৪. (১) আল-আবওয়া অভিযান – Patrol of Wa ddan (al-Abwa)
(১) আল-আবওয়া অভিযান বা গাজওয়াতুল আবওয়া | |||||||||||
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত গাজওয়া : ১ | |||||||||||
সাধারণ তথ্য | |||||||||||
|
|||||||||||
নেতৃত্ব | |||||||||||
মক্কার কুরাইশ | মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম | ||||||||||
শক্তি | |||||||||||
অজ্ঞাত | ৬০/৭০/২০০ অশ্বারোহী | ||||||||||
নোট | |||||||||||
ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষার জন্য প্রাথমিক কৌশল হিসেবে নিম্নের তিনটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন,
১. বিভিন্ন দিকে মুসলিম সশস্ত্র টহলদার বাহিনী প্রেরণ করা।
২. মক্কা থেকে মদিনার পার্শ্ববর্তী সিরিয়া অভিমুখে ঘন ঘন অভিযান পরিচালনা করা।
৩. এই পথের পার্শ্ববর্তী গোত্রসমূহের সাথে মৈত্রীচুক্তি করা।
|
শুরুর কথা
আল-আবওয়া অভিযান (গাজওয়াতুল আবওয়া) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের সর্বপ্রথম গাজওয়া। এটিই সর্বাধিক গৃহীত মত। আবওয়া (الأبواء) নামক স্থানের নামানুসারে এই গাজওয়ার নামকরণ করা হয়েছে। তবে ইবনে জারিরসহ কতিপয় ঐতিহাসিক এটিকে গাজওয়া ওয়াদ্দান নামে আখ্যায়িত করেন। ওয়াদ্দান (وَدَّان) নামক স্থানের নামানুসারে এই নামকরণ করা হয়েছে।[1]
আরো পড়ুন : সারিয়্যা শুজা ইবনে ওয়াহব আল-আসাদি – Expedition of Shuja ibn Wahb al-Asadi
আরো পড়ুন : সারিয়্যা সাঈদ ইবনে জায়েদ আল-আশহালি Raid of Sa’d ibn Zaid al-Ashhali
আরো পড়ুন : সারিয়্যা হিসমি – Expedition of Zayd ibn Harithah (Hisma)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে সংঘটিত গাজওয়াসমূহের সংখ্যার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মত রয়েছে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন ষোলোটির বর্ণনা পাওয়া যায়।[2] সর্বোচ্চ ২৮টির বর্ণনা পাওয়া যায়।[3] এরমধ্যে আল-আবওয়া অভিযান (গাজওয়াতুল আবওয়া) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের সর্বপ্রথম গাজওয়া। মক্কা মুকাররামার ১৩ বছরের নবুওয়াতি জীবনে তিনি পরম ধৈর্যের সাথে নির্মম অত্যাচারের মোকাবেলা করেন। অতঃপর তার মাদানি জীবনের প্রথম বছরেই যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللَّهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ
‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে, যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম।’[4]
কাফেরদের অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পদক্ষেপ গ্রহণে আদিষ্ট হয়ে তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেন। তন্মধ্যে হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু, উবায়দা ইবনে হারেস রাযিয়াল্লাহু আনহু ও সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে নেতৃত্ব দিয়ে তিনটি ক্ষুদ্র সামরিক অভিযান সম্পন্ন করার পর স্বীয় নেতৃত্বে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবওয়া নামক অভিযানই সর্বপ্রথম পরিচালনা করেন। ইমাম বুখারি ও ইবনে কাসিরসহ প্রায় সকলেই এই ব্যাপারে একমত। ইমাম বুখারি রহ. ইবনে ইসহাকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম সরাসরি যে অভিযান পরিচালনা করেন, তা হলো আবওয়া। অতঃপর বুওয়াত, অতঃপর উশাইরা। তবে জায়েদ ইবনে আরকাম রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদিসে উশাইরা (العشيرة) বা উসায়রা (العسيرة)-কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রথম গাজওয়া হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।[5] এটি ছাড়া বদরের ব্যাপারে কারো কারো অনুরূপ মন্তব্য থাকলে সেক্ষেত্রে কেবল সংঘর্ষপূর্ণ যুদ্ধগুলোর মধ্যে বদরই প্রথম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[6]
আল-আবওয়া অভিযান (গাজওয়াতুল আবওয়া) সম্পর্কে উপরিউক্ত আলোচনা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বক্তব্য রয়েছে। একটি হলো, ইবনুল আসির রহ.-এর বর্ণনা। উক্ত বর্ণনামতে আবওয়া অভিযান রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত গাজওয়া নয়; বরং তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রেরিত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্বে পরিচালিত একটি সারিয়্যা।[7] অপর বর্ণনাটি আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়ার। এই বর্ণনামতে, আবওয়া নামক অভিযান কেবল একটা নয়; বরং দুটি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বপ্রথম এবং পঞ্চম উভয় গাজওয়ার নামই ছিল গাজওয়াতুল আবওয়া।[8] তবে এই ব্যাপারে ইতিহাসে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না এবং উল্লিখিত কিতাবগুলোতেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো আলোচনা নেই।
স্থান পরিচিতি
পূর্বেই বলা হয়েছে, ‘আবওয়া’ নামক স্থানের নামানুসারে এই গাজওয়াকে ‘আল-আবওয়া অভিযান’ (গাজওয়াতুল আবওয়া) এবং ‘ওয়াদ্দান’ নামক স্থানের নামানুসারে গাজওয়াটিকে ‘গাজওয়া ওয়াদ্দান’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আবওয়া (الأبواء) মক্কা-মদিনার মধ্যখানে মদিনার নিকটবর্তী একটি স্থানের নাম। মুজামুল বুলদান গ্রন্থে বলা হয়েছে, আবওয়া মূলত মদিনার ফুরু’ (الفروع) অঞ্চলের বিস্তৃত এলাকা নিয়ে গঠিত একটি গ্রাম, যা জুহফা (الجحفة) থেকে মদিনার পথে। অর্থাৎ জুহফা থেকে মদিনার দিকে তার দূরত্ব তেইশ মাইল। এটিকে দক্ষিণ আরাত (يمين آرة) সংলগ্ন একটি অঞ্চল হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণ আরাত হলো অনেকগুলো প্রস্রবণসমৃদ্ধ একটি পাহাড়, যার প্রতিটি প্রস্রবণকে ঘিরে রেখেছে একেকটি গ্রাম। এই পাহাড়ের উপত্যকা আবওয়া এবং ওয়াদ্দান নামক স্থানদ্বয়ের সাথে মিলিত হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, তা মদিনার হজ-যাত্রীদের গমনপথে অবস্থিত একটি স্থান।[9]
এটি ছাড়াও স্থানটি সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তা লোহিত সাগর উপকূলের নিকটবর্তী ছিল এবং এই পথ দিয়েই সিরিয়াগামী বাণিজ্য কাফেলা ও অভিযাত্রীরা যাতায়াত করত। এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব ছিল বনু দামরার হাতে।[10]
আল্লামা শিবলি নোমানি বলেন, স্থানটির মূল অঞ্চল হলো ফুরু (الفروع), যেখানে মুজায়না গোত্র বসবাস করত। মদিনা থেকে তার দূরত্ব ৮০ মাইল। মক্কার দিক থেকে এটি মদিনার সীমান্তে অবস্থিত একটি অঞ্চল।[11] স্থানটির কর্তৃত্ব ছিল বনু দামরার, তবে বনু খুজাআরও বসবাস ছিল এখানে।[12]
আরো পড়ুন : সারিয়্যা বাশির ইবনে সাদ আনসারি – Expedition of Bashir Ibn Sa’d al-Ansari
আরো পড়ুন : সারিয়্যা বাশির ইবনে সাদ আল-আনসারি – Expedition of Bashir Ibn Sa’d al-Ansari (Fadak)
আরো পড়ুন : সারিয়্যা যুল-কাস্সা – Expedition of Muhammad ibn Maslamah
স্থানটির নাম আবওয়া (الأبواء) হওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ বলেন, স্থানটির নাম আবওয়া রাখা হয়েছে শব্দের প্রতি লক্ষ রেখে। কারণ, (الوباء) অর্থ মহামারি। সম্ভবত সেখানে সংঘটিত কোনো মহামারির (الوباء) কারণে স্থানটির নাম (الأبواء) হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে ভিন্নমত হলো, নামটি (أوباء) হওয়া উচিত ছিল। কারণ (الوباء) থেকে বহুবচন হিসেবে (أوباء) ব্যবহৃত হয়, (أبواء) নয়। এই মত অনুযায়ী أبواء শব্দটি بوء শব্দ থেকে উদ্গত। (بوء) শব্দের অর্থ ‘কোনো স্থানে স্থায়ী হওয়া’। সম্ভবত স্থানের অধিবাসীরা স্থায়ীভাবে স্থানটিকে বসবাসের জন্য নির্ধারণ করেছে বিধায় এই নামকরণ করা হয়েছে।[13]
উল্লেখ্য, আবওয়ায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মায়ের কবর অবস্থিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স যখন ছয় বছর, তখন তার মা তাকে নিয়ে মদিনায় তার পিতার কবর জিয়ারত করতে যান। সেখান থেকে মক্কায় ফেরার পথে আবওয়ায় তার মা ইনতেকাল করেন এবং সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।[14]
‘গাওয়া ওয়াদ্দান’ নামকরণের কারণ হিসেবে মুজামুল বুলদান গ্রন্থকার বলেন, ওয়াদ্দান মোট তিনটি স্থানের নাম। তন্মধ্যে এটি হলো মক্কা ও মদিনার মধ্যে ফুরু’ (الفروع) অঞ্চলের বিস্তৃত এলাকা নিয়ে গঠিত একটি গ্রাম। এটি এবং হারশা (هرشي)-এর মধ্যে ছয় মাইলের দূরত্ব। আর এই গ্রাম ও আবওয়ার মধ্যে দূরত্ব হলো প্রায় ৮ মাইল।[15] তবে অন্যান্য ঐতিহাসিক ৬ মাইল বলে উল্লেখ করেন।[16] মদিনার দিক থেকে তার ও রাবিগের মাঝে ২৯ মাইলের দূরত্ব।[17] স্থানটির অধিবাসী মোট তিনটি সম্প্রদায় অর্থাৎ বনু দামরা, বনু গিফার ও বনু কিনানা।[18]
এই প্রসঙ্গে মুহাম্মাদ রিদা বলেন, কেউ এটিকে ওয়াদ্দান নামক স্থানের এবং কেউ আবওয়া নামক স্থানের নামানুসারে নামকরণ করেন। কারণ জায়গা দুটি পাশাপাশি। এদের মধ্যে মাত্র ৬ মাইলের ব্যবধান।[19] তবে অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় সাহাবিদের সঙ্গে নিয়ে উপরিউক্ত স্থান দুটিতেই অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন।[20] সুতরাং গাজওয়াটির নামকরণে তার যেকোনো একটির নামে গৃহীত হওয়া স্বাভাবিক।
আরো পড়ুন : সারিয়্যা জায়েদ ইবনে হারিসা (কারাদা অভিযান) – Expedition of Zayd ibn Haritha
আরো পড়ুন : সারিয়্যা জায়েদ বিন হারিসা (জামুম) – Expedition of Zayd ibn Harithah (Al-Jumum)
আরো পড়ুন : সারিয়্যা দাহহাক ইবনে সুফিয়ান – Expedition of Dahhak al-Kilabi
মানচিত্র (০৪) : আল-আবওয়া অভিযান স্থল
গাজওয়ার প্রেক্ষাপট
মক্কাবাসীদের অত্যাচার-নিপীড়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের নিয়ে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। হিজরতের পর মদিনায় তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারলেন না। কারণ মক্কার জীবনে কাফেরদের অত্যাচারের প্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনায় হিজরতের পরও মুসলমানদের সেখানকার স্বাভাবিক জীবনযাপন দেখে মক্কার কাফেররা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে এবং দীন ইসলামের ক্রমবিকাশে তারা প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। ফলে ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য তারা মদিনায় আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং প্রয়োজনীয় রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের জন্য সিরিয়ামুখী বাণিজ্যিক তৎপরতা জোরদার করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যখন এ সকল সংবাদ এসে পৌঁছায়, তখন তাদের ষড়যন্ত্র থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের হেফাজত করার বিষয়টি তাকে চিন্তিত করে তোলে।
অপরদিকে মক্কার কুরাইশগণ মদিনার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসকারী গোত্রসমূহকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমনভাবে উত্তেজিত করে তুলতে থাকে, তাদের আক্রমণের আশঙ্কায় কয়েক বছর পর্যন্ত মদিনায় নিয়মিত রাত্রিকালীন পাহারার ব্যবস্থা করতে হয়। সাহাবিগণ অস্ত্রসহ ঘুমাতেন এবং সর্বদা যেকোনো অতর্কিত হামলার জন্য সতর্ক থাকতেন।[21] ইমাম বুখারি রহ. উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বরাতে সেই সময়ের ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত্রুদের অতর্কিত হামলার আশঙ্কায় গভীর রাত পর্যন্ত জাগ্রত ছিলেন। অতঃপর তিনি বিশ্রাম গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করলেন এবং বললেন, ‘যদি কোনো নেককার ব্যক্তি অবশিষ্ট রাতের প্রহরায় নিযুক্ত হতো, তাহলে আমি বিশ্রাম করতে পারতাম।’ এমন সময় বাইরে অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা গেল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে?’ উত্তর এলো, ‘আমি সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, পাহারা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি।’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্রাম করতে গেলেন।[22]
এ ছাড়াও তৃতীয় যে সমস্যাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদেরকে উদ্বেগের মধ্যে ফেলেছিল, তা হলো ইহুদিদের ষড়যন্ত্র। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের প্রথম দিকে ইহুদিরা মুসলমানদের পক্ষে থাকলেও পরবর্তীকালে যখন তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা ও অবস্থানের ক্রমোন্নতি দেখল, তখন তারা আর মনেপ্রাণে তা মেনে নিতে পারল না। কিন্তু মদিনাবাসীদের মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন, সেই চুক্তিতে ইহুদিরা আবদ্ধ থাকার কারণে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে প্রকাশ্যে তেমন কিছু করতে পারছিল না। কিন্তু ঠিকই তারা পর্দার অন্তরালে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে লাগল। তারা আনসার ও মুহাজিরদের ঐক্যে ফাটল ধরাবার জন্য তৎপর হয়ে উঠল। আবার কখনো আওস ও খাযরাজ গোত্রের মুসলমানদের মধ্যে বুআস যুদ্ধের বিস্মৃত স্মৃতি পুনরায় জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করল। বুআস যুদ্ধের সময় যেসব জ্বালাময়ী কবিতা আবৃত্তি করা হয়েছিল, আওস ও খাযরাজদের উত্তেজিত করার জন্য ইহুদিরা সেগুলো প্রায়ই আবৃত্তি করত। এভাবে তারা মুহাজির ও আনসার এবং আওস ও খাযরাজদের মধ্যে ঝগড়া বাধাতে সচেষ্ট ছিল।[23]
এ সকল পরিস্থিতিতে কুরাইশদের তৎপরতা রোধ করা, মদিনার পার্শ্ববর্তী গোত্রগুলোকে পক্ষে রাখা এবং মদিনার ইহুদিদেরকে তাদের তৎপরতা বন্ধে চাপ সৃষ্টি করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। এই প্রেক্ষিতেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষার জন্য প্রাথমিক কৌশল হিসেবে নিম্নের তিনটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন :
আরো পড়ুন : সারিয়্যা কুরজ ইবনে জাবির ফিহরি (সারিয়্যা উরায়না) – Expedition of Kurz bin Jabir Al-Fihri
আরো পড়ুন : সারিয়্যা খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রা. – Expedition of Khalid ibn al-Walid
আরো পড়ুন : সারিয়্যা গালিব ইবনে আবদুল্লাহ আল-লাইসি – Expedition of Ghalib ibn Abdullah al-Laithi (Al-Kadid)
১. বিভিন্ন দিকে মুসলিম সশস্ত্র টহলদার বাহিনী প্রেরণ করা, যাতে মুসলমানদের শক্তির প্রকাশ ঘটে এবং মনোবল বৃদ্ধির পাশাপাশি কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়।
২. মক্কা থেকে মদিনার পার্শ্ববর্তী সিরিয়া অভিমুখে ঘন ঘন অভিযান পরিচালনা করা, যাতে কুরাইশদের বাণিজ্য তৎপরতা সফল হতে না পারে। কারণ, সামরিক শক্তিবৃদ্ধির লক্ষ্যেই এই বাণিজ্য পরিচালিত হতো।
৩. উক্ত পথের পার্শ্ববর্তী গোত্রসমূহের সাথে মৈত্রীচুক্তি করা।[24]
আবওয়া অভিযানের লক্ষ্য
উপরে উল্লিখিত পরিকল্পনা অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবওয়া অভিযানে বের হন। তবে এক্ষেত্রে বিশেষভাবে দুটি লক্ষ্যের কথা ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে :
ক. সিরিয়া থেকে আগত কুরাইশদের একটি বাণিজ্য কাফেলার পথরোধ করা। বাণিজ্য কাফেলার এই পথরোধ করার উদ্দেশ্য হিসেবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক বলেন, তা ছিল কুরাইশদের বাণিজ্যিক তৎপরতা বন্ধ করা এবং কুরাইশদের কাছে মুসলমানদের শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে এ কথা বুঝিয়ে দেওয়া যে, মুসলমানগণ তাদের বাণিজ্য পথ বন্ধ করে দেওয়ার শক্তি রাখে।[25] তবে কাফেলার সম্পদ লুণ্ঠন করার উদ্দেশ্যে এই অভিযান পরিচালিত হয়নি।
খ. বনু দামরা গোত্রের সাথে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করা।[26] পূর্বেই বলা হয়েছে, আবওয়া নামক স্থানটির কর্তৃত্ব ছিল বনু দামরার হাতে এবং তা মক্কাবাসীদের সিরিয়ামুখী বাণিজ্য পথের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। বনু দামরার সাথে এই ধরনের চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল একাধিক। যেমন, শতধাবিচ্ছিন্ন আরব গোত্রগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলা, মক্কাবাসীদের সিরিয়ার বাণিজ্যে বাধা দেওয়া ও কুরাইশদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা।
আরো পড়ুন : সারিয়্যা কাআব ইবনে উমায়ের আল-গিফারি – Expedition of Ka’b ibn ‘Umair al-Ghifari
আরো পড়ুন : সারিয়্যা কাআব ইবনে উমায়ের আল-গিফারি রা. – Sariya Ka’ab ibn Umair al-Ghifari
আরো পড়ুন : সারিয়্যা কুতবা ইবনে আমের – Expedition of Qutbah ibn Amir
গাজওয়ার বিবরণ
ইবনে কাসিরের বর্ণনামতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মদিনায় আগমনের বারো মাস পর আবওয়া অভিযানে বের হন। এ হিসেবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক এটিকে দ্বিতীয় হিজরির সফর মাসে সংঘটিত অভিযান বলে উল্লেখ করেন। সফিউর রহমান মোবারকপুরি বলেন, আল-আবওয়া অভিযান (গাজওয়াতুল আবওয়া) সংঘটিত হয়েছিল দ্বিতীয় হিজরির সফর মাস মোতাবেক ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে।[27] জুরকানি অবশ্য সফর মাসের ১২ তারিখের কথা উল্লেখ করেন।[28] ইসলামি এনসাইক্লোপিডিয়া (উর্দু)-তে বলা হয়েছে, মুসলমানগণ সফর মাসের শুরুরদিকে এই অভিযানে বের হয়েছিলেন এবং ২০ তারিখে সফর থেকে ফিরে এসেছিলেন।[29]
অবশ্য তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় আরও মতপার্থক্য রয়েছে। ওয়াকিদি বলেন, এটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনায় আগমনের ১১ মাস পরের ঘটনা।[30] ইবনুল আসির বলেন, অভিযানটি ছিল প্রথম হিজরির জিলকদ মাসে।[31] ইমাম তাবারি বলেন, এটি দ্বিতীয় হিজরির রবিউল আওয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছিল।[32] তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক প্রথমোক্ত মতটি গ্রহণ করেন।
যুদ্ধের সৈন্যসংখ্যা
সৈন্যসংখ্যার হিসাব অধিকাংশ ঐতিহাসিক ৬০ জন বলে উল্লেখ করেন। তবে সফিউর রহমান মোবারকপুরি ৭০ জন বলেছেন[33] এবং ইবনে খালদুন তার তারিখে ২০০ জন উল্লেখ করেন।[34] এক্ষেত্রে একটি বিষয়ে সকল ঐতিহাসিক একমত, এই অভিযানে কোনো আনসার সাহাবি ছিলেন না।[35] নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সময় মদিনায় সাদ ইবনে উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিলেন। এই অভিযানে হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে পতাকা দেওয়া হয়েছিল। পতাকার রং ছিল সাদা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের কাফেলার মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে আবওয়া বা ওয়াদ্দান পর্যন্ত পৌঁছেন, কিন্তু কাফেরদের নাগাল না পাওয়ায় কোনো সম্মুখ সংঘর্ষ হয়নি। ফলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরের অবশিষ্ট দিনগুলোতে সেখানেই অবস্থান করেন। অবশ্য এক্ষেত্রে ইবনে কাসির রহ. বলেন, সফরের অবশিষ্ট দিনগুলোসহ রবিউল আওয়াল মাসের প্রথম কয়েক দিন অবস্থান করেন।[36] দাইরাতুল মাআরিফ ইসলামিয়াতে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২০শে সফর প্রত্যাবর্তন করেন। তবে ওয়াকিদিসহ অধিকাংশ ঐতিহাসিকের বর্ণনানুযায়ী তিনি পনেরো দিন মদিনা থেকে অনুপস্থিত থাকেন।[37]
উক্ত অভিযানে বনু দামরার দলপতি মাখশি ইবনে আমরের সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি মৈত্রীচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল, যা নিম্নরূপ :
আরো পড়ুন : সারিয়্যা উম্মু কিরফা – Killing of Umm Qirfa
আরো পড়ুন : সারিয়্যা উয়ায়না ইবনে হিসন আল-ফাজারি – Expedition of Uyainah bin Hisn
আরো পড়ুন : সারিয়্যা উসামা ইবনে জায়েদ – Expedition of Usama bin Zayd
‘বনু দামরা নিজেদের জানমালের ব্যাপারে নিরাপদ থাকবে। তাদের উপর কেউ হামলা করলে তাদেরকে সাহায্য করা হবে। তবে তারা যদি আল্লাহর দীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে, তবে এই সন্ধি বাতিল বলে গণ্য হবে। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না এবং মুসলমানদের শত্ৰুদেরকেও সাহায্য করবে না। তারা মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করবে না। সমুদ্র যতদিন তার সৈকতকে সিক্ত করবে, ততদিন এই চুক্তির কার্যকারিতা অটুট থাকবে। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাদেরকে তার সাহায্যের জন্য ডাকবেন, তখন তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।[38] উপরিউক্ত মৈত্রীচুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে আবওয়া অভিযানের পরিসমাপ্তি ঘটে।
তথ্যসূত্র
[1]. আত-তাবারি, তারিখ : ১/২৬১
[2]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৩ /২৯৫
[3]. সহিহ বুখারি : ২/৫৬৯; ড. ইয়াসিন মাজহার সিদ্দিকি, রাসুল মুহাম্মাদ-এর সরকার কাঠামো, অনুবাদ : মুহাম্মাদ ইব্রাহীম ভূইয়া : ১৫৩
[5]. ইমাম বুখারি, আস-সহিহ : ২/৫৬৩; ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৩/১৯৫
[6]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৩/১৯৭
[7]. ইবনুল আসির, আল-কামিল ফিত তারিখ : ২/১০
[8]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ২/১০
[9]. আল-হামাবি, মুজামুল বুলদান : ১/৭৯-৮০, প্রকাশক : দারু সাদের, বৈরুত, সংস্করণ : দ্বিতীয়, ১৯৯৫ খ্রি.।
[10]. ইসলামী বিশ্বকোষ, হজরত রাসুল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবন ও শিক্ষা : ৩৪২
[11]. শিবলি নোমানি, সিরাতুন নবী : ১/১৮৪
[12]. আল-হামাবি, মুজামুল বুলদান : ৭৯
[13]. আল-হামাবি, মুজামুল বুলদান : ৭৯; আরও দ্রষ্টব্য, জুরকানি, শরহুল মাওয়াহিবুল-লাদুন্নিয়া : ১/৩৯২
[14]. আল-হামাবি, মুজামুল বুলদান : ৭৯-৮০
[15]. আল-হামাবি, মুজামুল বুলদান : ৫/৩৬৫
[16]. ইবনে সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ১/৮
[17]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৩/২৯৮
[18]. আল-হামাবি, মুজামুল বুলদান : ৫/৩৬৫
[19]. মুহাম্মাদ রিদা, মুহাম্মাদুর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ১৫৮
[20]. হজরত রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও জীবন ও শিক্ষা : ৩৪৩
[21]. রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : জীবন ও শিক্ষা : ৩৪১; মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ১৭৩
[22]. ইমাম বুখারি, আস-সহিহ : ২/৫৬৩
[23]. মুহাম্মাদ হোসাইন হায়কাল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন চরিত : ৩২৩
[24]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ১৭৭; আরও ইসলামী বিশ্বকোষ, সম্পাদনা পরিষদ, হজরত রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবন ও শিক্ষা : ৩৪২
[25]. মুহাম্মাদ হোসাইন হায়কাল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন চরিত : ৩২০
[26]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৩/২৯৮
[27]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ১৭৯
[28]. জুরকানি, শরহুল মাওয়াহিবুল-লাদুন্নিয়া : ১/৩৯৩
[29]. শাহকার বেক ফাউন্ডেশন, ইসলামি এনসাইক্লোপিডিয়া, করাচি : ১১৮
[30]. ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/১১
[31]. ইবনুল আসির, আল-কামিল ফিত তারিখ : ২/১০
[32]. আত-তাবারি, তারিখুল উমাম ওয়াল-মুলুক : ১/২৬১
[33]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ১৭৯
[34]. ইবনে খালদুন, আত-তারিখ : ২/১৭
[35]. জুরকানি, শরহুল মাওয়াহিবুল-লাদুন্নিয়া : ১/৩৯৩
[36]. ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৩/২৪৩
[37]. ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/১২; মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ১৭৯
[38]. মুহাম্মাদ রিদা, মুহাম্মাদুর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : ১৫৮