সিরাত বিশ্বকোষ
সিরাত বিশ্বকোষ

৩০.(১৮) গাজওয়া খন্দক আহজাব  – Battle of the Trench

৩০.(১৮) গাওয়া খন্দক আহজাব – Battle of the Trench

১৮. গাজওয়া খন্দক বা খন্দকের যুদ্ধ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত গাজওয়া : ১৮
তারিখ শাওয়াল-জিলকদ, ৫ হিজরি; জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, ৬২৭ খ্রি.
অবস্থান মদিনার সীমান্ত।
ফলাফল অবরোধ ব্যর্থ, মুসলিমদের বিজয়।
বিবাদমান পক্ষ
মুসলিম বাহিনীতে ছিল আওস ও খাজরাজের আনসার-মুহাজির। জোট বাহিনীতে ছিল মক্কার কুরাইশ

 

নাদির ও কাইনুকার ইহুদি

 

অন্যান্য আরব গোত্র যেমন বনু গাতফান, বনু মুররা ও অন্যান্য

সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
 মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু,
উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু,
উসমান ইবনে আফফান রাযিয়াল্লাহু আনহু, আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু,
সালমান ফারসি রাযিয়াল্লাহু আনহু;
সাদ ইবনে মুয়াজ রাযিয়াল্লাহু আনহু 
আবু সুফিয়ান ইবনে হারব,
ইকরিমা ইবনে আবি জাহল,
উয়াইনা বিন হিসন,
হারেস বিন আউফ,
মিসআর বিন রুহাইলা,
হুয়াই ইবনে আখতাব;
কাব ইবনে আসাদ
শক্তি
৩,০০০ ১০,০০০
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
শহিদ ৭ জন নিহত ১৬ জন

 

 

পরিচিতি

খন্দক আরবিকৃত একটি শব্দ, যার মূল আর্য-হিন্দি বলে গণ্য করা হয়। উর্দু শব্দ খুদ, বাংলা শব্দ খাড়া এবং ফারসি শব্দ কান্দাহ-এর সঙ্গে এটির সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয়। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে সুরিয়ানি ভাষায় রচিত কিতাবুল হিমরিয়্যিন গ্রন্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কোনো শহর বা ছাউনির নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্যে তার চতুর্দিকে যে পরিখা খনন করা হয়, তাকে খন্দক বলে।[1]

এই যুদ্ধে মুসলমানগণ পারস্যের ইস্পাহান এলাকার অধিবাসী সালমান ফারসি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পরামর্শক্রমে যুদ্ধের অভিনব কৌশল হিসেবে মদিনার সম্ভাব্য শত্রু প্রবেশপথের বিস্তৃত এলাকায় খন্দক তথা পরিখা খনন করেছিলেন বিধায় এই যুদ্ধকে ‘খন্দকের যুদ্ধ’ নামে অভিহিত করা হয়।[2]

এই যুদ্ধে ইহুদি ও কুরাইশদের বিভিন্ন গোত্র ও দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের নির্মূল করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মদিনা আক্রমণ করেছিল বলে এই যুদ্ধকে গাজওয়া আহজাব বা সম্মিলিত বাহিনীর যুদ্ধ নামকরণ করা হয়েছে। আহজাব আরবি শব্দ হিজবুন-এর বহুবচন, যার অর্থ বহু দল বা বাহিনী।[3]

প্রেক্ষাপট

খন্দকের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনায় হিজরতের পর মুসলমান ও মক্কার কুরাইশ বাহিনীর সাথে উপর্যুপরি সামরিক অভিযান ও আক্রমণ কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে আরব উপদ্বীপে মুসলমানদের অনেকটা অনুকূল ও নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু যেসকল ইহুদি নিজেদের দুষ্কর্ম ও চক্রান্তের কারণে বিবিধ অপমান ও লাঞ্ছনার সম্মুখীন হয়েছিল, তখনো তাদের চৈতন্যদয় হয়নি। বিশ্বাসঘাতকতা, শঠতা, অঙ্গীকার ভঙ্গ, ধোঁকাবাজি ও ষড়যন্ত্র ইত্যাদি নানাবিধ অপকর্মের অশুভ পরিণতি থেকে কোনো শিক্ষাই তারা গ্রহণ করেনি। কাজেই মদিনা শরিফ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ইহুদি গোত্র বনু নাজির খায়বারে অবস্থানের পর মুসলমান ও মূর্তিপূজকদের মধ্যে যে সামরিক টানাপড়েন বা বিদ্বেষ চলছিল, তার ফলাফল কি দাঁড়ায় তা জানার জন্য তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু যখন তারা দেখল, পরিস্থিতি ক্রমেই মুসলমানদের অনুকূলে ধাবিত হচ্ছে এবং তাদের শাসন ক্ষমতা দিন দিন বিস্তৃতি লাভ করছে, তখন তারা হিংসার ক্ৰোধানলে জ্বলে-পুড়ে মরতে লাগল এবং নানা প্রকার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। শেষবারের মতো মুসলমানদের উপর এমন এক চরম আঘাত হানার জন্য তারা প্রস্তুতি শুরু করল, যাতে মুসলমানদের জীবন প্রদীপ চিরদিনের জন্য নির্বাপিত হয়ে যায়।[4]

আরো পড়ুন : গাওয়া খন্দক আহজাব – Battle of the Trench

আরো পড়ুন : গাওয়া তাবুক – Battle of Tabouk

আরো পড়ুন : গাজওয়া আস-সাবিক – Invasion of Sawiq

দীর্ঘকাল যাবত পরাধীন থাকার ফলে নীচ-প্রবৃত্তি ও কাপুরুষতা ইহুদি জাতির মজ্জাগত হয়ে পড়েছিল। এজন্য তারা কোনোদিনই মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে অগ্রসর হওয়ার সাহস করেনি। কিন্তু লোকদের কুমন্ত্রণা দিয়ে উত্তেজিত করতে এবং গোপনে গোপনে ষড়যন্ত্র পাকাতে তারা ছিল যথেষ্ট সিদ্ধহস্ত। শেষ চেষ্টা হিসেবে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুরাইশ ও অন্যান্য বিধর্মী গোত্রকে উত্তেজিত ও সংঘবদ্ধ করার বক্র পথটি বেছে নেয়। এই প্রেক্ষাপটেই মুসলমান ও সম্মিলিত মুশরিক বাহিনীর সাথে আহজাব বা খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

সময়কাল

খন্দকের যুদ্ধের সন-তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে। ইবনে ইসহাক, ইবনে উরওয়া, ইবনে জুবাইর, কাতাদা, বায়হাকিসহ অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও সিরাত বিশেষজ্ঞের মতে পঞ্চম হিজরির শাওয়াল মাস মোতাবেক ফেব্রুয়ারি ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে এটি সংঘটিত হয়।[5] ইমাম যাহাবি ও ইবনুল কায়্যিম রহ. এটিকে সঠিক অভিমত বলে মন্তব্য করেন।[6] মুসা ইবনে উকবা বলেন, ‘খন্দকের যুদ্ধ চতুর্থ হিজরির শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয়। ইমাম বুখারিও এই মতকে সমর্থন করেন।’[7] ঐতিহাসিক বালাযুরীর মতে, ‘চতুর্থ হিজরি জিলকদ মাসে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন।’[8] ইবনে সাদ ও ওয়াকিদির মতে পঞ্চম হিজরির জিলকদ মাসে এই যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়।[9] ইবনে ইসহাকসহ অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে উহুদযুদ্ধ তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে এবং খন্দকের যুদ্ধ পঞ্চম হিজরির শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয় এবং এটিই বিশুদ্ধ মত।[10] আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণিত হাদিসের ভিত্তিতে ইমাম বুখারি রহ. মুসা ইবনে উকবার মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আবদল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘আমি উহুদ যুদ্ধের দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যুদ্ধে গমনের অনুমতি প্রার্থনা করেছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল চৌদ্দ বছর। খন্দক যুদ্ধের দিন তার সমীপে উপস্থিত হয়েছিলাম তখন আমার বয়স ১৫ বছর। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এই যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেছেন।’[11]

উক্ত বর্ণনার দ্বারা পরিষ্কার বুঝা যায়, উহুদ এবং খন্দকের যুদ্ধের মধ্যে এক বছরের ব্যবধান। সুতরাং উহুদের যুদ্ধ তৃতীয় হিজরিতে হলে খন্দকের যুদ্ধ চতুর্থ হিজরিতে হওয়ারই কথা। অধিকাংশ সিরাত বিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিক এই ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন, খন্দকযুদ্ধ পঞ্চম হিজরিতেই সংঘটিত হয়েছিল। ইমাম বায়হাকি এটির সমাধানকল্পে বলেন, এটি আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা উহুদ যুদ্ধের সময় পূর্ণ চৌদ্দ বছর বয়স্ক ছিলেন না; বরং তখন চৌদ্দ বছরে কেবল পদার্পণ করেছিলেন। আর খন্দকের যুদ্ধের সময় তিনি পূর্ণ ১৫ বছরে উপনীত হন। এই হিসাবমতে উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধের মধ্যে দুই বছরের ব্যবধান হয়।[12] সুতরাং খন্দকের যুদ্ধ পঞ্চম হিজরির শাওয়াল মাসেই সংঘটিত হয়েছিল।

যুদ্ধের কারণ

এই যুদ্ধের মূল কারণ ছিল নির্বাসিত ইহুদি গোত্র বা নাজিরের বিশজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। যথা সালাম ইবনে আবিল হুকাইক, হুয়াই ইবনে আখতাব, কিনানা ইবনুর রবি, হাওয়া ইবনে কায়েস ওয়াইলি, আবু আম্মার আল-ওয়াইলি এবং বনু ওয়াইলের আরও কিছুসংখ্যক লোক ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের সমূলে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র একটি শক্তিশালী সম্মিলিত বাহিনী গঠন করে।[13]

উহুদ যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে আবু সুফিয়ান ঘোষণা করেছিল, আগামী বছর বদর প্রান্তরে আবার দেখা হবে। কিন্তু পরে অনুধাবন করল, একটি শক্তিশালী সুদৃঢ় বাহিনী ব্যতীত মুসলমানদের মোকাবেলা করা অসম্ভব। তাই পরবর্তী বত্সর বদর প্রান্তরে তারা যুদ্ধের জন্য যায়নি। উহুদ যুদ্ধে কুরাইশদের আংশিক বিজয় ও পুনরায় যুদ্ধের হুমকি খায়বারের ইহুদিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারা পরিকল্পনামতো প্রথমে মক্কায় গিয়ে কুরাইশদের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তাদের প্ররোচিত করে। তারা বলে, ‘তোমাদের সার্বিক সহযোগিতা পেলে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সমূলে উৎখাত করতে পারব।’[14] যেহেতু উহুদ যুদ্ধের দিন কুরাইশরা পুনরায় মুসলমানদের সঙ্গে বদরে মোকাবেলা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পালন করতে ব্যর্থ হয় এবং এর ফলে যোদ্ধা হিসেবে তাদের সুখ্যাতির যে হানি হয়, তা পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে বনু নাজিরের এই প্রস্তাব তাদের উৎসাহিত করে।[15] কুরাইশ তাদের বলল, ‘হে ইহুদি সম্প্রদায়! তোমরা প্রথম কিতাবধারী, মুহাম্মাদের সাথে আমাদের বিরোধের কারণ তোমাদের অজানা নয়। আচ্ছা তোমরা বলো, আমাদের ধর্ম উত্তম, না মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধর্ম উত্তম?’ তারা বলল, ‘তোমাদের ধর্মই তার ধর্ম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট এবং তোমরাই সঠিক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত আছো।’[16] এদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُونَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوتِ وَيَقُولُونَ لِلَّذِينَ كَفَرُوا هَؤُلَاءِ أَهْدَى مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا سَبِيلًا (৫১) أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ وَمَنْ يَلْعَنِ اللَّهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ نَصِيرًا (৫২)

‘তুমি কি তাদের দেখোনি, যাদের কিতাবের এক অংশ দেওয়া হয়েছিল, তারা জিব্ত ও তাগুতের প্রতি বিশ্বাস করে। তারা কাফেরদের সম্বন্ধে বলে, এদের পথ মুমিনদের অপেক্ষা প্রকৃষ্টতর। এরাই তারা যাদের আল্লাহ লানত করেন এবং আল্লাহ যাকে লানত করেন, তুমি কখনো তার কোনো সাহায্যকারী পাবে না।’[17]

তাদের বক্তব্য শুনে কুরাইশরা ভীষণ খুশি হলো এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ প্রস্তাবও তারা সানন্দে গ্রহণ করল। অতঃপর সকলে একমত হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।[18]

কুরাইশদের যুদ্ধের প্রস্তুতি

ইহুদিদের এই দলটি বনি গাতফান গোত্রের নিকট গমন করে এবং কুরাইশদের ন্যায় তাদেরকেও যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকে।[19] গাতফান গোত্রের লোকেরা পূর্ব থেকেই মুসলমানদের শত্রু ছিল। উপরন্তু ইহুদিরা বনি গাতফানের কাছে তাদের সহযোগিতা ও সমর্থনের নিদর্শনস্বরূপ খায়বারের উৎপাদিত এক বছরের খেজুর প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিল। তাতে তারা সাগ্রহে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করল।[20] আসাদ গোত্রের সাথে গাতফানিদের মিত্রতা ছিল। সুলাইম গোত্রের সাথে কুরাইশদের আত্মীয়তা ছিল এবং সাদ গোত্র ইহুদিদের মিত্র ছিল। ফলে এই গোত্রগুলোও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে যোগদান করল।[21]

আরো পড়ুন : ইহুদি নেতা আবু রাফে-এর হত্যা অভিযান – Killing of Abu Rafi’

আরো পড়ুন : কাব ইবনুল আশরাফ হত্যা অভিযান – Killing of Ka’b ibn al-Ashraf

আরো পড়ুন : খাররার অভিযান – Expedition of al-Kharrar

সিদ্ধান্ত মোতাবেক সর্বপ্রথম আবু সুফিয়ান তিনশত ঘোড়া, এক হাজার পাঁচশত উট এবং চার হাজার সুদক্ষ কুরাইশ সেনা নিয়ে মক্কা থেকে বের হলো। দারুন-নদওয়ায় কুরাইশদের পতাকা তৈরি করা হলো এবং উসমান ইবনে তালহা ইবনে আবি তালহাকে পতাকা প্রদান করা হলো।[22] তার পিতা তালহা উহুদ যুদ্ধে কুরাইশদের পতাকা বহনকালে মুসলমাদের হাতে নিহত হয়েছিল বলে এই যুদ্ধে তার পুত্ৰ উসমানকে এই সম্মানে ভূষিত করা হয়। কুরাইশ ও ইহুদি দলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সুফিয়ান ইবনে আবদ্ শামসের নেতৃত্বে বনু সুলাইমের সাতশত সৈন্য, উয়ায়না ইবনে হিসনের নেতৃত্বে বনু ফায়ারার এক হাজার উটসহ কয়েকশত অনুচর, মাসউদ ইবনে খায়লার নেতৃত্বে অশিজা গোত্রের চারশত সৈন্য, হালিস ইবনে আওফের নেতৃত্বে বনু মুররার চারশত সৈন্য, তালহা ইবনে খুওয়ায়লিদের নেতৃত্বে বনু আসাদের বেশকিছুসংখ্যক সৈন্য, জুর ও মাগাবার মধ্যবর্তী রুমার মুজতামিউল আসিয়ালে সমবেত হয়।[23]

আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের নেতৃত্বে সম্মিলিত বাহিনীর ১০ হাজার সৈন্য,[24] মতান্তরে ১২ বা ১৫ হাজার সৈন্যের[25] বিশাল বাহিনী মদিনার উপকণ্ঠে রুমাহ্-এর পশ্চিমে জুরফ ও যাগা-এর সংযোগস্থলে অবস্থান গ্রহণ করে।[26]

আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে সম্মিলিত বাহিনীর মদিনা অভিমুখে যাত্রা সম্পর্কে খুজাআ গোত্রের কিছুসংখ্যক লোকের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবহিত হলেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে সাহাবিদের সাথে পরামর্শে বসলেন। শত্রুবাহিনীর প্রতিরোধকল্পে মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করা সমীচীন হবে কি না, এই বিষয়ে পক্ষ-বিপক্ষের আলোচনা শেষে বিগত উহুদ যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে মদিনার ভেতরে থেকে শহর প্রতিরক্ষার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হলো। সাথে সাথে শক্ত প্রতিরোধের অভিনব পদ্ধতি হিসেবে সালমান ফারসি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খন্দক খননের প্রস্তাব গৃহীত হলো।[27] সালমান ফারসি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রস্তাবটি ছিল নিম্নরূপ,

يا رسول الله، إنا كنا بأرض فارس إذا حوصرنا خندقنا علينا.

‘হে আল্লাহর রাসুল! পারস্যে যখন আমাদের অবরোধ করা হতো, তখন আমরা আমাদের পার্শ্ববর্তী স্থানে পরিখা খনন করতাম।’[28]

খন্দক বা পরিখা খনন

খন্দক খননের এই কৌশল ছিল তাদের নিকট অজ্ঞাত। এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। মদিনার তিন দিক পাহাড়, খেজুর বাগান, টিলা ও বাড়ি-ঘর দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। ওই সমস্ত খেজুর বাগান প্রাচীরের কাজ করছিল। অশ্বারোহী সৈন্যের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। অভ্যন্তরস্থ রাস্তাগুলো এতই সরু ও সংকীর্ণ ছিল যে, শত্রুসৈন্যদের ঐ দিক দিয়ে আক্রমণ করা ছিল অসম্ভব। শুধু মদিনার উত্তরাঞ্চল তথা সিরিয়ার দিকটি ছিল উন্মুক্ত।[29] সুতরাং শুধু এদিকে পরিখা খনন করলে অতি সহজে শহর ও শহরবাসীকে অক্ষত অবস্থায় রাখা যাবে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার অদূরে সালা পাহাড়ের সম্মুখে হাররাতুল-ওয়াকিম ও হাররাতুল-ওয়াবরার মধ্যস্থলে পরিখা খনন করার নিদের্শ দিলেন।[30]

খননকার্যে তিন হাজার মুসলিম মুজাহিদ অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রতি দশজনের উপর চল্লিশ হাত দীর্ঘ পরিখা খননের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনশত ক্ষুদ্র দলের প্রত্যেক দল বিশ গজ বা চল্লিশ হাত করে মোট ছয় হাজার গজ বা বারো হাজার হাত তথা প্রায় সাড়ে তিন মাইল দীর্ঘ পরিখা খনন করেন। ঐতিহাসিকগণ পরিখার প্রস্থের কোনো বর্ণনা উল্লেখ করেননি। কিন্তু ‘ঘোড়া লাফ দিয়ে অতিক্রম করতে পারবে না’ এই ব্যাখ্যা দ্বারা সম্ভবত এটি বলা যেতে পারে, পরিখা দশ গজ চওড়া এবং পাঁচ গজ গভীর ছিল।[31] ইবনে হাজার রহ. বলেন, ‘পরিখা এত পরিমাণ গভীর ছিল, তাতে সাঁতার কাটা যেত।’[32] এই বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো বর্ণনা না থাকলেও বলা যায়, পরিখাটি ওই পরিমাণ গভীর ও প্রশস্ত ছিল, যাতে শত্রুসৈন্য সহজে তা অতিক্রম করতে সক্ষম না হয়।[33] সালমান ফারসি রাযিয়াল্লাহু আনহু যেহেতু পরিখা খনন পরিকল্পনার উদ্ভাবক ও এই বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন এবং তিনি মুহাজির ও আনসার কোনো দলেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না, তাই তাকে নিজ নিজ দলভুক্ত করার জন্য মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে কিছুটা প্রতিযোগিতার ভাব পরিলক্ষিত হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটির সমাধান করতে গিয়ে বলেন, ‘সালমান আমার পরিবারভুক্ত।’[34]

পরিখা খননের সময়পর্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। ইবনে সাদ রহ.-এর বর্ণনামতে ছয় দিনে এই পরিখা খননকাজ সম্পন্ন হয়।[35]

আরো পড়ুন : আল-আবওয়া অভিযান – Patrol of Wa ddan (al-Abwa)

আরো পড়ুন : আল-উশাইরা অভিযান – Patrol of Zul Al-Ushairah

আরো পড়ুন : আসমা বিনতে মারওয়ান হত্যা – Killing of Asma Bint Marwan

মুসা ইবনে উকবা বলেন, ‘২০ দিনে খন্দক খননকাজ সম্পন্ন হয়।’[36] আল্লামা সান্দী বলেন, ‘সঠিক মত হলো, খন্দক খনন ছয় দিনেই সম্পন্ন হয়। ২০ দিন ছিল সর্বমোট অবরোধের সময়।’[37] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্দক খননকাজে স্বয়ং মুসলিম সৈন্যদের সাথে অংশগ্রহণ করে তাদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেন। মুসলিম সৈন্যসংখ্যা ছিল তিন হাজার। মুহাজিরদের পতাকা জায়েদ ইবনে হারিসা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে এবং আনসারগণের পতাকা সাদ ইবনে উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে ছিল।[38] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম জমিনে কোদাল মেরে খননকাজের শুভ সূচনা করেন এবং আবৃত্তি করেন,

بِسْمِ اللَّهِ وَبِهِ بَدَيْنَا وَلَوْ عَبَدْنَا غَيْرَهُ شقينا فحبذا رَبًّا وَحب دِينَا.

‘আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি। তাকে ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করলে আমাদের বদনসিব। অথচ তিনিই উত্তম প্রভু এবং তার মনোনীত ধর্মই উত্তম ধর্ম।’[39]

মুসলিম বাহিনী পূর্ণ উদ্যম ও নিষ্ঠার সাথে খননকাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কতিপয় মুনাফিক তাতে গড়িমসি শুরু করল। তারা ছোটোখাটো অজুহাত দেখিয়ে খননকাজ থেকে সরে দাঁড়াল। এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিনা অনুমতিতে তারা ফাঁকি দিয়ে স্বীয় পরিবারবর্গের নিকট চলে গেল। আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়ে ইরশাদ করেন,

لَا تَجْعَلُوا دُعَاءَ الرَّسُولِ بَيْنَكُمْ كَدُعَاءِ بَعْضِكُمْ بَعْضًا قَدْ يَعْلَمُ اللَّهُ الَّذِينَ يَتَسَلَّلُونَ مِنْكُمْ لِوَاذًا فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (৬৩)

‘রাসুলের আহ্বানকে তোমরা তোমাদের একে অপরের প্রতি আহ্বানের মতো গণ্য কোরো; তোমাদের মধ্যে যারা চুপি চুপি সরে পড়ে, আল্লাহ তাদের জানেন। সুতরাং যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের উপর মর্মান্তিক শাস্তি।’[40]

পক্ষান্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ও পরকালে সওয়াবের আশায় মুসলিম সৈন্যগণ সকল বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে আন্তরিকতার সাথে খননকাজে অংশগ্রহণ করেন। তাদের কোনো জরুরি প্রয়োজন দেখা দিলে তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবগত করতেন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতি গ্রহণ করে প্রয়োজন সেরে পুনরায় কাজে যোগদান করতেন। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَإِذَا كَانُوا مَعَهُ عَلَى أَمْرٍ جَامِعٍ لَمْ يَذْهَبُوا حَتَّى يَسْتَأْذِنُوهُ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَأْذِنُونَكَ أُولَئِكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ فَإِذَا اسْتَأْذَنُوكَ لِبَعْضِ شَأْنِهِمْ فَأْذَنْ لِمَنْ شِئْتَ مِنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمُ اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ (৬২)

‘তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ এবং তার রাসুলের প্রতি ঈমান আনে এবং রাসুলের সঙ্গে সমষ্টিগত ব্যাপারে একত্র হলে তারা অনুমতি ব্যতীত সরে পড়ে না। যারা তোমার অনুমতি প্রার্থনা করে, তারাই আল্লাহ এবং তার রাসুলে বিশ্বাসী। অতএব তারা তাদের কোনো কাজে বাহিরে যাওয়ার জন্য তোমার অনুমতি চাইলে তাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা তুমি অনুমতি দিয়ো এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কোরো। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’[41]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং সাহাবিগণের সঙ্গে পরিখা খনন করেন। শৈত্যপ্রবাহ ছিল খুব তীব্র এবং ওই বছরটি ছিল দুর্ভিক্ষের। আর্থিক সংকটের দরুন খাদ্যের পরিমাণও ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অল্প।[42] আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘পরিখা খননরত মুসলমানদের জন্য যে সামান্য পরিমাণ খাদ্য আনা হয়েছিল, তা ছিল খুব নিম্নমানের। তাই-ই তারা ভক্ষণ করেছিলেন।’[43] মুসলমানগণ অত্যন্ত কষ্টক্লেশ ও ক্ষুধার যন্ত্রণা উপেক্ষা করে খন্দক খননে আত্মনিয়োগ করেন। আবু তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ক্ষুধার কথা বললাম এবং নিজেদের পেট দেখালাম। পেটে তখন পাথর বাধা ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তার পেটের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দিলেন, দেখলাম তাতে দুটি পাথর বাধা আছে।’[44] সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের উজ্জ্বল আদর্শ স্থাপন করলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্দক খননে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। মাটির ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে অতি উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে তিনি নিম্নের কবিতাটি আবৃত্তি করলেন,

اللَّهُمَّ لَوْلَا أَنْتَ مَا اهْتَدَيْنَا وَلَا تَصَدَّقْنَا وَلَا صَلَّيْنَا

فَأَنْزِلَنْ سَكِينَةً عَلَيْنَا وَثَبِّتْ الْأَقْدَامَ إِنْ لَاقَيْنَا

إِنَّ الْأُلَى قَدْ بَغَوْا عَلَيْنَا وَإِنْ أَرَادُوا فِتْنَةً أَبَيْنَا

‘হে আল্লাহ! তুমি না হলে আমরা হেদায়েত লাভ করতে পারতাম না, সদকা দিতে এবং নামাজ আদায় করতে জানতাম না। হে প্রভু! তুমি আমাদের প্রতি শান্তি অবতীর্ণ করো এবং শত্রুর সাথে যুদ্ধকালে আমাদের অটল ও দৃঢ় রাখো। মুশরিকরা আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। আর তারা বিপর্যয় সৃষ্টির সংকল্প করলে আমরা তাতে অসম্মতি প্রকাশ করি।’।[45]

ক্ষুধার্ত সাহাবিগণের অক্লান্ত পরিশ্রম ও কষ্ট দেখে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোমল হৃদয় বিগলিত হয়ে পড়ত। এই মর্মস্পর্শী করুণ দৃশ্য দেখে উৎকণ্ঠিত স্বরে তিনি বলে ওঠেন,

«اللهُمَّ، لَا عَيْشَ إِلَّا عَيْشُ الْآخِرَةِ، فَاغْفِرْ لِلْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ»

‘হে আল্লাহ! আখেরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন। অতএব তুমি আনসার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করো।’।[46]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই দোয়া শ্রবণ করে সাহাবিগণ সান্ত্বনা পেতেন এবং দ্রুতবেগে মাটির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে দৌড়াতেন আর আবৃত্তি করতেন,

نَحْنُ الَّذِينَ بَايَعُوا مُحَمَّدَا

عَلَى الْجِهَادِ مَا بَقِينَا أَبَدَا

‘আমরা তো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে আজীবন জিহাদ করার শপথ গ্রহণ করেছি।’[47]

আরো পড়ুন : বুওয়াত অভিযান – Patrol of Buwat

আরো পড়ুন : আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার অভিযান – Expedition Abdullah ibn Rawaha

আরো পড়ুন : আবু আফাক হত্যা – Killing of Abu Afak

কোনো কোনো সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উৎসাহিত করে বলেছিলেন,

اللَّهُمَّ إِنَّه لَا خَيْرَ إِلَّا خَيْرُ الْآخِرَهْ

فَبَارِكْ فِي الْأَنْصَارِ وَالْمُهَاجِرَهْ

‘হে আল্লাহ! আখেরাতের কল্যাণই আসল কল্যাণ। সুতরাং তুমি আনসার ও মুহাজিরদের বরকত দান করো।’[48]

মানচিত্র (৩১) : খন্দকের যুদ্ধে পরিখার অবস্থান

 

খন্দক খননকালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুজিযা

মুসলমানদের ঈমান সুদৃঢ়করণ ও নবুওয়াতের প্রত্যয়ন হিসেবে খন্দক খননকালে আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে কিছু মুজিযার প্রকাশ ঘটে।

ক. জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘খন্দক খননকালে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত অবস্থায় দেখতে পেলাম। আমি বাড়ি গিয়ে স্ত্রীকে বললাম, তোমার কাছে কি খাওয়ার মতো কিছু আছে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। তখন সে একটা চামড়ার পাত্র এনে তা থেকে এক সা পরিমাণ যব বের করল। আমাদের একটা বকরির বাচ্চা ছিল। আমি বকরির বাচ্চাটি জবেহ করলাম এবং গোশত ডেকচিতে উঠালাম। আমার স্ত্রীও যব পিষে আটা তৈরি করল। আমরা একইসাথে কাজ দুটি সম্পন্ন করলাম। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে গেলাম। আমার স্ত্রী বলল, আমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবিদের নিকট লজ্জিত কোরো না। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গোপনে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! বাড়িতে আমরা ছোট একটি বকরির বাচ্চা জবেহ করেছি। ঘরে এক সা পরিমাণ যব ছিল। আমার স্ত্রী তা পিষে আটা তৈরি করেছে। আপনি আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে চলুন। এই কথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চৈঃস্বরে সকলকে ডেকে বললেন, “হে পরিখা খননকারীগণ! তাড়াতাড়ি চলো। জাবির তোমাদের জন্য খাবার প্রকৃত করেছে।” অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “তুমি যাও, তবে আমি না আসা পর্যন্ত গোশতের ডেকচি চুলা থেকে নামাবে না এবং খামির থেকে রুটিও তৈরি করবে না।” অতঃপর আমি বাড়িতে ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সাহাবিগণকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। আমি আমার স্ত্রীর কাছে গেলে সে বলল, আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন। তুমি এটি কী করলে? আমি বললাম, তুমি যা বলেছিলে আমি তাই করেছি। অর্থাৎ তোমার আশঙ্কা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবহিত করেছি। অতঃপর আমার স্ত্রী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আটার খামির এগিয়ে দিলে তিনি তাতে মুখের লালা মেশালেন এবং বরকতের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর ডেকচির কাছে এগিয়ে গিয়ে তাতেও লালা মেশালেন এবং বরকতের জন্য দোয়া করলেন এবং বললেন, “হে জাবির! রুটি প্রস্তুতকারীকে ডাকো। সে আমার পাশে থেকে রুটি তৈরি করুক এবং চুলার উপর থেকে ডেকচি না নামিয়ে গোশত পরিবেশন করুক।” জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, সাহাবিদের সংখ্যা ছিল এক হাজার। আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, সবাই তৃপ্তি সহকারে খাওয়ার পরও ডেকচি ভর্তি গোশত টগবগ করে ফুটছিল এবং আটার খামির থেকেও রুটি প্রস্তুত হচ্ছিল।’[49]

খ. ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, সাঈদ ইবনে মিনা আমার নিকট বর্ণনা করেন, বাশির ইবনে সাদের জনৈকা কন্যা অর্থাৎ নুমান ইবনে বাশির রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বোন বলেন, ‘আমার মাতা আমরাহ বিনতে রাওয়াহা আমাকে ডেকে আমার কাপড়ে এক মুষ্টি খেজুর ঢেলে দিলেন। অতঃপর বললেন, বৎস! তুমি এগুলো তোমার পিতা ও তোমার মামা আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার কাছে নিয়ে যাও, তারা সকালের খাবার খাবেন। আমি সেগুলো নিয়ে রওনা হলাম। আমি তাদের খোঁজাখুঁজি করছি, এমন সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে আমার দেখা হলো। তিনি বললেন, বৎস, এদিকে এসো! তোমার কাছে এগুলো কী? আমি বললাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! এগুলো খেজুর। আমার পিতা বাশির ইবনে সাদ ও মামা আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার আহারের জন্য আমার মা এগুলো পাঠিয়েছেন।’ তিনি বললেন, ‘আমার কাছে নিয়ে এসো।’ আমি সেগুলো তার হাতে দিলাম। কিন্তু তা পরিমাণে এতই কম ছিল, তার হাত ভরেনি। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি কাপড় বিছাতে বললেন। তা বিছানো হলো। তিনি খেজুরগুলো সেই কাপড়ের উপর ছড়িয়ে দিলেন। অতঃপর পার্শ্বে উপস্থিত একজনকে বললেন, খন্দক খননকারীদের দুপুরের খাবারের জন্য আহ্বান করো। সকলে এসে খেজুর খাওয়া শুরু করলেন। কিন্তু আশ্চর্য! তারা যতই খান, খেজুর ততই বাড়তে থাকে। অবশেষে খন্দক খননকারীগণের তৃপ্তিসহ খাওয়া শেষ হলেও কাপড়ের চারপাশ থেকে খেজুর তখনো উপচে পড়ছিল।[50]

আরো পড়ুন : সিফুল বাহার অভিযান – Expedition of Hamza ibn Abdul-Muttalib

আরো পড়ুন : হুদাইবিয়ার সন্ধি – Treaty of Hudaybiyyah

গ. সালমান ফারসি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি পরিখার এক প্রান্তে খননকাজে মগ্ন ছিলাম। ঘটনাক্রমে একটি কঠিন পাথর আমার সামনে পড়ল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছেই ছিলেন। তিনি দেখলেন, আমি লাগাতার কোদাল মারছি, কিন্তু পাথরটি ভাঙতে পারছি না। অবশেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে কোদাল মারলেন, ফলে পাথরটি বালুকায় পরিণত হলো।’[51] সুনানে নাসায়ির বর্ণনায় আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত পাথরের উপর তিনবার কোদাল মেরেছিলেন। প্রত্যেকবারই বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো আলো বের হয়েছিল এবং সেই আলোতে যথাক্রমে সিরিয়া, পারস্য ও ইয়ামানের প্রাসাদসমূহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টিগোচর হয়েছিল এবং তিনি উক্ত রাজ্যত্রেয় মুসলমানদের অধীনস্থ হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন।[52]

তারিখে তাবারির অন্য এক বর্ণনায় দেখা যায়, আমর ইবনে আওফ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি সালমান ফারসি, হুজায়ফা ইবনুল-ইয়ামান, নুমান ইবনে মুকাররিন মুজানি এবং আনসারদের আরও ছয় ব্যক্তি, এই দশজনের একটি ক্ষুদ্র দলের উপরও ৪০ গজ খন্দক খননের দায়িত্ব পড়ে। আমরা যুবাব নামক স্থানের নিম্নদেশ থেকে খন্দক খনন শুরু করে নাদা নামক স্থান পর্যন্ত পৌঁছালাম। আল্লাহ তায়ালা খন্দকের ভেতর থেকে একটি চকচকে সাদা পাথর বের করে দিলেন। চেষ্টা করেও পাথরটি আমরা ভাঙতে পারলাম না। সালমান ফারসি রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বিষয়টি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবহিত করতে বললাম। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাথরের বিষয়টি অবহিত করলেন এবং বললেন, “আমরা যথাশক্তি প্রয়োগ করে উপর্যুপরি তার উপর আঘাত করেছি, কিন্তু পাথরটি ভাঙতে পারিনি। আপনি আমাদের সাহায্য করুন।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালমান ফারসির সাথেই খন্দকে নেমে এলেন। আমরা বাকি নয়জন খন্দকের কিনারায় ছিলাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালমান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট থেকে কোদাল নিয়ে পাথরে আঘাত করলেন, ফলে তার এক অংশ ভেঙে গেল এবং তা থেকে বিদ্যুৎ চমকে মদিনার দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থান আলোকিত হয়ে গেল। গভীর অন্ধকার ঘরে যেন সকালের শুভ্র আলো পতিত হলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহু আকবার বললেন, মুসলমানগণও তাকবির দিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়বার ওই পাথরে আঘাত করলেন। এইবার তার একটি অংশ ভেঙে পড়ল এবং বিদ্যুতের মতো চমকে পূর্বের ন্যায় দুই পাহাড়ের মধ্যখানে আলো ছড়িয়ে পড়ল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহু আকবার বললেন, মুসলমানগণও তাকবির ধ্বনি দিলেন। তৃতীয়বার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাথরে আঘাত করলেন। পাথর ভেঙে এবারও তা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহু আকবার বললেন, সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানগণও তাকবির দিলেন।

অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালমান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাত ধরলে তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার পিতা-মাতা আপনার প্রতি কুরবান হোক। আমি এমন কিছু দেখেছি, যা পূর্বে কোথাও দেখিনি। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের লক্ষ্য করে বললেন, “সালমান যা বলল, তা কি তোমরা দেখেছ?” সাহাবিগণ বললেন, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর রাসুল! আমাদের পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আমরা আপনাকে পাথরে আঘাত করতে এবং তা থেকে তরঙ্গের ন্যায় বিদ্যুৎ চমকাতে দেখেছি। অতঃপর আপনি তাকবির দিয়েছেন এবং আমরাও তাকবির দিয়েছি। এটি ছাড়া আর কিছু আমরা দেখিনি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা সত্য বলেছো। আমি প্রথম যখন পাথরে আঘাত করি, তখন তা থেকে বিদ্যুৎ চমকায়—যা তোমরা দেখেছ। তাতে আমাকে হিরা এবং কিসরার রাজপ্রাসাদ দেখানো হয়। তা যেন কুকুরের দন্তের ন্যায়। অতঃপর জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আমাকে সংবাদ দেন, আমার উম্মত কর্তৃক তা বিজিত হবে। অতঃপর দ্বিতীয়বার ওই পাথরে আঘাত করলে তা থেকে আলো চমকে ওঠে এবং তাতে আমি রোমের রাজপ্রাসাদ দেখতে পাই, যেন তা কুকুরের দন্তের ন্যায়। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম সংবাদ দিলেন, আমার উম্মতের হাতে এটিও বিজিত হবে। অতঃপর তৃতীয়বার আঘাত করলে পাথর ভেঙে আলো চমকায় এবং সানআর রাজপ্রাসাদ ভেসে ওঠে, যেন তা কুকুরের দন্তের ন্যায়। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আমাকে জানালেন, আমার উম্মত এই সাম্রাজ্য জয় করবে। তোমরা আনন্দিত হও, মুসলমানদের বিজয় সমাগত।” তাতে মুসলমানগণ আনন্দিত হলেন এবং কৃতজ্ঞস্বরে বললেন, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যই। এটি সত্য প্রতিশ্রুতি যার কোনো ব্যতিক্রম হবে না।’[53] এর প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَلَمَّا رَأَى الْمُؤْمِنُونَ الْأَحْزَابَ قَالُوا هَذَا مَا وَعَدَنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَصَدَقَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَمَا زَادَهُمْ إِلَّا إِيمَانًا وَتَسْلِيمًا (২২)

‘মুমিনগণ যখন সম্মিলিত বাহিনীকে দেখল, তারা বলে উঠল, এটি তো তাই, আল্লাহ ও তার রাসুল আমাদের সঙ্গে যার ওয়াদা করেন। আল্লাহ এবং তার রাসুল সত্যই বলেছেন। আর তাতে তাদের ঈমান ও আনুগত্যই বৃদ্ধি পেল।’[54]

এটি দ্বারা আল্লাহ তায়ালা এই কথা প্রমাণ করে দিলেন, কোনো কাজই আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। আর মুনাফিকরা বলল, তোমরা কি আশ্চর্যান্বিত হচ্ছো যে, মুহাম্মাদ তোমাদের মিথ্যা সংবাদ ও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এবং বলছে, মদিনায় থেকেই তিনি হিরা ও কিসরার রাজপ্রসাদ প্রত্যক্ষ করছেন, আর তোমরা তা জয় করবে? অথচ তোমরা খন্দক খনন করছো এবং এটি থেকে বের হতে পারছো না।[55] এই সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অবতীর্ণ করলেন,

وَإِذْ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ مَا وَعَدَنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ إِلَّا غُرُورًا (১২)

‘আর স্মরণ করো মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ছিল ব্যাধি, তারা বলছিল, আল্লাহ এবং তার রাসুল আমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা প্রতারণা ব্যতীত কিছুই নয়।’।[56]

আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি উমর ও উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শাসনামলে উল্লিখিত সাম্রাজ্যগুলো বিজয় হলে বলতেন, ‘সেই আল্লাহর কসম, যার হাতে আবু হুরায়রার প্রাণ! তোমরা সেই সকল শহর বিজয় করেছ এবং কেয়ামত পর্যন্ত যা তোমরা বিজয় করবে, এ সকল কিছুর চাবি অনেক পূর্বেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেওয়া হয়েছে।’[57]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা ফাদাক, ফাদাকের দ্বিতীয় অভিযান – Expedition of Muhaysa ibn Massud (Fadak)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা ফাদাক, ফাদাকের প্রথম অভিযান – Expedition of ʿAlī ibn Abī Ṭālib (Fadak)

আরো পড়ুন : সারিয়্যায়ে ওয়াদিউল কুরা (প্রথম) – Expedition of Zayd ibn Harithah (Wadi al-Qura)

ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, ‘অনেক কষ্ট ও পরিশ্রমের পর মুসলমানগণ পরিখা খনন শেষ করলেন। জুআইল নামক একজন মুসলিমকে নিয়ে এই দিন তারা সমবেত কণ্ঠে রণোদ্দীপক কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুআইলের নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন আমর। তাকে কেন্দ্র করে আবৃত্তিকৃত কবিতাটি ছিল নিম্নরূপ,

سَمَّاهُ مِنْ بَعْدِ جُعَيْلٍ عَمْرًا … وَكَانَ لِلْبَائِسِ يَوْمًا ظَهْرَا

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুআইলের নাম পরিবর্তন করে রাখেন আমর, সেদিন তিনি দুর্বলদের জন্য শক্তিতে পরিণত হন।’ যখন সাহাবিগণ আমরান’ বলতেন তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও তাদের সঙ্গে ‘আমরান’ বলতেন। আর যখন তারা ‘যাহরান’ বলতেন, তখন তিনিও ‘যাহরান’ বলতেন।[58]

যুদ্ধের পূর্বাবস্থা

 

কাফের বাহিনী মদিনায় পৌঁছার পূর্বে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী ও শিশুদের সুরক্ষিত ও নিরাপদ একটি দুর্গে রাখেন। এ সময় আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মদিনার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক নিযুক্ত করেন। বিশ্বাসঘাতক ইহুদিদের উপর মুসলমানগণ ইতিমধ্যে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। বনু কায়নুকা ও বনু নাজিরকে দেশান্তরিত করা হয়েছিল বটে, কিন্তু বনু কুরাইজা তখনো মদিনায় অবস্থান করছিল। ইতিপূর্বে একাধিকবার তারা সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করে বিশ্বাসঘাতকতার চেষ্টা করেছে। এবারও সুযোগ পেলে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, এই সন্দেহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনে উদ্রেক হচ্ছিল। আবার অন্যান্য গোত্রের মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন না। সুতরাং এটির প্রতিরোধকল্পে এবং নারী ও শিশুদের রক্ষার্থে জায়েদ ইবনে হারিসা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্বে তিনশত এবং মাসলামা ইবনে আসলামের নেতৃত্বে দুইশত সৈন্য নিযুক্ত করলেন।[59]

শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ

নারী ও শিশুদের রক্ষার্থে তিন হাজার মুসলিম সৈন্যের বাকি আড়াই হাজার সৈন্য নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালা পাহাড়কে পশ্চাতে এবং পরিখাকে সামনে রেখে শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধকল্পে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করলেন। মুসলমানদের সাংকেতিক চিহ্ন (কোড) ছিল ‘হামিম! তাদেরকে সাহায্য করা হবে না।’ অপরদিকে কাফের বাহিনী মদিনার উপকণ্ঠে এসে উপনীত হলো। কিনানা গোত্র এবং তিহামাবাসীদের সমন্বয়ে কুরাইশগণ জুরফ ও যিআবার মধ্যবর্তী উপত্যকা রুমাহ-এ অবতরণ করল। বনু গাতফান নাজদিদের নিয়ে উহুদ প্রান্তরের পাদদেশে তাবু স্থাপন করল। শত্রুবাহিনীর ১০ হাজার সুসজ্জিত সৈন্য মহা পরাক্রমে মদিনার দিকে অগ্রসর হতে লাগল।[60]

তাদের সাথে ছিল সাড়ে চার হাজার উট এবং তিনশত ঘোড়া।[61] অপরপক্ষে আল্লাহ ও তদীয় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দৃঢ় প্রত্যয়ী আড়াই হাজার সৈন্যের মুসলিম বাহিনী ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে শত্রুদের মোকাবেলায় পাহাড়ের ন্যায় দণ্ডায়মান হলেন। কিন্তু কিছু দুর্বল ঈমানদার ও কপট মুনাফিক বিশাল কুরাইশ বাহিনীর ভয়ে শঙ্কিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাবার বাহানা তালাশ করতে লাগল। ভীত-বিহ্বল হৃদয়ে তারা যেন মৃত্যুর বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করতে লাগল। তাদের এই অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

إِذْ جَاءُوكُمْ مِنْ فَوْقِكُمْ وَمِنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَإِذْ زَاغَتِ الْأَبْصَارُ وَبَلَغَتِ الْقُلُوبُ الْحَنَاجِرَ وَتَظُنُّونَ بِاللَّهِ الظُّنُونَا (১০) هُنَالِكَ ابْتُلِيَ الْمُؤْمِنُونَ وَزُلْزِلُوا زِلْزَالًا شَدِيدًا (১১) وَإِذْ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ مَا وَعَدَنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ إِلَّا غُرُورًا (১২) وَإِذْ قَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ يَاأَهْلَ يَثْرِبَ لَا مُقَامَ لَكُمْ فَارْجِعُوا وَيَسْتَأْذِن فَرِيقٌ مِنْهُمُ النَّبِيَّ يَقُولُونَ إِنَّ بُيُوتَنَا عَوْرَةٌ وَمَا هِيَ بِعَوْرَةٍ إِنْ يُرِيدُونَ إِلَّا فِرَارًا (১৩)

‘যখন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সমাগত হয়েছিল উচ্চ অঞ্চল ও নিম্ন অঞ্চল থেকে, তোমাদের চক্ষু বিস্ফোরিত হয়েছিল, তোমাদের প্রাণ হয়ে পড়েছিল ওষ্ঠাগত এবং তোমরা আল্লাহ সম্বন্ধে নানাবিধ ধারণা পোষণ করছিলে। তখন মুমিনগণ পরীক্ষিত হয়েছিল এবং তারা ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল। আর স্মরণ করো, মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ছিল ব্যাধি, তারা বলছিল, আল্লাহ এবং তার রাসুল আমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা প্রতারণা ব্যতীত কিছুই নয়। আর তাদের একদল বলেছিল, হে ইয়াসরিববাসী! এখানে তোমাদের কোনো স্থান নেই, তোমরা ফিরে চলো এবং তাদের মধ্যে একদল নবীর নিকট অব্যাহতি প্রার্থনা করে বলছিল, আমাদের বাড়ি-ঘর অরক্ষিত। অথচ ওগুলো অরক্ষিত ছিল না। আসলে পালানোই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।’[62]

অথচ যারা খাঁটি ঈমানদার ছিলেন, তারা মোটেও ভীত-সন্ত্রস্ত হননি। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَلَمَّا رَأَى الْمُؤْمِنُونَ الْأَحْزَابَ قَالُوا هَذَا مَا وَعَدَنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَصَدَقَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَمَا زَادَهُمْ إِلَّا إِيمَانًا وَتَسْلِيمًا (২২)

‘মুমিনগণ যখন সম্মিলিত বাহিনীকে দেখল তারা বলে উঠল, এটা তো তাই, আল্লাহ ও তার রাসুল যার প্রতিশ্রুতি আমাদের দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তার রাসুল সত্যই বলেছিলেন। আর তাতে তাদের ঈমান ও আনুগত্যই বৃদ্ধি পেল।’[63]

বনু কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতা

এই সংকটময় মুহূর্তে মুসলমানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজাও বিশ্বাসঘাতকতা করে সম্মিলিত বাহিনীর সাথে হাত মেলায়। আল্লাহর দুশমন হুয়াই ইবনে আখতাবের উপর্যুপরি প্ররোচনায় বনু কুরাইজা সর্দার কাআব ইবনে আশরাফ চুক্তি ভঙ্গ করে কাফের বাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করল। মুসলমানদের নিকট কাআবের বিশ্বাসঘাতকতার সংবাদ পৌঁছালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আওস গোত্রের নেতা সাদ ইবনে মুআজ, খাযরাজ গোত্রের নেতা সাদ ইবনে উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু, যিনি বনু সাদ ইবনে কাআব ইবনে খাযরাজের লোক ছিলেন এবং তাদের সাথে হারেস ইবনে খারাজ গোত্রের আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাযিয়াল্লাহু আনহু ও আমর ইবনে আওফ গোত্রের খাওয়াত ইবনে জুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রেরণ করলেন। তিনি তাদের বললেন, ‘ঘটনা তদন্ত করে দেখো, যদি সত্য হয় তবে এমন এক সংকেতে তা আমাকে জানাবে, যা কেবল আমিই বুঝতে পারব। সাবধান! মানুষের মনোবল নষ্ট করবে না। আর সে যদি চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে, তাহলে সকলের সামনে প্রকাশ্যে এই সংবাদ বর্ণনা করবে।’ প্রতিনিধিদল সেখানে গিয়ে দেখলেন, যা শুনেছেন বাস্তব অবস্থা তার চেয়ে খারাপ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তারা নানারূপ কটূক্তি পর্যন্ত করছে। তারা অবজ্ঞাভরে বলে, ‘রাসুল আবার কে? মুহাম্মাদের সাথে আমাদের কোনো চুক্তি বা অঙ্গীকার হয়নি।’[64] বিশ্বাসঘাতক বনু কুরাইজা সদলবলে শত্রুবাহিনীতে যোগ দিল।[65] জায়েদ ও মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অধীনস্থ বাহিনীদ্বয়ের তৎপরতার দরুন নারী ও শিশুদের দুর্গ আক্রমণ করা কিংবা অন্য কোনো প্রকার গোলযোগ সৃষ্টি করা তাদের জন্য সম্ভবপর হলো না। সুতরাং তারা শত্রুদলের সাথে সক্রিয় অংশগ্রহণ করল।

একযোগে আক্ৰমণ

শত্রু বাহিনী তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে সুপরিকল্পিতভাবে একযোগে মদিনার তিন দিক দিয়ে প্রবল বেগে আক্ৰমণ করল। কিন্তু শহরের নিকটবর্তী হলে মুসলিম সৈন্যবাহিনীর খননকৃত পরিখা তাদের অগ্রযাত্রা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করল। শত্রুবাহিনী এই অভিনব কৌশলের সাথে পূর্ব থেকে পরিচিত ছিল না বিধায় এটি দেখে তারা বিস্মিত হলো। তাদের ঔদ্ধত্য ও তর্জন-গর্জন নিমিষের মধ্যে স্তিমিত হয়ে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তারা সেখানেই তাঁবু স্থাপন করল এবং মুসলমানদের লক্ষ্য করে তির ও প্রস্তর বর্ষণ করতে লাগল। কিন্তু কোনো আশাপ্রদ ফলোদয় হলো না। মুসলমানগণও পরিখার অপর পারে থেকে তাদের এই বিচ্ছিন্ন আক্রমণ প্রতিহত করতে লাগলেন।[66] মুশরিক বাহিনী প্রায় এক মাস মদিনা অবরোধ করে রাখে। তারা কোনো দুর্বল ও সংকীর্ণ স্থানের অনুসন্ধান করতে থাকে, যে স্থান দিয়ে খন্দক অতিক্রম করা যায়। কিন্তু মুসলিম বাহিনী তাদের গতিবিধির উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন শত্রু বাহিনী যেন কোনোক্রমেই খন্দক অতিক্রম করতে কিংবা তার অংশবিশেষ ভরাট করে রাস্তা তৈরি করতে না পারে। সেজন্য মাঝেমধ্যে তারা শত্রুদের প্রতি তির নিক্ষেপ করছেন। এ দিকে বিশাল শত্রুবাহিনীর রসদ-সম্ভারও দিনে দিনে শেষ হয়ে আসতে লাগল। তখন কুরাইশ ও সম্মিলিত বাহিনী খন্দক অতিক্রম করে মদিনা আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।[67]

প্রথমে দিরার ইবনে আল-খাত্তাব, হয়রা ইবনে ওয়াহ্, ইকরিমা ইবনে আবি জাহল, আমর ইবনে আবদে উদ্দ প্রমুখ যোদ্ধা খন্দক অতিক্রম করার চেষ্টা করে। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে তারা পরিখা অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়।[68]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা গালিব ইবনে আবদুল্লাহ, ফাদাকের চতুর্থ অভিযান – Expedition of Ghalib ibn Abdullah al-Laithi (Fadak)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা তারাফ – Expedition of Zayd ibn Harithah (At-taraf)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা ফাদাক, ফাদাকের তৃতীয় অভিযান – Expedition of Bashir Ibn Sa’d al-Ansari (Fadak)

দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় নওফাল ইবনে আবদিল্লাহ আল-মাখজুমি, ইকরিমা ইবনে আবি জাহল, আমর ইবনে আবদে উদ্দ প্রমুখ সেনার একটি অশ্বারোহী দল পরিখার একটি অপ্রশস্ত অংশে এসে তীব্রবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। ঘোড়াগুলো পার হয়ে পরিখা ও সাল পর্বতের মধ্যখানে একটি জলাভূমিতে এসে পড়ে। আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু কয়েকজন সৈন্যসহ পরিখার যে অংশ দিয়ে তারা প্রবেশ করেছিল, সেখানে অবস্থান নেন এবং তাদের পথ বন্ধ করে দাঁড়ান।[69]

মল্লযুদ্ধের আহ্বান

আমর ইবনে আবদে উদ্দ বদরযুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল বিধায় উহুদ যুদ্ধে সে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। খন্দকের যুদ্ধে সে তার বিশেষ মর্যাদা প্রদর্শনের জন্য একটি চিহ্ন ধারণ করে এসেছিল। সে তার ঘোড়াসহ মুসলিম সৈন্যদের মুখোমুখি হয়ে প্রতিপক্ষের যেকোনো একজনকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান জানাল।[70] আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু আমর-এর ডাকে সাড়া দিয়ে বললেন, ‘হে আমর! তুমি না প্রতিজ্ঞা করেছিলে কুরাইশদের কোনো ব্যক্তি তোমার সামনে দুটি বিকল্প প্রস্তাব করলে তুমি তার একটি অবশ্যই পূরণ করবে?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ, করেছিলাম।’ আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘তাহলে আমি তোমাকে আল্লাহ ও তদীয় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ইসলামের প্রতি আহ্বান করছি।’ সে উত্তরে বলল, ‘তা আমার আর প্রয়োজন নেই।’ তখন আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘তবে আমি তোমাকে সম্মুখ যুদ্ধে আহ্বান করছি।’ সে বলল, ‘হে ভ্রাতুষ্পুত্র! আমি তোমাকে হত্যা করতে আগ্রহী নই।’ আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘কিন্তু আল্লাহর শপথ! আমি তোমাকে হত্যা করতে চাই।’ এটি শুনে আমর ক্রোধান্বিত হয়ে উঠল। রাগে উত্তেজিত হয়ে সে আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দিকে এগিয়ে এলো। ফলে উভয়ের মধ্যে মল্লযুদ্ধের সূত্রপাত হলো। পালাক্রমে একে অপরকে আঘাত করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত আরবের কথিত বীরশ্রেষ্ঠ, যাকে এক হাজার সেনার সমকক্ষ বলা হতো, সেই আমর ইবনে আবদে উদ্দকে আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু হত্যা করেন। পরাজয়ের গ্লানিতে তাদের অশ্বারোহী দল পালিয়ে আত্মরক্ষা করল।[71] আমর নিহত হওয়ার পর ইকরিমা ইবনে আবি জাহল স্বীয় বর্শা রেখে পালিয়ে যায়।[72] তার সম্পর্কেই হাসসান ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু নিম্নের কবিতাটি আবৃত্তি করেন,

فَرَّ وَأَلْقَى لَنَا رُمْحَهُ … لَعَلَّكَ عِكْرِمَ لَمْ تَفْعَلِ

وَوَلَّيْتَ تَعْدُو كَعَدْوِ الظَّلِي … مِ مَا أَنْ تَحُورَ عَنِ الْمَعْدِلِ

وَلَمْ تُلْقِ ظَهْرَكَ مُسْتَأْنِسًا … كَأَنَّ قَفَاكَ قَفَا فُرْعُلِ

‘সে প্রাণ নিয়ে পালাল, আর আমাদের জন্য রেখে গেল স্বীয় বর্শাটিও। হে ইকরিমা! এমন কাজ হয়তো তুমি আর কখনো করোনি। তুমি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলে উটপাখির মতো। তুমি সাহস করে একবারও পেছনে তাকালে না। তোমার ঘোড়া যেন হায়েনার ঘাড়ের সদৃশ।’[73]

আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রবল রণোদ্দীপনা এবং বিশেষত তরবারি জুলফিকারের চাকচিক্য দেখে আমরের সহযোগী অশ্বারোহী দল পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে লাগল। কিন্তু পলায়নোদ্যত নাওফাল পরিখা অতিক্রম করতে গিয়ে ঘাড় মুচড়ে পরিখার ভেতরে পতিত হলো। সাহাবিগণ শর ও লোষ্ট্র নিক্ষেপ করতে লাগলেন। নাওফাল চিৎকার করে বলল, ‘তোমরা আমাকে কুকুরের মতো মেরো না, আমি তোমাদের নিকট সম্মানজনক মৃত্যু প্রত্যাশা করছি।’ আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু তার শেষ বাসনা পূর্ণ করতে সম্মত হলেন এবং পরিখার ভেতরে অবতরণ করে তরবারির আঘাতে তাকে নিঃশেষ করে দিলেন।[74]

অপর বর্ণনামতে নাওফাল অশ্বে আরোহণপূর্বক খন্দক অতিক্রম করার চেষ্টা করলে ঘোড়া তাকে নিয়ে খন্দকে পড়ে যায়। ফলে তার ঘাড় ভেঙে যায় এবং সে সেখানেই নিহত হয়। মুশরিকরা দশ হাজার দিরহামের বিনিময়ে তার লাশ তাদের নিকট ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন জানালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘নাওফাল অপবিত্র (মুশরিক), তার বিনিময়ও অপবিত্র। এই রক্তপণের কোনো প্রয়োজন নেই।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনোরূপ বিনিময় ছাড়াই নাওফালের লাশ তাদের ফেরত দিলেন।[75] মল্লযুদ্ধে কাফেরদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় দেখে তারা সমবেতভাবে প্রচণ্ড আক্রমণ করল এবং বৃষ্টির মতো তির বর্ষণ করতে লাগল। সারাদিন অবিশ্রান্ত যুদ্ধ চলল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবিগণ এক মুহূর্তের জন্যও যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করতে পারেননি বিধায় চার ওয়াক্ত (জোহর, আসর, মাগরিব ও ইশা) নামাজ কাজা হয়েছিল।[76]

চার ওয়াক্ত কাজা নামাজ আদায়

জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। খন্দকের যুদ্ধের দিনে উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু আগমন করেন এবং কাফেরদের সম্পর্কে গালমন্দ করার পর আরজ করেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! অদ্য সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বে আমি নামাজ আদায় করতে সক্ষম হইনি।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমিও নামাজ আদায় করতে পারিনি।’ অতঃপর আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বুহান নামক স্থানে অবতরণ করি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে ওজু করেন। আমরাও ওজু করি। অতঃপর তিনি আসরের নামাজ আদায় করেন। এটি ছিল সূর্য অস্তমিত হওয়ার পরের ঘটনা। এরপর মাগরিবের নামাজ আদায় করা হয়।[77]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. – Expedition of Abu Ubaidah ibn al Jarrah

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু বকর সিদ্দিক রা. – Expedition of Abu Bakr As-Siddiq

আরো পড়ুন : সারিয়্যা গালিব ইবনে আবদুল্লাহ আল-লাইসি (মায়ফাহ) – Expedition of Ghalib ibn Abdullah al-Laithi (Mayfah)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ আদায় করতে না পারার কারণে এতই মর্মাহত হয়েছিলেন, মুশরিকদের বিরুদ্ধে তিনি বদদোয়া করেছিলেন। মুসনাদে আহমাদের বর্ণনামতে, মুশরিকগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জোহর, আসর, মাগরিব ও ইশার নামাজ আদায় করা থেকে বিরত রেখেছিল। ফলে একত্রে তিনি এ সকল নামাজের কাজা আদায় করেন। মুশরিকদের পক্ষ থেকে খন্দক অতিক্রম করার প্রচেষ্টা এবং মুসলমানদের পক্ষ থেকে অব্যাহত প্রতিরোধ কয়েকদিন পর্যন্ত ধারাবাহিক ছিল। কিন্তু যেহেতু দুই দলের মধ্যে প্রত্যক্ষ সমরে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে খন্দক ছিল বিরাট প্রতিবন্ধক, এজন্য সামনাসামনি সংগ্রামের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি; বরং যুদ্ধের গতিধারা বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ব্যতীত তির ও বর্শা নিক্ষেপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অবশ্য তির নিক্ষেপের ফলে উভয় পক্ষেরই কয়েকজনকে প্রাণ হারাতে হয়, কিন্তু তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। মুসলমানদের পক্ষে ছয়জন শহিদ হন এবং মুশরিকদের পক্ষে দশজন নিহত হয়। এটির মধ্যে এক কিংবা দুইজন তরবারির আঘাতে নিহত হয়েছিল।[78]

মুসলমান ও মুশরিকদের মধ্যে তীব্র গতিতে তির নিক্ষেপের একপর্যায়ে সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহুর মধ্যবর্তী মূল শিরায় তিরবিদ্ধ হয় এবং রক্ত প্রবাহিত হয়। হিব্বান ইবনে আরিকা নামক জনৈক কুরাইশির তিরের আঘাতে তিনি আহত হন। অতঃপর তিনি প্রার্থনা করেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি নিশ্চয় অবগত আছো, যে সম্প্রদায় তোমার রাসুলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, স্বীয় জন্মভূমি থেকে বহিষ্কৃত করেছে, তাদের সাথে যুদ্ধ করার বিষয়টি আমার নিকট যতটা প্রিয়, অন্য কোনো যুদ্ধ ততটা প্রিয় নয়। হে আল্লাহ! আমার বিশ্বাস, তাদের সাথে আমাদের যুদ্ধকে শেষ পর্যায়ে উপনীত করেছো। কিন্তু যুদ্ধের বিষয়ে এখনও যদি কোনো কিছু অবশিষ্ট থাকে, তা হলে আমাকে তাদের জন্য জীবিত রেখো—যাতে আমি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারি। আর যদি তুমি যুদ্ধ শেষ করে দিয়ে থাকো, তা হলে এই আঘাতকে বাকি রেখে এটিকে আমার মৃত্যুর কারণ করে দাও।’[79] তার দোয়ার শেষের অংশটুকু এই ছিল, ‘কিন্তু সেই পর্যন্ত আমার মৃত্যু দিয়ো না, যে পর্যন্ত না বনু কুরাইজার ব্যাপারে আমার চক্ষু পরিতৃপ্তি করে নিই।’[80] আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া কবুল করেছিলেন। খন্দকের যুদ্ধের শেষে বনু কুরাইজার শাস্তিপ্রাপ্তির পর তার ইনতেকাল হয়।[81]

শত্রুবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য মুসলমানগণ পরিখার পার্শ্বে দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। সমগ্র মদিনা প্রায় জনমানব শূন্য ছিল। বনু কুরাইজার মহল্লা সংলগ্ন দুর্গে মুসলিম শিশু ও নারীদের নিরাপদ প্রহরায় রাখা হয়েছিল। ইহুদিরা এই সুযোগে দুর্গ আক্রমণের পরিকল্পনা করল। তারা আক্রমণোদ্যত হয়ে দুর্গের দিকে অগ্রসর হলো। এ সময় কবি হাসসান ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু ব্যতীত আর কোনো পুরুষ সেখানে ছিল না। জনৈক ইহুদি দুর্গ আক্রমণের পূর্ব অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও সুযোগ সন্ধানের জন্য দুর্গের দ্বার পর্যন্ত এসে উপনীত হলো। সাফিয়্যা রাযিয়াল্লাহু আনহু এটি দেখে হাসসান রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বললেন, ‘আপনি অবতরণ করে শত্রুদের এই গুপ্তচরটিকে হত্যা করে ফেলুন।’ হাসসান রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হে আবদুল মুত্তালিব তনয়া! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আপনি তো জানেন, এটি আমার কাজ নয়।’ তার এই উত্তর শুনে সাফিয়্যা রাযিয়াল্লাহু আনহু বুঝতে পারলেন তাকে দিয়ে কিছু হবে না। তখন তিনি নিচে নেমে এলেন এবং তাঁবুর একটি খুঁটি উঠিয়ে ইহুদির মাথায় এত জোরে আঘাত করলেন যে, তার মাথা ফেটে গেল। তিনি উপরে উঠে হাসসান রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বললেন, ‘ইহুদির মস্তক কর্তন করে দুর্গের উপর থেকে শত্রুবাহিনীর সম্মুখে নিক্ষেপ করুন।’ হাসসান রাযিয়াল্লাহু আনহু এতেও অপারগতা প্রকাশ করলে বীরাঙ্গনা সাফিয়্যা রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেই এই কাজ সমাধা করলেন। গুপ্তচরের কর্তিত মস্তক দেখে ইহুদিদের ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। তারা ভাবল, দুর্গের অভ্যন্তরে মনে হয় অনেক সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। সুতরাং তারা ভীত হয়ে দুর্গ আক্রমণ না করে প্রাণভয়ে পালিয়ে গেল।[82]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা শুজা ইবনে ওয়াহব আল-আসাদি – Expedition of Shuja ibn Wahb al-Asadi

আরো পড়ুন : সারিয়্যা সাঈদ ইবনে জায়েদ আল-আশহালি Raid of Sa’d ibn Zaid al-Ashhali

আরো পড়ুন : সারিয়্যা হিসমি – Expedition of Zayd ibn Harithah (Hisma)

এই যুদ্ধে রুফায়দা রাযিয়াল্লাহু আনহু নামের একজন সম্মানিতা নারী সাহাবিও অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার নিকট প্রাথমিক চিকিৎসার ঔষধপত্র ছিল। তিনি আহত ব্যক্তিদের প্রাথমিক চিকিৎসা করতেন। সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু আহত হলে তারও তিনি চিকিৎসা করেন।[83]

যুদ্ধ হলো কূটকৌশলের খেলা

যুদ্ধের এই পরিস্থিতিতে এমন এক কূটনৈতিক পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল, যার মাধ্যমে শত্রুদের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করা যায় এবং তাদের পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়। এই প্রেক্ষাপটে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গাতফান গোত্রের দুই নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব উয়ায়না ইবনে হিসন এবং হারেস ইবনে আওফের সঙ্গে মদিনায় উৎপাদিত খেজুর এক-তৃতীয়াংশ দেওয়ার শর্তে এমন একটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদনের ইচ্ছা করলেন, যার ফলে এই নেতৃদ্বয় নিজ নিজ গোত্রের লোকজন নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করতে পারে এবং এই অবস্থায় মুসলমানগণ বিচ্ছিন্ন কুরাইশ বাহিনীকে সহজেই পর্যুদস্ত করতে পারেন।

উক্ত কূটনৈতিক কৌশল সম্পর্কে সাহাবিগণের সঙ্গে পরামর্শের একপর্যায়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং সাদ ইবনে উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে আলোচনা করেন, তখন তারা উভয়ে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এই নির্দেশ লাভ করে থাকেন, তবে বিনা বাক্যে তা স্বীকৃত হবে। আর যদি আপনি আমাদের জন্যই এটি করতে চান, তাহলে আমাদের এর কোনো প্রয়োজন নেই। যখন এই সকল লোকজন এবং আমরা মুশরিক প্রতিমা পূজারি ছিলাম, তখন এরা অতিথিসেবা ও ক্রয়-বিক্রয় ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে আমাদের একটি শস্যকণারও লোভ করতে পারেনি। আর এখন আল্লাহ তায়ালা আমাদের সত্য দীনের নুর দ্বারা আলোকিত করেছেন এবং আপনার মাধ্যমে সম্মান দান করেছেন। আমরা কখনো তাদের নিজ সম্পদের ভাগ দেব না। আল্লাহর শপথ! আমরা তাদের শুধু তরবারির আঘাতই করব, অন্য কিছু দিতে আমরা প্রস্তুত নই।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মতামতের অনুকূলেই রায় প্রদান করলেন এবং বললেন, ‘সমগ্র আরব তোমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছে বলে শুধু তোমাদের কারণেই আমি এই রূপ করতে মনস্থ করেছিলাম।’[84]

আল্লাহ তায়ালা সর্বাবস্থায় মুসলমানদের হেফাজতকারী। তিনি এমন ব্যবস্থা করলেন যে, শত্রুদের নিজেদের মধ্যেই বিভেদ ও বিচ্ছেদ সৃষ্টি হয়ে গেল। ফলে তাদের মনোবল ভেঙে পড়ল, প্রখরতা স্তিমিত হয়ে পড়ল। মুসা ইবনে উবার বর্ণনামতে তিন সপ্তাহের অধিক সময় অবরোধের পরও যখন আশাপ্রদ কোনো ফল হলো না, রসদপত্রও শেষ হওয়ার পথে; আবু সুফিয়ান ও তার সৈন্যদল চিন্তিত এবং ভগ্নোৎসাহ হয়ে পড়ল। বনু কুরাইজা উপায়ান্তর না দেখে নতুনভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সন্ধি স্থাপনের পরিকল্পনা করল। ঠিক এই সময় আয়ম ইবনে মাউদ আজাঈ নামক একজন গাতফানি, যিনি পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তখনো তার ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি জানাজানি হয়নি, গোপনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। কিন্তু আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা তা জানে না। সুতরাং আপনি আমায় আদেশ করুন দীনের জন্য আমি কী উপকার করতে পারি।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘ব্যক্তি হিসেবে যেহেতু তুমি একা, সেহেতু কোনো সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা তোমার পক্ষে অসম্ভব। তবে তাদের ঐক্যে ফাটল ধরানো, তাদের বিচ্ছিন্ন করা এবং মনোবল ক্ষীণ ও দুর্বল করে দেওয়ার মতো কোনো কৌশল তুমি অবলম্বন করতে পারো। কারণ শত্রুবাহিনী বিধ্বস্ত করার ব্যাপারে এসব কূটকৌশল অত্যন্ত মূল্যবান। যুদ্ধ অর্থ হচ্ছে কূটকৌশলের খেলা। পরামর্শ মোতাবেক নুআইম কূটকৌশল অবলম্বন করে ফাটল সৃষ্টির লক্ষে প্রথমে বনু কুরাইজার দিকে গমন করলেন।’[85]

ইবনে হিশাম-এর বর্ণনামতে তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নুআইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি পারো শত্রুদের পরস্পরের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দাও। কেননা কূটকৌশলও যুদ্ধের অংশ।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরামর্শ মোতাবেক নুআইম রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রথমে বনু কুরাইজার নিকট গমন করলেন। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তাদের সাথে তার বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতা ছিল। তারা বলল, ‘তুমি সত্যবাদী, তোমার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই।’ তিনি বললেন, ‘কুরাইশ, গাতফান এবং তোমাদের অবস্থান একপর্যায়ের নয়। এটি তোমাদের আবাসভূমি, এখানেই তোমাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ও অবলা নারীরা রয়েছে। তোমরা তাদের অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে পারবে না। কুরাইশ ও গাতফানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়তে এসেছে। তোমরা তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছ। তাদের ধন-সম্পত্তি, আত্মীয়-পরিজন এখানে নেই। কাজেই তাদের অবস্থা তোমাদের মতো নয়। তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। পক্ষান্তরে অবস্থা প্রতিকূল হলে তোমাদের শত্রুর কাছে রেখে তারা কেটে পড়বে। সুতরাং তাদের কতিপয় নেতৃস্থানীয় লোককে তোমাদের নিকট বন্ধক না রাখা পর্যন্ত তোমরা তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করবে না। তারা এই পরামর্শকে উত্তম বলে গ্রহণ করল।’

অতঃপর তিনি কুরাইশদের সাথে সাক্ষাৎ করে একই কায়দায় আবু সুফিয়ান ও অন্যান্য কুরাইশ নেতৃবর্গকে বললেন, ‘আপনাদের সাথে আমার মিত্রতা এবং আন্তরিকতার কথা তো আপনারা জানেন।’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ।’ নুআইম বললেন, ‘ইতিমধ্যে আমার নিকট একটি সংবাদ পৌঁছেছে, যা একজন শুভানুধ্যায়ী হিসেবে আপনাদের অবহিত করা সমীচীন বলে মনে করছি। তবে আমার কথা আপনাদের গোপন রাখতে হবে।’ তারা তাতে সম্মত হলে তিনি বললেন, ‘আপনারা হয়তো জানেন না, বনু কুরাইজা মুহাম্মাদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করে এখন অনুতপ্ত। তারা লোক মারফত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবহিত করেছে, এটির প্রতিবিধানস্বরূপ এখন আমরা সুকৌশলে কুরাইশ ও গাতফানদের পদস্থ নেতৃবৃন্দ ধরে যদি আপনার হাতে সমর্পণ করি, তবে আপনি কি খুশি হবেন? আপনি তাদের ইচ্ছামত হত্যা করতে পারবেন। অতঃপর আমরা যৌথ আক্রমণ চালিয়ে তাদের অবশিষ্টদের মূলোৎপাটন করব। মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের এই প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। কাজেই ইহুদিরা আপনাদের শীর্ষস্থানীয় কতিপয় ব্যক্তিবর্গকে জিম্মিস্বরূপ রাখার জন্য লোক পাঠাতে পারে। সাবধান! আপনারা একটি লোককেও তাদের হাতে অর্পণ করবেন না।’

অতঃপর তিনি গাতফান গোত্রের কাছে গিয়ে বললেন, ‘তোমরা আমার জ্ঞাতিগোষ্ঠী এবং কাছের লোক। আমার প্রতি তোমাদের সন্দেহ আছে বলে বিশ্বাস করি না।’ তারা বলল, ‘সত্য বলেছো। তুমি আমাদের কাছে অতি বিশ্বাসী।’ তিনি বললেন, ‘তোমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বলছি, তবে আমার কথা গোপন রাখবে। অতঃপর তিনি কুরাইশদের যা বলেছিলেন, তাদেরও অনুরূপ কথা বললেন এবং সাবধান করে দিলেন।’[86]

পঞ্চম হিজরির শাওয়াল মাসের এক শনিবার রাতে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও মহিমা প্রকাশ পায়, আবু সুফিয়ান ও গাতফান গোত্রের নেতৃবন্দু বনু কুরাইজার নিকট ইকরিমা ইবনে আবি জাহলকে কুরাইশ ও গাতফানের কতিপয় প্রতিনিধিসহ প্রেরণ করেন। তারা বনু কুরাইজাকে বলল, ‘আমরা তো এখানকার বাসিন্দা নই। আমাদের রসদ সম্ভার ও আরোহণের জীবজন্তু ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আর বিলম্ব না করে চলো মুহাম্মাদের সাথে চূড়ান্ত ফয়সালা অর্থাৎ তাকে শেষ করে ফেলি।’ ইহুদিরা বলল, ‘অদ্য শনিবার; এ দিন আমরা কোনো কিছু করি না। আমাদের পূর্বসূরিগণ এই দিনের অশ্রদ্ধা করে শাস্তি ভোগ করেছিল। তা ছাড়া মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করব না, যতক্ষণ না তোমাদের কতিপয় লোককে আমাদের নিকট জিম্মি রাখবে। মুসলমানদের সমূলে উৎখাত না করা পর্যন্ত তারা আমাদের হাতে বন্দি থাকবে। কারণ যুদ্ধ প্রচণ্ড আকার ধারণ করলে এবং তোমাদের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়লে তোমরা আমাদের শত্রুর কবলে রেখে স্বদেশে চলে যাবে বলে আমরা শঙ্কিত। অথচ মুসলমানদের সাথে লড়ার শক্তি ও জনবল আমাদের নেই।’

আরো পড়ুন : সারিয়্যা বাশির ইবনে সাদ আনসারি – Expedition of Bashir Ibn Sa’d al-Ansari

আরো পড়ুন : সারিয়্যা বাশির ইবনে সাদ আল-আনসারি – Expedition of Bashir Ibn Sa’d al-Ansari (Fadak)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা যুল-কাস্‌সা – Expedition of Muhammad ibn Maslamah

প্রতিনিধিবর্গ বনু কুরাইজার এই বার্তা নিয়ে কুরাইশ ও বনু গাতফানের নিকট ফিরে গেল। সংবাদ শুনে তারা বলল, ‘আল্লাহর শপথ! নুআইম ইবনে মাসউদের কথা সত্যে পরিণত হয়েছে। তারা বনু কুরাইজার নিকট এই বলে বার্তা পাঠাল, আমরা আমাদের একটা লোকও তোমাদের হাতে সমর্পণ করব না। তোমাদের ইচ্ছা হলে যুদ্ধ করতে পারো।’ এই সংবাদ শুনে বনু কুরাইজা ভাবল, ‘নুআইম যা বলেছিল সবই সত্য। যুদ্ধ করতে তারা এসেছে বটে, তবে যুদ্ধে সুবিধা করতে অক্ষম হলে তারা চলে যাবে এবং আমাদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে।’ সুতরাং তারা কুরাইশ ও গাতফান গোত্রকে জানিয়ে দিল, ‘আমাদের নিকট তোমাদের কিছু লোক জিম্মি না রাখলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আমরা তোমাদের পক্ষ অবলম্বন করব না।’ এভাবে উভয় পক্ষের পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতার পথ রুদ্ধ হয়ে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভাঙন সৃষ্টি হলো এবং সম্মিলিত বাহিনীর মধ্যে ফাটল ধরল। ফলে তাদের সাহস ও মনোবল ভেঙে পড়ল।[87] এ সময় মুসলমানগণ আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করেছিলেন,

للَّهُمَّ اسْتُرْ عَوْرَاتِنَا وَآمِنْ رَوْعَاتِنَا.

‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের দোষত্রুটিগুলো ঢেকে রাখুন এবং আমাদের ভয়ভীতি ও বিপদাপদ থেকে নিরাপত্তা দান করুন।’[88]

অপরদিকে এই কঠিন ও নাযুক পরিস্থিতিতে রাসুলুলাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে বললেন,

اللَّهُمَّ مُنْزِلَ الْكِتَابِ سَرِيعَ الْحِسَابِ اللَّهُمَّ اهْزِمْ الْأَحْزَابَ اللَّهُمَّ اهْزِمْهُمْ وَزَلْزِلْهُمْ.

‘হে কুরআন নাজিলকারী, দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী আল্লাহ! তুমি শত্রু বাহিনীসমূহকে পরাজিত করো। হে আল্লাহ! তুমি তাদের পরাভূত করো এবং আতঙ্কিত করো।’।[89]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের দোয়া আল্লাহ কবুল করলেন। মুশরিকদের মধ্যে অনৈক্যের সৃষ্টি হলো এবং তারা দ্বিধাবিভক্ত হলো। অপরদিকে শীতের স্বচ্ছ আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা দিল। শুরু হলো প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়। মরু ঝটকা তাদের সমুদয় ছাউনি উড়িয়ে নিয়ে গেল। প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহে তারা কাবু হয়ে পড়ল। এমনিভাবে আল্লাহর সুস্পষ্ট শাস্তি তাদের উপর আপতিত হলো।[90] উপরন্তু আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতা পাঠিয়ে তাদের হৃদয়ে এরূপ ভীতির সঞ্চার করে দিলেন, তারা মনে করল, না জানি এই কঠিন বিপদের মুহূর্তে মুসলমানগণ এসে আমাদের আক্রমণ করে বসে। না জানি ইহুদিরা মুসলমানদের সাথে সম্মিলিত হয়ে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করে। এমনকি আবু সুফিয়ান ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বলতে লাগল, ‘হয়তো মুসলমানগণ গভীর আঁধারে আমাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আক্রমণ চালাতে পারে। কাজেই প্রত্যেকের নিকটস্থ লোকটি নিজ দলের কি না, তা নিশ্চিত হয়ে নাও এবং পরস্পর পরস্পরের হাত ধরে রাখো। এই সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা বলেন,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَاءَتْكُمْ جُنُودٌ فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا وَجُنُودًا لَمْ تَرَوْهَا وَكَانَ اللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرًا (৯)

‘হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো, যখন শত্রু বাহিনী তোমাদের বিরুদ্ধে সমাগত হয়েছিল এবং আমি তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলাম ঝঞ্ঝাবায়ু এবং এক বাহিনী, যা তোমরা দেখোনি।’[91]

(رِيحًا) বলতে প্রচণ্ড ঘূর্ণিবায়ু উদ্দেশ্য, যা মুহূর্তের মধ্যেই বিশাল সৈন্যবাহিনীর তাঁবুর খুঁটি ও রসদসম্ভার উড়িয়ে ফেলে দিয়েছিল। ফলে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। (وَجُنُودًا لَمْ تَرَوْهَا) বলতে এখানে মুসলমানদের সাহায্যকারী হিসেবে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ফেরেশতাদের বুঝানো হয়েছে, যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার।[92] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পারলেন আল্লাহর অপার রহমতে শত্রুবাহিনী হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তিনি হুজায়ফা ইবনুল ইয়ামান রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, ‘দেখে আসো, রাতে এরা কী করেছে। তুমি আবার ফিরে আসবে এবং আমার নিকট প্রত্যাবর্তনের পূর্বে কারো সাথে কোনো কথা বলবে না।’ এটিও বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য এই দোয়া করেন, ‘তিনি যেন জান্নাতে তার সাথি হন।’[93]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা জায়েদ ইবনে হারিসা (কারাদা অভিযান) – Expedition of Zayd ibn Haritha

আরো পড়ুন : সারিয়্যা জায়েদ বিন হারিসা (জামুম) – Expedition of Zayd ibn Harithah (Al-Jumum)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা দাহহাক ইবনে সুফিয়ান – Expedition of Dahhak al-Kilabi

হুজায়ফা রাযিয়াল্লাহু আনহু শত্রুবাহিনীর শিবিরের সন্নিকটে গিয়ে প্রত্যক্ষ করলেন, সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। শত্রুদের প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতিপর্ব প্রায় সম্পন্ন। হুজায়ফা রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে শত্রুদের ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পর্কে তাকে অবহিত করলেন।[94]

অন্য বর্ণনামতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের ডেকে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আছে যে গোপনে শত্রুবাহিনীর অবস্থা জেনে আমাকে অবহিত করতে পারে?’ এই কথাটি তিনি তিনবার বললেন। পরিশেষে জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু এই কঠিন কাজের জন্য সম্মত হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ‘হাওয়ারি’ তথা সাহায্যকারী উপাধি দান করলেন।[95] তিনি ফিরে এসে জানালেন, ‘অবরোধকারীগণ অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পলায়ন করার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।’ এই সংবাদ শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবিগণ অত্যন্ত খুশি হলেন।[96]

আবু সুফিয়ান এত শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, ‘সে সৈন্যদের পরিত্যাগ করে একাই অশ্বে আরোহণ করে মক্কার পথে রওনার প্রস্তুতি গ্রহণ করল। সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া তাকে ডেকে বললো, ‘অধীনস্থদের বিপদে রেখে নিজের প্রাণ রক্ষা করা কোনো নেতার জন্য শোভনীয় নয়। তাতে লজ্জিত হয়ে আবু সুফিয়ান অশ্ব থেকে অবতরণ করে প্রস্থানবাদ্য বাজানোর নির্দেশ দিল।’ অতঃপর খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে ডেকে বলল, ‘তুমি অশ্বারোহী সৈন্যদলকে নিয়ে পেছনে থাকো এবং পশ্চাৎ থেকে মুসলমানগণ যেন আমাদের আক্রমণ করতে না পারে, তার প্রতি নজর রাখো। সমস্ত বিক্ষিপ্ত রসদসম্ভার পরিত্যাগ করে ভীত-সন্ত্রস্ত ও দিশাহারা হয়ে সম্মিলিত এই বিশাল শত্রুবাহিনী রাতের অন্ধকারে মক্কার পথে পাড়ি জমাল।[97] প্রভাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যক্ষ করলেন, যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদের কোনো নামগন্ধও নেই, আছে শুধু তাদের সকরুণ স্মৃতি, ভগ্ন ও লণ্ডভণ্ড রসদ-সম্ভার, ছিন্নভিন্ন তাঁবু এবং নির্বাপিত উনুনের ভস্মস্তূপ। মুসলমানগণ এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখে অবাক হলেন। কোনো প্রকার সাফল্য ছাড়াই গভীর অসন্তোষ এবং ক্রোধসহ ইসলামের শত্রুদের আল্লাহ তায়ালা ফেরত পাঠিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য একাই যথেষ্ট হয়েছেন।[98] এই মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

وَرَدَّ اللَّهُ الَّذِينَ كَفَرُوا بِغَيْظِهِمْ لَمْ يَنَالُوا خَيْرًا وَكَفَى اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ الْقِتَالَ وَكَانَ اللَّهُ قَوِيًّا عَزِيزًا (২৫)

আল্লাহ কাফেরদের ক্রুদ্ধাবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন। তারা কোনো কল্যাণ লাভ করেনি। যুদ্ধে মুমিনদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’[99]

শত্রুসৈন্য প্রত্যাবর্তনের পর মুসলমানগণ এই বিশাল বিজয়ের জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করলেন এবং তারা মদিনায় ফিরে এলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিগণকে নিয়ে সকালে মদিনায় প্রত্যাবর্তনকালে এই দোয়া পড়তে লাগলেন,

لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ سَاجِدُونَ لِرَبِّنَا حَامِدُونَ، صَدَقَ اللهُ وَعْدَهُ، وَنَصَرَ عَبْدَهُ، وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ.

আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তার কোনো শরিক নেই, সার্বভৌম কর্তৃত্ব তার জন্যই এবং তার জন্যই সকল প্রশংসা। তিনি প্রত্যেক বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান। আমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী, ইবাদতকারী এবং আমাদের প্রশংসিত প্রভুর সিজদাকারী। আল্লাহ তার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেন তার বান্দাকে সাহায্য করেন এবং একাই সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন।’[100]

এই যুদ্ধে মুসলমানদের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে বিক্ষিপ্ত আক্রমণে শত্রুদের তির ও তলোয়ারের আঘাতে আওস গোত্রের দলপতি বিশিষ্ট সাহাবি সাদ ইবনে মুআজ রহ., আনাস ইবনে উয়াইস রাযিয়াল্লাহু আনহু, আবদুল্লাহ ইবনে সাহল রাযিয়াল্লাহু আনহু, তুফায়ল ইবনে নুমান রাযিয়াল্লাহু আনহু, সালা ইবনে গাম রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং কাআব ইবনে জায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু—এই ছয়জন সাহাবি শাহাদাত লাভ করেন। অপরদিকে শত্রুপক্ষের তিন, মতান্তরে আটজন নিহত হয়। এর মধ্যে এক বা দুইজন তরবারির আঘাতে নিহত হয়েছিল।[101]

অন্য বর্ণনামতে কুরাইশ বাহিনীর মধ্য থেকে নাওফাল ইবনে আবদিল্লাহ, আমর ইবনে আবদে উদ্ এবং মুনাব্বিহ ইবনে উবায়েদ এই তিনজন নিহত হয়।[102]

আহজাব বা খন্দকের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে এক যুগান্তকরী ঘটনা। এটি মূলত একটি স্নায়ুযুদ্ধ ছিল। এই যুদ্ধে বড় ধরনের কোনো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়নি। এর পরও ইসলামের ইতিহাসে এই যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম।

এই যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের ঈমানী তেজ আরও বেড়ে যায়। অপরপক্ষে কাফের-মুশরিকদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। সকলের সামনে এটি সুস্পষ্ট হয়ে যায়, আরবের কোনো শক্তির পক্ষেই মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে দমিয়ে রাখা অসম্ভব। কারণ আহজাব যুদ্ধের জন্য বিশাল বাহিনী সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর চেয়ে অধিক শক্তিশালী বাহিনী সংগ্রহ করা ওই সময়ে আরবদের পক্ষে আর সম্ভব ছিল না।

খন্দকের যুদ্ধকে বলা যেতে পারে সমগ্র আরবের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আঘাত। মূলত ওই সকল আঘাতের উদ্দেশ্য ছিল মদিনাকে বিধ্বস্ত করা এবং ইসলামের নামনিশানা পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দেওয়া। কিন্তু তারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হলো। তারা ইসলামের ক্রমবর্ধমান বিজয়কে কোনোক্রমেই প্রতিহত করতে পারল না। মদিনা শত্রুমুক্ত হলো এবং ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হলো। আর বিধ্বস্ত মুশরিক বাহিনী দুর্বল, অপদস্থ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। এই যুদ্ধ কাফেরদের জন্য মহাপরাজয়ের গ্লানি এবং মুসলমানদের জন্য মহা বিজয়ের বার্তা বহন করে আনল। এই অভিযানের পর থেকে মদিনার চতুষ্পার্শ্বে শত্রু বাহিনীর আনাগোনা বন্ধ হয়ে গেল। এই প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহজাব যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় বলেছিলেন,

الْآنَ نَغْزُوهُمْ وَلَا يَغْزُونَنَا نَحْنُ نَسِيرُ إِلَيْهِمْ.

‘এখন থেকে আমরাই তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করব। তারা আর কখনো অভিযান পরিচালনা করতে পারবে না। আমরা তাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকব।’[103]

পরবর্তী ইতিহাস তারই সাক্ষ্য বহন করে। এরপর কাফেররা মুসলমানদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো আক্রমণ পরিচালনা করতে পারেনি। এই যুদ্ধ ছিল এক মহা পরীক্ষা। তাতে মুসলমানদের ঈমান ও আনুগত্য বৃদ্ধি পায়। এই যুদ্ধে সম্মিলিত কুরাইশ বাহিনীর পরাজয় ও ব্যর্থতার মূলে একাধিক কারণ ছিল।

প্রথমত, পরিখার মাধ্যমে তারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই অভিনব কৌশল সম্পর্কে তার পূর্ব থেকে অবহিত ছিল না। কুরাইশদের ধারণা ছিল, উহুদের যুদ্ধের ন্যায় সংখ্যাধিক্যে তারা মুসলিম বাহিনীকে পর্যুদস্ত করবে।

দ্বিতীয়ত, বেদুঈন, কুরাইশ ও ইহুদিদের দ্বারা গঠিত ত্রি-শক্তির মধ্যে একপর্যায়ে ঐক্য ও বিশ্বাসের অভাব পরিলক্ষিত হলে আক্রমণ শিথিল হয়ে পড়ে। আবার আরব বেদুঈন গোত্র, বনু গাতফান ও ইহুদি সম্প্রদায় ও বনু কুরাইজার সঙ্গে আবু সুফিয়ানের মতানৈক্য হলে শত্রুশক্তি খর্ব হয়ে পড়ে।

তৃতীয়ত, মুসলমানদের সাহায্যকল্পে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা শৈত্যপ্রবাহ ও প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝার আঘাতে ত্রি-শক্তির তাঁবু ও খাদ্যসামগ্রী বিনষ্ট হয়ে যায়। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তাদের অশ্বরাজি, উট প্রভৃতি জীবজন্তু পালিয়ে যায় কিংবা মারা যায়। এহেন দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় সৈন্যদের মধ্যে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দিলে কুরাইশ বাহিনী অবরোধ প্রত্যাহার করে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়।

আরো পড়ুন : সারিয়্যা কুরজ ইবনে জাবির ফিহরি (সারিয়্যা উরায়না) – Expedition of Kurz bin Jabir Al-Fihri

আরো পড়ুন : সারিয়্যা খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রা. – Expedition of Khalid ibn al-Walid

আরো পড়ুন : সারিয়্যা গালিব ইবনে আবদুল্লাহ আল-লাইসি – Expedition of Ghalib ibn Abdullah al-Laithi (Al-Kadid)

চতুর্থত, উহুদের যুদ্ধের শিক্ষাকে (সর্বাবস্থায় নেতার আদেশ মান্য করা) কার্যকর করার জন্য মুসলিম বাহিনী এমন ইস্পাত-কঠিন শপথ গ্রহণ করে, তারা যে কোনো বিপদে ধৈর্য, ঐক্য ও শৃঙ্খলা হারাবে না। এটির ফলে দ্বিধাবিভক্ত ত্রি-শক্তির আক্রমণকে প্রতিহত করা মুসলমানদের পক্ষে সহজতর হয়। খন্দকের যুদ্ধে শত্রুপক্ষের সম্মিলিত বাহিনীতে ভাঙন সৃষ্টির ফলে মক্কাবাসীদের সম্পূর্ণ পরাজয় প্রতিভাত হয়ে ওঠে এবং এটি মদিনায় মুসলিম রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল সুদৃঢ় করে। দীন ইসলাম অল্প সময়ের ব্যবধানে সমগ্র আরব তথা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর উপর ভরসাকারী ও আত্মসমর্পণকারীদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, সকল বিপদে তিনিই তাদেরকে সাহায্য করে থাকেন, খন্দকের যুদ্ধে এই মহাসত্যটি আবারও প্রমাণিত হলো। যুগে যুগে এই সকল যুদ্ধের ইতিহাস মুসলমানদের ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ও ঈমানি উদ্দীপনা বৃদ্ধি করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

তথ্যসূত্র

[1]. দাইরাতুল মাআরিফিল ইসলামিয়্যা : ১/৬৯; শিবলি নোমানি, সিরাতুন-নবী : ১/৪১৯; ইসলামি বিশ্বকোষ : ৯/৫০৮

[2]. ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ৩/২৭১; ফাতহুল বারি : ৮/৩৯৫; উমদাতুল-কারি : ১২/১৩৬; আশ-শাওকানি, ফাতহুল-কাদির : ৪/৩২৮; তাফসির : ২/১৬৩

[3]. সিরাতে মুহাম্মাদিয়্যা : ১/৪০২; ইসলামি বিশ্বকোষ : ৯/৫০৮

[4]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩০১

[5]. ফাতহুল বারি : ৮/৩৯৭; সিরাতে ইবনে ইসহাক : ৩/৩৪৫; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/১২৫; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/৯৫

[6]. মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতুল মুসতাফা : ২/৩০৯

[7]. সিরাতে মুহাম্মাদিয়া : ১/৪০৩

[8]. আনসাবুল আশরাফ : ১/৩৪৩; ইসলামি বিশ্বকোষ : ৯/৫০৮

[9]. ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ২/৬৫; শরহুল মাওয়াহিব : ২/১০৩

[10]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/৯৫

[11]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৮৮

[12]. ফাতহুল বারি : ৭/৩৯৩; ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ২/২১৮; সিরাতে মুস্তাফা : ২/৩০৯-৩১০

[13]. তারিখুত তাবারি : ২/২৩৩; আল-কামিল ফিত-তারিখ : ২/১৭৮

[14]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/১২৫; নবীয়ে-রহমত : ২৫০

[15]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩০১

[16]. ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ২/৪৪২; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/১২৫-১২৬

[17]. সুরা নিসা : ৫১-৫২

[18]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/১২৬

[19]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩০১, ৩০৮

[20]. শিবলি নোমানি রহ., সিরাতুন-নবী : ১/২৪৪; ফাতহুল বারি : ৮/৩৯৫

[21]. ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ২/৪৪২

[22]. ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ২/৬৬; আল-ওয়াফা বি আহওয়ালিল মুস্তফা : ৬৯২

[23]. উমদাতুল কারি : ১২/১৩৬; ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ২/৬৬; রুহুল মাআনি : ১২/১৫৫; ফাতহুল কাদির : ৪/৩২৮; ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ৩/২৭১; জালাল মাজহার, মুহাম্মাদ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ২৩৫

[24]. তারিখুল উমাম ওয়াল-মুলুক : ২/২৩৬; ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ২/৪৪৪

[25]. জামিউল-বায়ান ফি তাফসিরিল কুরআন : ২/১৬৩; জিহাদের ময়দানে রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ৭৫

[26]. মুজামুল বুলদান : ৪/৩৩৬; মুফরাদাতুত তারিখিল উমাম আল-ইসলামিয়্যা : ১/১১৯; ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ২/৪৪৪

[27]. ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ২, ৬৬; দাইরাতুল মাআরিফিল ইসলামিয়্যা : ৮/৪৬৩

[28]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩০৩; তারিখুল উমাম ওয়াল-মুলুক : ২/২৩৪

[29]. আহমদ বাশমিল, গাজওয়া আহজাব : ৪৫; আল-কাশশাফ : ৩/৫২৬; ফি যিলালিল কুরআন : ৫/২৮৩৩; মাদারিকুত তানজিল : ৩, ৪৮৫

[30]. ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ২/৪৫

[31]. ইসলামি বিশ্বকোষ : ৯/৫১০

[32]. ফাতহুল বারি : ৭/৩০৫

[33]. মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সমকালীন পরিবেশ ও জীবন, ৬০৭

[34]. উসদুল গাবাহ : ২/৩৩১; ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ২/৪৪৬

[35]. আত-তাবাকাতুল কুবরা : ২/৬৭

[36]. সিরাতে মুহাম্মাদিয়া : ১/৪০৭

[37]. শরহুল মাওয়াহিব : ২/১১০

[38]. ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ২/৬৭

[39]. ফাতহুল বারি : ৭/৩০৪; সিরাতুল মুস্তাফা : ২/৩

[40]. সুরা নুর : ৬৩

[41]. সুরা নুর : ৬২

[42]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩০৩

[43]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৮৮

[44]. মিশকাতুল মাসাবিহ : ২/৪৪৮

[45]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৪৯; সহিহ মুসলিম : ২/১১২

[46]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৮৮; সহিহ মুসলিম : ২/১১৩

[47]. সহিহ মুসলিম : ২/১১৩

[48]. সিরাতুল মুস্তাফা : ২/৪; উমদাতুল কারি : ১৪/১৩২

[49]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৮৮-৫৮৯

[50]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৩৬

[51]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৮৮

[52]. ইবনে কাসির, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৬৪; আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩৪২

[53]. তারিখুত তাবারি : ২/২৩৫-৩৬

[54]. আল-আহ্‌যাব, ৩৩ : ২২

[55]. তারিখে তাবারি : ২/২৩৬

[56]. আল-আহ্‌যাব, ৩৩ : ১২

[57]. তারিখুত তাবারি : ২/২৩৬

[58]. তারিখুত তাবারি : ২/২৩৫; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/২১০; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/৯৫

[59]. খিদরি বেক, নুরুল ইয়াকিন : ১৩৮

[60]. নদভি, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২১৭; আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩০৬

[61]. আকবর শাহ খান নজিবাবাদী, তারিখে ইসলাম : ১/১৫৯

[62]. ৩৩: ১০-১৩

[63]. ৩৩: ২২

[64]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৪৮; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/১৩২; আন-নাদবি, সিরাতুন-নাববিয়া : ২১৭

[65]. আসাহহুস্ সিয়ার : ১৪৬; ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ৩/২৭২

[66]. মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমকালীন পরিবেশ ও জীবন : ৬১৫

[67]. নাদবি, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২১৭

[68]. ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ৩/২৭২; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১০৩; আসাহহুস সিয়ার : ১৪৭

[69]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩৪৫

[70]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/১৩৪

[71]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/১৩৪-৩৫; ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ৩/২৭২

[72]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩৪৫

[73]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/১৩৫

[74]. শিবলি নোমানি, সিরাতুন-নবী : ১/৪২৮

[75]. জুরকানি, শরহুল মাওয়াহিব : ২/১১৪; ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতুল মুস্তাফা : ২/৩১৯

[76]. ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ২/৬৮; ইমাম নববী, শরহু মুসলিম : ১/২২৭; মুখতাসার সিরাতির রাসুল : ৮৬; ফিকহুস সিরাত : ৩২৫; তারিখুল উমাম ওয়াল-মুলক : ২/২৩৯

[77]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৯০

[78]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩৪৬

[79]. সহিহ আল-বুখারি, ২/৫৯১

[80]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৯০

[81]. শিবলি নোমানি রহ., সিরাতুন নবী : ১/১৫২

[82]. শরহুল মাওয়াহিব : ১২৯

[83]. ইসলামি বিশ্বকোষ : ৯/৫০৯; শিবলি নোমানি, সিরাতুন-নবী : ১/২৫২

[84]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩১১

[85]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩১২; ইবনে কাসির, আস-সিরাতুন নাবাবিয়া : ২/২১৩

[86]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/১৩৯

[87]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩১২; তারিখুত তাবারি : ৩/৫০; ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ২/৪৮১-৮৩

[88]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩১২

[89]. সহিহ আল-বুখারি : ১/৪১১; ২/৫৯০; উমদাতুল কারি : ১২/১৫১; মুনতাকা আন-নুকুল : ২৮৫

[90]. শরহুল মাওয়াহিব : ২/১১৬; নদভি, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২২০

[91]. ৩৩: ৯

[92]. আল-জামে লি আহকামিল কুরআন : ১৪/১২০; রুহুল মাআনি : ১১/১৫৫; আয়সারুত তাফসির : ৪/ ২৪৮-৪৯; ফাতহুল কাদির : ৪/৩২৮-২৯

[93]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৪৭; মাকতাবা তাওফিকিয়া, মিসর

[94]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩১৩

[95]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৯০

[96]. আশ-শাইবানি, হাদাইকুল আনওয়ার : ২/৫৯১

[97]. নাদবি, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২২০

[98]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩১৩

[99]. ৩৩: ২৫

[100]. সহিহ আল-বুখারি : ২/৫৯০; সহিহ মুসলিম : ১৩৪৪

[101]. সিরাতে মুস্তফা : ২/৩২৩; ইসলামি বিশ্বকোষ : ৯/৫০১; আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩০০

[102]. সিরাতুল মুস্তাফা : ২/৩২৩

[103]. সহিহ আল-বুখারি : ৪১১০

শেয়ার করুন

সূচীপত্র

error: Content is protected !!