৫. (২.) বুওয়াত অভিযান – Patrol of Buwat[1]
২. বুওয়াত অভিযান
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত গাজওয়া : ২ |
|||||||||||
|
|||||||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||||||
মদিনার মুসলমানগণ | মক্কার কুরাইশ | ||||||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||||||
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম | উমাইয়া ইবনে খালাফ | ||||||||||
শক্তি | |||||||||||
২০০ যোদ্ধা | ১০০ যোদ্ধা (১৫০০-২০০০ উট) | ||||||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||||||
কোনো লড়াই হয়নি, কোনো ক্ষতি নেই। | কোনো লড়াই হয়নি, কোনো ক্ষতি নেই। |
বুওয়াত পরিচিতি
গাজওয়ায়ে বুওয়াত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সংঘটিত দ্বিতীয় গাজওয়া। মক্কার কাফেরদের অত্যাচারের প্রেক্ষিতে মদিনায় হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসকল কাফেরের নানামুখী ষড়যন্ত্র ও প্রতিহিংসামূলক তৎপরতার শিকার হন, তন্মধ্যে মদিনায় আক্রমণের পরিকল্পনা এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র-রসদপত্র সংগ্রহের জন্য বাণিজ্যিক তৎপরতা জোরদার করা ছিল অন্যতম। সুতরাং ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থে তাদের এই অসৎ উদ্দেশ্য-প্রণোদিত বাণিজ্যিক তৎপরতা রোধ করা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। ফলে যখনই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসীদের কোনো বাণিজ্যিক কাফেলার খবর পেতেন, তখনই তাদের গতিরোধ করার জন্য অভিযান চালাতেন।[2]
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, আল-আবওয়া অভিযান রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের সর্বপ্রথম সামরিক অভিযান হলেও বুওয়াত অভিযান মদিনার আনসার মুসলমানদের প্রথম সামরিক অভিযান।[3]
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনায় হিজরতের পর বুওয়াত অভিযান পর্যন্ত কাফেরদের পক্ষ থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক বিভিন্ন প্রকার অপতৎপরতার বিরুদ্ধে মুসলমানদের কয়েকটি অভিযানে আনসার মুসলমানগণ শরিক হননি। এমনকি স্বয়ং নবীজির নেতৃত্বে সংঘটিত তার জীবনের প্রথম অভিযান আবওয়াতেও তারা শরিক হননি। এর তাৎপর্য হিসেবে ঐতিহাসিকগণ বলেন, আকাবার দ্বিতীয় বাইআতের সময় মদিনার আওস ও খাযরাজ এবং নবীজির মধ্যে নবীজির নিরাপত্তার ব্যাপারে যে চুক্তি হয়েছিল, তার ধরন ছিল আত্মরক্ষামূলক এবং ওই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল অন্যদের আক্রমণ থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা মুসলমানদের রক্ষা করা। ইসলামের পক্ষ হয়ে অন্যদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করা মোটেও উক্ত চুক্তির লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল না।[4]
আরো পড়ুন : সারিয়্যা ঈস/জায়েদ ইবনে হারিসা রা. – Expedition of Zayd ibn Harithah (Al-Is)
আরো পড়ুন : সারিয়্যা উক্কাশা ইবনে মিহসান রা. – Expedition of Ukasha bin Al-Mihsan
আরো পড়ুন : সারিয়্যা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. – Expedition of Umar ibn al-Khatab
আওস ও খাযরাজ ছাড়া বাইআতকারী অন্যান্য মুসলমানদেরও এই সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা ছিল যে, তারা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ওয়াদা করেন। কিন্তু আক্রমণাত্মক যুদ্ধের ব্যাপারে তারা কোনো প্রকার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেননি।[5] এই কারণে ইসলামের প্রাথমিক কয়েকটি অভিযানে মদিনার আনসার মুসলমানগণের অংশগ্রহণ দেখা যায় না। অবশেষে নিছক ইসলামের স্বার্থ বিবেচনা করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে বা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তারা সর্বপ্রথম বুওয়াত অভিযানে বের হন। এই দিক বিবেচনা করলে নিঃসন্দেহে একথা বলা যায়, মুসলমানদের প্রাথমিক অভিযানগুলোর তুলনায় এই অভিযান ছিল পূর্ণাঙ্গ ও অধিক সংঘবদ্ধ। আরও বলা যায়, এই অভিযানের মাধ্যমে আনসার, মুহাজির নির্বিশেষে সকল মুসলমান একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে উপনীত হন। তা হলো, ইসলামের স্বার্থ রক্ষা করা ও ইসলামকে শত্রুপক্ষের শত্রুতা থেকে হেফাজত করা।
বুওয়াত নামক স্থানের নামানুসারে এই নামকরণ করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, অনেক ঐতিহাসিক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই অভিযানের ব্যাপারে কিছুই উল্লেখ করেননি, তন্মধ্যে ওয়াকিদির কিতাবুল মাগাজি উল্লেখযোগ্য। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, আল্লামা আবুল হাসান আলি নদভি আল-আবওয়া অভিযান (গাজওয়াতুল আবওয়া) এবং বুওয়াত অভিযানকে একই গাজওয়া বলে উল্লেখ করেন। তিনি তার নবীয়ে রহমত নামক কিতাবে এক জায়গায় বলেছেন, ‘আল-আবওয়া অভিযান (গাজওয়াতুল আবওয়া), অনেকে এটিকে বুওয়াত অভিযানও বলে।’[6]
মানচিত্র (০৫) : বুয়াত অভিযান স্থল
যুদ্ধের সময়কাল
গাজওয়ায়ে বুওয়াতের তারিখ নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইবনুল আসির রহ.-এর বর্ণনায় এটিকে ১ম হিজরির ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[7] অন্য ঐতিহাসিকদের মতে এটি দ্বিতীয় হিজরিতে সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিতীয় হিজরির সময় নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। যেমন, ইবনে ইসহাকের উদ্ধৃতি দিয়ে জুরকানি বলেন, ‘তা রবিউল আওয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছে।’[8] ভিন্নমতে আবু উমর ইবনে হামের উদ্ধৃতি দিয়ে জুরকানি বলেন, ‘তা রবিউল আখিরে সংঘটিত হয়েছে।’[9] তবে প্রসিদ্ধ বর্ণনানুযায়ী গাজওয়া বুওয়াতের তারিখ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের তেরো মাসের মাথায় সংঘটিত হয়েছিল।’[10] সেই হিসেবে বলা যায়, যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরত ১ম হিজরির সফর মাসে হয়েছিল, সেহেতু হিজরতের তেরো মাসের মাথায় সংঘটিত অভিযান দ্বিতীয় হিজরির রবিউল আওয়াল মাসেই পড়ে। সফিউর রহমান মোবারকপুরি গাজওয়ায়ে বুওয়াতের তারিখ উল্লেখ করেন ২য় হিজরি রবিউল আওয়াল মোতাবেক ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস।[11]
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব (1) – Expedition of Ali ibn Abi Talib
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব রা. (3) – Expedition of Ali ibn Abi Talib
আরো পড়ুন : সারিয়্যা ইবনে আবিল আওজা – Expedition of Ibn Abi Al-Awja Al-Sulami
স্থান পরিচিতি
ইসলামের ইতিহাসে বুওয়াত একটি উল্লেখযোগ্য স্থান। এই স্থানেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে আনসার-মুহাজিরদের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনীর একটি জিহাদ পরিচালিত হয়েছিল। স্থানটির শাব্দিক উচ্চারণের একক কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। ভাষাবিদগণের এক পক্ষ এটিকে (بواط) অর্থাৎ প্রথম অক্ষর باء-এর উপর পেশ, واو -এর উপর জবর প্রদান করে স্থানটিকে বুওয়াত হিসেবে উচ্চারণ করেন। অপরপক্ষে আসিল আল-মুসতামিলি (যিনি বুখারির হাদিস বর্ণনাকারী রাবিদের একজন) এবং আল-আজরি (যিনি মুসলিম শরিফের রাবিদের একজন) প্রমুখের বর্ণনানুযায়ী স্থানটিকে باء -এর উপর জবর প্রদান করে বাওয়াত উচ্চারণ করা হয়েছে। তবে জুরকানি অবশ্য (المطالع) মাতালি’ গ্রন্থের এবং কামুস গ্রন্থকারের বরাতে বলেন, ‘প্রথমোক্ত মতটি যেমন সহজ, তেমনই অধিক পরিচিত।’[12] প্রকৃতপক্ষে দেখা যায়, অধিকাংশ ঐতিহাসিক بواط শব্দটির উচ্চারণের বর্ণনায় পূর্বোক্ত দুটি মতের কথা উল্লেখ করলেও باء -এর উপর পেশযুক্ত উচ্চারণটিকেই গ্রহণ করেন।
ঐতিহাসিকদের আলোচনায় বুওয়াতের স্থান পরিচিতি হিসেবে বিভিন্ন কথা এসেছে। একদিকে বলা হয়েছে, বুওয়াত জুহায়না পর্বতমালার অন্তর্ভুক্ত একটি পাহাড়। এটি ইয়ানবু (ينبوع)-এর নিকটবর্তী এবং মদিনা থেকে ৪৮ মাইল দূরে অবস্থিত। সুহাইলি বলেন, ‘বুওয়াত একটি পাহাড়ের দুটি শাখার অংশ। ভিন্নভাবে এদেরকে জালসি (جلسي) এবং গাওরি (غوري) বলা হয়। তন্মধ্যে জালসি অঞ্চলে বনু দিনার গোত্র বসবাস করত। এটি ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের দ্বিতীয় দফায় সামরিক অভিযানের মূল স্থল।’[13] তবে এটি ছাড়াও স্থানটির অন্যান্য বর্ণনা এসেছে। যেমন, স্থানটি লোহিত সাগরের উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে বলা হয়েছে।[14] আর-রাহিকুল মাখতুম-এ বলা হয়েছে, বুওয়াত একটি পাহাড়ের নাম। বুওয়াত ও রাদওয়া জুহায়না পাহাড়ি এলাকার দুটি পাহাড়। মূলত এটি একটি পাহাড়ের দুটি শাখা। মক্কা থেকে সিরিয়া যাওয়ার পথে পাহাড়টি পড়ে এবং এই কথা পূর্বেও বলা হয়েছে, মদিনা থেকে তা ৪৮ মাইল দূরে অবস্থিত।[15]
বুওয়াতের ভৌগোলিক গুরুত্ব
তৎকালীন আরবের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বলে গণ্য করা হতো সিরিয়াকে। মক্কাবাসীরা তাদের পণ্যদ্রব্য বিক্রয়ের জন্য এখানে নিয়ে আসত এবং তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী এখান থেকে আমদানি করত। আর এই বাণিজ্যিক যোগাযোগের জন্য স্থলপথই ছিল একমাত্র উপায়। পথের দূরত্ব ছিল যেমন বেশি, তেমনই ওই সময় দস্যুবৃত্তির প্রকোপও ছিল অত্যধিক। তাই যোগাযোগ ছিল কাফেলাভিত্তিক। অনেকের প্রয়োজন একত্র হবার পর একটি বাণিজ্যিক কাফেলা তৈরি হতো। উট, ঘোড়া, গাধা ও খচ্চর প্রভৃতি বাহনের মাধ্যমে মক্কার লোকেরা কাফেলাবদ্ধ হয়ে সিরিয়ায় যেত এবং তাদের বাণিজ্যিক তৎপরতা পরিচালিত করত।
বুওয়াত স্থানটি মক্কা-সিরিয়া বাণিজ্যিক কাফেলাগুলোর পথে পড়ত। স্থানটি মদিনার নিকটে হওয়ায় মদিনাবাসীদের দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত ছিল। মক্কার সাথে মদিনাবাসীদের সম্পর্কে কোনো প্রকার অবনতি ঘটলে উক্ত স্থানের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হতো, তেমনই সিরিয়ামুখী বাণিজ্যের অবস্থাও নাজুক হয়ে পড়ত। বুওয়াত কেবল মক্কা-সিরিয়া বাণিজ্যিক পথের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং আরবের গোটা দক্ষিণাঞ্চলের বাণিজ্যিক পথের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই অঞ্চল থেকে যেসকল বাণিজ্যিক কাফেলা চলাচল করত বা মক্কায় আসত, তার কোনোটিতে আড়াই হাজার পর্যন্ত উট বোঝাই পণ্য থাকত। এসব পণ্যের মূল্য পঞ্চাশ হাজার দিনারেরও বেশি হতো। ড. স্প্রেংগার বলেন, ‘এই সময় মক্কা থেকে যেসব পণ্য বাইরে যেত, সেসবের মূল্য অনেক সময় এক লাখ ষাট হাজার লিরা বা দুই লাখ ডলার ছাড়িয়ে যেত।’[16]
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলকামা ইবনে মুজাযিয আল-মুদলিজী – Expedition of Alkama Ibn Mujaziz Al-Mudliji
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আল-কুররা বি’র মাউনা – Expedition of Bir Maona
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আলি ইবনে আবি তালিব ( ) – Expedition of Ali ibn Abi Talib (2)
গাজওয়ার প্রেক্ষাপট
হিজরতের পর থেকেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবিদের বিরুদ্ধে মক্কাবাসীরা যে ষড়যন্ত্র করে আসছিল, তা প্রতিহত করার লক্ষ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরপর কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করলেন। ফলে মক্কাবাসীদের সিরিয়ামুখী বাণিজ্য ব্যবস্থা বিপন্ন হয়ে পড়ল। মদিনার পার্শ্ববর্তী এলাকার গোত্রগুলো ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হতে লাগল। তাদের মদিনায় যাওয়ার পথ সংকীর্ণ ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল।
এই পরিস্থিতিতে মক্কাবাসীরা তাৎক্ষণিকভাবে মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবওয়া অভিযানের পর মাত্র এক মাসের মধ্যে মদিনায় পরপর দুটি অভিযান পরিচালনা করল, যদিও তাতে তারা কোনো সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। এমনকি মুসলমানদের সাথে তাদের কোনো ধরনের মুখোমুখি সংঘর্ষও হয়নি। কিন্তু মদিনার জন্য এটি একদিকে বড় ধরনের ভবিষ্যৎ হামলার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলল, অন্যদিকে মদিনার পার্শ্ববর্তী গোত্রের সাথে মুসলমানদের মৈত্রী চুক্তির ভিতও দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিল। এমতাবস্থায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েকটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। তন্মধ্যে মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধি ও রণপ্রস্তুতি-প্রশিক্ষণ নিশ্চিতকরণ, মক্কাবাসীদের বাণিজ্যিক তৎপরতাকে আরও সূদৃঢ়ভাবে প্রতিরোধকরণ, সম্পাদিত মৈত্রী চুক্তি আরও জোরদার করার লক্ষ্যে তাদের সাথে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উপরিউক্ত প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলেন :
১. মুসলিম টহলদার বাহিনী আরও জোরদার করা।
২. কাফেরদের কোনো বাণিজ্যিক কাফেলার সংবাদ পেলে তাৎক্ষণিকভাবে তা প্রতিহত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩. মুসলিম সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা।
৪. আনসার-মুহাজির নির্বিশেষে সকল সামরিক পদক্ষেপে মুসলমানকে একই পতাকাতলে সমবেত করা।
গাজওয়ার বিবরণ
মাহমুদ শাকের বলেন, আবওয়া অভিযান সমাপ্ত হওয়ার কয়েকদিন পরই এই গাজওয়া সংঘটিত হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওহির মাধ্যমে জানানো হয়েছিল, কুরাইশদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কায় ফিরে যাচ্ছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন দুইশত সৈন্যবাহিনী নিয়ে ওই কাফেলার পথরোধ করার উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে বের হলেন। ইবনে কাসিরের বর্ণনানুযায়ী, এ সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাইব ইবনে উসমান ইবনে মাজউন রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মদিনায় তার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন।[17] তবে ওয়াকিদির বর্ণনায় এক্ষেত্রে সাদ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।[18]
এই অভিযানে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে পতাকা বহন করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পতাকার রং ছিল সাদা।[19]
কুরাইশদের উক্ত কাফেলা ছিল বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। কাফেলার নেতৃত্বে ছিল উমাইয়া ইবনে খালাফ। সংখ্যায় তারা ছিল একশত। কাফেলাটি আড়াই হাজার উট নিয়ে ফিরছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৈন্য নিয়ে বুওয়াত পর্যন্ত পৌঁছালেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের ব্যাপারটি উপলব্ধি করতে পেরে কুরাইশ সর্দার কাফেলা নিয়ে অন্য পথে গমন করল। ফলে এই অভিযানেও কুরাইশদের সাথে মুসলমানদের কোনো সংঘর্ষ হয়নি।[20] রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় এক মাস সেখানে অবস্থান করে কাফেলাসহ মদিনাতে ফিরে এলেন।
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আবুল হাদরাদ – Expedition of Abi Hadrad al-Aslami
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আমর ইবনুল আস – Expedition of Amr ibn al-As
আরো পড়ুন : সারিয়্যা আমর ইবনে উমাইয়া আদ-দামরি রা. – Expedition of Amr bin Umayyah al-Damri
গাজওয়ার ফলাফল
বুওয়াত অভিযান ইসলামের ইতিহাসে একটি বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। এটি মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ পরিমণ্ডল, মদিনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এবং মক্কার কাফেরদের মধ্যে খুব প্রভাব ফেলে। এই গাজওয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফলাফল হলো ইসলামের বিরুদ্ধে সকল অপতৎপরতা রোধে আনসার-মুহাজির-নির্বিশেষে সকল মুসলমানের ঐক্যবদ্ধভাবে একই পতাকাতলে সমবেত হওয়া। এটি ছাড়া দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ফল হলো মদিনার পার্শ্ববর্তী এলাকার সকল মিত্র গোত্রের সাথে সম্পর্কের উন্নতি। এই ঘটনার প্রায় দুই মাস পর পরবর্তী গাজওয়া উশাইরা সংঘটিত হয়েছিল।[21]
তথ্যসূত্র
[1]. বিস্তারিত জানেতে দেখুন, (غَزْوَةُ بُوَاطٍ) তারিখুল ইসলাম, ২/৪৭, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/২৯, তারিখু খালিফা, ৫৭, আররাউদুল উনফ, ৫/৪৬, ইমতাউল আসমা, ১/৭৩, সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৪/১৫; ইবনে সায়্যিদিন্নাস, উয়ুনুল আসার :১/২৬২, আল-মাগাজি লিল ওয়াকিদি, ১২, নুরুল ইয়াকিন, ৯৩, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা লি ইবনি হিশাম, ১/৫৯৪, শরহুয যুরকানি আলাল মাওয়াহিব, ২/২৩১, আর-রাহিকুল মাখতুম, ১৭৯
[2]. যুরকানি, যুরকানি, শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়া : ১/৩৯৩
[3]. মুহাম্মাদ হোসাইন হায়কাল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন চরিত : ৩১৭
[4]. মুহাম্মাদ হোসাইন হায়কাল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন চরিত : ৩১৭
[5]. মুহাম্মাদ হোসাইন হায়কাল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন চরিত : ৩১৭
[6]. সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভি, আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী অনূদিত, নবীয়ে রহমত : ২২৫
[7]. ইবনুল আসির, আল-কামিল ফিত তারিখ, ২/৫
[8]. যুরকানি, শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়া : ১/৩৯৩
[9]. যুরকানি, শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়া : ১/৩৯৩
[10]. ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/১২
[11]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ১৪৮, ১৭৯
[12]. যুরকানি, শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়া : ১/৩৯৩
[13]. যুরকানি, শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়া : ১/৩৯৩
[14]. হযরত রাসুল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, জীবন ও শিক্ষা : ৩৪৬
[15]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ১৭৯
[16]. মুহাম্মাদ হোসাইন হায়কাল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন চরিত : ৩১৯-৩২০
[17]. ইবনে কসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৩/৩০১
[18]. ওয়াকিদি, কিতাবুল মাগাজি : ১/১৩; ইবনে সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা : ১/৮
[19]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৩/৩০১
[20]. মোবারকপুরি, আর-রাহিকুল মাখতুম : ১৭৯; যুরকানি, শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়া : ১/৩৯৪; ইবনে কসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ১/৩০১; রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : জীবন ও শিক্ষা : ৩৪৬
[21]. রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : জীবন ও শিক্ষা : ৩৪৬