সিরাত বিশ্বকোষ
সিরাত বিশ্বকোষ

২৯. (১৭) গাজওয়া মুরাইসি  – Expedition of al-Muraysi’

লেখক: আহমাদ রিফআত

বিষয় : বিষয়ভিত্তিক সিরাত

২৯. (১৭) গাজওয়া মুরাইসি – Expedition of al-Muraysi’

১৭. গাজওয়া মুরাইসি গাজওয়া বনু মুসতালিক

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত গাজওয়া : ১৭

তারিখ পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ হিজরির শাবান মাস।
অবস্থান ‘আল-মুরাইসি’ নামক কূপের নিকট বনু মুসতালিক গোত্রের সাথে যুদ্ধ হয়েছিল।
পতাকার রং অজ্ঞাত
ফলাফল আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতা পাঠিয়ে মুসলমানদের সাহায্য করেছিলেন। মুসলমানদের বিজয় হয়েছিল।
কারণ মুসতালিক গোত্রের কাফেরদের ঔদ্ধত্য ও যুদ্ধোন্মাদনা।
বিবাদমান পক্ষ
মুসলমান মুসতালিক গোত্র
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অজ্ঞাত
শক্তি
৭০০ পদাতিক ও ৩০ জন অশ্বারোহীর
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
মুসলমানদের কেউ কাফেরদের হাতে শাহাদাতবরণ করেনি। একজন মুহাজির সাহাবি ভুলক্রমে মুসলমানদের হাতে নিহত হন। তাদের দশজন লোক নিহত হয় এবং সকলেই বন্দি হয়। দুই হাজার উট ও পাঁচ হাজার বকরি মুসলমানগণ গনিমত লাভ করেন। বন্দি নারীর সংখ্যা ছিল দুইশত।

গাজওয়া মুরাইসি বা বনু মুসতালিক

গাজওয়া বনু মুসতালিককে গাজওয়া মুরাইসিও বলা হয়। মুসতালিক গোত্রের সাথে যুদ্ধ হয়েছিল বলে এটি গাজওয়া বনু মুসতালিক নামে অভিহিত। মুসতালিক শব্দের অর্থ সুকণ্ঠের অধিকারী। খুজাআ গোত্রের জুজায়মা (মতান্তরে জাজিমা) ইবনে কাআব নামক ব্যক্তির কণ্ঠস্বর সুমধুর ছিল বলে তাকে মুসতালিক বলা হতো। এরই বংশধর বনু মুসতালিক নামে পরিচিত। আর খুজাআ গোত্রেরই মালিকানাধীন ‘মুরাইসি’ নামক কূপের নিকট যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বলে এটিকে গাজওয়া মুরাইসি বলা হয়।[1]

সময়কাল

এই যুদ্ধের সময়কাল সম্পর্কে সিরাতবিদ ও ইতিহাসবিদগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম বুখারি উল্লেখ করেন, ইবনে ইসহাকের বর্ণনামতে ৬ষ্ঠ হিজরি এবং মুসা ইবনে উকবার বর্ণনামতে ৪র্থ হিজরিতে উক্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়।[2] ইবনে হিশামের বর্ণনামতে ৬ষ্ঠ হিজরি শাবান মাসে[3] এবং ওয়াকিদির বর্ণনামতে ৫ম হিজরির ২ শাবান এটি সংঘটিত হয়।[4] আবদুর রউফ দানাপুরি উল্লেখ করেন, ৪র্থ হিজরির রেওয়ায়েত সঠিক নয়। কারণ সকলে এই ব্যাপারে একমত, ইফকের ঘটনা এই যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট। আর ইফকের ঘটনা বুখারি ও মুসলিম-এ উল্লিখিত হয়েছে। তাতে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ইফকের ঘটনা পর্দার আয়াত নাজিল হওয়ার পর সংঘটিত হয়। আর পর্দার আয়াত নাজিল হয় ৫ম হিজরিতে। তাই ৫ম হিজরির পূর্বে এই যুদ্ধ সংঘটিত হতে পারে না।[5] যু-কারাদ যুদ্ধের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমাদাল-আখিরা ও রজব মাসে মদিনায় রওনা হন।[6]

মানচিত্র (৩০) : গাজওয়া মুরাইসি বা বনু মুসতালিকের অবস্থান

আরো পড়ুন : বদরের যুদ্ধ – Battle of Badr

আরো পড়ুন : বনু সুলাইম অভিযান – Al Kudr Invasion

আরো পড়ুন : বাতনে রাগিব অভিযান – Expedition of Ubaydah ibn al-Harith

যুদ্ধের কারণ

এই যুদ্ধের মূল কারণ ছিল মুসতালিক গোত্রের কাফেরদের ঔদ্ধত্য ও যুদ্ধোন্মাদনা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সংবাদ পৌঁছেছিল, বনু মুসতালিক মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সৈন্য সংগ্রহ ও জোরদার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। তাদের নেতা ছিল হারেস ইবনে আবি দিরার, যিনি ছিলেন পরবর্তীকালে উম্মুল মুমিনিন জুওয়ায়রিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পিতা। এই যুদ্ধের পরপরই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বিবাহ করেন। হারেস ইবনে আবি দিরার তার সম্প্রদায় ও আরবের সক্ষম ব্যক্তিদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্ররোচিত করে। অতঃপর তারা বহুসংখ্যক ঘোড়া ও অস্ত্রপাতি ক্রয় করে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এমনকি আরোহীগণ তাদের আঙিনা থেকে বের হয়ে অন্যদের নিকট তাদের নিজেদের যাত্রার খবর জানিয়ে দেয়। এই সংবাদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছালে তিনি বুরায়দা ইবনুল হুসাইব আল-আসলামি রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে এই সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য প্রেরণ করেন। বুরায়দা রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কিছু (উল্টাপাল্টা) বলার অনুমতি প্রার্থনা করলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনুমতি প্রদান করেন। অতঃপর তিনি মুরাইসি নামক পানির কূপের নিকট অবতরণ করেন। সেখানে তিনি অহংকারী এক কওমের সাক্ষাৎ পান, যারা বিরাট এক জামাতে ঐক্যবদ্ধ ছিল। তারা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে?’ তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক। এই লোকটির (মুহাম্মাদ) বিরুদ্ধে তোমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা শুনে আমি এখানে আগমন করেছি। তাই এখন আমি আমার কওম ও আমার অনুগত লোকদের নিকট গমন করব, যাতে আমরা ঐক্যবদ্ধ শক্তি নিয়ে তাকে ধ্বংস করতে পারি।’ হারেস ইবনে আবি দিরার বললেন, ‘আমরা এই অবস্থায় এখানেই আছি। তুমি দ্রুত আমাদের সাথে এসে মিলিত হও।’ বুরায়দা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আমি এখনই সওয়ার হয়ে যাচ্ছি এবং সত্বর আমার কওম ও অনুগতদের বিশাল একটি দল নিয়ে আসছি। তাতে তারা খুশি হলো।’[7]

মুসলমানদের প্রস্তুতি

বুরায়দা রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে কাফেরদের সকল সংবাদ অবহিত করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে আহ্বান করে শত্রুদের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে দিলেন। মুসলমানগণ তাদের মোকাবেলায় বের হওয়ার জন্য দ্রুত প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। তাদের সঙ্গে ছিল ৩০টি ঘোড়া; মুহাজিরদের ১০টি, তন্মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ২টি, যার নাম ছিল লিযায ও জারিব। অবশিষ্ট ৮টির উপর আরোহী ছিলেন আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু, উমর, উসমান, আলি, জুবাইর, আবদুর রহমান ইবনে আওফ, তালহা ইবনে উবায়দিল্লাহ ও মিকদাদ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু। আর আনসারদের ছিল ২০টি ঘোড়া, যার মালিক ও আরোহী ছিলেন সাদ ইবনে মুআজ, উসাইদ ইবনে হুদাইর, আবু আবস ইবনে জাবর, কাতাদা ইবনুন-নুমান, উওয়াইম ইবনে সাইদা, মা’ন ইবনে আদি, সাদ ইবনে জায়েদ আল-আশহালি, হারেস ইবনে হাজমা, মতান্তরে খাজমা, মুআজ ইবনে জাবাল, আবু কাতাদা, উবাই ইবনে কাব, হুবাব ইবনুল মুনজির, জিয়াদ ইবনে লাবিদ, ফারওয়া ইবনে আমর ও মুআজ ইবনে রিফাআ ইবনে রাফে রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ।[8]

যুদ্ধে রওনা

অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু যর আল-গিফারি রাযিয়াল্লাহু আনহু, মতান্তরে নুমাইলা ইবনে আবদিল্লাহ আল-লাইসি রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মদিনার গভর্নর নিযুক্ত করে মুসলিম যোদ্ধাদের নিয়ে রওনা হলেন। এই যুদ্ধের সফরে বহু মুনাফিক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যোগ দেয়, যারা ইতিপূর্বে কোনো যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই সফরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যোগ দিয়েছিল জিহাদের উৎসাহ নিয়ে নয়; বরং দুনিয়াবি সম্পদের লোভে। উপরন্তু উক্ত সফরও ছিল নিকটবর্তী স্থানে। তাই সফরের কষ্টও কম ছিল।

অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার নিকটস্থ শস্য ও কূপসমৃদ্ধ ‘হালায়েক’–মতান্তরে খালায়েক নামক স্থানে অবতরণ করেন। সেখানে আবদুল কায়েস গোত্রের এক ব্যক্তি এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম করল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘তোমার পরিবার কোথায়?’ সে বলল, ‘রাওহা নামক স্থানে।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ লোকটি বলল, ‘আপনার নিকটই এসেছি। আমি এজন্য এসেছি, আপনার উপর ঈমান আনয়ন করব, আপনি যা নিয়ে আগমন করেন তা সত্য বলে সাক্ষ্য দেব এবং আপনার সঙ্গে থেকে আপনার শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে খুশি হয়ে বললেন, ‘সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি তোমাকে ইসলামের প্রতি পথ প্রদর্শন করেন।’ লোকটি বলল, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! কোন আমল আল্লাহর নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয়?’ তিনি বললেন, ‘প্রথম ওয়াক্তে নামাজ আদায় করা।’[9]

আরো পড়ুন : গাজওয়া হুনাইন – Battle of Hunayn

আরো পড়ুন : গাজওয়াতুল বুহরান – Invasion of Buhran

আরো পড়ুন : নাখলা অভিযান – Nakhla Raid

অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৫ম হিজরির শাবান মাসের কোনো এক সোমবারে ৭০০ পদাতিক ও ৩০ জন অশ্বারোহীর একটি ছোট বাহিনী পুনরায় রওনা হলেন। তারা মদিনা থেকে ২৪ মাইল দূরে ‘বাকআ’ নামক স্থানে পৌঁছালে মুশরিকদের এক গুপ্তচরের সাক্ষাৎ পেলেন। মুসলমানগণ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার পেছনে কী? শত্রু সৈন্যগণ কোথায়?’ সে বলল, ‘আমি তাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না।’ তার এই মিথ্যা কথা শুনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু খুবই রাগান্বিত হলেন। তিনি বললেন, ‘তুমি সত্য কথা বলো, নতুবা আমি তোমার গর্দান উড়িয়ে দেব।’ এই হুমকিতে সে ভয় পেয়ে গেল এবং বলল, ‘আমি বনু মুসতালিকের লোক। হারেস ইবনে আবি দিরারকে এই অবস্থায় দেখে এসেছি, সে তোমাদের বিরুদ্ধে বিশাল এক বাহিনী জড়ো করেছে। আরও বহু লোকজন তার সাথে এসে যোগ দিচ্ছে। সে আমাকে তোমাদের নিকট প্রেরণ করেছে তোমাদের খবর সংগ্রহ করার জন্য এবং তোমরা মদিনা থেকে বের হয়েছ কি না, তা জানার জন্য।

অতঃপর উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নিয়ে গেলেন এবং তাকে যাবতীয় বিষয় অবহিত করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। সে তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে বলল, ‘আমার কওম কী করে—তা না দেখা পর্যন্ত আমি আপনাদের দীনের অনুসরণ করব না। তারা যদি আপনাদের দীনে শামিল হয়, তবে আমিও তাদের একজন হবো। আর যদি তারা তাদের দীনের উপর অটল থাকে, তবে আমিও তাদের অন্যতম হবো।’ এই কথা শুনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘রাসুল! আমাকে অনুমতি দিন, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দিই।’ লোকটি যেহেতু মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করেছে এবং ইসলাম গ্রহণ করতে সরাসরি অস্বীকার করে ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়ে হত্যা যোগ্য অপরাধ করেছিল, তাই উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রস্তাবের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সম্মুখে বাড়িয়ে দিলেন, অতঃপর তাকে হত্যা করা হলো। এই সংবাদ বনু মুসতালিকের নিকট পৌঁছে গেল। তাতে তারা ভীষণ ভয় পেল। তাদের মনোবল একেবারে ভেঙে গেল।

এই সম্পর্কে উম্মুল মুমিনিন জুওয়ায়রিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বর্ণনা প্রণিধানযোগ্য। পরবর্তীকালে মুসলমান হওয়ার পর তিনি এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বলতেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট আগমন করার পূর্বে যখন লোকটির নিহত হওয়ার এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওনা হওয়ার সংবাদ আমাদের নিকট পৌঁছাল, তখন আমার পিতা ও তার সঙ্গীগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো এবং তারা ভীষণভাবে ভীত হয়ে পড়ল। আরবের শহরতলী ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে যারা আমাদের দলে যোগদান করেছিল তারাও পৃথক হয়ে গেল। অতঃপর আমাদের নিজেদের দলের লোকজন ছাড়া আর একজন লোকও অবশিষ্ট রইল না।’[10]

অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুরাইসি নামক স্থানে পৌঁছালেন। সেখানে অবতরণ করার পর তার জন্য একটি চামড়ার তাঁবু নির্মাণ করা হলো। তার সঙ্গে উম্মুল মুমিনিনদের মধ্যে আয়েশা ও উম্মু সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন। তারা পানির নিকটই সমবেত হলেন এবং যুদ্ধের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সঙ্গীদের লাইন সোজা করে দিলেন। অতঃপর মুহাজিরদের পতাকা আবু বকর সিদ্দিক রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে, মতান্তরে আম্মার ইবনে ইয়াসির রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে অর্পণ করলেন এবং আনসারদের পতাকা অর্পণ করলেন সাদ ইবনে উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে।[11] সেদিন মুসলমানদের বিশেষ সংকেত ছিল, ‘ইয়া মানসুর! আমিত, আমিত!’ তথা ‘হে সাহায্যপ্রাপ্ত! মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছিয়ে দাও, মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছিয়ে দাও’।[12]

অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ঘোষণা দিতে নির্দেশ দিলেন, ‘তোমরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো, তা হলে তোমরা তোমাদের জানমালের হেফাজত করতে পারবে।’ কিন্তু বনু মুসতালিক এটি বলতে অস্বীকার করল এবং প্রথমে তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি তির নিক্ষেপ করল। এটির প্রতিউত্তরে মুসলমানগণও কিছুক্ষণ তির নিক্ষেপ করলেন। ফলে উভয় পক্ষে তির নিক্ষেপ শুরু হয়ে গেল। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ দিলেন। মুসলিম বাহিনী একযোগে আক্রমণ করল। ফলে শত্রু সৈন্যদের একজনও পালাতে পারল না। বেশিক্ষণ যুদ্ধ করার প্রয়োজন হলো না, অল্পতেই শত্রুরা কাবু হয়ে গেল। তাদের দশজন লোক নিহত হলো এবং সকলেই বন্দি হলো। নারী-পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে সকলকেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে বন্দি করা হলো। উট, ঘোড়া ও বকরি গনিমতের সম্পদ হিসেবে গ্রহণ করা হলো। দুই হাজার উট ও পাঁচ হাজার বকরি মুসলমানগণ গনিমত হিসেবে লাভ করলেন। বন্দি নারীর সংখ্যা ছিল দুইশত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু নাদলা আত-তাঈকে এই যুদ্ধের বিজয় সংবাদ দিয়ে মদিনায় প্রেরণ করেন।[13]

এই যুদ্ধে আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু বনি মুসতালিকের মালিক নামে এক ব্যক্তি ও তার পুত্রকে হত্যা করেন। আর আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাযিয়াল্লাহু আনহু একজন অশ্বারোহীকে হত্যা করেন, যার নাম ছিল আহসার, মতান্তরে উহায়সির।[14]

এই যুদ্ধে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতা প্রেরণ করে মুসলমানদের সাহায্য করেছিলেন, যা দেখে শত্রু সৈন্যগণ ঘাবড়ে গিয়েছিল এবং সম্পূর্ণরূপে মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল। উম্মুল মুমিনিন জুওয়ায়রিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমরা মুরাইসিতে অবস্থানকালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে আগমন করলে আমার পিতাকে আমি বলতে শুনলাম, ‘তিনি এমন শক্তি নিয়ে এসেছেন, যার মোকাবিলা করা আমাদের সাধ্য নেই।

অতঃপর আমি মুসলমানদের সেনা সদস্য ও ঘোড়া এত অধিকসংখ্যক দেখলাম, যা বর্ণনাতীত। অতঃপর আমি যখন ইসলাম গ্রহণ করলাম আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বিবাহ করলেন এবং আমরা ফিরে চললাম, তখন আমি মুসলমানদের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম; কিন্তু পূর্বে আমি যেরূপ দেখেছিলাম সেরূপ কিছুই দেখতে পেলাম না। তখন আমি বুঝতে পারলাম, তা ছিল মুশরিকদের অন্তরে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত ভীতি।’[15]

ফেরেশতা অবতরণের বিষয়টি আর একটি রেওয়ায়েত দ্বারা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। মুশরিক বাহিনীরই এক ব্যক্তি, যিনি পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং খাঁটি মুসলমানরূপে জীবনযাপন করেছিলেন, তিনি বলতেন, ‘যুদ্ধের ময়দানে আমরা সাদা-কালো মিশ্রিত রংয়ের অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণকারী সাদা পোশাক পরিহিত পুরুষ সৈন্যদের দেখেছিলাম, তাদেরকে আমরা পূর্বেও কখনো দেখিনি, পরেও না।’[16]

এই যুদ্ধে মুসলমানদের একজন সৈন্যও কাফেরদের হাতে শাহাদাতবরণ করেননি। কেবল হিশাম ইবনে সুবাবা, মতান্তরে হাশেম ইবনে দুবাবা নামক একজন মুহাজির সাহাবি, কালব ইবনে আওফ ইবনে আমের গোত্রের লোক, ভুলক্রমে মুসলমানদের হাতে নিহত হন।[17] তিনি শত্রু সৈন্যের সন্ধানে বের হয়েছিলেন। ফেরার সময় প্রচণ্ড বায়ু প্রবাহিত হচ্ছিল এবং সেই সঙ্গে ধূলিবালি উড়ছিল। উবাদা ইবনুল সামিত রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দলের আওস নামক একজন আনসার সাহাবি তাকে শত্রুসৈন্য মনে করে হত্যা করেন।[18]

মিয়াস ইবনে সুবাবার ধোকা ও তার পরিণাম

হিশাম ইবনে সুবাবা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিহত হওয়ার সংবাদ পেয়ে তার কাফের ভাই মিয়াস ইবনে সুবাবা বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করার কথা প্রকাশ করে মক্কা থেকে আগমন করে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট স্বীয় ভাইয়ের রক্তপণ (দিয়াত) দাবি করে বলে, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি ইসলাম গ্রহণ করে আপনার নিকট আগমন করেছি। আমি আমার ভাইয়ের রক্তপণ দাবি করতে এসেছি, যে ভুলবশত নিহত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার ভাইয়ের রক্তপণ প্রদানের নির্দেশ দিলেন। তা গ্রহণ করে সে অল্প কয়েকদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট অবস্থান করে। অতঃপর সুযোগ পেয়ে সে তার ভাইয়ের হত্যাকারীকে হত্যা এবং মুরতাদ হয়ে মক্কায় পালিয়ে যায়।[19] এই বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উপর ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হন। এজন্যই পরবর্তীকালে মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার ব্যক্তিকে যেখানেই পাওয়া যায় সেখানেই হত্যা করার নির্দেশ দেন। এমনকি তাদের কাবা শরিফের গিলাফ আঁকড়ে ধরা অবস্থায় পাওয়া গেলেও। এই মিয়াস ইবনে সুবাবা ছিল উক্ত চারজনের অন্তর্ভুক্ত।[20] অতঃপর মক্কা বিজয়ের দিনই নুমাইলা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে হত্যা করেন।[21]

আরো পড়ুন : গাজওয়া যু-আমর – Dhu Amarr raid

আরো পড়ুন : গাজওয়া সারিয়্যা আর-রাজি – Expedition of Al Raji

আরো পড়ুন : গাজওয়া হামরাউল আসাদ – Battle of Hamra al-Asad

মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে সংঘটিত বিবাদ

এই যুদ্ধে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা সংঘটিত হয়, তন্মধ্যে একটি হলো মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে সাময়িক বিবাদ। যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর মুসলমানগণ মুরাইশি কূপের নিকট অবস্থান করছেন। কূপে পানি অল্প থাকায় সেখানে খুবই ভিড় ছিল। সকলেই বালতি দ্বারা পানি তুলছিল। উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে তার ভৃত্য ছিল গিফার গোত্রের জাহজাহ ইবনে মাসউদ, মতান্তরে সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ঘোড়ার লাগাম ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি কূপ থেকে বালতি দ্বারা পানি উঠাতে গেলেন। অপরদিকে আওফ ইবনুল খাযরাজ গোত্রের মিত্র সিনান ইবনে ওয়াবর আল-জুহানি রাযিয়াল্লাহু আনহু-ও পানি উঠানোর জন্য তার বালতি কূপে ফেললেন। উভয়ের বালতি টক্কর লাগায় এক বালতিতে পানি উঠল—যা উভয়ে দাবি করতে লাগলেন। বাদানুবাদের একপর্যায়ে জাহজাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু হাত দ্বারা সিনান রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আঘাত করলেন এবং তাতে আহত হয়ে তার দেহ থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগল আল-জুহানি চিৎকার করে বললেন, হে আনসার দল! আর জাহজাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু চিৎকার করে ডাকলেন, হে মুহাজির দল!

এই চিৎকার শুনে উভয় দলের লোকজন জড়ো হয়ে গেল। মুহাজিরদের কিছু লোক সিনান রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তার দাবি ত্যাগ করতে অনুরোধ করল। অতঃপর উভয় দলের মধ্যস্থতায় সে তার দাবি ত্যাগ করল এবং বিষয়টির মীমাংসা হয়ে গেল।

এই অবস্থা দেখে মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ল। তার নিকট তার কওমের কিছু লোক ছিল। তারা হলো, মালিক, দাইস, সুওয়াইদ, আওস ইবনে কায়জি, মুআত্তিব ইবনে কুশাইর, জায়েদ ইবনুল লুসাইত বা সালত ও আবদুল্লাহ ইবনে নাবতাল।[22] এদের মধ্যে খাঁটি মুসলমান তরুণ যুবক জায়েদ ইবনে আরকাম রাযিয়াল্লাহু আনহু-ও ছিল।

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বলল, ‘তারা এরূপ আচরণ করল! অথচ তারা আমাদের নিকট এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে এবং আমাদের দেশে আমাদের চাইতে সংখ্যায় বেশি হয়ে গেছে। আল্লাহর কসম! আমি আমাদের ও কুরাইশের এই ময়লা কাপড়গুলো সেরূপই মনে করি, যেমন পূর্বকালের কেউ বলেছে, “তোমাদের কুকুরকে খাইয়ে মোটাতাজা করো, সে তোমাকে খেয়ে ফেলবে।” আল্লাহর কসম! আমরা মদিনায় ফিরে গেলে আমাদের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ সেখান থেকে অপদস্থদের তাড়িয়ে দেবে। উল্লেখ্য, উবাই এখানে সম্মানিত বলতে নিজেকে ও মদিনার আনসারদের বুঝিয়েছে এবং অপদস্থ বলতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুহাজির সাহাবিদের বুঝিয়েছে। অতঃপর সে তার কওমের যারা সেখানে উপস্থিত ছিল, তাদের নিকট গিয়ে বলল, এটি তোমাদের কৃতকর্মেরই ফসল। তোমরা তাদের জায়গা দিয়েছ এবং তোমাদের সম্পদ তাদের বণ্টন করে দিয়েছ। আল্লাহর কসম! তোমাদের নিকট যা আছে, তা যদি দেওয়া বন্ধ করে দাও, তাহলে অবশ্যই তারা তোমাদের দেশ থেকে অন্যত্র চলে যাবে।’

জায়েদ ইবনে আরকাম রাযিয়াল্লাহু আনহু এটি শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে সব কথা বলে দিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সংবাদ অপছন্দ করলেন। তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘হে বালক! তুমি হয়তো-বা তার প্রতি রাগান্বিত হয়েছ।’ সে বলল, ‘না, আল্লাহর কসম, ইয়া রাসুলাল্লাহ, এটি আমি তার নিকট শুনেছি।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সম্ভবত তোমার কান ভুল শুনেছে।’ সে বলল, ‘না, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আল্লাহর কসম!’ তিনি বললেন তাহলে অন্য কেউ তা বলেছে। সে বলল, ‘না, আল্লাহর কসম! ইয়া রাসুলাল্লাহ,’

এই খবর সেনাবাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। কওমের সকলে কেবল এই আলোচনাই করতে লাগল।

আনসারদের একদল লোক জায়েদ ইবনে আরকাম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তিরস্কার করতে লাগল যে, ‘তুমি গোত্রপতিকে অপমান করেছ, সে যা বলেনি তার অভিযোগ করেছ। এর ফলে তুমি জুলুম করেছ এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছ।’ জায়েদ ইবনে আরকাম বললেন, ‘আল্লাহর কসম! সে যা বলেছে, আমি তাই শুনেছি। আল্লাহর কসম! খাযরাজ গোত্রের মধ্যে আমার নিকট তদপেক্ষা প্রিয় ব্যক্তি আর কেউ ছিল না। আল্লাহর কসম! এই কথাগুলো যদি আমি আমার পিতার নিকট থেকে শুনতাম, তবু আমি তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতাম। আমি আশা করি আল্লাহ তার রাসুলের উপর এমন কিছু নাজিল করবেন, যা দ্বারা আমার কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয়।’[23]

জায়েদ ইবনে আরকাম রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিষয়টি অবহিত করেন, তখন উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু তার নিকট ছিলেন। এটি শুনে রাগান্বিত হয়ে তিনি বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আব্বাদ ইবনে বিশরকে নির্দেশ দিন, সে তাকে হত্যা করুক।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তা কীভাবে হয় হে উমর! লোকে বলবে, মুহাম্মাদ তার সঙ্গীদের হত্যা করে, এটি হতে পারে না। তুমি বরং এখান থেকে রওনা হওয়ার ঘোষণা প্রদান করো।’ এটি এমন একটি সময় ছিল, যখন সাধারণত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথাও রওনা হতেন না। অতঃপর লোকজন সকলেই রওনা হলো।

আরো পড়ুন : গাজওয়া মুরাইসি – Expedition of al-Muraysi’

আরো পড়ুন : গাজওয়া যাতুর-রিকা – Expedition of Dhat al-Riqa

আরো পড়ুন : গাজওয়া যি-কারাদ বা গাজওয়া গাবা – Expedition of Dhu Qarad

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল যখন জানতে পারল, জায়েদ ইবনে আরকাম তার নিকট থেকে যা কিছু শুনেছে তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছে, তখন সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গমন করে আল্লাহর কসম করে বলল, ‘আমি তা কখনো বলিনি বা কোনো আলোচনাও করিনি।’ আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার কওমের মধ্যে সম্ভ্রান্ত ও প্রতাপশালী লোক ছিল। আনসারদের মধ্যে তার সঙ্গী যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত ছিল, তারা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাকে দোষ থেকে রক্ষা করার জন্য বলল, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! বালকটি হয়তোবা তার কথা ভালোমতো বুঝতে পারেনি এবং স্মরণ রাখতে পারেনি।’ কিন্তু জায়েদ ইবনে আরকাম রাযিয়াল্লাহু আনহু সর্বদাই তার কথার উপর অটল ছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমি ঠিক শুনেছি।’

অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন রওনা হলেন, তখন উসাইদ ইবনে হুদাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু তার সাথে সাক্ষাৎ করে ইসলামি কায়দায় স্বাগতম জানালেন এবং বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি অসময়ে রওনা করেন, যখন আপনি সাধারণত রওনা করেন না।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘তোমাদের সঙ্গী কী বলেছে সে খবর কি তোমার কাছে পৌঁছেনি?’ উসাইদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘কোন সঙ্গী ইয়া রাসুলাল্লাহ?’ তিনি বললেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে উবাই।’ উসাইদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘সে কী বলেছে?’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সে ধারণা করে, মদিনায় ফিরে গেলে সম্মানিত লোকেরা অপদস্থ লোকদের তথা থেকে বিতাড়িত করে দেবে। উসাইদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহর কসম! সে-ই অপদস্থ এবং আপনি সম্মানিত। অতঃপর তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের জন্য সুপারিশ করে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! তার প্রতি একটু সদয় হোন। আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে আমাদের মধ্যে এনে দিয়েছেন। অথচ একসময় আমাদের কওমের লোকজন তাকে রাজমুকুট পরাবার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিল।’[24]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকজনসহ সারাদিন ও সারারাত পথ চললেন। পরদিন সকালবেলাও তিনি চলতে থাকলেন। বেলা বেড়ে গেলে রোদের প্রখরতার কারণে চলতে কষ্ট হওয়ায় তিনি যাত্রা বিরতি করলেন। ভূমিতে অবতরণ করতেই দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে সকলে ঘুমিয়ে পড়লেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটা এজন্য করেছিলেন, যাতে লোকজনের মনোযোগ পূর্বদিনের আলোচিত আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কথা থেকে অন্যদিকে ফিরে যায়।

অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকজনসহ আবার চলতে শুরু করলেন এবং হিজাজের মধ্য দিয়ে চললেন। এই সময় তিনি হিজাজের সামান্য উপরিভাগে অবতরণ করলেন যাকে ‘বাকআ’, মতান্তরে ‘নাক’ বলা হতো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সেখানে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখন প্রচণ্ড এক ঝড় প্রবাহিত হলো। তাতে সকলের কষ্ট হলো এবং তারা ভীত হয়ে পড়লেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমরা ভয় পেয়ো না। কাফেরদের বড় কোনো এক নেতার মৃত্যুতে এই বাতাস প্রবাহিত হয়েছে। পরে তারা মদিনায় পৌঁছে জানতে পারলেন, কায়নুকা নামক ইহুদি গোত্রের বড় নেতা এবং মুনাফিকদের সাহায্যকারী রিফাআ ইবনে জায়েদ ইবনুত তাবুত যেদিন ঝড়ো হাওয়া প্রবাহিত হয়েছিল ঠিক সেদিনই মারা গেছে।’[25]

অতঃপর আল্লাহ তায়ালা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার সঙ্গী মুনাফিকগণের প্রকৃত অবস্থা জানিয়ে একটি সুরা নাজিল করেন, যা সুরা আল-মুনাফিকুন নামে পরিচিত। এটির ফলে মুনাফিকদের স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে পড়ল এবং বালক জায়েদ ইবনে আরকামের সততা প্রমাণিত হলো। এই সুরা নাজিল হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্নেহভরে জায়েদ ইবনে আরকামের কান ধরে বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা এর কান রক্ষা করেন।’

মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের পুত্র, যার নামও ছিল আবদুল্লাহ, খাঁটি মুসলমান ছিলেন। তার পিতার এই সংবাদ যখন তার নিকট পৌঁছালো, তখন তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি শুনেছি, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই সম্পর্কে আপনার নিকট যে সংবাদ পৌঁছেছে, তার কারণে আপনি তাকে হত্যা করতে মনস্থ করেন। আপনি যদি তাই করেন, তবে সেই দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করুন। আমিই তার মস্তক আপনার নিকট এনে দেব। আল্লাহর কসম! খাযরাজ গোত্র জানে, তাদের মধ্যে পিতার প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি আমার তুলনায় আর কেউ নেই। আমি আশঙ্কা করছি, আপনি তাকে হত্যা করার জন্য অন্যকে নির্দেশ দিলে সে যদি তাকে হত্যা করে, তবে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের হত্যাকারীকে লোকের মধ্যে চলাফেরা করতে দেখে আমি নিজেকে সংবরণ করতে পারব কি না। ফলে তাকে হত্যা করে ফেলব। তখন কাফেরের বিনিময়ে একজন মুমিনকে হত্যা করার দায়ে আমি জাহান্নামের অধিবাসী হবো। এই কথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমরা তার সাথে নম্র আচরণ করব এবং তার সাথে সদ্ব্যবহার করব, যতদিন সে আমাদের সঙ্গে থাকে।’[26]

আরো পড়ুন : গাজওয়া বদর আল-আখিরা – Expedition of Badr al-Maw’id

আরো পড়ুন : গাজওয়া বনি নাজির – Invasion of Banu Nadir

আরো পড়ুন : গাজওয়া বনু কায়নুকা – Invasion of Banu Qaynuqa 

এরপর থেকে যখনই সে কোনো অঘটন ঘটাত, তখন তার কওম তার জন্য তাকেই দোষারোপ করত এবং তিরস্কার করত। তাদের এই অবস্থা অবগত হয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেছিলেন, ‘কেমন বুঝছ হে উমর! তুমি সেদিন তাকে হত্যা করতে বলেছিলে। সেদিন যদি আমি তাকে হত্যা করতাম, তবে অনেকেই তাতে শোকাহত হতো। আর আজ যদি আমি তাকে হত্যা করার নির্দেশ দিই, তবে তার গোত্রের লোকজনই তাকে হত্যা করবে।’ উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি বুঝতে পেরেছি, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদক্ষেপ আমার পদক্ষেপ থেকে বেশি বরকতময়।’[27]

ইকরিমা ও ইবনে জায়েদ প্রমুখ বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের পুত্র আবদুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু মদিনার সরু প্রবেশপথে তার পিতার পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিলেন এবং পিতাকে বলেছিলেন, ‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকুন। আল্লাহর কসম! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যতক্ষণ আপনাকে মদিনায় প্রবেশের অনুমতি প্রদান না করবেন, ততক্ষণ আপনি মদিনায় প্রবেশ করতে পারবেন না।’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে পৌঁছে তাকে মদিনায় প্রবেশের অনুমতি দিলে আবদু্ল্লাহ তার পথ ছেড়ে দেন এবং সে মদিনায় প্রবেশ করে।[28]

গনিমত বণ্টন

যুদ্ধশেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গনিমত সম্পদ মুসলিম যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করার নির্দেশ দেন। বন্দিদের বণ্টনের দায়িত্ব প্রদান করেছেন বুরায়দা ইবনুল খাসিব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আসবাবপত্র, অস্ত্রপাতি, উট, বকরি প্রভৃতি বণ্টনের দায়িত্ব দেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুক্তদাস শুকরান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর, এক পঞ্চমাংশ (খুমুস) বণ্টনের দায়িত্ব দেন মাহমিয়া ইবনে জাযই রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর।[29]

জুওয়ায়রিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবাহ

এই যুদ্ধে মুসলমানগণ গনিমত সম্পদ হিসেবে বহু দাস-দাসী লাভ করেন, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। দাসীদের মধ্যে মুসতালিক গোত্রপতি হারেস ইবনে আবি দিরারের কন্যা জুওয়ায়রিয়াও ছিলেন, যার নাম ছিল তখন বাররা। তিনি ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। গনিমত বণ্টনের সময় তিনি সাবিত ইবনে কায়েস ইবনে শাম্মাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বা তার চাচাতো ভাইয়ের ভাগে পড়েন, এক বর্ণনামতে উভয়ের ভাগে পড়েন। কিন্তু সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু তার চাচাতো ভাইকে তার অংশের মূল্য পরিশোধ করে তার একচ্ছত্র মালিক হন। জুওয়ায়রিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু তার সাথে ৯ উকিয়া স্বর্ণ মুক্তিপণ আদায় পূর্বক মুক্ত হয়ে যাওয়ার চুক্তি করেন।

উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমরা পানির নিকট থাকতেই জুওয়ায়রিয়া তার অর্থ পরিশোধের ব্যাপারে সাহায্য চাওয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করল এবং তার নিকট গিয়ে বলল, “ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি এখন মুসলমান। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আর আপনি আল্লাহর রাসুল। আমি গোত্রপতি হারেস ইবনে আবি দিরারের কন্যা জুওয়ায়রিয়া। আমি কি বিপদে নিপতিত হয়েছি, তা আপনার অজানা নয়। আমি সাবিত ইবনে কায়েস ইবনে শাম্মাসের ভাগে পড়েছি। অতঃপর আমি তার সাথে অর্থের বিনিময়ে মুক্তির চুক্তি করেছি। এখন আপনার নিকট আমার চুক্তির ব্যাপারে সাহায্য চাওয়ার জন্য আগমন করেছি।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি কি এর থেকে উত্তম কিছু চাও?’ জুওয়ায়রিয়া বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! তা কী?’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি তোমার মুক্তিলাভের অর্থ পরিশোধ করে দেব এবং তোমাকে বিবাহ করব।’ তিনি সম্মতি দিলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবিতকে ডেকে তার অর্থ পরিশোধ করে দিলেন এবং জুওয়ায়রিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আজাদ করে তাকে বিবাহ করেন।[30]

অপর এক বর্ণনামতে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পিতার নিকট প্রস্তাব দিলে পিতাই তাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিবাহ প্রদান করেছেন। তার বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো,

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বনু মুসতালিক যুদ্ধশেষে ফিরে এলেন, তখন জুওয়ায়রিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু-ও বন্দি হিসেবে তাদের সাথে ছিলেন। জুওয়ায়রিয়াকে আনসারদের এক লোকের নিকট আমানতস্বরূপ রাখা হলো। তিনি আনসার সাহাবিকে নির্দেশ দিলেন, সে যেন জুওয়ায়রিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে উত্তমরূপে রক্ষণাবেক্ষণ করে। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় পৌঁছালে হারেস ইবনে আবি দিরার স্বীয় কন্যা জুওয়ায়রিয়াকে মুক্ত করার জন্য বেশকিছু উট নিয়ে মদিনায় আগমন করেছেন। আকিক নামক স্থানে আসার পর উত্তম দুটি উটের দিকে তার নজর পড়ল। তিনি উট দুটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন এবং তা তার খুবই পছন্দ হলো। তিনি উট দুটিকে আকিকের গুহায় লুকিয়ে রাখলেন এবং অবশিষ্ট উটগুলো নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করে বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ! আপনারা আমার কন্যাকে বন্দি করে এনেছেন। এই তার মুক্তিপণ।’ তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সেই দুটি উট কোথায়, যা তুমি আকিকের অমুক গুহায় লুকিয়ে রেখেছ? তখন হারেস বলে উঠলেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আপনি মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল। আল্লাহর কসম! এই বিষয়টি আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানে না।’ এই বলে হারেস মুসলমান হয়ে গেল। তার সাথে তার দুই পুত্র এবং তার গোত্রের বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করল। অতঃপর তিনি লোক পাঠিয়ে সেই উট দুটি নিয়ে এলেন এবং তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে পেশ করলেন। অতপর তার কন্যা জুওয়ায়রিয়াকে তার নিকট সোপর্দ করা হলো। তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন এবং একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান হিসেবে জীবনযাপন করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পিতার নিকট জুওয়ায়রিয়াকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে পিতা তাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিবাহ দেন এবং চারশত দিরহাম দেনমোহর ধার্য করেন।[31]

ওয়াকিদির বর্ণনামতে, বনি মুসতালিকের ৪০ জন, মতান্তরে সকল যুদ্ধবন্দিকে আজাদ করে দেওয়া তার মোহররূপে ধার্য হয়।[32]

আরো পড়ুন : গাজওয়া তায়েফ – Siege of Ta’if

আরো পড়ুন : গাজওয়া দুমাতুল জানাদাল – Expedition of Dumat al-Jandal

আরো পড়ুন : গাজওয়া ফাতহ মক্কা (মক্কা বিজয়) – Conquest of Mecca

এই ব্যাপারে জুওয়ায়রিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরও একটি রেওয়ায়েত বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, ‘আমার পিতা সাবিত ইবনে কায়েস ইবনে শাম্মাসের নিকট থেকে মুক্তিপণ দিয়ে আমাকে মুক্ত করেন। অন্যান্য নারীদের জন্য যে মুক্তিপণ নির্ধারণ করা হয়েছিল, তিনি সেই পরিমাণ মুক্তিপণ দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে নেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পিতার নিকট আমাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেন। আমার পিতা তার সাথে আমাকে বিবাহ দেন।’[33] তবে এসব বর্ণনার মধ্যে প্রথম বর্ণনাটি অধিকতর সঠিক।

জুওয়ায়রিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর স্বপ্ন

এই যুদ্ধের তিন দিন পূর্বে জুওয়ায়রিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু একটি স্বপ্ন দেখেন, যার তাৎপর্য ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তার সাথে বিবাহ। বলা যায়, স্বপ্নটি ছিল এই বিবাহেরই পূর্ব-সুসংবাদ। উরওয়া ইবনে জুবাইর থেকে বর্ণিত। জুওয়ায়রিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুরাইসিতে আগমনের তিন দিন পূর্বে আমি স্বপ্নে দেখলাম, ইয়াসরিব থেকে একটি চাঁদ এসে আমার কোলের উপর পতিত হলো। এই স্বপ্ন আমি কারো নিকট প্রকাশ করা পছন্দ করলাম না। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে আজাদ করে বিবাহ করলেন। আমি আমার সম্প্রদায়ের কাউকেও এটি বলিনি। এমনকি মুসলমানগণ তাদেরকে আজাদ করে দিল। এই সংবাদ আমি অন্য কোনো মাধ্যম থেকে জানতে পারিনি কেবল আমার এক চাচাতো বোনই আমাকে এই সংবাদ দেয়। তখন আমি আল্লাহর প্রশংসা করি।’[34]

বিবাহের এই সংবাদ মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে লোকজন বলাবলি করতে লাগল, ‘এরা তো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শ্বশুরের বংশ।’ তারা এই বলে তাদের অধীনে যত দাস-দাসী ছিল—সবাইকে মুক্ত করে দিল। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, ‘তাকে বিবাহের ফলে বন্দি মুসতালিক গোত্রের প্রায় একশত পরিবারকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। নিজ কওমের জন্য এমন বরকতসম্পন্না নারী আমি আর কখনো দেখিনি।’[35]

আরো পড়ুন : গাজওয়া উহুদ – Battle of Uhud

আরো পড়ুন : গাজওয়া ওয়াদিল কুরা – Third Expedition of Wadi al Qura

আরো পড়ুন : গাজওয়া খায়বার – Battle of Khaybar

প্রভাবশালী এই গোত্রের গোত্রপতির কন্যাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বিবাহের ফলে গোত্রের সকলেই মুসলমানদের প্রতি এবং মুসলমানগণও উক্ত গোত্রের প্রতি সদয় হলো। ফলে পারস্পরিক হৃদ্যতা বৃদ্ধি পেল এবং এই অঞ্চল, থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতার আশঙ্কা রইল না। পরবর্তীকালে গোত্রের সকলেই ইসলাম গ্রহণ করায় মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি পেল। এই সফরেই আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গলার হার হারিয়ে যায় এবং তার প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা হয়।

তথ্যসূত্র

[1]. সুহাইলি, আর-রাউদুল উনুফ : ৬/৪২৮

[2]. আল-বুখারি, আস-সহিহ, কিতাবুল মাগাজি : ৩৩

[3]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/২৩৫

[4]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৪০৪

[5]. আবদুর রউফ দানাপুরি, আসাহুহুস সিয়ার : ১২৯

[6]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/১৫৬

[7]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৪০৪-৪০৫

[8]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : প্রাগুক্ত; সুবুলুল-হুদা ওয়ার-রাশাদ : ৪/৩৪৪

[9]. ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৪০৫-৪০৬; মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ, সুবুলুল হুদা ওয়ার-রাশাদ : ৪/৩৪৪

[10]. ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৪০৬

[11]. ইবনে কায়্যিম, আল-মুনতাজাম : ৩/২১৯; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/১৫

[12]. মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ, সুবুলুল হুদা ওয়ার-রাশাদ : ৪/৩৪৫

[13]. আল-মুনতাজাম : ২১৯

[14]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/২৪০

[15]. মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ, সুবুলুল হুদা ওয়ার-রাশাদ : ৪/৩৪৫

[16]. ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৪০৮-৪০৯; মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ, সুবুলুল হুদা ওয়ার-রাশাদ : ৪/৩৪৫

[17]. তারিখুল উমাম ওয়াল মুলক : ২/৬০৪

[18]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৪০৭-৪০৮

[19]. আত-তাবারি, তারিখ : ২/৬০৯

[20]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/১৬৭

[21]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৪০৮; মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ, সুবুলুল হুদা ওয়ার-রাশাদ : ৪/৩৪৫

[22]. অলি-ওয়াকিদি, প্রাগুক্ত : ২/৪১৬

[23]. মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ, সুবুলুল হুদা ওয়ার-রাশাদ : ৪/২৪৮-৪৯

[24]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/২৩৬-৩৭; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/১৫৭

[25]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/২৩৮; আত-তাবারি, তারিখ : ২/৬০৭

[26]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, প্রাগুক্ত; আত-তাবারি, প্রাগুক্ত : ২/৬০৮; আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ২/৪২০-২১

[27]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/১৫৮; আত-তাবারি, তারিখ : ২/৬০৮-৬০৯

[28]. ইবনে কাসির, প্রাগুক্ত : ৪/১৫৮

[29]. ইবনু সাইয়্যিদিন নাস, উয়ুনুল আসার : ২/১২৯; মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ, সুবুলুল হুদা ওয়ার-রাশাদ : ৪/৩৪৬

[30]. করলেন ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/২৪০; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/১৫৯

[31]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/২৪১

[32]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৪১২; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/১৫৯

[33]. আল-ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/৪১২

[34]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/১৫৯; মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ, সুবুলুল হুদা ওয়ার-রাশাদ : ৪/৩৪৭; আল-ওয়াকিদি, মাগাজি : ১/৪১২

[35]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/২৪০-৪১; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/১৫৯; আত-তাবারি, তারিখ : ২/৬১০

শেয়ার করুন

সূচীপত্র

error: Content is protected !!