৩৯. (১৯) সারিয়্যা ঈস/জায়েদ ইবনে হারিসা রাযিয়াল্লাহু আনহু – Expedition of Zayd ibn Harithah (Al-Is)
১৯. সারিয়্যা জায়েদ ইবনে হারিসা রাযিয়াল্লাহু আনহু
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কর্তৃক প্রেরিত সারিয়্যা : ১৯ |
|||||||||
|
|||||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||||
মুসলমান | কুরাইশ | ||||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||||
জায়েদ ইবনে হারিসা রাযিয়াল্লাহু আনহু | অজ্ঞাত | ||||||||
শক্তি | |||||||||
১৭০ অশ্বারোহী | অজ্ঞাত |
স্থান ও সময়কাল
সারিয়্যা ঈস ৬ষ্ঠ হিজরি জুমাদাল উলা মাসে সংঘটিত হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পারলেন, কুরাইশদের একটি কাফেলা সিরিয়া থেকে প্রত্যাগমন করছে। তিনি জায়েদ ইবনে হারিসার নেতৃত্বে ১৭০ জন অশ্বারোহী সাহাবির একটি দল উক্ত কুরাইশ কাফেলাকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন। মদিনা থেকে চার দিনের পথ অতিক্রম করলে ঈস নামক স্থানে জায়েদ ইবনে হারিসার বাহিনী কুরাইশদের মুখোমুখি হলো। ঝটিকা আক্রমণে মুসলিম বাহিনী কুরাইশদের পর্যুদস্ত করল। প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী ও বন্দি হস্তগত হলো। যুদ্ধলব্ধ সামগ্রীর মধ্যে রৌপ্য ছিল প্রচুর পরিমাণে। আর সেই রৌপ্যের মালিক ছিল কুরাইশ ধনকুবের সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া।
মানচিত্র (৪০) : সারিয়্যা জামুম/বনু সুলাইম যুদ্ধাভিযানের স্থান
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা জয়নাবের স্বামী ছিল আবুল আস ইবনুর রাবি। ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, ‘আবুল আস বসবাস করতেন মক্কা নগরীতে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় কন্যা জয়নাবকে তার সাথে বিবাহ দেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির পর ধর্মীয় বিধানানুসারে আবুল আস ও জয়নাবের বৈবাহিক সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটে। জয়নাব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট মদিনায় ফিরে যান।
আরো পড়ুন : সারিয়্যা শুজা ইবনে ওয়াহব আল-আসাদি – Expedition of Shuja ibn Wahb al-Asadi
আরো পড়ুন : সারিয়্যা সাঈদ ইবনে জায়েদ আল-আশহালি Raid of Sa’d ibn Zaid al-Ashhali
আরো পড়ুন : সারিয়্যা হিসমি – Expedition of Zayd ibn Harithah (Hisma)
মক্কা বিজয়ের কিছুদিন পূর্বে আবুল আস বাণিজ্য উপলক্ষ্যে কুরাইশ কাফেলার সাথে সিরিয়া গমন করেন। তার নিজস্ব পণ্যসামগ্রী ব্যতীত অন্যান্যদের পণ্যসামগ্রীও তার তত্ত্বাবধানে ছিল। বাণিজ্যিক কার্যক্রম সমাপ্তির পর সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনকালে কুরাইশ কাফেলা জায়েদ ইবনে হারিসার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হলে তিনি রাতের অন্ধকারে বাহিনীর অগোচরে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। তার মালামাল বাহিনী কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়। বন্দি ও যুদ্ধলব্ধ সামগ্ৰী মদিনায় আনা হলো। আবুল আস রাতের অন্ধকারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা জয়নাবের নিকট উপস্থিত হয়ে আশ্রয়প্রার্থী হন। তিনি তাকে আশ্রয় প্রদান করেন।
ইয়াজিদ ইবনে রুম্মানের বর্ণনানুসারে জানা যায়, জয়নাব ফজর নামাজ শেষে নারীদের নামাজ আদায়ের স্থান থেকে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা দেন, ‘হে জনতা! তোমরা জেনে রাখো, আমি আবুল আসকে আশ্রয় প্রদান করলাম।’ নামাজ শেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত জনতাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমি যা শুনেছি তোমরাও কি তা শুনেছ?’ জনগণ সমস্বরে বলল, ‘হ্যাঁ।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমরা জেনে রাখো, যার হতে আমার জীবন তার শপথ করে বলছি, মুসলমানদের যেকোনো ব্যক্তির জন্য অপর একজনকে আশ্রয় প্রদানের অধিকার রয়েছে।’ অতঃপর তিনি তার কন্যার নিকট গমন করলেন এবং বললেন, ‘জয়নাব, আবুল আস তোমার সৌজন্য আচরণের অধিকার রাখে। তবে সে তোমার ঐকান্তিকতার অধিকার থেকে বঞ্চিত। এখন সে আর তোমার জন্য হালাল নয়।’
আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকরের উদ্ধৃতিতে ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, ‘যারা আবুল আসের সম্পদসমূহ বণ্টন করে নিয়েছিল, তাদের ডেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা উত্তমরূপে জানো, আবুল আসের সাথে আমার কীরূপ সম্পর্ক। আজ তোমরা তার সম্পদগুলো বাজেয়াপ্ত করে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিয়েছ। যদি তোমরা তার প্রতি সৌজন্য প্রকাশ করে সম্পদগুলো তাকে প্রত্যর্পণ করো, তাহলে বিষয়টি আমার খুবই মনঃপুত হবে। আর যদি তোমরা অস্বীকার করো, সেক্ষেত্রেও তোমাদের কোনো অপরাধ হবে না। কারণ যুদ্ধলব্ধ সামগ্রীতে তোমাদের অবশ্যই অধিকার রয়েছে।’ সকল সাহাবায়ে কেরামই তার সমুদয় সম্পদ ফেরত দিলেন।
এরপর আবুল আস তার যাবতীয় মালামালসহ মক্কায় চলে গেলেন! অপরের যা কিছু তার নিকট ছিল তাদের তা প্রত্যর্পণ করলেন। অতঃপর তিনি কুরাইশদের ডেকে বললেন, ‘হে কুরাইশগণ! আমার নিকট তোমাদের আর কোনো দাবি আছে কি?’ তারা সমস্বরে বলল, ‘আল্লাহ তোমাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। তোমার নিকট আমাদের আর কোনো প্রাপ্য নেই।’ এবার আবুল আস সজোরে ঘোষণা দিলেন, ‘এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রেরিত রাসুল।’
আরো পড়ুন : সারিয়্যা বাশির ইবনে সাদ আনসারি – Expedition of Bashir Ibn Sa’d al-Ansari
আরো পড়ুন : সারিয়্যা বাশির ইবনে সাদ আল-আনসারি – Expedition of Bashir Ibn Sa’d al-Ansari (Fadak)
আরো পড়ুন : সারিয়্যা যুল-কাস্সা – Expedition of Muhammad ibn Maslamah
ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-র সূত্রে ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, বিবাহ বিচ্ছেদের সুদীর্ঘ ছয় বছর পর আবুল আস মুসলমান হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কন্যা জয়নাব ও আবুল আসের পূর্বের বৈবাহিক সম্পর্ক বহাল রাখেন। জয়নাব পুনরায় স্বামীগৃহে গমন করেন।
একটি বিধান
স্বামী-স্ত্রী উভয়ে যদি দারুল হারবের (শত্রু রাষ্ট্রের) অধিবাসী হয় এবং স্বামীর পূর্বে যদি স্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে স্ত্রীর ইদ্দতকালের মধ্যে স্বামী মুসলমান হলে উভয়ের মধ্যে বিবাহ বন্ধন অটুট থাকবে। আর ইদ্দতকাল অতিক্রান্ত হলে উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটবে; এটিই সর্বসম্মত অভিমত।
জয়নাব রাযিয়াল্লাহু আনহু-সংক্রান্ত দুটি হাদিসের একটি আমর ইবনে শু’আয়ব রহ. ও অপরটি ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা কর্তৃক বর্ণিত। ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, আমর ইবনে শুআইব তার পিতা থেকে, তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কন্যা জয়নাবকে আবুল আসের নিকট দেনমোহর ধার্যপূর্বক পুনর্বিবাহের মাধ্যমে সমর্পণ করেছিলেন।’ এই হাদিসের আলোকে ফকিহগণ অভিমত প্রকাশ করেন, স্বামীর পূর্বে স্ত্রী যদি ইসলাম গ্রহণ করে এবং স্ত্রীর ইদ্দতকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই স্বামীও মুসলমান হয়, তবে এই স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অধিকার অধিক থাকবে, পূর্ব বিবাহ বহাল থাকবে। এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন মালেক ইবনে আনাস, আওজায়ি, শাফিয়ি, আহমাদ ও ইসহাক রহ. প্রমুখ।
ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কন্যা জয়নাবকে সুদীর্ঘ ছয় বছর পর আবুল আসের নিকট সমর্পণ করেছিলেন, নতুনভাবে কোনো বিবাহ চুক্তি করেননি।’ ইমাম তিরমিজি বলেন, ‘আমর ইবনে শুআইবের হাদিস অপেক্ষা ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর হাদিস সমধিক গ্রহণযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ফকিহগণ আমর ইবনে শুআইবের হাদিসকেই বিধানের উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন। জয়নাবের ইসলাম গ্রহণের পর তার ইদ্দতকালের সময়সীমা পর্যন্ত আবুল আস অমুসলিম অবস্থায় দারুল হারব মক্কায় অতিবাহিত করেন। সুতরাং জয়নাবের ইদ্দতকাল অতিক্রান্ত হওয়ায় উভয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ অনিবার্য হয়ে পড়ে। মুসলমান হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে নতুন মোহর ধার্য ও পুনর্বিবাহের মাধ্যমে আবুল আসের নিকট সমর্পণ করেন। ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘উভয়ের মধ্যে নতুনভাবে কোনো বিবাহ চুক্তি করেননি।’ এই জটিলতা নিরসনে ফকিহগণ বলেছেন, সুদীর্ঘ এই ছয় বছরের মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কন্যাকে অপর কারো সাথে বিবাহ দেননি অথবা বলা যায়, উভয়ের মধ্যে নতুন কোনো বিবাহ চুক্তি করেননি। কথাটি বর্ণনাকারীর, মূল হাদিসের অংশ নয়।
আর যদি ধরে নেওয়া হয়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কন্যাকে পুনর্বিবাহ ব্যতিরেকে আবুল আসকে সমর্পণ করেছিলেন, সেক্ষেত্রে খাত্তাবি বলেন, জয়নাব সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলোতে উভয়ের বিচ্ছেদের সময়সীমা ছয় বছর, তিন বছর ও দুই বছর কয়েক মাস উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বর্ণনা বৈষম্যের সামঞ্জস্যে বলা যায়, জয়নাব ও আবুল আসের ইসলাম গ্রহণের মধ্যকার ব্যবধানে ছিল ছয় বছর। ‘মুসলিম নারী অমুসলিম পুরুষের জন্য বৈধ নয়’ বিধানটি অবতীর্ণ হওয়ার পর আবুল আসের ইসলাম গ্রহণ তিন বছর অথবা দুই বছর কয়েক মাস পরে হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে খাত্তাবি বলেন, সম্ভবত জয়নাব ইদ্দতকালের মধ্যেই ছিলেন। কারণ নারীদের বিলম্বিত ঋতুকালের জন্য তিন ঋতুকালের সময়সীমা সর্বোচ্চ দুই বছর কয়েক মাস নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতরাং পূর্বে বিবাহ বহাল রাখাতে কোনোই জটিলতার সৃষ্টি হয়নি। কেউ বলেন, ‘মুসলিম নারীর জন্য অমুসলমান পুরুষ বৈধ নয়’ বিধানটি অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কন্যার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাননি। বিধানটি অবতীর্ণ হলে সম্ভবত তিনি তার কন্যাকে বলেন, ‘এখন তুমি আর আবুল আসের জন্য বৈধ নও। এখন তুমি ইদ্দত পালন করো।’ তার ইদ্দতকাল পূরণ হওয়ার পূর্বেই আবুল আস ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বিধায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাদের বিবাহ বন্ধন অটুট রেখেছিলেন।[1]
আরো পড়ুন : সারিয়্যা জায়েদ ইবনে হারিসা (কারাদা অভিযান) – Expedition of Zayd ibn Haritha
আরো পড়ুন : সারিয়্যা জায়েদ বিন হারিসা (জামুম) – Expedition of Zayd ibn Harithah (Al-Jumum)
আরো পড়ুন : সারিয়্যা দাহহাক ইবনে সুফিয়ান – Expedition of Dahhak al-Kilabi
তথ্যসূত্র
[1]. আত-তাবাকাত : ২/৮৭; ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা : সিরাতুন নবী : ১/৭৫৭; মাদারিজুন নুবুওয়াহ : ২/৩৩২; মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী বিশ্বকোষ : ১/৩৬৪; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৪/২০৩; ইবনে সায়্যিদিন্নাস, উয়ুনুল আসার : ২/১৪৫; আহওয়াজি : ৪/২৬৮- ৪৫২