৩৩. (২০) গাজওয়া বনু লিহ্য়ান – Invasion of Banu Lahyan
২০. গাজওয়া বনু লিহ্য়ান | |||||||
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত গাজওয়া : ২০ | |||||||
|
|||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
মুসলমান | বনু লিহয়ান | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম | অজানা | ||||||
শক্তি | |||||||
২০০ জন | অজানা |
বনু লিহয়ান পরিচিতি
বনু লিহয়ান বা বনু লাহয়ান কুরাইশের অন্যতম পূর্বপুরুষ মুদার ইবনে নিযারের প্রপৌত্র হুজাইলের বংশধর।[1] আরব বংশবিশারদ হামদানির মতে, তারা মূলত জুরহুমের সন্তান-সন্ততি। কিন্তু হুজাইল গোত্রে অনুপ্রবেশ করেছিল বলে তাদেরকেও হুজাইলের দিকে সম্বন্ধ করা হতো।[2] বনু লিহয়ান হিজাজের বিস্তীর্ণ উপত্যকা গুরানে বসবাস করত। এটি ওয়াদিল-আযক নামেও পরিচিত ছিল। এটি মক্কার নিকটে আজ ও উসফানের মধ্যে সায়াহ পর্যন্ত বিস্তৃত ৫ মাইল ব্যাপী একটি বিশাল জনপদ।[3]
মানচিত্র (৩৪) : গাজওয়া বনু লিহ্য়ান অবস্থান স্থল
গাজওয়া বনু লিহ্য়ান
তার হিজরি ৪র্থ সনের সফর মাসে (মে, ৬২৫ খ্রি.) রাজি নামক স্থানে প্রতারণার মাধ্যমে আসিম ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু ও তার সফরসঙ্গীকে গ্রেফতার করে, জায়েদ ও খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বন্দি করে মক্কায় নিয়ে যায় এবং নৃশংসভাবে হত্যা করে। পরে ওই দুজনকেও হত্যা করে। এর অব্যবহিত পরে সেই একই মাসে, মতান্তরে এর পূর্ববর্তী[4] মুহাররম মাসে হুযায়ল গোত্রের এলাকার অন্তর্গত বিরে মাউনায় ৭০ জন কুরআন বিশেষজ্ঞ সাহাবি অনুরূপভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে নৃশংসভাবে শাহাদাতবরণ করেন।[5] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুটি ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত হন। তাই তিনি এই শহিদদের রক্তের প্রতিশোধ নেবার জন্য মদিনায় আবদুল্লাহ ইবনু উম্মে মাকতুম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তার স্থলাভিষিক্ত করে নিজেই ২০ জন অশ্বারোহীসহ ২০০ জন আনসার ও মুহাজির সমভিব্যাহারে বনু লিহয়ানের উদ্দেশে অভিযানে বের হন।[6]
আরো পড়ুন : গাজওয়া তায়েফ – Siege of Ta’if
আরো পড়ুন : গাজওয়া দুমাতুল জানাদাল – Expedition of Dumat al-Jandal
আরো পড়ুন : গাজওয়া ফাতহ মক্কা (মক্কা বিজয়) – Conquest of Mecca
কখন সংঘটিত হয়
এই অভিযান কোন সনে এবং কোন মাসে সংঘটিত হয়, সে সম্পর্কে সিরাতবিশারদ ও ইতিহাসবিদদের বিভিন্ন মত পরিলক্ষিত হয়। ইবনে সাদের মতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬ষ্ঠ হিজরির ১লা রবিউল আওয়াল (জুলাই, ৬২৭ খ্রি.) বনু লিহয়ানের উদ্দেশে বের হন।[7] ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, ইবনুল আসির, তাবারি ও ইবনে আবদুল বার প্রমুখ প্রসিদ্ধ সিরাতবেত্তাদের মতে, এটি হিজরি ৫ম সনের জিলহজ মাসে (এপ্রিল-মে, ৬২৭ খ্রি.) সংঘটিত বা কুরায়ার যুদ্ধে জয়লাভ করার ছয় মাস পর হিজরি ৬ষ্ঠ সনের জুমাদাল-উলায় (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ৬২৭ খ্রি.) সংঘটিত হয়।[8] হাফেজ ইবনে হাজম বলেন, ‘বিশুদ্ধ অভিমত অনুসারে এটি ৫ম হিজরিতে সংঘটিত হয়’।[9] জুরকানি বলেন, ‘কারো কারো মতে এটি ৪র্থ হিজরিতে সংঘটিত হয়। কারো মতে এটি রজব মাসে, আর কারো মতে শাবান মাসে সংঘটিত হয়।’[10]
একটি যুদ্ধকৌশল
এই সফরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন দিকে রওনা হবেন, যুদ্ধকৌশল হিসেবে তা প্রথমে প্রকাশ করেননি। কারণ, তাতে শত্রুরা তার অভিযানের উদ্দেশ্য জেনে ফেলার আশঙ্কা ছিল। তাই তিনি মদিনা থেকে বের হওয়ার সময় মদিনার উত্তর প্রান্তে সিরিয়ার রাস্তায় অবস্থিত গুরাব পর্বতের পথ ধরে অগ্রসর হন। অতঃপর তিনি মাহিস হয়ে বতরায় আসেন। এখানে পৌঁছে তিনি বামদিকে গতি পরিবর্তন করেন এবং মদিনার বাইন উপত্যকা হয়ে সুখায়রাতুল ইয়ামামে গিয়ে পোঁছান। এখানে এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দক্ষিণে সোজা মক্কার দিকে দ্রুতগতিতে চলতে শুরু করেন। এভাবে তিনি তার সৈন্যদল নিয়ে বনু লিহয়ানদের আবাসভূমি পুরান উপত্যকায় পৌঁছায়।[11] এখানেই রাজি নামক প্রস্রবণের পাশে আসিম ইবনে সাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু ও তার সাথিগণ প্রতারণার শিকার হন এবং শাহাদাতবরণ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে পৌঁছানোর পর তাদের জন্য রহমত ও মাগফেরাতের দোয়া করেন।[12]
ঘটনাক্রমে বনু লিহয়ান গোত্রের লোকেরা অনেক আগে থেকেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের সংবাদ পেয়ে যায়।[13] সম্ভবত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেই স্থান থেকে গতি পরিবর্তন করে উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে রওনা হন, সেখানে বনু লিহয়ান গোত্রের কোনো লোক দেখে ফেলে। সে অতি দ্রুত এসে তার গোত্রের লোকদের এই খবর দেয়। তারা এই খবর পেয়ে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়ে এবং নিজেদের গবাদিপশু ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নিয়ে বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে আত্মগোপন করে।[14] তিনি তাদের এলাকায় দুই দিন,[15] মতান্তরে একদিন[16] অবস্থান করেন এবং তাদের পশ্চাদ্ধাবনের উদ্দেশ্যে এখান থেকে বিভিন্ন দিকে ছোট ছোট কয়েকটি অভিযান প্রেরণ করেন। কিন্তু কোথাও তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি।[17]
মক্কার দিকে অগ্রসর
অবশেষে তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের আশা ত্যাগ করে মক্কার দিকে অগ্রসর হন এবং উসফান উপত্যকায় গিয়ে পৌঁছান। এর পেছনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্দেশ্য ছিল, মক্কাবাসীরা দেখবে যে, মুসলমানগণ মক্কায় এসেছেন এবং এর ফলে তারা বিচলিত ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে।[18] উসফান থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু[19] কিংবা সাদ ইবনে উবাদার নেতৃত্বে দুজন,[20] মতান্তরে দশজন[21] অশ্বারোহীকে অথবা দুজনেরই নেতৃত্বে দুটি পৃথক অশ্বারোহী দলকে আরও সম্মুখে প্রেরণ করেন।[22] তারা নির্বিঘ্নে কুরাউল গামিম পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসেন।[23] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ নিরাপদ ও নির্ঝঞ্ঝাট অবস্থায় সৈন্যবাহিনীসহ মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন।[24] এই সফরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১৪ দিন মদিনার বাইরে অবস্থান করেন।[25] জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘মদিনার দিকে প্রত্যাবর্তনের সময় আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই দোয়া পাঠ করতে শুনেছি,
آئبون تَائِبُونَ إنْ شَاءَ اللَّهُ لِرَبِّنَا حَامِدُونَ، أَعُوذُ باللَّه مِنْ وَعْثَاءِ السَّفَرِ، وَكَآبَةِ الْمُنْقَلَبِ، وَسُوءِ الْمَنْظَرِ فِي الْأَهْلِ وَالْمَالِ.
আমরা ফিরে এসেছি। আল্লাহ চাইলে আমরা ফিরে যাব। আমরা আমাদের প্রতিপালকের প্রশংসা করছি। আমি সফরের দুঃখ-কষ্ট, খারাপ পরিণাম এবং পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদের বেহাল অবস্থা দর্শন থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’[26]
আরো পড়ুন : গাজওয়া উহুদ – Battle of Uhud
আরো পড়ুন : গাজওয়া ওয়াদিল কুরা – Third Expedition of Wadi al Qura
আরো পড়ুন : গাজওয়া খায়বার – Battle of Khaybar
তথ্যসূত্র
[1]. ইবনে হাযম, জামহারাতু আনসাবিল আরাব : ৩/১৯৬
[2]. আল-আইনি, উমদাতুল কারি : ১৭/১৬৯
[3]. ইয়াকুত অলি-হামাবী, মুজামুল বুলদান : ৪/১৯১
[4]. মুহাম্মাদ রিদা, মুহাম্মাদুর রাসুল, ১৯৭৫ ইসাব্দ : ২৪৩
[5]. জুরকানি, শরহুল মাওয়াহিব : ২/১৪৭
[6]. প্রাগুক্ত
[7]. জুরকানি, শরহুল মাওয়াহিব : ২/১৪৬
[8]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা
[9]. প্রাগুক্ত; ইবনুল আসির, আল-কামিল ফিত তারিখ : ২/১৮৮
[10]. প্রাগুক্ত
[11]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩৩৩
[12]. ইবনে কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ২/১১৯
[13]. তাবারি : ৩০৫
[14]. ড. মুহাম্মাদ হুসাইন হায়কাল, বাংলা অনু, মহানবীর জীবন চরিত : ৪৫৯
[15]. হালাবি, প্রাগুক্ত : ১/৬৭৭
[16]. মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা : ২/২৯
[17]. দানাপুরি, আসাহহুস সিয়ার : ১৫৩
[18]. ইবনুল আসির, প্রাগুক্ত : ২/১৮৮
[19]. জুরকানি, প্রাগুক্ত : ২/১৪৭
[20]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/৩৩৩
[21]. ইবনুল কায়্যিম, প্রাগুক্ত : ২/১১৯
[22]. জুরকানি, প্রাগুক্ত : ২/১৪৭
[23]. মুখতাসার তারিখির রাসুল : ২৯২
[24]. মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলবি, সিরাতে মোস্তফা : ২/২৯
[25]. দানাপুরি, প্রাগুক্ত : ১৫৪
[26]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ২/৩৩৩