সিরাত বিশ্বকোষ
সিরাত বিশ্বকোষ

২৬. (১৪) গাজওয়া বদর আল-আখিরা  – Expedition of Badr al-Maw’id

২৬. (১৪) গাজওয়া বদর আল-আখিরা – Expedition of Badr al-Maw’id

১৪. গাজওয়া বদর আল-আখিরা

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত গাজওয়া : ১৪

তারিখ এপ্রিল ৬২৬ খ্রি.-জানুয়ারি ৬২৬ খ্রি.- মার্চ ৬২৫ খ্রি.
অবস্থান বদর
ফলাফল মুসলমানদের বিজয়।

 

 

কারণ কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ।

 

 

বিবাদমান পক্ষ
মুসলমান কুরাইশ
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ান ইবনে হারব
শক্তি
১৫০০ যোদ্ধা এবং ১০ ঘোড়সওয়ার ২০০০ পদাতিক এবং ৫০ ঘোড়সওয়ার
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
কোনো হতাতত ও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কোনো হতাতত ও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

উহুদযুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বলেছিল, ‘তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে ওয়াদা রইল, আগামী বছর বদর প্রান্তরে আবার মোকাবেলা হবে।’ মুসলমানগণ এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন। দিন যত ঘনিয়ে আসতে লাগল, মুসলমানদের প্রস্তুতিও চলতে লাগল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম সিদ্ধান্ত নিলেন, আবু সুফিয়ান এবং তার কওমের সাথে মোকাবেলা করে এই কথা বুঝিয়ে দিতে হবে, মুসলমানরা দুর্বল নয় এবং মুখের ফুৎকারে আল্লাহর মনোনীত এই দীনকে নির্বাপিত করা যাবে না।

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরি চতুর্থ সনের শাবান অথবা জিলকদ মাসে (৬২৫ খ্রি.) বদর প্রান্তরে যাত্রার চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর মদিনার শাসনভার ন্যস্ত করলেন। ইবনে হিশামের মতে মদিনার দায়িত্বভার আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের উপর অর্পণ করা হয়। দেড় হাজার জানবাজ যোদ্ধা ও দশটি ঘোড়া সমভিব্যাহারে বদর অভিমুখে যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে সোপর্দ করা হয় সেনাবাহিনীর পতাকা।[1]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা কুরজ ইবনে জাবির ফিহরি (সারিয়্যা উরায়না) – Expedition of Kurz bin Jabir Al-Fihri

আরো পড়ুন : সারিয়্যা খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রা. – Expedition of Khalid ibn al-Walid

আরো পড়ুন : সারিয়্যা গালিব ইবনে আবদুল্লাহ আল-লাইসি – Expedition of Ghalib ibn Abdullah al-Laithi (Al-Kadid)

যুদ্ধের জন্য বাছাইকৃত দশটি ঘোড়া দশজন বিশিষ্ট যোদ্ধার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। এসব অশ্বারোহীগণ হলেন : ১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম; ২. আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু; ৩. উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু; ৪. আবু কাতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু; ৫. সাঈদ ইবনে জায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু; ৬. মিকদাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু; ৭. হুবাব রাযিয়াল্লাহু আনহু; ৮. জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু; ৯. আব্বাদ ইবনে বিশর রাযিয়াল্লাহু আনহু; ১০. অজ্ঞাত।[2] নুআইম ইবনে মাসউদ নামক জনৈক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সাহাবিগণের বদর অভিমুখে যাত্রা করার সংবাদ কুরাইশদের নিকট পৌঁছিয়ে দেন, পরবর্তী সময়ে অবশ্য তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। সে এমন কোনো ওজরের অপেক্ষায় ছিলেন যাতে যুদ্ধে যেতে না হয়। তিনি নুআইমকে প্রতিশ্রুতি দিলেন, ‘তুমি যদি মদিনা প্রত্যাবর্তন করে মুসলমানদের যুদ্ধাভিযান থেকে বিরত রাখতে পারো, আমি তোমাকে দশটি অথবা বিশটি উট পুরস্কার প্রদান করব।’ আবু সুফিয়ান নুআইম ইবনে মাসউদকে একটি ঘোড়ার উপর আরোহণ করিয়ে বললেন, ‘আমি এই মুহূর্তে সেনাদল নিয়ে বদর প্রান্তরে যাত্রা করা সঠিক মনে করি না। যদি মুহাম্মাদ যুদ্ধের জন্য আসেন, আর আমি উপস্থিত না হই, তাহলে মুসলমানদের সাহস বেড়ে যাবে। তাই আমি চাই যুদ্ধের ভয়ে আমরা প্রাণ বাঁচিয়েছি এই কথা না বলে; বরং জনগণ বলুক, যুদ্ধের ভয়ে মুসলমানরা নিজেরাই পশ্চাতে হটেছে। সুতরাং আমি চাই, তুমি মদিনা যাও এবং মুসলমানদের বলো, আমি এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি; যার মোকাবেলা মুসলমানরা করতে পারবে না। সুহাইল ইবনে আমরের মাধ্যমে আমি তোমাকে প্রতিশ্রুত উটগুলো প্রদান করব।’ নুআইম ইবনে মাসউদ সুহাইল ইবনে আমরের নিকট এসে বলল, ‘উক্ত উটের ব্যাপারে তুমি যদি জামিন হও, তবে আমি মদিনা গিয়ে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বাহিনীর অগ্রাভিযাত্রা বন্ধ করে দেব।’ সুহাইল এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলে নুআইম দ্রুত মদিনা রওনা হয়ে গিয়ে মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমি এমাত্র মক্কা থেকে মদিনা প্রত্যাবর্তন করেছি। আবু সুফিয়ান বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে। তোমরা তাদের মোকাবেলায় যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকতে পারবে না।’ নুআইম মুসলমানদের জনে জনে এ কথা বুঝিয়ে ভীতি-বিহ্বলতা সৃষ্টি করার প্রয়াস চালাল। এই অপপ্রচারে স্বল্পসংখ্যক মুসলমানের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ল। মদিনার মুনাফিক ও ইহুদিদের মুসলমানদের এই ভীতিপ্রদ অবস্থায় উৎফুল্ল হলো।

বিজ্ঞাপন

আবু বকর ও উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু নেতিবাচক এই প্রচারণা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নবীকে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং তার দীনকে বিজয়ী করবেন, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। শত্রুগণ আমাদের সাথে মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিয়েছে—এজন্য আমরা পেছনে পড়ে থাকতে পারি না। কারণ, তাতে তারা আমাদের ভীরু ও কাপুরুষ মনে করবে। সুতরাং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চলুন। আল্লাহর শপথ! এতেই রয়েছে কল্যাণ ও সমৃদ্ধি।’

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দৃঢ় প্রত্যয়ী বক্তব্য শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং বললেন,

والذي نفسي بيده لأخرجن وان لم يخرج معنا احد.

‘ওই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ! আমার সাথে কেউ না এলেও মোকাবেলার জন্য আমি অবশ্যই রওনা হবো।’[3]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই দৃপ্ত ঘোষণার ফলে মুশরিকগণ মুসলমানদের অন্তরে যে অহেতুক ভীতির সঞ্চার হয়েছিল, আল্লাহ তায়ালা তা দূর করে দিলেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের নিয়ে বদর অভিমুখে রওনা হলেন এবং সেখানে পৌঁছে শত্রুর আগমনের প্রতীক্ষায় থাকলেন।[4]

 

মানচিত্র (২৭) : গাজওয়া বদর আল-আখিরা বা দ্বিতীয় বদর অবস্থান স্থল

 

এ দিকে আবু সুফিয়ান কুরাইশদের ডেকে বললেন, ‘আমরা নুআইমকে মদিনায় পাঠিয়েছি, যাতে সে মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বাহিনীর যুদ্ধযাত্রাকে স্থগিত করতে পারে। কিন্তু আমাদেরও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যাত্রা করা দরকার, তবে বদর প্রান্তর পর্যন্ত যাব না। এক বা দুই রাত সফর করার পর আমরা ফিরে আসব। যদি তারা মদিনা থেকে বদর অভিমুখে যাত্রা না করে এবং এই খবর তার নিকট পৌঁছে যে, আমরা যুদ্ধযাত্রা করেছি অথবা আমাদের যুদ্ধযাত্রার খবর শুনে মুসলমানরা মাঝপথ থেকে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করে, তাহলে আমাদের মাথা উঁচু হবে আর মুসলমানদের মাথা অপমানে অবনত হয়ে যাবে। আর মুসলমানরা যদি সত্যিই মোকাবেলার জন্য বের হয়ে পড়ে, তাহলে আমরা এ কথা বলে পেছনে হটে যাব, এখন খরা, দুর্দিন ও দুর্ভিক্ষের সময়। অনুকূল পরিবেশ ও সুদিন ছাড়া যুদ্ধ করা সমীচীন নয়। জনগণ আবু সুফিয়ানের এই বক্তব্য গ্রহণ করল।’[5]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা কাআব ইবনে উমায়ের আল-গিফারি – Expedition of Ka’b ibn ‘Umair al-Ghifari

আরো পড়ুন : সারিয়্যা কাআব ইবনে উমায়ের আল-গিফারি রা. – Sariya Ka’ab ibn Umair al-Ghifari

আরো পড়ুন : সারিয়্যা কুতবা ইবনে আমের – Expedition of Qutbah ibn Amir

অতঃপর আবু সুফিয়ান দুই হাজার সৈন্য ও পঞ্চাশটি ঘোড়াসহ বদর অভিমুখে যাত্রা করলেন। মক্কা অঞ্চলের জাহরান-এর নিকটবর্তী মাজান্না নামক উপত্যকায় পৌঁছে শিবির স্থাপন করল। আরেক বর্ণনায় আছে, উসান নামক স্থানে তারা ঘাঁটি স্থাপন করে। আবু সুফিয়ান অতঃপর কুরাইশদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বক্তৃতায় বলে,

ارْجِعُوا، لَا يُصْلِحُنَا إلّا عَامُ خِصْبٍ غَيْدَاقٍ، نَرْعَى فِيهِ الشّجَرَ وَنَشْرَبُ فِيهِ اللّبَنَ، وَإِنّ عَامَكُمْ هَذَا عَامُ جَدْبٍ، وَإِنّي رَاجِعٌ فَارْجِعُوا. فَسَمّى أَهْلُ مَكّةَ ذَلِكَ الْجَيْشَ جَيْشَ السّوِيقِ، يَقُولُونَ: خَرَجُوا يَشْرَبُونَ السّوِيقَ.

‘হে কুরাইশের জনগণ! সচ্ছল ও সজীব মওসুমে যুদ্ধে যাওয়া তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক, যখন বৃক্ষরাজি সবুজ পাতায় ভরে উঠবে, যা পশুরা মনের আনন্দে ভক্ষণ করতে পারবে, তোমরাও তাদের দুগ্ধ পান করতে পারবে। এখন তো দুর্ভিক্ষ ও খরা মওসুম (এই সময়টা যুদ্ধের জন্য অনুপযোগী)। তাই আমি ফিরে চললাম, তোমরাও ফিরে চলো।’

এমনিতে কুরাইশ সৈন্যগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। আবু সুফিয়ানের বক্তব্যে তারা যুদ্ধের আগ্রহ হাড়িয়ে ফেলল। পরিশেষে তারা মক্কার পথে ফিরে চলল। মক্কাবাসীগণ এই অভিযানের নাম দিল ‘জায়শুস-সাবিক’ বা ছাতু বাহিনী। তারা বলাবলি করতে লাগল, আমরা তো আসলে ছাতু খাওয়ার জন্য গিয়েছিলাম, যুদ্ধ করার জন্য যাইনি।’[6] এ দিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আট দিন যাবত বদর প্রান্তরে শত্রুসৈন্যের আগমনের জন্য অপেক্ষা করেন। তখন বদরে সপ্তাহব্যাপী বাণিজ্যমেলা বসেছিল। মুসলমানগণ সেই সুযোগে ব্যবসা করে বিপুলভাবে লাভবান হন। মেলায় আগত লোকদের নিকট যখন মুসলমানগণ কুরাইশদের ব্যাপারে জানতে চাইত, তখন তারা বলত, কুরাইশগণ তোমাদের মোকাবেলায় বিপুল বাহিনী জমায়েত করেছে। মুসলমানগণ এই জবাব শুনে বলত,

حسبنا الله ونعم الوكيل.

‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই আমাদের জন্য উত্তম জিম্মাদার।’[7]

বদর প্রান্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রতীক্ষারত অবস্থায় ছিলেন তখন মাখশী ইবনে আমর আদ-দামরী তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছেন, যিনি এক যুদ্ধে দামরা গোত্রের পক্ষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। তিনি বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ! কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য এই জায়গায় বসে রয়েছেন?’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

«نَعَمْ يَا أَخَا بَنِي ضَمْرَةَ، وَإِنْ شِئْتَ مَعَ ذَلِكَ رَدَدْنَا إِلَيْكَ مَا كَانَ بَيْنَنَا وَبَيْنَكَ، ثُمَّ جَالَدْنَاكَ حَتَّى يَحْكُمَ اللَّهُ بَيْنَنَا وَبَيْنَكَ»

‘হে দামরা গোত্রের ভাই! তুমি যদি চাও তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে যেই অনাক্রমণ চুক্তি হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করে নিতে পারি। অতঃপর তোমাদের সাথে যুদ্ধ করব যতক্ষণ না আল্লাহু তায়ালা তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেন।’

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উম্মু কিরফা – Killing of Umm Qirfa

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উয়ায়না ইবনে হিসন আল-ফাজারি – Expedition of Uyainah bin Hisn

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উসামা ইবনে জায়েদ – Expedition of Usama bin Zayd

মাখশি জবাবে বললেন,

لا وَاللَّهِ يَا مُحَمَّد، مَا لَنَا بِذَلِكَ مِنْكَ حَاجَةٌ.

‘না, না, আল্লাহর কসম! আপনার সাথে যুদ্ধ করার কোনো অভিপ্রায় নেই।’[8] অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে আট দিন অবস্থান করে দেড় হাজার সাহাবিসহ মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। কুরাইশগণ সেখানে আগমন না করায় মুসলমানদের যুদ্ধ করার প্রয়োজন পড়ে নেই। এভাবে আল্লাহ তায়ালা কাফেরের ষড়যন্ত্র থেকে মুসলমানদের রক্ষা করলেন।[9] এই ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমের নিম্নোক্ত আয়াত নাজিল করেন,

الَّذِينَ اسْتَجَابُوا لِلَّهِ وَالرَّسُولِ مِنْ بَعْدِ مَا أَصَابَهُمُ الْقَرْحُ لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا مِنْهُمْ وَاتَّقَوْا أَجْرٌ عَظِيمٌ (১৭২) الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ (১৭৩) فَانْقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ لَمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللَّهِ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ (১৭৪) إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (১৭৫)

‘যখম হওয়ার পর যারা আল্লাহ ও রাসুলের ডাকে সাড়া দিয়েছে, তাদের মধ্যে যারা সকার্য করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে চলে, তাদের জন্য মহাপুরস্কার রয়েছে। এদের লোকে বলেছিল, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জমায়েত হয়েছে, সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় করো, কিন্তু এটি তাদের ঈমান দৃঢ়তর করেছিল এবং তারা বলেছিল, “আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক।” তারপর তারা আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহসহ ফিরে এসেছিল, কোনো অনিষ্ট তাদের স্পর্শ করেনি এবং আল্লাহ যাতে রাজি তারা তারই অনুসরণ করেছিল এবং আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। এরাই শয়তান, তোমাদের তার বন্ধুদের ভয় দেখায়। সুতরাং যদি তোমরা মুমিন হও, তবে তোমরা তাদের ভয় কোরো না, আমাকেই ভয় করো।’[10]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الوَكِيلُ، «قَالَهَا إِبْرَاهِيمُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ حِينَ أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَقَالَهَا مُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ» حِينَ قَالُوا: {إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا، وَقَالُوا: حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الوَكِيلُ} آل عمران: ১৭৩

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন, ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল (আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্ম বিধায়ক)—ইবরাহিম আলাইহিস সালাম-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তখন তিনি এই কথা বলেছিলেন। আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এই কথাই বলেছিলেন যখন লোকজন তাকে এসে খবর দিল যে, তোমাদের বিরুদ্ধে বিরাট সেনাদল প্রস্তুত করা হয়েছে, তাদের ভয় করো। এ কথা শুনে তাদের ঈমান আরও মজবুত হয়ে গেল এবং তারা বলল, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক।’[11]

অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে উল্লিখিত আয়াত গাজওয়া হামরাউল আসাদ উপলক্ষে অবতীর্ণ হয়েছিল। যুদ্ধ ছাড়াই যদিও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর প্রান্তর থেকে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন, তারপরও এই অভিযানের প্রভাব ও ফলাফল ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের হারানো মর্যাদা এটির মাধ্যমে পুনরুদ্ধার হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শক্তি তৎকালীন শক্তিধর কুরাইশগণ উপলব্ধি করল। এটির দ্বারা শাণিত হয় সাহাবিদের ঈমানি চেতনা ও সমরশক্তি। আল্লাহর উপর ভরসা, ঈমানের দৃঢ়তা, প্রচণ্ড কর্মশক্তি, বাতিলের প্রতিরক্ষা ব্যূহ বিধ্বস্ত করে দেওয়ার অদম্য স্পৃহা তৎকালীন পরিস্থিতিকে মুসলমানদের অনুকূলে নিয়ে আসে।

মুসলমানদের ভয়ে কুরাইশদের যুদ্ধ ছাড়া মক্কায় ফিরে যাওয়া মুসলমানদের জন্য উহুদের পরাজয়ের ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিগণিত হয়। অপরদিকে কাফেরদের এভাবে ফিরে যাওয়াটা বছরের প্রথম যুদ্ধে তাদের পরাজয়ের চাইতে কম অবমাননাকর ছিল না। তা সত্ত্বেও কুরাইশরা আগামী বছরের জন্য যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যাপারে উদাসীন ছিল না। কুরাইশদের পৃষ্ঠপ্রদর্শনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিশ্চিন্তে না থেকে নতুন কৌশল অবলম্বন করেন। শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে তিনি সাহাবিদের গোয়েন্দা তৎপরতায় নিয়োজিত রাখেন।[12]

ইসলামের ইতিহাসে এই যুদ্ধ প্রতিশ্রুত বদর যুদ্ধ, বদরের দ্বিতীয় যুদ্ধ, বদরের শেষ যুদ্ধ, বদরের ছোট যুদ্ধ ও ছাতুর যুদ্ধ নামে পরিচিতি।[13]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা ঈস/জায়েদ ইবনে হারিসা রা. – Expedition of Zayd ibn Harithah (Al-Is)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উক্কাশা ইবনে মিহসান রা. – Expedition of Ukasha bin Al-Mihsan

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. – Expedition of Umar ibn al-Khatab

তথ্যসূত্র

[1]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১২৩; ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ২/১১২

[2]. ইবনু সাইয়্যিদিন নাস, উয়ুনুল আসার : ২/৮২

[3]. ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৩৭৫; তাফসির মাজহারি : ২/২৭৮-৯

[4]. সিরাতুল হালাবিয়্যা : ৪/২৭৯-২৮০

[5]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/২৭৯; মাগাজি : ১/৩৮৭-৯

[6]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/১২৩; তাবারি, তারিখ : ২/৫৫৯; ইবনে কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ২/ ১১২; ইবনু সাইয়্যিদিন নাস, উয়ুনুল আসার : ২/৮২; দানাপুরি, আসাহহুস সিয়ার : ১২৮; সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৯৯

[7]. সুরা আলে ইমরান : ১৭৩; শায়খ আবদুল্লাহ, মুখতাসার সিরাতি রাসুলিল্লাহ : ২৬৫; আল-হালাবি, সিরাতুল হালাবিয়া : ৪/২৭৯-২৮০

[8]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১২৩-৪; ইবনে সায়্যিদিন্নাস, উয়ুনুল আসার : ২/৮২; আল-হালাবি, সিরাতুল হালাবিয়া : ৪/২৭৯-২৮০

[9]. আবুল হাসান আলি নদভি, নবীয়ে রহমত : ২৪৮

[10]. সুরা আলে ইমরান : ১৭২-১৭৫

[11]. সহিহ বুখারি : ২/৬৫৫

[12]. Dr. Muhammad Husayn Haykal, The Life of Muhammad, translated by Dr. Ismail Razi Al Faruqi. p. ২৪৩

[13]. তাবারি, তারিখ : ২/৫৫৯; ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ২/১১২; আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৯৯

শেয়ার করুন

সূচীপত্র

error: Content is protected !!