَدَّثَنِي إِبْرَاهِيمُ بْنُ مُوسَى أَخْبَرَنَا هِشَامُ بْنُ يُوسُفَ عَنْ مَعْمَرٍ عَنْ الزُّهْرِيِّ عَنْ عَمْرِو بْنِ أَبِي سُفْيَانَ الثَّقَفِيِّ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ بَعَثَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَرِيَّةً عَيْنًا وَأَمَّرَ عَلَيْهِمْ عَاصِمَ بْنَ ثَابِتٍ وَهُوَ جَدُّ عَاصِمِ بْنِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ فَانْطَلَقُوا حَتَّى إِذَا كَانَ بَيْنَ عُسْفَانَ وَمَكَّةَ ذُكِرُوا لِحَيٍّ مِنْ هُذَيْلٍ يُقَالُ لَهُمْ بَنُو لَحْيَانَ فَتَبِعُوهُمْ بِقَرِيبٍ مِنْ مِائَةِ رَامٍ فَاقْتَصُّوا آثَارَهُمْ حَتَّى أَتَوْا مَنْزِلًا نَزَلُوهُ فَوَجَدُوا فِيهِ نَوَى تَمْرٍ تَزَوَّدُوهُ مِنْ الْمَدِينَةِ فَقَالُوا هَذَا تَمْرُ يَثْرِبَ فَتَبِعُوا آثَارَهُمْ حَتَّى لَحِقُوهُمْ فَلَمَّا انْتَهَى عَاصِمٌ وَأَصْحَابُهُ لَجَئُوا إِلَى فَدْفَدٍ وَجَاءَ الْقَوْمُ فَأَحَاطُوا بِهِمْ فَقَالُوا لَكُمْ الْعَهْدُ وَالْمِيثَاقُ إِنْ نَزَلْتُمْ إِلَيْنَا أَنْ لَا نَقْتُلَ مِنْكُمْ رَجُلًا فَقَالَ عَاصِمٌ أَمَّا أَنَا فَلَا أَنْزِلُ فِي ذِمَّةِ كَافِرٍ اللَّهُمَّ أَخْبِرْ عَنَّا نَبِيَّكَ فَقَاتَلُوهُمْ حَتَّى قَتَلُوا عَاصِمًا فِي سَبْعَةِ نَفَرٍ بِالنَّبْلِ وَبَقِيَ خُبَيْبٌ وَزَيْدٌ وَرَجُلٌ آخَرُ فَأَعْطَوْهُمْ الْعَهْدَ وَالْمِيثَاقَ فَلَمَّا أَعْطَوْهُمْ الْعَهْدَ وَالْمِيثَاقَ نَزَلُوا إِلَيْهِمْ فَلَمَّا اسْتَمْكَنُوا مِنْهُمْ حَلُّوا أَوْتَارَ قِسِيِّهِمْ فَرَبَطُوهُمْ بِهَا فَقَالَ الرَّجُلُ الثَّالِثُ الَّذِي مَعَهُمَا هَذَا أَوَّلُ الْغَدْرِ فَأَبَى أَنْ يَصْحَبَهُمْ فَجَرَّرُوهُ وَعَالَجُوهُ عَلَى أَنْ يَصْحَبَهُمْ فَلَمْ يَفْعَلْ فَقَتَلُوهُ وَانْطَلَقُوا بِخُبَيْبٍ وَزَيْدٍ حَتَّى بَاعُوهُمَا بِمَكَّةَ فَاشْتَرَى خُبَيْبًا بَنُو الْحَارِثِ بْنِ عَامِرِ بْنِ نَوْفَلٍ وَكَانَ خُبَيْبٌ هُوَ قَتَلَ الْحَارِثَ يَوْمَ بَدْرٍ فَمَكَثَ عِنْدَهُمْ أَسِيرًا حَتَّى إِذَا أَجْمَعُوا قَتْلَهُ اسْتَعَارَ مُوسًى مِنْ بَعْضِ بَنَاتِ الْحَارِثِ لِيَسْتَحِدَّ بِهَا فَأَعَارَتْهُ قَالَتْ فَغَفَلْتُ عَنْ صَبِيٍّ لِي فَدَرَجَ إِلَيْهِ حَتَّى أَتَاهُ فَوَضَعَهُ عَلَى فَخِذِهِ فَلَمَّا رَأَيْتُهُ فَزِعْتُ فَزْعَةً عَرَفَ ذَاكَ مِنِّي وَفِي يَدِهِ الْمُوسَى فَقَالَ أَتَخْشَيْنَ أَنْ أَقْتُلَهُ مَا كُنْتُ لِأَفْعَلَ ذَاكِ إِنْ شَاءَ اللَّهُ وَكَانَتْ تَقُولُ مَا رَأَيْتُ أَسِيرًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ خُبَيْبٍ لَقَدْ رَأَيْتُهُ يَأْكُلُ مِنْ قِطْفِ عِنَبٍ وَمَا بِمَكَّةَ يَوْمَئِذٍ ثَمَرَةٌ وَإِنَّهُ لَمُوثَقٌ فِي الْحَدِيدِ وَمَا كَانَ إِلَّا رِزْقٌ رَزَقَهُ اللَّهُ فَخَرَجُوا بِهِ مِنْ الْحَرَمِ لِيَقْتُلُوهُ فَقَالَ دَعُونِي أُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ انْصَرَفَ إِلَيْهِمْ فَقَالَ لَوْلَا أَنْ تَرَوْا أَنَّ مَا بِي جَزَعٌ مِنْ الْمَوْتِ لَزِدْتُ فَكَانَ أَوَّلَ مَنْ سَنَّ الرَّكْعَتَيْنِ عِنْدَ الْقَتْلِ هُوَ ثُمَّ قَالَ اللَّهُمَّ أَحْصِهِمْ عَدَدًا ثُمَّ قَالَ مَا أُبَالِي حِينَ أُقْتَلُ مُسْلِمًا عَلَى أَيِّ شِقٍّ كَانَ لِلَّهِ مَصْرَعِي وَذَلِكَ فِي ذَاتِ الْإِلَهِ وَإِنْ يَشَأْ يُبَارِكْ عَلَى أَوْصَالِ شِلْوٍ مُمَزَّعِ ثُمَّ قَامَ إِلَيْهِ عُقبَةُ بْنُ الْحَارِثِ فَقَتَلَهُ وَبَعَثَتْ قُرَيْشٌ إِلَى عَاصِمٍ لِيُؤْتَوْا بِشَيْءٍ مِنْ جَسَدِهِ يَعْرِفُونَهُ وَكَانَ عَاصِمٌ قَتَلَ عَظِيمًا مِنْ عُظَمَائِهِمْ يَوْمَ بَدْرٍ فَبَعَثَ اللَّهُ عَلَيْهِ مِثْلَ الظُّلَّةِ مِنْ الدَّبْرِ فَحَمَتْهُ مِنْ رُسُلِهِمْ فَلَمْ يَقْدِرُوا مِنْهُ عَلَى شَيْءٍ .

‘আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (কুরাইশদের গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য) আসিম ইবনে উমর ইবনুল খাত্তাবের নানা আসিম ইবনে সাবিতকে দলপতি করে একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করলেন। তারা উসফান ও মক্কার মধ্যখানে উপনীত হলে বনু লিহয়ান নামে পরিচিত হুজাইল গোত্রের উপ-গোত্রের নিকট তাদের সংবাদ পৌঁছানো হলো। তখন প্রায় একশত তিরন্দাজ তাদের অনুসরণ করল। তারা তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করতে করতে এমন একটি স্থানে পৌঁছাল, যার নিকটেই সাহাবিদের উক্ত অনুসন্ধানী দল অবস্থান করছিল। তারা সেখানে এমন কিছু খেজুরের দানা লক্ষ করল—যা উক্ত সাহাবিগণ মদিনা থেকে সফরের পাথেয় হিসেবে সংগ্রহ করেছিলেন। তারা বলল, ‘এগুলো ইয়াসরিবের খেজুর।’ এরপর তারা পদচিহ্ন অনুসরণ করে তাদের খুঁজে পেল। তখন উপায় না দেখে আসিম ও তার সাথিগণ রাযিয়াল্লাহু আনহু একটি টিলার চূড়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন। প্রতিপক্ষগণ এসে তাদের অবরোধ করল এবং বলল, ‘আমরা ওয়াদা করছি ও প্রতিশ্রুতি দান করছি, যদি তোমরা নিচে নেমে আসো, তাহলে তোমাদের কাউকে আমরা হত্যা করব না।’ আসিম রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আমি কখনো কাফেরদের কথায় বিশ্বাস করে তাদের আশ্রয়ে অবতরণ করব না। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সম্পর্কে আপনার নবীকে অবহিত করুন।’ তারা তাদের সাথে যুদ্ধ অব্যাহত রাখল এবং তারা আসিমসহ তার সাতজন সাথিকে তিরের আঘাতে শহিদ করল। আর খুবাইব, জায়েদ ও অন্য একজন অবশিষ্ট রইল। হুজায়লগণ তাদের নিরাপত্তার ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি দান করল। তারা নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি পেয়ে নিচে অবতরণ করলেন। যখন তারা কাফেরদের নিয়ন্ত্রণে এসে গেলেন, তারা তাদের ধনুকের দড়ি খুলে তাদের বেঁধে ফেলল। তৃতীয় ব্যক্তি, যিনি তাদের দুজনের সঙ্গে ছিলেন, বললেন, এটি তাদের প্রথম প্রতারণা। তিনি কাফেরদের সাথে যেতে অস্বীকার করলেন। তারা তাকে হত্যা করল। তারা খুবাইব ও জায়েদকে মক্কাতে নিয়ে গিয়ে বিক্রয় করল। বনু হারেস ইবনে আমের ইবনে নাওফাল খুবাইবকে ক্রয় করল। কেননা খুবাইব হারেসকে বদরের দিন হত্যা করেছিলেন। তিনি তাদের নিকট বন্দি অবস্থায় রইলেন। যখন তারা তাকে হত্যার ব্যাপারে একমত হলো, তিনি হারিসের এক কন্যার নিকট থেকে ক্ষৌরকার্য সম্পন্ন করার জন্য একটি ক্ষুর চাইলেন। সে তাকে ক্ষুর দিল। সে বলল, ‘আমি আমার শিশুটি থেকে কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। শিশুটি (এই অবসরে) সিঁড়িতে উঠল এবং খুবাইবের নিকট চলে গেল। তিনি তাকে নিজের কোলে বসালেন। যখন আমি তাকে (এই অবস্থায়) দেখলাম, আমি সাংঘাতিকভাবে আতঙ্কিত হলাম। তিনি তার হাতে ক্ষুর থাকা অবস্থায় আমার এই আতঙ্কিত ভাব অনুধাবন করলেন এবং বললেন, “তুমি কি ভয় পাচ্ছ যে, আমি তাকে হত্যা করব? আল্লাহর মর্জি আমি অবশ্যই তা করব না।” উক্ত নারীটি বলত, আমি খুবাইবের মতো এত ভালো বন্দি কখনো দেখিনি। আমি তাকে লৌহ জিঞ্জির বেষ্টিত অবস্থায় আঙুরের থোকা থেকে ওই সময় আঙুর ভক্ষণ করতে দেখেছি, যখন সমগ্র মক্কাতে এই ফল পাওয়া যেত না। এটি ছিল তাকে দেওয়া আল্লাহর রিজিক। তারা তাকে হারাম এলাকা থেকে হত্যার জন্য বের করে নিয়ে গেল।’ তিনি বললেন, ‘তোমরা আমাকে দুই রাকাত নামাজ আদায় করার সুযোগ দাও।’ তিনি নামাজ আদায় করে ফিরে এসে বললেন, ‘আমি মৃত্যুর ভয়ে শঙ্কিত হয়ে নামাজ দীর্ঘায়িত করেছি বলে তোমরা ধারণা করতে পারো, আমার এই ভয় না হলে আমি নামাজ আরও দীর্ঘায়িত করতাম।’ তিনিই সর্বপ্রথম নিহত হওয়ার পূর্বে দুই রাকাত নামাজ আদায় করার সুন্নাত প্রবর্তন করেন। অতঃপর তিনি দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি তাদের কাউকেও ছেড়ে দেবেন না।’ এরপর তিনি কবিতা আবৃত্তি করলেন,

‘মুসলিম হয়ে মরছি যবে মরণে আমার নেইকো ভয়।

আল্লাহর তরে দানিলাম জান অন্য কিছু মুখ্য নয়।

রবের তরেতে এ ত্যাগ আমার, তাই যদি তিনি এমনই চান।

হাড়ের জোড়ায় গোশত টুকরায় তিনি করবেন বরকত দান।’

উকবা ইবনুল হারেস এরপর তাকে শহিদ করল এবং কুরাইশদের এক দলকে আসিমের নিকট পাঠাল, তার শরীর থেকে মাংস কেটে আনতে যাতে তাকে শনাক্ত করা যায়। আসিম বদরের দিন তাদের সেরা ব্যক্তিদের একজনকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ ছায়ার মতো একদল মৌমাছি প্রেরণ করে কুরাইশদের প্রেরিত লোকদের হাত থেকে তার মৃতদেহকে হেফাজত করলেন। সুতরাং তারা কিছুই করতে পারল না।’[30]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উম্মু কিরফা – Killing of Umm Qirfa

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উয়ায়না ইবনে হিসন আল-ফাজারি – Expedition of Uyainah bin Hisn

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উসামা ইবনে জায়েদ – Expedition of Usama bin Zayd

এই ঘটনা এই হাদিসে যেমনভাবে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে, তেমনই বিস্তারিত আর কোনো হাদিসে আলোচিত হয়নি। আবু দাউদ শরিফে হাদিসটি সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণিত হয়েছে।[31] তবে ঐতিহাসিক ও সিরাতবেত্তাগণ এই যুদ্ধকে আরও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন, উল্লিখিত হাদিসটি বুখারি শরিফের যে অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে উক্ত অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে,

بَاب غَزْوَةِ الرَّجِيعِ وَرِعْلٍ وَذَكْوَانَ وَبِئْرِ مَعُونَةَ وَحَدِيثِ عَضَلٍ وَالْقَارَةِ وَعَاصِمِ بْنِ ثَابِتٍ وَخُبَيْبٍ وَأَصْحَابِهِ قَالَ ابْنُ إِسْحَاقَ حَدَّثَنَا عَاصِمُ بْنُ عُمَرَ أَنَّهَا بَعْدَ أُحُدٍ

‘আর-রাজি, রিল ও যাকওয়ান এবং বির মাউনার যুদ্ধ; আদাল ও আল-কারা, আসিম ইবনে সাবিত ও খুবাইব এবং তার সাথিদের ঘটনা।’

এই শিরোনাম কিছুটা অস্পষ্ট হওয়ার কারণে আর-রাজি ও বির মাউনার সাথে উল্লেখ হয়েছে। আর-রাজি-এর ঘটনা একটি স্বতন্ত্র ঘটনা কি না, তা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। কেননা এখানে রিল ও যাকওয়ান গোত্রদ্বয়ের নামকে বির মাউনার সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে আর রাজি ও বির মাউনা হচ্ছে দুটি পৃথক ঘটনা। আর রাজি যুদ্ধের সাথে আদাল ও আল-কারা গোত্রদয় জড়িত ছিল। আর বির মাউনার ঘটনার সাথে রিল ও যাকওয়ান গোত্রদ্বয় জড়িত ছিল।[32] সুতরাং এটি দুটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা; একটি ঘটনা নয়। ভিন্ন দুটি ঘটনাকে বুখারি রহ. একই অনুচ্ছেদে সংযুক্ত করার সম্ভাব্য কারণ হলো, এই দুটি ঘটনার চূড়ান্ত সংবাদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই রাতে পেয়েছিলেন।[33]

আর-রাজির যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ ইতিহাস, মাগাজি ও সিরাত গ্রন্থে আর-রাজি’র যুদ্ধের ঘটনা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়েছে।

যুদ্ধের কারণ

 

হিজরি চতুর্থ বর্ষের সফর মাস। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছয়[34] অথবা সাত[35] অথবা দশজন[36] সাহাবিকে বিশেষ উদ্দেশ্যে পাঠালেন। তাদেরকে প্রেরণের উদ্দেশ্য দুভাবে বর্ণিত হয়েছে। বুখারির বর্ণনা অনুযায়ী[37] গোপনে কুরাইশদের সংবাদ সংগ্রহের লক্ষ্যে তাদের পাঠানো হয়েছিল। অন্য বর্ণনায় তাদের পাঠানোর কারণ ছিল, উহুদযুদ্ধে আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে[38] সুফিয়ান ইবনে খালিদ ইবনে নুবাইহ নিহত হওয়ার পর[39] বনু লিহয়ানের লোকেরা আদাল (عَضَلْ) ও আল-কারা (الْقَارَةْ) গোত্রদ্বয়ের নিকট গিয়ে বলল, ‘এখন তোমাদের অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য হলো, তোমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে দীন ইসলাম শিক্ষার দোহাই দিয়ে তার কিছু সাহাবিকে নিয়ে আসবে। তাদের মধ্যে যারা পূর্বে আমাদের কোনো লোককে হত্যা করেছে, আমরা তাদের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য হত্যা করব। আর অবশিষ্ট লোকদের মক্কায় বিক্রয় করে অর্থ সংগ্রহ করব।’[40]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা ঈস/জায়েদ ইবনে হারিসা রা. – Expedition of Zayd ibn Harithah (Al-Is)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উক্কাশা ইবনে মিহসান রা. – Expedition of Ukasha bin Al-Mihsan

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. – Expedition of Umar ibn al-Khatab

সেই মোতাবেক আল-হুন ইবনে খুজায়মা ইবনে মুদরিকা বংশীয় আদাল (عَضَلْ) ও কারা গোত্রদ্বয়ের সাতজন[41] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমীপে উপস্থিত হলো। তারা বলল,

وذكروا أن فيهم إسلاما. وسألوا أن يبعث معهم من يعلمهم الدين، ويقرئهم القرآن.

‘তাদের মধ্যে ইসলাম বিস্তৃতি লাভ করেছে। তারা তাদের দীন শিক্ষা দান করতে এবং কুরআন পড়াতে কিছু লোক পাঠানোর অনুরোধ করল।’[42]

তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছয়[43] বা সাত[44] অথবা দশজন[45] সাহাবিকে তাদের সাথে পাঠালেন।

উল্লেখ্য, আদাল ও কারা ছিল বনু হুনের দুজন ইহুদির নাম।[46]

সুতরাং এই দুটি বর্ণনায় সাহাবিদের পাঠানোর উদ্দেশ্য দুভাবে বর্ণিত হয়েছে। জুরকানির উদ্ধৃতি দিয়ে কান্ধলবির সিরাত গ্রন্থের হাশিয়াতে[47] উল্লিখিত হয়েছে, হতে পারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কুরাইশদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে পাঠাচ্ছিলেন। এই মুহূর্তে উল্লিখিত এই দুই গোত্রের লোকেরা এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দীন ও কুরআন শিক্ষাদানের জন্য লোক চাইল। তখন তিনি দুটি উদ্দেশ্যকে একই সাথে সংযুক্ত করে উভয় লক্ষ্য হাসিলের জন্য তাদের সাথে সাহাবিদের পাঠিয়ে দিলেন।

এখানে ভিন্নমুখী দুটি বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে, তা ধারণাপ্রসূত হলেও এটির গ্রহণযোগ্যতা উপেক্ষা করা যায় না। তবে শাইখ নাইফ আল-আব্বাস গোপনে কুরাইশদের সংবাদ সংগ্রহের জন্য যে তাদের পাঠানো হয়েছিল, বুখারির এই বর্ণনাকেই বিশুদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেন।[48]

যাহোক, যেকোনো উদ্দেশ্যেই সাহাবিগণ যখন আর-রাজি নামক কূপ অথবা খেজুর বাগান অথবা স্থানের নিকট পৌঁছালেন, হুজাইল গোত্রের বনু লিহয়ান প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য[49] তাদের আক্রমণ করল।[50] সুতরাং যুদ্ধটি সংঘটিত হওয়ার কারণ হলো উহুদযুদ্ধে নিহত হুজায়লিদের গোত্রপতির হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করা।

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব (1) – Expedition of Ali ibn Abi Talib

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব রা. (3) – Expedition of Ali ibn Abi Talib

আরো পড়ুন : সারিয়্যা ইবনে আবিল আওজা – Expedition of Ibn Abi Al-Awja Al-Sulami

বিপক্ষে অংশগ্রহণকারীদের বর্ণনা

 

আদাল ও কারা গোত্র দুটি বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা করে সাহাবিদের মদিনা থেকে বের করে এনেছিল, আর বনু লিহয়ান তাদের আক্রমণ করেছিল। আদাল, কারা ও হুজাইলদের বংশীয় ধারার ছক নিচে উপস্থাপন করা হলো।

আদাল, কারা ও হযায়লদের বংশলতিকার ছক

 

আদনান » মু’আদ » আককু » কানস » নিয়ার » আনমার » মুদার » আয়্যাদ » রাবিআ » ইলয়াস » কাইস আয়লান » মুদরিকা » তানজা » খুজায়মা » হুজাইল » আসাদ » হুন » কিনানা » লিহয়ান » কারা » আদাল » আদ-দিল।[51] (লিহয়ানের বংশধরগণ বনু লিহয়ান নামে পরিচিত। তারা আর-রাজি যুদ্ধে সাহাবিদের আক্রমণ করেছিল।)

এই ছক থেকে বুঝা যাচ্ছে, আদাল ও আদ-দিল গোত্রদ্বয় কারা থেকে নির্গত হয়েছে। আল্লামা আইনির মতে, আদাল ও কারা উভয় গোত্র হলো আদ-দিল ইবনে মিলহান ইবনে গালিব ইবনে আইজা ইবনে ইয়াশবা ইবনে মালিহ ইবনুল হুন ইবনে খুজায়মা থেকে নির্গত। তাহলে ছকের শেষাংশটি হবে নিম্নরূপ,

হুন » মালিহ » ইয়াশবা » আ’ইয়া » গালিব » মিলহান » দিল » আদাল » আল-কারা।[52] এই দুই গোত্র প্রতারণা করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাহাবিদের নিয়ে এসেছিল। উল্লেখ্য, কারা গোত্রের তির চালনায় পারদর্শিতার বিষয়টি প্রবাদে পরিণত হয়েছিল।[53]

আলোচ্য ছক থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, আদাল ও কারা দুটিই দিল ইবনে মিলহান ইবনে গালিব ইবনে আইজা ইবনে ইয়াশবা ইবনে মালিহ ইবনে হুন ইবনে খুজায়মা ইবনে মুদরিকা ইবনে ইলয়াস ইবনে মুদার ইবনে নিজার ইবনে মুআদ ইবনে আদনান থেকে নির্গত হয়েছে। অন্যদিকে বনু লিয়ান হচ্ছে হুজাইল ইবনে মুদরিকা ইবনে ইলয়াস ইবনে মুদার ইবনে নিযার ইবনে মু’আদ ইবনে আদনান থেকে নির্গত। তবে ঐতিহাসিক হামদানি ধারণা করেন, বনু লিহয়ান হুজাইল থেকে নির্গত কোনো গোত্র নয়, ইয়ামান থেকে আগত জুরহুম গোত্রের অবশিষ্ট অংশ, যারা হুজাইলদের সাথে মিলিত হয়েছিল, তাদের বনু লিহয়ান বলা হয়ে থাকে।[54] কেউ কেউ বলেছেন, আল-কারা আদাল থেকে ভিন্ন কোনো গোত্র নয়। আদাল গোত্রের যারা পাহাড়ের উঁচু কালো টিলাতে বসবাস করত আরবিতে এই ধরনের কালো চূড়াকে আল-কারা বলে কথিত হওয়ার কারণে তাদের আল-কারা নামকরণ করা হয়েছে।[55]

যাহোক, আর-রাজি যুদ্ধে সাহাবিদের বনু লিহয়ানই আক্রমণ করেছিল এবং আদাল ও আল-কারা এই দুই গোত্র সাহাবিদের মদিনা থেকে প্রতারণা করে এই স্থানে নিয়ে এসেছিল।

অংশগ্রহণকারী সাহাবিগণ

 

এই যুদ্ধে কতজন সাহাবি অংশগ্রহণ করেছিলেন—সেই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ও সিরাতবিশারদগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম বুখারি রহ.-এর আর-রাজি অনুচ্ছেদে বর্ণিত এই প্রসঙ্গের হাদিসে সংখ্যার কথা উল্লেখ না থাকলেও অন্যত্র[56] তাদের সংখ্যা দশ উল্লেখ করা হয়েছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ بَعَثَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَشَرَةً عَيْنًا

‘আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশজন গুপ্তচর প্রেরণ করেছিলেন।’[57]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলকামা ইবনে মুজাযিয আল-মুদলিজী – Expedition of Alkama Ibn Mujaziz Al-Mudliji

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আল-কুররা বি’র মাউনা – Expedition of Bir Maona

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব ( ) – Expedition of Ali ibn Abi Talib (2)

তাদের ছয়জন ছিলেন মুহাজির ও চারজন ছিলেন আনসারি।[58] দশজন প্রেরণের মতকে সমর্থন করেন। The Encyclopaedia of Islam বলা হয়েছে, …a small body of ten of the prophet’s followers was discovered and surrounded between Mecea and Usfan.[59] উর্দু দাইরা মা’আরিফি ইসলামিয়াতে সাতজন উল্লেখ করা হয়েছে।[60] ইবনে হিশাম[61] ও ইবনে হাযম[62] এই যুদ্ধে প্রেরিত সাহাবিদের সংখ্যা ছয়জন বলেছেন। নদভি রহ. এই মতকে সমর্থন করে বলেন, The Messenger of Allah sent six of his Companions including Asim ibn Thabit, Khubayb ibn Adi and Zayd ibn al-Dathinah (p. ৯৪)। যারা ছয়জন প্রেরণের মতকে গ্রহণ করেন তারা সেই ছয়জনের নামও উল্লেখ করেন। তারা হলেন,

১. মারসাদ ইবনে আবি মারসাদ কাননাজ ইবনে হুসাইন ইবনে আরবু ইবনে খারাশা ইবনু সাদ, আল-গানাবি রাযিয়াল্লাহু আনহু।[63]

২. আসিম ইবনে সাবিত ইবনে আফিল আকলাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু—তিনি ছিলেন আসিম ইবনে উমর ইবনুল খাত্তাবের নানা। উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু জামিলা বিনতে আসিম ইবনে সাবিতকে বিবাহ করেছিলেন। তার গর্ভেই আসিম ইবনে উমর জন্মগ্রহণ করেন।[64] অন্য বর্ণনায় এসেছে, তার মাতা ছিলেন, শামুস বিনতে আবি আমের।[65] কারো মতে তিনি ছিলেন আসিম ইবনে উমর ইবনে খাত্তাবের মামা।[66] তবে নানা হওয়াটাই গ্রহণযোগ্য। ইমাম বুখারি রহ.-এর বর্ণিত হাদিসও এটিকে সমর্থন করে।[67]

৩. খালিদ ইবনে বুকাইর ইবনে আবদ ইয়ালিল ইবনে নাশিব আল-লাইসি রাযিয়াল্লাহু আনহু আল-কিনানি।[68] তিনি ৩৪ বছর বয়সে শহিদ হন।

৪. খুবাইব ইবনে আদি আল-আনসারি।

৫. জায়েদ ইবনুদ দাসিনা ইবনে মুআবিয়া আল-বায়াদি।

৬. আবদুহ ইবনে তারিক।

মুহাম্মাদ আবদুল ওয়াহ্হাব[69] ও দানাপুরি[70] ছয়জন প্রেরিত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। ইবনে সাদ দশজন প্রেরণের তথ্যটির প্রতি জোর সমর্থন দিয়েছেন। তবে তিনি উপরোল্লিখিত ছয় ব্যক্তির সাথে শুধু সপ্তম ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেন,[71] অবশিষ্ট তিনজনের নাম উল্লেখ করেননি। তিনি যে সপ্তম ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেন তিনি হচ্ছেন,

৭. মুআত্তিব ইবনে উবায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু[72] অথবা মুআত্তিব ইবনে আওফ।[73] তিনি ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে তারিকের বৈপিত্রেয় ভাই। মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব,[74] ইবনে হাজার[75] ও মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি,[76] ১০ জনকে প্রেরণের প্রতি সমর্থন দিয়ে উপরোল্লিখিত সাতজনের নামই উল্লেখ করেছেন। ইসলামি বিশ্বকোষেও এই সাতজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।[77]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবুল হাদরাদ – Expedition of Abi Hadrad al-Aslami

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আমর ইবনুল আস – Expedition of Amr ibn al-As

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আমর ইবনে উমাইয়া আদ-দামরি রা. – Expedition of Amr bin Umayyah al-Damri

মুসা ইবনে উকবা সপ্তম নম্বরে মুআত্তিবের পরিবর্তে মুগিস ইবনে আওফ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নাম উল্লেখ করেন।[78] আমরা এই ব্যক্তিকে অষ্টম ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করতে পারি। তা হলে অষ্টম ব্যক্তি হলেন মুগিস ইবনে আওফ রাযিয়াল্লাহু আনহু।

রহমাতুল্লিল আলামিন গ্রন্থে আর-রাজি-এর শহিদদের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেখানে অত্র উল্লিখিত প্রথম ছয় ব্যক্তির সাথে অন্য দুটি নাম সংযোজন করে আট জনের নামই উল্লেখ করা হয়েছে।[79] আমরা উপরে বর্ণিত আটজন সাহাবি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নামের সাথে ওই দুটি নাম সংযুক্ত করলে এই যুদ্ধে বুখারির বর্ণনা অনুযায়ী যে দশজন সাহাবিকে পাঠানো হয়েছিল, তাদের নামের সংখ্যা পূর্ণ হয়। উক্ত দুইজন সাহাবি হলেন,

৯. জায়েদ ইবনে মুযায়্যিন আনসারি বায়াদি রাযিয়াল্লাহু আনহু;

১০. মুগিস ইবনে উবায়দা ইবনে আবি ইয়াস মালাবি রাযিয়াল্লাহু আনহু।[80]

এই দশজন সাহাবি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দলপতি কে ছিলেন—এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন দুটি বর্ণনা পাওয়া যায়। কারো মতে তাদের দলপতি ছিলেন মারসাদ ইবনে আবি মারসাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু।[81] অন্য বর্ণনায় তাদের দলপতি ছিলেন আসিম ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু।[82] ইমাম বুখারির বিশুদ্ধ বর্ণনায় যেহেতু আসিম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দলপতি করার কথা উল্লিখিত হয়েছে এবং মূল রণাঙ্গণের যে চিত্র বিভিন্ন বর্ণনায় পরিলক্ষিত হয়, সেখানে আসিম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অগ্রগণ্য ভূমিকাও এই কথার বাস্তব প্রমাণ যে—তিনিই ছিলেন এই যুদ্ধের দলপতি।

রণাঙ্গণ ও সাহাবিগণ যখন আর-রাজি নামক স্থানে উপনীত হলেন, তখন আদাল ও আল-কারা গোত্রের যারা তাদের সাথি ছিল, তারা বিশ্বাসঘাতকতা করল। তারা হুজাইল গোত্রকে তাদের আক্রমণ করার জন্য চিৎকার করে আহ্বান জানাল। মতান্তরে তাদের হত্যা করার জন্য ইঙ্গিত করল। এরপর ওই গোত্রের সকল পুরুষ তরবারি নিয়ে বের হলো। তারা ছিল সংখ্যায় দুইশত। কোনো কোনো বর্ণনায় বলা হয়েছে, তখন তাদের মধ্য থেকে একশত যোদ্ধা হাতে তির-তরবারি নিয়ে বের হয়ে পড়ল। সাহাবিগণ রাযিয়াল্লাহু আনহু সংবাদ সংগ্রহের জন্য এসেছিলেন, যোদ্ধা হিসেবে নয়। আত্মরক্ষার জন্য সামান্য কিছু সরঞ্জাম ছাড়া তাদের নিকট কিছুই ছিল না। অবস্থার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সাহাবিগণ রাযিয়াল্লাহু আনহু পাহাড়ের উঁচু চূড়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন।[83]

শত্রু পক্ষ তাদের খুঁজতে লাগল। একপর্যায়ে তারা এক স্থানে শুধুমাত্র মদিনা মুনাওয়ারাতে উৎপাদিত খেজুরের দানা[84] ছড়িয়ে থাকতে দেখল। তাদের মোটেও বুঝতো কষ্ট হলো না যে, শুধু মদিনাতে যে ধরনের খেজুর উৎপন্ন হয়ে থাকে—এটি সেই খেজুরেরই দানা। তখন তাদের ধারণা আরও পাকাপোক্ত হলো, ‘আশেপাশে কোথায়ও মুহাম্মাদের সাথিরা আত্মগোপন করে রয়েছেন।’ অবশেষে তারা তাদের সন্ধান পেল। যে পাহাড়ের চূড়াতে তারা আশ্রয়গ্রহণ করেছিলেন—সেই স্থান অবরোধ করল।[85]

এ সময় শত্রুপক্ষ তাদের বলল, ‘তোমরা যদি আত্মসমর্পণ করো, তাহলে আমরা তোমাদের কাউকেও হত্যা না করার অঙ্গীকার করছি।[86] আমরা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে চাই না। তোমাদের মক্কার অধিবাসীদের নিকট বিক্রয় করে কিছু অর্থ উপার্জন করার ইচ্ছা পোষণ করছি মাত্র।’[87] শত্রুপক্ষের এই প্রতিশ্রুতি শুনে আসিম ইবনে সাবিত, মারসাদ ইবনে আবি মারসাদ ও খালিদ ইবনে বুকাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমরা কোনো মুশরিকের প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করতে পারি না।’[88] সাহাবিগণ আল্লাহর উপর ভরসা করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন।

আসিম রাযিয়াল্লাহু আনহু তির শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার অন্যান্য সঙ্গীসহ (৭ জন) প্রাণপণে তির নিক্ষেপ করতে লাগলেন। একসময় তির শেষ হয়ে গেল। তিনি ক্ষান্ত হলেন না। বীরবিক্রমে বর্শা দিয়ে শত্রুদের সজোরে আঘাত হানতে লাগলেন। যখন বর্শা ভেঙে গেল, তখন শাহাদাতের নেশায় উদ্দীপ্ত হয়ে সর্বশক্তি ব্যয় করে তরবারি চালাতে লাগলেন।[89] প্রথমে তির, পরে বর্শা এবং সর্বশেষে তরবারি ব্যবহার করে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার এই যে অভিনব পদ্ধতি এই যুদ্ধে আসিম রাযিয়াল্লাহু আনহু অনুসরণ করেছিলেন—বদরের যুদ্ধেও আসিমের এই বিজ্ঞানসম্মত যুদ্ধ পদ্ধতিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।[90]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ – Expedition of Abu Ubaidah ibn al Jarrah

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু কাতাদা ইবনে রিবঈ – Expedition of Abu Qatadah ibn Rab’i al-Ansari (Batn Edam)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু সালামা – Expedition of Qatan

আসিম ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু তরবারি নিয়ে বীরদর্পে যুদ্ধ করতে করতে একপর্যায়ে তার তরবারির হাতল ভেঙে গেল। তিনি সেই ভাঙা তরবারি নিয়ে লড়াই অব্যাহত রাখলেন। দুইজন শত্রুকে শক্ত আঘাত হানিয়ে আহত করলেন, অন্য একজনকে হত্যা করলেন। সবশেষে শত্রুরা তাকে তীক্ষ্ণ বর্শার নির্মম আঘাতে জর্জরিত করল। আল্লাহর এই নির্ভীক সৈনিক জান্নাতের সুগন্ধ স্পর্শ করলেন। তখন তিনি দোয়া করলেন,

اللهم أخبرنا رسول الله اللهم حمیت دینك أول نهاری فاحم لحمى اخره.

‘হে আল্লাহ! আমাদের অবস্থার সংবাদ আপনার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পৌঁছিয়ে দিন। হে আল্লাহ! আমি আপনার দীনকে দিনের প্রথম অংশে রক্ষা করেছি, আপনি আমার দেহকে দিনের শেষে রক্ষা করুন।’[91] উল্লেখ্য, তিনি যেদিন শাহাদাতবরণ করেছিলেন, এই দোয়ায় মহান রাব্বুল আলামিন তার শাহাদাতের খবর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তৎক্ষণাৎ পৌঁছে দিয়েছিলেন।[92]

আসিম রাযিয়াল্লাহু আনহু এভাবে শাহাদাত লাভ করলেন।[93] তার পর মুআত্তিব ইবনে উবায়েদ মরণপণ লড়ে যেতে লাগলেন। হঠাৎ তিনি শত্রুদের তরবারির আঘাতে আহত হলেন। সুযোগ পেয়ে শত্রুরা তাকেও শহিদ করল।[94] তারা দুজনসহ আটজনকে[95] অথবা ৬ জন,[96] মতান্তরে সাতজনকে অত্যন্ত নির্মমভাবে শহিদ করল।[97] এই শহিদদের ৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন : আসিম, মারসাদ, খালিদ ও মুআত্তিব।[98] প্রতিশোধপরায়ণ শত্রুরা আসিম ব্যতীত অন্য শহিদদের শাহাদাতবরণের পর তাদের শরীর থেকে কাপড় খুলে ফেলল।[99]

এক অলৌকিক ঘটনা ও উহুদের যুদ্ধে সুলাফার দুই পুত্র আসিম কর্তৃক নিহত হওয়ায় সুলাফা শপথ করেছিল, সে আসিমের মাথার খুলিতে মদ পান করবে। এজন্য যে তার মাথা তাকে এনে দেবে—তাকে একশত উট পুরস্কার দেবে বলে সে ঘোষণা দেয়।[100] আসিম রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের স্বগোত্রীয় চাচাতো ভাই। কথিত আছে, এই ঘোষণার পর জনৈক ব্যক্তি আবু সুফিয়ান ইবনে হারবকে বলল, ‘তোমারই চাচাতো ভাইয়ের মাথার খুলিতে অন্যে মদপান করবে, এটি কেমন করে হয়! বংশের তো একটা মর্যাদা রয়েছে।’ এতৎসত্ত্বেও কুফরিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত আবু সুফিয়ানের মনে এই কথা কোনো রেখাপাত করল না।[101] লোভনীয় এই পুরস্কারের খবর সমগ্র আরব গোত্রের মধ্যে বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ল। এই মহামূল্য পুরস্কারের লোভে অনেক কাফেরই আসিমকে হত্যার জন্য আসিমের মাথা অর্জনের আকাঙ্ক্ষায় প্রহর গুণছিল।

আরো পড়ুন : সাফওয়ানা অভিযান – First Expedition to Badr (Safwan)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস রা. – Expedition of Abdullah Ibn Unais

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা রা. – ‘Abdullah ibn Hudaffa

সুবর্ণ সুযোগ এসে উপস্থিত হলো। হুজাইলগণ শহিদ আসিমের মাথা সংগ্রহ করার জন্য তার লাশের নিকট উপস্থিত হলো।[102] কুরাইশরাও তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে আসিমের মাথা সংগ্রহ করার জন্য পাঠাল।[103] মহান আল্লাহর কী অপূর্ব শান! তার দীনের জন্য আত্মউৎসর্গকারী আসিমের মাথা মোবারক অপবিত্র মুশরিকদের হাত থেকে হেফাজতের দায়িত্ব তিনি নিজেই গ্রহণ করলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আসিমের দোয়া, ‘হে আল্লাহ! দিনের প্রথম অংশে আমি আপনার দীনকে হেফাজত করেছি। আপনি এটির শেষাংশে আমার দেহকে হেফাজত করুন’—কবুল করলেন। অত্যন্ত অলৌকিকভাবে আল্লাহ একদল ভীমরুল অথবা পুরুষ মৌমাছি পাঠালেন। তারা আসিমের শহিদি লাশকে ঘিরে ধরল। বিষাক্ত দংশক ভীমরুলের ভয়ে তারা তার মাথা সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলো।

রাতে এই পোকাগুলো অবশ্যই চলে যাবে, সুতরাং সকালে এই মহামূল্য মাথা সংগ্রহ করতে তাদের মোটেও অসুবিধা হবে না। এই আশায় বুক বেঁধে তারা সকলেই প্রস্থান করল। পরের দিন সকালে নির্বিঘ্নে আসিমের মাথা সংগ্রহ করার আকাঙ্ক্ষায় যখন তারা সমবেত হলো, তখন দেখল, রাতে প্রবল বর্ষণের ফলে পানি আসিমের পবিত্র দেহকে নির্ধারিত স্থান থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তারা তার লাশ আর খুঁজে পেল না।[104]

পুরুষ মৌমাছি, ডাঁশ বা ভীমরুল জাতীয় এ ধরনের প্রাণীকে আরবিতে আদ-দাবর (الدَبَر) বলা হয়ে থাকে। মহান আল্লাহ যেহেতু আসিম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তার এই আদ-দাবর সৈনিকদের মাধ্যমে হেফাজত করেছিলেন, সেজন্য ইসলামের ইতিহাসে আসিম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে হামিয়্যুদ দাবর বা মৌমাছি কর্তৃক রক্ষিত বলা হয়ে থাকে।[105]

 উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন শুনতে পেলেন, মৌমাছিরা আসিম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মৃতদেহ পাহারা দিয়েছিল, তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহ তার মুমিন বান্দাকে রক্ষণাবেক্ষণ করেন। আসিম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দোয়া ছিল, তার জীবদ্দশায় যেন কোনো মুশরিক তাকে স্পর্শ করতে না পারে। তিনি তার মৃত্যুর পরেও মুশরিকদের থেকে তার মৃতদেহকে রক্ষণাবেক্ষণ করলেন।’[106]

যাহোক, জানবাজ এই দশজন সাহাবি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মধ্য থেকে সাতজন শাহাদাত লাভে ধন্য হলেন। অবশিষ্ট রইলেন তিনজন ও জায়েদ ইবনুদ দাসিনা, খুবাইব ইবনে আদি ও আবদুল্লাহ ইবনে তারিক রাযিয়াল্লাহু আনহু। অবশিষ্ট তিনজন পাহাড়ের চূড়া থেকে অবতরণ করে দুবৃত্ত কাফেরদের নিকট আত্মসমর্পণ করলেন। বিশ্বাসঘাতক এই কাফেররা আত্মসমর্পণের পরও সামান্য দয়া তো দেখায়নি; বরং পাষাণ্ডরা অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে তাদেরকে শহিদ করে।

আবদুল্লাহ ইবনে তারিক রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শাহাদাত

 

জায়েদ ইবনুদ দাসিনা ও খুবাইব ইবনে আদি রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে অর্থলিপ্সু কাফেররা মক্কা নগরীতে বিক্রয় করার পূর্বেই আবদুল্লাহ ইবনে তারিককে শহিদ করল। তবে তাকে কোথায় কীভাবে শহিদ করা হলো, তাতে মতভেদ রয়েছে। কাফেরদের অভয়বাণী ও প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে জায়েদ ইবনুদ দাসিনা, খুবাইব ইবনে আদি ও আবদুল্লাহ ইবনে তারিক রাযিয়াল্লাহু আনহু কাফেরদের নিকট আত্মসমর্পণ করলেন। কাফেররা তাদের নিজেদের আওতায় পেয়ে ধনুকের রশি খুলে বাঁধা শুরু করল।[107] আবদুল্লাহ ইবনে তারিক রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতাকে বুঝতে পারলেন। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বললেন, ‘আমাদের তোমরা যে এখনই বেঁধে ফেলছ এটিই হচ্ছে তোমাদের প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা।’ ঘটনাটি জাহরান নামক স্থানে সংঘটিত হয়েছিল। তিনি তাদের সঙ্গে যেতে অস্বীকার করলেন। তারা সেখানেই আল্লাহর এই আপসহীন মুজাহিদকে শহিদ করল।[108] ইবনে হাজার পাহাড়ের চূড়া থেকে অবতরণের সাথে সাথেই আবদুল্লাহকে হত্যা করার বর্ণনাকে বিশুদ্ধ বলে মত দিয়েছেন।[109] অন্য বর্ণনায় এসেছে, জায়েদ ইবনে দাসিনা, খুবাইব ইবনে আদি ও আবদুল্লাহ ইবনে তারিক রাযিয়াল্লাহু আনহু পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে অবতরণ করলে তারা তাদের বেঁধে ফেলল। বাঁধা অবস্থাতেই তাদের বিক্রয় করার জন্য মক্কায় নিয়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে আজ-জাহরান,[110] মতান্তরে মাররুজ জাহরান[111] নামক স্থানে এলে আবদুল্লাহ ইবনে তারিক তার হাতের বাঁধন খুলে ফেললেন এবং নিজের তরবারি কোষমুক্ত করলেন। তখন কাফেররা তাকে পাথর নিক্ষেপ করে অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে শহিদ করল।[112] অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে, কাফেররা তাদের না বেঁধেই মক্কাতে নিয়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে আজ-জাহরান নামক স্থানে উপস্থিত হলে সতর্কতার জন্য ধনুকের রশি ছিড়ে তা দ্বারা তাদের বেঁধে ফেলল। আবদুল্লাহ ইবনে তারিক রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন,

هَذَا أَوّلُ الْغَدْرِ! وَاَللهِ لَا أُصَاحِبُكُمْ، إنّ لِي فِي هَؤُلَاءِ لَأُسْوَةٌ

‘এটিই হচ্ছে প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা। আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের সাথে যাব না। নিশ্চয় ওই সমস্ত শহিদের মধ্যেই আমার অনুকরণীয় আদর্শ নিহিত রয়েছে।’[113]

আরো পড়ুন : মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রা.-এর অভিযান – Expedition of Muhammad ibn Maslamah

আরো পড়ুন : যুল ক্বাসসাহর দ্বিতীয় অভিযান – Second expedition of Zul Qassah

আরো পড়ুন : যুল ক্বাসসাহর প্রথম অভিযান – First expedition of Dhul Qassah

তিনি একপর্যায়ে তার নিজের হাত বাঁধনমুক্ত করলেন, উন্মুক্ত করলেন নিজের তরবারি। দুর্ধর্ষ শত্রুরা তাকে পরাজিত করল। তারা পুনরায় তাকে বাঁধার চেষ্টা চালাল। তিনি সুকৌশলে তাদের হাত থেকে ছুটে গেলেন। তখন কাফেররা তাকে পাথর নিক্ষেপ করে নির্মমভাবে শহিদ করল।[114] আবদুল্লাহ ইবনে তারিকের কবর উক্ত আজ-জাহরানেই অবস্থিত।[115] অবশেষে কাফেররা অবশিষ্ট দুইজন জায়েদ ইবনুদ দাসিনা ও খুবাইব ইবনে আদিকে মক্কায় নিয়ে গেল।[116]

জায়েদ ইবনুদ দাসিনা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শাহাদাত

 

কাফেররা জায়েদ ইবনুদ দাসিনাকে নিয়ে মক্কা নগরীতে উপস্থিত হলো। তারা তাকে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার নিকট ৫০টি উটের বিনিময়ে,[117] মতান্তরে মক্কায় অবরুদ্ধ হুজাইলদের বন্দির বিনিময়ে[118] বিক্রয় করল। খুবাইব ও জায়েদ দুজনকে হুজাইলদের দুই বন্দির বিনিময়ে বিক্রয়ের কথাও অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে।[119] সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া ইবনে খালাফ তাকে তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য ক্রয় করেছিল।[120] উমাইয়া ইবনে খালাফ মুসলমানদের হাতে বদরযুদ্ধে নিহত হয়েছিল। যখন জায়েদ ইবনুদ দাসিনা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বিক্রয় করা হয়েছিল, তখন ছিল জিলকদ মাস। এই মাসে হত্যাকে তারা বৈধ মনে করত না। সেজন্য সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া জায়েদ ইবনুদ দাসিনা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তার ক্রীতদাস নাসতাসের নিকট[121] অথবা বনু জুমাহের কিছু লোকের নিকট বন্দি করে রাখল।[122]

নিষিদ্ধ মাস জিলকদ অতিবাহিত হলো। মক্কার হারাম শরিফের বাইরে নিয়ে তাকে হত্যা করার জন্য সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া নাসতাসের হাতে তাকে অর্পণ করল। নাসতাস হারাম শরিফের বাইরে তানঈম নামক স্থানে তাকে হত্যা করার জন্য নিয়ে গেল। শত্রু নিধনের তামাশা উপভোগ করার জন্য বেশকিছু কুরাইশ তানঈমে একত্র হলো। তাদের মধ্যে আবু সুফিয়ান ইবনে হারবও ছিলেন। তিনি তখনো ছিলেন অমুসলিম। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পূর্বে আবু সুফিয়ান ইবনে হারব জায়েদ ইবনুদ দাসিনা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জিজ্ঞাসা করলেন,

أَنْشُدُكَ اللَّهَ أَتُحِبُّ أَنَّ مُحَمَّدًا الْآنَ عِنْدَنَا مَكَانَكَ نَضْرِبُ عُنُقَهُ وَأَنَّكَ فِي أَهْلِكَ؟

‘আল্লাহর শপথ করে আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি হে জায়েদ! তুমি কি পছন্দ করো যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তুমি যেখানে এখন রয়েছ তোমার স্থলে হোক এবং আমরা তার গর্দান উড়িয়ে দিই, আর তার বিনিময়ে তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের মধ্যে ফিরে যাও?’ অন্য বর্ণনায় এই কথাটি নাসতাসের বলে বর্ণিত হয়েছে।[123] ঈমানের তেজোদীপ্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অনাবিল ভালোবাসার চূড়ান্ত নমুনাস্বরূপ জায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দ্বিধাহীন চিত্তে ঘোষণা করলেন,

مَا أُحِبُّ أَنَّ مُحَمَّدًا الْآنَ مَكَانَهُ الَّذِي هُوَ فِيهِ تُصِيبُهُ شَوْكَةٌ تُؤْذِيهِ وَأَنَا جَالِسٌ فِي أَهْلِي.

‘আল্লাহর শপথ! যে স্থানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখন অবস্থান করছেন, তিনি যদি সেখানেই অবস্থান করেন আর তাকে এমন একটি কাঁটা আঘাত হানে—যা তাকে কষ্ট দেবে, এটুকুর বিনিময়েও আমাকে আমার পরিবারের সাথে বসবার সুযোগ গ্রহণকে আমি পছন্দ করি না।’

তার এই বলিষ্ঠ বক্তব্য শুনে আবু সুফিয়ান বিস্মিত হয়ে বললেন,

مَا رَأَيْتُ مِنَ النَّاسِ أَحَدًا يُحِبُّ كَحُبِّ أَصْحَابِ مُحَمَّدٍ مُحَمَّدًا.

‘আমি কখনো একজন মানুষকে অন্যকে এত বেশি ভালোবাসতে দেখিনি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিদের যেমন মুহাম্মাদকে ভালোবাসতে দেখেছি।’[124]

আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও জায়েদ ইবনুদ দাসিনা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মধ্যকার বাক্যবিনিময় কি তাদের দুজনের মধ্যেই হয়েছিল, না আবু সুফিয়ান ও খুবাইব ইবনে আদি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মধ্যে হয়েছিল—তাতে ইবনে হাজম সন্দেহ পোষণ করেন।[125] সম্ভবত আবু সুফিয়ান ইবনে হারব-এর এই একই কথোপকথন খুবাইব ইবনে আদি ও জায়েদ ইবনুদ দাসিনা রাযিয়াল্লাহু আনহু উভয়ের সাথেই হয়েছিল।[126] অবশেষে নাসতাস অত্যন্ত নির্মমভাবে আল্লাহর এই শার্দুল মুজাহিদকে শহিদ করল।[127] উল্লেখ্য, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার এই ক্রীতদাস নাসতাস পরে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।

আরো পড়ুন : বদরের যুদ্ধ – Battle of Badr

আরো পড়ুন : বনু সুলাইম অভিযান – Al Kudr Invasion

আরো পড়ুন : বাতনে রাগিব অভিযান – Expedition of Ubaydah ibn al-Harith

 

খুবাইব ইবনে আদি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শাহাদাত

 

জায়েদ ইবনুদ দাসিনা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে জাহজাবি ইবনে জুলফা ইবনে আমর ইবনে আওফ গোত্রের[128] খুবাইব ইবনে আদি রাযিয়াল্লাহু আনহু-কেও হুজালিগণ মক্কায় নিয়ে এলো । তাকে হুদাইর ইবনে আবি ইহাব আত-তামিমির ভ্রাতুষ্পুত্র[129] উকবা ইবনুল হারেস ইবনে আমের ইবনে নাওফালের নিকট একটি কালো ক্রীতদাসী[130] অথবা আশি মিসকাল স্বর্ণ বা পঞ্চাশটি উটের বিনিময়ে বিক্রয় করা হলো।[131] অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে, তাকে হুজালিগণ মক্কায় তাদের গোত্রের একজন বন্দির বিনিময়ে বিক্রয় করেছিল।[132] আরও কথিত আছে, তাকে হারেস ইবনে নাওফলের এক কন্যার নিকট একশত উটের বিনিময়ে বিক্রয় করা হয়েছিল।[133] এখানে বিভিন্ন প্রকার বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কীসের বিনিময়ে তাকে বিক্রি করা হয়েছিল এবং কে ক্রেতা ছিল—তা নিয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হলেও তাকে যে বিক্রয় করা হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই।

খুবাইব ইবনে আদি রাযিয়াল্লাহু আনহু বদরের যুদ্ধে উকবার পিতা হারেস ইবনে আমের ইবনে নাওফালকে হত্যা করেছিলেন।[134] খুবাইবকে হত্যা করে হারিসের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্যই তারা তাকে ক্রয় করেছিল।[135] অন্যত্র বর্ণিত আছে, যাদের পিতারা বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিল, তারা সকলে মিলে সম্মিলিতভাবে তাদের পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের আকাঙ্ক্ষায় খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ক্রয় করেছিল। তারা হলো আবু ইহাব ইবনে আজিজ, ইকরামা ইবনে আবি জাহল, আখনাস ইবনে শারিক, উবায়দা ইবনে হাকিম ইবনিল আওকাস, উমাইয়া ইবনে আবি উতবা, ইবনুল হাদরামি, শুবা ইবনে আবদিল্লাহ ও সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া।[136] খুবাইব ইবনে আদি রাযিয়াল্লাহু আনহু উল্লিখিত সকল কুরাইশের পিতাদের হত্যা করেননি। তিনি শুধু উকবা ইবনে হারিসের পিতাকে হত্যা করেছিলেন। যেহেতু তাদের পিতাগণ মুসলমানদের হাতেই নিহত হয়েছিল, সেহেতু প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তারা খুবাইবকে হত্যা করার আকাঙ্ক্ষায় ক্রয় করেছিল।

কোনো কোনো ঐতিহাসিক খুবাইব ইবনে আদি রাযিয়াল্লাহু আনহু বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি বলে মত প্রকাশ করেন। ঐতিহাসিক দিময়াতি বলেছেন, খুবাইব ইবনে আদি রাযিয়াল্লাহু আনহু, বদরের যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন না, তিনি ছিলেন আওস গোত্রের লোক। যে খুবাইব হারেস ইবনে আমেরকে হত্যা করেছিলেন, তিনি হলেন খুবাইব ইবনে ইসাফ। তিনি ছিলেন খাযরাজ গোত্রের লোক।[137] দিময়াতি রহ.-এর এই ধারণা সঠিক নয়। বুখারি শরিফের বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারাই প্রমাণিত, খুবাইব ইবনে আদি বদরের যুদ্ধেই হারেস ইবনে আমের ইবনে নাওফালকে হত্যা করেছিলেন।[138] বিশুদ্ধ এই বর্ণনার উপর ভিত্তি করে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, খুবাইব ইবনে আদি বদরের যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন।

অন্য একটি যৌক্তিক কারণেও এই বাস্তব সত্য প্রমাণিত হয়। অসংখ্য বর্ণনায় বলা হয়েছে, বদরের যুদ্ধে হত্যাকারী হিসেবেই প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্যে খুবাইব ইবনে আদিকে মক্কাতে হত্যা করা হয়েছিল। দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে হত্যা প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিশোধমূলকভাবে কারো হত্যা আরবদের সেই সমাজে প্রচলিত ছিল না। যেহেতু কুরাইশরা তাকে হত্যাকারী হিসেবে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে হত্যা করেছিল, সেহেতু এটি দ্বারা প্রমাণিত হয়, খুবাইব ইবনে আদি বদরের যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের কাউকেও না কাহাকে হত্যাও করেছিলেন। অবশ্য এই সমস্ত বর্ণনা ও দিময়াতির মতামতের এই পার্থক্যকে দূর করার জন্য কেউ কেউ বলেছেন, ‘এমনও হতে পারে, খুবাইব ইবনে আদি ও খুবাইব ইবনে ইসাফ উভয়েই হারেস ইবনে আমেরকে হত্যা করেছিলেন।’[139] বাহ্যত এই কথাটি দুটি সাংঘর্ষিক মতকে সমন্বয় সাধনের প্রয়াস হিসেবে গ্রহণযোগ্য মনে হলেও এটির কোনো প্রমাণ কোনো গ্রহণযোগ্য বর্ণনায় না পাওয়ার কারণে তা প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণ করা যায় না।

জিলকদ মাস নিষিদ্ধ মাসসমূহের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এ সময় খুবাইব ইবনে আদি রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে হত্যা না করে হারেস ইবনে আমেরের বাড়িতে বন্দি করে রাখল।[140] অন্য বর্ণনায় এসেছে, তাকে বনু আবদে মানাফের হুদাইর ইবনে আবি ইহাবের ক্রীতদাসী[141] মারিয়া,[142] মতান্তরে হুজাইন ইবনে আবি ইহাবের ক্রীতদাসী মারিয়া,[143] ইবনে বাত্তালের বর্ণনানুযায়ী হুজাইন ইবনে আবি ইহাবের ক্রীতদাসী জুওয়ায়রিয়া-[144]এর গৃহে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। মারিয়া পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।[145]

মারিয়া বলেছেন, ‘খুবাইব ইবনে আদি সুললিত কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করে সালাতুত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। আশেপাশের নারীরা তার আকর্ষণীয় এই তেলাওয়াত বিমুগ্ধ হয়ে শ্রবণ করত। ধীরে ধীরে তারা খুবাইবের প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ল। তারা তার প্রতি নমনীয় ব্যবহার শুরু করল। আমি ছিলাম তাদের অন্যতম। আমি দয়ার্দ্র হয়ে খুবাইবকে জিজ্ঞাসা করলাম, “হে খুবাইব! আপনি কি কোনো কিছুর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন? প্রয়োজনে আমি আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত রয়েছি।” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আমি সুমিষ্ট পানির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। আশা করি তুমি তা আমাকে সরবরাহ করবে। আমি আরও আশা করি, শুধু আল্লাহর নামে জবেহকৃত পশু ব্যতীত অন্য কারো নামে জবেহকৃত পশুর গোশত আমাকে কখনো খাওয়াবে না। আর তারা আমাকে যখন হত্যা করার সময় নির্ধারণ করবে, তুমি আমাকে তা আগাম জানিয়ে দেবে।”’[146] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জিজ্ঞাসা করা হয়নি, তিনি উপযাচক হয়ে হারেস ইবনে আমেরের ক্রীতদাস মাওহাবের নিকট থেকে এই তিনটি জিনিস চেয়েছিলেন।[147]

কুরাইশগণ বন্দি অবস্থায় খুবাইব ইবনে আদির প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর আচরণ করত। অতিষ্ঠ হয়ে একসময় খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হায়! সম্মানিত লোক বলে যারা নিজেদের দাবি করে, তারা কি তাদের বন্দির সাথে ভালো আচরণ করতে পারে না?’ খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এই নীতিবাক্য তাদের বিবেককে কশাঘাত করল। বাধ্য হয়ে তারা খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রতি ভালো ব্যবহার শুরু করল এবং তার দেখাশোনা করার জন্য একজন নারীকে পরিচারিকা হিসেবে নিয়োগ করল।[148] সম্ভবত সেই নারীটি হলো উপরোল্লিখিত মারিয়া।

খুবাইব ইবনে আদি রাযিয়াল্লাহু আনহু লৌহবেষ্টিত ঘরে বন্দি জীবনযাপন করে দিন অতিবাহিত করছেন। জয়নব বিনতে হারেস ইবনে আমের ইবনে নাওফাল,[149] মতান্তরে হুজাইন ইবনে আবি ইহাবের ক্রীতদাসী মারিয়া অথবা মারিয়া হঠাৎ তার কাছে উপস্থিত হলো এবং দেখল, তিনি মানুষের মাথার মত বড় আঙুরের থোকা থেকে সুন্দর সুন্দর আঙুর ভক্ষণ করছেন।

বর্ণনাকারী বলেন, সে সময় মক্কাতে এ ধরনের কোনো ফল পাওয়া যেতো না। এমনকি ভূ-পৃষ্ঠে উৎপাদিত কোনো আঙুর থেকে এই আঙুর ছিল একেবারেই ভিন্ন।[150] নিঃসন্দেহে এটি একটি অলৌকিক ঘটনা। এই আঙুর আসলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হয়েছিল। যারা আল্লাহর জন্যই নিবেদিত, আল্লাহর দীনের জন্যই যারা নিজেদের উৎসর্গ করেন, স্বয়ং রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে তাদের এই ধরনের সম্মানিত রিজিক সরবরাহ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

ইবনে বাত্তালের মতে খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আল্লাহ পক্ষ থেকে রিজিক সরবরাহ আল্লাহর কুদরতের ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের অকাট্য প্রমাণের জন্য একটি জ্বলন্ত নিদর্শন। তবে সচরাচর সংঘটিত হয় না নিয়ম বহির্ভূত এমন যেকোনো অলৌকিক ঘটনা—যা দেখে মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়, যা এমন আশ্চর্য যে, মানুষের চোখকে স্থির করে ফেলে, এ ধরনের কোনো ঘটনা নবীরা ব্যতীত অন্যদের নিকট থেকে সংঘটিত হওয়া সম্ভবপর নয়। ইবনে হাজারের দৃষ্টিতে ইবনে বাত্তালের এই মতামত দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমন্বয় করেছে। তিনি যেমন কারামাতকে অস্বীকার করেননি, আবার আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল-জামাতের যেকোনো অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হওয়া সম্ভব, মতামতকেও গ্রহণ করেননি।[151] একজন নারী এই আঙুর তাকে খেতে দেখেছিল, বুখারি শরিফে উক্ত নারীর নাম উল্লেখ করা হয়নি।[152] ইবনুল আসিরও তার নাম উল্লেখ করেননি, শুধু একজন নারীর কথা বলা হয়েছে।[153] অপরদিকে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনায় ভিন্ন নারীর নাম, কোথাও জয়নব বিনতে হারেস, কোথাও ক্রীতদাসী মারিয়া, মতান্তরে মারিয়ার নাম উল্লিখিত হয়েছে।[154] ইবনে হাজার ভিন্নমুখী এই দুই বর্ণনাকে এভাবে সমন্বয় করেন, হতে পারে জয়নব বিনতে হারেস ও ক্রীতদাসী মারিয়া উভয়েই খুবাইবের হাতে আঙুর দেখেছিলেন। এটিও সম্ভব যে, খুবাইবকে উক্ত ক্রীতদাসীর ঘরে বন্দি করা হয়েছিল আর জয়নব বিনতে হারেসকে তাকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।[155]

আশহুরুল হুরুম (যেসকল মাসে যুদ্ধ ও হত্যা নিষিদ্ধ) অতিবাহিত হলে[156] খুবাইব ইবনে আদি রাযিয়াল্লাহু আনহু ক্রীতদাসীর মাধ্যমে জানতে পারলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই তারা তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।[157] তখন তিনি জয়নব বিনতে হারেস[158]-এর নিকট ক্ষৌরকার্য সম্পন্ন করে পবিত্র হওয়ার জন্য একটি ক্ষুর চাইলেন। তাকে ক্ষুর সরবরাহ করা হলো। মক্কার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আবুল হুসাইনের দাদা আবুল হুসাইন ইবনে হারেস ইবনে আদি ইবনে নাওফাল তখনো ছিলেন শিশু।[159] তার মাতা দেখলো, খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে ক্ষুর শোভা পাচ্ছে আর তার এই শিশু ছেলেটি খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর একটি রানের উপর বসে আছে। মায়ের অমনোযোগিতার সুযোগেই শিশুটি নিজেই খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট গিয়েছিল। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বন্দির হাতে ধারালো ক্ষুর। এমনি অবস্থায় শত্রু পক্ষের কোনো শিশু তার হাতে মোটেও নিরাপদ হওয়ার কথা নয়। যেকোনো মুহূর্তে তাকে হত্যা করে বন্দি প্রতিশোধ গ্রহণ করবে এটিই স্বাভাবিক। শিশুটির মাতা নিজের কলিজার ধন শিশুকে এমন একটি বিপদের মুখে অবস্থান করতে দেখে সাপ দেখার মতো চমকে উঠল। তীক্ষ্ণ ধীশক্তিসম্পন্ন সাহাবি খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু নারীটির এই সন্ত্রস্ত অবস্থা উপলব্ধি করলেন। তিনি ছেলেটিকে এই বলে দৌড় দিতে বললেন, ‘তোমরা আমাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছ। এই অবস্থায় তোমার মা আমার হাতে ক্ষুর থাকার পরেও তোমাকে আমার কাছে কী করে পাঠাল! তোমার মা কি আমার পক্ষ থেকে বিশ্বাসঘাতকতার ভয় পায়নি?’ তার এই কথা শুনে ছেলেটির মা বলল, ‘আমার ছেলেকে তো হত্যা করার জন্য আপনাকে ক্ষুর সরবরাহ করা হয়নি।’ খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন,

أَتَخْشَيْنَ أَنْ أَقْتُلَهُ مَا كُنْتُ لِأَفْعَلَ ذَاكِ إِنْ شَاءَ اللَّه. وَمَا نَسْتَحِلّ فِي دِينِنَا الْغَدْرَ.

‘তুমি কি ভয় পাচ্ছ যে, আমি তাকে হত্যা করব? আমি কখনো তা করব না।[160] আমাদের দীন ইসলাম এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকতাকে বৈধ মনে করে না।’[161] অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে, ছেলেটি খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে যখন গিয়েছিল, তখন তার হাতে ক্ষুর ছিল বলে ছেলেটির মা চমকে ওঠেননি; বরং ছেলেটি নিজেই একটি ধারালো ছুরি নিয়ে খেলতে খেলতে মায়ের অমনোযোগিতার সুযোগে খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট পৌঁছে গিয়েছিল। বন্দি অবস্থায় বন্দির পাশে ছুরি হাতে নিজের শিশু ছেলেকে দেখে তার মা সন্তানের আশু বিপদ উপলব্ধি করে আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে উঠল।[162] তখন খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু উপরোল্লিখিত কথাগুলো বলেছিলেন।

আরো পড়ুন : গাজওয়া হুনাইন – Battle of Hunayn

আরো পড়ুন : গাজওয়াতুল বুহরান – Invasion of Buhran

আরো পড়ুন : নাখলা অভিযান – Nakhla Raid

খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু ক্ষুর পেয়ে ক্ষৌরকার্য সম্পন্ন করে পবিত্রতা অর্জন করলেন। কুরাইশরা তাকে শূলবিদ্ধ করে হত্যা করার জন্য হারামের বাইরে তানঈম নামক স্থানে নিয়ে এলো।[163] লোমহর্ষক এই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখার জন্য মক্কা নগরী থেকে অনেকে তানঈমে উপস্থিত হলো।[164] উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যারা ছিল তারা হলো, ইহাব ইবনে আজিজ, আখনাস ইবনে শারিক, উবায়দা ইবনে হাকিম আস-সুলামি, উমাইয়া ইবনে উতবা,[165] ইবনুল হাদরামি, সাঈদ ইবনে আবদুল্লাহ,[166] আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও তার পুত্র মুআবিয়া।[167] কুরাইশরা খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মৃত্যুর পূর্বে তার কোনো আকাঙ্ক্ষা রয়েছে কি না জানতে চাইল।[168] দুই রাকাত নামাজ আদায় করার জন্য তিনি অনুমতি চাইলেন। তারা তাকে দুই রাকাত নামাজ আদায় করার অনুমতি দান করল। তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন।[169] তানঈমে যে প্রসিদ্ধ মসজিদ পরে নির্মিত হয়েছে তিনি ওই স্থানটিতেই উক্ত নামাজ আদায় করেছিলেন।[170] প্রশান্তচিত্ত ও উদ্বেগহীন মন নিয়ে নামাজ শেষ করে তিনি বললেন, ‘আমি মৃত্যুর ভয়ে শঙ্কিত হয়ে নামাজ দীর্ঘায়িত করেছি বলে তোমরা ধারণা করতে পারো; যদি আমার এই ভয় না হতো, তাহলে আমি নামাজ আরও দীর্ঘায়িত করতাম।[171] খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসলমানদের কাউকেও মৃত্যুদণ্ড দিতে চাইলে মৃত্যুর পূর্বে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের সুন্নাত প্রবর্তন করলেন।[172] সুহাইলি বলেছেন, ‘হুজর ইবনে আদি ইবনুল আদবার রাযিয়াল্লাহু আনহু-ও খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মতো মৃত্যুর পূর্বে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেছিলেন।

যখন খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে শূলে চড়ানোর জন্য শক্ত করে বাঁধা হলো। তখন তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিনামাজকে যথাযথভাবে পৌঁছিয়েছি। তারা আমার সাথে যে অমানবিক আচরণ করছে, তার সংবাদ আপনি আপনার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পৌঁছিয়ে দিন।’[173] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বসা অবস্থায়ই ছিলেন। তার নিকট খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর পৌঁছানো হলো। তিনি বললেন, ‘হে খুবাইব! তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।’[174]

যখন তাকে শূলবিদ্ধ করার জন্য উঁচু কাঠে উঠানো হলো, তিনি দোয়া করলেন,

اللَّهمّ أَحْصِهِمْ عَدَدًا، وَاقْتُلْهُمْ بَدَدًا، وَلَا تُغَادِرْ مِنْهُمْ أَحَدًا.

‘হে আল্লাহ! আপনি তাদের সংখ্যা গণনা করুন এবং তাদের পৃথক পৃথকভাবে হত্যা করুন। তাদের কাউকেও আপনি ছাড়বেন না।’[175]

এক নিষ্ঠুর প্রকৃতির মুশরিক লোমহর্ষক এই হত্যাকাণ্ডের সকল আয়োজন স্বচক্ষে দেখেও খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি চাও না যে, তোমাকে আমরা ছেড়ে দিই, আর মুহাম্মাদ তোমার এই করুণ পরিণতির স্থানে উপনীত হোক?’ খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে উত্তর দিলেন, ‘আল্লাহ এটি অবশ্যই জানেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পায়ে একটি কাঁটা বিদ্ধ করে তার বিনিময়ে আমি খুবাইব প্রাণে বেঁচে যাব; তা আমি কখনো চাই না।’[176] তিনি কবিতা পাঠ করলেন—যার প্রতিটি ছন্দে ঈমানি জযবার বহিপ্রকাশ ঘটেছে,

لَقَدْ جَمَّعَ الْأَحْزَابُ حَوْلِي وَأَلَّبُوا … قَبَائِلَهُمْ وَاسْتَجْمَعُوا كُلَّ مَجْمَعِ

وَكُلُّهُمْ مُبْدِي الْعَدَاوَةَ جَاهِدٌ … عَلَيَّ لِأَنِّي فِي وِثَاقٍ بِمَصْيَعِ

وَقَدْ جَمَّعُوا أَبْنَاءَهُمْ وَنِسَاءَهُمْ … وَقُرِّبْتُ مِنْ جِذْعٍ طَوِيلٍ مُمَنَّعِ

إلَى اللَّهِ أَشْكُو غُرْبَتِي ثُمَّ كُرْبَتِي … وَمَا أَرْصَدَ الْأَحْزَابُ لِي عِنْدَ مَصْرَعِي

فَذَا الْعَرْشِ، صَبِّرْنِي عَلَى مَا يُرَادُ بِي… فَقَدْ بَضَّعُوا لَحْمِي وَقَدْ يَاسَ مَطْمَعِي

وَذَلِكَ فِي ذَاتِ الْإِلَهِ وَإِنْ يَشَأْ … يُبَارِكْ عَلَى أَوْصَالِ شِلْوٍ مُمَزَّعِ

وَقَدْ خَيَّرُونِي الْكُفْرَ وَالْمَوْتُ دُونَهُ … وَقَدْ هَمَلَتْ عَيْنَايَ مِنْ غَيْرِ مَجْزَعِ

وَمَا بِي حِذَارُ الْمَوْتِ، إنِّي لَمَيِّتٌ … وَلَكِنْ حِذَارِي جَحْمُ نَار ملفّع

فو الله مَا أَرْجُو إذَا مِتُّ مُسْلِمًا … عَلَى أَيِّ جَنْبٍ كَانَ فِي اللَّهِ مَصْرَعِي

فَلَسْتُ بِمُبْدٍ لِلْعَدُوِّ تَخَشُّعًا … وَلَا جَزَعًا إنِّي إلَى اللَّهِ مَرْجِعِي

‘আমার চতুর্দিকে অনেক দল একত্র হয়েছে, তারা তাদের গোত্রগুলোকে প্রতিটি লোকালয় থেকে সমবেত করেছে।

তাদের প্রত্যেকেই আমার প্রতি শত্রুতা প্রদর্শনকারী, সর্বশক্তি দিয়ে আমাকে কষ্ট দানকারী। কেননা আমি তো বন্দিদশায় এমন ধ্বংসোন্মুখ একটি অস্ত্রে আবদ্ধ আছি, যা আমার চামড়া ছিন্ন করে।

তাদের সন্তান ও স্ত্রীদের তারা একত্র করেছে, নিষিদ্ধ লম্বা কাঠের (শূলের) নিকট আমাকে উপস্থিত করা হয়েছে।

আমি আমার দেশ থেকে দূরে, বিপদগ্রস্ত ও বধ্যভূমিতে আমার জন্য দলগুলো যা তৈরি করেছে, তার জন্য আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করছি।

হে আরশের অধিপতি! তারা আমাকে নিয়ে যা করতে চায়, সে বিষয়ে আপনি আমাকে ধৈর্য দিন। তারা আমার মাংস টুকরা টুকরা করেছে, আমার আশা নিরাশায় পরিণত হয়েছে।

এটা আল্লাহরই উদ্দেশ্যে, তিনি চাইলে হাড়ের প্রতিটি গিরায় ও মাংসের প্রতিটি অংশকে বরকতময় করবেন।

তারা আমাকে কুফরি এখতিয়ার করতে বলেছিল, কিন্তু মৃত্যুকে তার তুলনায় আমি সহজ মনে করলাম। আমার দুটি চক্ষু থেকে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল, কোনো প্রকার অস্থিরতা ছাড়া।

আমি মৃত্যুভয়ে ভীত ছিলাম না; কারণ মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তবে জাহান্নামের দাউ দাউ করে প্রজ্জলিত আগুনকেই আমি ভয় করি।

আল্লাহর শপথ! আমি মুসলিম অবস্থায় আল্লাহর উদ্দেশ্যেই যদি মারা যাই, তাহলে আমি বধ্যভূমিতে কোনপাশে পড়ে মারা গেলাম সে বিষয়ে আমার কোনো পরওয়া নেই।

আমি শত্রুর নিকট নতি স্বীকার করব না, অস্থিরতাও প্রকাশ করব না। কেননা আমায় প্রত্যাবর্তন হচ্ছে আল্লাহর নিকটে।’[177]

এরপর উকবা ইবনে হারেস তাকে নির্মমভাবে হত্যা করল।[178] অন্য বর্ণনায় আছে, উকবা ইবনে হারেস বলেছেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমি খুবাইবকে হত্যা করিনি। তবে বনু আবদিদ দারের আবু মায়সারা আল-আবদারি[179] একটি বর্শা আমার হাতে উঠিয়ে দেয়। আমি বর্শা ধরে রাখলাম, আর সে আমার হাতে ধরে থাকা বর্শা দ্বারাই খুবাইব ইবনে আদিকে আঘাত করে হত্যা করল।’[180]

আরো পড়ুন : গাজওয়া যু-আমর – Dhu Amarr raid

আরো পড়ুন : গাজওয়া সারিয়্যা আর-রাজি – Expedition of Al Raji

আরো পড়ুন : গাজওয়া হামরাউল আসাদ – Battle of Hamra al-Asad

৪০ দিন পর্যন্ত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর লাশ শূলে ঝুলানো ছিল।[181] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই মর্মান্তিক খবর পেয়ে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন,

يّكُم ينزل خبيباً من خشبته وَله الْجنَّة؟

‘তোমাদের মধ্যে যেই খুবাইবকে শূল থেকে নামাবে সেই জান্নাত লাভ করবে।’[182]

জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু ও মিকদাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই গুরুদায়িত্ব পালন করার জন্য প্রতিশ্রুতি দিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দুজনকে শূল থেকে খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মৃতদেহ নামানোর জন্য মক্কায় পাঠালেন। তারা যখন তার মৃতদেহের অবস্থানস্থল মক্কার তানঈমে পৌঁছালেন, তখন চল্লিশজন লোককে এই মৃতদেহ পাহারা দিতে দেখলেন। তারা সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগলেন। পাহারায় নিযুক্ত ব্যক্তিগণ ঘুমিয়ে গেল। আল্লাহর পথে শহিদ খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এই মৃতদেহ প্রায় চল্লিশ দিন পরেও ছিল অবিকৃত তো বটেই, এমনকি একেবারে তরতাজা। আল-কুরআনের ভাষায়, ‘আল্লাহর রাস্তায় যারা শহিদ হয়েছে, তাদের তোমরা মৃত বোলো না’[183]-এর প্রমাণ ছিল খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মৃতদেহ। সুযোগ বুঝে জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু ও মিকদাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মৃতদেহকে শূল থেকে নামিয়ে ঘোড়ার পিঠে নিয়ে মদিনার পথে রওনা হলেন। কাফেররা ঘুম থেকে জেগে উঠল। খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মৃতদেহ না দেখে তারা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল ও খোঁজাখুঁজি শুরু করল। একপর্যায়ে তারা জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু ও মিকদাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দূর থেকে এই মৃতদেহ নিয়ে যেতে দেখল। তারা তাদের নিকট থেকে মৃতদেহ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের পশ্চাৎ অনুসরণ করল। জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু আশু বিপদ উপলব্ধি করে অত্যন্ত সম্মানের সাথে মৃতদেহটি ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে নামালেন। আল্লাহর সৈনিক খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মৃতদেহকে আল্লাহ অপবিত্র কাফেরদের হাত থেকে হেফাজত করলেন। আকস্মিকভাবে সেই স্থানের মাটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মৃতদেহকে মাটি নিজের বুকের মধ্যে এমনভাবে ধারণ করল যে, এখানে যে এই মৃতদেহ সংরক্ষণ করা হলো তা বুঝবার কোনো উপায় অবশিষ্ট রইল না। খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সেজন্য বালিউল আরদ অর্থাৎ মাটি যাকে ভক্ষণ করেছে উপাধিতে ভূষিত করা হয়।[184] যুগ যুগ ধরে খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এই কবর অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে। অন্য বর্ণনায় আছে, আমর ইবনে উমাইয়া আদ-দামরি রাযিয়াল্লাহু আনহু খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে শূল থেকে নামিয়ে গভীর রাতে অত্যন্ত সংগোপনে দাফনের ব্যবস্থা করেছিলেন।[185]

খুবাইব ও জায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে একই দিন হত্যা করা হয়েছিল।[186] খুবাইব ও জায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হলেন আর-রাজি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবিগণের মধ্যে সর্বশেষ শহিদ। এভাবে তারা সকলেই শাহাদাতবরণ করলেন।

তদানীন্তন মুসলিম সমাজে এই যুদ্ধের প্রভাব

 

এই যুদ্ধের সকল মুজাহিদের শাহাদাত লাভ মুসলমানদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। জান দেওয়া যায়, তবু বাতিলের সাথে আপস করা যায় না, এই শাশ্বত সত্যের জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলমানদের হৃদয়ে হৃদয়ে বিরাজ করেন এই যুদ্ধের অমর শহিদগণ। শত্রুপক্ষ এই যুদ্ধের মুজাহিদগণের সাথে অমানবিক ও বর্বরোচিত আচরণ করে তাদের শহিদ করেছিল। এই ঘটনার খবর তদানীন্তন মদিনা মুনাওয়ারায় মুসলিম সমাজে পৌঁছালে—পুরো মদিনায় শোকের ছায়া নেমে এলো। সমগ্র পরিবেশ দীর্ঘ দিন যাবত ছিল শোকার্ত ও বেদনাবিধুর। প্রায় একই সময়ে সংঘটিত বির মাউনা-এর ঘটনাও ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক। সেই ঘটনায়ও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে শহিদ হয়েছিলেন প্রায় সত্তরজন সাহাবি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবিগণ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই দুটি ঘটনায় এত বেশি শোকার্ত হয়েছিলেন, দীর্ঘ প্রায় একটি মাস ধরে তারা এই উভয় ঘটনার সাথে জড়িত বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে প্রত্যহ বদদোয়া করতেন।[187] তিনি আর-রাজি ও বিরে মাউনার শহিদদের জন্যও দোয়া করতেন।[188]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবি হাসসান ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু আর-রাজি-এর ঘটনায় খুবই মর্মাহত হন। ইবনে ইসহাক বলেছেন, ‘হাসসান রাযিয়াল্লাহু আনহু শহিদদের উদ্দেশ্যে একটি শোকগাথা রচনা করেন,

صَلَّى الْإِلَهُ عَلَى الَّذِينَ تَتَابَعُوا … يَوْمَ الرَّجِيعِ فَأُكْرِمُوا وَأُثِيبُوا

رَأْسُ السَّرِيَّةِ مَرْثَدٌ وَأَمِيرُهُمْ … وَابْنُ الْبُكَيْرِ إمَامُهُمْ وَخُبَيْبُ

وَابْنٌ لِطَارِقَ وَابْنُ دَثْنَةَ مِنْهُمْ … وَافَاهُ ثَمَّ حِمَامُهُ الْمَكْتُوبُ

وَالْعَاصِمُ الْمَقْتُولُ عِنْدَ رَجِيعِهِمْ … كَسَبَ الْمَعَالِيَ إنَّهُ لَكَسُوبُ

مَنَعَ الْمَقَادَةَ أَنْ يَنَالُوا ظَهْرَهُ … حَتَّى يُجَالِدَ إنَّهُ لَنَجِيبُ

আর-রাজি-এর দিন যারা পর্যায়ক্রমে যুদ্ধ করেন, তাদের প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়েছে, তারা সম্মানিত হয়েছেন এবং তাদের সওয়াব দান করা হয়েছে।

মারসাদ ছিলেন তাদের দলপতি, সম্মুখে ছিলেন ইবনে বুকার, আরও ছিলেন খুবাইব, ইবনে তারিক, ইবনে দাসিনা, তাদের উপর নির্ধারিত মৃত্যুই এসে পড়ল।

তাদের সাথে আরও ছিলেন আসিম, যিনি ‘রাজি’-তে শহিদ হলেন, যিনি উচ্চ মর্যাদা অর্জন করলেন এবং তিনি ছিলেন উচ্চ মর্যাদার আগ্রহী।

শত্রুরা তার নাগাল পাবে তিনি সেরূপ আত্মসমর্পণকে গ্রহণ না করেই তরবারি পরিচালনা করলেন। আর তিনি হলেন মহৎ ও সম্ভ্রান্ত।’[189]

উল্লেখ্য, ইবনে হিশাম বলেছেন, ‘অধিকাংশ মনীষী এই শোকগাথাটি হাসসান ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু রচিত বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন।’[190] এই কবিতাংশে মারসাদকে দলপতি বলা হলেও আসলে দলপতি ছিলেন আসিম ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু, যেমনটি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

হাসসান ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু যেমন ‘আর-রাজি’-এর যুদ্ধে শহিদদের শোকে শোকার্ত হয়ে শোকগাথা রচনা করেন, তেমনই যারা প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রশ্রয় নিয়ে আল্লাহর এই সকল নিবেদিতপ্রাণ সৈনিককে শহিদ করেছিল, তাদের জন্যও বিদ্রুপাত্মক ব্যঙ্গ কবিতাও রচনা করেন। উদাহরণস্বরূপ কিছু পঙ্‌ক্তি এখানে উল্লেখ করা হলো,

لَعَمْرِي لَقَدْ شَانَتْ هُذَيْلَ بْنَ مُدْرِكٍ … أَحَادِيثُ كَانَتْ فِي خُبَيْبٍ وَعَاصِمِ

أَحَادِيثُ لِحْيَانٍ صَلَوْا بِقَبِيحِهَا… وَلِحْيَانُ جَرَّامُونَ شَرَّ الْجَرَائِمِ

أُنَاسٌ هُمْ مِنْ قَوْمِهِمْ فِي صَمِيمِهِمْ … بِمَنْزِلَةِ الزَّمْعَانِ دُبْرَ الْقَوَادِمِ

هُمْ غَدَرُوا يَوْمَ الرَّجِيعِ وَأَسْلَمَتْ … أَمَانَتُهُمْ ذَا عِفَّةٍ وَمَكَارِمِ

رَسُولَ رَسُولِ اللَّهِ غَدْرًا وَلَمْ تَكُنْ … هُذَيْلٌ تَوَقَّى مُنْكَرَاتِ الْمَحَارِمِ

فَسَوْفَ يَرَوْنَ النَّصْرَ يَوْمًا عَلَيْهِمْ … بِقَتْلِ الَّذِي تَحْمِيهِ دُونَ الْحَرَائِمِ

أَبَابِيلُ دَبْرٍ شُمَّسٍ دُونَ لَحْمِهِ … حَمَتْ لَحْمَ شَهَّادٍ عِظَامَ الْمَلَاحِمِ

لَعَلَّ هُذَيْلًا أَنْ يَرَوْا بِمَصَابِّهِ … مَصَارِعَ قَتْلَى أَوْ مَقَامًا لِمَأْتَمِ

‘আমার জীবনের শপথ! হুজাইল ইবনে মুদরিককে কলঙ্কিত করেছে, সেসব আচরণ, যা তারা খুবাইব ও আসিমের সঙ্গে করেছে।

লিহয়ানদের আচরণের পরিণতি তারা ভোগ করেছে। আর লিহয়ানরা তো জঘন্য অপরাধে অপরাধী।

লিহয়ানরা যদিও মূল হুয়াইলদের অংশ, তারপরও তারা অন্যদের তুলনায় পশুর সম্মুখ পায়ের পশমের মতোই নিকৃষ্ট।

তারা আর-রাজির দিন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। পবিত্র ও উচ্চ বংশীয়দের সাথে প্রতারণা করে তারা নিজেদের বিশ্বস্ততাকে জলাঞ্জলি দিয়েছে।

তারা আল্লাহর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দূতের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, আর হুজাইলরা তো নিষিদ্ধ হারাম থেকে কখনো বেঁচে থাকেনি।

আরো পড়ুন : গাজওয়া মুরাইসি – Expedition of al-Muraysi’

আরো পড়ুন : গাজওয়া যাতুর-রিকা – Expedition of Dhat al-Riqa

আরো পড়ুন : গাজওয়া যি-কারাদ বা গাজওয়া গাবা – Expedition of Dhu Qarad

শীঘ্রই তারা একদিন দেখবে, তাদের বিরুদ্ধে অন্যদের সাহায্য করা হচ্ছে এমন মহান ব্যক্তিকে হত্যা করার কারণে, যার লাশকে অপরাধীদের থেকে রক্ষা করা হয়েছে।

তার মাংসে তোমার দল পাহারা দিয়েছে, যিনি বড় বড় রণাঙ্গনে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন।

হুজাইলগণ অন্যদের আহত করেছে, সম্ভবত তারা তার পরিবর্তে নিজেদের নিহতের বধ্যভূমি অথবা শোক প্রকাশের স্থলে দেখতে পাবে। অর্থাৎ তাদের অনেকেই অল্প দিনের ভেতরেই নিহত হবে।’[191]

এই যুদ্ধ সম্পর্কে অবতীর্ণ আয়াতসমূহ

 

‘আর-রাজি’-এর হৃদয়বিদারক ঘটনাকে নিয়ে মুনাফিকরা বিভিন্ন প্রকার আজেবাজে কথাবার্তা বলতে লাগল। একদিকে তাদের এই অবাঞ্ছিত কথাবার্তার কঠোর প্রতিবাদ, অপরদিকে এই ঘটনায় যারা শাহাদাতবরণ করেন, তাদের ভূয়সী প্রশংসা করে কুরআনের কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন, মক্কা ও মদিনার মাঝে আর-রাজি নামক স্থানে যখন খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথিগণ,[192] যাদের মধ্যে মারসাদ, আসিম ইবনে সাবিত ও ইবনুদ দাসিনা ছিলেন,[193] তারা দুর্ঘটনায় পতিত হলে মুনাফিকরা বলতে লাগল,

يَا وَيْحَ هَؤُلَاءِ الْمَفْتُونِينَ الَّذِينَ هَلَكُوا هَكَذَا، لَا هُمْ أَقَامُوا فِي أَهْلِيهِمْ وَلَا هُمْ أَدَّوْا رِسَالَةَ صَاحِبِهِمْ.

‘ওই সমস্ত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীর ধ্বংস অনিবার্য, যারা এভাবে ধ্বংস হয়ে গেল। না তারা নিজেদের ঘরে বসে রইল, না তারা তাদের সাথির (রাসুল) দেওয়া দায়িত্ব পালন করল।’

তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের প্রচারণার প্রতি-উত্তরে নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ অবতীর্ণ করলেন,[194]

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُعْجِبُكَ قَوْلُهُ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيُشْهِدُ اللَّهَ عَلَى مَا فِي قَلْبِهِ وَهُوَ أَلَدُّ الْخِصَامِ (২০৪) وَإِذَا تَوَلَّى سَعَى فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا وَيُهْلِكَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْفَسَادَ (২০৫) وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللَّهَ أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْإِثْمِ فَحَسْبُهُ جَهَنَّمُ وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ (২০৬) وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ (২০৭)

‘মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তি আছে, পার্থিব জীবন সম্বন্ধে যার কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করে এবং তার অন্তরে যা রয়েছে, তা সম্পর্কে আল্লাহকে সাক্ষী বানায়। প্রকৃতপক্ষে সে ভীষণ কলহপ্রিয়। যখন সে ফিরে যায়, তখন সে পৃথিবীতে কী করে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে, কী করে শস্যক্ষেত ও বংশ ধ্বংস করবে—সেই চেষ্টায় নিয়োজিত হয়। অথচ আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না। এই ব্যক্তিকে যখন বলা হয়, তুমি আল্লাহকে ভয় করো, তখন তার আত্মাভিমান তাকে পাপের মধ্যে লিপ্ত রাখে। সুতরাং তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। নিশ্চয় তা অত্যন্ত খারাপ স্থান। মানুষের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে, যে কেবল আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যেই নিজের জীবন উৎসর্গ করে। আল্লাহ বান্দাদের প্রতি খুবই অনুগ্রহশীল।’[195]

মূলত এখানে শেষ আয়াতটিতে ইবনে আব্বাস-এর বর্ণনা অনুযায়ী ‘আর-রাজি’-এর শহিদদের আত্মত্যাগের কথাই বলা হয়েছে।[196]

আরো পড়ুন : গাজওয়া বনু কুরাইজা – Invasion of Banu Qurayza

আরো পড়ুন : গাজওয়া বনু লিহ্য়ান – Invasion of Banu Lahyan

আরো পড়ুন : গাজওয়া মুতা – Battle of Mu’tah

তথ্যসূত্র

[1]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩২/৯৬৯

[2]. দাইরাতুল মাআরিফ ইসলামিয়া : ১০/২১৫

[3]. দাইরাতুল মাআরিফ ইসলামিয়া : ১০/২১৫

[4]. ইনআমুল বারি : ২/২৪৮; আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১১৬; মুহাম্মাদ আমিন : ১৩১

[5]. সহিহ বুখারি : ২/৫৮৫

[6]. ইবনুল-আসির, আল-কামিল ফিত তারিখ : ২/১১৫

[7]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬৮

[8]. শিবলি নোমানি : ১/২২৪

[9]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৯১; ইবনে হাজম, জাওয়ামিউস সিরাহ : ২১৪

[10]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬৯; মোবারকপুরি : ২৯১-২৯২

[11]. মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতুল মুসতাফা : ২/৫৭৭; শিবলি নোমানি : ১/২২৫

[12]. দায়েরাতুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া : ১০/২১৬; আবু যাহরা : ২/৮৮০; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/৬৪

[13]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬; ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ১/৩৮৪

[14]. আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১৬৮

[15]. মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতুল মুসতাফা : ২/৭৫৫; আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১১৬; মুহাম্মাদ আমিন : ১৩১

[16]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬৯; দা, মা, ই : ১০/২১৬

[17]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬৯

[18]. আল আমিদি : ১/১৫৩; ইবনু সাদ : ১/১৮৪

[19]. ইবনুল আসির : ২/১২০

[20]. উর্দু দায়েরায়ে মাআরিফ ইসলামিয়া : ১০/২১৫

[21]. ইসলামি বিশ্বকোষ : ২২/২১৪

[22]. মোবারকপুরি : ৩২৬-২৭

[23]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬৮

[24]. ইবনুত তীনের উদ্ধৃতি দিয়ে আল-আইনি : ৯/১৬৬

[25]. ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ১/৩৮৪

[26]. ইবনে হাজম : ২১৪; মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব : ৩৩৪

[27]. মুহাম্মাদ আল-খিদরি : ১৫৩; মনসুরপুরি, রহমাতুল্লিল আলামিন : ২/২১২; ইবনে কায়্যিম : ৩/২৪৪; মোবারকপুরি : ২৯১; আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১৬৬; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইসলামী বিশ্বকোষ : ২২/২২৪

[28]. মনসুরপুরি, রহমাতুল্লিল আলামিন : ২/৪১০

[29]. মনসুরপুরি, রহমাতুল্লিল আলামিন : ২/২৯২

[30]. সহিহ বুখারি : ২/৫৮৫ (৪০৮৬)

[31]. ৩/১১৫-১১৬

[32]. আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১৬৬

[33]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪

[34]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬৮; ইবনে হাম : ২১৪; ইবনুল আসির : ২/১১৫

[35]. দায়েরাতুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া : ১০/২১৫

[36]. শিবলি নোমানি রহ., সিরাতুন নবী : ১/২২৪-২২৫; আল-বুখারি, আস-সহিহ : ৫/১১

[37]. সহিহ বুখারি : ৫/৪০

[38]. আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১৬৮

[39]. দায়েরাতুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া : ১০/২১৫

[40]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৪; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইসলামী বিশ্বকোষ : ২২/২২৫

[41]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫০

[42]. ইবনে কায়্যিম : ৩/২৪৪; শিবলি নোমানি, সিরাতুন নবী : ১/২২৪-২২৫; মোবারকপুরি : ২৯১; দায়েরাতুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া : ১০/২১৫; মুহাম্মাদ আমীন : ১৩২; মাজমাউল বুহুস আল-ইসলামিয়্যা : ১/৪৮৩; আল-খিদরি : ১৫৩; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইসলামী বিশ্বকোষ : ২২/২২৪-২২৫; আবু জাহরা : ২/৮৮০

[43]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬৮; ইবনে হাজম : ২১৪; ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ১/৩৮৪

[44]. দায়েরাতুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া : ১০/২১৫

[45]. শিবলি নোমানি : ১/২২৪-২২৫; আল-বুখারি, আস-সহিহ : ৫, ১১

[46]. মুহাম্মাদ আমীন, দুহাল ইসলাম : ১৩১

[47]. মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতুল মুসতাফা : ২/৭৫৪

[48]. আল-খিদরি : ১৫৩

[49]. আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ১/১৬৮

[50]. সহিহ বুখারি : ৫, ৪০

[51]. মনসুরপুরি, রহমাতুল্লিল আলামিন : ২/৬১-৬৩

[52]. আইনি : ৯/১৬৬

[53]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৩৯

[54]. আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১৬৮

[55]. মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব : ৩৩৪; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৩৯

[56]. সহিহ বুখারি : ৫/১১

[57]. সহিহ বুখারি : ৫/১১

[58]. মাজমাউল-বুহুস আল-ইসলামিয়্যা : ৪৮৩; আল-উমারি : ২/৩৯৮

[59]. C.E. Bosworth & others, vol. v, P. ৪০

[60]. ১০/২১৫

[61]. ৩/৯৬৮

[62]. ইবনে হাযম : ২১৪

[63]. ইবনুল আসির : ৪/৫০০

[64]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪০

[65]. ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইসলামী বিশ্বকোষ : ৩/১৭২

[66]. আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১৬৮

[67]. ৫/১০-১১

[68]. ইবনুল আসির, উসদুল গাবা : ২/৯১

[69]. পৃষ্ঠা : ৩৩৪

[70]. পৃষ্ঠা : ১১৬

[71]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬৮

[72]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬৮

[73]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪০

[74]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৩৮৪

[75]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি ৭/৪৪০

[76]. সিরাতুল মুসতাফা : ২/৭৫৫

[77]. ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইসলামী বিশ্বকোষ : ২২/২২৫

[78]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬৮

[79]. মনসুরপুরি, রহমাতুল্লিল আলামিন : ২/২৫১

[80]. মনসুরপুরি, রহমাতুল্লিল আলামিন : ২/২৫১-২

[81]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬৮; মুহাম্মাদ আবদুল ওয়াহহাব : ৩৩৪; দানাপুরি, মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ১১৬; দায়েরাতুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া : ১০/২১৫

[82]. আবু দাউদ : ৩/১১৬; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৩৯; শিবলি নোমানি : ১/২২৫; মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতুল মুসতাফা : ২/৭৫৫; আল-বুখারি, আস-সহিহ : ৫/১১, ৪০; আল-উমারি : ২/৩৭৮

[83]. সহিহ বুখারি, মাগাজি, গাজওয়াতুর রাজি; শিবলি নোমানি : ১/২২৫

[84]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪০

[85]. মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব : ৩৩৫; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬৯

[86]. মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব : ৩৩৫; আবু দাউদ : ৩/১১৬

[87]. ইসলামী বিশ্বকোষ : ২২/২২৫; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬৯; ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ১/৩৮৪; আবু জাহরা : ২/৮৮১

[88]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৬৯; মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব : ৩৩৫

[89]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৬

[90]. বিস্তারিত বিবরণের জন্য নিবন্ধ আসিম, ইসলামী বিশ্বকোষ।

[91]. ইবনুল আসির, আল-কামিল ফিত তারিখ : ২/১১৫; মুহাম্মাদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব : ৩৩৫; আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৬; মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতুল মুসতাফা : ২/২৪৮

[92]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪১; শিবলি নোমানি রহ. : ১/২২৫

[93]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৬

[94]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭

[95]. আস সিরাতুন নববিয়্যাহ : ৯৪-৯৫

[96]. আল-উমারি : ২/৩৯৯

[97]. মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব : ৩৩৫; শিবলি নোমানি রহ. : ১/২২৫

[98]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৫

[99]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৬

[100]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৬

[101]. আবু জাহরা : ২/৮৮১

[102]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭১

[103]. শিবলি নোমানি রহ. : ১/২২৫

[104]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫; ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ১/৩৮৫; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইসলামী বিশ্বকোষ : ২২/২২৫; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭১

[105]. মুহাম্মাদ আমিন : ১৩৩-১৩৪; দায়েরাতুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া : ১০/২১৬; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইসলামী বিশ্বকোষ : ২২/২২৫

[106]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৬-৩৫৭; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭১, কান্ধলবি : ২/৭৬১; ইবনে কাসির : ৪/৬৭

[107]. সহিহ বুখারি : ৫/৪০

[108]. ইবনুল আসির : ২/১১৫; আবু দাউদ : ৩/১১৬; মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহ্হাব : ৩৩৫

[109]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪১

[110]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭১

[111]. ওয়াকিদি : ১/৩৫৭; ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ১/৩৮৫; ইবনে হাজম : ২১৬

[112]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭১; আবু জাহরা : ১/৮৮২; দানাপুরি, মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ১১৬; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪১; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইসলামী বিশ্বকোষ : ২২/২২৫

[113]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭

[114]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭; ইবনে হাজম : ২১৬

[115]. দাইরাতুল মাআরিফ ইসলামিয়া : ১০/২১৬; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭১

[116]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭১

[117]. ইবনে হাজর : ৭/৪৪১; আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭; শিবলি নোমানি রহ. : ১/২২৬

[118]. দানাপুরি, মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ১১৬

[119]. আবু জাহরা : ২/৮৮৩

[120]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭২

[121]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭

[122]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭

[123]. ইবনুল আসির : ২/১১৬

[124]. ইবনু সাদ : ১/৩৫৮; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭২

[125]. ইবনে হাজম : ২১৬

[126]. ইবনে কাসির : ২/৬৮

[127]. দানাপুরি, মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ১১৭; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭২; শিবলি নোমানি রহ. : ১/২২৬; মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতুল মুসতাফা : ২/৭৫২; মাজমাউল-বুহুস আল-ইসলামিয়্যা : ৮৩

[128]. আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১০০

[129]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭

[130]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৩৮১, বৈরুত; আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১৬৮

[131]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭, আল-আইনি : ৯/১০০

[132]. দানাপুরি, মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ১১৬

[133]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭

[134]. দানাপুরি, মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ১৭৭; মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব : ৩৩৫

[135]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭; শিবলি নোমানি : ১/২২৫

[136]. আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১০০; ইবনুল আসির, উসদুল গাবাহ : ২/১০৪

[137]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৩৮২; মুহাম্মাদ আমিন : ১৩৪; আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১৬৮

[138]. সহিহ বুখারি : ৫/৪১

[139]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৩৮২

[140]. মনসুরপুরি, রহমাতুল্লিল আলামিন : ১/১২২

[141]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭২

[142]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭২; মুহাম্মাদ আমিন : ১৩৩

[143]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪২; আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ১/১৬৮

[144]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪২; আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১৬৮

[145]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭২

[146]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৩৮২; আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭-৩৫৮

[147]. ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ১/৩৮৫

[148]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৩৮২

[149]. মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতুল মুসতাফা : ২/৭৫৬; আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১৬৮

[150]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭; দানাপুরি, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ১১৭; মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব : ৩৩৫

[151]. ফাতহুল বারি : ৭/৩৮৩

[152]. সহিহ বুখারি : ৫/৪০

[153]. ইবনুল আসির : ২/১১৫-১১৬

[154]. কান্ধলবি : ২/২৫৮; আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১৬৮; আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৭

[155]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪২

[156]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪২

[157]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৮

[158]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭৩

[159]. আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১৬৮

[160]. সহিহ বুখারি : ২/৪১

[161]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৮; আল-উমারি : ২/৩৯৯

[162]. মনসুরপুরি, রহমাতুল্লিল আলামিন : ১/১২৩

[163]. ইবনে কায়্যিম : ৩/২৪৫; মোবারকপুরি : ২৯২; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭২

[164]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৫৮

[165]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪৩

[166]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৮০

[167]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭২

[168]. মনসুরপুরি, রহমাতুল্লিল আলামিন : ১/১২৩

[169]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩২/৯৭৩; ইবনে কায়্যিম : ৩/২৪৫; আবু দাউদ : ৩/১১৬

[170]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪৩

[171]. সহিহ বুখারি, ৫/৪১; মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব : ৩৩৫; শিবলি নোমানি রহ. : ৫/৪১; ইবনে কায়্যিম : ৩/২৪৫; মনসুরপুরি, রহমাতুল্লিল আলামিন : ১/১২৩; আবু জাহরা : ২/৮৮৩; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭৩

[172]. সহিহ বুখারি : ৫/৪০

[173]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭৩

[174]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪৩

[175]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭৩; ইবনুল আসির : ২/১১৬; ইবনে কায়্যিম : ৩/২৪৫; মোবারকপুরি : ২৯২; আবু জুহরা : ২/৮৮৩

[176]. মনসুরপুরি, রহমাতুল্লিল আলামিন : ১/১২৩; মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব : ৩৩৬

[177]. ইবনে কাসির : ৪/৬৯; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৪/৯৭৬-৯৭৭; ইবনে কায়্যিম : ৩/২৪৫

[178]. সহিহ বুখারি : ৫/৪১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪৫

[179]. ফাতহুল বারি লি ইবনি হাজার : ৭/৪৪৫

[180]. আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১০১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি : ৭/৪৪৫; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭৪

[181]. মনসুরপুরি, রহমাতুল্লিল আলামিন : ২/৩০২

[182]. আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১০১

[183]. সুরা বাকারা : ১৫৪

[184]. আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ৯/১০১; কান্ধলবি : ২/৭৬১

[185]. ইবনে কায়্যিম : ৩/২৪৬; মোবারকপুরি, ২৯২; দানাপুরি, মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ১১৮

[186]. আবু জাহরা : ২/৮৮৪

[187]. দাইরাতুল মাআরিফ ইসলামিয়া : ১০/২১৬

[188]. ইসলামী বিশ্বকোষ : ২২/২২৫

[189]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৮৫-৯৮৬

[190]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৮৬

[191]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৮২-৯৮৩

[192]. তাবারি : ২/৩২৫

[193]. আবু হায়্যান : ২/১২২

[194]. তাবারি : ২/৩২৫; ইবনে কাসির : ৪/৬৯; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/৯৭৮; আবু হায়্যান : ২/১২২

[195]. সুরা বাকারা : ২০৪-২০৭

[196]. তাবারি : ২/৩২৫

শেয়ার করুন

সূচীপত্র

error: Content is protected !!