সিরাত বিশ্বকোষ
সিরাত বিশ্বকোষ

৩১. (১৯) গাজওয়া বনু কুরাইজা  – Invasion of Banu Qurayza

লেখক: আহমাদ রিফআত

বিষয় : বিষয়ভিত্তিক সিরাত

৩১. (১৯) গাজওয়া বনু কুরাইজা – Invasion of Banu Qurayza

১৯. গাজওয়া বনু কুরাইজা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত গাজওয়া : ১৯
তারিখ জানুয়ারি, ৬২৭ খ্রি.; পঞ্চম হিজরি
অবস্থান বনু কুরাইজার দুর্গ
ফলাফল মুসলমানদের বিজয় ও বনু কুরাইজা গোত্রের ২৫ দিনের সফল অবরোধ।

 

 

কারণ চুক্তি ভঙ্গ করে বিদ্রোহ করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে চুক্তি নবায়ন করতে চাইলে বনু নাজির তা অস্বীকার করে। ফলে তাদেরকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বিবাদমান পক্ষ
মুসলিম বনু কুরাইজা
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু,

 

উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু, আলি ইবনে আবু তালিব রাযিয়াল্লাহু আনহু, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু; সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু

হুআই ইবনে আখতাব, কাব বিন আসাদ আল কুরাজি; ইজ্জাল বিন সামাওয়াল
শক্তি
৩,০০০ পদাতিক, ৩০ অশ্বারোহী প্রায় ৭০০ এর কাছাকাছি
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
২ জন শহিদ ৪০০-৭০০ জন নিহত

পটভূমি

আওস ও খাযরাজ আনসারের এই দুই সম্প্রদায় ছাড়াও মদিনায় বনু কুরাইজা, বনু নাজির, বনু কায়নুকা, বনু সালাবা ও বনু আওফ প্রভৃতি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। তবে তাদের মধ্যে বনু কুরাইজা, বনু নাজির ও বনু কায়নুকা সম্প্রদায় ছিল বিশেষভাবে পরিচিত ও উল্লেখযোগ্য। বনু কায়নুকা খাযরাজ গোত্রের সাথে এবং বনু কুরাইজা আওস গোত্রের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ ছিল।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমনের পর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন। তিনি মুসলমানদের নিরাপত্তা, নির্বিঘ্নে জীবনযাপন ও সর্বোপরি মদিনাকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সেখানে বসবাসরত ইহুদিদের সাথেও একটি চুক্তি সম্পাদন করেন, যাতে তাদের জীবন, ধনসম্পদ ও ধর্মীয় বিষয়ে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা প্রদান করা হয়।[1] এই চুক্তিনামার বিশেষ দিক ছিল, ইহুদিদের মুসলমানদের সহযোগী হয়ে থাকতে হবে। একই জাতি-গোষ্ঠীর ন্যায় তাদের সাথে বসবাস করতে হবে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিজেরা যেমন অস্ত্র ধরতে পারবে না, কোনো ইহুদি কোনো কুরাইশি কাফেরের সম্পদ নিরাপদ আশ্রয়ে রাখবে না এবং কোনো মুসলমানের বিপক্ষে কুরাইশদের সে সাহায্যও করবে না। সমবেতভাবে যুদ্ধরত অবস্থায় মুসলমানদের মতো তাদেরকেও যুদ্ধের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতে হবে, বহিঃশত্রু কর্তৃক ইয়াসরিব অর্থাৎ মদিনা আক্রান্ত হলে সম্মিলিতভাবে তার মোকাবেলা করবে।[2] মদিনাবাসীদের কল্যাণে এই চুক্তির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। দেশ ও জাতির স্বার্থ রক্ষায় এই অঙ্গীকারনামা ছিল এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত—যা ইতিহাসে মদিনা সনদ নামে খ্যাত।

কুরাইশগণ পত্র প্রেরণের মাধ্যমে ইহুদিদের এই চুক্তি ভঙ্গ করার জন্য প্ররোচিত করতে থাকলে তারা প্রভাবিত হয়ে বিদ্রোহ করতে শুরু করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে চুক্তি নবায়ন করতে চাইলে বনু নাজির তা অস্বীকার করে। ফলে তাদের মদিনা থেকে বহিষ্কার করা হয়। অপরদিকে বনু কুরাইজা নতুন করে চুক্তিতে আবদ্ধ হলে তাদের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়। এই ঘটনা মুসলিম শরিফে আবদুল্লাহ ইবনে ইমরান-এর উদ্ধৃতিতে বর্ণিত হয়েছে, বনু নাজির ও কুরাইজা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিদ্রোহ করলে বনু নাজিরকে দেশান্তরিত করা হয় এবং বনু কুরাইজাকে বসবাস করতে দেওয়া হয়। তাদের উপর অনুগ্রহ প্রদর্শন করা হয়।[3]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা কাআব ইবনে উমায়ের আল-গিফারি – Expedition of Ka’b ibn ‘Umair al-Ghifari

আরো পড়ুন : সারিয়্যা কাআব ইবনে উমায়ের আল-গিফারি রা. – Sariya Ka’ab ibn Umair al-Ghifari

বিজ্ঞাপন

আরো পড়ুন : সারিয়্যা কুতবা ইবনে আমের – Expedition of Qutbah ibn Amir

মদিনা থেকে বনু নাজির বহিষ্কৃত হওয়ার পর খায়বারে গিয়ে বসতি স্থাপন করে এবং সেখানকার নেতৃত্ব অর্জন করে। তাদের সরদার হুয়াই (হুয়ায়্যি) ইবনে আখতাব প্রতিশোধের নেশায় কুরাইশসহ অন্যান্য আরব গোত্রসমূহে অব্যাহত প্রচারণা চালিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের সংঘবদ্ধ করে মদিনা আক্রমণের ক্ষেত্র রচনা করে। খন্দকের যুদ্ধ মূলত তারই চেষ্টার ফল ছিল। ইসলাম বিরোধী এই সংঘবদ্ধ বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণ থেকে মদিনাকে রক্ষার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে পরিখা খনন করার রণপ্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন পর্যন্তও বনু কুরাইজা চুক্তির উপর বহাল থেকে আলাদা অবস্থান করছিল।[4]

বনু নাজির তাদের একত্র করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। নাজির গোত্রপতি হুয়াই ইবনে আখতাব কুরাইজা গোত্রপতি কাআব ইবনে আসাদ আল-কুরাজিকে মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে কুরাইশদের নেতৃত্বে ইসলাম বিরোধী মিত্রজোটে যোগ দিতে প্ররোচিত করার লক্ষ্যে বনু কুরাইজা এলাকায় গমন করে এবং গোত্রপতি কাব-এর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধাক্রান্ত হলে তাকে সাহায্য করতে বা কুরাইজা যেহেতু প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল, তাই হুয়াই দরজার নিকট উপস্থিত হলে কাব তাকে দেখে দরজা বন্ধ করে দেয়; অনেক পীড়াপীড়ির পর দরজা খোলা হয়। কাবকে উদ্দেশ্য করে হুয়াই বলে, ‘বর্তমানে কুরাইশসহ গোটা আরব মুহাম্মাদের রক্তপিপাসু। তারা ইসলাম ও মুসলিম শক্তির মূলোৎপটনের লক্ষ্যে সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে মদিনার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করছে। তারা আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গীদের সমূলে ধ্বংস না করা পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাবে না। যুদ্ধের জন্য আমার বাহিনীকেও প্রস্তৃত রেখেছি। ইসলামের মূলোৎপটনের এটিই মোক্ষম সময়। এই সুযোগ হাতছাড়া করা মোটেও উচিত নয়।’ কাআব বলল, ‘তোমার দুর্ভাগ্য হোক হে হুয়াই! সত্যই তুমি এক অশুভ কুলাঙ্গার। আমি তো মুহাম্মাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ আছি। আমাদের পারস্পরিক এই চুক্তি ভঙ্গ করতে পারি না। কারণ আমি তার মধ্যে সততা, সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততা ছাড়া আর কিছুই দেখিনি।[5] তাকে সর্বদা প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী হিসেবে পেয়েছি। কাজেই অযথা আমার পেছনে সময় নষ্ট কোরো না। আমাকে আমার অবস্থায় থাকতে দাও।’[6]

হুয়াই তবু নাছোড়বান্দা। তাকে নানাভাবে বুঝাতে ও বাগে আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকল। এমনকি তাকে আল্লাহর নামে এই প্রতিশ্রুতি দিল, ‘কুরাইশ এবং গাতফান যদি আল্লাহ না করুন আক্রমণ থেকে হাত গুটিয়ে নেয় এবং মুহাম্মাদকে কোনোরূপ আঘাত না করেই মক্কা প্রত্যাবর্তন করে, তাহলে খায়বার ছেড়ে আমি তোমার সাথে তোমার দুর্গেই থাকব। তখন তোমার যা হবে, আমারও তাই হবে।’[7] হুয়াই-এর অব্যাহত প্রচেষ্টা ও তার সর্বশেষ এই আকর্ষণীয় বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে কাআব ইবনে আসাদ নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে এবং তার ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে যেসকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, তা থেকে সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়।[8]

তাদের এই চুক্তিভঙ্গের সংবাদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছামাত্রই তিনি এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আওস গোত্রপতি সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু, খাযরাজ গোত্রপতি সাদ ইবনে উবাদা, আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা ও খাওয়াত ইবনে জুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে এই নির্দেশ দিয়ে প্রেরণ করলেন, ‘সংবাদটি সত্য প্রমাণিত হলে সরাসরি অমার নিকট এসে অস্পষ্ট শব্দে তা প্রকাশ করবে, যাতে কেবল আমিই বুঝতে পারি, অন্যরা নয়। আর অসত্য হলে এবং তারা প্রতিশ্রুতি ও চুক্তির উপর বহাল থাকলে, তা স্পষ্ট ভাষায় জনসমক্ষে প্রকাশ করবে।’ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্যই তিনি এরূপ নির্দেশ প্রদান করেছিলেন।

তারা সেখানে গিয়ে খুবই খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। বনু কুরাইজার লোকেরা তাদের দেখে প্রকাশ্যে শত্রুতা, বাড়াবাড়ি ও গালিগালাজ করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অমার্জিত ভাষায় অশোভন কথাবার্তা বলে এবং বিদ্রুপাত্মকভাবে বলতে থাকে, ‘আল্লাহর রাসুল আবার কে? আমাদের এবং মুহাম্মাদের মধ্যে কোনো চুক্তি নেই।’[9] তারা কাআব ইবনে আসাদের নিকট গিয়ে চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিলে কাআব বলে, ‘তা কেমন চুক্তি। মুহাম্মাদ আবার কে? তার সাথে আমার কোনো চুক্তি নেই।’[10] তারা রীতিমতো যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দেয়।[11]

মোটকথা, তারা যতটা শুনেছিলেন—সেখানে গিয়ে প্রকৃত অবস্থা তার চাইতেও ভয়ানক দেখে ফিরে এলেন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পূর্ব নির্দেশিত পন্থায় ইঙ্গিতে তা ব্যক্ত করলেন। তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালেন, ‘আসহাবে রাজি তথা খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে আদাল ও কারা গোত্র যেমন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, আপনার সাথে এদের বিশ্বাসঘাতকতাও অনুরূপ।’[12]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সংবাদে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। মুসলিম বাহিনী যেন মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে সেজন্য প্রথমদিকে এই ব্যাপারটা গোপন করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বা কুরাইজা প্রকাশ্যে বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণ করতে থাকায় পরবর্তী সময়ে তা আর গোপন রইল না। অচিরেই মুসলমানগণ তা জানতে পারলেন। খন্দকের যুদ্ধে যখন মুসলিম বাহিনী রাতের কনকনে শীত ও একাধারে কয়েক দিনের ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে চরম কষ্টসাধ্য বিশাল পরিখা খনন করে এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ বহিঃশত্রুর সংঘবদ্ধ বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ অবস্থায় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ক্লান্ত, এমনি এক নাযুক অবস্থায় মদিনার ভেতর থেকে বনু কুরাইজার আকস্মিক চুক্তিভঙ্গ ও শত্রুদের পক্ষাবলম্বন মুসলমানদের অত্যন্ত সংকটময় অবস্থায় ফেলে দেয়। কারণ এই বিশ্বাসঘাতকদের অদূরেই সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় মুসলিম নারী ও শিশুগণ অবস্থান করছিল। পেছনদিক থেকে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করার কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। আবার সম্মুখ ভাগের বিশাল বাহিনীকে ফেলে পেছনে আসাও সম্ভব ছিল না। এককথায় মুসলমানদের জন্য এটি ছিল এক কঠিন মুহূর্ত। কুরআনুল কারিমের নিম্নোক্ত আয়াতে ওই অবস্থাকে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে,

إِذْ جَاءُوكُمْ مِنْ فَوْقِكُمْ وَمِنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَإِذْ زَاغَتِ الْأَبْصَارُ وَبَلَغَتِ الْقُلُوبُ الْحَنَاجِرَ وَتَظُنُّونَ بِاللَّهِ الظُّنُونَا (১০)

‘যখন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সমাগত হয়েছিল, উচ্চ ও নিম্নাঞ্চল থেকে তোমাদের তোমাদের চোখ বিস্ফোরিত হয়েছিল, তোমাদের প্রাণ হয়ে পড়েছিল কণ্ঠাগত এবং তোমরা আল্লাহ সম্বন্ধে নানাবিধ ধারণা পোষণ করছিলে। সেসময় মুমিনগণ পরীক্ষিত হয়েছিল এবং তারা ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল।’[13]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উম্মু কিরফা – Killing of Umm Qirfa

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উয়ায়না ইবনে হিসন আল-ফাজারি – Expedition of Uyainah bin Hisn

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উসামা ইবনে জায়েদ – Expedition of Usama bin Zayd

বনু কুরাইজার আচরণ মুসলমানদের জন্য কত যে কষ্টকর ও বেদনাদায়ক ছিল, তা নিম্নোক্ত ঘটনা থেকেও অনুমান করা যায়।

সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু, যিনি তাদের সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন, বিপদাপদে সর্বদা সাহায্যকারী, সহানুভূতিশীল ও কল্যাণকামী ছিলেন। খন্দকের যুদ্ধে হিব্বান ইবনুল আরাকা নামক এক কুরাইশির[14] নিক্ষিপ্ত তিরে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে যখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত, তখন তিনি বিনীতভাবে আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছিলেন—যার শেষবাক্য ছিল, ‘হে আল্লাহ! আমাকে ততক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যু দিয়ো না, যতক্ষণ না আমার চোখ বনু কুরাইজার ধ্বংস দেখে শীতল হয়।’[15] বনু কুরাইজা চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে খন্দকের যুদ্ধে মুশরিকদের সহায়তা করে[16] এবং ইসলামের বড় শত্রু হুয়াই ইবনে আখতাবকে স্বীয় দুর্গে আশ্রয় দান করে।[17] সঙ্গত কারণেই বনু কুরাইজার এই বিশ্বাসঘাতকতামূলক জঘন্য আচরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

বনু কুরাইজার বিরুদ্ধে অভিযান

খন্দকের যুদ্ধে কুরাইশ, গাতফান ও ইহুদিদের সম্মিলিত বিশাল বাহিনীর ব্যর্থ হয়ে রাতের অন্ধকারে পালানোর সংবাদ সাহাবি হুজায়ফা ইবনুল ইয়ামান-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরের দিন অর্থাৎ ৫ম হিজরির জিলকদ মাসের ২২/২৩ তারিখ[18] বুধবার ফজর নামাজের পর[19] মুসলমানদের নিয়ে সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করেন এবং মদিনায় পৌঁছে সবাই যুদ্ধাস্ত্র পরিত্যাগ করেন।[20]

মানচিত্র (৩২) : বনু কুরাইজার অবস্থান স্থান

 

দ্বিপ্রহরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন উম্মু সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গৃহে গোসলখানায় গোসল করতে শরীরে একদিকে কেবল পানি ঢেলেছেন, এমন সময়[21] জিবরাঈল আলাইহিস সালাম ঘন, পুরু ও মনোরম রেশমী কাপড়ের পাগড়ি পরিহিত অবস্থায় মখমল আচ্ছাদিত জিনবিশিষ্ট এক বাহনে আরোহণ করে আগমন করেন।[22] তিনি (মসজিদে নববী সংলগ্ন) জানাজা নামাজের জন্য নির্ধারিত জায়গার সন্নিকটে এসে দাঁড়ান[23] এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম দেন।[24] ইমাম আহমাদ ও বায়হাকি বর্ণিত দুটি হাদিস অনুযায়ী আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে সেদিন গৃহের অভ্যন্তর থেকে সাহাবি দিহইয়া কালবির আকৃতিতে ধূলি ধুসরিত অবস্থায় দেখতে পান, যাতে তার কর্মব্যস্ততার চিত্রই ফুটে উঠছিল।[25]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা ঈস/জায়েদ ইবনে হারিসা রা. – Expedition of Zayd ibn Harithah (Al-Is)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উক্কাশা ইবনে মিহসান রা. – Expedition of Ukasha bin Al-Mihsan

আরো পড়ুন : সারিয়্যা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. – Expedition of Umar ibn al-Khatab

জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি অস্ত্র ত্যাগ করেছেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ জিবরাঈল আলাইহিস সালাম বললেন, ‘আমরা ফেরেশতাগণ এখনও অস্ত্র রাখিনি। আমরা তো মুশরিকদের পশ্চাদ্ধাবন করতে করতে হামরাউল আসাদ নামক স্থান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলাম।[26] একটা কওমের সন্ধানেই এখন আবার ফিরে এলাম। আল্লাহ আপনাকে বনু কুরাইজা অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি আমার সহযাত্রী ফেরেশতাদের নিয়ে আপনার আগেই সেদিকে অগ্রসর হচ্ছি, যাতে তাদের ভেতর অস্থিরতা ও ভীতি সৃষ্টি করতে পারি। আপনি আপনার সাথিদের নিয়ে দ্রুত রওনা হোন।’[27] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্দকের দীর্ঘ যুদ্ধ থেকে সদ্য প্রত্যাগত সাহাবিদের ক্লান্তি ও পরিশ্রান্তির কথা উত্থাপন করলে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তাকে তার চিন্তা না করে তৎক্ষণাৎ বনু কুরাইজার উদ্দেশ্য যাত্রার ইঙ্গিত দান করেছেন।[28] মদিনার নিকটবর্তী বাকি নামক এলাকায় অবস্থিত (খাজরাজের এক শাখাগোত্র) গানম গোত্রের পল্লি ‘সুরিন’ হয়ে তার (জিবরাঈল) যাওয়ার সময় সেখানকার অলিগলি ধুলাবালিতে ভরে যায়। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘বনু গানমের সরু মেঠোপথ অতিক্রমকালে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম-এর বাহন থেকে যেই ধুলাবালি উড়ছিল, সেই দৃশ্য যেন আমি এখনও দেখতে পাচ্ছি।’[29]

জিবরাঈল আলাইহিস সালাম চলে যাওয়ার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলাল রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাধ্যমে মুসলমানদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে দ্রুত রওনা হতে এবং বনু কুরাইজায় পৌঁছে আসরের নামাজ আদায় করার জন্য বলেন।[30] তিনি আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে ইসলামের পতাকা প্রদান করে তাকে বনু কুরাইজার উদ্দেশ্যে অগ্রে পাঠিয়ে দেন। তিনি তাদের দুর্গের নিকটবর্তী হলে দুর্গাভ্যন্তর থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ইহুদিদের প্রকাশ্য কটূক্তি ও অশ্লীল কথাবার্তা শুনতে পান[31] যা ছিল সম্পূর্ণরূপে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। মদিনার দায়িত্বে আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে নিয়োগ করে এবার স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসার ও মুহাজিরগণকে নিয়ে বের হন।[32] তিনি বনু গানমের বসতি ‘সুরিন’ অতিক্রমকালে রাস্তায় অপেক্ষমাণ দর্শনার্থীদের নিকট থেকে কারুকার্য খচিত রেশমী বস্ত্রের মখমল সজ্জিত এক সাদা বাহনে সাহাবি দিহইয়া ইবনে কালবির আকৃতিতে কিছুক্ষণ আগে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম-এর গমনের ব্যাপারে নিশ্চিত হন।[33] তিনি তাদেরকেও বনু কুরাইজার এলাকায় তার সাথে মিলিত হয়ে সেখানেই আসরের নামাজ পড়ার নির্দেশ প্রদান করেছেন। ফলে সেখান থেকেও একদল মুসলমান বনু কুরাইজার দিকে গমন করে।[34] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইজার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও জীবিকা উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত ‘বিরে আনা’ নামক তাদের এক কূপের নিকট এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। অতঃপর মুসলিম বাহিনী একের পর এক দলে দলে এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হয়। এমনকি কিছুসংখ্যক লোক ইশার নামাজের পরও এসে উপস্থিত হন।[35] এই অভিযানে মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা ছিল তিন হাজার; আর ঘোড়া ছিল ত্রিশটি[36], ইবনে সাদ-এর মতে ছত্রিশটি।[37]

আসরের নামাজ আদায়ের ব্যাপারে মতভেদ

বনু কুরাইজা অভিমুখে যাত্রার প্রাক্কালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জারিকৃত নির্দেশ ‘কেউ যেন বনু কুরাইজা ছাড়া অন্য কোথাও আসরের নামাজ না পড়ে’-এর ফলে পথিমধ্যে উক্ত নামাজের ওয়াক্ত হলে মুসলমানদের মধ্যে তা আদায়ের ব্যাপারে মতভেদ সৃষ্টি হয়। একদল বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশানুযায়ী আমরা বনু কুরাইজায় পৌঁছার পরই কেবল আসর পড়ি, তার পূর্বে নয়।’ আরেক দল বলেন, ‘ওই নির্দেশ দ্বারা তার উদ্দেশ্য তো এটি ছিল না, নামাজ কাজা বা বিলম্বে আদায় করতে হবে; বরং তার উদ্দেশ্য ছিল বনু কুরাইজায় দ্রুত গমন—যাতে সেখানে পৌঁছে আসর পড়া যায়।’ এই বলে তারা পথেই নামাজ পড়ে নেন। পরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এই বিষয় উপস্থান করা হলে তিনি কোনো দলকেই ভর্ৎসনা করেননি।[38]

কারণ উভয় দলের নিয়ত ভালো ছিল। মূলত সেদিন একদল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশকে আক্ষরিক অর্থে মেনেছিলেন, আরেক দল ওই নির্দেশের মধ্যে রাসুলের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দিয়ে তার হুকুম পালনে সচেষ্ট হন। বাহ্যিক শব্দ ও অর্থানুযায়ী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বিলম্বে নামাজ আদায়ের ওই বিশেষ আদেশকে প্রথম দল শরিয়ত নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায়ের সাধারণ হুকুম ও আদেশের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে সূর্যাস্তের পর,[39] এমনকি কেউ কেউ রাতে ইশার সময় বা কুরাইজাতে পৌঁছে আসর নামাজ আদায় করেন।[40]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব (1) – Expedition of Ali ibn Abi Talib

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব রা. (3) – Expedition of Ali ibn Abi Talib

আরো পড়ুন : সারিয়্যা ইবনে আবিল আওজা – Expedition of Ibn Abi Al-Awja Al-Sulami

তবে হাফিজ ইবনে কায়্যিমের মতে প্রথম দল শুধু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুকুম পালনের সওয়াব লাভ করেন, আর দ্বিতীয় দল যেহেতু (ক) ইজতিহাদের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুকুম পালন এবং (খ) আসরের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ নামাজ সময়মতো আদায় করেন, যার সংরক্ষণ ও যত্নের ব্যাপারে কুরআন কারিমে বিশেষ নির্দেশ ও তাকিদ এসেছে এবং হাদিস শরিফে সেই নামাজ সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ‘যার আসর ছুটেছে তার আমল ব্যর্থ ও নিষ্ফল হয়েছে’, তাই উপরিউক্ত দুই কারণে তারা দ্বিগুণ সওয়াব ও মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন।[41]

অবরোধ

মুসলিম বাহিনীর অগ্রাভিযানের সংবাদে বনু কুরাইজার ইহুদিদের যদি নিজেদের কৃত অপরাধে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে সন্ধি ও বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করত, তাহলে তাদের নিরাপত্তা প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছিল। তা-ই ছিল সবেচেয়ে সহজ ও নিরাপদ পন্থা। কিন্তু এই দুরাচার হতভাগ্য সম্প্রদায় ওই পথে না গিয়ে বরং মোকাবেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।[42] মুসলমানগণ নিকটবর্তী হলে তারা প্রকাশ্যে আল্লাহর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে।[43] মুসলিম সৈন্যবাহিনীর অগ্রগামী ইসলামের পতাকাবাহী আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু সর্বপ্রথম তা শ্রবণ করা মাত্রই সেখান থেকে দ্রুত প্রত্যাবর্তন করেন। পথিমধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার দিকে অগ্রসর হতে দেখে বিনীতভাবে তার গতিরোধ করার চেষ্টা করেন। ইহুদিদের অশ্লীল ও নোংরা গালি সরাসরি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুনলে কষ্ট পাবেন ভেবে তিনি তাকে সম্মুখে অগ্রসর না হওয়ার জন্য অনুরোধ জানান এবং বলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, এই অবাধ্য লম্পটদের নিকটবর্তী হওয়া আপনার জন্য সমীচীন নয়। আপনি বরং প্রত্যাবর্তন করুন। এদের অনিষ্ট থেকে আপনাকে রক্ষার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’

‘সম্মুখে অগ্রসর না হয়ে প্রত্যাবর্তন কেন করতে হবে’—এটির কারণ জিজ্ঞাসা করলে আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু দুর্গাভ্যন্তর থেকে রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্বন্ধে তাদের যেসব অশ্লীল কথাবার্তা শুনেছিলেন, তিনি তা তার নিকট গোপন করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘মনে হচ্ছে তুমি তাদের পক্ষ থেকে আমার সম্বন্ধে কষ্টদায়ক কিছু শুনেছ?’ আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু ইতিবাচক উত্তর দিলে তিনি বললেন, ‘তারা আমাকে দেখতে পেলে তুমি যা শুনেছ তার কোনো কিছুই বলতে পারত না।’ এই বলে তিনি সম্মুখে অগ্রসর হলেন এবং দুর্গের নিকটবর্তী হয়ে দুর্গশীর্ষে অবস্থানরত তাদের কয়েকজন নেতৃস্থায়ী ব্যক্তিদের নাম ধরে (তারা শুনতে পায় এমন উচ্চৈঃস্বরে) ডাক দিয়ে বললেন, ‘উত্তর দাও হে ইহুদি সম্প্রদায়! হে বানরের জ্ঞাতি! আল্লাহ কি তোমাদের অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করেছেন? তোমাদের উপর কি তার শাস্তি অবতীর্ণ করেছেন? বস্তুত তোমাদের জন্য আল্লাহর লাঞ্ছনা ও অপমানই অবধারিত।’ এটি শুনে তারা উত্তর করল, ‘হে আবুল কাসিম! তুমি তো এরূপ মূর্খের মতো কথা বলতে না।’[44] যাহোক, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইজার ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতা, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও অশালীন কথাবার্তার সমুচিত শাস্তি প্রদানের লক্ষ্যে উপরিউক্ত কথোপকথনের পর কালবিলম্ব না করে তাদের উপর অবরোধ আরোপ করেন। এই অবরোধ চলে একাধারে ২৫ দিন। অবশেষে দীর্ঘ অবরোধে তারা দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে।[45]

অবরোধের তীব্রতায় একপর্যায়ে যখন বনু কুরাইজার হৃদয়ে এই বিশ্বাস ও ধারণা বদ্ধমূল হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে সমুচিত শিক্ষা না দিয়ে সেখান থেকে ফিরে যাবেন না, তখন তাদের গোত্রপতি কাআব ইবনে আসাদ উদ্ভূত সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সবাইকে একত্র করে বলল, ‘আমি তোমাদের নিকট তিনটি প্রস্তাব পেশ করছি। এর যেকোনো একটি গ্রহণ করে তোমরা এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারো।

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলকামা ইবনে মুজাযিয আল-মুদলিজী – Expedition of Alkama Ibn Mujaziz Al-Mudliji

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আল-কুররা বি’র মাউনা – Expedition of Bir Maona

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব ( ) – Expedition of Ali ibn Abi Talib (2)

১. ইসলাম গ্রহণ করে মুহাম্মাদের ধর্মে প্রবেশ করা এবং তার পরিপূর্ণ অনুসারী হয়ে যাওয়া। আল্লাহর শপথ! এটি সম্পূর্ণরূপে তোমাদের নিকট পরিষ্কার হয়ে গেছে, মুহাম্মাদ নিঃসন্দেহে একজন নবী ও রাসুল। নিশ্চয় তিনিই সেই নবী যার আলোচনা তোমরা তাওরাতে দেখতে পাও। সুতরাং তার উপর ঈমান আনলে তোমাদের জীবন, সম্পদ, স্ত্রী-পুত্র সকল কিছু নিরাপদ থাকবে। তারা বলল, আমাদের নিকট এটি গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা আমাদের ধর্ম পরিত্যাগ করব না, তাওরাতের বিধান ছাড়া অন্য কোনো বিধানই মানব না। কাআব বলল, তা হলে আসো,

২. আমরা আমাদের সন্তান ও স্ত্রীগণকে স্বহস্তে হত্যা করে একেবারে চিন্তামুক্ত হয়ে যাই এবং কোষমুক্ত তরবারি হাতে বের হয়ে পূর্ণ সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে মুহাম্মাদ ও তার সাথিদের মোকাবেলা করি। তাতে পরাজিত হলে স্ত্রী-পুত্রের কোনো বাড়তি চিন্তা থাকবে না। আর বিজয় লাভ করলে নতুন স্ত্রীর অভাব হবে না। তাদের মাধ্যমে পুনরায় সন্তান লাভ করতে পারব। তারা বলল, অযথা এই অসহায় নারী-শিশুদের হত্যার পর নিজেদের বেঁচে থাকার মধ্যে কী স্বাদ ও সার্থকতা রয়েছে? কাআব বলল, ঠিক আছে তোমাদের নিকট এটিও যখন গ্রহণযোগ্য নয়, তা হলে আমার সর্বশেষ প্রস্তাব হলো,

৩. আমাদের এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শনিবারের রাতই হবে উপযুক্ত সময়। যেহেতু শনিবার ইহুদিদের নিকট পবিত্র ও তার সঙ্গীগণ ওই রাতে আমাদের পক্ষ থেকে আক্রান্ত না হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকবে, তাদের এই অসতকর্তা ও অন্যমনস্কতার সুযোগে তাদের উপর আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে তাদের পর্যুদস্ত করা খুবই সহজ হবে।

তারা এই প্রস্তাবের উত্তরে বলল, কাআব! তোমার ভালোভাবেই জানা আছে, আমাদের পূর্বপুরুষগণ এই দিনকে কলঙ্কিত করার অপরাধে শূকর ও বানরে রূপান্তরিত হয়েছিল। তারপরও তুমি আমাদের তার নির্দেশ প্রদান করছো?’

বনু কুরাইজা একে একে যখন সকল প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করল, তখন তাদের উপর ক্রোধ ও বিরক্তি প্রকাশ করে কাআব বলল, ‘জন্মলগ্ন থেকে অদ্যাবধি তোমাদের কেউই দৃঢ় সংকল্প ও বিচক্ষণতার সাথে একটা রাতও অতিবাহিত করোনি।’[46]

অনুশোচনার এক অভিনব দৃষ্টান্তু : আবু লুবাবা রাযিয়াল্লাহু আনহু

অবরোধের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য উপস্থাপিত কাআব-এর প্রস্তাবসমূহ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর বনু কুরাইজার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় অবশিষ্ট থাকল না। তবে তার পূর্বে তার সিদ্ধান্ত অবনত মস্তকে মেনে নিলে তাদের কী অবস্থা হবে, কোন ধরনের শাস্তি ভোগ করতে হবে—তা অবগত হওয়ার জন্য তারা তাদের কতক মুসলিম মিত্রের সাথে মিলিত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করল। আওস গোত্রের মিত্র বনু আমর ইবনে আওফ বংশের নেতৃস্থানীয় আনসার সাহাবি আবু লুবাবা রাযিয়াল্লাহু আনহু, যার আসল নাম রিফাআ ইবনে আবদুল মুনজির, ছিলেন বনু কুরাইজার এক ঘনিষ্ঠ মিত্র। তার সন্তান ও ধন-সম্পদও থাকত তাদের এলাকাতে।[47] সুতরাং সঙ্গত কারণেই তাদের হৃদয়ে এই আশার সঞ্চার হলো, সম্ভবত এই বিপদের সময় তিনি অন্তত সুপরামর্শ দিয়ে তাদের কোনো সাহায্য করতে পারবেন।

তারা তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলার জন্য চিৎকার করে ডাকল। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের নিকট যাব না, যতক্ষণ না আল্লাহর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে অনুমতি প্রদান করবেন।’[48] তারা নিজেদের ব্যাপারে পরামর্শাদির জন্য আবু লুবাবা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তাদের নিকট পাঠানোর আবেদন জানিয়ে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বার্তা পাঠাল। তিনি তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে পাঠিয়ে দিলেন। আবু লুবাবাকে দেখে বনু কুরাইজার পুরুষগণ ছুটে এলো। তার সম্মুখে তাদের শিশু ও নারীরা কান্নায় ভেঙে পড়ল। তাতে তার হৃদয় বিগলিত হয়ে গেল। তাদের প্রতি তিনি দয়ার্দ হয়ে উঠলেন। তারা তাকে বলল, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিদ্ধান্ত কি মেনে নেব? তার ফয়সালার উপর কি সন্তুষ্ট থাকব?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাত দ্বারা কণ্ঠনালির দিকে ইশারা করে বুঝিয়ে দিলেন, তাদের জবেহ করা হবে। এরপর তিনি সেখান থেকে প্রস্থানের জন্য পা উঠানোর পূর্বেই বুঝতে পারলেন, গোপনীয়তা ফাঁস করে তিনি আল্লাহ ও তদীয় রাসুলের সাথে বিশ্বাসভঙ্গ করেন। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন,

(ক) যে ভূমিতে এই ঘটনা ঘটেছে সেখানে তিনি থাকবেন না;[49]

(খ) আল্লাহর রাসুলের সম্মুখে নিজের চেহারা দেখাবেন না, যতক্ষণ না এমন খাঁটি তাওবা করবেন—যা কেবল আল্লাহই জানেন।[50]

(গ) তিনি আল্লাহর শপথ করে বললেন, যতক্ষণ না আল্লাহ আমার তাওবা কবুল করবেন, ততক্ষণ আমি পানাহার করব না। এমনকি এই অবস্থায় আমার মৃত্যু হয়ে গেলেও না।’[51] আবু লুবাবা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপরিউক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুমিনদের সতর্কীকরণার্থে আল্লাহ তায়ালা নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ (২৭)

‘হে মুমিনগণ! তোমরা জেনেশুনে আল্লাহ ও তার রাসুলের সাথে বিশ্বাসভঙ্গ করবে

এবং তোমাদের পরস্পরের আমানত সম্পর্কেও না।’[52]

যাহোক, তিনি উপরিউক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পূর্বক কালবিলম্ব না করে দুর্গ থেকে ফিরে এলেন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত না হয়ে সরাসরি মসজিদে নববিতে এসে তার এক খুঁটির সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ফেললেন এবং ঘোষণা করলেন, (ক) যতক্ষণ না আল্লাহ তার অপরাধ ক্ষমা করবেন ততক্ষণ তিনি সেই স্থান ত্যাগ করবেন না; (খ) তিনি আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে এই অঙ্গীকার করলেন, ভবিষ্যতে বনু কুরাইজার এলাকায় প্রবেশ করবেন না;[53] (গ) তিনি এটিও শপথ করলেন যে, যতক্ষণ না আল্লাহর রাসুল নিজ হাতে তার বন্ধন খুলে দেবেন, ততক্ষণ তিনি তা খুলবেন না বা কাউকেও খুলতে দেবেন না।[54]

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবুল হাদরাদ – Expedition of Abi Hadrad al-Aslami

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আমর ইবনুল আস – Expedition of Amr ibn al-As

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আমর ইবনে উমাইয়া আদ-দামরি রা. – Expedition of Amr bin Umayyah al-Damri

আল্লাহর রাসুলের নিকট যখন এই সংবাদ পৌঁছাল, তখন তিনি বললেন, ‘আমার অনুপস্থিতিতে আবু লুবাবা ফেতনায় পতিত হয়েছে।[55] সরাসরি সে আমার নিকট এলে তার জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থনা করতাম। যখন সে নিজ বুদ্ধিতে ক্ষমা প্রাপ্তির জন্য ওই পদ্ধতি অবলম্বন করেই ফেলেছে, তখন আমিও তাকে স্বহস্তে মুক্ত করব না, যতক্ষণ না আল্লাহ তায়ালা তার তাওবা কবুল করেন।’[56] মসজিদে নববিতে খুঁটির সঙ্গে বাঁধাবস্থায় ৬ দিন[57], মতান্তরে ২০ দিন ছিলেন। প্রত্যেক নামাজের সময় তার স্ত্রী এসে নামাজ আদায়ের জন্য তার বন্ধন খুলে দিতেন। নামাজ শেষ হতেই তিনি পুনরায় নিজেকে বেঁধে নিতেন। অবশেষে আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন এবং উম্মু সালামার গৃহে অবস্থানরত আল্লাহর রাসুলকে নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে সাহরির সময় তা অবহিত করেন,

وَآخَرُونَ اعْتَرَفُوا بِذُنُوبِهِمْ خَلَطُوا عَمَلًا صَالِحًا وَآخَرَ سَيِّئًا عَسَى اللَّهُ أَنْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

‘এবং অপর কিছু লোক নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেছে, তারা এক সৎকর্মের সাথে অপর অসৎকর্ম মিশ্রিত করেছে; আল্লাহ হয়তো তাদেরকে ক্ষমা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’[58]

এই সংবাদে আল্লাহর রাসুল হাসতে লাগলেন। উম্মু সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, ‘আবু লুবাবার তাওবা কবুল হয়েছে।’ উম্মু সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহু স্বয়ং এই সংবাদ আবু লুবাবাকে দেওয়ার জন্য রাসুলের নিকট অনুমতি প্রার্থনা করলেন। রাসুল তাকে অনুমতি দিলে তিনি আনন্দের সহিত বের হয়ে আবু লুবাবাকে সম্বোধন করে বললেন, ‘সুসংবাদ নাও! আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করেছেন।’ সাহাবিদের মধ্যে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে তারা তাকে বন্ধনমুক্ত করার জন্য ছুটে এলেন। তখন আবু লুবাবা বললেন, ‘কখনো না, আল্লাহর কসম! যতক্ষণ না আল্লাহর রাসুল স্বয়ং তার মোবারক হাতে আমাকে মুক্ত করবেন, ততক্ষণ আমি এই অবস্থায় থাকব, কারো মাধ্যমেই মুক্ত হবো না।’ পরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য আবু লুবাবা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পাশ দিয়ে অতিক্রম কালে বন্ধন খুলে দিয়ে তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করলেন।[59]

ভীত-সন্ত্রস্ত বনু কুরাইজার নমনীয় মনোভাব

 

বিশ্বাসঘাতকতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কেমন কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে, তা আবু লুবাবার মাধ্যমে অবগত হওয়ার পরও বনু কুরাইজা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে প্রস্তুত হয়। অথচ তারা মুসলমানদের তুলনায় অনেক অনুকূল ও ভালো অবস্থানে ছিল। দীর্ঘ অবরোধের ধকল সামাল দেওয়ার ক্ষমতা তাদের ছিল। কারণ তাদের পর্যাপ্ত কূপ, পানি ও খাদ্যসামগ্রী মজুদ ছিল। দুর্গও ছিল বেশ সুরক্ষিত ও দুর্ভেদ্য। অপরদিকে মুসলমানগণ খন্দকের যুদ্ধের পূর্ব থেকে যুদ্ধ-সংক্রান্ত কার্যাবলি চালিয়ে আসার কারণে যেমন চরম ক্লান্ত অবস্থায় ছিলেন, আবার বনু কুরাইজাকে অবরোধকালে দুর্গের বাইরে উন্মুক্ত আকাশের নিচে অবস্থানের ফলে তাদের তীব্র ক্ষুধার যন্ত্রণা এবং প্রচণ্ড শীতের কষ্টও ভোগ করতে হচ্ছিল। এটির পরও এমন কী ঘটেছিল যার কারণে তার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফয়সালা শিরোধার্য করে নিতে বাধ্য হয়। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করেন। ফলে তারা যুদ্ধ করার সাহস হারিয়ে ফেলে।

তাদের মনোবল ভেঙে পড়ে। এই ভাঙন চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়। তখন আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু ও জুবাইর ইবনুল আওয়াম রাযিয়াল্লাহু আনহু উচ্চৈঃস্বরে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে যান এবং আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু বলতে থাকেন, ‘হে ঈমানদার বাহিনী! আল্লাহর কসম, হয় হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মতো শাহাদাতের স্বাদ আস্বাদন করব অথবা তাদের দুর্গ জয় করে তাতে আমাদের বিজয়ের পতাকা উড্ডীন করব।’ আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বীরোচিত ওই ঘোষণায় তারা অতিমাত্রায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেকোনো সিদ্ধান্ত দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নিতে সম্মত হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ঘটনা অবহিত হয়ে বনু কুরাইজার পুরুষদের বন্দি করার নির্দেশ প্রদান করেন। ফলে তাদের মুহাম্মাদ ইবনে সালাম আল-আনসারি সাহাবির তত্ত্বাবধানে বেঁধে ফেলা হয়। তাদের নারী ও শিশুদের পুরুষদের নিকট থেকে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন করে একপাশে রাখা হয়।[60]

সাদ ইবনে মুআজ রহ.-এর ফায়সালা

খাযরাজ ও বনু কায়নুকা-এর মধ্যে যেমন মৈত্রী চুক্তির সম্পর্ক ছিল, খাযরাজের মোকাবেলায় আওস বনু কুরাইজার মধ্যেও তেমন ইসলাম-পূর্ব কাল থেকে মৈত্রী চুক্তির বন্ধন ছিল। সুতরাং বনু কুরাইজার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে নির্দেশ দেবেন, তাই তারা মেনে নেবে, এমন কথা জানার পর আওস গোত্র তাদের সাহায্যার্থে রাসুলের নিকট ছুটে এসে আবেদন করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ভাই খাযরাজ গোত্রের মিত্র বনু কায়নুকা-এর সঙ্গে ইতিপূর্বে যেমন ক্ষমার আচরণ করেছিলেন, আমাদের মিত্র বনু কুরাইজার সাথেও অনুরূপ আচরণ করার বিনীত অনুরোধ করছি।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা কি তাতে সন্তুষ্ট নও, তোমাদের মধ্য থেকেই একজন তাদের ব্যাপারে ফয়সালা দেবেন?’ তারা জি হ্যাঁ বলে স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি জ্ঞাপন করলে তিনি বললেন, ‘তোমাদের গোত্রপতি সাদ ইবনে মুআজকেই এই দায়িত্ব প্রদান করা হলো। তিনিই এই ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা দেবেন।’ তাতে তার সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলল, ‘তিনি (সাদ) যেই রায় প্রদান করবেন, আমরা তা মেনে নেব।’[61]

সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু খন্দকের যুদ্ধে হিব্বান ইবনে আল-অরিকা নামক এক কুরাইশ সৈন্যের নিক্ষিপ্ত তিরে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রাসুলের নির্দেশে মসজিদে নববিতে যুদ্ধাহত মুসলমানদের জন্য সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠিত চিকিত্সা শিবিরে রুফায়দা নামের এক নারী সাহাবির তত্ত্বাবধানে তখন পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছেন।[62] তিনি ছিলেন সুন্দর ও বলিষ্ঠদেহী। বনু কুরাইজা সম্বন্ধে চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বিচারক মনোনীত হলে তাকে আনার জন্য তার কওমের কয়েকজন লোক সেখানে গমন করে।

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ – Expedition of Abu Ubaidah ibn al Jarrah

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু কাতাদা ইবনে রিবঈ – Expedition of Abu Qatadah ibn Rab’i al-Ansari (Batn Edam)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবু সালামা – Expedition of Qatan

অতঃপর তারা একটা গাধার পৃষ্ঠে চামড়ার বালিশ স্থাপন করে তার উপর তাদের অসুস্থ নেতাকে আরোহণ করিয়ে রাসুলের দরবারে নিয়ে আসেন। পথিমধ্যে তার দুই পার্শ্বে চলমান আওস গোত্রের লোকজন তাকে বলতে থাকে, ‘হে আবু আমর! আপন মিত্রদের সাথে ভালো আচরণ করবেন। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সঙ্গে সদাচরণের জন্যই আপনাকে বিচারকের দায়িত্ব প্রদান করেছেন।’ তাদের এই আবেদনের প্রতি কোনো মনোযোগ না দিয়ে তিনি নীরব থাকেন। কিন্তু তারা যখন একই কথা বারবার বলতে লাগল, তখন তিনি বললেন, ‘ভাগ্যক্রমে সাদের জন্য আজ যথার্থ সিদ্ধান্ত প্রদানে আল্লাহর সন্তুষ্টির মোকাবেলায় কোনো ভর্ৎসনাকারীর ভর্ৎসনার পরওয়া না করার সুযোগ এসেছে।’[63]

একথা শ্রবণে তাদের অনেকেই বুঝে ফেলল, ‘তিনি হত্যারই নির্দেশ প্রদান করবেন।’[64] ফলে সেখান থেকেই তাদের কিছু লোক হতাশ হয়ে বনু আবদিল আশহাল-এর আবাসস্থালে প্রত্যাবর্তন করল। তাদের নিকট সাদের ওই উক্তি শ্রবণ করে বনু কুরাইজার পুরুষগণ বিলাপ করতে শুরু করল।

যাহোক, সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছালেন, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত সাহাবিদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমরা তোমাদের সরদারের উদ্দেশ্যে দণ্ডায়মান হও।’[65] মুহাজিরগণ মনে করলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারগণকে উদ্দেশ্য করেই এই নির্দেশ দিয়েছেন। আনসারগণ ভাবলেন, তিনি উপস্থিত সকল মুসলমানকে লক্ষ্য করেই তা বলেছেন।’[66] তখন তারা দাঁড়িয়ে গেলেন।

যখন তাকে অবতরণ করিয়ে নির্দিষ্ট আসনে বসানো হলো, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এ সকল লোক নিজেদের ফায়সালার ভার তোমার উপর অর্পণ করেছে।’ সাহাবিগণ বললেন, ‘এরা (বনু কুরাইজা) আপনার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে প্রস্তুত রয়েছে। আপনার যেকোনো আদেশ তারা শিরোধার্য করে নেবে।’ তিনি বললেন, ‘আমার হুকুম কি তাদের উপর কার্যকর হবে?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘মুসলমানগণের ক্ষেত্রে?’ তারা বললেন, ‘হ্যাঁ, মুসলমানদের ক্ষেত্রেও।’ এবার তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ইঙ্গিত করে তার সম্মানার্থে স্বীয় চেহারা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললেন, এখানে যিনি আছেন তার ক্ষেত্রেও কি আমার ফয়সালা গ্রহণযোগ্য হবে?’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার ক্ষেত্রেও।’ এবার সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাদের ব্যাপারে নিজের রায় ঘোষণা করলেন :

(ক) ‘যোদ্ধা পুরুষদের হত্যা করা হবে;

(খ) তাদের ধন-সম্পদ (মুসলমানদের মধ্যে) বণ্টন করা হবে;

(গ) তাদের শিশু ও নারীদের দাস-দাসীতে পরিণত করা হবে।’ এই রায় শ্রবণ করে আল্লাহর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তাদের ব্যাপারে অবশ্যই আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক ফয়সালা দিয়েছ।’[67]

তাওরাতের বিধান মোতাবেক ফায়সালা

বনু কুরাইজা সম্বন্ধে সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপরিউক্ত রায় ছিল হুবহু তাওরাতের বিধান অনুযায়ী, যা সম্পর্কে তারা ছিল পুরাপুরি ওয়াকিফহাল। তাওরাতে বর্ণিত সেই বিধান ছিল নিম্নরূপ,

‘যখন তুমি কোনো শহরের উপর আক্রমণের উদ্দেশ্যে তার নিকটে এসে উপনীত হবে, তখন প্রথমে সেই শহরের কর্ণধারের নিকট সন্ধির বার্তা পাঠাবে। যদি সে সন্ধির প্রস্তাবে সম্মত হয়ে তোমার জন্য শহরের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়, তাহলে সেথায় (সেই শহরে) যত লোককে পাওয়া যাবে, তারা সবাই তোমার করদাতা (প্রজা) ও দাস হয়ে যাবে। আর যদি সন্ধি না করে, বরং তোমার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তা হলে ওই শহর অবরোধ করে রাখবে। অনন্তর যখন তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু তা তোমার করায়ত্তে করে দেবেন, তখন সেখানকার সকল পুরুষকে খড়গ দ্বারা হত্যা করবে। অবশিষ্ট নারী, শিশু, জীবজন্তু এবং শহরের সকল জিনিস গনিমতের সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হবে। সুতরাং তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু প্রদত্ত ওই শত্রুসম্পদ লুট ভোগ করবে।’[68]

প্রাচীনকাল থেকেই ওই বিধান বনু ইসরাঈলের মধ্যে প্রচলিত ছিল। যেমন, তাওরাতের এক বর্ণনানুসারে তারা (বনু ইসরাঈল) মুসা আলাইহিস সালাম-এর উপর আল্লাহর প্রত্যাদেশ অনুসারে মাদয়ানবাসীর সাথে যুদ্ধ করে সেখানকার সকল পুরুষকে বধ করে। তাদের সাথে মাদয়ানের ইবি, রেশম, সুর, হুর ও রেবা নামক পাঁচ রাজাকে হত্যা করে। খড়গ দ্বারা হত্যা করে বিয়োরের পুত্র বিলিয়মকেও। তারা মায়ানের সকল স্ত্রীলোক ও বালক-বালিকাদের বন্দি করে নিয়ে যায়। তাদের সমস্ত পশু, মেষপাল ও সকল সম্পত্তি লুট করে নেয়। পুড়িয়ে ফেলে তাদের সমস্ত ছাউনি, বাসস্থান ও শহর।[69]

সুতরাং বনু কুরাইজার সম্বন্ধে সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ফয়সালা তাওরাতের ওই বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, যা তাদের পূর্বপুরুষ থেকেই প্রচলিত ও অনুসৃত হয়ে আসছিল। উক্ত ফয়সালাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসমানি ফায়সালা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ওই রায় শোনার পর স্বয়ং ইহুদিদের মুখ থেকে যা উচ্চারিত হয় তা থেকেও প্রমাণিত হয়, তারা নিজেরাও সেটাকে খোদায়ী বিধানের মতোই মনে করেছিল। নিম্নে তার দৃষ্টান্ত পেশ করা হলো, বনু কুরাইজা ফিতনার মূল হোতা হুয়াই ইবনে আখতাবকে ফয়সালা অনুযায়ী বধ করার জন্য উপস্থিত করা হলে সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেছিল, ‘আল্লাহর শপথ! তোমার সাথে যেই বৈরী আচরণ ও শত্রুতা করেছি, সেজন্য আমি আদৌ অনুতপ্ত নই। নিজেকে আমি ওইজন্য বিন্দুমাত্রও ভর্ৎসনা করি না, দিই না সামান্যতমও ধিক্কার। তবে যেই ব্যক্তি আল্লাহকে পরিত্যাগ করে আল্লাহও তাকে পরিত্যাগ করেন। অতঃপর উপস্থিত জনগণকে সম্বোধন করে সে বলে, আল্লাহর বিধান পালনে আমার কোনো অসুবিধা নেই, নেই কোনো আপত্তি। এ তো (সাদ-এর ফায়সালা) পূর্ব নির্ধারিত এক খোদায়ী বিধান এবং আল্লাহ কর্তৃক বনু ইসরাঈলের ভাগ্যে লিপিবদ্ধ এক অলঙ্ঘনীয় শাস্তি।’[70]

আরো পড়ুন : সাফওয়ানা অভিযান – First Expedition to Badr (Safwan)

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস রা. – Expedition of Abdullah Ibn Unais

আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা রা. – ‘Abdullah ibn Hudaffa

দণ্ডাদেশ কার্যকর

সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ঘোষিত রায় কার্যকর করার লক্ষ্যে আল্লাহর রাসুলের নির্দেশক্রমে প্রথমত বনু কুরাইজার প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষগণকে মদিনার বনু নাজ্জার গোত্রের এক আনসার নারী হারেস-কন্যা কানীসা-এর বাড়িতে বন্দি করে রাখা হয়। তাদের জন্য খনন করা হয় পরিখা। অতঃপর উক্ত পরিখাসমূহে একের পর এক নিয়ে গিয়ে তাদের শিরচ্ছেদ করা হতে থাকে। একপর্যায়ে বন্দিশালার অবশিষ্ট বন্দিগণ তাদের নেতা কাআব ইবনে আসাদকে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হবে বলে আপনার মনে হয়?’ উত্তরে সে বলল, ‘তোমরা কি সর্বক্ষেত্রেই নির্বোধ? কিছুই বোঝো না? দেখছো না, আহ্বানকারী তোমাদের যাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে সে আর ফিরে আসছে না? আল্লাহর কসম! আমাদের হত্যাই করা হবে’।[71]

ঐতিহাসিকদের বর্ণনানুযায়ী বা কুরাইজার গোত্রপতি কাআব ইবনে আসাদসহ তাদের ছয় থেকে সাত, মতান্তরে আট থেকে নয়শত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের শিরচ্ছেদ করা হয়।[72] তবে তিরমিজি, নাসায়ি প্রভৃতি হাদিস গ্রন্থে চারশত এবং ইবনে আসাকির-এ তিনশত যোদ্ধাকে হত্যা করা হয় বলে উল্লিখিত হয়েছে।[73]

এই সংখ্যা আরও অনেক কম ছিল বলে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ অনেক যুক্তি-প্রমাণ পেশ করেন। তাদের সঙ্গে বনু নাজির গোত্রপতি, আহজাব যুদ্ধের শীর্ষ পর্যায়ের এক অপরাধী, উম্মুল মুমিনিন সাফিয়্যা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পিতা হুয়াই ইবনে আখতাব, যার প্ররোচনায় বা কুরাইজা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করে খন্দক যুদ্ধে আরব মুশরিকদের পক্ষাবলম্বন করেছিল, কুরাইজা গোত্রপতি কাআবকে প্ররোচিত করার সময় বিপদে তার পাশেই থাকার যেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা রক্ষার্থে অবরোধের পূর্ব থেকেই সে বনু কুরাইজার সঙ্গে তাদের দুর্গেই অবস্থান করে আসছিল, তাকেও হত্যা করা হয়। হত্যার পূর্বে স্কন্ধের সঙ্গে দুই হাত রশি দ্বারা বাঁধা অবস্থায় বন্দিশালা থেকে বের করে পরিখার পার্শ্বে উপস্থিত করা হলে সে (হুয়াই) রাসুলের নিকট কৃত অপরাধে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত হয়নি। সে পূর্বেই নিজের পরিধেয় বস্ত্র চতুর্দিক থেকে এক বিঘত পরিমাণ ছিড়ে ফেলেছিল, যাতে তা কেউ লুণ্ঠন করতে না পারে।[74] খাল্লাদ ইবনে সুওয়ায় নামক একজন মুসলমানকে পেষণযন্ত্র বা প্রস্তর নির্মিত জাতা নিক্ষেপ করে হত্যা করার অপরাধে ‘বুনানা’ নামক বনু কুরাইজার কেবল একজন নারীকে হত্যা করা হয়।[75] তার স্বামীর নাম ছিল হাকাম আল-কুরাজি।[76]

উক্ত নারী যেই সাহসিকতার সঙ্গে প্রাণ দেয়, বিস্ময়কর ভাবলেশহীন চিত্তে যেভাবে মৃত্যুকে বরণ করে—তা আবু দাউদ ও সিরাতে ইবনে হিশামে নিম্নে উল্লেখিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। যাদের হত্যা করা হবে, তাদের তালিকায় নিজের নাম থাকার কথা ওই নারী পূর্ব থেকে জানত। হত্যাস্থানে একেকজন অপরাধী নামানুসারে পর্যায়ক্রমে যাচ্ছিল এবং মৃত্যুর শাস্তি গ্রহণ করছিল। ঘোষক একেকজনের নাম ধরে ডাকছিল, উক্ত ধ্বনি তার কর্ণে এসে পৌঁছাচ্ছিল। তার পরও একান্ত স্বাভাবিক অবস্থায় আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সঙ্গে সে আলাপচারিতায় লিপ্ত ছিল এবং কথায় কথায় হাসছিল, কখনো সশব্দে আবার কখনো মুখ চেপে। হঠাৎ তার নামের ডাক পড়লে সে ভাবলেশহীন চিত্তে উঠে দাঁড়ায়। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার! তোমার কী হলো? কোথায় যাচ্ছ?’ সে বলল, ‘আমি এক ঘটনা ঘটিয়েছিলাম, করেছিলাম এক অপরাধ, তার শাস্তি ভোগ করতে যাচ্ছি। আমাকে এখন হত্যা করা হবে। এই বলে সে প্রফুল্ল ও সন্তুষ্টচিত্তে হত্যাস্থলে এসে তরবারির নিচে মাথা রাখে।’ আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু এই ঘটনা যখনই বর্ণনা করতেন, ভাষায় ও বর্ণনায় তার বিস্ময়ের প্রকাশ ঘটত। তিনি বলতেন, ‘আল্লাহর শপথ! অচিরেই হত্যার সম্মুখীন হতে হবে এটি জানা সত্ত্বেও পূর্বক্ষণে আমার সম্মুখে অধিক হাস্য, প্রফুল্লতা ও আনন্দোলতার যেই বিস্ময়কর স্মৃতি উক্ত নারী রেখে গেছে—তা আমি আজও ভুলিতে পারিনি।’[77]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ ছিল শুধু প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষগণকে হত্যা করার। এজন্য কিশোর আতিয়া আল-কুরাজি অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে মৃত্যুদণ্ড থেকে মুক্তিলাভ করে। জীবিত ছাড়া পেয়ে সে ইসলাম গ্রহণ করে।[78] অপরদিকে রিফাআ ইবনে সামওয়াল আল-কুরাজি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও বেঁচে যায়, প্রাণে রক্ষা পায় শুধু সালমা বিনতে কায়েস নামক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক খালার একান্ত আবেদনের ভিত্তিতে। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে উভয় কিবলামুখী হয়ে নামাজ আদায় করেছিলেন এবং তার কাছে বায়আত গ্রহণ করেন। তার আবেদনের কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রিফাকে জন্য তিন অংশ অর্থাৎ অশ্বের দুই অংশ এবং অশ্বারোহীর জন্য এক অংশ নির্ধারণ করেন। পদাতিক সৈন্যের জন্য এক অংশ ধার্য করেন। যুদ্ধলব্ধ সম্পদে দুই অংশ নির্ধারণ এবং পঞ্চমাংশ পৃথক করার এটিই ছিল প্রথম ঘটনা। বণ্টনের ওই নিয়মই তখন থেকে প্রবর্তিত হয় এবং ওই ধারাই পরবর্তী সময়ে চালু থাকে।[79] প্রাপ্ত সকল সম্পত্তি ৩ হাজার ৭২ অংশে বিভক্ত হয়।[80]

আরো পড়ুন : মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রা.-এর অভিযান – Expedition of Muhammad ibn Maslamah

আরো পড়ুন : যুল ক্বাসসাহর দ্বিতীয় অভিযান – Second expedition of Zul Qassah

আরো পড়ুন : যুল ক্বাসসাহর প্রথম অভিযান – First expedition of Dhul Qassah

বনু কুরাইজার অধিবাসীদের মধ্যে মুষ্টিমেয় এমন কিছু লোক ছিল, যারা অবরোধের শেষপ্রান্তে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেকোনো নির্দেশ মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ব রাতেই ইসলাম গ্রহণ করেন। ফলে তাদের জীবন, সম্পদ ও স্ত্রী-পুত্রদের রক্ষা করা হয়। তারা যাবতীয় ক্ষতি থেকে নিষ্কৃতি পায়। আমর ইবনে সুদা নামে তাদের মধ্যে এমন এক সৌভাগ্যবান ব্যক্তিও ছিল, যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতায় বনু কুরাইজার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেনি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিরাপত্তা বাহিনী প্রধান মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা উক্ত রাতে দুর্গ থেকে তাকে বের হতে দেখেন এবং তাকে চিনতে পেরে ছেড়ে দেন।।[81] এভাবে বনু কুরাইজার কিছুসংখ্যক লোক শাস্তি থেকে রক্ষা পায়। বনু কুরাইজার ঘটনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন,

وَأَنْزَلَ الَّذِينَ ظَاهَرُوهُمْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ مِنْ صَيَاصِيهِمْ وَقَذَفَ فِي قُلُوبِهِمُ الرُّعْبَ فَرِيقًا تَقْتُلُونَ وَتَأْسِرُونَ فَرِيقًا (২৬) وَأَوْرَثَكُمْ أَرْضَهُمْ وَدِيَارَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ وَأَرْضًا لَمْ تَطَئُوهَا وَكَانَ اللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرًا (২৭)

‘কিতাবিদের মধ্যে যারা তাদের সাহায্য করেছিল, তাদের তিনি দুর্গ থেকে অবতরণ করালেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন। এখন তোমরা তাদের কতককে হত্যা করেছে এবং কতককে করেছ বন্দি। আর তিনি তোমাদের অধিকারী করলেন তাদের ভূমি, ঘরবাড়ি ও ধনসম্পদের এবং এমন ভূমির—যা তোমরা এখনও পদানত করোনি। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’[82]

একটি ভুল ধারণার অপনোদন

ইসলাম বিরোধী শিবির বনু কুরাইজাকে শান্তি সম্বন্ধে নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারের জোর আপত্তি তুলেছে। তারা শুধু ঘটনার খোলস তথা বাইরের দিকটাই দেখেছে। তার অভ্যন্তরে তলিয়ে দেখেনি, শাস্তির রূপকেই প্রাধান্য দিয়েছে, তার কারণ নিয়ে পর্যালোচনা করেনি। যদি তারা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বনু কুরাইজার আচরণ গভীরভাবে পর্যালোচনা করত, তাহলে কোনোভাবেই নিষ্ঠুরতার অপবাদ উত্থাপন করত না। নিম্নে প্রকৃত ব্যাপার তুলে ধরা হচ্ছে, যার দ্বারা বুঝা যাবে, কেন তাদের বিরুদ্ধে সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উপরিউক্ত রায় প্রদান করেছিলেন।

(১) মদিনায় পৌঁছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইজার সঙ্গে সদয় আচরণ করেন এবং মৈত্রী চুক্তি স্থাপন করেন।

(২) তিনি তাদের সঙ্গে যেই চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন, তাতে তাদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং জানমাল রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছিল।

(৩) বনু কুরাইজা বনু নাজির অপেক্ষা কম মর্যাদাসম্পন্ন হিসেবে বিবেচিত ছিল। বনু নাজিরের কারো দ্বারা বনু কুরাইজার কেউ নিহত হলে তার রক্তপণ ছিল অর্ধেক। অপরদিকে বনু কুরাইজার দ্বারা বনু নাজিরের কেউ নিহত হলে কুরাইজার ইহুদিদের পূর্ণ রক্তপণ পরিশোধ করতে হতো। মানবতার মুক্তির দূত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইজাকে এই সামাজিক বৈষম্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেন। তিনি তাদের মর্যাদা বা নাজিরের সমান করে দেন।[83]

(৪) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু নাজিরকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করার পর বনু কুরাইজার সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করেন। পুনরায় চুক্তির মাধ্যমে তিনি তাদের স্বীয় বাসস্থানে অবস্থানের সুযোগ প্রদান করেন।

(৫) তাদের সঙ্গে এত ভালো আচরণ করার পরও মুসলমানগণ যখন তাদের জীবনের সর্বাপেক্ষা কঠিন মুহূর্ত অতিক্রম করছেন, ইসলাম বিরোধী বহিঃশত্রুর সম্মিলিত আক্রমণ থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার লক্ষ্যে একাধারে কয়েকদিন ক্ষুধার্ত অবস্থায় দীর্ঘ পরিখা খননের মাধ্যমে রণপ্রস্তুতিতে একেবারে ক্লান্ত ও অবসন্নপ্রায়, ঠিক এমন সংকটময় পরিস্থিতি ও নাজুক অবস্থায় তারা মদিনার ভেতরে থেকেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে এবং মুসলমানগণকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য ইহুদি-কুরাইশ সামরিক শক্তির পক্ষাবলম্বন করে।

(৬) মুসলিম নারী ও শিশুদের হেফাজতের জন্য তাঁবুতে প্রেরণ করা হলে তারা তাদের উপর আক্রমণ করতে উদ্যত হয়।[84]

(৭) জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়াও এই অকৃতজ্ঞগোষ্ঠী মুসলমানগণের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য পনেরোশত তরবারি, দুই হাজার বর্শা-বল্লম, তিনশত বর্ম ও পনেরোশত ঢাল সংগ্রহ করে রেখেছিল—যা তাদের দুর্গ বিজিত হওয়ার পর মুসলিম বাহিনীর হস্তগত হয়।[85]

(৮) খন্দক যুদ্ধের মূল উসকানিদাতা হুয়াই ইবনে আখতাব—যাকে বিদ্রোহের অপরাধে মদিনা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এবং যে গোটা আরবকে উসকানি দিয়ে আহজাব (খন্দক) যুদ্ধের আয়োজন করেছিল, বনু কুরাইজা এমন রাষ্ট্রদ্রোহী শত্রু নিজেদের সঙ্গে রেখে গাদ্দারি ও হঠকারিতার পরাকাষ্ঠা দেখায়। এমতাবস্থায় তাদের সঙ্গে উপরিউক্ত আচরণ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। তারা নিজেদের কুকর্মের ফলে সর্বাপেক্ষা জঘন্য যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে গণ্য হয়েছিল, যাদের প্রাপ্য কেবল মৃত্যুদণ্ডই।[86]

আরবে চুক্তির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। মৈত্রী চুক্তিকে প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের সমতুল্য মনে করা হতো। মৈত্রী বন্ধনের ফলে রক্তের সম্পর্কের মতো অনেক সময় গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হতো। বনু কুরাইজার মিত্র আওসের অবস্থা ছিল ঠিক অনুরূপ। তারা মনেপ্রাণে চাচ্ছিল, বনু কুরাইজা যেন কোনোরূপ শাস্তির সম্মুখীন না হয়। তাদের সঙ্গে যেন ক্ষমা সুন্দর আচরণ করা হয়। তাদের ব্যাপারে আওস গোত্ৰপতি সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-র পেরেশানিও কম ছিল না। চুক্তির ব্যাপারে তিনিই ছিলেন প্রকৃত জিম্মাদার। তাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন তাদের বড় হিতাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু এই হতভাগ্য জাতির অপরাধ এতই মারাত্মক ছিল—এত কিছুর পরও তার (সাদ) পক্ষে উপরিউক্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।[87] অপরাধ অনুপাতে সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ফয়সালা ছিল পুরাপুরি ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক। তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। এই ঘটনার উপর আলোকপাত করতে গিয়ে R.v.c Bodley তার The Messenger The life of Muhammad নামক বিখ্যাত গ্রন্থে লেখেন,

আরো পড়ুন : বদরের যুদ্ধ – Battle of Badr

আরো পড়ুন : বনু সুলাইম অভিযান – Al Kudr Invasion

আরো পড়ুন : বাতনে রাগিব অভিযান – Expedition of Ubaydah ibn al-Harith

‘মুহাম্মাদ আরবে একা ছিলেন। এই ভূখণ্ড আকার-আয়তনের দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক-তৃতীয়াংশ এবং এটির লোকসংখ্যা ছিল পঞ্চাশ লাখ। তাদের নিকট এমন কোনো সৈন্যবাহিনী ছিল না, যারা জনসাধারণকে আদেশ পালনে ও আনুগত্য প্রদর্শনে বাধ্য করতে পারে, কেবল একটা ক্ষুদ্র সেনাদল ছাড়া, যার সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার। এই বাহিনীও আবার পরিপূর্ণরূপে অস্ত্রসজ্জিত ছিল না। এমতাবস্থায় যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনোরূপ শৈথিল্য কিংবা গাফলতিকে প্রশ্রয় দিতেন এবং বনু কুরাইজাকে তাদের বিশ্বাস ভঙ্গের কোনোরূপ শাস্তি দান ব্যতিরেকে ছেড়ে দিতেন, তাহলে আরব উপদ্বীপে ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হতো। তাতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইহুদিদের হত্যার ব্যাপার খুবই কঠিন ছিল। কিন্তু ইহুদিদের ধর্মীয় ইতিহাসে তা কোনো নতুন ব্যাপার ছিল না। আবার মুসলমানগণের দিক থেকে ওই কাজের পেছনে পূর্ণ বৈধতা ও অনুমোদন বর্তমান ছিল।[88] স্যার স্ট্যানলি লেনপুল বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, তাদের অপরাধ ছিল দেশের সঙ্গে গাদ্দারি এবং তা-ও আবার অবরোধের মতো সংকটময় অবস্থায়।’[89]

সুদূরপ্রসারী প্রভাব

উদীয়মান ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপরিউক্ত রায়ের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। উক্ত ফয়সালা কার্যকর হওয়ার ফলে মদিনা ইহুদি ষড়যন্ত্র, প্রতারণা ও বিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিতিশীলতা থেকে মুক্ত ও নিরাপদ হয়ে যায়। মুসলমানগণের জন্য পেছন থেকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দূরীভূত হয়ে যায়। এই ঘটনার পর মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনোরকম অভ্যন্তরীণ চক্রান্ত মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে তারা পূর্বাপেক্ষা নিশ্চিন্ত জীবনের স্বাদ আস্বাদন করতে শুরু করেন। এরপর ভেতর ও বাইরের শত্রুর আক্রমণের থাবা থেকে মদিনা অধিকতর নিরাপদ ও সুরক্ষিত হয়ে ওঠে।

সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হওয়ার ফলে অপরাপর আরব গোত্রসমূহও কোনোরূপ চুক্তি ভঙ্গ ও গাদ্দারি করার পূর্বে বারবার চিন্তা-ভাবনা করতে বাধ্য হয়। কেননা এটির পরিণতি কত মারাত্মক হতে পারে, তা তারা স্বচক্ষেই দেখেছিল এবং তারা খুব ভালো করেই জানত যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ফয়সালা কার্যকর করার ক্ষমতা রাখেন।[90]

মদিনার ইহুদিদের সর্বশেষ ঘাঁটি বনু কুরাইজার দুর্গ পতনের পর মুনাফিক শিবির স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে যায়। তাদের তৎপরতায় ভাটা পড়ে ও মনোবল ভেঙে যায়। ড. ইসরাঈল ওয়েলফিন্সন-এর মতে, ‘বনু কুরাইজার পতনের পর মুনাফিকদের স্বর নিচে নেমে আসে।’[91]

কুরাইজার যুদ্ধে নিহত ইহুদিদের সংখ্যা

 সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সিদ্ধান্ত অনুসারে বনু কুরাইজার একদলকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এবং আরেক দলকে বন্দি করা হয়। কিন্তু সেদিন ঠিক কতজন ইহুদিকে হত্যা করা হয়, সেই ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক তাদের সংখ্যা হয় শত; হয়তো নয়শত পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়েছেন—যা ইউরোপীয় লেখকগণকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্রে কালিমা লেপনে রসদ যুগিয়েছে। নিম্নোক্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিহতদের প্রকৃত ও নির্ভরযোগ্য সংখ্যা পাওয়া যাবে;

কুরাইজা গোত্রে অভিযানকালে তাদের পুরুষদের সংখ্যা কত ছিল—তা তিরমিজি ও নাসায়িসহ প্রভৃতি হাদিসগ্রন্থে বিশ্বস্ত সূত্রে জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক এভাবে বর্ণিত হয়েছে,

‘তাদের (পুরুষদের) সংখ্যা ছিল চারশত’। অতঃপর তাদের হত্যার পর সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইনতেকাল করেন। এই চারশত পুরুষের মধ্যে যারা যুদ্ধে লিপ্ত বা যুদ্ধে লিপ্ত থেকে সক্ষম; কেবল তাদের সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হত্যার আদেশ দেন। বুখারি ও মুসলিম শরিফে সাদের এতৎসংক্রান্ত উক্তিই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ বহন করে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যুদ্ধে নিযুক্ত বা যুদ্ধ করতে সক্ষম পুরুষদের হত্যার আদেশ করছি।’ সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এই উক্তিতে প্রাপ্ত এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সকল পুরুষ যোদ্ধাকে হত্যা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল, যা স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মধ্য থেকে কেবল প্রাপ্তবয়স্কদেরকে হত্যার নির্দেশ প্রদান করেছেন।[92] অপ্রাপ্তবয়স্কদের বন্দি করে রাখা হয়।[93] অতঃপর তাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুক্ত করে দেন। এদের মধ্য থেকে আতিয়া আল-কুরাজির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ও তার কয়েকজন সঙ্গী প্রাণে রক্ষা পেয়ে মুসলমান হন।[94] প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইনে আসাকির কুরাইজার ঘটনা প্রসঙ্গে একটি হাদিস বর্ণনা করেন, নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের তিনশত পুরুষ হত্যা করলেন এবং অবশিষ্ট লোকদের বললেন, ‘তোমরা সিরিয়া প্রদেশে চলে যাও। অবশ্য আমি তোমাদের গতিবিধির সন্ধান রাখব। অতঃপর তিনি তাদের সিরিয়াতে পাঠিয়ে দিলেন।’[95]

আরো পড়ুন : গাজওয়া হুনাইন – Battle of Hunayn

আরো পড়ুন : গাজওয়াতুল বুহরান – Invasion of Buhran

আরো পড়ুন : নাখলা অভিযান – Nakhla Raid

সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শাহাদাতবরণ

খন্দক যুদ্ধে আহত হওয়ার পর সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি ভালোভাবেই জানো, আমার নিকট এটি অপেক্ষা প্রিয় আর কিছুই নেই, আমি তোমার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ওই কওমের সঙ্গে জিহাদ করব—যারা তোমার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অস্বীকার করেছে। হে আল্লাহ! আমার মনে হয় তুমি আমাদের ও তাদের মধ্যে যুদ্ধের উপসংহার টেনেছ। যদি কুরাইশদের সঙ্গে এখনও যুদ্ধের কোনো কিছু অবশিষ্ট থাকে, তাহলে আমাকে জীবিত রাখো যাতে তোমার রাস্তায় তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারি। আর যদি তুমি যুদ্ধ শেষ করে থাকো, তাহলে আমার এই ক্ষত থেকে রক্ত প্রবাহিত করো এবং এটিকে আমার শাহাদাতের উসিলা বানিয়ে দাও।’[96]

শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে তিনি যেই দোয়া করেছিলেন—তা কবুল হয়, বনু কুরাইজার যাবতীয় ব্যাপার সম্পন্ন হওয়ার পর তার ফলাফল প্রকাশ পায়। তাদের করুণ পরিণতি অবলোকন করে তার চক্ষু শীতল হয়। অতঃপর তার জখম থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বর্ণনা অনুযায়ী তার বক্ষ থেকে প্রবলবেগে রক্ত বের হয়। তিনি তখন মসজিদে অবস্থান করছেন। উক্ত মসজিদে তার পাশেই ছিল বনু গিফার-এর একটি তাঁবু। সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দিক থেকে হঠাৎ রক্তের স্রোতধারা নিজেদের দিকে আসতে দেখে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত ও বিচলিত হয়ে পড়ে। তারা হতবিহ্বল চিত্তে শিবিরস্থ লোকদের জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমাদের দিক থেকে এটি কী আসছে?’ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দেহের ক্ষত থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। প্রচুর রক্তক্ষরণে তিনি সেখানেই ইনতেকাল করেন।[97] জিবরাঈল আলাইহিস সালাম-এর মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মৃত্যুর সংবাদ পান। জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুলকে বলতে শুনেছি, সাদ ইবনে মুআজের মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছে।’[98]

এই ব্যাপারে এক আনসারি রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিম্নলিখিত কবিতাংশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য,

وَمَا اهْتَزَّ عَرْشُ اللَّهِ مِنْ مَوْتِ هَالِكٍ … سَمِعْنَا بِهِ إِلَّا لِسَعْدٍ أَبِي عَمْرٍو

‘আমরা আবু উমর সাদ ছাড়া কোনো ব্যক্তির মৃত্যুতে আল্লাহর আরশের কম্পনের কথা শুনিনি।’[99]

বনু কুরাইজাকে অবরোধকালে খালিদ ইবনে সুওয়াইদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নামক একজন সাহাবি বুনানা নামক কুরাইজার এক নারীর নিক্ষিপ্ত যাতা (চাকতি)-র আঘাতে নিহত হন। তাকে তিনি দুজন শহিদের মর্যাদা পাবেন বলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুসংবাদ দেন।[100] অবরোধকালে উক্কাশার ভাই আবু সিনান ইবনে মিহসান নামক অপর এক সাহাবিও ইনতেকাল করেন। বনু কুরাইজার কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।[101]

আরো পড়ুন : গাজওয়া যু-আমর – Dhu Amarr raid

আরো পড়ুন : গাজওয়া সারিয়্যা আর-রাজি – Expedition of Al Raji

আরো পড়ুন : গাজওয়া হামরাউল আসাদ – Battle of Hamra al-Asad

তথ্যসূত্র

 

[1]. শিবলি নোমানি, সিরাতুন নবী : ১/২৫৩

[2]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/৫০৩-৪; আবুল হাসান আলি নদভী, নবীয়ে রহমত : ২৭১

[3]. সহিহ মুসলিম : ২/৯৪

[4]. সিরাতুন নবী : ১৩/২৫৩

[5]. মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা : ২/৩১৫

[6]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৩

[7]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৩

[8]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৩৮-৩৯; আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৩; নবীয়ে রহমত : ২৭১; মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা : ২/৩১৫

[9]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৩৯; আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৪; নবীয়ে রহমত : ২৭১: সিরাতুন নবী : ২৪৬

[10]. মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা : ২/৩১৬

[11]. নবীয়ে রহমত : ২৭১

[12]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৪; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৪০; জুরকানি : ১২/১১১; মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা : ২/৩১৬

[13]. ৩৩: ১০-১১

[14]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/১২৪

[15]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৪৩; সিরাতুল মুস্তাফা : ২/৩১৯; আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৩

[16]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৩

[17]. সিরাতুন নবী : ১/২৫৩

[18]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৭

[19]. মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা : ২/৩২৩

[20]. জুরকানি : ২/১২৬; মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা : ২/৩২৩

[21]. আসাহহুস সিয়ার : ১৫৩

[22]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/১১৮

[23]. ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ২/৫৩

[24]. ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১২০

[25]. আল-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১১৯-১২০

[26]. আল-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১১৯-২০

[27]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৪৫

[28]. মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা : ২/৩২৪

[29]. সহিহ বুখারি : ২/৫৯১

[30]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩ /১৪৮; আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৮

[31]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৪৯; আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৮

[32]. আল-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১১৮

[33]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৪৯; আল-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১২১

[34]. আল-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১২১

[35]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৪৯; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১২২

[36]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৮

[37]. তাবাকাতে ইবনে সাআদ : ২/৭৪

[38]. সহিহ বুখারি : ২/৫৯১; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১২১; মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা : ২/৩২৪

[39]. ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/ ১২১

[40]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৮

[41]. ফাতহুল বারি : ৭/৩১৬; মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ২/৩২৫

[42]. সিরাতুন নবী : ১/২৫৩

[43]. তারিখে ইসলাম : ৬৯

[44]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৪৯; আল-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১২০

[45]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৪৯

[46]. ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১২২; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৫৩

[47]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৯

[48]. ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১২১

[49]. আল-কামিল ফিত তারিখ : ২/৭৫

[50]. ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১২১

[51]. রুহুল মাআনি : ৯/১৯৫

[52]. আল-আন-ফাল, ৮ : ২৭

[53]. ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১২২; মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা : ৩২৬-২৭; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ১৫১

[54]. আল-কামিল ফিত তারিখ : ২/৭৫

[55]. ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১২১

[56]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৫১; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১১৯

[57]. আল-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১২২; ইবনু হিশাম : ওই ১৫২

[58]. ৯: ১০২; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৫২; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১২২

[59]. ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ঐ, ১২২-১২৩; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ঐ, ১৫২

[60]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৮৯

[61]. আল-কামিল ফিত তারিখ : ২/৭৫; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১২৩

[62]. বিদায়া, ৪/১২৩; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ঐ, ১৫৩

[63]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ঐ, ১৫৩; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ঐ, ১২৩; আল-কামিল ফিত তারিখ : ২/৭৬

[64]. আল-কামিল ফিত তারিখ : ২/৭৬

[65]. সহিহ বুখারি : ২/৫৯১; আবু দাউদ : ৫/৩৯১; মুসলিম : ২/৯৫; আল-কামিল ফিত তারিখ : ২/৭৬; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১২৩; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ১৫৩

[66]. ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১২৩

[67]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩২, ১৫৩; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১২৩

[68]. দ্বিতীয় বিবরণ, অধ্যায় ২০, পদ ১০-১৪; পবিত্র বাইবেল, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা-১৯৭৩; সিরাতুন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ২৫৩

[69]. পবিত্র বাইবেল, গণনা পুস্তক, ৩১ অধ্যায়, ৭-১০ পদ, বাইবেল সোসাইটি বাংলাদেশ, ঢাকা ১৯৭৩; নবীয়ে রহমত : ২৭৫

[70]. সিরাতুন নবী : ১/২৫৪; আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৯১

[71]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৯০

[72]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৯০; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৫৪

[73]. মাওলানা তাফাজ্জুল হোসেন, মুহাম্মাদ মুস্তফা : ৬৩১; মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মোস্তফা চরিত : ৭১৩-৭১৫

[74]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৯১

[75]. মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা : ২/৩২৯; আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৯১

[76]. ইবনু সাইয়্যিদিন নাস, উয়ুনুল আসার : ২/৭৮

[77]. আবু দাউদ : ২/১৪; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/১৫৫

[78]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ঐ, ১৫৭

[79]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ঐ, ১৫৭; আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৯১; জুরকানি : ২/১৩৭

[80]. ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ২/৭৫

[81]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৯১

[82]. ৩৩: ২৬, ২৭

[83]. আবু দাউদ : ২/২৭৭

[84]. সিরাতুন নবী : ১২, ২৫৪

[85]. ইবনু সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ৭৫

[86]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৯০

[87]. সিরাতুন নবী : ২৫৫

[88]. The Messenger The life of Muhammad, London ১৯৪৬, P. ২০২-২০৩; নবীয়ে রহমত : ২৭৭

[89]. Selection from the Quran, P. xv

[90]. The Messenger The life of Muhammad, London ১৯৪৬, P. ২০২-২০৩; নবীয়ে রহমত : ২৭৭

[91]. নবীয়ে রহমত : ২৭৭

[92]. ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ৩/১৩২; আবু দাউদ : ৪৪০৪; ইমাম তিরমিজি, জামে তিরমিজি : ১৫৪৮; ইবনে মাজাহ : ৪৫৪১

[93]. ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ৩/১৩২; আবু দাউদ : ৪৪০৪; ইমাম তিরমিজি, জামে তিরমিজি : ১৫৪৮; ইবনে মাজাহ : ৪৫৪১

[94]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ২৯১

[95]. মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মোস্তফা চরিত, ৪৭১-৪৭২; কানযুল উম্মাল, ৫/২৮২

[96]. সহিহ বুখারি : ২/৫৯১; মুসলিম : ২/৯৫

[97]. সহিহ বুখারি : ২/৫৯১; মুসলিম : ২/৯৫; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৬৩

[98]. সহিহ বুখারি : ১/৫৩৬; মুসলিম : ২/২৯৪; ইমাম তিরমিজি, জামে তিরমিজি : ২/২২৫

[99]. ইসতিআব : ২/৩২; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৬৩

[100]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৬৪

[101]. আর-রাহিকুল মাখতুম : ১৯২

শেয়ার করুন

সূচীপত্র

error: Content is protected !!