৩৪. (১৪) গাজওয়া যি-কারাদ বা গাজওয়া গাবা – Expedition of Dhu Qarad
১৪.গাজওয়া যি-কারাদ বা গাজওয়া গাবা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কর্তৃক প্রেরিত সারিয়্যা : ১৪ |
|||||||||
|
|||||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||||
মুসলমান | গাতফান গোত্রের ৪০ জন | ||||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||||
সালামা ইবনুল আকওয়া | আবদুর রহমান উয়াইনা বিন হিসন আল-ফাজারি | ||||||||
শক্তি | |||||||||
৫০০ হতে ৭০০ মুসলিম জড়ো হয়েছিলেন, তবে উদ্ধারের জন্য মাত্র ৮ জন অশ্বারোহীকে পাঠানো হয়। | ৪০ জন | ||||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||||
৪ জন শহিদ | ৪ জন নিহত |
নামকরণ
কারাদ শব্দটি পানিবিশিষ্ট একটি গিরিপথের নাম। কারাদ ওই স্থান, যেখানে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মুসলিম বাহিনী অবস্থান গ্রহণ করেছিল এবং শত্ৰুদের সেখান থেকে বিতাড়িত করেছিল।[1] সম্ভবত এই কারণেই গাজওয়াটির যু-কারাদ নামকরণ করা হয়েছে। ইমাম বুখারি এই গাজওয়াকে ‘বাবু গাজওয়াতি যাতিল-কারাদ’ শিরোনামে উল্লেখ করেন এবং উকাল ও উরায়নার ঘটনার পরে এটিকে স্থান দিয়েছেন। ইবনে হাজার আসকালানি লিখেছেন, ‘কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে সম্ভবত ইমাম বুখারি এর মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছেন, এই উভয় ঘটনা একই ছিল। যদিও এর বিপরীত মতটিই অধিক শক্তিশালী।’[2]
ইবনে হাজার আরও লিখেছেন, ‘কারাদ শব্দটি ‘কাফ’ ও ‘রা’ বর্ণে যবর অথবা এই উভয় বর্ণে পেশ কিংবা প্রথমটিতে পেশ ও দ্বিতীয়টিতে যবর দিয়ে পড়া যায়।’ হাযিমী বলেন, ‘প্রথমটি হাদিস বিশারদগণের মত এবং দ্বিতীয়টি ভাষাবিদগণের মত।’ বালাজুরির মতে প্রথম মতটিই বিশুদ্ধ। আর সেই হিসেবে স্থানটি হলো গাতফান অঞ্চলের কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত একটি এলাকা যেখানে কূপ রয়েছে। কারো কারো মতে, গাতফান থেকে এর দূরত্ব এক দিনের পথ।[3]
ইবনুল কায়্যিম আল-জাওযিয়্যা ‘ফাসলুন ফি গাজওয়াতিল-গাবা’ শিরোনামে এই গাওয়া সম্পর্কে আলোচনা করেন। কারণ এই গাজওয়ার সূত্রপাত হয় মদিনার নিকটবর্তী ‘গাবা’ নামক স্থানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উটপালের উপর আক্রমণের ঘটনা থেকে। আর তাই এই গাজওয়ার নামকরণ করা হয়েছে ‘গাজওয়াতুল গাবা’।[4]
আরো পড়ুন : গাওয়া খন্দক আহজাব – Battle of the Trench
আরো পড়ুন : গাওয়া তাবুক – Battle of Tabouk
আরো পড়ুন : গাজওয়া আস-সাবিক – Invasion of Sawiq
মোটকথা, গাজওয়াটির প্রারম্ভ বা সূচনার দিক বিবেচনা করে এর নাম হয়েছে ‘গাজওয়াতুল গাবা’ এবং এর সমাপ্তিকালে মুসলিম বাহিনীর অবস্থানস্থল বিবেচনা করে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘গাজওয়া যু-কারাদ’ বা ‘গাজওয়া যাতিল কারাদ’।
সময়কাল
এই গাজওয়ার সময়কাল সম্পর্কে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হলো ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম-এর অভিমত। ইমাম বুখারি রহ. বলেন, ‘এটি হলো সেই গাজওয়া, যাতে খায়বারের তিন দিন আগে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উটপালের উপর আক্রমণ করা হয়।’[5] আল্লামা কুরতুবি রহ. বলেন, ‘ঐতিহাসিকগণ এই ব্যাপারে একমত যে, গাজওয়া যু-কারাদ সংঘটিত হয়েছিল হুদায়বিয়ার পূর্বে।’[6] হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন, ‘বুখারির মতই এক্ষেত্রে অধিক গ্রহণযোগ্য।’[7]
ইবনুল কায়্যিম—এই গাজওয়া সংঘটিত হয়েছিল হুদায়বিয়ার পর। অনেক ঐতিহাসিক এটিকে হুদায়বিয়ার পূর্বে বলে বর্ণনা করেন; কিন্তু তা ঠিক নয়।[8] তিনি তার মতটি সঠিক হওয়ার ব্যাপারে ইমাম আহমাদ এবং হাসান ইবনে সুফিয়ানের বর্ণিত হাদিস দলিল হিসেবে পেশ করেন। তারা দুজন এই হাদিস ইকরামা ইবনে আম্মার সূত্রে সালামা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘হুদায়বিয়ার যুদ্ধের সময় আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মদিনায় আগমন করি। আমি এবং রাবাহ তালহার একটি ঘোড়া নিয়ে চললাম, যাতে উটপালের সাথে এটিকেও মাঠে চরিয়ে আনতে পারি। ঘটনাক্রমে সেদিন শেষরাতের অন্ধকারে আবদুর রহামন ইবনে উয়ায়না রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উটপালের উপর আক্রমণ চালায় এবং তার রাখালকে হত্যা করে।’ অবশিষ্ট ঘটনাও তিনি বর্ণনা করেন।[9]
সফিউর রহমান মোবারকপুরি লিখেছেন, ‘হুদায়বিয়ার পরে এবং খায়বারের পূর্বে এটিই প্রথম গাজওয়া, যাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অংশগ্রহণ করেন।’[10] সুতরাং এই গাজওয়া খায়বারের পূর্বে এবং হুদায়বিয়ার পরে সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে ইমাম বুখারির বর্ণনা অত্যন্ত স্পষ্ট।
তবে এটি ছাড়াও এই গাজওয়ার দিনক্ষণের ব্যাপারে আরও বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। ইবনে সাদ ও ওয়াকিদির বর্ণনামতে, গাজওয়া যু কারাদ ছিল ষষ্ঠ হিজরির রবিউল আওয়াল মাসে। আর কুরতুবি রহ.-এর মতে, এটি ছিল ষষ্ঠ হিজরির জুমাদাল উলা মাসে।[11] ইবনে ইসহাক রহ.-এর মতে, এটি ছিল ষষ্ঠ হিজরির শাবান মাসে।[12]
মানচিত্র (৩৫) : গাজওয়া যি-কারাদ বা গাজওয়া গাবা ঘটনা স্থল
যু-কারাদের ঘটনা সম্ভবত একাধিকবার সংঘটিত হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উটপালের উপরও হয়তো দুবার আক্রমণ হয়েছে। একবার হুদায়বিয়ার পূর্বে, যা ইবনে সাদ এবং ইবনে ইসহাক প্রমুখ উল্লেখ করেন। আরেকবার হুদায়বিয়ার পর খায়বারের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পূর্বে, যা অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেন। আল্লামা হাকিম আল-ইকলিল গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘যু-কারাদের উদ্দেশ্যে বের হওয়াটা একাধিকবার সংঘটিত হয়েছিল। প্রথমটি ছিল উহুদের পূর্বে, যেটিতে জায়েদ ইবনে হারিসা গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়টি পঞ্চম হিজরির রবিউল-আখির মাসে, যেটিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অংশগ্রহণ করেছিলেন। আর তৃতীয়টি হলো ইতিপূর্বে আলোচিত ঘটনা।’[13]
আরো পড়ুন : ইহুদি নেতা আবু রাফে-এর হত্যা অভিযান – Killing of Abu Rafi’
আরো পড়ুন : কাব ইবনুল আশরাফ হত্যা অভিযান – Killing of Ka’b ibn al-Ashraf
আরো পড়ুন : খাররার অভিযান – Expedition of al-Kharrar
ঘটনার উৎপত্তি
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশটি দুগ্ধবতী উষ্ট্রী ছিল। মদিনার নিকটবর্তী ‘গাবা’ নামক স্থানে এগুলোকে চরানো হতো। সেখানে বুধবার রাত্রিবেলা উয়ায়না ইবনে হিসন আল-ফাযরি ‘গাতফান’ গোত্রের ৪০ জন অশ্বারোহী নিয়ে আক্রমণ চালায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই উষ্ট্রীপালের রাখাল ছিল বনু গিফার গোত্রের একজন লোক। তার সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিল। তারা লোকটিকে হত্যা করে এবং তার স্ত্রীকে বন্দি করে উষ্ট্রীপালের সাথে নিয়ে যায়। আর অমনি জীবন বাজি রেখে সর্বপ্রথম যিনি শত্রু বাহিনীর উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি হলেন—সালামা ইবনে আমর ইবনুল আকওয়া আল-আসলামি রাযিয়াল্লাহু আনহু।[14] তিনি বলেন, ‘আমি তখন ইয়া সাবাহা…. (শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্যের আহ্বান) বলে তিনবার জোরে চিৎকার করে মদিনাবাসীদের কানে পৌঁছে দিলাম।’ অতঃপর তিনি ‘গাবা’-এর দিকে চললেন। তখন তার সাথে ছিল তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এক ক্রীতদাস। সে তার মনিবের একটি ঘোড়া চরাচ্ছিল। অতঃপর তিনি ‘সানিয়াতুল-ওয়াদা’ নামক পাহাড়ে আরোহণ করে কাফেরদের বাহিনীকে দেখতে পেলেন, শত্রুদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে অগ্রসর হতে হতে তাদের প্রতি তির নিক্ষেপ করতে থাকলেন। অবশেষে শত্রুদের নিকট থেকে তিনি ছিনতাইকৃত উটগুলো এবং তাদের ত্ৰিশটি চাদর ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হলেন।[15] ইত্যবসরে মদিনায় এই খবর ছড়িয়ে পড়ল এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ
একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উটগুলো দেখে আসার জন্য রাবাহকে প্রেরণ করলেন। সালামা ইবনে আকওয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু তালহার একটি ঘোড়া নিয়ে রাবাহ-এর সাথে গেলেন। তারা পৌঁছার পূর্বেই ফাযারা গোত্রের একদল লুণ্ঠনকারী হানা দিয়ে রাখালকে হত্যা করে এবং সমস্ত উট নিয়ে রওনা হয়। ওই দলে আবদুর রহমান ইবনে উয়ায়নার নেতৃত্বে ৪০ জন লুণ্ঠনকারী ছিল। গাবার নিকটে পৌঁছে তারা যখন দেখতে পেলেন লুণ্ঠনকারীরা উট নিয়ে যাচ্ছে, তখন সালামা আপন সঙ্গী রাবাহকে বললেন, ‘আমি তির নিক্ষেপ করে লুণ্ঠনকারীদেরকে বাধা দিতে চেষ্টা করব। আর তুমি এই ঘোড়াটি নিয়ে মদিনায় গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সংবাদ জানাও।’[16] মাত্র তিন দিন হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়া থেকে মদিনায় প্রত্যাগমন করেন। এ দিকে মদিনার অলিতে-গলিতে খবর পৌঁছে গেছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উষ্ট্রীপাল আক্রান্ত হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে সাহাবিগণ দলে দলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এই সংবাদ নিয়ে আসতে লাগলেন। অশ্বারোহী যোদ্ধাদের মধ্য থেকে সর্বপ্রথম যিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এই সংবাদ নিয়ে এসেছিলেন তিনি হলেন, মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ রাযিয়াল্লাহু আনহু। ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, মিকদাদের ঘোড়ার নাম ছিল ‘বা যাজাহ’ অর্থাৎ আক্রমণের ক্ষেত্রে দ্রুতগামী।[17] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার বর্শার অগ্রভাবে পতাকা বেঁধে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি রওনা হয়ে যাও। অশ্বারোহী বাহিনী গিয়ে তোমার সাথে মিলিত হবে। আমরাও তোমার পেছনে আসছি।’[18] মিকদাদের পরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসেছিলেন আবদ ইবনে বিশর আশহালি, সাদ ইবনে জায়েদ, উসাইদ ইবনে যুহায়র, উকাশা ইবনে মিহসান, মুহরিয ইবনে নাদ্লাহ আল-আসাতি অলি-আখরাম, আবু কাতাদা হারেস ইবনুর রাবি এবং আবু আয়্যাশ উবায়েদ ইবনে জায়েদ ইবনুস সামিত আয-যুরায়কি প্রমুখ সাহাবি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদ ইবনে জায়েদ আল-আশহালিকে তাদের আমির বানিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শত্রুর খোঁজে বের হয়ে পড়ো। আমিও এসে তোমাদের সাথে মিলিত হবো।’[19]
ইবনে হিশাম আরও বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন আবু আয়্যাশ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ঘোড়াটি মুআজ ইবনে মাইস অথবা আইয ইবনে মাইসকে দিয়েছিলেন। কেননা তিনি ছিলেন অশ্ব পরিচালনায় আবু আয়্যাশের তুলনায় অধিক পারদর্শী।’
আরো পড়ুন : আল-আবওয়া অভিযান – Patrol of Wa ddan (al-Abwa)
আরো পড়ুন : আল-উশাইরা অভিযান – Patrol of Zul Al-Ushairah
আরো পড়ুন : আসমা বিনতে মারওয়ান হত্যা – Killing of Asma Bint Marwan
এই গাজওয়ায় সালমা ইবনুল আকওয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু অশ্বরোহী ছিলেন না, পদাতিক ছিলেন এবং তিনিই ছিলেন এই গাজওয়ার অগ্নিপুরুষ। তির নিক্ষেপে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত। ঘোড়াটি রাবাহকে দিয়ে তিনি পায়ে হেঁটে শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন করলেন। ইতিমধ্যে শত্রুবাহিনীর কাছে পৌঁছে তিনি তাদের উপর তিরের পর তির নিক্ষেপ করতে লাগলেন এবং প্রতি তিরের আঘাতেই কোনো না কোনো শত্রু আহত হতে লাগল। অবস্থা এমন হলো যে, তিনি একাই ৪০ জন লুণ্ঠনকারীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন। তারা ফিরে তাকে আক্রমণ করলে তিনি কখনো বা গাছের আড়ালে, কখনো বা পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করে শত্রুদের নাকেমুখে তির নিক্ষেপ করতেন এবং তাদের ভর্ৎসনা করে বীরগর্বে বলতেন,
أَنَا ابْنُ الْأَكْوَعْ الْيَوْمُ يَوْمُ الرُّضَّعْ.
‘এই নাও আমার তির। আমি আকওয়ার সুযোগ্য পুত্র। আজকের এই দিন কঠিন পরীক্ষার দিন; যে বেশি মাতৃদুগ্ধ পান করেছে তার দিন।’
এভাবে তিনি শত্রুবাহিনীর তাড়া খেয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন এবং পুনরায় সুযোগ বুঝে আক্রমণ চালাতে থাকেন।[20]
লুণ্ঠনকারীরা দুই পর্বতের মধ্যবর্তী সংকীর্ণ গিরিপথে প্রবেশ করল। এবার সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহু পাহাড়ের উপরে আরোহণ করে তাদের উপর পাথর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। ডাকাতরা তার আক্রমণ থেকে কোনো প্রকারেই নিষ্কৃতি লাভ করতে না পেরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উষ্ট্রীগুলো ছেড়ে যেতে বাধ্য হলো। সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি উষ্ট্রীগুলোকে মদিনাভিমুখে তাড়িয়ে দিয়ে শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন করলাম এবং পর্যায়ক্রমে তির নিক্ষেপ করে চললাম। শত্রুরা পালাতে না পেরে এক একটি করে গায়ের চাদর ফেলে দিয়ে হালকা হতে লাগল এবং প্রাণপণে দৌঁড়াতে লাগল। আমি চিহ্নস্বরূপ প্রত্যেকটি চাদরের উপর একটি পাথর রেখে দিয়ে শত্রুদের পেছনে পেছনে ধাবিত হয়ে তির নিক্ষেপ করতে থাকলাম। অবশেষে তারা নিজেদের হাতের বর্শাগুলোও ফেলে দিয়ে বোঝা আরও হালকা করতে লাগল। তারা প্রায় ত্রিশটির বেশি চাদর এবং সমসংখ্যক বর্শা ফেলে গেল। কিন্তু আমি ফিরে না এসে তাদের পেছন থেকে তাড়া করতে লাগলাম।[21]
ইতিমধ্যে রাবাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট সংবাদ পেয়ে সেখানে মুসলমানদের অশ্বারোহী বাহিনী এসে পৌঁছায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও ইবনে উম্মে মাকতুম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মদিনার দায়িত্বে রেখে রওনা হলেন। সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি শত্রুদের পেছনে তির নিক্ষেপ করতে করতে অগ্রসর হচ্ছিলাম। এমন সময় ফাযারা গোত্রের একটি লোক এসে তাদের সঙ্গী হলো এবং তারা সকলে মিলে আহার করতে বসল। এই সুযোগে আমিও তাদের অনতিদূরে বসে নিজের সঙ্গের রুটি খেতে লাগলাম। আগন্তুক লোকটি সম্ভবত তাদের জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের এত অস্থির দেখছি কেন? তারা আমার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, এই লোকটি আজ আমাদের তির নিক্ষেপ করতে করতে অস্থির করে ফেলেছে। আমাদের সাথে যা কিছু ছিল সব ফেলে এসেছি। তথাপি সে আমাদের পেছন ছাড়ছে না।
এই কথা বলতে না বলতেই তারা দেখতে পেল, মুসলমান সৈন্যগণ আসছে। তাদের দেখামাত্রই লুণ্ঠনকারীরা উঠে পালাতে লাগল। সালামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সর্বাগ্রে মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনীর মুহরিয ইবনে নদিলা আল-আখরাম রাযিয়াল্লাহু আনহু আমাকে অতিক্রম করে লুণ্ঠনকারীদেরকে আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হয়েছিলেন। আমি তার ঘোড়ার লাগাম ধরে বললাম, আপনি একা যাবেন না, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আসতে দিন। তিনি বললেন, “হে সালামা! তুমি যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে থাকো এবং জান্নাত-জাহান্নামকে সত্য বলে বিশ্বাস করো, তবে আমাকে বাধা দিয়ো না। শহিদ হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করার সুযোগ দাও।” এই কথা শুনে আমি ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিলাম। তিনি অগ্রসর হয়ে লুণ্ঠনকারীদের দলপতি আবদুর-রহমানকে আক্রমণ করলেন। উভয়ের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ বেঁধে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই শাহাদাতের পেয়ালা পান করে তিনি স্বীয় উদ্দেশ্যে সফলকাম হলেন।
আরো পড়ুন : বুওয়াত অভিযান – Patrol of Buwat
আরো পড়ুন : আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার অভিযান – Expedition Abdullah ibn Rawaha
আরো পড়ুন : আবু আফাক হত্যা – Killing of Abu Afak
এইবার আবু কাতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু অগ্রসর হয়ে আখমের রাযিয়াল্লাহু আনহু হত্যাকারী আবদুর রহমানকে তরবারির এক আঘাতেই হত্যা করলেন। তাতে মুশরিক বাহিনী মনোবল হারিয়ে পিছু হটতে লাগল।’ সালামা বলেন, ‘আমি আবার পূর্ণোদ্যমে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলাম। অবশেষে তারা পিপাসায় কাতর হয়ে যু-কারাদ জলাশয় থেকে পানি পান করতে চাইল। কিন্তু আমার বিরামহীন তির বর্ষণের ফলে তারা পানিও পান করতে পারল না। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা তাদের তাড়া করতে থাকলাম এবং আরও দুটি ঘোড়া তাদের নিকট থেকে কেড়ে নিলাম।
সন্ধ্যার পরক্ষণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে আমাদের সাথে মিলিত হলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! শত্রুগণ ক্ষুৎপিপাসায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছে। আপনি আমাকে একশত সৈন্য দিন। আমি শত্রুদলের সকলকে হত্যা করে তাদের বাহনগুলো ছিনিয়ে নিই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে বললেন,
يَا ابْنَ الْأَكْوَعِ، مَلَكْتَ فَأَسْجِحْ.
“তুমি যখন জয়ী হয়েছ, তখন সদয় হও।”
তৎসঙ্গে তিনি এটিও বললেন, নিশ্চয় তারা এতক্ষণে গাতফানে পৌঁছে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।”’[22]
আটজন অশ্বারোহী
ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, ‘এই গাজওয়ায় আটজন অশ্বারোহী মুজাহিদ ছিলেন। নিজ নিজ ঘোড়ার নামসহ তাদের তালিকা নিম্নরূপ,
(১) মাহমুদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু। তার ঘোড়ার নাম ছিল যাল-লাম্মাহ বা কঠোর। (২) সাদি ইবনে জায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু; তার ঘোড়ার নাম ছিল ‘লহিক’ বা অগ্রবর্তী বস্তুর পশ্চাদ অনুসরণকারী।
(৩) মিকদাদ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু; তার ঘোড়ার নাম ছিল আজা বা দ্রুত আক্রমণকারী। সেটাকে সাহা-ও বলা হতো।
(৪) উক্কাশা ইবনে মিহসান রাযিয়াল্লাহু আনহু; তার ঘোড়ার নাম ছিল যুল-লাম্মাহ বা কঠোর। (৫) আবু কাতাদা হারেস ইবনে রিবঈ রাযিয়াল্লাহু আনহু; তার ঘোড়ার নাম ছিল ‘হাযরাহ’ বা যে শত্রুকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে।
(৬) আব্বাদ ইবনে বিশর রাযিয়াল্লাহু আনহু, তার ঘোড়ার নাম ছিল লুম্মা বা উজ্জ্বল।
(৭) উসাইদ ইবনে হুদাইর; তার ঘোড়ার নাম ছিল মাসনুন বা তীক্ষ্ণ।
(৮) আবু আয়াশ উবায়েদ ইবনে জায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু; তার ঘোড়ার নাম ছিল ‘জালওয়াহ্’ বা যে তার প্রভুর দুশ্চিন্তা দূরীভূত করে।[23]
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উদ্ধারকৃত উষ্ট্রীপাল থেকে একটি উষ্ট্রী জবেহ করলেন এবং সেই স্থানে একদিন একরাত অবস্থান করে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলেন। উষ্ট্রীপালের রাখাল গিফারির স্ত্রী মদিনায় এসে তথা থেকে একটি উষ্ট্রী জবেহ করার মানত করল। কিন্তু উষ্ট্রীর প্রকৃত মালিক সে ছিল না। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জানিয়ে দিলেন, ‘আল্লাহর নাফরমানি করে কারো কোনো মানত করার সুযোগ নেই এবং যে বস্তুর সে মালিক নয়, তাতেও কোনো মানত চলবে না।’
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই গাজওয়ায় প্রাপ্ত মাল মুজাহিদগণের মধ্যে বণ্টন করে দেন। সালামা ইবনুল আকওয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দুটি অংশ দিয়েছেন, একটি পদাতিক যোদ্ধার অংশ এবং অপরটি অশ্বরোহী যোদ্ধার অংশ। মদিনায় ফেরার সময় তিনি আমাকে তার সাথে তার ‘আদবা’ নামক বাহনে চড়িয়ে সম্মানিত করেন।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আজকের দিন আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী যোদ্ধা হলো আবু কাতাদা। আর সর্বশ্রেষ্ঠ পদাতিক যোদ্ধা হলো সালামা ইবনুল আকওয়া।’[24]
আরো পড়ুন : সিফুল বাহার অভিযান – Expedition of Hamza ibn Abdul-Muttalib
আরো পড়ুন : হুদাইবিয়ার সন্ধি – Treaty of Hudaybiyyah
তথ্যসূত্র
[1]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩৬৩
[2]. ফাতহুল বারি : ৭/৫২৫
[3]. ফাতহুল বারি : ৭/৫২৬
[4]. ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ৩/২৭৮
[5]. সহিহ বুখারি, কিতাবুল মাগাজি : ৪১৯৪; সহিহ মুসলিম : ১৮০৭
[6]. মুহাম্মাদ ইবনে আবদিল ওয়াহ্হাব, মুখতাসারু সিরাতির রাসুল : ৩২৭
[7]. ফাতহুল বারি : ৭/৫২৬
[8]. ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ৩/২৭৯
[9]. আল-মুসনাদ : ৪/৫২-৫৪
[10]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩৬২
[11]. বদরুদ্দিন আইনি, উমদাতুল কারি : ১৭/২৩২
[12]. ফাতহুল বারি : ৭/৫২৬
[13]. ফাতহুল বারি : ৭/৫২৬
[14]. মুখতাসার সিরাতির রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ৩২৭
[15]. সহিহ বুখারি : ৩৮৭৪
[16]. তফাজ্জল হোসাইন, মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সমকালীন পরিবেশ ও জীবন : ৬৪৩
[17]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৮১
[18]. ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ : ৩/২৭৮
[19]. আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/২৭৯
[20]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৭৯
[21]. তফাজ্জল হোছাইন, প্রাগুক্ত : ৬৪৪
[22]. সফিউর রহমান মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ৩৬৩
[23]. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : ৩/১৮১
[24]. মোবারকপুরি, প্রাগুক্ত