মিশকতাতুল আসার
ওয়া মিসবাহুল আবরার
সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ মিয়া দেওবন্দি রাহিমাহুল্লাহ
১৩২১ হিজরি – ১৩৯৫ হিজরি
ভাষান্তর ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
মাওলানা মুহাম্মাদ সফিউল্লাহ
مقدمة
بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله وكفى وسلامٌ على عباده الذين اصطفى، خصوصاً على سيدنا وسيد الثقلين محمد المجتبى وأحمد المصطفى، وعلى آله وأهله الطيبين الطاهرين وأصحابه المزكّين، وأتباعهم المصطفين، إلى يوم الدين. أما بعد- فقد قال الله تعالى في كتابه المبين -و هو أصدق القائلين-: ﴿إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾ [الحجر: 9]
قال العبد الضعيف «محمد میاں» : من أبدع الأمثلة لهذه الحفاظة التي وعدها الله ما تشرفت به الهند.
অনুবাদ : সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য এবং তিনিই যথেষ্ট। আর শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর নির্বাচিত বান্দাদের ওপর। বিশেষ করে আমাদের এবং উভয় জাহানের সরদার মুহাম্মাদ-এর ওপর যিনি নির্বাচিত এবং আহমাদ-এর ওপর যিনি মনোনীত। এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও বংশধরের ওপর, যাঁরা পূতপবিত্র। এবং তাঁর সাহাবিদের উপর, যারা পরিশুদ্ধ এবং কেয়ামত পর্যন্ত তাদের অনুসারীদের উপর যারা মনোনীত। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তার সুস্পষ্ট কিতাব পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন; -আর তিনি তো মহান সত্যবাদী—
অর্থ : নিশ্চয়ই আমি কুরআন নাজিল করেছি এবং নিশ্চয় আমিই তার রক্ষণাবেক্ষণকারী। [সুরা আল-হিজর : (১৫) : ৯]
দুর্বল বান্দা মুহাম্মদ মিয়াঁ বলেন, (পবিত্র কুরআনের আয়াতে) আল্লাহ তায়ালা যে রক্ষণাবেক্ষণের ওয়াদা করেছেন, তার বিরল দৃষ্টান্তের অন্তর্ভুক্ত সে অনন্য ভূমিকা যার মর্যাদা লাভ করেছে ভারত।
كان من قضاء الله أن الدولة المُغُولِيَّة – التي كانت عُروة للمسلمين في الهند، ومِسكَة لقوتهم وشوكتهم، تستقي منها معاهدهم الثقافية، وترتوي حدائقهم العلمية، انقرضت كل الانقراض في السنة الرابعة والسبعين بعد المائتين والألف من الهجرة النبوية على صاحبها الصلاة والسلام الموافق ۱۸۵۷م باستيلاء الإنكليز على بلاد الهند قاطبة؛ فبقي المسلمون في حيرة وقلق عظيم، كأنهم يتامى لا ولي لهم ولا والٍ، ولامُعين لهم ولا واقٍ.
فبمقتضى هذه الحالة المقلقةالمنقلبة كان من الطبيعي أن تخمد نيران العلوم الإسلامية، وتطفئ مصابيح مناراتهم العلمية وتكسف في الهند شمس الملة البيضاء، وتنكدر نجومها، وتغشى ظلمات الجهل و العمه ظهورها وبطونها، وكاد ذلك أن يبدو واقعاً فإذا الطاف فضل الله العظيم ورحمته توجهت نحو عباد الله الصالحين، تلقى في قلوبهم العزم الراسخ لحفاظة الدين بطرز جديد و نمط بديع لم يسبق له مثيل.
অনুবাদ : আল্লাহ তায়ালার ফায়সালাই ছিলো এমন, যে মোগল সম্রাজ্য ছিলো ভারতের মুসলমানদের আশ্রয় এবং তাদের প্রতাপ ও শক্তিমত্তার কেন্দ্র, যার সাহায্যে মুসলমানদের কৃষ্টিকালচারের কেন্দ্রগুলো সচল থাকতো এবং তাদের জ্ঞানের উদ্যানগুলো সজীব থাকতো; সে মোগল সম্রাজ্যের পূর্ণ পতন ঘটলো ১২৭৪ হিজরি মোতাবেক ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে গোটা ভারতবর্ষে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে। তখন মুসলমানরা এক বিশাল অস্থিরতায় ও দুশ্চিন্তায় নিপতিত হয়। যেন তারা একদল এতিম; যাদের নেই কোনো অভিভাবক, নেই কোনো শাসক, নেই কোনো সহায়ক, নেই কোনো রক্ষক। এই উদ্বেগজনক প্রতিকূল পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী এটাই স্বাভাবিক ছিলো; ইসলামি জ্ঞানের আলো নিভে যাবে, ইলমি মিনারাসমূহের বাতিগুলো নিভে যাবে, এবং ভারতবর্ষে এক আলোকিত জাতির (ভাগ্যাকাশের) সূর্য স্তিমিত হবে এবং তারকাগুলো অন্ধকারে হারিয়ে যাবে; সঙ্গে সঙ্গে মূর্খতার ও অন্ধত্বের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অন্ধকার (সর্বত্র) ছেয়ে যাবে। আর বাস্তবেই এমনটা প্রকাশ পাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো; কিন্তু হঠাৎ আল্লাহ তায়ালার দয়া ও রহমত তার একদল নেককার বান্দার দিকে ধাবিত হলো। তাঁদের হৃদয়ে (আল্লাহর) দীনকে এমন এক পদ্ধতি ও দুর্লভ পন্থায় সুরক্ষিত রাখার দৃঢ় স্পৃহা তৈরি হয়েছিলো, যার দৃষ্টান্ত আগে দেখা যায়নি।
ألقى في أرواعهم وأذهانهم تأسيس معاهد علمية، تدرّس فيها العلوم الدينية، مع التربية على مكارم الأخلاق متوكلين على الله مستغنين كل الاستغناء عن إعانة الحكومة المتسلطة متمسكين بأذيال القناعة والصبر معتمدين في حوائجهم المالية على تبرعات المؤمنين القانتين وهداياهم المخلصة.
وأول من استجاب لهذه الإلقاء الروعي، وقام لهذا المقصد العظيم والفرض القويم صلحاء هذه القرية التي تعرف باسم «دیوبند» من قرى «سهارنبور» على نحو مائة وخمسين كلومترا من عاصمة الهند «دهلي».
وجعلوا رئيسهم وقائدهم في هذا المقصد العالم الأوحد الذكي البلمعي الزاهد الأبر، إمام الأتقياء، ومقتدى العلماء، مولانا الشيخ «محمد قاسم النانوتوي» – رحمة الله عليه- فرأينا على أديم الأرض في ناحية مسجد قديم تحت شجرة الرمان أستاذاً اسمه «محمود» يدرس تلميذاً هو سميّه «محمود». كان هذا شَطأ للمزرع العلمي الذي زرعه هؤلاء الصلحاء صلحاء «ديوبند» في سنة ثمان وثمانين بعد المائتين والألف من الهجرة النبوية على صاحبها آلافُ آلافِ تحيةٍ.
অনুবাদ : আল্লাহ তায়ালা তাদের মন-মস্তিষ্কে এমন কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা ঢেলে দিলেন; যেখানে উত্তম চরিত্রের দীক্ষা প্রদানের সাথে সাথে ইলমে দীনের দরস হবে—আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে, কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীর সাহায্য-সহযোগিতা থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে, অল্পেতুষ্টি ও ধৈর্যের আঁচল আকড়ে ধরে, তাঁদের আর্থিক প্রয়োজনগুলোতে তারা মুমিন বান্দাদের দান-অনুদান ও স্বতঃস্ফূর্ত হাদিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে।
আর সর্বপ্রথম এই পরিকল্পনা কার্যকর করার লক্ষ্যে সাড়া দিলেন এবং এই মহান উদ্দেশ্য ও বিশুদ্ধ ফরজ আঞ্জাম দেওয়ার নিমিত্তে উদ্যেগী হলেন এই জনপদের নেককার ব্যক্তিবর্গ যা দেওবন্দ নামে পরিচিত। যেটি সাহারানপুরের জনপদসমূহের অন্তর্গত। যেটি ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।
আর তারা এই উদ্দেশ্যে তাদের প্রধান ও পরিচালক নিযুক্ত করেন অদ্বিতীয় আলেম, মেধাবী, প্রতিভাবান, দুনিয়া বিমুখ, সৎ পরহেযগারদের ইমাম, উলামাদের অনুসৃত ব্যক্তিত্ব মাওলানা শায়খ মুহাম্মাদ কাসেম নানুতাভী (র.)-কে। যার ফলে আমরা দেখতে পাই যমীনের উপর এক প্রাচীন মসজিদের পাশে ডালিম গাছের নিচে এক (মহান) উস্তাদকে, যার নাম মাহমুদ। তিনি দরস দিচ্ছেন এক (সৌভাগ্যবান) তালিবুল ইলমকে, যিনি তাঁর মিতা মাহমুদ। এটাই ছিলো ইলমী আবাদ ভূমির প্রথম আঙ্কুর, যা রোপন করেছিলেন এসকল নেককার ব্যক্তিবর্গ তথা দেওবন্দ জনপদের নেককার ব্যক্তিবর্গ। হিজরতে নববীরল ১২৮৮ সনে। সাহেবে নবুওয়াতের উপর লক্ষ লক্ষ সালাম।
ولم يمْض على نُشوئه واستوائه إلا سنوات عديدة حتى عادت حديقة مخضرة، وجنة مدهامة، بلغ المنزل الأقصى من جهته العلمية والروحية، تعانقان مكارم الأخلاق، وتتحليان بسنن الهدى سنن سيد المرسلين صلوات الله وسلامه- واليوم تعرف هذه المدرسة بـ «دار العلوم دیوبند». وقد برز المتخرجون من هذا المعهد متصفين بهذه الخصائل الحميدة والصفات المحمودة.
ولم يزل عددهم يزداد، و حلقة تلاميذهم وتلاميذ تلاميذهم تتوسع حتى عمّت بلادَ الهند و جاوزتْها، حتى لم يبق قُطر من أقطار الأرض حتى أرض الحرمين الشريفين «مكة المعظمة» و «المدينة المنورة» إلا وفيه عدد من هؤلاء المستفيضين من هذا المنبع «دار العلوم الديوبندية». يشتغلون في التدريس في مدارسهم التي أقاموها، أو التصنيفِ والتأليف أو الدعوة والإرشاد في مراكزهم التي أسسوها. فهؤلاء هم اليوم حَمَلة العلوم الدينية والمحافظون على سنن الهدى وأداب الإيمان واليقين، المصدِّقون ببشارة سيد المرسلين: «لاتزال طائفة من أمتي ظاهرين حتى يأتيهم أمر الله وهم ظاهرون»« صَحِيْحُ البُخَارِيِّ» -الشاكرون الحامدون- لما فضّلهم الله به ضوأكرمهم، إنه جعلهم مظاهر وعوامل لإيفاء ما وعد به بقوله المتين: ﴿إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾ [الحجر: 9]
অনুবাদ : সূচনালগ্নের কয়েক বছর অতিবাহিত না হতেই দ্বীনী ইলমের এই উদ্যান সজীবতা লাভ করে এবং তালিবুল ইলমদের পদচারণায় মুখোরিত হয়ে উঠে। যেখানে যুগপদ নববী ইলমের শিক্ষা এবং নববী আদর্শের দীক্ষার সমন্বয় ঘটে।
আর আজ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান “দারুল উলুম দেওবন্দ” নামে পরিচিত।
এই প্রতিষ্ঠান থেকে ফুযালার বের হয়েছে এ সকল উত্তম চরিত্র ও প্রশংসনিয় গুণাবলীদ্বারা গুনন্বিত হয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ভারতের সকল রাষ্ট্রে, এমন কি বশ্বের প্রতিটা দেশে তারা ছড়িয়ে পড়েছে। পবিত্র ভূমি মক্কা এবং রাসূল-এর শহর মদীনাতেও রয়েছে এ প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষপ্রাপ্ত বহু তালিবুল ইলম, যারা সেখানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় অধ্যাপনায় নিয়োজিত; কিংবা রচনা ও সংকলনের কাজ অথবা দাওয়া ও নসীহার দায়িত্ব নিয়োজিত। তারা আজ দ্বীনী ইলমের ধারক-বাহক এবং হেদায়েতের পথ ও ইমানের নীতিমালার রক্ষণাবেক্ষণকারী। তারা রাসূল-এর এ সুসংবাদে বিশ্বাসী- “আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা বিজয়ী থাকবে এমন কি যখন কেয়ামত এসে যাবে তখনও তারা বিজয়ী থাকবে।” -(বুখারী)
তারা আপন রবের শোকরগুজার এবং তার প্রশংসাকারী। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে শ্রেষ্টত্ব দান করেছেন এবং তাঁর ওয়াদা বাস্তবায়নের মাধ্যম হওয়ার মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। তিনি তো ওয়াদা করেছেন- “নিশ্চয়ই আমি কুরআন নাজিল করেছি এবং আমিই তার রক্ষণা বেক্ষণকারী।” –[সুরা আল-হিজর: (১৫) : ৯]
ثم إن «دار العلوم» هذه التي مضى عليها أكثر من مائة سنة والتي يديرها اليوم الفاضل النبيل الخطيب المصقع، مولانا محمد طيب الذي هو في فضائله وسماته كاسمه طيب، حفيدُ مولانا محمد قاسم المؤسس لـ «دار العلوم» لها مجلس استشاري، أركانه يُنتخبون من العلماء الراسخين المَوثوقون بهم عند عامة المسلمين وخاصتهم، أرباب بصيرة في العلوم وأصحاب خبرة في أساليب التربية والتعليم، لهم إطلاع على أفكار جديدة ومطالب عصرية، كما لهم حذاقة في العلوم القديمة.
ولا يزال منهج دراسات «دار العلوم» مطمحَ نظرهم ومحطّ بصيرتهم، ويضيفون إليه وينقصون منه، كلما تقتضي الأحوال ومصالح التعليم والتدريس لرفع شأن التعليم والتربية.
অনুবাদ : এ যাবৎ কাল পর্যন্ত দারুল উলুম দেওবন্দের শত বছরের অধিক কাল অতিবাহিত হয়েছে। বর্তমানে দারুল উলুম দেওবন্দ পরিচালনা করছেন মহান আলেম, অনর্গলভাষী খতীব মাওলানা মুহাম্মদ তৈইয়ব “দামাত বারাকাতুহু”। তিনি তাঁর নামের মতোই “তৈইয়ব” অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ ও উত্তম ব্যক্তি। সম্পর্কে তিনি দারুল উলুমের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতাভী (র.)-এর নাতি।
দারুল উলুম দেওবন্দের রয়েছে একটি “মজলিসে শুরা” বা পরামর্শ কমিটি। মজলিসে শুরার সদ্যসগণ বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের মধ্য থেকে নির্বাচিত এবং মুসলিম সমাজে অত্যন্ত আস্থাভাজন ব্যক্তিত্ব। অধ্যাপনা ও মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে তারা যেমন বিজ্ঞ, তেমন অভিজ্ঞ। জ্ঞানের প্রচীন শাস্ত্রগুলো সম্পর্কে তাদের রয়েছে যথার্থ পণ্ডিত্ব, তেমন নিত্য- নতুন চিন্তা-চেতনা ও যুগের চাহিদা সম্পর্কে তাঁদের রয়েছে সজাগ দৃষ্টি ও অবগতি।
দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠ্যসূচি সম্পর্কেও তাঁরা অতন্ত সজাগ
সচেনতন। যুগের চাহিদা এবং শিক্ষা-দীক্ষার মনোন্নয়নের লক্ষ্যে তাঁরা পাঠ্যসূচিতে সংযোজন বিয়োজন করে থাকেন।
وقد قضى فكرهم البالغ واجتهادهم الكاملُ في سنة إحدى وتسعين (من المائة الرابعة عشرة) أن يدخَل في المنهج الدراسي بعض الفنون الجديدة ويضاف إلى مقررات العلوم القديمة بعض ما يسهل تحصيله ويمكن نفعه. فنظروا لهذا المقصد في الكتب المؤلفة المطبوعة، فأخذوا منها ما ساعدهم في مقصدهم، و مالم يجدوه من المؤلفات المطبوعة موافقا لمرادهم قرروا أن يؤلَّف ما يلائم غرضهم.
وإن أحاديث رسول الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم وإن كانت من أهم المقاصد المنهج الديني لا تماس أهدابه إلا في أواخره. وكان «مِشْكَاةُ الْمَصَابِيْحِ» أول كتب الحديث درس قبل التخريج بسنة، ولَعَمْري إن القرآن وأحاديث رسول الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَبُغيَة قصوى ومُنْيَةٌ عظمى تتعلق بالمنهج الديني. فقرروا -وما أحسن ما قرروا- أن تبدأ دروس الأحاديث من المرحلة الوسطى من الأحاديث التي تتعلق بمكارم الأخلاق والبر والإثم وسنن الهدى، كي يكون المتعلم على بصيرة منها ويتحلى بها بتوفيق الله، إن كان ذا حظ من التوفيق.
অনুবাদ : তাদের বিজ্ঞ চিন্তা-চেতনা ১৩৯১ হিজরি সনে এ ফায়সালা প্রদান করে যে, দারুল উলুমের পাঠ্যসূচিতে কিছু নতুন শাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং প্রাচীন শাস্ত্রগুলোর ক্ষেত্রে আরও কিছু কিতাব সংযুক্ত করা হবে, যেন উক্ত শাস্ত্রীয় জ্ঞান অর্জন করা শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ হয়। এ লক্ষ্যে তারা মুদ্রিত ও প্রকাশিত কিতাবগুলোর মধ্যে যেটাকে উপযোগী মনে করেছেন, গ্রহণ করেছেন। আর যে বিষয়ে উপযোগী কিতাব পাওয়া যায়নি, সে ক্ষেত্রে নতুন গ্রন্থ রচনা ও সংকলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সূচনালগ্ন থেকেই হাদীসে নববী দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠসূচির অন্যমত গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্র। কিন্তু এ শাস্ত্রের প্রথম কিতাব “মিশকাতুল মাসাবিহ” এর পাঠ দান করা হয় শিক্ষার্থীর শিক্ষা-সমাপনের মাত্র এক বছর আগে।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, পবিত্র কুরআন এবং হাদীসে নববী পাঠ্যসূচিতে চূড়ান্ত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য এবং বিষয় দু’টি দীন-ধর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি নির্ধারকগণ এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, শিক্ষা সিলেবাসের মাধ্যমিক স্তর থেকেই হাদীসশাস্ত্রের চর্চা শুরু হবে। মাধ্যমিক স্তরের সিলেবাসে থাকবে এমন সব হাদীস; যা মহৎ চরিত্র, পাপ ও পূণ্য এবং হেদায়াতে পথ- পদ্ধতি সম্বলিত, যেন শিক্ষার্থী এ জাতীর হাদীস পাঠ করে তার আলোকে নিজেকে আলোকিত করতে পারে। পারিশেষে এর জন্য আল্লাহ তায়ালার তাওফিক প্রাপ্তি একান্ত অবশ্যক। বর্তমানে প্রকাশিত ও প্রচলিত কিতাবগুলোর মধ্যে তাদের উদ্দিষ্ট ও কাঙ্ক্ষিত সংকলনের মতো কোনো কিতাব পাওয়া যায়নি বিধায় এমন একটি হাদিসের কিতাব সংকলনের দায়িত্ব দারুল উলুম দেওবন্দের নীতিনির্ধারকগণ আমার মতো দুর্বল ও অযোগ্য ব্যক্তির দায়িত্বে অর্পণ করেছেন।
ولعمري كان من السعادة العظمى أن فوَّضوا هذا الأمر الجليل إلى هذا العبد الضعيف الخامل إذ لم يجدوا في الكتب المتداولة المطبوعة ما يطابق مرادهم ويوافق مطمحهم.
فهذا المجموع الوجيز الذي يحتوي على ما يربو على خمس مائة من أحاديث رسول الله صلى الله عليه وسلم ، وأيات كتاب الله عزّ وجل إمتثال لأمرهم، وتصوير لخطتهم السعيدة وغرضهم المبارك.
وحيث أني اقتبست الأحاديث جُلّها بل كلها غير أحاديث معدودة، من كتاب «مِشْكَاةُ الْمَصَابِيْحِ» رأيت التيمن بإسمه أحسن وأجمل. فسميت هذا المجموع «مشكاة الآثار و مصباح الأبرار».
و هذه الأحاديث وإن اقتطفتها من «مِشْكَاةُ الْمَصَابِيْحِ» لكني لم أقتصر على أن أشير إلى «المشكاة» فقط، وكذالك لم أكتف بتسمية مأخذه، بل ما كان من أحاديث الصحاح أدرجت في الهامش ما به الذي ورده فيه هذا الحديث، وربما وردت أرقام الصفحات أيضا فلم أقتصر على أن أقول: «رواه البُخَارِيُّ…» مثلاً بل ذكرت الباب الذي فيه هذا الحديث مع رقم صفحته، ولم أسم المطبعة التي طبع فيها هذا الكتاب ، لأن الصحيحين : « صَحِيْحَ البُخَارِيِّ » و « صَحِيْحَ مُسْلِمٍ » : وإن طبعا في المطابع المختلفة ولكن أرقام صفحاتهما متوافقة منطبقة.
অনুবাদ : কোনো সন্দেহ নেই, এটা আমার জন্য অনেক বড় সৌভগ্যের বিষয়। এই সংক্ষিপ্ত পুস্তিকা, যা বিতবুল্লাহর আয়াত ও আল্লাহর রাসূল-এর হাদীসমূহ থেকে পাঁচশর চেয়ে বেশি অর্ন্তভূক্ত করে নেয়, তা মূলত তাদের আদেশ পালন, তাদের মুবারক উদ্দেশ্য ও সৌভগ্যময় পরিকল্পনায় চিত্রায়ন।
আমি যখনই সামন্য কিছু হাদীস ছাড়া অধিকাংশ হাদীস, বরং সকল হাদীস “মিশকাতুল মাসাবিহ” থেকে সংগ্রহ করেছি, তখন তার নামে বরকত লাভ করাকে সবচেয়ে উত্তম ও সুন্দর মনে করেছি। তাই আমি এই পুস্তিকার নাম রেখেছি (مشكاة الآثار مصباح الأبرار)।
তবে আমি শুধু মিশকাতের দিকে ইশারা করে ক্ষান্ত হইনি। অনুরূপভাবে এই পুস্তিকার মূল উৎসের নামকরণ দ্বারাই সীমবদ্ধ হইনি; বরং যা সহী হাদীসসমূহ, তথা সিহাহ সিত্তার অন্তর্ভুক্ত, অমি হাশিয়ায় সেই কিতাবের অধ্যায়, যেখানে হাদীসটি উল্লেখ হয়েছে, তার নাম নিয়ে এসেছি। কখনো কখনো পৃষ্ঠার নাম্বারও চলে এসেছে। তাই আমি শুধু (رواه البخاري)-বুখারী বর্ণনা করেছে বলে থেমে যাইনি। উদাহরণস্বরূপ বরং আমি হাদীসটি যে অধ্যায়ে রয়েছে, তার পৃষ্ঠায় নাম্বারসহ উল্লেখ করেছি। আমি এই কিতাবটি যেই ছাপাখানয় ছেপেছে, তার নাম উল্লেখ করিনি। কেননা, সহীহাইন (صحيح البخاري وصحيح مسلم) যদিও একাধিক ছাপখানায় ছেপেছে, কিন্তু উভয়ের পৃষ্ঠা-নাম্বার এক ও সামজস্যপূর্ণ।
وأما بقية كتب الصحاح، فأرقام صفحاتها مختلفة ، فيجمل لي أن أذكر مطابعها، فالسنن كلها من سُنَنِ التِّرْمِذِيِّ، وسُنَنِ أَبِيْ دَاود وكذلك سنن النسائي، كانت عندي من مطبوعات المطبع المجتبائي غير سنن ابن ماجة، فإني أخذت من نسختها المطبوعة في المطبع النظامي بـ«دهلي».
وبعد هذا التمهيد والتقديم أدعوا الله أن يتقبل مني هذا السعي، ويضع له القبول عند العلماء وطلبة الحديث كما وضع القبول لمأخذه ويجعل هذا الفرع كمثل أصله في عموم الإفادة وكثرة الدراسة وما ذلك على الله بعزيز.
راجي رحمة الرحمان المفتقر إلى دعوات الأكابر والإخوان
محمد میاں ابن السيد منظور محمد بن السيد محمد يوسف الديوبندي مولداً وموطناً، ومسلكاً والدهلوي إقامة.
অনুবাদ : আর অন্যান্য বাকি সহী কিতাব, সেগুলোর পৃষ্ঠার নাম্বার বিভিন্নরকম। তাই সেইগুলোর ছাপখানা মোটামুটিভাবে উল্লেখ করে বললে বলবো, সকল সুনান তথা সুনানে তিরমিযী, সুনানে আবী দাউদ ও সুনানে নাসায়ী, যা আমার কাছে ছিল তা মূলত মুজতাবায়ী ছাপাখানা থেকে। সুনানে ইবনে মাজাহ ব্যতীত; কেননা তার নুসখা, যা দিল্লির নেজাসি ছাপাখানা থেকে ছেপেছে, সেখান থেকে নিয়েছি।
এই ভূমিকা ও সূচনা কথার পর আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যেন তিনি আমার কাছ থেকে এই চেষ্টাকে কবুল করেন। হাদিসের ছাত্রদের ও আলেমদের নিকট এই পুস্তিকাকে গ্রহণযোগ্য করেন, যেমনিভাবে এর মূল উৎসকে গ্রহণযোগ্য করেছেন। এই শাখাকে অধিক অধ্যায়ণ ও ব্যাপক ফায়দা দেওয়ার ক্ষেত্রে তার মূলের মত নির্বাচন করেন। আর এটা আল্লাহর নিকট কঠিন নয়। রহমানের রহমতের আশাকারী, বড়দের ও ভাইদের দোয়ার মুখাপেক্ষী।
মুহাম্মদ মিয়া ইবনুস সাইয়িদ মানযুর মুহাম্মদ ইবনুস সাইয়িদ মুহাম্মদ ইউসুফ জন্ম, দেশ ও মতাদর্শের দিক দিয়ে দেওবান্দী, আর অবস্থান হিসেবে দেহলভী।
بسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ |
অনুবাদ: .আল্লাহর নামে শুরু, যিনি সকলের প্রতি দয়াবান, পরম দয়ালু। |
الْحَمْدُ لِلهِ وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِينَ اصْطَفَى: |
অনুবাদ: .সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, এবং শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর বান্দাদের উপর যাদের তিনি মনোনীত করেছেন: |
إِخْلَاصُ النِّيَّةِ وَتَعْيِينُ الْمَقْصِدِ |
ইখলাসপূর্ণ নিয়ত এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য |
ক্রমিক নং : 1 | ||
আরবি | বাংলা | |
الْحَافِظُ الْعَلَّامُ عَلْقَمَةُ بْنُ وَقَّاصٍ اللَّيثِيُّ رَحِمَهُ اللهُ يُحَدِّثُ أَنَّهُ سَمِعَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَلَى الْمِنْبَرِ يَقُولُ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ و إِنَّمَا لِامْرِئٍ مَّا نَوَى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ. مُتَّفق عَلَيْهِ. | অনুবাদ: . আলকামা ইবনে ওয়াক্কাস লায়সী রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত, আমি উমর ইবনুল খাত্তাব রাদি. কে মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছি, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ইরশাদ করতে শুনেছিঃ প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের অথবা কোন নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে, সেই উদ্দেশ্যই হবে তার হিজরতের প্রাপ্য।[1] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : হাদীসটি বুখারী সহ বহু হাদিসের কিতাবের প্রথম হাদীস। উপরে হাদীসটির যে অনুবাদ করা হয়েছে, এতেই এর মর্ম উদ্ধার হয়ে যায় এবং ভাবার্থ প্রকাশের জন্য এর চাইতে অধিক কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু হাদীসটির বিশেষ গুরুত্বের দাবী এই যে, এর অর্থ ও তাৎপর্যের উপর আরো কিছু লিখা হোক।
হাদীসটির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, উম্মতের উপর এই বাস্তব ও সত্য কথাটি তুলে ধরা যে, মানুষের সকল কর্মকাণ্ডের শুদ্ধাশুদ্ধ এবং এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ও অগ্রহণযোগ্যতা নিয়্যতের উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ, পুণ্য কাজ বলে কেবল সেটাকেই ধরা হবে এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে সে কাজেরই মূল্যায়ন হবে, যা ভাল নিয়্যতে করা হবে। আর যে পুণ্য কাজ কোন হীন উদ্দেশ্যে ও খারাপ নিয়্যতে করা হবে, সেটা পুণ্য কাজ বলে গণ্য হবে না এবং আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্যও হবে না; বরং নিয়্যত অনুসারে সেটা অশুদ্ধ ও প্রত্যাখ্যাত হবে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদিও সেটা পুণ্য কাজই মনে হয়।।
সারকথা এই যে, আল্লাহ্ তায়ালা কাজের সাথে নিয়্যতও দেখেন এবং বাহ্যিক অবস্থার সাথে অন্তরের অবস্থারও খবর রাখেন। তাই তাঁর দরবারে প্রত্যেক কাজের মূল্যায়ন আমলকারীর নিয়্যত অনুসারে করা হয়। একটি ভ্রান্তির নিরসন এখানে কেউ যেন এই ভুল ধারণা না করে যে, কাজের ফলাফল যেহেতু নিয়্যত অনুসারেই হয়ে থাকে, তাহলে কোন মন্দ কাজও ভাল নিয়্যতে করলে সেটা পুণ্য কাজ বলে গণ্য হয়ে যাবে এবং এর জন্য সওয়াব পাওয়া যাবে। যেমন, কেউ যদি এই নিয়্যতে চুরি অথবা ডাকাতি করে যে, এর দ্বারা অর্জিত সম্পদ গরীব-মিসকীনের সাহায্যে ব্যয় করবে, তাহলে সে সওয়াবের অধিকারী হতে পারবে। আসল কথা এই যে, যে কাজটি আদতেই মন্দ এবং যে কাজ করতে আল্লাহ্ ও রাসূল নিষেধ করেছেন, এমন কাজে ভাল নিয়্যতের প্রশ্নই আসতে পারে না। এগুলো সর্বাবস্থায়ই মন্দ এবং আল্লাহ্র ক্রোধ ডেকে আনে; বরং এমন খারাপ কাজে ভাল নিয়্যত করা এবং সওয়াবের আশা করা অধিক শাস্তির কারণ হতে পারে। কেননা, এটা আল্লাহ্র দীন ও আহকামের সাথে এক ধরনের উপহাসের শামিল।
এখানে হাদীসটির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে নেক আমল সম্পর্কে এ কথাটি বলে দেওয়া যে, নেক কাজও যদি কোন অসৎ উদ্দেশ্যে করা হয়, তাহলে সেটা আর নেক আমল থাকবে না; বরং অসৎ উদ্দেশ্যের কারণে তার ফল মন্দই হবে। যেমন, যে ব্যক্তি নামায খুব একাগ্রতা ও বিনয়ের সাথে আদায় করে, যাকে আমরা অত্যন্ত উচ্চ স্তরের নেক আমল মনে করি, সেখানে লোকটি যদি একাগ্রতা ও বিনয়ভাব এই জন্য অবলম্বন করে যে, মানুষ এর দ্বারা তার দীনদারী ও খোদাভীতি সম্পর্কে ভাল মানোভাব পোষণ করবে ও তার সম্মান করবে, তাহলে এই হাদিসের দৃষ্টিতে তার এ বিনয়ভাব ও একাগ্রতার নামাযেরও আল্লাহ্ তায়ালার কাছে কোন মূল্য নেই। অথবা এক ব্যক্তি কুফরের দেশ থেকে ইসলামি রাষ্ট্রে হিজরত করে যায় এবং হিজরতের সকল কষ্ট-মুসীবত বরণ করে নেয়; কিন্তু এই হিজরতের দ্বারা তার উদ্দেশ্য আল্লাহ্ তায়ালার সন্তোষ অর্জন নয়; বরং এর মধ্যে পার্থিব কোন স্বার্থ ও উদ্দেশ্য লুকায়িত থাকে। যেমন, হিজরতের দেশে বসবাসকারী কোন মহিলাকে বিয়ে করার খাহেশ তাকে হিজরতে উদ্বুদ্ধ করল। এমতাবস্থায় এই হিজরত ইসলামের জন্য হিজরত হবে না এবং আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে সে কোন প্রতিদানও পাবে না; বরং উল্টো সে শুনাহের ভাগী হবে। এটাই হচ্ছে এই হাদিসের মর্ম। বিরাট নেক আমলও এখলাছশূন্য হলে উহা জাহান্নামেই নিয়ে যাবে এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তিকে আল্লাহর আদালত থেকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার ফায়সালা দেওয়া হবে। সবার আগে ঐ ব্যক্তিকে হাজির করা হবে, যে জেহাদের ময়দানে শহীদ হয়েছিল। সে যখন আদালতে হাজির হবে, তখন আল্লাহ তায়ালা প্রথমে তাকে নিজের নে’আমতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। সেও এগুলো স্মরণ করে স্বীকার করবে। তারপর তাকে বলা হবে, বল তো! তুমি এগুলোর কি হক আদায় করেছ এবং কি কাজ করে এসেছ? সে বলবে, হে আল্লাহ! আমি তোমার পথে জেহাদ করেছি এবং তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমার জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছি। আল্লাহ তায়ালা বলবেন! তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি তো কেবল এই উদ্দেশ্যে জেহাদ করেছিলে যে, বীর বাহাদুর হিসাবে প্রসিদ্ধ হবে। আর দুনিয়াতে তো তোমার বীরত্বের আলোচনা হয়েই গিয়েছে। এরপর তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
অনুরূপভাবে একজন দ্বীনের আলেম ও কুরআনের আলেমকে আদালতে হাজির করা হবে। তাকেও আল্লাহ তায়ালা জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি কি আমল করে এসেছ? সে বলবে আমি তোমার দীন ও তোমার কুরআনের জ্ঞান লাভ করেছিলাম এবং তা অন্যকেও শিক্ষা দিয়েছিলাম। আর এসব তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই করেছিলাম। আল্লাহ্ তায়ালা বলবেনও তুমি মিথ্যাবাদী। তুমি তো নিজেকে আলেম ও কারী হিসাবে প্রকাশ করার জন্য ওসব করেছিলে। তারপর আল্লাহর নির্দেশে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর আরেক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে, যাকে আল্লাহ তায়ালা প্রচুর ধন-সম্পদ দান করেছিলেন। তাকেও জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তুমি কি করে এসেছ? সে বলবে, হে আল্লাহ্। আমি পুণ্য অর্জনের কোন ক্ষেত্রই অবশিষ্ট রাখিনি; বরং সকল খাতে তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আমি অর্থ ব্যয় করেছি। আল্লাহ্ তায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যাবাদী। তুমি তো কেবল এই উদ্দেশ্যে তোমার সম্পদ ব্যয় করেছিলে যে, দুনিয়ার মানুষ তোমাকে বড় দানশীল বলবে। আর দুনিয়াতে তো তোমার দানশীলতার খুব সুনাম হয়েই গিয়েছে। তারপর তাকেও উপুড় করে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। -মুসলিম
মোটকথা, আল্লাহর নিকট কেবল ঐ আমলই কাজে আসবে, যা বিশুদ্ধ নিয়্যতে অর্থাৎ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই করা হয়। দ্বীনের বিশেষ পরিভাষায় একেই এখলাছ বলা হয়। কুরআন মজীদে মুখলেছ ও অমুখলেছের আমলের একটি দৃষ্টান্ত পবিত্র কুরআনের নিম্নের দু’টি আয়াতে দান-খয়রাতকারী দুই শ্রেণীর মানুষের আলোচনা করা হয়েছে। প্রথম শ্রেণীতে রয়েছে ঐসব লোক, যারা লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে নিজেদের সম্পদ কল্যাণখাতে ব্যয় করে থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে রয়েছে ঐসকল মানুষ, যারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজেদের ধন-সম্পদ দ্বারা গরীব, মিসকীন ও অভাবীদের সাহায্য করে। এ দুই শ্রেণীর মানুষের বাহ্যিক কর্মকাণ্ডকে দেখতে সম্পূর্ণ একই মনে হয়। মানুষের চোখ এর মধ্যে কোন পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। কিন্তু পবিত্র কুরআন বলে যে, যেহেতু তাদের নিয়্যত ও উদ্দেশ্য ভিন্ন, তাই তাদের আমলের ফলাফলও ভিন্ন হবে। এক শ্রেণীর মানুষের আমল বরকত ও কল্যাণে পরিপূর্ণ, আর অপর শ্রেণীর মানুষের আমল সম্পূর্ণ নিষ্ফল ও বিনষ্ট। আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
كَالَّذِي يُنْفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ وَلَا يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَيْهِ تُرَابٌ فَأَصَابَهُ وَابِلٌ فَتَرَكَهُ صَلْدًا لَا يَقْدِرُونَ عَلَى شَيْءٍ مِمَّا كَسَبُوا وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ
তোমরা ঐ ব্যক্তির মত নিজেদের দান-খয়রাতকে বিনষ্ট করো না, যে নিজের সম্পদ লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে থাকে, অথচ সে আল্লাহ্ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে এমন যে, একটি মসৃণ পাথরে কিছু মাটি জমে গেল (এবং এর উপর কিছু সবুজ ঘাস উৎপন্ন হয়ে গেল।) তারপর এর উপর প্রবল বৃষ্টিপাত হল এবং একে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিল। তাই এই ধরনের রিয়াকার লোকেরা নিজেদের উপার্জিত সম্পদের কোন বিনিময় লাভ করতে পারবে না। আর আল্লাহ্ এই অকৃতজ্ঞদেরকে হেদায়াত এর সুমিষ্ট ফল থেকে বঞ্চিতই রাখবেন। – সুরা বাকারা : আয়াত ২৬৪
অপরদিকে মুখলেছদের সম্পর্কে বলা হয়েছে
وَمَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَتَثْبِيتًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ كَمَثَلِ جَنَّةٍ بِرَبْوَةٍ أَصَابَهَا وَابِلٌ فَآتَتْ أُكُلَهَا ضِعْفَيْنِ
যারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এবং নিজেদের মনকে সুদৃঢ় ও ত্যাগ তিতীক্ষায় অভ্যস্ত করার জন্য নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর রাহে খরচ করে তাদের উদাহরণ হচ্ছে টিলায় অবস্থিত সজীব বাগানের মত, যাতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং এর ফলে দ্বিগুণ ফল দান করে। -সুরা বাকারা : আয়াত ২৬৫
এখানে যদিও উভয় ব্যক্তি বাহ্যত একইভাবে নিজেদের ধন-সম্পদ গরীব, মিসকীন ও অভাবীদের জন্য ব্যয় করেছে; কিন্তু একজনের নিয়্যত যেহেতু কেবল লোকদেখানোই ছিল, তাই মানুষের সামনে তার এই প্রদর্শনী সাময়িক বাহবা কুড়ানো ছাড়া আর কিছুই লাভ হল না। কেননা, তার এই অর্থব্যয়ের পেছনে এ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্যই ছিল না। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় ব্যক্তি যেহেতু এ অর্থ ব্যয় ও ত্যাগ দ্বারা কেবল আল্লাহর সন্তোষ ও তাঁর অনুগ্রহ কামনা করেছিল, তাই আল্লাহ্ তায়ালা তাকে তার নিয়্যত অনুযায়ী ফল দান করেছেন।
সারকথা, এটাই হচ্ছে আল্লাহর নীতি ও তাঁর বিধান। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীসে এ কথাটিরই ঘোষণা দিয়েছেন। দুনিয়াতে বাহ্যিক অবস্থার উপর সকল ফায়সালা হয়ে থাকে, আখেরাতে নিয়্যতের উপর ফায়সালা হবে এই জগতে যেখানে আমরা বর্তমানে রয়েছি এবং যেখানে আমাদেরকে কাজ করার সুযোগ দিয়ে রাখা হয়েছে, এটাকে “আলমে যাহের” তথা দৃশ্য ও প্রকাশ্য জগত বলা হয়।
এখানে আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতি এবং সকল বোধ-বুদ্ধির সীমানা ও বাহ্যিক অবস্থা ও বিষয়াবলী পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এখানে আমরা কোন ব্যক্তির কোন বাহ্যিক আচার-আচরণ দেখেই তার ব্যাপারে ভাল অথবা মন্দ কোন মন্তব্য করতে পারি এবং এরই ভিত্তিতে তার সাথে আমরা নিজেরাও আচরণ করে থাকি। বাহ্যিক কর্মকাণ্ড ও আচার-আচরণের বাইরে তাদের নিয়্যত, অন্তরের রহস্য ও মনের গোপন অবস্থা উপলব্ধি করতে আমরা অক্ষম। এই জন্যই ফারুকে আযম ওমর রাদি. বলতেনঃ আমাদের কাজ হচ্ছে বাহ্যিক অবস্থা দেখে বিচার করা, আর গোপন অবস্থা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেওয়া।
কিন্তু আখেরাতের জগতে বিচারক হবেন আল্লাহ তায়ালা, যিনি সকল গোপন বিষয় সম্যক অবগত। তাই সেখানে মানুষের নিয়্যত ও মনের ইচ্ছা বিবেচনায় সকল বিচার ও সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। অতএব, মনে রাখতে হবে যে, এই জগতে বিধান প্রয়োগের বেলায় যেমন বাহ্যিক আমল ও কর্মই মূল বিষয় এবং কারো নিয়্যতের উপর এখানে বিচার করা যায় না, অনুরূপভাবে আখেরাতে বিষয়টি হবে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ, আল্লাহ্ তায়ালা সেখানে বিচার ও ফায়সালা করবেন নিয়্যত দেখে। সেখানে বাহ্যিক আমল ও কর্মকে কেবল নিয়্যতের অনুগামী হিসাবে গণ্য করা হবে। হাদীসটির বিশেষ গুরুত্ব এই হাদীসটি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অত্যন্ত তত্ত্বপূর্ণ অথচ সংক্ষিপ্ত বাণীসমূহের অন্তর্ভুক্ত। দ্বীনের একটা বিরাট অংশ এই হাদীস নিজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। তাই এটাকে ‘ক্ষুদ্র ঝিনুকের ভিতরে মহাসমুদ্র’ বলা যায়। এই জন্যই কোন কোন ইমাম বলেছেন, ইসলামের এক তৃতীয়াংশ এই হাদীসে এসে গিয়েছে। আর বাস্তবতার নিরিখে বলতে গেলে মহান ইমামদের এই কথায় কোন অতিরঞ্জন নেই; বরং তাদের কথাই যথার্থ। কেননা, মৌলিক দিক থেকে ইসলামের বিভাগ তিনটি : (১) ঈমান তথা আকীদা সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী, (২) আমল ও (৩) এখলাছ। যেহেতু এই হাদীস এখলাছের সম্পূর্ণ বিভাগকে তার অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে, তাই বলা যায় যে, ইসলামের এক তৃতীয়াংশই এখানে এসে গিয়েছে।
এখলাস এমন বস্তু যে, প্রত্যেক কাজে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে এর প্রয়োজন দেখা দেয়। বিশেষ করে আল্লাহর কোন বান্দা যখন কোন শুভ কাজের সূচনা করে, সে কাজটি আমল সংক্রান্তই হোক অথবা গবেষণাধর্মীই হোক, সেখানে সে প্রয়োজন অনুভব করে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণীটি চোখের সামনে থাকুক। এই জন্যই অনেক মনীষীকেই দেখা যায় যে, তাঁরা নিজেদের গ্রন্থসমূহ এই হাদীস দ্বারা শুরু করা খুবই পছন্দ করেছেন। যেমন, ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর অমরগ্রন্থ বুখারী শরীফকে এই হাদীস দ্বারাই শুরু করেছেন। তাঁর পরে ইমাম বগভী (রহঃ) তাঁর মাসাবীহ নামক হাদীসগ্রন্থকেও এই হাদীস দ্বারা শুরু করেছেন। তাঁরা যেন এই হাদীসটিকে কিতাবের ‘প্রারম্ভিকা’ বানিয়ে নিয়েছেন। হাফেযুল হাদীস আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী (রহঃ) বলেন, কেউ কোন দ্বীনি কিতাব লিখতে চাইলে এই হাদীস দ্বারাই সেই কিতাবের সূচনা হোক, এটাই আমি উত্তম মনে করি। আমি নিজে কোন কিতাব লিখলে এর প্রতিটি অধ্যায়ের সূচনা এই হাদীস দ্বারাই করব। —ফতহুল বারী
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. মানুষের উচিত দীনী কাজ দ্বারা দুনিয়া নয়; বরং আখিরাত ও আল্লাহর সন্তুটি কামনা করা।
খ. হাদীছে যেহেতু আমলকে নিয়তের উপর নির্ভরশীল বলা হয়েছে, সেহেতু সেই যদি দীনী কাজ দুনিয়ার উদ্দেশ্যে করে, তবে তা প্রকৃতপক্ষে দীনী কাজ থাকে না, দুনিয়াবী কাজ হয়ে যায়, বাহ্যদৃষ্টিতে তাকে যতই দীনী কাজ মনে হোক না কেন।
গ. দুনিয়াবী জায়েয কাজ, যেমন পানাহার করা, বেচাকেনা করা, ঘর-সংসার কর ইত্যাদি যদি কেউ আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করে, তবে তা নিছক দুনিয়াবী কাজ থাকে না, তা ইবাদতেরও মর্যাদা লাভ করে।
ঘ. বর্জন করাটাও যেহেতু কাজ, যেমন চুরি না করা, মদপান না করা, দর্প না করা, ঝগড়া না করা, কারও মনে আঘাত না দেওয়া যাদি, সেহেতু এগুলো না করার ক্ষেত্রে যদি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির নিয়ত থাকে, তবে এর দ্বারাও ছওয়াব পাওয়া যাবে।
ঙ. নিয়ত দ্বারা ছোট ও তুচ্ছ কাজও বড় ও মহৎ কাজে পরিণত হয়ে যায়। যেমন কারও সংগে হাসি দিয়ে কথা বলা, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়া, আপাতদৃষ্টিতে এগুলো বিশেষ বড় কোনও কাজ নয়, কিন্তু আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির নিয়তে করলে তাঁর কাছে এসব অনেক মর্যাদাপূর্ণ কাজে পরিণত হয়ে যায়। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা আখিরাতে এসব আমলের অভাবনীয় পুরস্কার লাভের কথা জানা যায়।
চ. নিয়ত দ্বারা একই আমল বহু আমলে পরিণত হতে পারে। যেমন কেউ যদি মসজিদে গমন করে আর জামাতে নামায পড়ার সাথে সাথে এই নিয়তও রাখে যে, সে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেবে, মু’মিনদের দেখা পেলে সালাম দেবে, মু’মিনদের খোঁজখবর নেবে, রুগ্ন ব্যক্তির দেখা পেলে তার সেবা করবে ইত্যাদি, তবে বাস্তবে এসব কাজের অবকাশ না আসলেও কেবল নিয়তের কারণেও সে তার ছওয়াব পাবে। কাজ তো হয়েছে একটি অর্থাৎ মসজিদে গমন, কিন্তু নিয়ত যেহেতু ছিল বহুবিধ, তাই সে বহুবিধ আমলেরই ছওয়াবের অধিকারী হয়ে যাবে।
ছ. নিয়ত একান্তই মনের বিষয়। প্রত্যেকে কেবল তার নিজ মনের অবস্থাই জানে, অন্যের মনে কি আছে তা কেউ জানে না। সুতরাং আমলের ক্ষেত্রে কর্তব্য নিজ নিয়তের তদারকি করা, অন্যের নিয়ত নিয়ে কথা না বলা। অন্যের নিয়ত নিয়ে কুধারণা করা শুনাহ’র কাজ। এর থেকে বিরত থাকা জরুরি।
مَاذَا نَرَى وَنَسْمَعُ ؟ |
আমরা কী দেখবো এবং কী শুনবো? |
ক্রমিক নং : 2-3 | |
আরবি | বাংলা |
قَالَ اللهُ تَعَالى : ﴿وَفِي الْأَرْضِ آيَاتٌ لِلْمُوقِنِينَ وَفِي أَنْفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ﴾ | অনুবাদ: ১. যারা নিশ্চিত বিশ্বাসী, তাদের জন্য পৃথিবীতে আছে বহু নিদর্শন।এবং স্বয়ং তোমাদের অস্তিত্বেও! তবুও কি তোমরা অনুধাবন করতে পার না? [সুরা আয-যারিয়াত : (৫১) : 20-21] |
قَالَ اللهُ تَعَالى : ﴿رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ﴾ | অনুবাদ: ২. হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা এক ঘোষককে ঈমানের দিকে ডাক দিতে শুনেছি যে, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আন।’ সুতরাং আমরা ঈমান এনেছি। কাজেই হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিন, আমাদের মন্দসমূহ আমাদের থেকে মিটিয়ে দিন এবং আমাদেরকে পুণ্যবানদের মধ্যে শামিল করে নিজের কাছে তুলে নিন। [সুরা আ-লু ইমরান : (০৩): ১৯৩] |
قُصْوٰى بُغْيَتِنَا |
আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য |
আরবি | বাংলা |
وَلَما كَانَ قُصوى بُغْيَتِنَا وَغَايَةُ مَرَامِنَا أَنْ نَتَوَفّىٰ مَعَ الْأَبْرَارِ فَعَلَيْنَا تَحْقِيقُ مَعْنَى الْبِرِّ وَالْأَبْرَارِ وأَنَّ الرَّجُلَ كَيْفَ يَكُونُ مِنَ الْأَبْرَارِ. فَهَذِهِ فُصُوْلٌ وَأَبْوَابٌ تَكْشِفُ عَنْ وُجُوهِ الْأَجْوِبةِ الْأَسْتَارَ وَبِاللهِ التَّوْفِيقُ وَلَهُ الْحَمْدُ.
وَلَمَّا كَانَتِ الْأَشْيَاءُ تَتَبَيَّنُ بِأَضْدَادِهَا نَذْكُرُ بَعْدَهَا الْإِثْمَ وَشُعَبَهُ وَفُرُوعَهُ وَأُصُولَهُ حَسْبَمَا بَيَّنَهَا الَّذِي أُرْسِلَ إِلَىٰ كَافَّةِ النَّاسِ بَشِيْراً وَنَذِيراً وَبُعِثَ لِيَتْلُوَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ آيَاتِ اللهِ وَيُزَكِّيهمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ، وَكَمَا أَشَارَ إِلَيْهَا الْكِتَابُ الْمُبِينُ الَّذِي فِيْهِ تَفْصِيلُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ نُورٌ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ. وَ الْمَقْصُودُ أنْ يَتَحَلَّى الشَّابُّ الصَّالِحُ بِالْفَضَائِلِ الْمَحْمُودَةِ وَيَتَخَلَّى عَنِ الْخَصَائِلِ الْمَذْمُوْمَةِ لِيَسْتَظِلَّ بِظِلِّ عَرْشِ الرَّحْمَانِ يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلا ظِلُّهُ. |
অনুবাদ: . আর অন্যান্য বাকি সহী কিতাব, সেগুলোর পৃষ্ঠার নাম্বার বিভিন্নরকম। তাই সেইগুলোর ছাপখানা মোটামুটিভাবে উল্লেখ করে বললে বলবো, সকল সুনান তথা সুনানে তিরমিযী, সুনানে আবী দাউদ ও সুনানে নাসায়ী, যা আমার কাছে ছিল তা মূলত মুজতাবায়ী ছাপাখানা থেকে। সুনানে ইবনে মাজাহ ব্যতীত; কেননা তার নুসখা, যা দিল্লির নেজাসি ছাপাখানা থেকে ছেপেছে, সেখান থেকে নিয়েছি।
এই ভূমিকা ও সূচনা কথার পর আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যেন তিনি আমার কাছ থেকে এই চেষ্টাকে কবুল করেন। হাদিসের ছাত্রদের ও আলেমদের নিকট এই পুস্তিকাকে গ্রহণযোগ্য করেন, যেমনিভাবে এর মূল উৎসকে গ্রহণযোগ্য করেছেন। এই শাখাকে অধিক অধ্যায়ণ ও ব্যাপক ফায়দা দেওয়ার ক্ষেত্রে তার মূলের মত নির্বাচন করেন। আর এটা আল্লাহর নিকট কঠিন নয়। রহমানের রহমতের আশাকারী, বড়দের ও ভাইদের দোয়ার মুখাপেক্ষী। মুহাম্মদ মিয়া ইবনুস সাইয়িদ মানযুর মুহাম্মদ ইবনুস সাইয়িদ মুহাম্মদ ইউসুফ জন্ম, দেশ ও মতাদর্শের দিক দিয়ে দেওবান্দী, আর অবস্থান হিসেবে দেহলভী। আর উদ্দেশ্য হলো, নেককার যুবক প্রশংসনীয় গুণাবলি দ্বারা সজ্জিত হবে এবং নিন্দনীয় বৈশিষ্টসমূহ থেকে মুক্ত হবে। যেন দয়াময় আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান নিতে পারে, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। |
ক্রমিক নং : 4 | ||
আরবি | বাংলা | |
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لا ظِلَّ إِلا ظِلُّهُ. الإِمَامُ الْعَادِلُ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ رَبِّهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ، وَرَجُلَانِ تَحابّا فِي اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ طَلَبَتْهُ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ: إِنِّي أَخَافُ اللهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ إِخْفَاءً حَتَّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا أَنْفَقَ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ | অনুবাদ: . আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে দিন আল্লাহর রহমতের ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিজের (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দিবেন।
১. ন্যায়পরায়ণ শাসক, ২. সে যুবক যার জীবন গড়ে উঠেছে তার রবের ইবাদতের মধ্যে, ৩. সে ব্যক্তি যার কলব মসজিদের সাথে লেগে রয়েছে, ৪. সে দু’ব্যক্তি যারা পরস্পরকে ভালোবাসে আল্লাহর ওয়াস্তে, একত্র হয় আল্লাহর জন্য এবং পৃথকও হয় আল্লাহর জন্য, ৫. সে ব্যক্তি যাকে কোন উচ্চ বংশীয় রূপসী নারী আহবান জানায়, কিন্তু সে এ বলে তা প্রত্যাখ্যান করে যে, আমি আল্লাহকে ভয় করি, ৬. সে ব্যক্তি যে এমন গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত যা খরচ করে বাম হাত তা জানে না, ৭. সে ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহর যিক্র করে, ফলে তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হয়।[2] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছে সাত ব্যক্তি সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে, তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা নিজ ছায়ায় স্থান দেবেন। সাত ব্যক্তি দ্বারা সাত শ্রেণীর লোক বোঝানো উদ্দেশ্য। ‘আল্লাহর ছায়া’ বলে তাঁর রহমতের ছায়া বোঝানো হয়েছে অথবা আরশের ছায়া। অপর এক বর্ণনায় আছে, তাদেরকে আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন। হাদীছটিতে সাত শ্রেণীর লোকের বিবরণ দেওয়া হয়েছে নিম্নরূপ
ন্যায়পরায়ণ শাসকের মর্যাদা
এক. امام عادل (ন্যায়পরায়ণ শাসক)। অর্থাৎ এমন শাসক, যে আল্লাহ তায়ালার বিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করে এবং সে অনুযায়ী জনগণের মধ্যে ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। কোনওরূপ স্বজনপ্রীতির পরিচয় দেয় না। না কোনও ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে, না শৈথিল্য দেখায়। কেউ কারও প্রতি জুলুম করলে সে ক্ষেত্রে জালিমের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করে এবং মজলুমকে নিজ ইনসাফের ছায়াতলে আশ্রয় দান করে। বলাবাহুল্য, কাজটি সহজ নয়। বরং ন্যায়-ইনসাফের সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালনা করা দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা কঠিন কাজ। তাই এই সাত শ্রেণীর মধ্যে ন্যায়পরায়ণ শাসককে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার কাছে তার মর্যাদা অনেক উপরে। বিভিন্ন হাদীছে তার বিপুল ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে,
إن المقسطين عند الله على منابر من نور، عن يمين الرحمن عز وجل، وكلتا يديه يمين، الذين يعدلون في حكمهم وأهليهم وما ولوا
“আল্লাহ তায়ালার কাছে ইনসাফকারীগণ থাকবে নূরের মিম্বরে, দয়াময় আল্লাহর ডানদিকে তাঁর উভয় হাতই ডান যারা তাদের শাসনকার্যে ইনসাফ করে, ইনসাফ করে তাদের পরিবারবর্গ ও অধীনস্থদের উপর।
আরেক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে,
إن أحب الناس إلى الله عز وجل يوم القيامة وأقربهم منه مجلسا: إمام عادل، وإن أبغض الناس إلى الله يوم القيامة وأشده عذابا إمام جائر
“কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় ও সর্বাপেক্ষা বেশি নৈকট্যপ্রাপ্ত হবে ন্যায়পরায়ণ শাসক। অপরদিকে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি ঘৃণ্য ও সর্বাপেক্ষা কঠোর শাস্তিযোগ্য হবে জালিম শাসক।
অপর এক হাদীছে ইরশাদ الإمام العادل لا ترد دعوته ‘ন্যায়পরায়ণ শাসকের দুআ নামঞ্জুর করা হয় না।
ন্যায়পরায়ণ শাসক যেহেতু মানুষকে তার ইনসাফের ছায়াতলে আশ্রয় দেয়, তাই হাশরের ময়দানে তাকেও আল্লাহ তায়ালা নিজ রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন।
ইবাদতনিষ্ঠ যুবকের মর্যাদা
দুই. وشاب نشأ في عبادة الله عز وجل (ওই যুবক যে মহান আল্লাহর ইবাদতের ভেতর বেড়ে উঠে)। যৌবন বয়সে মানুষ সবদিক থেকে শক্ত-সমর্থ থাকে। তাই ইন্দ্ৰিয়চাহিদা থাকে প্রবল। ফলে অধিকাংশ যুবকই যৌবনের উন্মাদনায় মাতোয়ারা হয়ে যায়। তারা ইন্দ্রিয়ের বশীভূত হয়ে পড়ে। ইন্দ্রিয়ের চাহিদা পূরণকেই জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বানিয়ে ফেলে। তাদের পক্ষে যৌবনের উচ্ছ্বসিত আবেদন ও ইন্দ্রিয়সুখের হাতছানি উপেক্ষা করে শরীআতের পাবন্দী করা সহজ হয় না। তা সত্ত্বেও যারা তা উপেক্ষা করে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত-বন্দেগী আদায় করতে যত্নবান থাকে, তারা যে তাদের অন্তরে অধিকতর শক্তিশালী তাকওয়া ও গভীর আল্লাহভীতি লালন করে তাতে সন্দেহ কী? এ শ্রেণীর যুবকেরা যেহেতু আল্লাহভীতিতে উদ্দীপিত হয়ে নফস ও শয়তানের প্ররোচনা উপেক্ষা করে এবং ইবাদত-বন্দেগীর আশ্রয় নেয়, তাই এর পুরস্কারস্বরূপ আল্লাহ তায়ালাও তাদেরকে নিজ রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দান করবেন। অপর এক হাদীছে এরূপ যুবকের ফযীলত বর্ণনায় ইরশাদ হয়েছে إن الله ليعجب من الشاب ليست له صبوة “আল্লাহ তায়ালা ওই যুবকের প্রতি অবশ্যই খুশি থাকেন, যার খেলাধুলার ও মন্দ চাহিদার প্রতি আসক্তি নেই ৷
মসজিদমুখী মুমিনের মর্যাদা
তিন. ورجل قلبه معلق بالمساجد (ওই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে ঝুলন্ত)। অর্থাৎ মসজিদে ঝাড়বাতি বা ফানুস যেমন ঝুলে থাকে, তেমনি তার অন্তরও সর্বদা মসজিদের সঙ্গে ঝুলন্ত থাকে, যদিও তার দেহ থাকে বাইরে। বোঝানো উদ্দেশ্য মসজিদের ভালোবাসা তার অন্তরে বদ্ধমূল। কেননা মসজিদ আল্লাহর ঘর। আল্লাহর ভালোবাসায় সে মনপ্রাণ দিয়ে মসজিদকে ভালোবাসে।
মসজিদ আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর জন্য। আল্লাহর আশেক বান্দা অন্য সবকিছুর উপর ইবাদতকে প্রাধান্য দেয়। সে ইবাদতের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্যের স্বাদ অনুভব করে। মসজিদ আল্লাহর ঘর হওয়ায় সেই নৈকট্যলাভের এটাই বেশি উপযুক্ত স্থান। তাই সে বার বার ফিরে ফিরে মসজিদেই আসে। পার্থিব প্রয়োজনে বাইরে থাকলেও কখন নামাযের সময় হবে সেই অপেক্ষায় থাকে। ফলে আযান শোনামাত্র মসজিদে চলে আসে। ফরয নামায সে মসজিদেই পড়ে। নামায শেষে বাইরে বের হলেও আবার ফিরে আসার তাড়নায় থাকে। পার্থিব প্রয়োজন না থাকলে যেন সে মুহূর্তের জন্যও মসজিদের বাইরে যেত না। এভাবে যে মসজিদকে তার আশ্রয়স্থল বানায়, আল্লাহ তায়ালাও পুরস্কারস্বরূপ হাশরের ময়দানে তাকে নিজ আরশের ছায়ায় জায়গা দেবেন।
যারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে একে অন্যকে ভালোবাসে
চার. ورجلان تحابا في الله ، اجتمعا عليه وتفرقا عليه (ওই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে একে অন্যকে ভালোবাসে, তাঁরই জন্য একত্র হয় এবং তাঁরই জন্য পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়)। অর্থাৎ তাদের পারস্পরিক ভালোবাসায় আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টিলাভ ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই। ফলে যতক্ষণ সে ভালোবাসা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টিলাভের অনুকূল থাকে, ততক্ষণ তারা একে অন্যকে ভালোবেসে যায়। কিন্তু যখন তাদের সম্পর্ক আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টিলাভের পক্ষে অন্তরায় হয়, তখন একে অন্যকে পরিত্যাগ করে। সারকথা তাদের সম্পর্ক রক্ষাও যেমন পার্থিব স্বার্থে হয় না; আল্লাহর উদ্দেশ্যেই হয়, তেমনি সম্পর্ক ছিন্ন করাটাও কোনও পার্থিব কারণে নয়; আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যেই হয়। পারস্পরিক যে মহব্বত আল্লাহ তায়ালার জন্য হয়, তা আল্লাহ তায়ালার বড় পসন্দ। একটি হাদীছে কুদসীতে আছে حقت محبتى للمتحابين في “যে দুই ব্যক্তি আমারই জন্য একে অন্যকে ভালোবাসে, তাদের জন্য আমার ভালোবাসা অবধারিত হয়ে যায়।
আল্লাহরই জন্য ভালোবাসা ও আল্লাহরই জন্য সম্পর্কচ্ছেদ প্রকৃতপক্ষে মনপ্রাণ আল্লাহতে নিবেদিত থাকারই পরিচয় বহন করে। এরূপ ব্যক্তি যেন আল্লাহ ছাড়া অন্যকিছুর লগ্নতায় স্বস্তিবোধ করে না। তাই সর্বাবস্থায় সে তাঁরই অভিমুখী থাকে, তাঁরই দিকে ধাবিত থাকে। সুতরাং আল্লাহ তায়ালাও তাকে মহব্বতের সঙ্গে কবুল করে নেন। সে কবুলিয়াতের নিদর্শনস্বরূপ তিনি হাশরের ময়দানে তাকে নিজ রহমতের ছায়ায় ঠাঁই দেবেন।
চরিত্ররক্ষায় বদ্ধপরিকর ব্যক্তির মর্যাদা
পাঁচ. ورجل دعته امراة ذات منصب وجمال ، فقال اني اخاف الله (ওই ব্যক্তি যাকে কোনও খান্দানী ও সুন্দরী নারী ডাকে আর সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি)। এমনিই নারী-পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণ অন্যসব আকর্ষণ অপেক্ষা অনেক শক্তিশালী। তদুপরি নারী যদি হয় সুন্দরী ও খান্দানী, তবে সে আকর্ষণ হয় তীব্রতর। এরূপ নারী যখন কাউকে প্রলোভন দিয়ে ডাকে, তখন সে ডাক উপেক্ষা করে নিজেকে সংযত রাখা অতি গভীর আল্লাহভীতি ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। এরূপ ব্যক্তি যেন নিজ চরিত্ররক্ষায় ইয়ূসুফ আলাইহিস সালামের প্রতিনিধিত্ব করে। মিশরের শাসনকর্তার স্ত্রী তাঁকে নিজ শয়নকক্ষে আমন্ত্রণ জানালে তিনি সাফ বলে দিয়েছিলেন معاذ الله (আমি আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি)।
এ হাদীছ জানাচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে সে ডাক উপেক্ষা করে এবং তার ছলনা, নফসের ধোঁকা ও শয়তানের প্ররোচনা থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে এই বলে দয়াময়ের আশ্রয় গ্রহণ করে যে, আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ভয় করি, আল্লাহ তায়ালা তাকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানে অবশ্যই সাহায্য করেন। দুনিয়ায় তাকে সেই পাপকর্ম থেকে হেফাজত করেন, আর হাশরের ময়দানে তাকে নিজ রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দান করবেন।
গোপনে দান-খয়রাত করার ফযীলত
ছয়. ورجل تصدق بصدقة فاخفاها حتى لا تعلم شماله ما تنفق يمينه (ওই ব্যক্তি যে-কোনও দান-সদাকা করে, আর সে তা এমনভাবে গোপন করে যে, তার বাম হাত জানে না ডান হাত কী ব্যয় করে)। এ দান-সদাকা দ্বারা নফল দান-সদাকা বোঝানো হয়েছে, যাকাত নয়। কেননা যাকাত প্রকাশ্যে দেওয়াই ভালো। ডান হাত কী ব্যয় করে তা বাম হাত জানে না’ বলে চূড়ান্ত পর্যায়ের গোপনীয়তা বোঝানো উদ্দেশ্য। যেন বলা হচ্ছে, যদি কল্পনা করে নেওয়া হয় বাম হাতের বুঝ-জ্ঞান আছে, ফলে ডান হাত কী খরচ করেছে সে তা বুঝতে পারে, তবুও চূড়ান্ত পর্যায়ের গোপনীয়তা রক্ষার কারণে ডান হাতের খরচের বিষয়টি সে জানতে পারবে না, যদিও তার অবস্থান ডান হাতের অতি কাছে।
দান-খয়রাত গোপনে করাই নিরাপদ। তাতে যেমন নিজ ইখলাস ঠিক থাকে, অহংকার থেকে আত্মরক্ষা হয়, তেমনি যাকে দেওয়া হয় তারও ইজ্জত-সম্মান বাঁচে, যদিও অন্যকে উৎসাহ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ক্ষেত্রবিশেষে প্রকাশ্যেও দান করার অনুমতি আছে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيِّئَاتِكُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
“তোমরা দান-সদাকা যদি প্রকাশ্যে দাও, সেও ভালো, আর যদি তা গোপনে গরীবদেরকে দান কর তবে তা তোমাদের পক্ষে কতইনা শ্রেয়! এবং আল্লাহ তোমাদের মন্দকর্মসমূহের প্রায়শ্চিত্ত করে দেবেন। বস্তুত আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।
মানবস্বভাবে যেমন আছে সম্পদের আসক্তি, তেমনি আছে খ্যাতির মোহও। এ দু’টিই প্রকৃত দুনিয়াদারী। এ দু’টি যে ব্যক্তি দমন করতে পারে, কিংবা বলা যায় যে ব্যক্তি এর উপর আল্লাহপ্রেমকে প্রাধান্য দিতে সক্ষম হয়, তার পক্ষেই আল্লাহর পথে গোপনে দান-খয়রাত করা সম্ভব হয়। এরূপ দান-খয়রাত প্রমাণ করে- দুনিয়া নয়; বরং কেবল আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্যলাভই তার প্রধান লক্ষ্যবস্তু। তাই তো সে সম্পদ ও সুখ্যাতির ছত্রচ্ছায়া পরিহার করে আল্লাহকে পাওয়ার সাধনায় মনোনিবেশ করেছে। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা হাশরের ময়দানে তাকে নিজ রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন।
গোপনে দান করার ফযীলত সম্পর্কে এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে,
فتعجبت الملائكة من خلق الجبال، فقالت : يا رب، هل من خلقك شيء أشد من الجبال؟ قال: نعم، الحديد. قالت: يا رب، هل من خلقك شيء أشد من الحديد؟ قال: نعم، النار . قالت : يا رب، هل من خلقك شيء أشد من النار؟ قال: نعم، الماء. قالت: يا رب، هل من خلقك شيء أشد من الماء؟ قال: نعم، الريح . قالت: يا رب، فهل من خلقك شيء أشد من الريح؟ قال: نعم، ابن آدم يتصدق بيمينه يخفيها من شماله
“ফিরিশতাগণ পাহাড়ের সৃজনে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার সৃষ্টিরাজির মধ্যে পাহাড়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী আর কিছু আছে? তিনি বললেন, হাঁ, লোহা। তারা বলল, লোহার চেয়ে শক্তিশালী কিছু আছে? তিনি বললেন, হাঁ, আগুন। তারা বলল, আগুনের চেয়ে শক্তিশালী কিছু আছে? তিনি বললেন, হাঁ, পানি। তারা বলল, পানির চেয়ে শক্তিশালী কিছু আছে? তিনি বললেন, হাঁ, বাতাস। তারা বলল, বাতাসের চেয়ে শক্তিশালী কিছু আছে? তিনি বললেন, হাঁ, আদমসন্তান তার ডান হাতে যা খরচ করে আর তা তার বাম হাত থেকেও গোপন রাখে।
নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে ক্রন্দন করা
সাত. ورجل ذكر الله خاليا ففاضت عيناه (এবং ওই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে আর তার দুই চোখ অশ্রুপ্লাবিত হয়)। নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করার অর্থ লোকচক্ষুর আড়ালে মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করা ও মুখে তাঁর যিকর করা, যেমন কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত করা, সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ইত্যাদি জপ করা। এ নির্জনতা লোকসমাবেশের মধ্যেও হতে পারে। আর তা হলো সমস্ত গায়রুল্লাহ থেকে মন-মস্তিষ্ক খালি করে একান্তভাবে এক আল্লাহর যিকর ও স্মরণে মগ্ন থাকা।
আল্লাহর স্মরণে চোখে পানি আসতে পারে বিভিন্ন কারণে, যেমন তাঁর সন্তুষ্টি ও নৈকট্যলাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, তাঁর ইশক ও ভালোবাসার ব্যাকুলতা, তাঁর আযাব, গযব ও প্রতিপত্তির ভীতি, নিজ ত্রুটি-বিচ্যুতি ও পাপ-পঙ্কিলতাজনিত অনুতাপ-অনুশোচনা। বান্দা হিসেবে এর প্রতিটিই কাম্য ও প্রশংসনীয়। যে বান্দা এসব কারণে চোখের পানি ফেলে, তখন তার মনপ্রাণ, চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান-জ্ঞান এক আল্লাহতে নিবেদিত হয়ে যায়। তাই আল্লাহ তায়ালাও তাকে নিজ রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দান করেন।
আল্লাহর ভয়ে চোখ থেকে পানি ঝরানোর ফযীলত সম্পর্কে অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে,
من ذكر الله ففاضت عيناه من خشية الله، حتى يصيب الأرض من شيء من دموعه لم يعذبه الله يوم القيامة
“যে ব্যক্তি আল্লাহর যিকর ও স্মরণ করে, ফলে আল্লাহর ভয়ে তার চোখ অশ্রু প্রবাহিত করে, এমনকি তার অশ্রুর কিছু ফোঁটা মাটিতেও পড়ে যায়, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তাকে শাস্তি দেবেন না।
হাসান বসরী রহ. বলেন, আল্লাহ তায়ালার পথে রক্তের যে ফোঁটা গড়ানো হয় অথবা গভীর রাতে যখন এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না, তখন সিজদা অবস্থায় অশ্রুর যে ফোঁটা বহানো হয়, আল্লাহর কাছে তার চেয়ে প্রিয় আর কোনও ফোঁটা নেই।
আরও যারা আল্লাহর রহমত ও আরশের ছায়াতলে স্থান পাবে
প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছে যে সদ্গুণসমূহের কারণে আল্লাহ তায়ালার রহমত ও আরশের ছায়াতলে স্থানদানের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে তা নারী-পুরুষ সকলের জন্যই প্রযোজ্য। ‘পুরুষ’ শব্দ ব্যবহার করাটা কেবলই বাকশৈলী। আল্লাহ তায়ালার কাছে নেক আমলের পুরস্কার লাভের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের কোনও ভেদাভেদ নেই। উল্লেখ্য, আরশ ও রহমতের ছায়াতলে যারা স্থান পাবে তারা কেবল এ সাত শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর বাইরেও আছে। যেমন এক হাদীছে আছে,
من أنظر معسرا أو وضع عنه، أظله الله في ظله
‘যে ব্যক্তি ঋণগ্রহীতা গরীবকে সময় দেয় বা ছাড় দেয়, আল্লাহ তায়ালা তাকে নিজ রহমতের ছায়ায় স্থান দান করবেন।
এক বর্ণনায় আছে,
التاجر الصدوق مع السبعة، في ظل عرش الله يوم القيامة
“কিয়ামতের দিন সত্যনিষ্ঠ ব্যবসায়ী সাত শ্রেণীর লোকের সঙ্গে আল্লাহর আরশের ছায়ায় থাকবে।
অপর এক হাদীছে সাত শ্রেণীর যে তালিকা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে দু’টি শ্রেণী এরকম-
ورجل غض عينيه عن محارم الله تعالى، وعين حرست في سبيل الله
‘ওই ব্যক্তি, যে নিজের দুই চোখ ওই সকল বস্তু থেকে সংযত রাখে, যা আল্লাহ হারাম করেছেন। এবং (ওই ব্যক্তি) যার চোখ আল্লাহর পথে (অর্থাৎ সীমান্ত রক্ষায়) পাহারাদারি করে।
অপর এক হাদীছে প্রদত্ত তালিকায় এরকম আছে,
ورجل كان في سرية مع قوم فلقوا العدو، فانكشفوا، فحمى آثارهم، حتى نجا ونجوا، أو استشهد
“এবং ওই ব্যক্তি, যে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কোনও যুদ্ধাভিযানে ছিল। এ অবস্থায় শত্রুদলের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। তারপর যুদ্ধে শত্রুদল পরাস্ত হয়ে পলায়ন করে। তখন সে শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন করে, যতক্ষণ না সে নিজে ও তার সঙ্গীগণ তাদের থেকে রক্ষা পায় কিংবা সে শহীদ হয়ে যায়।
এছাড়াও যারা শৈশবে কুরআন শেখে এবং বৃদ্ধাবস্থায় তা তিলাওয়াত করে, যারা ওয়াক্তমত নামায আদায়ে যত্নবান থাকে, যারা অন্ধকারে জামাতে নামায আদায়ের জন্য মসজিদে যায়, যারা আল্লাহর পথের মুজাহিদদেরকে সাহায্য করে এবং এমনিভাবে আরও বিভিন্ন সৎকর্মপরায়ণ সম্পর্কে রেওয়ায়েত দ্বারা জানা যায় যে, তারাও আল্লাহ তায়ালার রহমত ও আরশের ছায়ায় স্থান পাবে।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. আল্লাহ তায়ালা যাকে শাসনক্ষমতা দান করেছেন, তার একান্ত কর্তব্য ন্যায় ইনসাফের সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালনা করা।
খ. যৌবনকালকে খেলাধুলার ও খেয়ালখুশির ভেতর নষ্ট করা উচিত নয়। এ সময়টা অনেক মূল্যবান। ইবাদত-বন্দেগীর সঙ্গে কাটাতে পারলে রহমতের ছায়ায় স্থান পাওয়া যাবে।
গ. প্রত্যেক মুমিনের উচিত মসজিদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা। যখন যেখানেই থাকা হয় না কেন, মন যেন মসজিদেই পড়ে থাকে।
ঘ. পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও ভালোবাসা হওয়া উচিত কেবল আল্লাহ তায়ালার জন্যই।। এমনিভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়টাও কোনও পার্থিব স্বার্থে না হয়ে আল্লাহ তায়ালার জন্যই হওয়া উচিত।
ঙ. কোনও পুরুষের উচিত নয় কোনও নারীর ছলনায় পড়া। কোনও নারীরও উচিত নয় পুরুষের ছলনায় নিজেকে কলঙ্কিত করা। আল্লাহর ভয়ে নিজেকে এর থেকে হেফাজত করা চাই।
চ. আল্লাহর পথে সাধ্যমত দান-খয়রাত করা চাই। আর নিজের পক্ষ থেকে তা কিছুতেই প্রকাশ করা উচিত নয়।
ছ. নির্জনে নিভৃতে আল্লাহ তায়ালার যিকর ও স্মরণে লিপ্ত হয়ে চোখের পানি ঝরানো অতি উচ্চ পর্যায়ের আমল। আপন সময়-সুযোগ অনুযায়ী এ আমলটি অবশ্যই করা চাই।
وَ هَذَا شُرُوعٌ فِي الْمَرَامِ وَفَّقَنِيَ اللهُ وَإِيَّاكُمْ لِخَيْرِ الْخِتَامِ.
فَأَوَّلُ مَا يَلْزَمُ عَلَيْنَا تَحْقِيقُهُ وَتَنْقِيحُهُ أَنَّ «البِرّ» مَا هُوَ ؟ |
অনুবাদ: . আর এটা মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনার সূচনা। আল্লাহ তায়ালা আমাকে এবং তোমাদেরকে কল্যাণকর সমাপ্তির তাওফীক দান করুন। তো সর্বপ্রথম আমাদের যে বিষয়টা তাহকীক ও অনুসন্ধান করে বের করতে হবে, তা হলো, পুণ্যের কাজ কী? |
«البِرُّ» مَا هُوَ ؟ |
নেক কাজ কী? |
ক্রমিক নং : 5 | |
আরবি | বাংলা |
قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ : ﴿لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ﴾ | অনুবাদ: . পুণ্য তো কেবল এটাই নয় যে, তোমরা নিজেদের চেহারা পূর্ব বা পশ্চিম দিকে ফেরাবে; বরং পুণ্য হল (সেই ব্যক্তির কার্যাবলী), যে ঈমান রাখে আল্লাহর, শেষ দিনের ও ফিরিশতাদের প্রতি এবং (আল্লাহর) কিতাব ও নবীগণের প্রতি। আর আল্লাহর ভালোবাসায় নিজ সম্পদ দান করে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, মুসাফির ও সওয়ালকারীদেরকে এবং দাসমুক্তিতে এবং সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় এবং যারা কোনও প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূরণে যত্নবান থাকে এবং সঙ্কটে, কষ্টে ও যুদ্ধকালে ধৈর্যধারণ করে। এরাই তারা, যারা সাচ্চা (নামে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত) এবং এরাই মুত্তাকী। [সুরা আল-বাকারা : (০২):177] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
পুণ্য তো কেবল এটাই নয় যে, তোমরা নিজেদের চেহারা পূর্ব বা পশ্চিম দিকে ফেরাবে: একথা বলা হচ্ছে সেই কিতাবীদেরকে লক্ষ্য করে, যারা কিবলা নিয়ে এমনভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু করে দিয়েছিল যেন দীনের ভেতর এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোনও বিষয় নেই। মুসলিমদেরকে বলা হচ্ছে, কিবলার বিষয়টাকে যতটুকু স্পষ্ট করার দরকার ছিল তা করা হয়েছে। এবার তোমাদের উচিত, দীনের অন্যান্য জরুরী বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হওয়া। আর কিতাবীদেরকেও বলে দেওয়া চাই যে, কিবলার বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনায় লিপ্ত হওয়া অপেক্ষা দরকারী বিষয় হল, নিজ ঈমানকে দুরস্ত করে নেওয়া এবং নিজের ভেতর সেই সকল গুণ আনয়ন করা যা ঈমানেরই দাবী। কুরআন মাজীদ এ প্রসঙ্গে সৎকর্মের বিভিন্ন শাখার বিবরণ দিয়েছে এবং ইসলামি আইনের নানা দিক তুলে ধরেছে। সামনে এক-এক করে তা আসছে।
ক্রমিক নং : | |
আরবি | বাংলা |
هذه كَلِمَاتٌ نَضَدَتْ فِي هَذِهِ الْآيَةِ الْكَرِيمَةِ تَحْتَوِي عَلَى جَمِيعِ أَنْوَاعِ الْبِرِّ. وَقَدْ شَرَحَهَا وَبَيّنَهَا الَّذِي بُعِثَ مُعَلِّماً، الَّذِي كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ وَكَانَ نُطْقُهُ وَحْيَ الرَّحْمَانِ -كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى: ﴿وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى﴾ [النجم: 3-4]
وَ هَا بَيْنَ يَدَيْكَ هَذِهِ الشُّرُوْحُ الَّتِي هِيَ سُنَنُ الْهُدَى وَسُبُلُ السَّلام. وَلَمَّا كَانَ أَوَّلُ كَلِمَةٍ مِّنْ هَذِهِ الْكَلِمَاتِ ﴿مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ﴾ نَتْلُوْ عَلَيْكَ الْأَحَادِيثَ وَالْأَخْبَارَ الَّتِي وَرَدَتْ فِي شَرْحِ الْإِيْمَانِ وَبِاللهِ التَّوْفِيْقُ وَعَلَيْهِ التُّكْلَانُ. |
অনুবাদ: . এগুলো উল্লেখযোগ্য কিছু শব্দ, যা এই মাহাত্ম্যপূর্ণ আয়াতে সন্নিবেশিত হয়েছে, যা পুণ্যের সমস্ত প্রকারকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই শব্দগুলোর ব্যাখ্যা করেছেন এবং সুস্পষ্টভাবে এর অর্থ বর্ণনা করেছেন সেই মহান রাসূল, যিনি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছেন, যাঁর চরিত্র ছিল আল-কুরআন, যাঁর কথা ছিল রহমানের ওহী, যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর তিনি নিজ প্রবৃত্তি হতে কিছুই রচনা
করেন না। তাঁর উক্তি কেবল ওহী, যা তাঁর প্রতি প্রেরিত হয়।” -(সুরা নাজম: ৩-৪) এই তো তোমার সামনে এই ব্যাখ্যাসমূহ, যা হেদায়েতের পথ এবং শান্তি ও নিরাপত্তার পথ। যখন এই বাক্যসমূহের প্রথম বাক্যটা হলো, “যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে”, তখন আমরা তোমার কাছে ঐ হাদীসসমূহ বর্ণনা করবো, যা ঈমানের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার নিকট তাওফীক প্রার্থনা করি এবং তাঁর উপর ভরসা করি। |
شَرْحُ الإيْمَانِ |
ঈমানের ব্যাখ্যা |
ক্রমিক নং : ৬ | |
আরবি | বাংলা |
6- عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ يَقُوْلُ : بَيْنَمَا نَحْنُ جُلُوسٌ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ في الْمَسْجِدِ دَخَلَ رَجُلٌ عَلَى جَمَلٍ فَأَنَاخَهُ ثُمَّ عَقَلَهُ ثُمَّ قَالَ لَهُمْ: أَيُّكُمْ مُحَمَّدٌ؟ وَالنَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُتَّكِئٌ بَيْنَ ظَهْرَانَيْهِمْ، فَقُلْنَا: هَذَا الرَّجُلُ الْأَبْيَضُ الْمُتَّكِئُ. فَقَالَ الرَّجُلُ: يَا ابْنَ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ..! فَقَالَ لَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَجَبْتُكَ. فَقَالَ لَهُ الرَّجُلُ: إِنِّي سَائِلُكَ فَمُشَدِّدٌ عَلَيْكَ فِي الْمَسْئَلَةِ، فَلا تَجِدْ عَلَيَّ فِي نَفْسِكَ. فَقَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : سَلْ عَمَّا بَدَا لَكَ. فَقَالَ: أَسْألُكَ بِرَبِّكَ وَرَبِّ مَنْ قَبْلَكَ : آللهُ أَرْسَلَكَ إِلَى النَّاسِ كُلِّهِمْ؟ فَقَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : اللهم نَعَمْ. فَقَالَ: أَنْشُدُكَ بِاللهِ : آللهُ أَمَرَكَ أنْ تُصَلِّيَ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسَ فِي الْيَوْمِ وَاللَّيْلَةِ؟ فَقَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : اللهم نَعَمْ. قَالَ: أَنْشُدُكَ بِاللهِ : آللهُ أَمَرَكَ أَنْ تَصُوْمَ هَذَا الشَّهْرَ مِنَ السَّنَةِ؟ قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : اللهم نَعَمْ. قَالَ: أَنْشُدُكَ بِاللهِ : آللهُ أَمَرَكَ أَنْ تَأْخُذَ هَذِهِ الصَّدَقَةَ مِنْ أَغْنِيَائِنَا فَتَقْسِمَهَا عَلَىٰ فُقَرَائِنَا؟ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : اللهم نَعَمْ. فَقَالَ الرَّجُلُ: آمَنْتُ بِمَا جِئْتَ بِهِ، وَأَنَا رَسُوْلُ مَنْ وَرَائِي مِنْ قَوْمِي، وَأَنَا ضِمَامُ بْنُ ثَعْلَبَةَ أَخُوْ بَنِيْ سَعْدِ بْنِ بَكْرٍ. (رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ النسائيُّ وَالدَّارَقُطْنِيُّ). | অনুবাদ: . আনাস ইবনে মালিক রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একবার আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে মসজিদে বসা ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি সওয়ার অবস্থায় ঢুকল। মসজিদ (প্রাঙ্গণে) সে তার উটটি বসিয়ে বেঁধে রাখল। এরপর সাহাবিদের লক্ষ্য করে বলল, তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তার সামনেই হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। আমরা বললাম, এই হেলান দিয়ে বসা ফর্সা রংয়ের ব্যক্তিই হলেন তিনি।
তারপর লোকটি তাঁকে লক্ষ্য করে বলল, হে আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র! নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, আমি তোমার জওয়াব দিচ্ছি। লোকটি বলল, আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব এবং সে প্রশ্ন করার ব্যাপারে কঠোর হব, এতে আপনি রাগ করবেন না। তিনি বললেন, তোমার যেমন ইচ্ছা প্রশ্ন কর। সে বলল, আমি আপনাকে আপনার রব ও আপনার পূর্ববর্তীদের রবের কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, আল্লাহ্ই কি আপনাকে সকল মানুষের প্রতি রাসূলরূপে পাঠিয়েছেন?’ তিনি বললেন, আল্লাহ্ সাক্ষী, হ্যাঁ। সে বলল, আমি আপনাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, আল্লাহ্ই কি আপনাকে দিনরাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন? তিনি বললেন, আল্লাহ্ সাক্ষী, হ্যাঁ। সে বলল, আমি আপনাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, আল্লাহ্ই কি আপনাকে বছরের এ মাসে (রমযান) রোযা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন? তিনি বললেন, আল্লাহ্ সাক্ষী, হ্যাঁ। সে বলল, আমি আপনাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, আল্লাহ্ই কি আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমাদের ধনীদের থেকে সাদ্কা (যাকাত) উসূল করে গরীবদের মধ্যে ভাগ করে দিতে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ্ সাক্ষী, হ্যাঁ। এরপর লোকটি বলল, আমি ঈমান আনলাম আপনি যা (যে শরীআত) এনেছেন তার ওপর। আর আমি আমার কওমের রেখে আসা লোকজনের পক্ষে প্রতিনিধি, আমার নাম যিমাম ইবনে সা’লাবা, বনী সাদ ইবনে বকর গোত্রের একজন।[3] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা :
এই হেলান দিয়ে বসা ফর্সা রংয়ের ব্যক্তিই হলেন তিনি : এখানে সাদা দ্বারা ধবধবে সাদা উদ্দেশ্য নয়; রাসূল-এর শরীরের রং সম্পর্কে শামায়েলে তিরমিযীর রেওয়ায়েত হলো- لَا بِالْأَبْيَضِ الْأَمْهَقِ وَلَا بِالْأَدَمِم প্রিয়নবী চুনার মতো একদম শ্বেতশুভ্র ছিলেন না, আবার একদম গোধূমী রং-এরও ছিলেন না; বরং লালমিশ্রিত ফর্সা ও সুন্দর ছিলেন। কিন্তু যেহেতু শুভ্রতা প্রবল ছিল, তাই أَبْيَضُ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে।
হে আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র! : এ সম্বোধন আদব ও সম্মান প্রদর্শনের পরিপন্থি নয়। কারণ, আব্দুল মুত্তালিব আরবের প্রসিদ্ধ নেতা ছিলেন। এই সুখ্যাতির ভিত্তিতে হুনাইনের যুদ্ধে তিনি নিজেই কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন – أَنَا النَّبِيُّ لَا كَذِبُ : أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ অর্থাৎ, আমি নবী, আর নবী কখনো যুদ্ধে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন না, পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকেও আমি আরবের প্রসিদ্ধ নেতার সন্তান।
আল্লাহ্ সাক্ষী, হ্যাঁ : শব্দ বলে উত্তর দেওয়ার কারণ হল, রাসূল লোকটির প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রত্যেকবারই اللَّهُمَّ، نعم বলেছেন। এর কারণ সম্পর্কে ফখরুদ্দীন আহমদ মুরাদাবাদী রহ. বলেন, উক্ত শব্দটি আল্লাহ তায়ালার সকল সুন্দর নামের স্থলাভিষিক্ত। এজন্যই হয়তো রাসূল উত্তর প্রদানের ক্ষেত্রে আল্লাহর সকল সুন্দর নামের সমন্বয় করেছিলেন।
ক্রমিক নং : ৭ | ||
আরবি | বাংলা | |
وَعَنْهُ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّهُ جَاءَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْبَادِيَةِ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم فَقَالَ: أَتَانَا رَسُوْلُكَ فَأَخْبَرَنَا أَنَّكَ تَزْعَمُ أَنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ أرْسَلَكَ. قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : صَدَقَ. فَقَالَ : فَمَنْ خَلَقَ السَّمَاءَ؟ قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : “اللهُ عَزَّ وَجَلَّ. قَالَ: فَمَنْ خَلَقَ الْأَرْضَ وَالْجِبَالَ؟ قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : اللهُ عَزَّ وَجَلَّ. قَالَ: فَمَنْ جَعَلَ فِيهَا الْمَنَافِعَ ؟ قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : “اللهُ عَزَّ وَجَلَّ. قَالَ: فَبِالَّذِي خَلَقَ السَّمَاءَ وَخَلَقَ الْأَرْضَ وَنَصَبَ الْجِبَالَ وَجَعَلَ فِيهَا الْمَنَافِعَ- آللهُ أَرْسَلَكَ؟ قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : نَعَمْ. قَالَ: زَعَمَ رَسُوْلُكَ أَنَّ عَلَيْنَا خَمْسَ صَلَوَاتٍ وَزَكَاةً فِي أَمْوَالِنَا. قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : صَدَقَ. قَالَ: بِالَّذِي أَرْسَلَكَ- آللهُ أَمَرَكَ بِهَذَا؟ قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : نَعَمْ. قَالَ: وَزَعَمَ رَسُوْلُكَ أَنَّ عَلَيْنَا صَوْمَ شَهْرٍ فِي سَنَتِنَا. قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : صَدَقَ. قَالَ: فَبِالَّذِي أَرْسَلَكَ -اللهُ أَمَرَكَ بِهَذَا؟ قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : نَعَمْ. قَالَ: وَزَعَمَ رَسُوْلُكَ أَنَّ عَلَيْنَا حِجَّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلاً..! قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : صَدَقَ. قَالَ: فَبِالَّذِي أرْسَلَكَ -آللهُ أَمَرَكَ بِهَذَا؟ قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : نَعَمْ. قَالَ: فَوَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ، لاَ أَزِيدُ عَلَيْهِنَّ شَيْئًا وَلَا أَنْقُصُ. فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِنْ صَدَقَ لَيَدْخُلَنَّ الْجَنَّةَ. (رَوَاهُ مسلم) | অনুবাদ: . আনাস ইবনে মালিক রাদি. থেকে বর্ণনা করেন,
একদিন গ্রাম থেকে এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলল, হে মুহাম্মাদ! আমাদের কাছে আপনার দূত এসে বলেছে, আপনি দাবি করেছেন যে, আল্লাহ আপনাকে রাসূল হিসাবে পাঠিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে সত্যই বলেছে। আগন্তুক বলল, আসমান কে সৃষ্টি করেছেন? তিনি বললেন, আল্লাহ। আগন্তুক বলল, যমীন কে সৃষ্টি করেছেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ। আগন্তুক বলল, এসব পর্বতমালা কে স্থাপন করেছেন এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে তা কে সৃষ্টি করেছেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ। আগন্তুক বলল, কসম সেই সত্তার! যিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং এসব পর্বতমালা স্থাপন করেছেন। আল্লাহই আপনাকে রাসূলরূপে পাঠিয়েছেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। আগন্তুক বলল, আপনার দূত বলে যে, আমাদের উপর দিনেরাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে সত্যই বলেছে। আগন্তুক বলল, যিনি আপনাকে রাসূলরূপে পাঠিয়েছেন তাঁর কসম, আল্লাহই কি আপনাকে এর নির্দেশ দিয়েছেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। আগন্তুক বলল, আপনার দূত বলে যে, আমাদের উপর আমাদের মালের যাকাত দেওয়া ফরয। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে ঠিকই বলেছে। আগন্তুক বলল, যিনি আপনাকে রাসূলরূপে পাঠিয়েছেন, তাঁর কসম, আল্লাহই কি আপনাকে এর নির্দেশ দিয়েছেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। আগন্তুক বলল, আপনার দূত বলে যে, প্রতি বছর রমযান মাসের রোযা পালন করা আমাদের উপর ফরয। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে সত্যই বলেছে। আগন্তুক বলল, যিনি আপনাকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন, তার কসম, আল্লাহই কি আপনাকে এর নির্দেশ দিয়েছেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। আগন্তুক বলল, আপনার দূত বলে যে, আমাদের মধ্যে যে বায়তুল্লাহতে যেতে সক্ষম, তার উপর হজ্জ ফরয। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে সত্যই বলেছে। রাবী বলেন যে, তারপর আগন্তুক চলে যেতে যেতে বলল, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তার কসম, আমি এর অতিরিক্তও করব না এবং এর থেকে কমও করব না। এ কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, লোকটি সত্য বলে থাকলে অবশ্যই সে জান্নাতে যাবে।[4] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : হাদিসের শুরু অংশে প্রশ্ন করার যে নিষেধাজ্ঞার কথাটি বলা হয়েছে, এর দ্বারা কোরআন পাকের ঐ আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছেঃ হে মুমিনগণ! তোমরা এমন বিষয় জিজ্ঞাসা করো না, যা পরিবাক্ত হলে তোমাদের কাছেই খারাপ লাগবে।। (সুরা মায়েদাহ)
বাস্তব কথাও হচ্ছে এই যে, নতুন নতুন প্রশ্ন করা মানুষের একটি স্বভাব। কিন্তু এ অভ্যাসকে অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ছেড়ে দিলে এই ফল হয় যে, মানুষের মন ও আকর্ষণ তখন চুলচেরা তর্ক-বিতর্কের দিকেই বেশী অগ্রসর হয়। আর এতে কথার বিশ্লেষণের প্রবণতাই বেশী সৃষ্টি হয় এবং এ তুলনায় কর্ম ও আমল খুব কমই হয়ে থাকে। তাছাড়া এতে সময়ও নষ্ট হয়। বিশেষ করে যুগের নবীর কাছে অধিক প্রশ্ন করার একটি ক্ষতিকর দিক এটাও যে, নবীর পক্ষ থেকে যখন উত্তর আসে, তখন দেখা যায়, উম্মতের অনেক পাবন্দীও বেড়ে যায়।
যা হোক, এ সকল কারণেই অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা থেকে সাহাবায়ে কেরামকে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে তারা নিজেরা প্রশ্ন খুবই কম করতেন এবং এ আশায় থাকতেন যে, কোন গ্রাম্য বেদুঈন এসে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করুক, আর এ সুযোগে আমরা কিছু শুনে শিখে নেই। কারণ, বেদুঈনদের জন্য হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে অনেক অবকাশ ছিল। এ হাদিসেরই এক বর্ণনায় আনাস রাদি. থেকেই বর্ণিত হয়েছে, “বেদুঈন লোকটি খুব দুঃসাহসের সাথে প্রশ্ন করে যাচ্ছিল এবং নির্দ্বিধায় যা মনে আসছিল তাই জিজ্ঞাসা করছিল।” — ফতহুল বারী।
বুখারী শরীফে এ হাদিসেরই বর্ণনায় রয়েছে যে, শেষে যাবার সময় এই বেদুঈন বলেছিল। আমি বনু সাদ ইবনে বকর গোত্রের এক সদস্য, আমার নাম হচ্ছে যেমাম ইবনে সা’আলাবাহ। আমি আমার গোত্রের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলাম।
বুখারীর বর্ণনায় একথাও রয়েছে যে, এ লোকটি এসে প্রথমেই হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছিল যে, আমি আপনার কাছে কিছু বিষয় জিজ্ঞাসা করব, তবে আমার প্রশ্নের ধরন কিছুটা শক্ত হবে। তাই বলে আপনি আমার উপর রাগ করবেন না। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, তোমার মনে যা আসে তাই জিজ্ঞাসা কর। তারপর ঐ প্রশ্নোত্তর হল, যা হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে।
প্রশ্নকারী বেদুঈন যাওয়ার সময় কসম খেয়ে যে কথাটি বলেছিল যে, “আমি এতে কোন হ্রাস-বৃদ্ধি করব না”, সম্ভবত তার এ কথার এ উদ্দেশ্য ছিল যে, আমি আপনার এ শিক্ষা ও দিক নির্দেশনার সম্পূর্ণ অনুসরণ করব এবং আমার মনের চাহিদায় এতে কোন প্রকার কমবেশী করব না। দ্বিতীয় অর্থ এও হতে পারে যে, আমি আপনার এই পয়গাম ও বাণী অবিকল এভাবেই আমার গোত্রের কাছে পৌঁছে দিব এবং আমার নিজের পক্ষ থেকে এতে কোন সংযোজন বা বিয়োজন করব না।
অন্যান্য বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, এ বেদুঈন লোকটি নিজ গোত্রের কাছে গিয়ে খুব উদ্যমের সাথে দীন প্রচারের কাজ শুরু করে দিলেন। তিনি প্রতিমাপূজার বিরুদ্ধে এমন সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য বক্তব্য দিতে লাগলেন যে, তার কোন কোন নিকটাত্মীয় ও আপনজন তাকে বলল হে যেমাম। কুষ্ঠরোগ উন্মাদ হওয়া থেকে সাবধান থাক। (অর্থাৎ, দেবতাদের বিরুদ্ধাচরণ করে কুন্ঠরোগে যেন আক্রান্ত না হয়ে যাও অথবা তুমি যেন পাগল না হয়ে যাও)
কিন্তু আল্লাহ্ তায়ালা তার তবলীগ ও দীন প্রচারে এমন বরকত দান করলেন যে, সকাল বেলা যারা তাকে কুষ্ঠরোগ ও পাগলামীতে আক্রান্ত হওয়ার ভয় দেখাচ্ছিল, সন্ধ্যা বেলায় তারাই মূর্তিপূজা থেকে তওবা করে তওহীদের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করল। ফলে সারা গোত্রে একটি প্রাাণীও আর অমুসলিম রইল না।
أَيُّ الإِسْلَامِ خَيْرٌ؟ |
ইসলামের কোন্ কাজ সবচাইতে কল্যানকর? |
ক্রমিক নং : ৮ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَجُلاً سَأَلَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أيّ الإسلامِ خَيْرٌ ؟ قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : تُطْعِمُ الطَّعَامَ وَتَقْرَءُ السَّلَامَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرفْ. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ) | অনুবাদ: . আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদি. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–কে জিজ্ঞাসা করল, ‘ইসলামের কোন্ কাজ সবচাইতে কল্যানকর?’ তিনি বললেন, তুমি লোকদের আহার করাবে এবং পরিচিত–অপরিচিত নির্বিশেষে সকলকে সালাম করবে।[5] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : কোন ইসলাম উত্তম? এর উত্তরে রাসূল দুটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। ক. إِطْعَامُ إِفْشَاءُ السَّلَامِ الطَّعَامِ এখানে إِطْعَامُ শব্দটি ব্যাপক, খাওয়ানো, পান করানো, দরিদ্রদেরকে খাওয়ানো সবই এর অন্তর্ভুক্ত। তেমনিভাবে এটি কারো জন্য নির্দিষ্ট নয়; বরং কাফের-মুসলিম, আপন-পর, এমনকি মানুষ ও জীবজন্তু সবই এর অন্তর্ভুক্ত।
أيُّ الإسْلامِ أَفْضَلُ؟ |
ইসলামের কোন্ কাজ সবচাইতে উত্তম? |
ক্রমিক নং : ৯ | ||
আরবি | বাংলা | |
عَنْ أَبِي مُوسَى رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالُوا: يَا رَسُوْلَ الله! أيُّ الإِسْلامِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُوْنَ مِنْ لِّسَانِهِ وَيَدِه. (رَوَاهُ أَحْمد) | অনুবাদ: . আবু মুসা রাদি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাহাবায়ে কেরাম বলতেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন্ ইসলাম উত্তম? তিনি বললেন, যার রসনা ও হাত হতে অন্য মুসলমানগণ নিরাপদ থাকে।[6] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম ব্যক্তির পরিচয় দিতে গিয়ে তার অন্যতম প্রধান একটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন, আর তা হচ্ছে নিজের জিহ্বা ও হাত দ্বারা অন্য কোনও মুসলিমকে কষ্ট না দেওয়া। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় কেবল এই একটি গুণ যার মধ্যে আছে সেই মুসলিম। এর অর্থ দাঁড়ায় যার মধ্যে এ গুণটি নেই সে মুসলিম নয়। প্রকৃতপক্ষে হাদীছটি দ্বারা সে কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। কেননা এক তো কোনও ব্যক্তিই কেবল এই একটি গুণ দ্বারাই মুসলিম হয়ে যায় না, আবার কোনও মুসলিম ব্যক্তির মধ্যে এ গুণটি না থাকলে সে ইসলাম থেকে খারিজও হয়ে যায় না।
প্রকৃতপক্ষে এটি পরিপূর্ণ ও উৎকৃষ্ট মুসলিমের গুণ। যার মধ্যে এটি না থাকে কিন্তু ইসলামের অন্যান্য জরুরি বিষয়সমূহ থাকে, সে অবশ্যই মুসলিম থাকবে কিন্তু পরিপূর্ণ ও উৎকৃষ্ট মুসলিম বলে গণ্য হবে না। সুতরাং ‘মুসলিম ওই ব্যক্তি’-এর অর্থ পরিপূর্ণ মুসলিম ওই ব্যক্তি। যেমন বলা হয়, পুরুষ তো যায়দ। তার মানে সে একজন উৎকৃষ্ট পুরুষ। অপর একটি হাদীছের দিকে লক্ষ করলে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
عن أبي موسى قال سئل رسول الله ﷺ أي المسلمين أفضل؟ قال: من سلم المسلمون من لسانه ويده
‘ আবূ মূসা রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, কোন্ মুসলিম শ্রেষ্ঠ? তিনি বললেন, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে।
এ হাদীছে জিহ্বা ও হাত দ্বারা কাউকে কষ্ট না দেওয়াকে শ্রেষ্ঠ মুসলিমের গুণ বলা হয়েছে। বোঝা গেল এ গুণ কোনও মুসলিমের মধ্যে না থাকলে সে মুসলিম থাকবে বটে, কিন্তু শ্রেষ্ঠ মুসলিম বলে গণ্য হবে না।
জিহ্বা দ্বারা কাউকে কষ্ট না দেওয়ার ব্যাখ্যা
যার জিহ্বা থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে অর্থাৎ সে তার জিহ্বা দ্বারা তাদেরকে কোনওরকম কষ্ট দেয় না, সে তাদেরকে গালি দেয় না, অভিশাপ দেয় না, গীবত করে না, চুগলখোরী করে না, ঝগড়া-ফাসাদে উস্কানি দেয় না এবং এমনিভাবে মুখের এমন কোনও ব্যবহার করে না, যা দ্বারা কেউ কষ্ট পেতে পারে বা কারও কোনও ক্ষতি হতে পারে। এস্থলে ‘কথা দ্বারা কষ্ট দেয় না। –না বলে জিহ্বা দ্বারা কষ্ট না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কেননা জিহ্বা দ্বারা যেমন কথা বলা হয়, তেমনি জিহ্বার এমন ব্যবহারও সম্ভব, যা দ্বারা অন্যে কষ্ট পেতে পারে, যেমন জিহ্বা বের করে ভেংচি কাটা। বোঝা গেল প্রকৃত মুসলিম কথা দ্বারাও কাউকে কষ্ট দেয় না এবং ব্যঙ্গ করে বা ভেংচি কেটেও কাউকে কষ্ট দেয় না।
উল্লেখ্য, যখন থেকে লেখা ও কলমের ব্যবহার শুরু হয়েছে, তখন থেকে এ মাধ্যমটিও জিহ্বার বিকল্প গণ্য হয়ে আসছে। বলা হয়ে থাকে- القلم أحد اللسانين (কলম মানুষের দ্বিতীয় জিহ্বা)।
সুতরাং লেখা বা কলমের ব্যবহার দ্বারা কাউকে কষ্ট দেওয়া হলে তাও এ হাদীছের অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ প্রকৃত মুসলিম তার লেখনী শক্তি দ্বারাও কষ্ট দেবে না।
চাইলে এটাকে হাতেরও অন্তর্ভুক্ত করা যায়, যেহেতু লিখতে বা কলম ব্যবহার করতে হাতের প্রয়োজন হয়। সুতরাং কেউ লেখা দ্বারা অন্যের নিন্দা করলে বা কলম দ্বারা অন্যের ওপর অন্যায় আক্রমণ চালালে কিংবা একজনের লেখা দ্বারা অন্যের যে কোনওরকম ক্ষতি হয়ে গেলে সে পরিপূর্ণ মুসলিমরূপে গণ্য হবে না।
হাত দ্বারা কষ্ট না দেওয়ার ব্যাখ্যা
তারপর বলা হয়েছে, তার হাত থেকেও অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে। অর্থাৎ হাত দ্বারাও সে কাউকে কষ্ট দেয় না, কাউকে অন্যায়ভাবে মারধর করে না, যাতায়াত পথে কষ্টদায়ক জিনিস ফেলে না, কারও মাল কেড়ে নেয় না ইত্যাদি।
‘হাত’ দ্বারা অনেক সময় ক্ষমতা ও প্রভাবও বোঝানো হয়ে থাকে, যেমন বলা হয় এ বিষয়ে আমার কোনও হাত নেই মানে আমার ক্ষমতা নেই বা তার ওপর আমার কোনও হাত নেই অর্থাৎ তার ওপর আমার কোনও প্রভাব নেই। সুতরাং কেউ যদি ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে অন্যের ক্ষতি করে, তাও হাত দ্বারা কষ্ট দেওয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে। তাই প্রকৃত মুসলিম তার ক্ষমতা ও প্রভাবের অপব্যবহার করে না এবং এর দ্বারা অন্যের ক্ষতিসাধন হতে বিরত থাকে।
কেবল জিহ্বা ও হাতের উল্লেখ করার কারণ
অন্যের ক্ষতি করা বা অন্যকে কষ্ট দেওয়ার কাজ কেবল হাত ও মুখ দিয়েই হয় না, অন্যান্য অঙ্গ দ্বারাও হয়। তা সত্ত্বেও হাদীছে কেবল এ দু’টি অঙ্গের কথা বলা হয়েছে এ কারণে যে, বেশিরভাগ কষ্ট দেওয়ার কাজ এ দু’টি অঙ্গ দ্বারাই হয়ে থাকে। সুতরাং এ কথা বোঝা ঠিক হবে না যে, অন্যান্য অঙ্গ দ্বারা কাউকে কষ্ট দিলে তাতে দোষের কিছু নেই। অবশ্যই তা দোষের। প্রধান দুই অঙ্গের উল্লেখ দ্বারা বাকি অঙ্গসমূহকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে ফেলা হয়েছে। প্রধান অঙ্গের উল্লেখ দ্বারা সকল অঙ্গকে বোঝানোর প্রচলন সব ভাষাতেই আছে। কাজেই হাদীছের অর্থ বুঝতে হবে এরকম যে, প্রকৃত মুসলিম সেই ব্যক্তি, যে তার জিহ্বা, হাত এবং অন্য যে-কোনও অঙ্গ দ্বারা মানুষকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকে।
হাত ও জিহ্বার মধ্যেও আবার জিহ্বার কথা আগে বলা হয়েছে। এর কারণ কষ্টদানের ব্যাপারটা হাতেরচে’ও জিহ্বার দ্বারা বেশি হয়ে থাকে। জিহ্বার আওতা অতি বিস্তৃত। হাত দ্বারা কেবল হাতের গণ্ডির মধ্যে থাকা লোককে কষ্ট দেওয়া যায়। কিন্তু জিহ্বা দ্বারা কষ্ট দেওয়া হয়ে থাকে দূর-দুরান্তের লোককেও। গীবত, পরনিন্দা ও অপবাদ দেওয়ার কাজ তো আড়ালেই করা হয়। এমনিভাবে হাত দিয়ে কষ্ট দেওয়া যায় কেবল উপস্থিত লোককে, আর জিহ্বা দিয়ে কষ্ট দেওয়া যায় কেবল উপস্থিত ও বর্তমানকালের লোককেই নয়; বরং অতীতকালের লোকদেরকেও। এমনকি চাইলে ভবিষ্যৎকালের লোকদেরকেও এর আওতায় ফেলা যায়।
এ হাদীছে কেবল মুসলিমদের কষ্টদান থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য হাদীছ দ্বারা জানা যায়, অন্যায়ভাবে কষ্ট দেওয়া কাউকেই জায়েয নয়, তা মুসলিম হোক বা অমুসলিম। এমনকি শুধু শুধু কোনও পশু-পাখি ও পোকা-মাকড়কেও কষ্ট দেওয়া জায়েয নয়। এক হাদীছে জানানো হয়েছে, এক মহিলা একটি বিড়ালকে না খাইয়ে মারার কারণে জাহান্নামী হয়েছে। একবার পিঁপড়ার বাসা আগুনে পুড়ে দেওয়ার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
إنه لا ينبغي أن يعذب بالنار إلا رب النار
‘আগুনের সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কারও আগুন দিয়ে শাস্তি দেওয়া উচিত নয়।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো পশু যবাইয়ের ক্ষেত্রেও ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নেওয়ার হুকুম করেছেন, যাতে পশুর কষ্ট কিছুটা হলেও কম হয়। পশু পালনের ক্ষেত্রেও তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ আছে যেন ঠিকভাবে তাদের দানাপানি দেওয়া হয় এবং তাদেরকে অহেতুক কষ্ট না দেওয়া হয়। যেখানে পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রেও তিনি দয়ার আচরণ করতে বলেছেন, সেখানে মানুষের প্রতি কিভাবে জুলুম করার সুযোগ থাকতে পারে, তা হোক না সে অমুসলিম? সুতরাং আলোচ্য হাদীছেরই কোনও কোনও বর্ণনায় আছে,
المؤمن من أمنه الناس على دمائهم وأموالهم
‘মুমিন ওই ব্যক্তি, যাকে মানুষ তাদের জান-মালের ব্যাপারে নিরাপদ মনে করে।
এ হাদীছে সাধারণভাবে সমস্ত মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দানকে মু’মিনের বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। হাদীছের প্রথম অংশে যে বিশেষভাবে মুসলিম ব্যক্তির নিরাপত্তা দানের কথা বলা হয়েছে তা এ কারণে যে, মুসলিমগণ পরস্পর ভাই-ভাই। আর ভাই-ভাই হওয়ার সুবাদে সাধারণ মানুষ অপেক্ষা মুসলিম ব্যক্তিকে কষ্টদান করা থেকে বিরত থাকার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাছাড়া অমুসলিম রাষ্ট্রের সাথে জিহাদের অবকাশ আসলে তখন যুদ্ধরত অমুসলিমদের জান-মালের নিরাপত্তা বাকি থাকে না। সেদিক থেকে তাদের তুলনায় মুসলিম নর-নারীর জানমালের নিরাপত্তায় ব্যাপকতা রয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, মুসলিম ও অমুসলিম যে-কোনও ব্যক্তিকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকার যে শিক্ষা ইসলামে দেওয়া হয়েছে তা থেকে ওইসকল ক্ষেত্র ব্যতিক্রম গণ্য হবে, যেসকল ক্ষেত্রে কষ্ট দেওয়াটা শরী’আতেরই হুকুম, যেমন মদপান করলে শাস্তি দেওয়া, চুরি করলে হাত কাটা এবং এভাবে অন্যান্য হুদূদের বিধান কার্যকর করা।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. আমাদেরকে হাতের ব্যবহারে সাবধান হতে হবে, যাতে কোনও মুসলিম নর-নারী এর দ্বারা কষ্ট না পায়
খ. প্রকৃত মুসলিম হতে চাইলে যবানের ব্যবহার করতে হবে সচেতনভাবে, যাতে এর দ্বারা কোনও মুসলিমকে কষ্ট দিয়ে না ফেলি।
গ. পরিপূর্ণ মুসলিম হতে চাইলে ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি দ্বারাও কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।
ঘ. কলমও একরকম যবান। কাজেই এর ক্ষতিকর ব্যবহার থেকেও বিরত থাকতে হবে।
ঙ. প্রকৃত মুসলিম হওয়ার জন্য এটাও জরুরি যে, নিজের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচেতনভাবে ব্যবহার করা হবে, যাতে কোনও অঙ্গ দ্বারাই কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় বা কষ্ট না পায়।
চ. কেবল মুসলিম নর-নারী নয়; আমার দ্বারা যাতে অমুসলিম নর-নারীরও জান, মাল ও ইজ্জতের কোনও ক্ষতি না হয়ে যায় সে ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।
ক্রমিক নং : ১০ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي شُرَيْحٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: وَاللهِ لَا يُؤْمِنُ! وَاللهِ لَا يُؤْمِنُ! وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ! قِيلَ: وَمَنْ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: الَّذِي لَا يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ. ( مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ) | অনুবাদ: . আবু শুরাইহ রাদি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা বলছিলেনঃ আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। আল্লাহর কসম! সে লোক মু’মিন নয়! আল্লাহর কসম। সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। জিজ্ঞাসা করা হলঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! কে সে লোক? তিনি বললেন, যে লোকের প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে না।[7] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকা ঈমানের অঙ্গ। এটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন-তিনবার কসম করে যার অনিষ্ট থেকে প্রতিবেশী নিরাপদ নয় তার মুমিন না হওয়ার কথাটি পুনরাবৃত্তি করেছেন। যদিও মুমিন না হওয়ার দ্বারা পরিপূর্ণ মুমিন না হওয়ার কথা বোঝানো হয়েছে, অর্থাৎ সে কাফের হয়ে যায় না; তার ঈমান ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়, ফলে সে আল্লাহ ও বান্দার পক্ষ থেকে ক্ষমালাভ করতে না পারলে শুরুতে জান্নাতে যেতে পারবে না বটে, কিন্তু ঈমান নিয়ে মারা গেলে একসময় সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে অবশ্যই জান্নাতে যাবে, তবুও বাস্তবিকপক্ষে এটি একটি কঠিন সতর্কবাণীই বটে। কেননা প্রথমত জাহান্নামের শাস্তি যত অল্পদিনের জন্যই হোক না কেন এবং যত সামান্যই হোক না কেন, দুনিয়ার হাজারও বছরের কঠিনতম কষ্ট অপেক্ষাও তা বেশি ভয়াবহ। কোনও মুমিনেরই সে শাস্তিকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। কাজেই তা থেকে বাঁচতে চাইলে অবশ্যই প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত ছোট ক্ষতিও অনেক সময় অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই যে ব্যক্তি প্রতিবেশীকে লাগাতার কষ্ট দিতে থাকবে, তার এ বেপরোয়া অবস্থার কারণে আশঙ্কা থেকে যায় যে, কোনও একদিন তার মূল ঈমানই ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। ফলে ঈমান নিয়ে তার কবরে যাওয়া হবে না। আল্লাহ তায়ালা এ পরিণতি থেকে আমাদের সকলকে রক্ষা করুন।
এ হাদীছে সাধারণভাবে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়ার ভয়াবহতা উল্লেখ করা হয়েছে। এখন আমাদেরকে খুঁজে দেখতে হবে কোন্ কোন্ পথে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া হয়। মৌলিকভাবে এটা দু’রকম- কথা দিয়ে কষ্ট দেওয়া এবং কাজ দিয়ে কষ্ট দেওয়া। সুতরাং প্রতিবেশীকে লক্ষ্য করে রূঢ় কথা বলা, গালাগাল করা, তার সমালোচনা করা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা এবং তার মনে আঘাত লাগে এরকম যে-কোনও কথাবার্তা হতে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। কেননা এর পরিণাম হতে পারে জাহান্নামের আযাব। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীছে সে সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছেন। আবূ হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত,
قيل للنبي صلى الله عليه وسلم: إن فلانة تقوم الليل وتصوم النهار، وتفعل وتصدق، وتؤذي جيرانها بلسانها، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «لا خير فيها، هي من أهل النار». قيل: وفلانة تصلي المكتوبة، وتصدق بأثوار، ولا تؤذي أحدا فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: هي من أهل الجنة
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অমুক মহিলা রাতে নফল নামায পড়ে, দিনে রোযা রাখে ও ইবাদত-বন্দেগী করে এবং দান সদাকা করে, কিন্তু সে তার প্রতিবেশীদেরকে মুখ দিয়ে কষ্ট দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তার মধ্যে কোনও কল্যাণ নেই। সে জাহান্নামীদের একজন। বলা হলো, অমুক মহিলা কেবল ফরয নামায পড়ে এবং রুটির ছোট ছোট টুকরা দান করে, কিন্তু সে কাউকে কষ্ট দেয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইছি। ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জান্নাতবাসীদের একজন।
প্রতিবেশীদেরকে বিভিন্ন কাজকর্ম দ্বারাও কষ্ট দেওয়া হয়। যেমন প্রতিবেশীর বাড়িতে আলো-বাতাসের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া, নিজ বাড়ির ধোঁয়া, দুর্গন্ধ, ময়লা আবর্জনা, পানি ইত্যাদি তার বাড়ির দিকে যেতে দেওয়া, অহেতুক উচ্চ আওয়াজ দ্বারা তাদেরকে অতিষ্ঠ করে তোলা, বিবাহে ভাঙানি দেওয়া, সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা ইত্যাদি। এরকম আরও যত কাজ দ্বারা প্রতিবেশী আর্থিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা থেকে বিরত থাকা এ হাদীছের শিক্ষা অনুযায়ী ঈমানের দাবি।
মানুষের হক মূলত তিন প্রকার জানের হক, মালের হক ও ইজ্জতের হক। এক প্রতিবেশীর উপর অপর প্রতিবেশীর এ তিনও প্রকার হকই রয়েছে। কাজেই এ তিন প্রকারের যে প্রকারেই প্রতিবেশীর হক খর্ব করা হবে এবং যেভাবেই তাকে কষ্ট দেওয়া হবে, তা-ই এ হাদীছের সতর্কবাণীর আওতাভুক্ত হবে। তাই লক্ষ রাখা জরুরি যাতে এক প্রতিবেশীর দ্বারা অন্য প্রতিবেশীর জান, মাল ও ইজ্জতের কোনও ক্ষতি না হয়; বরং তার এ তিনও প্রকার হকের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। এ নিরাপত্তা ভঙ্গ করা যে কত কঠিন পাপ, অপর এক হাদীছে তা এভাবে স্পষ্ট করা হয়েছে যে,
لأن يزني الرجل بعشرة نسوة خير عليه من أن يزني بامرأة جاره، ولأن يسرق الرجل من عشرة أبيات أيسر عليه من أن يسرق من بيت جاره
‘কোনও ব্যক্তি যদি দশ নারীর সঙ্গেও ব্যভিচার করে, তবে তা তার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করা অপেক্ষা লঘু। এমনিভাবে কোনও ব্যক্তি যদি দশটি ঘরেও চুরি করে, তবে তা তার প্রতিবেশীর ঘরে চুরি করা অপেক্ষা হালকা।’
ইমাম ইবন আবী জামরাহ রহ. বলেন, এই যে বাহ্যিক প্রতিবেশী, যার সঙ্গে অপর প্রতিবেশীর বাড়ির দেয়াল বা অন্যকিছুর আড়াল থাকে, তার সম্পর্কেই যখন এত গুরুত্বের সঙ্গে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, কিছুতেই তাকে কষ্ট দেবে না এবং সর্বাবস্থায় তার প্রতি ভালো ব্যবহার করতে সচেষ্ট থাকবে, তখন যেই প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের কোনও আড়াল নেই অর্থাৎ দুই কাঁধের দুই ফিরিশতা, তাদেরকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকা কতইনা গুরুত্বপূর্ণ হবে। সুতরাং বন্ধু হে, সাবধান! তুমি যে শরীআতের হুকুম অমান্য করে দিবারাত্র তাদেরকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছ, এর থেকে বিরত হও। হাদীছ দ্বারা জানা যায়, বান্দা যখন নেক আমল করে তখন তারা দু’জন খুশি হয়, আর বান্দা পাপকর্মে লিপ্ত হলে তারা কষ্ট পায়। সুতরাং সর্বদা বেশি বেশি সৎকর্মে লিপ্ত থেকে এবং অসৎকর্ম পরিহারে যত্নবান থেকে তাদের খুশি রাখতে সচেষ্ট থাকা চাই। মনে রাখতে হবে পার্থিব প্রতিবেশীদের হক আদায়ে যত্নবান থাকা অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তবে তারচে’ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ অদৃশ্য এ দুই প্রতিবেশীর হক আদায়ে যত্নবান থাকা।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় প্রতিবেশীর হক আদায় করা ঈমানের অঙ্গ।
খ. কথা ও কর্ম- কোনওভাবেই প্রতিবেশীকে কষ্ট দিতে নেই।
গ. সদা সচেষ্ট থাকা চাই যাতে এক প্রতিবেশীর পক্ষ হতে অপর প্রতিবেশী তার জান, মাল ও ইজ্জত এ তিনও দিক থেকে নিরাপদ থাকে।
ক্রমিক নং : ১১ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ) | অনুবাদ: . আনাস রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান ও অন্য সকল মানুষের চেয়ে বেশী প্রিয় হই।[8] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : একজন মুসলমান পূর্ণ মু’মিন তখনই হতে পারে, যখন দুনিয়ার সকল মানুষ থেকে এমনকি নিজের পিতা-মাতা ও সন্তানাদি থেকেও বেশী ভালবাসা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি থাকবে। এর আগের হাদীসটিতে অন্য সকলের চাইতে আল্লাহর ভালবাসা, রাসূলের ভালবাসা ইসলামের ভালবাসা অধিক হওয়াকে ঈমানের স্বাদ লাভের পূর্বশর্ত বলা হয়েছে। আর এ হাদীসে কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আসল ব্যাপার এই যে, আল্লাহ এবং রাসূলের ভালবাসা এবং ইসলামের ভালবাসার মধ্যে এমন সম্পর্ক রয়েছে যে, এর একটি অন্যটি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালার প্রতি এবং ইসলামের প্রতি খাঁটি ভালবাসা আল্লাহর রাসূলের ভালবাসা ছাড়া সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে আল্লাহর এবং ইসলামের ভালবাসা ব্যতীত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসার কল্পনাও করা যায় না। কেননা, রাসূলের প্রতি যে ভালবাসা রাসূল হিসাবে হবে, সেটা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কের কারণেই হবে। আর এর অপরিহার্য ফল এ হবে যে, ইসলামের প্রতিও তার পূর্ণ ভালবাসা থাকবে। এ জন্য এ হাদীসে ঈমানের পূর্ণতার জন্য কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু মর্ম উহাই যে, ঈমানের আলো ও এর বরকত কেবল ঐ ভাগ্যবানরাই লাভ করতে পারবে, যাদের অন্তরে আল্লাহ্ এবং রাসূলের ভালবাসা এবং ইসলামের প্রতি ভালবাসা এমন প্রবল যে, এর সামনে অন্য সকল ভালবাসা পরাভূত হয়ে যায়।
এ হাদীসসমূহে আল্লাহ্ এবং রাসূলের প্রতি ভালবাসার যে দাবী উল্লেখ করা হয়েছে, এর মর্ম নির্ধারণে হাদীস ব্যাখ্যাতাদের বক্তব্য অভিন্ন নয়। যে কারণে অনেকের পক্ষে এর মর্ম ও উদ্দেশ্য বুঝে উঠা কঠিন হয়ে পড়েছে, অথচ যে বাস্তবতাটি এ হাদীসসমূহে বর্ণনা করা হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার ও সহজ। ভালবাসা একটি পরিচিত শব্দ, আর এর অর্থও সুবিদিত, আর সে অর্থই এখানে উদ্দেশ্য। তবে আল্লাহ এবং রাসূলের সাথে মু’মিনদের যে ভালবাসা হয়ে থাকে, সেটা পিতা-মাতা ও স্ত্রী-পুত্রদের ভালবাসার ন্যায় রক্তের সম্পর্ক অথবা অন্য কোন সহজাত প্রবৃত্তির কারণে হয় না; বরং আত্মিক ও জ্ঞান বিবেচনায় হয়ে থাকে। আর এই ভালবাসা যখন পূর্ণতা লাভ করে, তখন এর বাইরে অন্যান্য ভালবাসা যা মানুষের স্বভাবগত চাহিদা অথবা প্রবৃত্তির কারণে হয়ে থাকে, সেটা এর সামনে পরাজিত ও পরাভূত হয়ে যায়। এ কথাটি প্রত্যেক ঐ ব্যক্তিই বুঝতে পারে, যাকে আল্লাহ্ তায়ালা এর কিছুটা অংশ দিয়ে থাকেন।
সারকথা, এসব হাদীসে ভালবাসা দ্বারা অন্তরের ঐ অবস্থাকেই বুঝানো হয়েছে, যা ভালবাসা শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়ে থাকে, আর আমাদের কাছে এ জিনিসটিরই দাবী করা হয়েছে। আসলে এ জিনিসটিই আমাদের ঈমানের প্রাণতুল্য। কুরআন মজীদেও এরশাদ হয়েছে। “ঈমানদাররা সবচেয়ে বেশী ভালবাসা আল্লাহর প্রতিই রাখে।” (সুরা বাকারা) অন্যত্র এরশাদ হয়েছে। “হে নবী। আপনি বলে দিন, যদি তোমাদের পিতা-মাতা, তোমাদের সন্তানাদি, তোমাদের ভাই-বেরাদর, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের গোত্র, তোমাদের কষ্টার্জিত সম্পদ, তোমাদের ঐ চালু ব্যবসা, যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান, যাকে তোমরা পছন্দ কর, (দুনিয়ার এসব পছন্দনীয় ও আকর্ষণীয় জিনিসসমূহ) আল্লাহ তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জেহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তাহলে তোমরা আল্লাহর হুকুম আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আর আল্লাহ্ ফাসেক সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না – সুরা তওবা
অতএব, পবিত্র কুরআনের এ মহত্বপূর্ণ আয়াতের দাবী ও আবেদনও এটাই যে, ঈমানদারদের অন্তরে তাদের সকল প্রিয় জিনিসের চেয়ে আল্লাহ তাঁর রাসূল এবং তাঁর দ্বীনের ভালবাসা বেশী থাকতে হবে। অন্যথায় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর বিশেষ হেদায়াত লাভ করা সম্ভব হবে না এবং ঈমানের পূর্ণতাও লাভ করা যাবে না।
এটা প্রকাশ্য বিষয় যে, যে ব্যক্তি এ সম্পদ ও সৌভাগ্য অর্জন করে নিতে পারবে, তার জন্য ঈমানের সকল দাবী পূরণ করা এবং আল্লাহ ও রাসূলের বিধানের উপর চলা কেবল সহজই হবে না; বরং এ পথে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতেও সে অন্তরে স্বাদ অনুভব করবে। পক্ষান্তরে যার অন্তরে আল্লাহ ও রাসূলের ভালবাসার এই প্রাবল্য থাকবে না, তার জন্য প্রাত্যহিক ইসলামি বিধান পালন ও ঈমানের সাধারণ দাবী পুরণও কঠিন মনে হবে। সে এ পথে যতটুকু করবে, সেটা কেবল আইন পালন হিসাবেই করবে। এর বেশী কিছু তার কাছে আশা করা যায় না। এ জন্যই বলা হয়েছে যে, যে পর্যন্ত আল্লাহ এবং রাসূলের ভালবাসা অন্য সকল ভালবাসার উপর জয়ী না হবে, সে পর্যন্ত ঈমানের প্রকৃত মর্তবা লাভ করা সম্ভব হবে না এবং ঈমানের স্বাদ এবং মজাও পাওয়া যাবে না।
আর হাদীসে স্বীয় সত্তার কথা উল্লেখ করা হয়নি এজন্য যে, তা وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ এর মধ্যে নিহিত রয়েছে। অথবা পিতা ও সন্তান উল্লেখ করার পর স্বীয় সত্তার উল্লেখ করা প্রয়োজন হয়নি এজন্য যে, পিতা ও সন্তান নিজ সত্তার চেয়েও ব্যক্তির নিকট মর্যাদাবান। ইমাম খাত্ত্বাবী বলেনঃ হাদীসে মুহাব্বাত বা ভালোবাসা দ্বারা অভ্যাসগত ভালোবাসা বুঝানো হয়নি। বরং তা দ্বারা ইখতিয়ারী (ইচ্ছাকৃত) ভালোবাসা বুঝানো হয়েছে। কেননা মানুষের পরিবার ও সম্পদের প্রতি ভালোবাসা প্রকৃতিগত ভালোবাসা যা থেকে পরিত্রাণ মানুষের সাধ্যাতীত। তা পরিবর্তন করার কোনো পথ নেই। অতএব হাদিসের মর্ম হলো, কোনো ব্যক্তি তার ঈমানের দাবীতে সঠিক বলে প্রমাণিত হবে না যতক্ষণ না সে স্বীয় সত্তাকে আমার আনুগত্যের উদ্দেশে উৎসর্গ করবে এবং আমার সন্তুষ্টিকে স্বীয় প্রবৃত্তির উপর প্রাধান্য দিবে।
হে আল্লাহ্! তুমি আমাদেরকে তোমার ভালবাসা, তোমার রাসূলের ভালবাসা এবং ঐ কাজের ভালবাসা দান কর, যা আমাদেরকে তোমার ভালবাসা লাভে ধন্য করবে।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
১। আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ভালোবাসা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত।
২। এ ভালোবাসা অর্জনে মানুষের মধ্যে শ্রেণী বিন্যাস রয়েছে। অর্থাৎ- রসূলের প্রতি ভালোবাসা অর্জনে সকলে একই স্তরের নয়।
৩। রসূলের প্রতি ভালোবাসার কারণে ঈমান বৃদ্ধি পায়। আর তাঁর প্রতি ভালোবাসা কমে গেলে ঈমানও কমে যায় যা দুর্বল ঈমানের আলামত।
ক্রমিক নং : ১২ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرو رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُوْنَ هَوَاهُ تَبْعاً لِمَا جِئْتُ بِهِ. (رَوَاهُ فِي شَرْحِ السُّنَّةِ)
وَقَالَ النَّوَوِيُّ فِي أَرْبَعِينِهِ: هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحٌ رَوَيْنَاهُ فِي كتابِ الْحجَّة بِإِسْنَاد صَحِيح. |
অনুবাদ: . আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদি. হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার প্রবৃত্তি আমার আনিত বস্তুর অনুগত হয়। [9] মুহিউস সুন্নাহ বাগাবী রাহি. শরহুস সুন্নাহয় রেওয়ায়াত করেছেন এবং ইমাম নববী তার আরবাঈনে বলেছেন, এটি একটি ছহীহ হাদীস। আমি এটা কিতাবুল হুজ্জাতে বিশুদ্ধ সনদসহ বর্ণনা করেছি। |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের শাস্ত্রীয় আলোচনা : গ্রন্থকার এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ইমাম নববির মত উল্লেখ করেছেন। হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী নুআইম ইবন হাম্মাদ। তিনি ছাড়া আর কেউ হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। নুআইম ইবন হাম্মাদ অত্যন্ত কঠোর ও উগ্র ‘সুন্নাত–পন্থী বা সুন্নি’ ছিলেন। তিনি কঠোরভাবে মু’তাযিলা, কাদারিয়া, মুরজিয়া আহলু রাই ও হানাফি মাযহাবের বিরোধিতা করতেন এবং সরাসরি হাদিসের প্রকাশ্য অর্থের অনুসরণের প্রবক্তা ছিলেন। এজন্য সাধারণ মুহাদ্দিসগণ তাকে শ্রদ্ধা করতেন। ইমাম বুখারি তার হাদীস গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার বর্ণিত হাদীসসমূহ তুলনামূলক নিরীক্ষা করলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তিনি হাদীস বর্ণনায় খুবই ভুল করতেন। আলী ইবনুল মাদীনি, ইয়াহইয়া ইবন মাঈন, নাসায়ি প্রমুখ মুহাদ্দিস নুআইম ইবন হাম্মাদকে দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। অনেকেই তাকে ইচ্ছাপূর্বক বানোয়াট হাদীস বলার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। ইমাম আবু হানীফা ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে বানোয়াট ও কল্পিত কথা ছড়াতেন বলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও সনদে আরো দুর্বলতা আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লামা ইবন রাজাব, আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানি প্রমুখ মুহাদ্দিস এই হাদীসটিকে সহীহ হিসাবে গণ্য করা কঠিন বলে মনে করেছেন। দেখুন: ইবন রাজাব, জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম, পৃ: ৩৮৭–৩৮৮, নাসিরুদ্দীন আলবানি, আস–সুন্নাহ লি–ইবনি আবী আসিম, পৃ: ১২।
ক্রমিক নং : ১৩ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ) | অনুবাদ: . আনাস রাদি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য পসন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে।[10] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সম্পর্কে শিক্ষাদান করেছেন, যা ঈমানের দাবিও বটে। তা হচ্ছে, নিজের জন্য যা পসন্দ করা হয় তা মুসলিম ভাইয়ের জন্যও পসন্দ করা এবং নিজের জন্য যা অপসন্দ করা হয় তা মুসলিম ভাইয়ের জন্যও অপসন্দ করা। তিনি বলেন, لا يؤمن أحدكم ‘তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না’। অর্থাৎ পরিপূর্ণ মুমিন। মুমিন না হতে পারার দ্বারা ঈমানের উচ্চতর স্তরে না পৌছা এবং ঈমানের হাকীকত ও গভীরতায় উপনীত না হওয়ার কথা বোঝানো উদ্দেশ্য। একেবারেই মুমিন হতে পারবে না, সে কথা বোঝানো হয়নি। তবে ইসলাম চায় তার অনুসারীগণ ঈমানের চূড়ান্ত ধাপে উপনীত হোক এবং ঈমানের গভীরতা তার মধ্যে এসে যাক। তাই দেখা যায় বহু হাদীছে যেসকল গুণ পরিপূর্ণ ঈমান বা চূড়ান্ত ধাপের ঈমানের শাখা, সেগুলো অর্জিত না হওয়ার ক্ষেত্রেও সাধারণভাবে ‘ঈমান অর্জিত না হওয়া’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। আলোচ্য হাদীছটিও সেরকমই।
حتى يحب لاخيه যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য পসন্দ করবে। এখানে ভাই বলতে সাধারণভাবে যে-কোনও মুসলিম ভাইকে বোঝানো হয়েছে, সুনির্দিষ্ট কোনও মুসলিমকে নয়। কেননা সমস্ত মুমিন ভাই-ভাই; বরং সমস্ত মুসলিম একদেহতুল্য। ব্যক্তি যেমন তার দেহের সবগুলো অঙ্গকে সমান পরিচর্যা করে, কোনও অঙ্গকেই অবহেলা করে না, তেমনি মুসলিম ব্যক্তিরও কর্তব্য দুনিয়ার সমস্ত মুসলিমকে তার আপন মনে করা এবং সে হিসেবে প্রত্যেকের জন্য কল্যাণকামী হওয়া।
কোনও কোনও আলেমের মতে এখানে ভাই বলে আরও ব্যাপকভাবে সমস্ত আদমসন্তানকে বোঝানো উদ্দেশ্য। এক আদি পিতামাতার সন্তান হিসেবে দুনিয়ার সমস্ত মানুষ ভাই-ভাই। সুতরাং প্রকৃত মুমিন হওয়ার জন্য কর্তব্য দুনিয়ার সমস্ত মানুষের প্রতি কল্যাণকামী হওয়া।
ما يحب لنفسه ‘যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে। অর্থাৎ, ইবাদত-বন্দেগী ও বৈধ বিষয়াবলী। এমনিভাবে যা সে নিজের জন্য অপসন্দ করে তা তাদের জন্যও অপসন্দ করে। যেহেতু হাদীছের বক্তব্য দ্বারা এটা এমনিই বুঝে আসে তাই পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়নি। হাদীছটি সারকথা হচ্ছে, প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য নিজের জন্য সে যা কিছু ভালোবাসে তা অন্যান্য মানুষের জন্যও ভালবাসবে। একজন মুমিন হিসেবে ঈমান ও ইসলাম তার প্রিয়। কাজেই সে কামনা করবে যেন দুনিয়ার সমস্ত মানুষ ঈমান ও ইসলামের অধিকারী হয়ে যায়। এ কারণেই অমুসলিমদের জন্য হিদায়াতের দুআ করা মুস্তাহাব।
এ হাদীছ দ্বারা এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, কেবল এ গুণটি অর্জিত হলেই সে মুমিন হয়ে যাবে এবং তার জন্য ইসলামের অন্যান্য ফরযসমূহ পালন করা জরুরি হবে না। বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য কেবল ইসলামের অনুসারীদেরকে বিনয়, সচ্চরিত্র, ঐক্য ও সম্প্রীতির প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। এসকল গুণ অর্জিত হলে পরস্পরের মধ্যে সাহায্য-সহযোগিতা জারি থাকবে। ফলে শরীআতের যাবতীয় বিধি-বিধান পালন করা সকলের জন্য সহজ হয়ে যাবে। এভাবে যেহেতু এ গুণটি গোটা দীন ও শরীআত কায়েমের পক্ষে সহায়ক, তাই এ হাদীছে এটি অর্জনের প্রতি জোর তাগিদ করা হয়েছে। এবং এর অর্জনকে ঈমানদার হওয়ার পক্ষে শর্ত সাব্যস্ত করা হয়েছে।
নিজের জন্য যা পসন্দ করা হয় অন্যের জন্য তা পসন্দ করার মানে নিজেরটা তাকে দিয়ে দেওয়া নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে, অনুরূপ বিষয় বা বস্তু তারও হয়ে যাক এই কামনা করা। নিজেরটা দিয়ে দেওয়াকে ঈমানের জন্য শর্তারোপ করা হলে তা অনেকের জন্যই কঠিন হয়ে যাবে। ইসলাম সেরকম কঠিন বিধান আরোপকে পসন্দ করে না। তবে হাঁ, স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেউ যদি সেরকম উচ্চতর আদর্শ অবলম্বনে প্রস্তুত হয়ে যায় সেটা ভিন্ন কথা। একে ঈছার ও আত্মত্যাগ বলা হয়ে থাকে। ইসলামের ইতিহাসে এমন বহু মহান ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়, যারা নিজের প্রিয় বস্তু অন্যকে দিয়ে আনন্দ বোধ করতেন। মদীনার আনসারগণ তো এ বৈশিষ্ট্যেরই অধিকারী ছিলেন। কুরআন মাজীদে তাদের প্রশংসা করে বলা হয়েছে, وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ “এবং তাদেরকে (মুহাজিরদেরকে) তারা নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও, তাদের অভাব-অনটন থাকে। সুরা হাশর : ৫৯, আয়াত ৯
ইসলাম এরকম আদর্শে উজ্জীবিত হতে উৎসাহ জানায়। যদিও তা বাধ্যতামূলক করেনি।
কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে, নিজের প্রিয় জিনিস অন্যের জন্য পসন্দ করাটা তো অন্যের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে? কেননা অনেকেই এমন এমন জিনিস পসন্দ করে থাকে যা বাস্তবিক পক্ষে ক্ষতিকর, যেমন মদপান, ধূমপান, অবৈধ খেলাধুলা করা, নাচগান করা ইত্যাদি।
এর উত্তর হচ্ছে, প্রকৃত মুমিনের কাছে কখনও এ জাতীয় জিনিস প্রিয় হতেই পারে না। হাদীছের মূলবার্তা হচ্ছে, প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার তাগিদ। যাবতীয় মন্দ বস্তু ঈমানের পরিপন্থী। ফলে ঈমানদারের কাছে তা হবে ঘৃণ্য। সুতরাং সে তা নিজের জন্যও পসন্দ করবে না এবং অন্যের জন্যও তা পসন্দ করার অবকাশ আসবে না। হাদীছের বার্তা দ্বারা এ কথা এমনিই বুঝে আসে। ফলে সুষ্ঠু ও সুস্থ বোধ-বুদ্ধির অধিকারী ব্যক্তির মনে এরকম প্রশ্ন আসেই না। তারপরও বুঝের কমতির কারণে কারও মনে খটকা জাগতে পরে বিধায় খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকেই বিষয়টা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং কোনও কোনও বর্ণনায় ما يحب لنفسه (যা নিজের জন্য পসন্দ করে)-এর পর আছে من الخير (অর্থাৎ, উৎকৃষ্ট বস্তু। -সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৫০১৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৩১৪৬; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৩৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৭৫; মুসনাদে আবূ ইয়ালা, হাদীছ নং ২৮৮৭
নিজের জন্য যা ভালোবাসা হয়, অন্যের জন্যও তা ভালোবাসা এবং নিজের জন্য যা অপসন্দ করা হয়, অন্যের জন্যও তা অপসন্দ করা অতি উন্নত একটি গুণ। এটা ঈমানেরও এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যেমনটা আলোচ্য হাদীছ দ্বারা উপলব্ধি করা যায়। কারও মধ্যে এ গুণের অভাব থাকলে তার ঈমান ও ইসলাম অপূর্ণ থেকে যায়। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছ ছাড়াও আরও বিভিন্ন হাদীছে এর প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। একবার ইয়াযীদ ইবনে আসাদ রাদি.-কে উপদেশ দিতে গিয়ে তিনি বলেনঃ- يا يزيد، أحب للناس ما تحب لنفسك “হে ইয়াযীদ! তুমি নিজের জন্য যা ভালোবাস মানুষের জন্যও তা ভালোবাসবে।-তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৬২৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৬৬৫৩, বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৬১৭
একবার শ্রেষ্ঠতম আমল সম্পর্কে মুআয ইবনে আনাস আলজুহানী রাদি এর জিজ্ঞাসার উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, وأن تحب للناس ما تحب لنفسك، وتكره لهم ما تكره لنفسك.”এবং তুমি নিজের জন্য যা ভালোবাস মানুষের জন্যও তা ভালোবসবে। আর নিজের জন্য যা অপসন্দ কর মানুষের জন্যও তা অপসন্দ করবে।-মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২১৩২; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৫৭৪; তাবারানী মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ৭০
যদি জান্নাত পেতে চাও
মুমিনের অভীষ্ট লক্ষ্য জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভ। এ লক্ষ্য অর্জনের প্রকৃষ্ট উপায় এ গুণের অধিকারী হয়ে যাওয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াযীদ আল কসরী রাদি.-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কি জান্নাত কামনা কর? ইয়াযীদ বললেন, হাঁ। তিনি বললেন- فاحب لاخيك ما تحب لنفسك এ তাহলে তুমি নিজের জন্য যা ভালোবাস তোমার ভাইয়ের জন্যও তা ভালোবেসো’।- মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৬৬৫৫; মুস্তাদরাকে হাকিম, হাদীছ নং ৭৩১৩
আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,فمن أحب أن يزحزح عن النار، ويدخل الجنة، فلتأته مينه وهو يؤمن بالله واليوم الآخر، وليأت إلى الناس الذي يحب أن يؤتى إليه “যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতে প্রবেশ কামনা করে তার যেন এমন অবস্থায় মৃত্যু আসে যখন সে আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে এবং সে মানুষের প্রতি এমন আচরণ করে যেমন আচরণ তার সঙ্গে করা হোক বলে কামনা করে।- সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৪৪, মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৮০২, সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪১৯১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৫৯৬১; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ৩৭১০৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৫৬
অহংকার ও হাসাদ দমনের একটি ব্যবস্থা
উল্লেখ্য, নিজ পসন্দের বিষয় অন্যের জন্য পসন্দ করা এবং নিজের অপসন্দনীয় বিষয় অন্যের জন্য অপসন্দ করার পক্ষে সবচেয়ে বড় বাধা অহংকার ও হাসাদ। মানবস্বভাব সবকিছুতে অন্যের উপর নিজ শ্রেষ্ঠত্ব চায়। কেউ তার সমান হয়ে গেলে বা উপরে উঠে গেলে সে তাতে ঈর্ষা বোধ করে। কাজেই অন্যের জন্য নিজ পসন্দনীয় জিনিস পসন্দ করলে বা নিজ অপসন্দের জিনিস অপসন্দ করলে তাতে উভয়ে সমস্তরের হয়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে অপর ব্যক্তি তার উপরে চলে যায়। এটা অহমিকায় বাঁধে। ঈর্ষাবোধও এটা মানতে পারে না। কাজেই মানবস্বভাব এ আমলের জন্য প্রস্তুত হতে পারে না। অথচ ঈমানের দাবী এ আমল করা, এছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ হয় না। তবে কি আমাদের ঈমান অপূর্ণ থেকে যাবে?
না, ঈমান অপূর্ণ রাখার সুযোগ নেই। ঈমানের এ দাবি অনুযায়ী আমাদের আমল করতেই হবে। আর তা করার জন্য আমাদেরকে নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে। এ সংগ্রাম অহংকার ও হাসাদ দমনের ওষুধও বটে। নিজ হাসাদ ও অহংকারপ্রবণ মন নিজ পসন্দের জিনিস অন্যের জন্য পসন্দ করতে চাবে না। তা যতই না চাক কেন তার সঙ্গে যুদ্ধে নেমে তা পসন্দ করে যেতে হবে। তার সঙ্গে যুদ্ধ করে এ আমল যত বেশি করা হতে থাকবে নফস ততই নিস্তেজ হতে থাকবে। ততই অহংকার ও হাসাদ দুর্বল হতে থাকবে। এক পর্যায়ে তা এমনই দুর্বল হয়ে পড়বে যে, তখন এ অসৎ স্বভাবের এতে বাধা দেওয়ার ক্ষমতাই থাকবে না। তখন এ আমল অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। এতদিন তো এ আমল তেতো লাগছিল। আর তখন নিজ পসন্দের জিনিস অন্যের অর্জিত হয়ে গেলে ভালো লাগবে এবং নিজ অপসন্দের জিনিস অন্যকে স্পর্শ না করলে আনন্দবোধ হবে। এটাও ঈমানের আস্বাদ, যা নিরবচ্ছিন্ন সাধনার দ্বারা অর্জিত হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন – আমীন।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. এ হাদীছ আমাদেরকে পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতি শিক্ষা দেয়।
খ. আমাদেরকে অবশ্যই পরিপূর্ণ মুমিন হতে হবে। আর সে লক্ষ্যে আমাদের কর্তব্য হবে সর্বদা নিজ পসন্দের বিষয় অন্যের জন্য পসন্দ করা ও নিজ অপসন্দের বিষয় অন্যের জন্য অপসন্দ করা।
গ. আমাদের যেহেতু এ আমল করতেই হবে, সেহেতু কোনও বাধা গ্রাহ্য করলে চলবে না। মনের অহংকার ও হাসাদ যেহেতু এর জন্য বাধা তাই মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই এ আমল চালিয়ে যেতে হবে।
ঘ. এ আমলটি অহংকার ও হাসাদ দমনের মহৌষধ। তাই এ মন্দ স্বভাবদুটি দমনের লক্ষ্যেও নিয়মিত এ আমল করে যাওয়া চাই।
ক্রমিক নং : ১৪ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: الْإِيْمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ شُعْبَةً، فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الأذَى عَنِ الطَّرِيقِ، وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِّنَ الْإِيْمَانِ. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ) | অনুবাদ: . আবূ হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ঈমানের সত্তরটির বেশি অথবা ষাটটির বেশি শাখা আছে। তার মধ্যে সর্বোত্তমটি হল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলা এবং সর্বনিম্নটি হল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া। আর লজ্জাশীলতা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা।[11] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক হাদীছ। এতে জানানো হয়েছে ঈমান শাখা-প্রশাখাহীন কোনও বিষয় নয়। এটা সুনির্দিষ্ট একটা জিনিসমাত্র নয় যে, কেউ সেই একটা জিনিস করল আর তাতেই মু’মিন হয়ে গেল। এমনিতে তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে তো এ কথা ঠিক যে, ঈমান অন্তরের বিশ্বাসের নাম। আর বিশ্বাস এক অবিভাজ্য জিনিস। কিন্তু সেই বিশ্বাসও কোনও একটা বিষয়ের উপর হলেই যথেষ্ট হয় না। বরং তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত ইত্যাদি সবগুলোর প্রতি বিশ্বাস রাখলেই কেউ মু’মিন হতে পারে। কাজেই অন্তরের বিশ্বাসের অনেক শাখা-প্রশাখা আছে। তাছাড়া কুরআন-হাদীছ সাধারণত মু’মিন বলে পূর্ণাঙ্গ মু’মিনকেই বোঝায় অর্থাৎ যে ব্যক্তি আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে সাথে শরী’আতের সমস্ত আদেশ-নিষেধও মেনে চলে। সে হিসেবে শরী’আত যা-কিছু করতে বলেছে তার প্রত্যেকটিই ঈমানের একটি শাখা। এমনিভাবে যা-কিছু নিষিদ্ধ করেছে তার প্রত্যেকটি থেকে বেঁচে থাকাও ঈমানের একেকটি শাখা। যে ব্যক্তি সবগুলো শাখার উপর আমল করবে, সে-ই প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ মু’মিন।
এ হাদীছে ঈমানের শাখা বলা হয়েছে ষাট অথবা সত্তরটির কিছু বেশি। এ সংখ্যা দ্বারা মূলত সুনির্দিষ্ট অংক বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং বোঝানো উদ্দেশ্য সংখ্যাধিক্য। অর্থাৎ ঈমানের অনেকগুলো শাখা আছে। সুতরাং ষাট বা সত্তরের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা মেলানোর চেষ্টা বৃথা।
এ হাদীছ দ্বারা মূলত বোঝানো উদ্দেশ্য ঈমানের শাখা অনেকগুলো। সুতরাং তোমরা সামান্য কিছু আমল নিয়ে বসে থেকো না; বরং কুরআন-হাদীছে যত সৎকর্মের কথা বলা হয়েছে সবগুলো করার চেষ্টা করো। তবেই পূর্ণাঙ্গ মু’মিন হতে পারবে। কুরআন ও হাদীছে যেসব কাজ সম্পর্কে কোনও ফযীলত ও ছাওয়াবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আগ্রহভরে তা করে যাও। এবং যেসব কাজ সম্পর্কে আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তির সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে, তা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো।
এ হাদীছে ঈমানের সর্বোচ্চ শাখা বলা হয়েছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনও মা’বুদ নেই- এ সাক্ষ্য দেওয়াকে। এটা ঈমানের সর্বপ্রধান শাখা। এর অপর নাম তাওহীদ। তাওহীদের প্রতি বিশ্বাস পূর্ণাঙ্গ হয় রিসালাত ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস দ্বারা। মূলত এসব বিশ্বাস পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। একটি ছাড়া অন্যটি গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং বিশ্বাসগত যতগুলো বিষয় আছে সবগুলোই অন্তরে লালন করা জরুরি।
তাওহীদের বিশ্বাস ঈমানের সর্বপ্রধান শাখা এ কারণে যে, এর উপর সমস্ত আমলের ভিত্তি। এছাড়া কোনও আমলই গ্রহণযোগ্য নয়। দুনিয়ায় মানুষ যত ভালো কাজই করুক, যদি অন্তরের আকীদা-বিশ্বাস সঠিক না থাকে তবে আখিরাতে সেসব কাজের কোনও সুফল পাওয়া যাবে না। হাঁ, কাজ যেহেতু ভালো তাই দুনিয়ায় তাকে তার বদলা দিয়ে দেওয়া হয়। আখিরাতে বদলা পেতে হলে আকীদা-বিশ্বাস ঠিক থাকা জরুরি। আর সেজন্যই একে ঈমানের সর্বোত্তম শাখা বলা হয়েছে।
ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা বলা হয়েছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করে দেওয়াকে। আপাতদৃষ্টিতে এ আমলটি অতি সামান্য মনে হলেও হাকীকতের দিক থেকে এটি অনেক বড়। কেননা এ কাজটি করা হয় মানুষের প্রতি মমত্ববোধ থেকে। আল্লাহর বান্দাগণ এ পথে যাতায়াত করতে গিয়ে কষ্ট পেতে পারে, সে চিন্তা থেকেই একজন মু’মিন কষ্টদায়ক বস্তুটি সরিয়ে ফেলে। অর্থাৎ সে অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে শিক্ষাই আমাদের দান করেছেন। তিনি এক হাদীছে বলেন,
الْمُسْلِمُوْنَ كَرَجُلٍ وَاحِدٍ إِنِ اسْتَكى عَيْنُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ ، وَإِنِ اشْتَكَى رَأْسُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ
‘মুসলিমগণ সকলে মিলে এক ব্যক্তির মতো, যার চোখ অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মাথা অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে।- সহীহ মুসলিম: ২৫৮৬, ৬৭
হাদীছে ঈমানের সর্বোত্তম ও সর্বনিম্ন শাখা উল্লেখের পর মধ্যবর্তী শাখাসমূহের মধ্য থেকে কেবল লজ্জার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। লজ্জার এমন কী বিশেষত্ব, যে কারণে অন্যসব শাখা থেকে বাছাই করে কেবল এর কথাই উল্লেখ করা হল? এর উত্তর মেলে অন্য এক হাদীছে। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إِنَّ مِمَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلَامِ النُّبُوَّةِ الْأُولَى إِذَا لَمْ تَسْتَحْيِ فَاصْنَعْ مَا شِئْتَ
‘মানুষ পূর্ববর্তী নবুওয়াতের যে বাণী লাভ করেছে (অর্থাৎ পূর্ববর্তী নবীদের যে শিক্ষা এ পর্যন্ত পৌছেছে) তা হচ্ছে- তুমি যদি লজ্জাই না কর, তবে যা চাও করতে পার।-সহীহ বুখারী: ৩৪৮৩; আল-আদাবুল মুফরাদ: ৫৯৭; মুসনাদে আহমাদ: ১৭০৯১; মুআত্তা মালিক: ৫৪৫; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৮২: সনানে আব দাউদ: ৪৭৯৭
অর্থাৎ যে ব্যক্তির লজ্জা নেই সে হেন কাজ নেই যা করতে পারে না। যে-কোনও অন্যায়-অপরাধ লজ্জাহীন মানুষ অবলীলায় করতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তির লজ্জা আছে, সে সহজে অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত হতে পারে না। লজ্জা তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যখনই কোনও মন্দ কাজ করার ইচ্ছা জাগে, তখন লোকে দেখলে কী বলবে এই অনুভূতি তাকে সে কাজ করতে দেয় না। সে মনের ইচ্ছা মনেই দমন করে ফেলে। মানুষকে লজ্জা করার কারণেই যখন মানুষ এভাবে পাপ কাজ থেকে দূরে থাকে, তখন যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে লজ্জা করবে সে তো কোনওক্রমেই পাপ কাজের ধারেকাছে যাবে না।
মূলত আল্লাহ তায়ালাকে লজ্জা করাই প্রকৃত লজ্জা। তাই উলামায়ে কেরাম লজ্জার ব্যাখ্যা দেন- أَنْ لَا يَرَى مَوْلَاكَ فِيْمَا نَهَاكَ عَنْهُ ‘লজ্জা হল এই যে, তোমার মাওলা যেন তোমাকে এমন কাজে না দেখেন, যা করতে তিনি তোমাকে নিষেধ করেছেন’
প্রকাশ থাকে যে, শরী’আতের আদেশ নিষেধ পালনে যে লজ্জা বাধা হয় তা আদৌ লজ্জা নয়; তা ঈমানের দুর্বলতা। প্রকৃত লজ্জা তো তাই, যা লোকে কী বলবে না বলবে তা উপেক্ষা করে মানুষকে শরী’আতের হুকুম মানতে উৎসাহিত করে। তাই তো আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ استَحيوا منَ اللَّهِ حقَّ الحياءِ ، قُلنا : يا رسولَ اللَّهِ إنَّا لنَستحيي والحمد لله ، قالَ : ليسَ ذاكَ ، ولَكِنَّ الاستحياءَ منَ اللَّهِ حقَّ الحياءِ أن تحفَظ الرَّأسَ ، وما وَعى ، وتحفَظَ البَطنَ ، وما حوَى ، ولتَذكرِ الموتَ والبِلى ، ومَن أرادَ الآخرةَ ترَكَ زينةَ الدُّنيا ، فمَن فَعلَ ذلِكَ فقدَ استحيا يعني : منَ اللَّهِ حقَّ الحياءِ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন বললেন, তোমরা আল্লাহকে লজ্জা করো যথার্থ লজ্জার সাথে। ইবন মাস’ঊদ রাদি. বলেন, আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর শোকর যে, আমরা লজ্জা করি। তিনি বললেন, ওই লজ্জা নয়; বরং আল্লাহ তায়ালাকে যথার্থ লজ্জা করা হল এই যে, তুমি হেফাজত করবে নিজ মাথা এবং মাথা যা চিন্তা-ভাবনা করে, নিজ উদর এবং উদর যা ধারণ করে। আর স্মরণ করবে মৃত্যু এবং মৃত্যুর পর পচে-গলে যাওয়াকে। যে ব্যক্তি আখিরাত কামনা করে সে দুনিয়ার সাজসজ্জা পরিত্যাগ করে। যে ব্যক্তি এসব করল, সে-ই আল্লাহকে যথার্থভাবে লজ্জা করল।-জামে’ তিরমিযী: ২৪৫৮; মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৭১; তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর : ৩১৯২; মুসতাদরাক হাকিম: ৭৯১৫; বাগাবী, শারহুস্-সুন্নাহ: ৪০৩৩
অর্থাৎ প্রকৃত লজ্জা এই যে, আল্লাহ তায়ালা যা পসন্দ করেন না ও ভালোবাসেন না, তা পরিত্যাগ করা হবে। যা-কিছুই করা হবে বা ত্যাগ করা হবে, তাতে কেবল তাঁরই ভয় কার্যকর থাকবে এবং কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি কামনা করা হবে। আর এজন্য প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও প্রত্যেক শক্তি-সামর্থ্যকে আল্লাহর অপসন্দনীয় সবকিছু থেকে হেফাজত করা হবে এবং তিনি যা-কিছু পসন্দ করেন কেবল তাতেই ব্যবহার করা হবে। এমনিভাবে বিশ্বাস করা হবে দুনিয়া অপেক্ষা আখিরাতই উত্তম, আখিরাতই স্থায়ী। আর সে বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও অনুরাগ-আসক্তি পরিহার করে আখিরাতের নাজাত ও মুক্তির লক্ষ্যেই যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করা হবে।
বস্তুত লজ্জা মু’মিনের শোভা। এটা কেবল নারীর নয়; নর-নারী সকলের মধ্যেই থাকা উচিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন,
مَا كَانَ الْحَيَاءُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ وَلَا كَانَ الْفُحْشُ فِي شَيْءٍ إِلَّا شَانَه.
‘যে-কোনও বস্তুতে লজ্জা থাকে, তা তাকে শোভা দান করে। আর যে বস্তুতেই নির্লজ্জতা থাকে, তা তাকে অশোভন করে তোলে। -আল-আদাবুল মুফরাদ : ৬০১; মুসনাদে আহমাদ: ১২৬৮৮; জামে তিরমিযী: ১৯৭৪
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক বর্ণনায় আছে,
وَلَوْ كَانَ الْحَيَاءُ رَجُلًا لَكَانَ رَجُلًا صَالِحًا
‘লজ্জাশীলতা যদি কোনও পুরুষ হত, তবে সে একজন সুপুরুষ হত।-বায়হাকী, শু’আবুল ঈমান: ৭৩২৬; তাবারানী, আল মু’জামুল আওসাত: ৪৭১৮
হাদীছটির শিক্ষা
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল ঈমানের অনেক শাখা আছে। ঈমানের সমস্ত আদেশ- নিষেধ মেনে চলাই হচ্ছে ঈমানের শাখা-প্রশাখা। সুতরাং পরিপূর্ণ মু’মিন হতে হলে শরী’আতের সমস্ত আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে।
খ. আরও জানা গেল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য রাস্তায় কোনও কষ্টদায়ক জিনিস চোখে পড়লে তা অবশ্যই সরিয়ে ফেলা এবং নিজে কিছুতেই রাস্তায় কোনও কষ্টদায়ক জিনিস না ফেলা।
গ. লজ্জাশীলতা যেহেতু ঈমানের অতি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, তাই মু’মিনের কর্তব্য তার সকল কাজে লজ্জাশীলতার পরিচয় দেওয়া।
ক্রমিক নং : ১৫ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّهُ سَأَلَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ أَفْضَلِ الْإِيْمَانِ. قَالَ: أَنْ تُحِبَّ للهِ وَتُبْغِضَ لِلهِ وَتَعْمَلَ لِسَانَكَ فِي ذِكْرِ الله. قَالَ: وَمَاذَا يَا رَسُوْلَ اللهِ! قَالَ: وَأَنْ تُحِبَّ لِلنَّاسِ مَا تُحِبُّ لِنَفْسِكَ وَتَكْرَهَ لَهُمْ مَا تَكْرَهُ لِنَفْسِكَ. (رَوَاهُ أَحْمَدُ) | অনুবাদ: . মুআয বিন জাবাল রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–কে সর্বোৎকৃষ্ট ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন করলে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দেন, ভালবাস তো আল্লাহর জন্য, শত্রু মনে কর তো আল্লাহর জন্য এবং তুমি তোমার জবান আল্লাহর যিকিরে রত রাখ। মুআয রাদি. বললেন, তা কি, হে আল্লাহর রাসূল? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি লোকদের জন্য তা পছন্দ করবে যা নিজের জন্য পছন্দ কর। আর তাদের জন্য তাই অপছন্দ করবে যা নিজের জন্য অপছন্দ কর।[12] |
ক্রমিক নং : ১৬ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي أُمَامَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَجُلاً سَأَلَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَا الإِيْمَانُ؟ قَالَ: إِذَا سَرَّتْكَ حَسَنَتُكَ وَسَائَتْكَ سَيِّئَتُكَ فَأَنْتَ مُؤْمِنٌ. قَالَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! مَا الإِثْمُ؟ قَالَ: إِذَا حَاكَ فِي نَفْسِكَ شَيء فَدَعْهُ. (رَوَاهُ أَحْمد) | অনুবাদ: . আবু উমামা রাদি. বলেন, একদিন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–কে জিজ্ঞাসা করল যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ঈমানের স্বরূপ কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, যখন তোমার সৎকাজ তোমাকে আনন্দ দিবে এবং অসৎকাজ তোমাকে কষ্ট দিবে তখন মনে করবে যে, তুমি খাঁটি মুমিন। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! গুনাহের কাজ কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যখন কোন কাজ করতে তোমার বিবেকে বাধবে তখন মনে করবে যে, এটাই গুনাহের কাজ এবং তা পরিত্যাগ করবে।[13] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : আলোচ্য হাদীসে একজন সাহাবি মহানবী-এর কাছে একজন খাঁটি ও বিশুদ্ধ ঈমানদারের নিদর্শন ও পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে রাসূলুল্লাহ বলেছিলেন, যখন নেক ও সৎকাজ তোমার অন্তরে আনন্দ সৃষ্টি করে, উৎসাহ উদ্দীপনার সঞ্চার করে, আর বদ ও মন্দ কাজ অন্তরে বিষণ্ণতা ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করে, তখন তুমি খাঁটি ঈমানদার হিসেবে গণ্য হবে। এর বিপরীত হলে বুঝতে হবে- তোমার ঈমানে এখনও পূর্ণতা আসেনি এবং তুমি খাঁটি ঈমানদার এখনো হতে পারনি।
ক্রমিক নং : ১৭ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ جَرِيرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ الْبَجَلِيِّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: بَايَعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى إِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيْتَاءِ الزَّكَاةِ وَالنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ. | অনুবাদ: . জারীর রাদি. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি নামায আদায়ের, যাকাত দেওয়ার এবং প্রত্যেক মুসলিমের কল্যাণ কামনার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে বায়আত করেছি।[14] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : জারীর ইব্ন আব্দুল্লাহ রাদি. তাঁর এ বর্ণনায় দু’টি বিষয় সম্পর্কে আমাদের অবগত করেছেন। একটি হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে তাঁর বাইআত গ্রহণ করা। আর দ্বিতীয় হচ্ছে সে বাই’আতের বিষয়বস্তু। তিনি জানাচ্ছেন, তিনি বাইআত গ্রহণ করেছিলেন তিনটি বিষয়ে নামায কায়েম করা, যাকাত দেওয়া এবং প্রত্যেক মুসলিমের কল্যাণ কামনা করা।
বাইআত প্রসঙ্গ
মৌলিকভাবে বাইআত তিন প্রকার।
ক. ইসলাম গ্রহণের বাইআত। অর্থাৎ কোনও অমুসলিম ব্যক্তি কর্তৃক কারও হাতে হাত রেখে এই মর্মে অঙ্গীকার করা যে, আমি কুফর ও শিরক পরিত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করলাম, এক আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে নিলাম এবং ওয়াদাবদ্ধ হলাম যে, আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে আমি সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়ে আসা দীন অনুসরণ করে চলব।
খ. নেতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের বাইআত। অর্থাৎ যে ব্যক্তিকে মুসলিম জাতির শাসকরূপে মনোনীত করা হয়েছে তার হাতে হাত রেখে জনগণকর্তৃক এ প্রতিশ্রুতিদান যে, তিনি যতদিন আল্লাহর দেওয়া শরী’আত অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করবেন, ততদিন আমরা তার অনুগত হয়ে থাকব এবং দেশ পরিচালনায় তার সাহায্য-সহযোগিতা করব।
গ. দীনের কোনও সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বাইআত গ্রহণ করা। যেমন এ হাদীছে নবী ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জারীর ইব্ন ‘আব্দুল্লাহ রাদি.-এর বাইআত। এ বাইআত হয়েছিল সুনির্দিষ্ট তিনটি বিষয়ে। এমনিভাবে হুদায়বিয়ায় সংঘটিত বাই’আতুর রিযওয়ান। তাতে সাহাবায়ে কিরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে হাত রেখে এই মর্মে বাইআত গ্রহণ করেছিলেন যে, তারা যুদ্ধ থেকে পলায়ন করবেন না। শরীরের সর্বশেষ রক্তবিন্দুও আল্লাহর পথে উৎসর্গ করবেন। এছাড়াও বিভিন্ন প্রসঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরাম থেকে বাইআত নিয়েছিলেন। তাসাওউফের প্রচলিত বাইআতও এরকমই।
সুলূক ও তাসাওউফের প্রচলিত বাইআত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণে ইসলামের শুরু যমানা থেকেই চলে এসেছে। এতে শরী’আতের যাহেরী বিধানাবলী মেনে চলার পাশাপাশি বাতেনী বিধানসমূহ তথা রিয়া, অহংকার, হাসাদ প্রভৃতি মন্দ চরিত্র বর্জন ও ইখলাস, বিনয়, রিয়া বিল-কাযা প্রভৃতি সৎগুণ অর্জনের সাধনা সম্পর্কে কোনও খাঁটি মুরশিদ ও আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির হাতে হাত রেখে অঙ্গীকার করা হয়।
আখলাক-চরিত্রের পরিশুদ্ধি ইসলামের মৌলিক শিক্ষার একটি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যেসব মৌলিক দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে, এটি তার অন্যতম। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ
– هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ “
তিনিই উম্মীদের মধ্যে তাদেরই একজনকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, যে তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হেকমতের শিক্ষা দেবে।
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
بعثت لأتمم مكارم الأخلاق
‘আমাকে পাঠানো হয়েছে উত্তম চরিত্রের পূর্ণতাবিধানের জন্য।”
‘হাদীছে জিবরীল’ নামক প্ৰসিদ্ধ হাদীছে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা পেশ করা হয়েছে। সে মৌলিক শিক্ষার একটি হচ্ছে ইহসান। তাতে ইহসানের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছেঃ
أن تعبد الله كأنك تراه، فإن لم تكن تراه فإنه يراك
‘তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে এমনভাবে, যেন তুমি তাঁকে দেখছ। আর যদি তুমি তাঁকে নাও দেখে থাক, তিনি তো তোমাকে দেখছেন অন্তরে এ ধ্যান বজায় রাখবে।এটা ইখলাসের উচ্চতর স্তর। এ স্তরের ইখলাস অর্জনের চেষ্টা সর্বপ্রকার ইবাদতে কাম্য; প্রত্যক্ষ ইবাদতেও যেমন নামায, রোযা ইত্যাদি, এবং পরোক্ষ ইবাদতেও যেমন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত মোতাবেক বিবাহ করা, সংসার-জীবন যাপন করা, ব্যবসা-বাণিজ্য করা, আত্মীয়তা রক্ষা করা, বিচার নিষ্পত্তি করা ইত্যাদি।
ইখলাসবিহীন ইবাদত আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই রিয়া, সুনাম সুখ্যাতি ও লোক দেখানোর মানসিকতা বর্জন করে ইহসান ও ইখলাসের গুণ অর্জন করা। অবশ্যকর্তব্য। এটা আখলাকের অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক; বরং বলা যায় আখলাকের সারবস্তু। ইহসান ও ইখলাস অর্জন হয়ে গেলে আখলাক-চরিত্রের অন্যান্য শাখা-প্রশাখা অর্জন সহজ হয়ে যায়। তাই সুলূক ও তাসাওউফে একে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। সে গুরুত্বের কারণে সুলূক ও তাসাওউফকে ইহসান নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।
মোটকথা, আখলাক সংশোধন করা তথা মন্দ স্বভাব পরিহার করে সৎগুণ অর্জনের চেষ্টা করা ফরয ও অবশ্যকর্তব্য। এটা শরী’আতের একটি মৌলিক অঙ্গ। ইহসান, সুলূক ও তাসাওউফ চর্চার মূল উদ্দেশ্য এটাই। এর জন্য বাইআত বিশেষভাবে ফলপ্রসূ। কোনও খাঁটি মুরশিদের হাতে বাইআত হয়ে তার সাহচর্য-সান্নিধ্যে থেকে আত্মসংশোধনের চেষ্টা যত বেশি উপকার দিয়ে থাকে, অতটা উপকার অন্য কোনও মাধ্যমে সাধারণত হাসিল হয় না। এ কারণেই যুগ যুগ যাবৎ হক্বানী ‘উলামা-মাশায়েখ এ পন্থার গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কারও যদি অন্য কোনও পন্থায় আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয়ে যায় তাতে আপত্তির কিছু নেই। উদ্দিষ্ট বস্তু হাসিল হওয়াই আসল কথা, তা যে পন্থায়ই হোক। সারকথা- আখলাক-চরিত্রের সংশোধন ফরয, বাইআত ফরয নয়। হাঁ, এটা উদ্দেশ্য হাসিলের পক্ষে বেশি সহায়ক। যুগ যুগের অভিজ্ঞতা দ্বারা তা প্রমাণিত।
নামায ও যাকাতের গুরুত্ব
জারীর রাদি.-এর বাই’আতে যে তিনটি বিষয়ের প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়েছে তার প্রথম দু’টি হচ্ছে যথাক্রমে নামায ও যাকাত। নামায মূল চার ইবাদতের মধ্যে প্রধান। শরী’আত এর এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছে যে, কোনও মুসলিম নামায না পড়লে তার যেন নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেওয়ারই অধিকার থাকে না। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
بين العبد وبين الكفر ترك الصلاة
‘বান্দা ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য হল নামায ত্যাগ।
অর্থাৎ মু’মিন ব্যক্তি নামায পড়ে আর যে ব্যক্তি কুফরীতে লিপ্ত সে নামায পড়ে না। নামাযের পরপরই সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যাকাত। কুরআন মাজীদে যত আয়াতে নামাযের হুকুম দেওয়া হয়েছে, তার অধিকাংশেই নামাযের পাশাপাশি যাকাতেরও আদেশ করা হয়েছে। নেসাব পরিমাণ মাল থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি যাকাত দেয় না, বে নামাযীর মতই তারও যেন নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেওয়ার অধিকার থাকে না। কুরআন-হাদীছে যাকাত অনাদায়ী ব্যক্তি সম্পর্কে নামায তরককারীর মতই কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে। আবূ বকর সিদ্দীক রাদি. নিজ খেলাফতকালে যাকাত আদায়ে গড়িমসিকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ইসলামে যাকাত কত গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এ গুরুত্বের কারণেই এ হাদীছে এ বিধানদু’টি পালন সম্পর্কে বাইআত নেওয়া হয়েছে।
নসীহত ও কল্যাণকামনা সম্পর্কে বাইআত
এ হাদীছে বর্ণিত বাই’আতের তৃতীয় বিষয় হল প্রত্যেক মুসলিমের জন্য নসীহত ও কল্যাণকামনা। বাইআতগ্রহণ দ্বারা এর গুরুত্ব ফুটে ওঠে। দুনিয়ার সমস্ত মুসলিম পরস্পর ভাই-ভাই। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য তার মুসলিম ভাইয়ের কল্যাণ কামনা করা। জারীর ইব্ন আব্দুল্লাহ রাদি, জীবনভর এ বাইআত রক্ষা করেছেন এবং মুসলিম-সাধারণের প্রতি কল্যাণকামী হয়ে থেকেছেন। তাঁর সে কল্যাণকামিতার একটি ঘটনা এরকম যে, একবার তিনি এক ব্যক্তির নিকট থেকে ২০০ দিরহামের বিনিময়ে একটি ঘোড়া কিনেছিলেন। ঘোড়াটি নিয়ে বাড়ি যাওয়ার পর তাঁর মনে হল। এটির দাম আরও বেশি হওয়ার কথা। এ মনে হতেই তিনি ঘোড়াটি নিয়ে বিক্রেতার কাছে ফিরে গেলেন এবং তাকে বললেন, তোমার ঘোড়াটির দাম আরও বেশি হয়। এই বলে তিনি তাকে আরও বেশি দাম দিলেন। তারপর ফিরে এসে ঘোড়াটি ব্যবহার করার পর তাঁর কাছে আবার মনে হল এর দাম আরও বেশি হয়। সুতরাং তিনি আবারও বিক্রেতার কাছে চলে গেলেন এবং তাকে বললেন, তোমার ঘোড়াটির দাম আরও বেশি হয়। সেমতে তিনি তাকে আরও বেশি দাম দিলেন। এভাবে তিনি তার কাছে তিনবার আসা-যাওয়া করলেন এবং দাম বাড়াতে থাকলেন। এ করে তা ৮০০ দিরহামে পৌঁছল।
আল্লাহু আকবার! কী গভীর কল্যাণকামিতা! এঁরাই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবি। উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ জামাত।
কল্যাণকামনার একটা অংশ উপদেশ দানও। এটা ‘ফরযে কিফায়াহ’ স্তরের একটি বিধান। প্রত্যেক এলাকায় একদল লোক যদি এটা পালন করে এবং তাতে সেই এলাকার প্রয়োজন সমাধা হয়, তবে সকলের পক্ষ থেকেই দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু প্রয়োজন পরিমাণে তা না হলে দায়িত্ব আদায় হবে না এবং সে কারণে সকলেই গুনাহগার হবে। তবে এর জন্য শর্ত হল উপদেশদাতার একথা জানা থাকা যে, তার উপদেশ গ্রহণ করা হবে এবং এ দায়িত্ব পালন করতে গেলে তাকে জুলুম-নিপীড়নের শিকার হতে হবে না। সেরকম আশঙ্কা থাকলে নসীহত করা জরুরি থাকে না। অবশ্য সে ক্ষেত্রেও যদি কেউ হিম্মতের পরিচয় দেয় এবং জুলুম-নিপীড়নের মুখেও এ দায়িত্ব পালন থেকে পিছপা না হয়, তবে তার সে আমল উচ্চতর জিহাদরূপে গণ্য হবে এবং এজন্য সে আল্লাহ তায়ালার কাছে অশেষ পুরস্কার লাভ করবে।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. নামায ও যাকাত ঈমানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। সুতরাং সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গেই তা পালন করা চাই।
খ. নসীহত ও কল্যাণকামিতা দীনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এতে অবহেলার কোনও সুযোগ নেই।
গ. সুলূক ও তাসাওউফের বাইআত ভিত্তিহীন কোনও কাজ নয়; বরং একটি সুন্নত আমল। আত্মশুদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে এ সুন্নতের ওপর আমল করা চাই।
ক্রমিক নং : ১৮ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: الدِّينُ النَّصِيْحَةُ ثَلَاثَ مِرَارٍ. قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ! لِمَنْ؟ قَالَ: لِلهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُوْلِهِ وَلِأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَعَامَّتِهِمْ. (رَوَاهُ مُسْلِمٌ) | অনুবাদ: . আবু হুরায়রা রাদি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার বলেছেন, দীন হলো কল্যাণকামিতা। লোকগণ জিজ্ঞাসা করলেনঃ কার জন্য, ইয়া রাসূলাল্লাহ? তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের এবং তাঁর রাসূলের ও মুসলমানের ইমামদের এবং মুসলিম সাধারণের জন্য।[15] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছটি ইসলামের একটি মৌলিক শিক্ষামূলক হাদীছ। বলা হয়েছে দীন তো কল্যাণকামনাই। অর্থাৎ দীনের স্তম্ভ ও সারনির্যাস হচ্ছে কল্যাণকামনা। অত্যধিক গুরুত্বের কারণে দীনকে কল্যাণকামিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেমন এক হাদীছে বলা হয়েছে (الحج عرفة) ‘হজ্জ তো আরাফায় অবস্থানই’। তার মানে আরাফায় অবস্থানই সম্পূর্ণ হজ্জ নয়; বরং আরাফায় অবস্থান করা হজ্জের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তদ্রূপ এ হাদীছেও এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, সম্পূর্ণ দীন বাস কল্যাণকামনাই, এর বাইরে আর কিছু নেই। এর বাইরে দীনের আরও অনেক কিছুই আছে। তবে হাঁ, নসীহত ও কল্যাণকামনা দীনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সে গুরুত্বের প্রতি লক্ষ করেই বলা হয়ে থাকে, এ হাদীছের মধ্যে দীনের এক- চতুর্থাংশ শিক্ষা বিদ্যমান। ইমাম নববী রহ. বলেন, বরং এই একটি হাদীছই সমগ্র দীনের শিক্ষার সারমর্ম। তাঁর এ কথা যথার্থ। কেননা সমগ্র দীন মূলত আল্লাহ ও বান্দার হক আদায়ের সমষ্টির নাম। কল্যাণকামনা দ্বারা মূলত হক আদায়ের কথা বোঝানো উদ্দেশ্য। সে হিসেবে এ হাদীছে আল্লাহ তায়ালার হক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হক, মুসলিম জাতির ইমামদের হক এবং আমজনগণের হক আদায়ের তাকিদ করা হয়েছে। এঁদের সকলের হকের শিক্ষা রয়েছে আল্লাহর কিতাবে। এ হাদীছে আল্লাহ তায়ালার কিতাবের হক আদায়ের কথাও আছে। এভাবে দীনের যাবতীয় বিধি- বিধান পালনের নির্দেশ এ হাদীছের মধ্যে এসে গেছে। সুতরাং এটি সমগ্র দীনের শিক্ষার সারমর্মই বটে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বললেন, দীন তো কল্যাণকামিতাই, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এর দ্বারা কার প্রতি কল্যাণকামিতা বোঝানো উদ্দেশ্য? এটা স্পষ্টভাবে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় এর যথার্থ প্রয়োগ সম্ভব নয়। তাই উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, কার প্রতি কল্যাণকামনা? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে পাঁচ প্রকার কল্যাণকামনার কথা উল্লেখ করলেন। নিচে সে পাঁচ প্রকার কল্যাণকামনার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া গেল।
১. আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামিতা
সর্বপ্রথম বলা হয়েছে আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামনার কথা। আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামনা মানে আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করা অর্থাৎ তাঁর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্বে বিশ্বাস করা, কোনওকিছুকে তাঁর সঙ্গে শরীক না করা, তাঁর সিফাত ও গুণবাচক নামসমূহে বিশ্বাস রাখা এবং তা অস্বীকার ও তার ভুল ব্যাখ্যা হতে বিরত থাকা। যাবতীয় উৎকৃষ্ট গুণে তাঁর পরিপূর্ণতা এবং সর্বপ্রকার দোষত্রুটি থেকে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করা।
এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালার প্রতি কল্যাণকামিতা হচ্ছে প্রকাশ্যে ও আন্তরিকভাবে তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা ও তাঁর অবাধ্যতা হতে বিরত থাকা, তাঁর জন্যই কাউকে ভালোবাসা ও তাঁর জন্যই কারও প্রতি শত্রুতা পোষণ করা, তাঁর বন্ধুকে বন্ধু জানা ও তাঁর শত্রুকে শত্রু গণ্য করা, তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে কার্যত জিহাদ করা বা জিহাদের নিয়ত রাখা, তাঁর যাবতীয় অনুগ্রহ স্বীকার করা ও নি’আমতসমূহের শোকর আদায় করা, তাঁর ইবাদত-বন্দেগীতে অন্তরে ইখলাস বজায় রাখা, তাঁর আদেশসমূহ পালনের ক্ষেত্রে তাঁর ঘোষিত পুরস্কারের আশা রাখা, তাঁর অবাধ্যতার ক্ষেত্রে তাঁর শান্তির ভয় রাখা।
এ যা-কিছু বলা হল, এর প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেওয়া, মানুষকে এর প্রতি উৎসাহী করে তোলার ব্যবস্থা নেওয়া, তাদেরকে এর শিক্ষাদান করা এবং এ লক্ষ্যে তাদের প্রতি নম্র-কোমল ব্যবহার করাও আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামিতার অন্তর্ভুক্ত।
আলী রাদি. থেকে বর্ণিত আছে যে, ঈসা আলাইহিস সালামের শিষ্যগণ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামী কে? তিনি বলেছিলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর হককে মানুষের হকের ওপর প্রাধান্য দেয়।
প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ তায়ালা কারও প্রতি ঠেকা নন। তিনি সর্বপ্রকার অভাব ও কমতি থেকে মুক্ত-পবিত্র। সুতরাং তাঁর প্রতি প্রকৃত অর্থে কারও কল্যাণকামনার প্রশ্নই আসে না। তাঁর প্রতি কল্যাণকামনা হিসেবে যে কাজগুলোর কথা উল্লেখ করা হল, তার সুফল মূলত বান্দা নিজেই লাভ করে। সে হিসেবে কল্যাণকামনা আল্লাহর প্রতি নয়; বরং বান্দার নিজের প্রতি। তা সত্ত্বেও হাদীছে যে একে “আল্লাহর কল্যাণকামনা’ শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে, এটা বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। হাদীছের কথা মূলত আল্লাহরই কথা। সুতরাং বান্দার প্রতি মহব্বত ও অনুগ্রহবশত আল্লাহ তায়ালা বান্দার নিজের প্রতি নিজ কল্যাণকামনাকে আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামনা বলে অভিহিত করেছেন। সুবহানাল্লাহ! তিনি কতই না মহানুভব এবং কত উচ্চ তাঁর গুণগ্রাহিতা। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে কুরআন মাজীদের এ আয়াত-
ولَيَنْصُرَنَّ الله مَنْ يَنصُرُهُ
আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তার সাহায্য করবেন, যে তাঁর সাহায্য করবে।সুরা হজ্জ (২২), আয়াত ৪০
এ মর্মে আরও একাধিক আয়াত আছে, যাতে আল্লাহর দীনের সাহায্য করাকে আল্লাহর সাহায্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। দীন মানুষেরই জন্য। কাজেই দীনের সাহায্য করার দ্বারা প্রকৃতপক্ষে নিজেরই সাহায্য করা হয়। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা আপন অনুগ্রহে বান্দার কাজের মর্যাদা দানের লক্ষ্যে সে সাহায্যকে আল্লাহর সাহায্য বলে প্রকাশ করেছেন।
২. আল্লাহর কিতাবের প্রতি কল্যাণকামিতা
আল্লাহর কিতাবের প্রতি কল্যাণকামিতার অর্থ প্রথমত এর প্রতি ঈমান আনা যে, এটা আল্লাহর কিতাব ও তাঁর বাণী। তিনিই এ কিতাব নাজিল করেছেন। এটা কোনও মানুষের কথা নয়। কোনও মানুষের পক্ষে এরকম কথা বলা সম্ভব নয়। দুনিয়ার সমস্ত মানুষ মিলেও যদি চেষ্টা করে, তবে এর ছোট্ট একটি সুরার মত সুরাও বানাতে পারবে না। তারপর অন্তরে এ কিতাবের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা লালন করা, এর শিক্ষা গ্রহণ করা ও শিক্ষা দান করা, এর তিলাওয়াত করা ও অর্থ বোঝার চেষ্টা করা এবং এর মধ্যে তাদাব্বুর ও চিন্তাভাবনা করে আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এর অন্তহীন জ্ঞানরাশি থেকে যতদূর সম্ভব আহরণে যত্নবান থাকা। তারপর এর উপদেশ গ্রহণ করা ও এর শিক্ষা অনুযায়ী আমল করা। তারপর এর প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখা, ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনে এর বিধানাবলী বাস্তবায়নের চেষ্টা করা এবং সর্বপ্রকার অপব্যাখ্যা থেকে তার হেফাজত করা।
৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কল্যাণকামিতা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কল্যাণকামিতার অর্থ প্রথমত তাঁর প্রতি এ বিশ্বাস রাখা যে, তিনি আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবী। কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের হিদায়াতের জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছে। তারপর যথার্থ ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা, তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা, আল্লাহ তায়ালার মহব্বত ও ভালোবাসা পাওয়ার লক্ষ্যে তাঁর পরিপূর্ণ অনুসরণ করা, তাঁর জীবদ্দশায় এবং তাঁর ওফাতের পর তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাঁর সুন্নত ও জীবনাদর্শ শেখা ও শিক্ষাদান করা, তাঁর রেখে যাওয়া দীনের প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেওয়া এবং সর্বত্র তার প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা।
এমনিভাবে নবীর আহলে বাইত ও সাহাবায়ে কিরামকে ভালোবাসা, যে-কোনও সাহাবির নিন্দা ও সমালোচনা থেকে বিরত থাকা; বরং তাদের নিন্দাকারী এবং বিদআত ও বিদআতপন্থীদের প্রতি ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা পোষণ করা এ কল্যাণকামিতার অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কল্যাণকামিতার একটা অংশ এইও যে, তাঁর ওয়ারিশ তথা উলামায়ে কিরামের প্রতি মহব্বত রাখা হবে, তাদের কাছ থেকে দীনের শিক্ষা গ্রহণ করা হবে, দীনের বহুমুখী খেদমতে ঐকান্তিকভাবে তাদের সহযোগিতা করা হবে এবং দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তাদের দিকনির্দেশনা গ্রহণ করা হবে।
4. মুসলিম নেতৃবর্গের প্রতি কল্যাণকামিতা
এ হাদীছে মুসলিমদের ইমাম বলতে তাদের নেতৃবর্গকে বোঝানো হয়েছে। তাদের প্রতি কল্যাণকামিতার অর্থ তাদের প্রতি অর্পিত দায়-দায়িত্ব যাতে তারা যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে পারে সে ব্যাপারে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদের দ্বারা কোনও ভুলত্রুটি হয়ে গেলে সে ব্যাপারে তাদের সতর্ক করা, তাদের নেতৃত্বে সকলের ঐক্যবদ্ধ থাকা, তাদের বিরুদ্ধাচারীদেরকে তাদের প্রতি অনুগত করে তোলার চেষ্টা করা এবং উত্তম পন্থায় তাদেরকে জনগণের প্রতি জুলুম-অত্যাচার করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা।
ইমাম ও নেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা; বরং তার বিরুদ্ধে কোথাও বিদ্রোহ হলে যদি তা দমনের জন্য ডাক দেওয়া হয়, তবে তাতে সাড়া দেওয়াও তাদের কল্যাণকামিতার অন্তর্ভুক্ত। সক্ষম ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। কেননা যে কাজে আল্লাহর নাফরমানী হয় না এবং তা জনগণের স্বার্থবিরোধী ও শাসকের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে না হয়, সে কাজে ইমামের আনুগত্য করা ফরয।
5. আমজনগণের প্রতি কল্যাণকামিতা
আমজনগণের প্রতি কল্যাণকামিতার অর্থ তাদের প্রতি মমত্ব প্রদর্শন করা, তাদেরকে কল্যাণকর বিষয় শেখানো, দীন ও দুনিয়ার উপকারী বিষয়ে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদেরকে কষ্টদান থেকে বিরত থাকা, তাদের জান-মাল ও ইজ্জতের কোনও প্রকার ক্ষতিসাধন না করা, বরং তার হেফাজতে ভূমিকা রাখা। মোটকথা, তাদের দীনী ও দুনিয়াবী সর্বপ্রকার হক আদায়ে যত্নবান থাকা, কোনওভাবেই তাদের কোনও অধিকার ক্ষুণ্ণ না করা এবং নিজের জন্য যা পসন্দ করা হয় তাদের জন্যও তা পসন্দ করা আর নিজের জন্য যা অপসন্দ করা হয় তাদের জন্যও তা অপসন্দ করা।
আমীর ও শাসক এবং আমজনগণের কল্যাণকামিতার একটা অংশ হচ্ছে তাদেরকে সদুপদেশ দেওয়া। তাদের দ্বারা আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায়ে গড়িমসি হলে কিংবা তাদেরকে কোনও অন্যায়-অসৎকর্মে লিপ্ত দেখতে পেলে তখন ইখলাস ও আন্তরিকতার সঙ্গে তাদেরকে সদুপদেশ দেওয়া ও সংশোধনের চেষ্টা করাই তাদের প্রতি শ্রেষ্ঠতম কল্যাণকামিতা। এ ক্ষেত্রে উপদেশদান ও সংশোধন চেষ্টার রীতিনীতি রক্ষা করাও জরুরি, অন্যথায় উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবন হাজার আসকালানী রহ.-এর বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন,
“আদেশ-উপদেশ দেওয়ার উদ্দেশ্য যদি থাকে তার প্রতি কল্যাণকামনা আর সে লক্ষ্যেই তার অবস্থা (তার দোষত্রুটি) তুলে ধরা হয়, তবেই সে আদেশ-উপদেশ জায়েয। পক্ষান্তরে যদি উদ্দেশ্য হয় কেবলই তার নিন্দা করা, তার দোষ প্রকাশ করা ও তাকে কষ্ট দেওয়া, তবে তা জায়েয হবে না। কেননা শরী’আতের পক্ষ থেকে আদেশ হচ্ছে অপরাধীর দোষ গোপন করা, তাকে শিক্ষাদান করা ও উত্তম পন্থায় তাকে নসীহত করা। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত নম্র-কোমলতার দ্বারা এটা সম্ভব, ততক্ষণ পর্যন্ত তার প্রতি কঠোর আচরণ ও নিন্দা-ধিক্কারের পন্থা অবলম্বন জায়েয নয়। কেননা তা অনেক সময় তাকে আরও বেশি অন্যায়-অপরাধের প্রতি উস্কানি দেওয়ার এবং তার আপন কাজে জেদী হয়ে ওঠার কারণ হয়। কিছু মানুষ স্বভাবগতভাবেই আত্মাভিমানী হয়ে থাকে। বিশেষত যাকে আদেশ-উপদেশ দেওয়া হয়, আদেশদাতা যদি মর্যাদায় তার তুলনায় নিচে হয় (তখন নিন্দা-তিরস্কারে তার আত্মাভিমান জেগে ওঠে, ফলে সে তার কৃত অন্যায়-অপরাধে আরও জেদী হয়ে ওঠে)। ফাতহুল বারী, ১০ম খণ্ড, ৫৭২ নং পৃষ্ঠা।
আদেশ-উপদেশদাতার নিজ আমলেরও তদারকি করা উচিত। কেননা সে যদি মুত্তাকী-পরহেযগার হয় এবং তার আখলাক-চরিত্র উন্নত হয়, তখন তার মুখের কথা অপেক্ষা তার কর্ম ও চরিত্র দ্বারাই মানুষ আত্মসংশোধনে বেশি উৎসাহ পায় এবং তার বয়ান-বক্তব্য অপেক্ষা তার আমল-আখলাক দ্বারাই মানুষের উপকার বেশি হয়।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. এ হাদীছ দ্বারা ইসলামে কল্যাণকামিতার গুরুত্ব কত বেশি তা উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের জন্য এ গুণের অধিকারী হওয়া অবশ্যকর্তব্য।
খ. এই হাদীছ দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, কুরআন ও হাদীছের কোনও বিষয় ভালোভাবে বুঝে না আসলে যার তা ভালোভাবে জানা আছে তার কাছ থেকে জেনে নেওয়া চাই।
গ. আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আনুগত্য প্রকাশের পাশাপাশি আল্লাহর কিতাবের হকসমূহ জেনে নিয়ে তা আদায়ে সচেষ্ট থাকা উচিত।
ঘ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদব ও হকসমূহ ভালোভাবে জানা ও তা আদায় করাও প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্যকর্তব্য।
ঙ. মুসলিম জাতির যারা নেতা হবে তাদের নিজেদের যেমন আপন দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত, তেমনি আমজনগণেরও কর্তব্য তাদের প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করা।
চ. মুসলিম-সাধারণের প্রত্যেকের উচিত অন্যের প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করা। তাদের মধ্যে শরী’আতপ্রদত্ত পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য আছে। সেসব দায়িত্ব- কর্তব্য পালন করাও দীনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
ক্রমিক নং : ১৯ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ. (رَوَاهُ مَالك وَأحمد) | অনুবাদ: . আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ব্যক্তির ইসলামের একটি সৌন্দর্য হল যা–কিছু অনর্থক তা পরিহার করা।[16] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এটি একটি অত্যন্ত মূল্যবান হাদীছ। দীনী আদব-কায়দা ও চালচলন সম্পর্কে এর দ্বারা একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ এটিকে ইসলামি শিক্ষার এক-চতুর্থাংশ এবং কেউ অর্ধাংশ সাব্যস্ত করেছেন। কেউ তো বলেন, সম্পূর্ণ দীনই এর মধ্যে এসে গেছে।
হাদীছটির অর্থ হচ্ছে- যার ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে, সে অনর্থক সকল কথা ও সকল কাজ পরিহার করে চলে। অনর্থক মানে অপ্রয়োজনীয়। অর্থাৎ যা দুনিয়া এবং আখিরাতে কোনও কাজে লাগে না। কোনও উপকারে আসে না। যা কোনও উপকারে আসে না, তা অবশ্যই ক্ষতিকর। এরকম কাজ হয়তো হারাম হবে, নয়তো মাকরূহ হবে, নয়তো সন্দেহযুক্ত। এসবই অহেতুক তো বটেই, সেইসংগে সরাসরি পাপকর্মও। আর কিছু না হোক অন্তত পক্ষে পাপকর্মের দিকে টেনে তো নেয়ই।
কিছু ফজুল কাজ এমন আছে, যে সম্পর্কে মনে করা হয় তাতে ছওয়াব ও পাপ কিছুই নেই, যেমন ফালতু গল্পগুজব করা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এতে কোনও ক্ষতি নেই। প্রকৃতপক্ষে এটাও ক্ষতিকর। কেননা আর কিছু না হোক, অন্তত সময় তো নষ্ট হয় তাতে। সময় মানুষের অমূল্য সম্পদ। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা জিজ্ঞেস করবেন, তোমার আয়ু কী কাজে ব্যয় করেছ? আয়ু তো সময়ই। তো যে বিষয়ে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে, তা অহেতুক নষ্ট করার অবকাশ কোথায়? টাকা-পয়সা অপচয় করা যদি নাজায়েয হয়, তবে সময়ের অপচয় কী করে বৈধ হয়? তাছাড়া সময় জীবনের পুঁজি। পুঁজি খরচে
একজন সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ
মুসলিমের কর্তব্য অপ্রয়োজনীয় সবকিছু থেকে বিরত থাকা।
কোনটা প্রয়োজনীয় এবং কোনটা অপ্রয়োজনীয়, তা কিভাবে বোঝা যাবে? বোঝা খুব সহজ। মানুষের যাবতীয় কথা ও কাজের সম্পর্ক হয়তো পার্থিব জীবনের সংগে হবে, নয়তো আখিরাতের সাথে। যখনই কোনও কথা বলা হয় বা কোনও কাজ করা হয়, দেখতে হবে এটা না করলে পার্থিব জীবনের বা পরকালীন জীবনের কোনও ক্ষতি আছে কি না। যদি দেখা যায় ক্ষতি নেই, তবে মনে করতে হবে সেটাই ফযুল ও অপ্রয়োজনীয়।
ইমাম গাযালী রহ. বলেন, যে কথা না বলে চুপ থাকলে কোনও গুনাহ হয় না এবং দুনিয়া ও আখিরাতের কোনও ক্ষতি হয় না, সেটাই অহেতুক কথা। এতে লিপ্ত হওয়া মানে সময় নষ্ট করা। এরূপ কথা বলা মানে জবানের অপব্যবহার করা। এর পরিবর্তে যদি যিক্র বা দু’আ করা হয়, তবে প্রভূত ছওয়াব ও কল্যাণ অর্জিত হবে।
যে ব্যক্তি দীনী ও দুনিয়াবী উভয় ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় সবকিছু পরিহার করবে, তার জীবন সৌন্দর্যমণ্ডিত হবে এবং সকল অশান্তি ও অনিষ্ট থেকে বেঁচে যাবে। তার সময় মাটি হবে না, অর্থের অপচয় হবে না, কারও সংগে ঝগড়া-বিবাদ দেখা দেবে না, সময় ও সম্পদে বরকত হবে এবং জ্ঞান, কর্ম, শান্তি ও সমৃদ্ধিতে জীবন পরিপূর্ণতা লাভ করবে।
অহেতুকতা পরিহারের উপায়
দীন ও দুনিয়া সংক্রান্ত অপ্রয়োজনীয় সবকিছু পরিহার করা সম্ভব মুরাকাবার মাধ্যমে। মুরাকাবা দ্বারা অন্তরে লজ্জা জাগ্রত হয়। অর্থাৎ যদি চিন্তা করা হয় আমি আল্লাহর দৃষ্টির সামনে আছি, তিনি আমার সব কাজ দেখছেন ও সব কথা শুনছেন, তখন অপ্রয়োজনীয় কাজ করতে লজ্জাবোধ হবে এবং লজ্জা লাগবে অর্থহীন কথা বলতেও। উদাহরণত, কেউ যখন মুরুব্বীস্থানীয় কারও সামনে থাকে, তখন যে-কোনও ফালতু কথা ও ফালতু কাজ করতে লজ্জাবোধ হয়। মুরাকাবার বিষয়টাও এরকমই। আল্লাহর সামনে আছি এ কথা চিন্তা করলে যে-কোনও অঙ্গেরই অন্যায় ব্যবহার করতে লজ্জাবোধ হবে। বিশেষত যখন জানা আছে, তাঁর ফিরিশতাগণ সবকিছু লিখে রাখছেন এবং আখিরাতে এসবের জবাবদিহিতাও আছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে,
ما يلفظ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ
অর্থ : মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত আছে, (যে লেখার জন্য) সদা প্রস্তুত।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
أَمْ يَحْسَبُونَ أَنَّا لَا تَسْمَعُ سِرَّهُمْ وَلَجُوبُهُمْ بَلَى وَرُسُلُنَا لَدَيْهِمْ يَكْتُبُونَ
অর্থ : তারা কি মনে করছে আমি তাদের গোপন কথাবার্তা ও তাদের কানাকানি শুনতে পাই না? অবশ্যই পাই। তাছাড়া আমার ফেরেশতাগণ তাদের কাছেই রয়েছে, যারা সবকিছু লিপিবদ্ধ করছে।
আরও ইরশাদ-
وَمَا تَكُونُ في شَأْنٍ : مَا تَتْلُوا مِنْهُ مِن قَزانٍ وَلَا تَعْمَلُونَ مِنْ عَمَلٍ إِلَّا كُنَّا عَلَيْكُمْ شُهُودًا إِذْ تُفِيضُونَ فِيهِ وَمَا يَعْرُبُ عَنْ رَّبِّكَ مِن مِثْقَالِ رَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَلَا أَصْغَرَ مِنْ ذلِكَ وَلَا البر إلا في كتب مبين
অর্থ : হে নবী! তুমি যে-অবস্থায়ই থাক এবং কুরআনের যে-অংশই তিলাওয়াত কর এবং হে মানুষ! তোমরা যে কাজই কর, তোমরা যখন তাতে লিপ্ত থাক, তখন আমি তোমাদের দেখতে থাকি। তোমার প্রতিপালকের কাছে অণু পরিমাণ জিনিসও গোপন থাকে না- না পৃথিবীতে, না আকাশে এবং তার চেয়ে ছোট এবং তার চেয়ে বড় এমন কিছু নেই, যা এক স্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই।
প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় যা-কিছুই বলা হয় ও যা-কিছুই করা হয়, লিপিবদ্ধ হয়ে যায় সবকিছুই। কিয়ামতের দিন তা সবই সামনে তুলে ধরা হবে। তখন কী অবস্থা হবে? ইরশাদ হয়েছে,
و وضع الكتب فترى المُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يُوَيْتَنَا مَالٍ هَذَا الْكِتَبِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَ لَا لَبِيْدَةُ إِلَّا أَحْضُهَا وَوَجَدُوا مَا عَبِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًان
অর্থ : আর ‘আমলনামা’ সামনে রেখে দেওয়া হবে। তখন তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে, তাতে যা লেখা আছে, তার কারণে তারা আতঙ্কিত এবং তারা বলছে, হায় আমাদের দুর্ভোগ! এটা কেমন কিতাব, যা আমাদের ছোট-বড় যত কর্ম আছে, সবই পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে রেখেছে, তারা তাদের সমস্ত কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। তোমার প্রতিপালক কারও প্রতি কোনও জুলুম করবেন না।
উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. বলেন, যে ব্যক্তি তার কথাকে তার কাজ বলে গণ্য করে, তার কথা বলা অবশ্যই কমে যাবে। সে কেবল প্রয়োজনীয় কথাই বলবে। আমরা সাধারণত অহেতুক কথাকে গুরুত্ব দেই না। অথচ অহেতুক কথা দীন- দুনিয়ার অশেষ ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।
সাহল তুসতারী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি অহেতুক কথা বলে, সে সততা থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়।
মা’রুফ কারখী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি অহেতুক কথায় লিপ্ত হয়, সে আল্লাহর তাওফীক থেকে বঞ্চিত হয়।
লুকমান হাকীম রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি না অমুক গোত্রের একজন দাস ছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করা হল, আপনি না অমুক পাহাড়ের পাদদেশে ছাগল চরাতেন? উত্তর দিলেন, তাই করতাম। তারপর জিজ্ঞেস করা হল, আপনি বর্তমান মর্যাদায় পৌঁছলেন কী করে? তিনি বললেন, সত্য কথা বলা এবং অপ্রয়োজনীয় কথা হতে বিরত থাকার দ্বারা।
জনৈক সাহাবির মৃত্যু হলে এক ব্যক্তি বলেছিল, জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, তুমি কী করে জান? হয়তো সে কোনও অহেতুক কথা বলেছিল কিংবা অপ্রয়োজনে কৃপণতা করেছিল।
সারকথা, অহেতুক কথা বলা ও অহেতুক কাজ করার দ্বারা দীন-দুনিয়ার অশেষ ক্ষতি হয়ে যায়। এর থেকে বিরত থাকতে পারলে জীবন হয় সৌন্দর্যমণ্ডিত। তাতে দুনিয়ার জীবনও শান্তিময় হয় এবং তা আখিরাতের সাফল্য অর্জনেও সহায়ক হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
অহেতুক যত পড়াশোনা
প্রকাশ থাকে যে, কোনও কোনও কথা ও কাজ যেমন অহেতুক হয়ে থাকে, তেমনি কোনও কোনও শিক্ষাও এমন আছে, যার দীনী ও দুনিয়াবী কোনও ফায়দা নেই। অনেক শিক্ষা এমন আছে, যা দ্বারা কেবল অর্থ উপার্জনই হয় আর সেদিকে লক্ষ করে মানুষ সে শিক্ষাকে লাভজনক মনে করে, কিন্তু তা দ্বারা মানুষের ব্যক্তিচরিত্র এবং পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি-শৃংখলার যে ক্ষতি সাধিত হয়, সেদিকে লক্ষ করলে এরূপ শিক্ষাকে কিছুতেই উপকারী মনে করা যায় না। এরূপ শিক্ষা কেবল ফযুলই নয়, সরাসরি ক্ষতিকরও। তা থেকে বিরত থাকা জরুরি, যেমন নাচ-গান শিক্ষা, বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার শিক্ষা, জাদু শিক্ষা ইত্যাদি।
অনুরূপ অধিকাংশ লোকের জন্য নভেল-নাটক ও গল্প-উপন্যাসের বই পাঠ একটি ফযুল ও ক্ষতিকর কাজ। এর দ্বারা সময় তো নষ্ট হয়ই, ক্ষেত্রবিশেষে চরিত্রেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। বর্তমানকালে মোবাইল ফোনের যত্রতত্র যথেচ্ছা ব্যবহার একটি মারাত্মক ফযুল কাজ। এর দ্বারা ব্যক্তিচরিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইদানীং অনৈতিকতা ও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ মুঠোফোনের অসংযত ব্যবহার। আজ এর কারণে পারিবারিক শান্তি-শৃংখলা ধ্বংস হচ্ছে এবং সমাজে পাপ-পঙ্কিলতার ক্রমবিস্তার ঘটছে। সুতরাং আধুনিক এ যন্ত্রটির ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
হাদিসের শিক্ষা
ক. এ হাদীছ আমাদেরকে সবরকম অপ্রয়োজনীয় কথা ও অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বেঁচে থাকার শিক্ষা দান করে।
খ. নিজের দ্বারা অহেতুক কথা ও অহেতুক কাজ হতে দেখলে মনে করতে হবে ইসলামের অনুসরণে ত্রুটি রয়ে গেছে। ফলে নিজের ভেতর এখনও পর্যন্ত ইসলামি সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটতে পারেনি।
গ. অহেতুক সবকিছু পরিহারের পক্ষে এই ধ্যান সহায়ক যে, সবই আল্লাহ দেখছেন, সবকিছু আমলনামায় লেখা হচ্ছে। হাশরের ময়দানে সব সামনে তুলে ধরা হবে এবং এর জন্য আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে।
وَالْيَوْمِ الْآخِرِ |
আখেরাত দিবস |
ক্রমিক নং : ২০-২৩ | ||
আরবি | বাংলা | |
هُوَ يَوْمُ الدِّيْنِ.
قَالَ اللهُ تَعَالٰى: ﴿وَمَا أَدْرَاكَ مَا يَوْمُ الدِّينِ ثُمَّ مَا أَدْرَاكَ مَا يَوْمُ الدِّينِ يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِنَفْسٍ شَيْئًا وَالْأَمْرُ يَوْمَئِذٍ لِلَّهِ ﴾ [الانفطار: 17-19] |
অনুবাদ: 20 . তুমি কি জান কর্মফল দিবস কী? আবারও, তুমি কি জান কর্মফল দিবস কী? তা সেই দিন, যে দিন কেউ কারও জন্য কিছু করার সামর্থ্য রাখবে না এবং সে দিন কেবল আল্লাহরই কর্তৃত্ব চলবে। [সুরা আল-ইন্ফিতার : (৮২) :17-19] | |
قَالَ اللهُ تَعَالَى : ﴿وَالْوَزْنُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (8) وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ بِمَا كَانُوا بِآيَاتِنَا يَظْلِمُونَ﴾ [الأعراف: 8-9] | অনুবাদ : 21. এবং সে দিন (আমলসমূহের) ওজন (করার বিষয়টি) একটি অকাট্য সত্য। সুতরাং যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই হবে কৃতকার্য। আর যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই তো সেই সব লোক, যারা আমার আয়াতসমূহের ব্যাপারে সীমালংঘন করে নিজেদেরকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। [সুরা আল-আরাফ : (০৭) : 8-9] | |
قَالَ اللهُ تَعَالَى : ﴿وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا وَكَفَى بِنَا حَاسِبِينَ ﴾ [الأنبياء : 47] | অনুবাদ : 22. কিয়ামতের দিন আমি ন্যায়ানুগ তুলাদণ্ড স্থাপন করব। ফলে কারও প্রতি কোন জুলুম করা হবে না। যদি কোন কর্ম তিল পরিমাণও হয়, তবে তাও আমি উপস্থিত করব। হিসাব গ্রহণের জন্য আমিই যথেষ্ট। [সুরা আল-আম্বিয়া : (২১) : 47] | |
قَالَ اللهُ تَعَالَى : ﴿فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ فَلَا أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءَلُونَ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ تَلْفَحُ وُجُوهَهُمُ النَّارُ وَهُمْ فِيهَا كَالِحُونَ ﴾ [المؤمنون : 101-104] | অনুবাদ: 23. অতঃপর যখন শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে, তখন তাদের মধ্যকার কোন আত্মীয়তা বাকি থাকবে না এবং কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না। তখন যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে। আর যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই এমন, যারা নিজেদের জন্য লোকসানের ব্যবসা করেছিল। তারা সদা-সর্বদা জাহান্নামে থাকবে। আগুন তাদের চেহারা ঝলসে দেবে এবং তাতে তাদের আকৃতি বিকৃত হয়ে যাবে। [সুরা আল-মুমিনূন : (২৩) : 101-104] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
আয়াতের ব্যাখ্যাঃ এবং সে দিন (আমলসমূহের) ওজন (করার বিষয়টি) একটি অকাট্য সত্য : আমল ওজন করার অর্থ কেউ বলেছেন আমলনামা ওজন করা। কেউ বলেন, কিয়ামতের দিন আমলকে বস্তুর রূপ দান করা হবে, তারপর তা ওজন করা হবে। কারও মতে ওজন করা হবে আমলকারী ব্যক্তিকে। কিন্তু এতসব ব্যাখ্যার আশ্রয় নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা খোদ আমলকেই যদি ওজন করা হয়, তাতে আশ্চর্যের কি আছে? আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে যখন শীত, তাপ, বাতাস ও শব্দকে পর্যন্ত পরিমাপ করা যাচ্ছে, তখন আহকামুল-হাকিমীনের আদালতে আমলের পরিমাপ করাটা তো কোন ব্যাপারই নয়। যিনি হও বললে সব হয়ে যায় এবং যার ‘হও’-এর কল্যাণে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সৃষ্টি থেকে মহাস্থূল মহাজগত পর্যন্ত অস্তিত্ব লাভ করেছে, তার সকাশে কঠিন ও অসম্ভব বলতে কিছু নেই।
কিয়ামতের দিন আমি ন্যায়ানুগ তুলাদণ্ড স্থাপন করব: এ আয়াত স্পষ্ট জানাচ্ছে, কিয়ামতের দিন কেবল এতটুকুই নয় যে, সমস্ত মানুষের প্রতি ইনসাফ করা হবে, বরং সে ইনসাফ যাতে সমস্ত মানুষের নজরে আসে সে ব্যবস্থাও করা হবে। এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা সর্বসমক্ষে তুলাদণ্ড স্থাপন করবেন। তাতে মানুষের আমল পরিমাপ করা হবে এবং আমলের ওজন অনুসারে মানুষের পরিণাম স্থির করা হবে। মানুষ যে আমলই করে, দুনিয়ায় যদিও তার কোন বস্তুগত অস্তিত্ব দেখা যায় না এবং তার কোন ওজনও অনুভূত হয় না, কিন্তু আখেরাতে আল্লাহ তায়ালা পরিমাপের এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন যা দ্বারা আমলের প্রকৃত অবস্থা স্পষ্ট হয়ে যাবে। মানুষ যদি শীত ও তাপ মাপার জন্য নতুন-নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়, মানুষের স্রষ্টা বুঝি তাদের কর্ম পরিমাপের ব্যবস্থা করতে পারবেন না? আলবত পারবেন। তিনি অসীম ক্ষমতার মালিক।
কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না : দুনিয়ায় আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব একে অন্যের খোঁজ-খবর নেয়, কেমন আছে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু কিয়ামতের অবস্থা এমনই বিভীষিকাময় হবে যে, প্রত্যেকে নিজের চিন্তায় ব্যস্ত থাকবে। আত্মীয়-স্বজন বা অন্য কারও খবর নেওয়ার মত অবকাশ কারও হবে না।
আগুন তাদের চেহারা ঝলসে দেবে এবং তাতে তাদের আকৃতি বিকৃত হয়ে যাবে : আগুনে ঝলসে তাদের চেহারা এমনই বীভৎস হয়ে যাবে যে, তাদের উপরের ঠোঁট কুঞ্চিত হয়ে মাথার তালুতে পৌঁছে যাবে, নিচের ঠোঁট ঝুলে নাভি পর্যন্ত নেমে আসবে এবং মাঝখানে বিশাল-বিকট দাঁত বের হয়ে আসবে। হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে জাহান্নাম থেকে পানাহ চাই।
ক্রমিক নং : ২৪ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَلِمَتَانِ حَبِيْبَتَانِ إِلَى الرَّحْمَنِ، خَفِيفَتَانِ عَلَى اللِّسَانِ، ثَقِيلَتَانِ فِي الْمِيزَانِ: سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ سُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيم. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ) | অনুবাদ: . আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দুটি কালেমা জিহ্বার উপর (উচ্চারণে) খুবই হালকা, মীযানের (পাল্লায়) অত্যান্ত ভারী, রহমান (পরম দয়ালু আল্লাহ) এর কাছে খুবই প্রিয়। তা হলোঃ سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ سُبْحَانَ اللَّهِ الْعَظِيمِ (আমি আল্লাহ তায়ালার জন্য সপ্রশংসা পবিত্রতা জ্ঞাপন করছি, আমি মহান আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি)।[17] |
ক্রমিক নং : ২৫ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: يُحْشَرُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيمَةِ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلًا. قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ! الرِّجَالُ وَالنِّسَاءُ جَمِيعًا يَنْظُرُ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ! قَالَ: يَا عَائِشَةُ! الْأَمْرُ أَشَدُّ مِنْ أَنْ يَنْظُرَ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ. | অনুবাদ: . আয়িশা সিদ্দীকা রাদি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, কিয়ামতের দিন লোকদেরকে একত্রিত করা হবে খালি পা, উলঙ্গ দেহ এবং খাৎনা বিহীন অবস্থায়। এ কথা শুনে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! পূরুষ এবং মহিলা এক সাথেই উত্থিত হবে কি? তবে তো তারা পরস্পর একে অন্যের প্রতি নযর করবে। অতঃপর তিনি বলেলেন, হে আয়িশা! তখনকার অবস্থা তারা একে অন্যের প্রতি দেখার অবস্থা থেকে কঠিন হবে।[18] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছে হাশর-ময়দানের ভয়ানক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। সেদিন নারী পুরুষ সকলকে এমনভাবে জড়ো করা হবে যে, কারও পায়ে জুতা থাকবে না, শরীরে পোশাক থাকবে না এবং সকলেই থাকবে খতনাবিহীন অবস্থায়। মানুষ দুনিয়ায় যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই তাদেরকে হাশরের ময়দানে একত্র করা হবে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে,
وَلَقَدْ جِئْتُمُونَا فُرَادَى كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَتَرَكْتُمْ مَا خَوَّلْنَاكُمْ وَرَاءَ ظُهُورِكُمْ
(কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বলবেন,) তোমরা আমার কাছে নিঃসঙ্গ অবস্থায় এসেছ, যেমন আমি প্রথমে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম। আর আমি তোমাদেরকে যা-কিছু দান করেছিলাম, তা তোমাদের পেছনে ফেলে এসেছ।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
كَمَا بَدَأَكُمْ تَعُودُونَ
তিনি যেভাবে প্রথমে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তোমরা সেভাবেই ফিরে আসবে।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন
إنكم محشورون حفاة عراة غرلا: (كما بدأنا أول خلق نعيده ﴾ [الأنبياء: ١٠٤] الآية ، وإن أول الخلائق يكسى يوم القيامة : إبراهيم “
কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে খালি পায়ে উলঙ্গ শরীরে খতনাবিহীন অবস্থায় সমবেত করা হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, كما بدأنا أول خلق نعيده (আমি পুনরায় তাকে সৃষ্টি করব, যেভাবে প্রথমবার সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম -সুরা আম্বিয়া: ১০৪) কিয়ামতের দিন সমস্ত মাখলুকের মধ্যে ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে সবার আগে কাপড় পরানো হবে।
প্রশ্ন হতে পারে, কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা তো জানা যায় মৃত ব্যক্তি যে পোশাকে মারা যায় সে পোশাকেই তাকে উঠানো হবে, যেমন আবূ সা’ঈদ খুদরী রাদি.থেকে বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إن الميت يبعث في ثيابه التي يموت فيها
‘নিশ্চয়ই মৃত ব্যক্তিকে উঠানো হবে তার ওই পোশাকেই, যে পোশাকে তার মৃত্যু হয়।
এর উত্তর হলো, সম্ভবত কাউকে কবর থেকে উঠানো হবে নগ্ন অবস্থায় এবং কাউকে পোশাক পরিহিত অবস্থায়। অথবা কবর থেকে সকলকেই পোশাক পরিহিত অবস্থায় উঠানো হবে, তারপর হাশরের সূচনাকালে সকলের পোশাক খুলে পড়ে যাবে এবং সবাইকে নগ্ন অবস্থায় হাশরের ময়দানে একত্র করা হবে। কারও কারও মতে আবূ সা’ঈদ রাদি. বর্ণিত হাদীছটি শহীদদের সম্পর্কে। তারা যে পোশাক পরিহিত অবস্থায় শহীদ হয়, সে অবস্থায়ই তাদেরকে কবর থেকে উঠিয়ে হাশরে উপস্থিত করা হবে।
কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম পোশাক পরানো হবে ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে। যেমন উপরে উদ্ধৃত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদি. বর্ণিত হাদীছটি দ্বারা জানা গেল। আলী রাদি. বর্ণনা করেন,
أول من يكسى خليل الله : إبراهيم قبطيتين، ثم يكسى محمد صلى الله عليه وسلم حلة حبرة عن يمين العرش
‘কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে কাপড় পরানো হবে আর তা হবে এক জোড়া কুবতী কাপড়। তারপর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক জোড়া ডোরাকাটা পোশাক পরিধান করানো হবে। তিনি থাকবেন আরশের ডান দিকে।
প্রকাশ থাকে যে, এটা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এক বিশেষ ফযীলত। বিশেষ ফযীলত দ্বারা সামগ্রিকভাবে সকলের উপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হয় না। সামগ্রিকভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন সমস্ত নবী- রাসূলের প্রধান মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এটা বিভিন্ন দলীল-প্রমাণ দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত।
এ হাদীছ শুনে আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রাদি. ভীষণ উদ্বিগ্ন হলেন। তাই তিনি বলে উঠলেন
يا رسول الله ، الرجال والنساء جميعا ينظر بعضهم الى بعض ؟
(ইয়া রাসূলাল্লাহ! পুরুষ ও নারী সকলে? তারা একে অন্যকে দেখবে?)। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বার বর্ণনায় আছে, আমাদের কি তখন লজ্জা লাগবে না? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
يا عائشة الأمر أشد من أن يهمهم ذلك
(হে আয়েশা! এ বিষয়টি যে তাদেরকে ভাবাবে, পরিস্থিতি তারচে’ অনেক কঠিন)। অপর এক বর্ণনায় আছে,
فقالت عائشة : فكيف بالعورات؟ قال: «لكل امرئ منهم يومئذ شأن يغنيه [عس : ۳۷]
‘ আয়েশা সিদ্দীকা রাদি. বললেন, তখন সতরের ব্যাপারটা কেমন হবে? তিনি বললেন, (সে চিন্তা করো না। আল্লাহ তায়ালা তো বলেই দিয়েছেন—)
لكل امرئ منهم يومئذ شأن يغنيه
(সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন দুশ্চিন্তা দেখা দেবে, যা তাকে অন্যের থেকে ব্যস্ত করে রাখবে -সুরা আবাসা : ৩৭)।
অপর এক বর্ণনায় এসেছে। আয়েশা রাদি. বলে উঠেন,
وا سوأتاه، الرجال والنساء يحشرون جميعا، ينظر بعضهم إلى سوءة بعض؟ فقال: لكل امرئ منهم يومئذ شأن يغنيه» الآية، وزاد: ولا ينظر الرجال إلى النساء، ولا النساء إلى الرجال، شغل بعضهم عن بعض.
‘কী লজ্জার কথা! নারী-পুরুষ সকলকে একত্র করা হবে আর তারা একে অন্যের সতর দেখবে! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন দুশ্চিন্তা দেখা দেবে, যা তাকে অন্যের থেকে ব্যস্ত করে রাখবে -সুরা আবাসা : ৩৭”। পুরুষগণ নারীদের দিকে তাকাবে না, নারীরাও পুরুষদের দিকে তাকাবে না। প্রত্যেকে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে, অন্যকে নিয়ে ভাবার অবকাশ পাবে না।
সারকথা, মানুষ তো একে অন্যের দিকে লক্ষ করে যখন আরামে থাকে। হাশরের ময়দান আরামের জায়গা নয়। সকলেই থাকবে ভীষণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে। তখন বন্ধু বন্ধুকে ভুলে যাবে। এমনকি মা’ও তার সন্তানের দিকে ফিরে তাকানোর অবকাশ পাবে না। প্রত্যেকে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। কার শরীরে কাপড় আছে বা নেই, কারও সেদিকে তাকানোর ফুরসত থাকবে না। আল্লাহ তায়ালা নিজ মেহেরবানীতে আমাদেরকে সেদিনের বিভীষিকা থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. এ হাদীছ ইসলামের এ মৌলিক আকীদা প্রমাণ করে যে, মৃত্যুর পর অবশ্যই পুনরুত্থান হবে। হাশরের মাঠে হিসাব-নিকাশের জন্য দাঁড়াতে হবে।
খ. হাশরের ময়দান চরম বিভীষিকাময়। ইহজীবনের আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে সে কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
গ. একে অন্যের সামনে উলঙ্গ অবস্থায় থাকা হাশরের ভয়ানক পরিস্থিতির অংশ। এটা ইহজীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই কোনও মুমিন-মুসলিমের অন্যের সামনে উলঙ্গ বা অর্ধোলঙ্গ হয়ে থাকার বেহায়াপনা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়।
ক্রমিক নং : ২৬ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَتُؤَدَّنَّ الْحُقُوقُ إلى أَهْلِهَا حَتَّى تُقَادَ الشَّاةُ الْجَلْحَاءُ مِنَ الشَّاةِ الْقَرْنَاءِ. (رَوَاهُ مُسْلِمٌ) | অনুবাদ: . আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক হকওয়ালার হক অবশ্যই আদায় করা হবে। এমনকি শিংহীন ছাগলের পক্ষে শিংওয়ালা ছাগলের পক্ষ থেকেও বদলা নেয়া হবে।[19] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা :
জুলুমের প্রতি নিষেধাজ্ঞা এবংজুলুমের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ ফেরত দেওয়ার হুকুম
‘জুলুম’-এর শাব্দিক অর্থ কোনও বস্তু এমন স্থানে রাখা, যা তার প্রকৃত স্থান নয়। শরী’আতের পরিভাষায় জুলুম বলা হয় অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা বা অন্যের হক নষ্ট করা ও অনধিকার চর্চাকে। শরী’আত যে বস্তুর যে সীমা স্থির করে দিয়েছে, তা লঙ্ঘন করাকেও জুলুম বলা হয়। সুতরাং অন্যের জমি দখল করা, অন্যের টাকা-পয়সা কেড়ে নেওয়া, সম্মানী ব্যক্তিকে সম্মান না করা, অন্যায়ভাবে কাউকে তার পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি সবই জুলুমের মধ্যে পড়ে।
জুলুম প্রথমত দুই প্রকার। এক জুলুম হচ্ছে হাক্কুল্লাহর ক্ষেত্রে, আরেক জুলুম হাক্কুল ইবাদের ক্ষেত্রে। আল্লাহর হক বলতে – তাঁকে এক জানা ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা-সহ–তাঁর সম্পর্কিত যাবতীয় আকীদা-বিশ্বাস অন্তরে লালন করা এবং তাঁর দেওয়া শরী’আত মেনে চলাকে বোঝায়। সুতরাং ঈমান ও আকীদায় যে-কোনও ত্রুটি এবং আল্লাহর যে-কোনও আদেশ-নিষেধ অমান্য করা জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। আদম আলাইহিস সালাম তো তাঁর ইজতিহাদভিত্তিক ভুলকেও ‘জুলুম’ নামে অভিহিত করেছেন, যা কিনা গুনাহর মধ্যেই পড়ে না। সুতরাং তিনি ও তাঁর স্ত্রী হাওয়া আলাইহিমাস সালাম সে ভুলের পর এই বলে আল্লাহ তায়ালার কাছে দু’আ করেছিলেন যে,
قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজ সত্তার ওপর জুলুম করে ফেলেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন ও আমাদের প্রতি রহম না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অকৃতকার্যদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।
হাক্কুল ইবাদের ক্ষেত্রে জুলুমকে মৌলিকভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
ক. অন্যের জানের প্রতি জুলুম;
খ. অন্যের মালের ওপর জুলুম এবং
গ. অন্যের ইজ্জতের ওপর জুলুম।
তা এভাবে যে, মানুষের মূল সম্পদ হচ্ছে তিনটি তার জান, তার মাল ও তার ইজ্জত। সুতরাং এ তিন বস্তুর নিরাপত্তা লাভ প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার। অন্যায়ভাবে এর কোনওটিতে আঘাত করা জায়েয নয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জের দিন ঘোষণা করেন,
فإن دماءكم وأموالكم وأعراضكم بينكم حرام كحرمة يومكم هذا في شهركم هذا في بلدكم هذا
তোমাদের এই (মক্কা) নগরে এই (হজ্জের) মাসে আজকের এই দিনটির যেমন মর্যাদা, তোমাদের পরস্পরের মধ্যে তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের ইজ্জতের মর্যাদা তেমনই।
অর্থাৎ প্রত্যেকের কর্তব্য অন্যের এ তিনটি বিষয়ের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষা করা।এমন কোনও কাজ করা জায়েয নয়, যা দ্বারা অন্যের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। যদি তা করা হয়, তবে সে কাজটি জুলুমরূপে গণ্য হবে।
সুতরাং কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, অঙ্গহানি করা, মারধর করা এবং যে কোনওভাবে শারীরিক কষ্ট দেওয়া হচ্ছে তার জানের ওপর জুলুম।
কারও বাড়িঘর ও জমি-জায়েদাদ দখল করা, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি করা, টাকা পয়সা কেড়ে নেওয়া এবং যে-কোনও রকম বৈষয়িক ক্ষতি করা তার মালের ওপর জুলুম বলে বিবেচিত হবে।
কারও নামে অপবাদ দেওয়া, তার গীবত করা, তাকে গালাগাল করা এবং তার প্রতি মানহানিকর যে-কোনও আচরণ করা ইজ্জতের ওপর জুলুম করার অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম এর প্রত্যেকটিকেই কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করেছে এবং যে-কোনও প্রকার জুলুমকে কঠিন পাপ ঘোষণা করেছে।
চিন্তা করলে বোঝা যায় ‘হাক্কুল ইবাদ’ জাতীয় জুলুম হাক্কুল্লাহ’র ক্ষেত্রে জুলুম অপেক্ষাও কঠিন। কেননা হাক্কুল ইবাদ আদায় করাও আল্লাহ তায়ালা হুকুম। কাজেই এটা লঙ্ঘন করলে যেমন বান্দার হক নষ্ট করার জুলুম হয়, তেমনি আল্লাহর হক নষ্ট করারও জুলুম হয়ে যায়। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য এর থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা।অন্যথায় আখিরাতে এর জন্য কঠিন শাস্তির সম্মুখীন তো হতেই হবে, দুনিয়ায়ও এর অশুভ পরিণাম ভোগ করার আশঙ্কা আছে।
ইতোমধ্যে কারও দ্বারা যদি কোনও প্রকার জুলুম হয়ে থাকে, তবে তার কর্তব্য এখনই সে ব্যাপারে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া। পরিষ্কার হওয়ার উপায় হচ্ছে, হালুল্লাহর ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার কাছে তাওবা করা এবং হাক্কুল ইবাদের ক্ষেত্রে তাওবার পাশাপাশি সে যার ওপর জুলুম করেছে তার থেকে দায়মুক্তি লাভ করা। অর্থাৎ যদি তার জানের ওপর আঘাত করে থাকে বা কোনওভাবে তার মানহানি করে থাকে, তবে তার কাছে সরাসরি ক্ষমা চাওয়া এবং আন্তরিকভাবে তার কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করে নেওয়া। যদি তার মৃত্যু হয়ে থাকে, তবে তার ওয়ারিশদের প্রতি সদাচরণ করা, তাদেরকে খুশি করার চেষ্টা করা এবং সেই মৃত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাতের দু’আ করতে থাকা। এতে আশা করা যায় আল্লাহ তায়ালা তার পক্ষ থেকে ক্ষমার ব্যবস্থা করে দেবেন।
আর যদি অর্থ-সম্পদ সংক্রান্ত জুলুম হয়ে থাকে, তবে সে যদি জীবিত থাকে এবং তাকে পাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে তার যে পরিমাণ অর্থ সে আত্মসাৎ করেছে তা তাকে ফেরত দেবে। যদি সে মারা গিয়ে থাকে, তবে তার ওয়ারিশদের কাছে ফেরত দেবে। যদি তাকে বা তার ওয়ারিশদের কাউকেই না পাওয়া যায়, তবে তার নামে তা দান সদাকা করে দেবে। অর্থাৎ এই নিয়ত রাখবে যে, এর ছাওয়াব যেন সে ব্যক্তি পায়। এর বিস্তারিত মাসাইল বিজ্ঞ আলেমদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া চাই।
উল্লেখ্য, প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের ওপরও নিজের হক আছে। যেমন এক হাদীছে বলা হয়েছে,
وإن لنفسك عليك حقا
নিশ্চয়ই তোমার ওপর তোমার নিজেরও হক আছে।
সুতরাং বান্দার হকের মধ্যে নিজের হকও শামিল। এ ক্ষেত্রে অবহেলাও জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। এমন কোনও কাজ করা জায়েয হবে না, যা দ্বারা নিজ জান, মাল ও ইজ্জত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর সর্বপ্রকার জুলুমই শেষটায় নিজ সত্তার ওপরই জুলুম। কেননা তাতে যে পাপ হয় তার খেসারত তো নিজেকেই দিতে হয়। তাই অন্ততপক্ষে নিজের ক্ষতি চিন্তা করেও সবরকম জুলুম থেকে বিরত থাকা উচিত।
এ হাদীছ দ্বারা হুকুকুল ইবাদ যে কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা অনুমান করা যায়। এখানে لتؤدن -এর আগে والله (আল্লাহর কসম) উহ্য আছে। এ কারণেই لتؤدن -এর শুরুতে তাকীদের ل (লাম) (যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার কসম করে বলছেন যে, কিয়ামতের দিন অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেকের হক আদায় করিয়ে দেবেন। সেদিন কারও হক অনাদায় থাকবে না। দুনিয়ায় যদি কেউ কারও হক নষ্ট করে থাকে, তবে আখিরাতে তাকে তার বদলা দিতেই হবে। যার হক নষ্ট করা হয়েছে সে তার পুরোপুরি বদলা পেয়ে যাবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আখিরাতে তো কোনও টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদের কারবার নেই, যারা মারা যায় তারা এর সবকিছুই দুনিয়ায় রেখে যায়, তাহলে সেদিন একে অন্যের হক কিভাবে আদায় করবে?
এর জবাব অন্য এক হাদীছে আছে। তাতে জানানো হয়েছে, সেদিন পরস্পরের পাওনা আদায় হবে প্রথমত নেকীর দ্বারা, তারপর পাপ দ্বারা। অর্থাৎ প্রথমত হকদারকে তার হকের বদলে হক নষ্টকারীর নেকী দিয়ে দেওয়া হবে। এভাবে হকদারদের হক আদায় করতে করতে যখন তার নেকী শেষ হয়ে যাবে, তখন তাদের হকের বদলে তাদের পাপ এ ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। এভাবে নিজের পাপের সাথে অন্যের পাপের বোঝা যোগ হয়ে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে যে, তার আর মুক্তির কোনও উপায় থাকবে না। ফলে জাহান্নামই হবে তার অবধারিত গন্তব্য।
মজলুমদের জন্য আশ্বাসবাণী
এটা যেমন হক নষ্টকারীর জন্য এক কঠিন সতর্কবাণী, তেমনি যাদের হক নষ্ট করা হয় সেই মজলূমদের জন্য এক আশ্বাসবাণীও বটে। কেননা দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। একদিন না একদিন শেষ হবেই হবে। কারও হক কোনওভাবে নষ্ট করা না হলে সে যে অনন্ত জীবন লাভ করবে এমন তো নয়। হাঁ এতটুকু কথা যে, হকসমূহ নষ্ট করা না হলে যতদিন বাঁচত ততদিন তার সুবিধা হত। হক নষ্ট হওয়ার ফলে সেই সুবিধাটুকু তার হল না। কিন্তু হক নষ্ট হওয়ার দ্বারা তার যে লাভ হবে, সে তুলনায় দুনিয়ার এ সুবিধা কিছুই নয়। কেননা তার যত হক নষ্ট করা হয়েছে, আখিরাতে এর বিনিময়ে সে বলতে গেলে প্রায় মুফতেই বিপুল ছাওয়াব পেয়ে যাবে। অসম্ভব নয় হয়তো তার নেকীর পাল্লায় কিছুটা টান ছিল, আর এ মুফতে পাওয়া নেকীর দ্বারা সেই টান পূর্ণ হয়ে গেল এবং এভাবে তার মুক্তির ব্যবস্থা হয়ে গেল। ভাবা যায় এটা কত বড় লাভ? এজন্যই কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, আখিরাতে পাওনাদারগণ আফসোস করে বলবে, আহা, দুনিয়ায় তার কোনও পাওনা যদি পরিশোধ না-ই করা হত!
হাশরে পশুদের পারস্পরিক জুলুমের বিচার
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হক আদায়ের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে আমাদের জানান যে, মানুষ তো মানুষ, আখিরাতে এমনকি পশুদের মধ্যেও তাদের পারস্পরিক জুলুমের বিচার করা হবে। তাদেরও একের থেকে অন্যের হক আদায়ের ব্যবস্থা থাকবে। দুনিয়ায় এক পশু যদি অন্য পশুর ওপর জুলুম করে থাকে, তবে সেদিন সেই জুলুমেরও প্রতিশোধ নিয়ে দেওয়া হবে।
হয়তো এক শিংওয়ালা ছাগল শিংবিহীন ছাগলকে খামোখা গুঁতো মারল। শিং না থাকায় দুর্বল ছাগলটি তার বদলা নিতে পারল না। এ অবস্থায় আখিরাতে শিংবিহীন ছাগলটিকে শিং দিয়ে দেওয়া হবে আর বলা হবে, তোমাকে যেমন গুঁতো মেরেছিল। তেমনি তাকেও গুঁতো মেরে দাও। সে সমযাত্রার গুঁতো তাকেও মারবে। তারপর তাদেরকে মাটি করে ফেলা হবে। এভাবেই তাদের বিচার শেষ হবে। তাদের জন্য জান্নাত-জাহান্নাম নেই। মানুষের বেলায় যেহেতু জান্নাত-জাহান্নাম আছে, তাই তাদের বদলা আঘাত ও প্রত্যাঘাতের দ্বারা হবে না; বরং তা হবে পাপ-পুণ্যের বিনিময় দ্বারা।
উল্লেখ্য, পশুপাখির এ বিচার পুরস্কার-শাস্তিদান হিসেবে নয়; বরং কিসাস ও বদলা হিসেবে করা হবে।
এর দ্বারা বোঝা গেল হাশর কেবল মানুষেরই হবে না; বরং পশু-পক্ষীরও হবে।
মৃত্যুর পর মানুষসহ সব প্রাণীকেই পুনর্জীবিত করে হাশরের ময়দানে একত্র করা হবে।তারপর বিচারকার্য সম্পন্ন করে অন্য সকলকে মাটিতে পরিণত করা হবে এবং মানুষ ও জিনদেরকে জান্নাত ও জাহান্নামের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এই যে পশুপাখির হাশর ও পুনরুত্থানের কথাটি বলা হল, এটি কুরআন মাজীদে সুস্পষ্টভাবেই জানানো হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে, وَإِذَا الْوُحُوشُ حُشِرَتْ ‘এবং যখন বন্য পশুসমূহ (হাশরে) একত্র করা হবে।
কুরআন-হাদীছ দ্বারা যখন স্পষ্টভাবেই তাদের হাশরের বিষয়টি জানা গেল, তখন এতে বিশ্বাস রাখা জরুরি।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. এ হাদীছ দ্বারা বান্দার হক আদায়ের বিষয়টি যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা অনুমান করা যায়। সুতরাং আমরা এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করব।
খ. যাদের কোনও হক কারও দ্বারা নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের উচিত আখিরাতে পুণ্য লাভের আশায় এ ব্যাপারে নমনীয়তা অবলম্বন করা।
গ. এ হাদীছ দ্বারা আখিরাত, পুনরুত্থান ও হাশরে বিচার সংঘটিত হওয়ার সত্যতা জানা যায়, যা ইসলামের একটি মৌলিক আকীদা।
ঘ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা ন্যায়বিচারক। দুনিয়ায় কেউ কাউকে ঠকিয়ে নিস্তার পেলেও আখিরাতে সে বাঁচতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালার আদালতে তাকে ন্যায়বিচারের সম্মুখীন হতেই হবে।
ঙ. আখিরাতে পশু-পাখিরও পুনরুত্থান ও বিচার হবে।
ক্রমিক নং : ২৭ | |
আরবি | বাংলা |
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لا تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيمَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْالَ عَنْ خَمْسٍ: عَنْ عُمْرِهِ فِيْمَا أَفْنَاهُ، وَعَنْ شَبَابِهِ فِيْمَا أَبْلَاهُ، وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ، وَفِيْمَا أَنْفَقَهُ، وَمَاذَا عَمِلَ فِيْمَا عَلِمَ؟ (رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَقَالَ: هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ) | অনুবাদ: . ইবনে মাসউদ রাদি. থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামতের দিন প্রভুর নিকট থেকে আদম সন্তানের পা সরবে নাঃ জিজ্ঞাসা করা হবে তার বয়স সম্পর্কে, কি কাজে সে তা অতিবাহিত করেছে, তার যৌবন সম্পর্কে কি কাজে সে তা বিনাশ করেছে; তার সম্পদ সম্পর্কে, কোথা থেকে সে তা অর্জন করেছে আর কি কাজে সে তা ব্যয় করেছে এবং সে যা শিখেছিল তদনুযায়ী কি আমল সে করেছে? [20] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদীস থেকে শিক্ষা :
অর্থ-সম্পদের আয়ের উৎস যেমন বৈধ ও হালাল হতে হবে. তদ্রুপ ব্যয়ের ক্ষেত্রও বৈধ হতে হবে। সুতরাং নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোন পথে ব্যয় করার অধিকার কারো নেই।
ক্রমিক নং : ২৮ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : رَحِمَ اللهُ عَبْدًا كَانَتْ لِأَخِيْهِ عِنْدَه مَظْلِمَةٌ فِي عِرْضٍ أَوْ مَالٍ، فَجَاءَهُ فَاسْتَحَلَّهُ قَبْلَ أَنْ يُؤْخَذَ وَلَيْسَ ثَمَّ دِيْنَارٌ وَلا دِرْهَمٌ، فَإِنْ كَانَتْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ حَسَنَاتِهِ وَإِنْ لَّمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ حَمَّلُوا عَلَيْهِ مِنْ سَيِّآتِهِمْ. (هذا حديثٌ حسنٌ صَحِيحٌ) | অনুবাদ: . আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ রহম করুন বান্দার উপর, যার যিম্মায় তার কোন ভাইয়ের সম্মান ও সম্পদ বিনষ্ট করার মত যুলুম জনিত অপরাধ রয়ে গেছে সে যেন এই অপরাধগুলো পাকড়াও হওয়ার আগেই মাফ করিয়ে নেয়। সেখানে (কিয়ামতের ময়দানে) কোন দীনার (স্বর্ণ মুদ্রা) বা কোন দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) থাকবে না। যদি তার নেক আমল থাকে (মযলুমের বদলায়) তবে নেক আমল নিয়ে যাওয়া হবে। আর তার যদি নেক আমল না থাকে তবে মযলুমদের বদ আমল এনে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।[21] |
الْمُفْلِسُ مِنْ أُمَّة مُحَمَّدٍ ﷺ |
মুহাম্মাদ সা.-এর উম্মতরে দেউলিয়া |
ক্রমিক নং : ২৯ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: أَتَدْرُونَ مَنِ الْمُفْلِسُ؟ قَالُوا: الْمُفْلِسُ فِيْنَا يَا رَسُولَ اللهِ! مَنْ لَا دِرْهَمَ لَهُ وَلَا متاع. قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : الْمُفْلِسُ مِنْ أُمَّتِي مَنْ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيمَةِ بِصَلَاةٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ وَيَأْتِي قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَفَ هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا… فَيُقْعَدُ، فَيَقْتَصُّ هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ. فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْتَصَّ مَا عَلَيْهِ مِنَ الْخَطَايَا أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَ عَلَيْهِ، ثُمَّ طرِح في النَّارِ. (رَوَاهُ مُسلم) | অনুবাদ: . আবূ হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান নিঃস্ব–গরীব কে? সাহাবিগণ বললেন, আমাদের মধ্যে নিঃস্ব–গরীব হচ্ছে ওই ব্যক্তি, যার কোনও অর্থ–সম্পদ নেই। তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব–গরীব ওই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে হাজির হবে। সেইসঙ্গে সে হাজির হবে এ অবস্থায় যে, (দুনিয়ায়) সে কাউকে গালি দিয়েছে, কারও প্রতি অপবাদ দিয়েছে, কারও সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কারও রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে মেরেছে। সুতরাং এই ব্যক্তিকে তার নেক আমলের একাংশ দেওয়া হবে, ওই ব্যক্তিকে তার নেক আমলের একাংশ দেওয়া হবে (এভাবে দেওয়া হতে থাকবে)। যদি তার নেক আমলসমূহ তার দেনা পরিশোধ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়, তবে তাদের থেকে তাদের গুনাহসমূহ নিয়ে তার ওপর নিক্ষেপ করা হবে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[22] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে জিজ্ঞেস করেছেন,
أَتَدْرُونَ مَنِ الْمُفْلِسُ
(তোমরা জান মুফলিস কে?)।
الْمُفْلِسُ (মুফলিস) শব্দটির উৎপত্তি فلس থেকে। فلس অর্থ পয়সা। الْمُفْلِسُ অর্থ যার কোনও টাকা-পয়সা নেই, একদম নিঃস্ব, মিসকীন ও কপর্দকহীন। সাহাবায়ে কিরাম উত্তরে এ কথাই বলেছেন যে, মুফলিস ওই ব্যক্তি, যার কোনও দিরহাম-দীনার ও মাল-সামানা নেই। তাদের এ উত্তর ছিল শব্দটির প্রচলিত ও ব্যবহারিক অর্থ অনুযায়ী। স্বাভাবিকভাবে তাদের এরকম উত্তর দেওয়ারই কথা। তা সত্ত্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে এ প্রশ্ন করেছেন এই জন্য যে, এর পরে তিনি তাদের সামনে যে বক্তব্য পেশ করবেন তা যাতে তাদের অন্তরে বিশেষভাবে রেখাপাত করে। কেননা কোনও শব্দের প্রচলিত অর্থের বাইরে যখন অন্য কোনও অর্থ কানে পড়ে, তখন তা মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরকম অর্থ মানুষের মনোযোগ কাড়ে এবং মানুষ সে অর্থ নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করে। সাধারণত মানুষ বিশেষ কোনও বক্তব্য দানের আগে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এ জাতীয় প্রশ্ন করে থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এর পরে যে কথা বলেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা বিশেষভাবে চিন্তা করার বিষয়ই বটে।
তিনি ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের মধ্যে কিয়ামতের দিন মুফলিস ও কপর্দকশূন্য হবে ওই ব্যক্তি, যে (বিপুল) নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে উপস্থিত হবে। অর্থাৎ তোমরা যাদেরকে মুফলিস ও নিঃস্ব বলছ, দুনিয়ার বিচারে তারাও নিঃস্ব বটে, কিন্তু প্রকৃত নিঃস্ব তো আখিরাতের নিঃস্ব। তা ওই ব্যক্তি, যে অনেক ইবাদত-বন্দেগী এবং বিপুল ছাওয়াব ও পুণ্য নিয়ে হাজির হবে। ছাওয়াবের দিক থেকে সে হবে বিরাট ধনী। কিন্তু সেইসঙ্গে তার উপস্থিতি হবে এমন অবস্থায় যে, সে দুনিয়ায় বিভিন্ন মানুষের প্রতি নানাভাবে জুলুম করেছে। তাদের বিভিন্ন হক নষ্ট করেছে, কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে মারধর করেছে, কাউকে গালাগাল করেছে এবং কারও সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। এভাবে সে মানুষের জান, মাল ও ইজ্জত তিন প্রকার হক নষ্ট করেছে। ওদিকে আল্লাহ তায়ালা ন্যায়বিচারক। তাঁর আদালতে সমস্ত জুলুম ও অন্যায়-অনাচারের বিচার হবে। দুনিয়ায় অন্যের প্রতি জুলুম করে এবং মানুষের হক নষ্ট করে বাঁচতে পারলেও আল্লাহর আদালতে বাঁচার কোনও উপায় নেই। সেখানে জুলুমের প্রতিকার হবেই হবে। অন্যের যেসব হক নষ্ট করা হয়েছে, আল্লাহর আদালতে তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। কিন্তু সেখানে তো দুনিয়ার টাকা-পয়সা অচল। সোনা-রুপা ও অর্থ-সম্পদ দিয়ে সেখানে দেনা শোধ করা যাবে না। সেখানে যা চলবে তা কেবলই ছাওয়াব ও নেকী।
সুতরাং যে ব্যক্তি বিভিন্নভাবে অন্যের হক নষ্ট করেছে আর এভাবে মানুষের প্রতি জুলুম করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে, আল্লাহর আদালতে তার সে জুলুমের প্রতিকার করা হবে তার নেকীর বিনিময়ে। যার যতটুকু হক নষ্ট করেছে, ততটুকু পরিমাণ নেকী তাকে তার দিয়ে দিতে হবে। এভাবে মানুষের হক পরিশোধের বিনিময়ে তার নেকী দিতে দিতে একপর্যায়ে দেখা যাবে তার সবটা নেকী শেষ হয়ে গেছে। পাহাড় সমান নেকী নিয়ে সে হাজির হয়েছিল, কিন্তু হক পরিশোধ করতে গিয়ে সবটা শেষ হয়ে গেছে। অথচ এখনও তার ওপর অন্যদের হক অবশিষ্ট রয়ে গেছে। সে হক পরিশোধ হবে কিসের দ্বারা? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানান-
فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ، أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ، ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ
‘যদি তার নেক আমলসমূহ তার দেনা পরিশোধ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়, তবে তাদের থেকে তাদের গুনাহসমূহ নিয়ে তার ওপর নিক্ষেপ করা হবে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’
কী ভয়াবহ অবস্থা! একে দুনিয়ায় যা-কিছু ছাওয়াব অর্জন করা হয়েছিল সব শেষ, তার ওপর কত রকম গুনাহ করা হয়েছিল, সেসব গুনাহের বোঝা তো আছেই, তাতে যোগ হল অন্যের হক আদায়ের বিপরীতে চলে আসা বিপুল গুনাহের নতুন বোঝা। এ অবস্থায় জাহান্নাম ছাড়া কোনও গতি থাকে কি? সুতরাং গুনাহের ডবল বোঝাসহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এই পরিণতি থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
“তাযকিরাতুল মুহিব্বীন’* শীর্ষক গ্রন্থে ইবনুর রাসসা’ রহ. বলেন, কোনও তত্ত্বজ্ঞ বুযুর্গ এ হাদীছটি উল্লেখপূর্বক বলেছেন, এটি এক কঠোর সতর্কবাণী। বুঝমানদের পক্ষে এ এক কঠিন হুঁশিয়ারী বার্তা। কেননা মানুষ যা-কিছুই আমল করে তা একদম খালেস ও রিয়ামুক্ত কমই হয়। শয়তান তার ভেতর নানা কৌশলে ভেজাল ঢুকিয়ে দেয়। যদি কোনওক্রমে তার দু’-চারটি আমল নির্ভেজাল হয়ও, তবে মানুষকে কষ্টদানের ব্যাপারটা থেকেই যায়। এ জাতীয় পাপ থেকে মুক্ত থাকা হয় কমই। সুতরাং ওহে আত্মপ্রবঞ্চক! যখন কিয়ামত হবে, তখন তোমার কোনও কোনও ইবাদত খুঁত-খামতিসহ যাচাই-বাছাইতে টিকে গেলেও যাদেরকে তুমি কোনওভাবে কষ্ট দিয়ে ফেলেছ, সেই প্রতিপক্ষরা তোমার ওইসব ইবাদতের ছাওয়াব দাবি করবে। আর তখন তোমার মাওলার ফয়সালায় সেসব নেকী তারা পেয়ে যাবে। সেদিন তো টাকা-পয়সা ধন-দৌলত থাকবে না, যা দ্বারা তুমি তোমার দেনা শোধ করবে; বরং তা শোধ করা হবে তোমার নেকী দ্বারাই। তুমি যদি দিন কাটাও রোযা রেখে, রাত কাটাও নামায পড়ে আর রহমানের ইবাদত- আনুগত্যে সময় পার কর, অন্যদিকে মুমিন-মুসলিমদের গীবত করে বেড়াও, তাদের অর্থ-সম্পদ হরণ কর আর বিভিন্নভাবে তাদেরকে কষ্ট দিয়ে থাক, তবে হে বদনসীব! তাদের বদলা দিয়েই তোমার সব পুণ্য খতম হয়ে যাবে। ভেবে দেখ তারপর পরিণাম কী দাঁড়াবে।
وتمامه: تذكرة المحبين في شرح أسماء سيد المرسلين للإمام العلامة محمد بن قاسم أبي عبد الله الأنصاري التونسي المالكي المتوفى سنة ٨٩٤ هـ (دار التصنيف)*
এই যদি হয় ইবাদতগুযারদের অবস্থা, তখন আমাদের মত পাপাচারী, যারা বদী সঞ্চয়ে মশগুল, খায় হারাম ও সন্দেহযুক্ত খাবার, ইবাদত-বন্দেগীতে করে অবহেলা আর সদা নাফরমানির দিকে ধাবিত থাকে, তাদের কী গতি হবে?
(দালীলুল-ফালিহীন অবলম্বনে)
এ হাদীছটি আমাদের জন্য অতি বড় সতর্কবাণী। আমাদের এখনই সাবধান হয়ে যাওয়া উচিত। যথাযথভাবে ইবাদত-বন্দেগী করার পাশাপাশি লক্ষ রাখা উচিত যাতে কোনওভাবেই আল্লাহর কোনও বান্দার হক নষ্ট হয়ে না যায়। খুন-খারাবীর তো প্রশ্নই আসে না, অন্যায়ভাবে কারও গায়ে হাত তোলা ও শারীরিক কষ্ট দেওয়া থেকেও সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতে হবে। আমরা যেন কারও টাকা-পয়সা ও জমি-জায়েদাদ অন্যায়ভাবে দখল না করি। কাউকে গালাগালি করা, অন্যের গীবত-শেকায়েত করা, কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা এবং অন্যের মর্যাদা নষ্ট এমন যে-কোনও আচরণ করা থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে, যদি আমরা চাই আমাদের টুটাফাটা ইবাদতের ছাওয়াব হাতছাড়া না হয়ে যাক এবং সামান্য যা ছাওয়াব অর্জিত হয় তার অছিলায় আল্লাহর রহমতে জাহান্নাম থেকে বেঁচে জান্নাত পেয়ে যাই।
যদি ইতোমধ্যে আমাদের কারও দ্বারা এরকম কিছু হয়ে গিয়ে থাকে, তবে এখনই খাঁটি তাওবা করে যথাসম্ভব অন্যের হক ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে এবং মজলুমদের কাছ থেকে ক্ষমা হাসিল করে নিতে হবে।
হাদীছটির শিক্ষা
ক. আল্লাহর হক আদায়ের পাশাপাশি বান্দার হক নষ্ট করা ও তাদের প্রতি জুলুম করার দ্বারা আখিরাতে মিসকীন হয়ে যাওয়া অবধারিত। তাই এর থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে।
খ. কিয়ামতে ন্যায়বিচার হবেই হবে। তখন প্রত্যেক মজলুমের পক্ষে জালেমের থেকে প্রতিশোধ নিয়ে দেওয়া হবে।
গ. দুনিয়া থেকে জালেমরূপে বিদায় না নিয়ে মজলুমরূপে বিদায় নিয়ে নেওয়াই শ্রেয়।
ঘ. নামায-রোযা তো অবশ্যই করতে হবে, কিন্তু আখিরাতে কেবল তা দ্বারাই বাঁচা যাবে না, বান্দার হকও আদায় করতে হবে।
الْمَلائِكَةُ |
ফেরেশতা |
ক্রমিক নং : ৩০-৩৩ | |
আরবি | বাংলা |
قَالَ اللهُ تَعَالَى : ﴿الْحَمْدُ لِلَّهِ فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ جَاعِلِ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا أُولِي أَجْنِحَةٍ مَثْنَى وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ يَزِيدُ فِي الْخَلْقِ مَا يَشَاءُ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ﴾ [سورة فاطر: 1] | অনুবাদ:30 . সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, যিনি ফেরেশতাদেরকে বার্তাবাহীরূপে নিযুক্ত করেছেন, যারা দু’-দুটি, তিন-তিনটি ও চার-চারটি পাখা বিশিষ্ট। তিনি তাঁর সৃষ্টিতে যা-ইচ্ছা বৃদ্ধি করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। [সুরা ফাত্বির : (৩৫) : 01] |
قَالَ اللهُ تَعَالَى : ﴿الَّذِينَ يَحْمِلُونَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيُؤْمِنُونَ بِهِ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَحْمَةً وَعِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا وَاتَّبَعُوا سَبِيلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ (7) رَبَّنَا وَأَدْخِلْهُمْ جَنَّاتِ عَدْنٍ الَّتِي وَعَدْتَهُمْ وَمَنْ صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (8) وَقِهِمُ السَّيِّئَاتِ وَمَنْ تَقِ السَّيِّئَاتِ يَوْمَئِذٍ فَقَدْ رَحِمْتَهُ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ﴾ ύ[سورة الغافر: ٧-٩] | অনুবাদ: 31. যারা (অর্থাৎ যে ফেরেশতাগণ) আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা তাঁর চারপাশে আছে, তারা তাদের প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে তাঁর তাসবীহ পাঠ করে ও তাঁর প্রতি ঈমান রাখে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য মাগফিরাতের দুআ করে (যে,) হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার রহমত ও জ্ঞান সমস্ত কিছু জুড়ে ব্যাপ্ত। সুতরাং যারা তাওবা করেছে ও তোমার পথের অনুসারী হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করে দাও এবং তাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে দাখিল কর স্থায়ী জান্নাতে, যার ওয়াদা তুমি তাদের সাথে করেছ এবং তাদের পিতা-মাতা, স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে যারা নেক লোক তাদেরকেও। নিশ্চয়ই তুমিই পরাক্রশালী, প্রজ্ঞাময়। এবং তাদেরকে সকল মন্দ বিষয় থেকে রক্ষা কর। সে দিন তুমি যাকে সব মন্দ থেকে রক্ষা করবে, তার প্রতি তুমি অবশ্যই দয়া করলে। আর এটাই মহাসাফল্য। [সুরা আল-মুমিন : (৪০) : 7-9] |
قَالَ اللهُ تَعَالَى : ﴿إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ (30) نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ (31) نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ ﴾ [ حم السجده : 30-32] | অনুবাদ: 32. (অপর দিকে) যারা বলেছে, আমাদের রব্ব আল্লাহ! তারপর তারা তাতে থাকে অবিচলিত, নিশ্চয়ই তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হবে (এবং বলবে) যে, তোমরা কোন ভয় করো না এবং কোন কিছুর জন্য চিন্তিত হয়ো না আর আনন্দিত হয়ে যাও সেই জান্নাতের জন্য, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেওয়া হত। আমরা পার্থিব জীবনেও তোমাদের সাথী ছিলাম এবং আখেরাতেও থাকব। জান্নাতে তোমাদের জন্য আছে এমন সব কিছুই, যা তোমাদের অন্তর চাবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আছে এমন সব কিছুই যার ফরমায়েশ তোমরা করবে, অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (আল্লাহ)-এর পক্ষ হতে প্রাথমিক আতিথেয়তাস্বরূপ। [সুরা হা-মীম আস-সিজদাহ্ /(ফুছছিলাত) : (৪১) : 30-32] |
قَالَ اللهُ تَعَالَى : ﴿إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ (17) مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ﴾ [ق: 17-18] | অনুবাদ: 33. সেই সময়ও, যখন (কর্ম) লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতাদ্বয় লিপিবদ্ধ করে একজন ডান দিকে এবং একজন বাম দিকে বসা থাকে। মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত আছে, যে (লেখার জন্য) সদা প্রস্তুত। [সুরা ক্বাফ : (৫০) : 17-18] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
তিনি তাঁর সৃষ্টিতে যা-ইচ্ছা বৃদ্ধি করেন : পূর্বের বাক্যের সাথে মিলিয়ে দেখলে এর অর্থ হয় এই যে, আল্লাহ তায়ালা যে ফেরেশতার পাখা-সংখ্যা বাড়াতে চান বাড়িয়ে দেন। সুতরাং হাদীস দ্বারা জানা যায়, জিবরাঈল আলাইহিস সালামের ছয়শত পাখা আছে। কিন্তু শব্দ সাধারণ হওয়ায় যে-কোনও সৃষ্টিই এর অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টির যাকে ইচ্ছা হয় তাকে বিশেষ কোন গুণ বেশি দান করেন।
তাদেরকে সকল মন্দ বিষয় থেকে রক্ষা কর : ‘মন্দ বিষয়’ দ্বারা জাহান্নামের কষ্ট বোঝানো হয়েছে অথবা তারা দুনিয়ায় যেসব মন্দ কাজ করেছে তা। দ্বিতীয় অবস্থায় এর অর্থ হবে, তাদেরকে দুনিয়ায় কৃত মন্দ কাজের পরিণাম থেকে রক্ষা কর, তথা সেগুলো ক্ষমা করে দাও।
(কর্ম) লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতাদ্বয় লিপিবদ্ধ করে : অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা মানুষের সমস্ত ভালো-মন্দ কাজের রেকর্ড রাখার জন্য দু’জন ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন। তারা সর্বদা তার ডান ও বাম পাশে উপস্থিত থাকে। এ ব্যবস্থা কেবল এজন্যই করা হয়েছে যে, যাতে কিয়ামতের দিন প্রমাণ হিসেবে মানুষের সামনে তার সে আমলনামা পেশ করা যায়। নচেৎ মানুষের কর্ম সম্পর্কে জানার জন্য আল্লাহ তায়ালার অন্য কারও সাহায্য গ্রহণের প্রয়োজন নেই। তিনি মানুষের অন্তরে যেসব কল্পনা জাগে সে সম্পর্কেও অবহিত। তিনি মানুষের গলদেশের শিরা অপেক্ষাও তার বেশি কাছে।
ক্রমিক নং : ৩৪ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: يَتَعَاقَبُونَ فِيكُمْ مَلَائِكَةٌ بِاللَّيْلِ وَمَلَائِكَةٌ بِالنَّهَارِ. وَيَجْتَمِعُونَ فِي صَلَاةِ الْعَصْرِ وَصَلَاةِ الْفَجْرِ. ثُمَّ يَعْرُجُ الَّذِينَ بَاتُوا فِيكُمْ، فَيَسْأَلُهُمْ وَهُوَ أَعْلَمُ بِهِمْ: كَيْفَ تَرَكْتُمْ عِبَادِي؟ فَيَقُولُونَ: تَرَكْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّونَ، وَأَتَيْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّونَ.[[23]] | অনুবাদ: . আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কাছে পালাক্রমে এক দল ফিরিশতা রাতে এবং এক দল ফিরিশতা দিনে আসতে থাকেন এবং তারা– উভয় দল ফজর ও আসরের নামাযে একত্র হন। এরপর যারা তোমাদের মাঝে রাত্রি যাপন করেছিলেন তাঁরা উর্ধ্বলোকে চলে যান। এরপর তাঁদের প্রতিপালক তাদেরকে প্রশ্ন করেন, অথচ তিনি তাঁদের চেয়ে অধিক জ্ঞাত– তোমরা আমার বান্দাদের কি অবস্থায় রেখে এলে? তখন তাঁরা বলেন আমরা যখন তাদেরকে রেখে আসি তখনও তারা নামায আদায় করছিলেন আর যখন তাদের কাছে গিয়েছিলাম তখনও তারা আদায় করছিলেন। |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : তোমাদের কাছে পালাক্রমে এক দল ফিরিশতা রাতে এবং এক দল ফিরিশতা দিনে আসতে থাকেন। অর্থাৎ, প্রতিনিয়ত দুই দল ফেরেশতা পৃথিবীতে আগমন করে। দিনের ফেরেশতা ফজরের পূর্বে আগমন করে এবং আসরের পরে আকাশে চলে যায়। আর রাতের ফেরেশতা আসরের পূর্বে আসে এবং ফজরের পরে আকাশে উঠে যায়। সুতরাং ফজরের ওয়াক্তে এবং আসরের ওয়াক্তে উভয় দল পরস্পর মিলিত হয়। এখানে ফেরেশতা দ্বারা বান্দার আমল সংরক্ষণকারী ফেরেশতা উদ্দেশ্য। তবে কারো কারো মতে, অন্য ফেরেশতাও উদ্দেশ্য হতে পারে।
ক্রমিক নং : ৩৫ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِنَّ اللهَ إِذَا أَحَبَّ عَبْدًا نَادَى جِبْرِيلَ أنَّ اللهَ قَدْ أَحَبَّ فُلَانًا فَأَحِبَّهُ. فَيُحِبُّهُ جِبْرِيلُ. ثُمَّ يُنَادِي جِبْرِيلُ فِي السَّمَاءِ: إِنَّ اللهَ قَدْ أَحَبَّ فُلَانًا فَأَحِبُّوهُ. فَيُحِبُّهُ أَهْلُ السَّمَاءِ، وَيُوضَعُ لَهُ الْقَبُولُ فِي أَهْلِ الْأَرْضِ. | অনুবাদ: . আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালবাসেন, তখন তিনি জিবরাঈলকে ডেকে বলেন, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালবাসেন, তাই তুমিও তাকে ভালবাস। সুতরাং জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) তাকে ভালবাসেন। তারপর জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) আসমানে এ ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালবাসেন, তোমরাও তাকে ভালবাস, তখন তাকে আসমানবাসীরা ভালবাসে এবং যমীনবাসীদের মাঝেও তাকে মকবুল করা হয়।[24] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : বান্দাকে আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসার আলামত ও তা অর্জনে সচেষ্ট থাকার প্রতি উৎসাহদান
কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, এমন অনেক আমল আছে, যা আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসার প্রমাণ বহন করে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি সেসব আমল করে, আল্লাহ তায়ালা তাকে ভালোবাসেন। এটা তো সত্য যে, মানুষ মাত্রই আল্লাহ তায়ালাকে ভালোবাসে, যদি না কোনও কারণে তার মানসিক ও মানবিক বিকৃতি ঘটে গিয়ে থাকে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালাকে ভালোবাসলেই যে তাঁরও ভালোবাসা পাওয়া যাবে এটা অনিবার্য নয়। তাঁর ভালোবাসা পাওয়া যাবে কেবল তখনই, যখন তাঁর পসন্দমত কাজও করা হবে। বস্তুত শরীআত যেসব কাজের আদেশ করেছে তা করা এবং যা নিষেধ করেছে তা থেকে বিরত থাকাই আল্লাহ তায়ালার পসন্দ। সুতরাং কেবল তাঁরই ভালোবাসায় উজ্জীবিত হয়ে যে ব্যক্তি শরীআত পালন করবে, সে আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা পাবেই। তারপরও সুনির্দিষ্টভাবেও কোনও কোনও আমল সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে, তাতে লিপ্ত থাকলে আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা পাওয়া যায়। এমনিভাবে কোনও কোনও গুণ সম্পর্কেও স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে যে, তার অধিকারী হতে পারাটা আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা পাওয়ার আলামত। সেগুলো যখন আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা পাওয়ার আলামত, তখন প্রত্যেক আল্লাহপ্রেমিকের উচিত মনেপ্রাণে সেসব আমল করতে সচেষ্ট থাকা, সেসকল গুণ অর্জনের সাধনায় রত থাকা।
যারা আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দা, সাধারণত মানুষ তাদের ভালোবাসে।। ওলী-বুযুর্গগণ পৃথিবীর সমস্ত মাখলূকের ভালোবাসা পায়। তারা সর্বজনপ্রিয় হয়ে যায়। অন্যদিকে পাপী ও অসৎকর্মশীলদের সকলে ঘৃণা করে। এর রহস্য কী? আলোচ্য হাদীছে এর জবাব দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর কোনও বান্দাকে ভালোবাসলে তিনি জিবরীল আলাইহিস সালামকে তাকে ভালোবাসতে হুকুম দেন। ফলে জিবরীল আলাইহিস সালাম তাকে ভালোবাসেন। তারপর তাকে ভালোবাসে সকল আসমানবাসী। তারপর পৃথিবীবাসীদের অন্তরে তার প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করে দেওয়া হয়। তাকে সকলের কাছে মকবূল করে তোলা হয়। সে হয়ে যায় সকলের প্রিয়। বোঝা গেল, পৃথিবীতে কারও সর্বজনপ্রিয় হওয়ার উৎস হলো আল্লাহর ভালোবাসা। আল্লাহ তায়ালা কাউকে ভালোবাসলেই সে সকলের প্রিয় হয়ে যায়। তাহলে কারও সর্বজনপ্রিয় হওয়াটা এ কথার আলামত যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে ভালোবাসেন।
প্রকাশ থাকে যে, কারও প্রতি আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা থাকার অর্থ তিনি তার কল্যাণ চান ও তাকে তার কৃতকর্মের জন্য পুরস্কৃত করেন। ফিরিশতাদের পক্ষ থেকে ভালোবাসার অর্থ তার জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা, তার দোজাহানের কল্যাণ কামনা করা এবং তার প্রতি তাদের আকর্ষণ বোধ করা। মাখলূকাতের ভালোবাসার অর্থ হলো তার প্রতি সুধারণা রাখা, শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রকাশ করা এবং সাধ্যানুযায়ী বিপদ-আপদ থেকে তাকে সুরক্ষা দেওয়া।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আল্লাহ তায়ালা কাউকে ভালোবাসেন তখনই, যখন সে আল্লাহর মর্জিমত চলে। যেমন পেছনের হাদীছে আছে, বান্দা নফল ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা আমার নিকটবর্তী হতে থাকে। একপর্যায়ে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। কুরআন মাজীদেও ইরশাদ হয়েছে,
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ الرَّحْمَنُ وُدًّا
‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, নিশ্চয়ই দয়াময় (আল্লাহ) সত্বর তাদের জন্য সৃষ্টি করবেন ভালোবাসা।
এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে
إن العبد ليلتمس مرضاة الله، فلا يزال بذلك، فيقول الله لجبريل : إن فلانا عبدي يلتمس أن يرضيني، ألا وإن رحمتي عليه، فيقول جبريل : رحمة الله على فلان ويقولها حملة العرش، ويقولها من حولهم، حتى يقولها أهل السماوات السبع ثم تهبط له إلى الأرض
বান্দা নিরবচ্ছিন্নভাবে নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি সন্ধানে লিপ্ত থাকে। শেষে আল্লাহ জিবরীলকে বলেন, আমার অমুক বান্দা আমাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টায় লেগে আছে। শুনে রাখ, তার উপর আমার রহমত রয়েছে। জিবরীল বলেন, অমুকের উপর আল্লাহর রহমত। তারপর আরশবাহী ফিরিশতাগণও বলেন, অমুকের উপর আল্লাহর রহমত। একই কথা বলেন আরশের চারপাশের ফিরিশতাগণ। তারপর সাত আসমানের অধিবাসীগণও সে কথা বলে থাকে। তারপর পৃথিবীতে তার উপর রহমত বর্ষিত হয়।
মুসলিম শরীফের বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, কারও প্রতি মানুষের অন্তরে ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা জন্মানোরও মূল কারণ এটাই যে, সে প্রথমে আল্লাহ তায়ালার কাছে অপ্রিয় হয়ে গেছে। আল্লাহ তায়ালার কাছে অপ্রিয় হয়ে যাওয়ার কারণে পর্যায়ক্রমে সে সাত আসমানের ফিরিশতাদের কাছে অপ্রিয় হয়ে যায়। সবশেষে পৃথিবীবাসীর কাছেও তাকে অপ্রিয় করে তোলা হয়।
আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রিয় হওয়ার কারণ যেমন ছিল তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা, তেমনি তাঁর কাছে অপ্রিয় হওয়ার কারণ তাঁর আদেশ-নিষেধ অমান্য করা। সুতরাং কারও দ্বারা নাফরমানির কাজ হওয়া আল্লাহর কাছে তার অপ্রিয় হওয়ার আলামত।
হাদীস থেকে শিক্ষা :–
ক. কারও প্রতি ব্যাপকভাবে মানুষের অন্তরে সমাদর ও শ্রদ্ধাভক্তি থাকা আল্লাহ তায়ালার কাছে তার প্রিয় হওয়ার আলামত।
খ. জনমনে কারও ঘৃণ্য ও ধিকৃত হওয়াটা আল্লাহর কাছে তার অপ্রিয় হওয়ার আলামত।
وَالكِتَابِ |
আল-কিতাব |
ক্রমিক নং : ৩৬-৩৭ | ||
আরবি | বাংলা | |
قَالَ اللهُ تَعَالٰى: ﴿الم ذَلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ ﴾ [البقرة: 1-2] | অনুবাদ: 36. আলিফ-লাম-মীম। এটি এমন কিতাব, যার মধ্যে কোনও সন্দেহ নেই। এটা হিদায়াত এমন ভীতি অবলম্বনকারীদের জন্য; [সুরা আল-বাকারা : (০২) : 1-2] | |
وَقَالَ اللهُ تَعَالٰى: ﴿آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ﴾ [البقرة: 285] | অনুবাদ: 37. রাসূল (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাতে ঈমান এনেছে, যা তাঁর উপর তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ হতে নাজিল করা হয়েছে এবং (তাঁর সাথে) মুমিনগণও। তাঁরা সকলে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফিরিশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছে। (তারা বলে,) আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোনও পার্থক্য করি না (যে, কারও প্রতি ঈমান আনব এবং কারও প্রতি আনব না)। এবং তাঁরা বলে, আমরা (আল্লাহ ও রাসূলের বিধানসমূহ মনোযোগ সহকারে) শুনেছি এবং তা (খুশীমনে) পালন করছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার মাগফিরাতের ভিখারী, আর আপনারই কাছে আমাদের প্রত্যাবর্তন। [সুরা আল-বাকারা : (০২) : 285] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
আলিফ-লাম-মীম : বিভিন্ন সুরার শুরুতে এ রকমের হরফ এভাবেই পৃথক-পৃথকরূপে নাজিল হয়েছিল। এগুলোকে আল-হুরূফুল মুকাত্তাআত (বিচ্ছিন্ন হরফসমূহ) বলে। এগুলোর অর্থ ও মর্ম সম্পর্কে সঠিক কথা এই যে, তা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কারও জানা নেই। এটা আল্লাহ তায়ালার কিতাবের এক নিগূঢ় রহস্য। এ নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধানের কোনও প্রয়োজন নেই। কেননা এর অর্থ বোঝার উপর আকীদা ও আমলের কোনও মাসআলা নির্ভরশীল নয়।
যার মধ্যে কোনও সন্দেহ নেই : অর্থাৎ এ কিতাবের প্রতিটি কথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য। মানব-রচিত কোনও গ্রন্থকে শত ভাগ সন্দেহমুক্ত বলে বিশ্বাস করা যায় না। কেননা মানুষ যত বড় জ্ঞানীই হোক তার জ্ঞানের একটা সীমা আছে। তাছাড়া তার রচনার ভিত্তি হয় তার ব্যক্তিগত ধারণা-ভাবনার উপর। কিন্তু এ কুরআন যেহেতু আল্লাহ তায়ালার কিতাব, যার জ্ঞান সীমাহীন এবং শত ভাগ সন্দেহাতীত, তাই এতে কোনও রকম সংশয়-সন্দেহের অবকাশ নেই। যদি কারও মনে সন্দেহ দেখা দেয়, তবে তা তার বুঝের কমতির কারণেই দেখা দেবে, না হয় এ কিতাবের কোনও বিষয় সন্দেহপূর্ণ নয় আদৌ।
এটা হিদায়াত এমন ভীতি অবলম্বনকারীদের জন্য : যদিও কুরআন মাজীদ মুমিন-কাফির নির্বিশেষে সকলকেই সঠিক পথ দেখায় এবং এ হিসেবে কুরআনের হিদায়াত সকলের জন্যই অবারিত, কিন্তু ফলাফলের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় কুরআনী হিদায়াত দ্বারা উপকার কেবল তারাই লাভ করতে পারে, যারা এর প্রতি বিশ্বাস রেখে এর সমস্ত বিধি-বিধান ও শিক্ষামালার অনুসরণ করে। এ কারণেই বলা হয়েছে, ‘এটা হিদায়াত এমন ভীতি অবলম্বনকারীদের জন্য, যারা অদৃষ্ট জিনিসসমূহে ঈমান আনে…’। ভীতি অবলম্বনের অর্থ হল অন্তরে সর্বদা এই চেতনা জাগ্রত রাখা যে, একদিন আল্লাহ তায়ালার দরবারে আমাকে আমার সমস্ত কর্মের জবাবদিহী করতে হবে। কাজেই আমার এমন কোনও কাজ করা উচিত হবে না, যা তাঁর অসন্তুষ্টির কারণ হতে পারে। এই ভয় ও চেতনারই নাম তাকওয়া। অদৃশ্য ও নাদেখা জিনিসসমূহের জন্য কুরআন মাজীদ ‘গায়ব’ শব্দ ব্যবহার করেছে। এর দ্বারা এমন সব বিষয় বোঝানো উদ্দেশ্য, যা চোখে দেখা যায় না, হাতে ছোঁয়া যায় না এবং নাক দ্বারা শুঁকেও উপলব্ধি করা যায় না; বরং তা কেবলই আল্লাহ তায়ালার ওহীর মাধ্যমে জানা সম্ভব। অর্থাৎ হয়ত কুরআন মাজীদের ভেতর তার উল্লেখ থাকবে অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহী মারফত জেনে আমাদেরকে তা অবহিত করবেন। যেমন আল্লাহ তায়ালার গুণাবলী, জান্নাত ও জাহান্নামের অবস্থাদি, ফিরিশতা প্রভৃতি। এ স্থলে আল্লাহ তায়ালার নেক বান্দাদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে যে, তারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীসমূহের প্রতি মনে-প্রাণে বিশ্বাস রেখে সেই সকল জিনিসকে সত্য বলে স্বীকার করে, যা তারা দেখেনি। এ দুনিয়া মূলত পরীক্ষার স্থান। সেই অদৃশ্য বিষয়াবলী যদি চোখে দেখা যেত, তারপর কেউ তাতে বিশ্বাস করত, তবে তা কোনও পরীক্ষা হত না। আল্লাহ তায়ালা সেসব জিনিসকে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে রেখেছেন, কিন্তু বাস্তবে যে তার অস্তিত্ব আছে, তার সম্পর্কে অসংখ্য দলীল-প্রমাণ সামনে রেখে দিয়েছেন। যে-কেউ ইনসাফের সাথে তাতে চিন্তা করবে, সে গায়বী বিষয়াবলীর প্রতি সহজেই ঈমান আনতে পারবে, ফলে পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হবে। কুরআন মাজীদও সেসব প্রমাণ পেশ করেছে, যা ইনশাআল্লাহ একের পর এক আসতে থাকবে। প্রয়োজন কেবল কুরআন মাজীদকে সত্য-সন্ধানের প্রেরণায় নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পড়া এবং অন্তরে এই চিন্তা রাখা যে, এটা হেলাফেলা করার মত কোনও বিষয় নয়। এটা মানুষের স্থায়ী জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতার বিষয়। কাজেই অন্তরে এই ভয় জাগ্রত রাখা চাই যে, পাছে আমার কুপ্রবৃত্তি ও মনের খেয়াল-খুশী কুরআন মাজীদের দলীল-প্রমাণ যথাযথভাবে বোঝার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমাকে কুরআন প্রদত্ত হিদায়াত ও পথ-নির্দেশকে সত্য-সন্ধানের প্রেরণা নিয়ে পড়তে হবে এবং আগে থেকে অন্তরে যেসব চিন্তা-চেতনা শিকড় গেড়ে আছে তা থেকে অন্তরকে মুক্ত করে পড়তে হবে, যাতে সত্যিকারের হিদায়াত আমি লাভ করতে পারি। ‘কুরআন যে ভীতি-অবলম্বনকারীদের জন্য হিদায়াত’ তার এক অর্থ এটাও।
وَالنَّبِيِّيْنَ |
নবীগণ |
ক্রমিক নং : ৩৮ | ||
আরবি | বাংলা | |
قَالَ اللهُ تَعَالٰى: ﴿قُولُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنْزِلَ إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَى وَعِيسَى وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِنْ رَبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ صِبْغَةَ اللَّهِ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ صِبْغَةً وَنَحْنُ لَهُ عَابِدُونَ﴾ [البقرة: 136-138] | অনুবাদ: 38. (হে মুসলিমগণ!) বলে দাও যে, আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি এবং সেই বাণীর প্রতিও, যা আমাদের উপর নাজিল করা হয়েছে এবং তার প্রতিও, যা ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাঁদের সন্তানদের প্রতি নাজিল করা হয়েছে এবং তার প্রতিও, যা মূসা ও ঈসাকে দেওয়া হয়েছিল এবং তার প্রতিও, যা অন্যান্য নবীগণকে তাঁদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে দেওয়া হয়েছিল। আমরা এই নবীগণের মধ্যে কোনও পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁরই (এক আল্লাহরই) অনুগত। অতঃপর তারাও যদি সে রকম ঈমান আনে যেমন তোমরা ঈমান এনেছ, তবে তারা সঠিক পথ পেয়ে যাবে। আর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তারা মূলত শত্রুতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে। সুতরাং শীঘ্রই আল্লাহ তোমার সাহায্যার্থে তাদের দেখে নেবেন এবং তিনি সকল কথা শোনেন ও সবকিছু জানেন। (হে মুসলিমগণ! বলে দাও, আমাদের উপর তো) আল্লাহ নিজ রং আরোপ করেছেন। কে আছে, যে আল্লাহ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট রং আরোপ করতে পারে? আর আমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করি। [সুরা আল-বাকারা : (০২) : 136-138] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
আমরা এই নবীগণের মধ্যে কোনও পার্থক্য করি না : অর্থাৎ আমরা সকল রাসূল ও সমস্ত কিতাবে বিশ্বাস রাখি এবং সকলকেই সত্য ও আপন-আপনকালে অনুসরণীয় মনে করি। আমরা আল্লাহর বাধ্যগত, তিনি যখন যে নবী পাঠান এবং তার মাধ্যমে যে বিধান দেন তাকে শিরোধার্য মনে করি। কিন্তু কিতাবীগণ তাদের নিজ-নিজ ধর্ম ছাড়া অন্যসব ধর্মকে ও অন্য সকল নবীকে প্রত্যাখ্যান করে এবং রহিত হওয়া সত্ত্বেও নিজ ধর্মকেই আঁকড়ে ধরে রাখে। অথচ তাদের আপন আপন নবী ও কিতাবের শিক্ষা অনুযায়ী উচিত ছিল- শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের পর তাঁর প্রতিও ঈমান আনা এবং পুরানো শরীআত ছেড়ে দিয়ে তাঁর আনীত শরীয়াতেরই অনুসরণ করা, যেহেতু তিনিই সর্বশেষ ও সার্বজনীন নবী, তাঁর মাধ্যমে নবুওয়াতের সিলসিলা সমাপ্ত হয়ে গেছে’, তাঁর পর নতুন কোনও নবী এবং নতুন কোনও কিতাব ও শরীআত আসার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং এখন ইহুদী-খৃস্টান, আরব-অনারব নির্বিশেষে সারা বিশ্বের সমস্ত মানুষের জন্য ফরয তাঁর প্রতি ঈমান এনে তাঁর শরীআত মেনে চলা।
কে আছে, যে আল্লাহ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট রং আরোপ করতে পারে? : এতে খ্রিস্টানদের ‘বাপটাইজ’ (তরিকাবন্দী) প্রথার প্রতি ইশারা করা হয়েছে। বাপটাইজ করানোকে ‘ইসতিবাগ’ (রং মাখানো)-ও বলা হয়। কোনও ব্যক্তিকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দেওয়ার সময় রঙিন পানিতে গোসল করানো হয়। তাদের ধারণা, এতে তার সত্তায় খ্রিস্ট ধর্মের রং লেগে যায়। এভাবে নবজাতক শিশুকেও বাপটাইজ করানো হয়। কেননা তাদের বিশ্বাস মতে প্রতিটি শিশু মায়ের পেট থেকে পাপী হয়েই জন্ম নেয়। বাপটাইজ না করানো পর্যন্ত সে গুনাহগারই থেকে যায় এবং সে ইয়াসূ মাসীহের কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত)-এর হকদার হয় না। কুরআন মাজীদ ইরশাদ করছে- মাথামু-হীন এই ধারণার কোনও ভিত্তি নেই। কোনও রঙে যদি রঙিন হতেই হয়, তবে আল্লাহ তায়ালার রং তথা খাঁটি তাওহীদকে অবলম্বন কর। এর চেয়ে উত্তম কোনও রং নেই।
وَ اٰتَی المَالَ عَلٰی حُبِّه |
আর মাল প্রদান করে আল্লাহর ভালোবাসায় |
আরবি | বাংলা |
قَالَ اللهُ تَعَالٰى: ﴿ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ﴾ [البقرة: 177] | অনুবাদ: . আর আল্লাহর ভালোবাসায় নিজ সম্পদ দান করে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, মুসাফির ও সওয়ালকারীদেরকে এবং দাসমুক্তিতে; [সুরা আল-বাকারা : (০২) : 177] |
ক্রমিক নং : ৩৯ | |
আরবি | বাংলা |
قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ الله! أَيُّ الصَّدَقَةِ أَعْظَمُ أَجْرًا؟ قَالَ: أَنْ تَصَدَّقَ وَأَنْتَ صَحِيحٌ شَحِيحٌ تَخْشَى الْفَقْرَ وَتَأْمُلُ الْغِنَى، وَلَا تُمْهِلُ حَتَّى إِذَا بَلَغَتْ الْحُلْقُومَ قُلْتَ: لِفُلَانٍ كَذَا وَلِفُلَانٍ كَذَا! وَقَدْ كَانَ لِفُلَانٍ. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ) | অনুবাদ: . আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক সাহাবি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন সাদ্কার সাওয়াব বেশী পাওয়া যায়? তিনি বললেন, কৃপণ অবস্থায় তোমার সাদ্কা করা, যখন তুমি দারিদ্রের আশঙ্কা করবে ও ধনী হওয়ার আশা রাখবে। সাদ্কা করতে দেরী করবে না। অবশেষে যখন প্রাণবায়ু কন্ঠাগত হবে, আর তুমি বলতে থাকবে, অমুকের জন্য এতটুকু, অমুকের জন্য এতটুকু, অথচ তা অমুকের জন্য হয়ে গেছে।[25] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ বর্ণনায় আছে, জনৈক সাহাবি দান-সদাকার শ্রেষ্ঠ সময় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। ইনি কে তা জানা যায় না। তবে হাফিজ ইব্ন হাজার আসকালানী রহ সম্ভাবনা ব্যক্ত করেন যে, ইনি আবূ যর গিফারী রাদি. হতে পারেন। কেননা মুসনাদে আহমাদ ও তবারানীর বর্ণনা দ্বারা জানা যায় যে, তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ জাতীয় প্রশ্ন করেছিলেন। তো সাহাবির প্রশ্নের জবাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দানখয়রাতের শ্রেষ্ঠ সময়ের কথা বলে দিয়েছেন। বলেছেন যে, ওই সময়ের দান শ্রেষ্ঠ যখন তুমি সুস্থ ও সবল। এই সময় দান করা শ্রেষ্ঠ এজন্য যে, এ সময়কার দানখয়রাতে ইখলাস বেশি থাকে। যে-কোনও আমলে ইখলাস যত বেশি থাকে, ছাওয়াবও তত বেশি হয়।
সুস্থ অবস্থায় ইখলাস বেশি থাকে এ কারণে যে, তখন বেঁচে থাকার আশা প্রবল থাকে। সুস্থ-সবল শরীরে মনে হয় অনেকদিন বাঁচব। অনেক দিন বাঁচলে অনেক সম্পদের দরকার হয়। তাই এ সময় টাকাপয়সা হাত থেকে ছাড়তে ইচ্ছা হয় না। কারণ টাকাপয়সা যদি না থাকে আর আমি বেঁচে থাকি, তখন চলবে কী করে? অর্থের অভাবে কষ্ট ভোগ করতে হবে। সে কষ্ট যাতে ভোগ করতে না হয় তাই বেশি বেশি সঞ্চয় করে রাখা দরকার। তাই এ সময় মানুষ খুব সঞ্চয় করে। এ কারণে মালের প্রতি মহব্বতও বেড়ে যায়। ফলে এ অবস্থায় দানখয়রাত করতে খুব কষ্ট বোধ হয়। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। মালের মহব্বত ছাড়তে হয়। তা সত্ত্বেও যদি দানখয়রাত করে, তবে প্রমাণ হয় সে মালের মহব্বতের উপর আল্লাহর মহব্বতকে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং দুনিয়ার উপর আখিরাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এটা ইখলাসের পরিচায়ক। এজন্যই সুস্থাবস্থায় দানখয়রাত করলে ছাওয়াব বেশি হয়।
এ হাদিসের একটি শব্দ হল شحيح।এ শব্দটি الشح থেকে নির্গত। যার অর্থ লোভলালসার কারণে কৃপণতা। অর্থাৎ অর্থসম্পদের প্রতি লোভ থাকার কারণে তা খরচ করতে না চাওয়া ও কৃপণতা করা।
কোনও ব্যক্তি যদি সুস্থ-সবল থাকে আবার তখন অর্থসম্পদের প্রতি তার অন্তরে লোভলালসাও থাকে, যে কারণে তা আল্লাহর পথে খরচ করতে মন একদম প্রস্তুত হয় না, যখনই খরচের কোনও ক্ষেত্র আসে তখনই মালের লোভ ও কৃপণতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তার পক্ষে খরচ করা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কেননা এ অবস্থায় আল্লাহর পথে খরচ করতে হলে মনের সঙ্গে লড়াই করতে হয় এবং লোভ ও কৃপণতার বাধা দূর করতে হয়। অনেকেই তা করতে সক্ষম হয় না। ফলে দানখয়রাতের ছাওয়াব থেকে সে বঞ্চিত থেকে যায়। এ হাদীছে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যে, তোমরা যদি দানখয়রাতের বিপুল ছাওয়াবের অধিকারী হতে চাও, তবে বিলম্ব না করে সুস্থ অবস্থায় যখন অন্তরে মালের লোভ ও কৃপণতা থাকে, তখন মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে হলেও দানখয়রাতে রত হও।
হাদীছে বলা হয়েছে- যখন দারিদ্র্যের ভয় হয় ও সচ্ছলতার আশা করা হয়, তখনকার দানখয়রাতে ছাওয়াব বেশি হয়। কেননা এ অবস্থায়ও দানখয়রাত করতে হলে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। শয়তান প্ররোচনা দেয় যে, দানখয়রাত করলে তুমি গরীব হয়ে যাবে। পরে কী খেয়ে বাঁচবে? কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الفَقْرَ অর্থ : শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায়। সুরা বাকারা, আয়াত ২৬৮
শয়তান এ ভয় দেখায় মানুষ যখন সুস্থ-সবল থাকে। যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন তো মৃত্যুভয় প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে কবরে কিছু পুণ্য নিয়ে যাওয়ার আশায় তখন দানখয়রাত করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। তখন শয়তান ধোঁকা দিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। তার ধোঁকা সফল হয় মানুষের সুস্থতাকালে। আল্লাহ তায়ালা বড় মেহেরবান। তিনি বান্দাদের সতর্ক করছেন যে, তোমরা ওর ধোঁকায় পড়ো না। আল্লাহর উপর ভরসা করে দানখয়রাত করতে থাক। তাহলে তাঁর কাছে মাগফিরাত লাভ করতে পারবে এবং তিনি তোমাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করবেন। তাঁর অনুগ্রহে তোমরা দানখয়রাতের কারণে অভাব-অনটনে পড়বে না। আল্লাহর ভাণ্ডার অফুরন্ত। তোমরা যদি তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর পথে খরচ কর, তবে তিনি তাঁর অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে তোমাদেরকে তোমাদের কল্পনার বাইরে বদলা দান করবেন। দুনিয়া ও আখিরাত সব জায়গায় তোমাদেরকে পুরস্কৃত করবেন। সুতরাং তিনি ইরশাদ করেন,
وَاللَّهُ يَعِدُكُمْ مَغْفِرَةً مِنْهُ وَفَضْلًا وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
অর্থ : আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আল্লাহ ঐশ্বর্যময়, সর্বজ্ঞানী। -সুরা বাকারা, আয়াত ২৬৮
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের প্রাণ যখন তোমাদের কণ্ঠনালিতে পৌঁছে যাবে অর্থাৎ যখন মৃত্যু উপস্থিত হবে, সেইসময় পর্যন্ত বিলম্ব করে না। কেননা সেই সময়কার দানখয়রাতে বিশেষ মূল্য নেই। তখন তো মানুষ জীবন থেকে হতাশ হয়ে যায়। ফলে অর্থসম্পদের কোনও মহব্বত তখন থাকে না। সে জানে সারা জীবন যা-কিছু সঞ্চয় করেছে, এখন তা সব ছেড়েই কবরে চলে যেতে হবে, কিছুই সঙ্গে নেওয়া যাবে না। যা সঙ্গে নেওয়া যাবে না তা দান করতে কোনও ত্যাগের প্রশ্ন নেই। তাই এ দান মনের দানশীলতা থেকে হয় না। নেহাত বাধ্য হয়েই তা করে থাকে। তাই এ দানের বিশেষ ফযীলত নেই। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لأن يتصدق المرء في حياته وصحته بدرهم خير له من أن يتصدق بمئة درهم عند موته
“সুস্থ-সবল অবস্থায় কোনও ব্যক্তির এক দিরহাম দান করা মৃত্যুকালে তার একশ’দিরহাম দান করা অপেক্ষাও উত্তম।সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৩৩৩৪। সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ২৮৬৬.
অপর এক হাদীছে আছে,
مثل الذي يعتق عند الموت، كمثل الذي يهدي إذا شبع.
“যে ব্যক্তি মৃত্যুকালে গোলাম আযাদ করে সে ওই ব্যক্তির মত, যে পেট ভরে খাওয়ার পর হাদিয়া দেয়।সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৩৯৬৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৭৫৩২; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১২৩
বরং মৃত্যুকালীন কোনও কোনও দান জায়েযও হয় না। এ সময় সে কেবল পারে ঋণ পরিশোধ করতে এবং তিনভাগের একভাগ সম্পদের মধ্যে অসিয়ত করতে। এর বাইরে আর কিছু করার অধিকার তার থাকে না। কেননা তখন তাতে ওয়ারিশদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তাই দানখয়রাত করে ছাওয়াব পেতে চাইলে মৃত্যুকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না; বরং তার আগেই সুস্থাবস্থায় করতে হবে।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মৃত্যুকালে তুমি যদি বল ‘অমুকের এতটুকু এবং অমুকের এতটুকু’, তার কী ফায়দা? তা তো অমুকের এমনিই হয়ে যায়। অর্থাৎ তুমি মারা গেলে তোমার ওয়ারিশগণ সে সম্পদ এমনিই পেয়ে যাবে। আর কেউ যদি পাওনাদার থাকে, তবে সেও তোমার সম্পদ থেকে তার প্রাপ্য অংশ পেয়ে যাবে। কাজেই এ সময় ‘অমুকের এত অমুকের এত’ বলার কোনও সার্থকতা থাকে না। যা দান করবার তা আগেই করে ফেল। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ وَأَنْفِقُوا مِنْ مَا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَا أَخَّرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُنْ مِنَ الصَّالِحِينَ وَلَنْ يُؤَخِّرَ اللَّهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমাদের অর্থসম্পদ ও তোমাদের সন্তানসন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে। যারা এ রকম করবে (অর্থাৎ গাফেল হবে) তারাই (ব্যবসায়) ক্ষতিগ্রস্ত। আমি তোমাদেরকে যে রিয্ক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) ব্যয় কর, এর আগে যে, তোমাদের কারও মৃত্যু এসে যাবে আর তখন বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে কিছুকালের জন্য সুযোগ দিলে না কেন, তাহলে আমি দান-সদাকা করতাম এবং নেক লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম! যখন কারও নির্ধারিত কাল এসে যাবে তখন আল্লাহ তাকে কিছুতেই অবকাশ দেবেন না। আর তোমরা যা-কিছু কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবহিত।- সুরা মুনাফিকূন, আয়াত ৯-১১
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. এ হাদীছও ‘ইবাদত-বন্দেগী ও দানখয়রাতে অগ্রগামী হওয়ার শিক্ষা দেয়।
খ. এর দ্বারা আরও শিক্ষা পাওয়া যায়, সুস্থ অবস্থায় দানখয়রাত করাই প্রকৃত দানশীলতা। মৃত্যুকালে তো অর্থসম্পদ এমনিতেই হাতছাড়া হয়ে যায়।
গ. মৃত্যুকালে দানখয়রাতে সতর্কতা জরুরি, যাতে ওয়ারিশদেরকে তাদের হক থেকে বঞ্চিত করা না হয়।
ঘ. মানুষ যত বড় ধনীই হোক, মৃত্যুকালে সমস্ত ধনসম্পদ ফেলে রেখে একাকী কবরে যেতে হয়। প্রত্যেকের উচিত আগেভাগে সে ধনসম্পদ আল্লাহর পথে খরচ করে কবরের সঙ্গী যোগার করে নেওয়া।
ক্রমিক নং : ৪০ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ حَكِيمِ بْنِ حِزَامٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَال: الْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنْ الْيَدِ السُّفْلَى. وَابْدَأْ بِمَنْ تَعُولُ. وَخَيْرُ الصَّدَقَةِ عَنْ ظَهْرِ غِنًى. وَمَنْ يَسْتَعِفَّ يُعِفَّهُ اللهُ، وَمَنْ يَسْتَغْنِ يُغْنِهِ اللهُ. | অনুবাদ: . হাকীম ইবনে হিযাম রাদি. থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম। তুমি যাদের লালন–পালন কর তাদের থেকে খরচ শুরু কর। উৎকৃষ্ট দান সেটাই যা অভাবমুক্ততা রক্ষার সঙ্গে করা হয়। যে ব্যক্তি সংযমী হতে চায়, আল্লাহ তাকে সংযমী বানান। যে ব্যক্তি (মাখলূক থেকে) মুখাপেক্ষিতামুক্ত থাকতে চায় আল্লাহ তাকে মুখাপেক্ষিতামুক্ত রাখেন।[26] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষ পাঁচটি বিষয়ে উম্মতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন,
ক. নিচের হাত অপেক্ষা উপরের হাত শ্রেষ্ঠ হওয়া।
খ. খরচের খাতসমূহের মধ্যে অগ্রগণ্য কোনটি?
গ. দান-খয়রাতে কী নীতি অবলম্বন করা চাই?
ঘ. হাত না পাতার সুফল।
ঙ. আত্মিক ঐশ্বর্যের মাহাত্ম্য।
নিচের হাত অপেক্ষা উপরের হাত শ্রেষ্ঠ হওয়া
হাদীছটির প্রথম কথা হচ্ছে,
اليد العليا خير من اليد السفلى
(উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম)। নিচের হাত দ্বারা গ্রহণকারীর হাত এবং উপরের হাত দ্বারা দাতার হাত বোঝানো উদ্দেশ্য। দান করা না করা এবং গ্রহণ করা না করা হিসেবে মানুষের হাত চার প্রকার। দাতার হাত, সওয়ালকারীর হাত, দান গ্রহণ করা হতে বিরত ব্যক্তির হাত এবং বিনা সওয়ালে গ্রহণকারীর হাত।
এই চার প্রকারের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট হল দাতার হাত। উপরের হাত বলতে এ হাতই বোঝানো হয়েছে। কেননা বাহ্যত দাতার হাত গ্রহীতার হাতের উপরেই থাকে। আর যেহেতু সে দেয়, তাই মর্যাদায়ও তা শ্রেষ্ঠ বৈকি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, উপরের হাত কোন হাত? তিনি বলেন, যে হাত দান করে, গ্রহণ করে না।
দাতার হাত শ্রেষ্ঠ এ কারণে যে, দান করাটা আল্লাহ তায়ালার গুণ। সৃষ্টির সূচনা থেকে এ যাবতকাল তিনি শুধু দিয়েই যাচ্ছেন। কারও কাছ থেকে কিছু নেন না। বলাবাহুল্য আল্লাহর গুণই সর্বশ্রেষ্ঠ। বান্দাকে তাঁর গুণে গুণান্বিত হতে বলা হয়েছে। কাজেই যে হাত কারও কাছ থেকে কিছু নেয় না; বরং দেয়, অন্যসব হাত থেকে তা শ্রেষ্ঠ হবে তাতে সন্দেহ কী?
দ্বিতীয় স্তরের হল ওই ব্যক্তির হাত, যে কারও কাছে কিছু চাওয়া হতে বিরত থাকে। এমনকি বিনা চাওয়াতে দেওয়া হলেও গ্রহণ করে না। একে ইস্তিগনা বলে। হাদীছের শেষবাক্যে এর মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও যে কোনও মাখলূকের কাছে কিছু চায় না এবং মাখলূকের কাছ থেকে কিছু নেয়ও না, সে উচ্চস্তরের যাহিদ। সাহাবায়ে কেরামের শ্রেষ্ঠত্বের একটা কারণ তাঁরা শ্রেষ্ঠতম যাহিদ ছিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনৈক সাহাবিকে এই বলে উপদেশ দেন যে,
ازهد في الدنيا يحبك الله، وازهد فيما في أيدي الناس يحبك الناس
“দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত থাক, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। মানুষের হাতে যা আছে তা থেকে বিমুখ থাক, মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে।
আব্দুল্লাহ ইবন মাস’ঊদ রাদি. বলেন, তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবিদের তুলনায় অনেক বেশি সাধনা-মুজাহাদা করে থাক এবং তাদের তুলনায় নামাযও অনেক দীর্ঘ ও বেশি পড়। তা সত্ত্বেও তোমাদের তুলনায় তারা শ্রেষ্ঠ ছিলেন। জিজ্ঞাসা করা হল, তার কারণ? তিনি বললেন, তোমাদের তুলনায় তারা বেশি দুনিয়াবিমুখ ও বেশি আখেরাতমুখী ছিলেন।
সাহাবায়ে কেরামের পরও এ উম্মতের আকাবির-আসলাফের মধ্যে অনেকেই এমন ছিলেন, যারা নিজ উপার্জনেই সন্তুষ্ট থাকতেন। যত কষ্ট-ক্লেশই হোক না কেন, তারা মানুষের কাছে হাত তো পাততেনই না; বিনা চাওয়াতে দিলেও কিছু গ্রহণ করতেন না। একবার দাউদ তাঈ রহ.-এর অনাহারক্লিষ্ট অবস্থায় ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর পুত্র হাম্মাদ রহ. তাঁর কাছে দু’শ দিরহাম পেশ করে বললেন, এটা এমন এক ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে আনা হয়েছে, তাকওয়া-পরহেযগারী ও দুনিয়াবিমুখতায় আমি যারচে’ উত্তম কাউকে পাইনি, এমনকি হালাল উপার্জনেও নয়। আপনি এটা গ্রহণ করুন। তিনি বললেন, আমি কোনও মানুষের কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করলে এটা অবশ্যই গ্রহণ করতাম। এক তো মহান মৃত ব্যক্তি (ইমাম আবূ হানীফা) এর মর্যাদায়, দ্বিতীয়ত তাঁর জীবিত এ উত্তরাধিকারীর সম্মানে। কিন্তু আমি নিজের যা আছে তাতে পরিতুষ্টির মর্যাদা নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।
আমাদের মহান আকাবিরে দেওবন্দের প্রাণপুরুষ ইমাম কাসিম নানুতবী রহ. তো বটেই, তাঁর পরবর্তী অনুসারীদের মধ্যেও অনেকেই এ পর্যায়ের যাহিদ ছিলেন।
তৃতীয় স্তরের হাত সেই ব্যক্তির হাত, যে কারও কাছে চায় না বটে, তবে তাকে দেওয়া হলে সে তা গ্রহণ করে। বিনা চাওয়ায় কিছু দেওয়া হলে তা গ্রহণ করতে দোষ নেই। বরং এরূপ দান গ্রহণের জন্য উৎসাহই দেওয়া হয়েছে। যেমন উমর রাদি. থেকে বর্ণিত আছে,
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعطيني العطاء، فأقول: أعطه من هو أفقر إليه مني، فقال: خذه إذا جاءك من هذا المال شيء وأنت غير مشرف ولا سائل، فخذه ومالا فلا تتبعه نفسك
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে কিছু দান করতে চাইলে আমি বলতাম, এটা আমার চেয়ে যার বেশি প্রয়োজন তাকে দিন। এর উত্তরে তিনি বলেন, তুমি এটা নাও। তোমার কাছে যদি কোনও সম্পদ আসে আর তুমি তার প্রতি আগ্রহী না থাক এবং যাচনাকারীও না হও, তবে তা গ্রহণ কর। এরকম না হলে তুমি নিজেকে তার অনুগামী করো না।
চতুর্থ ও সর্বনিম্ন হল ওই ব্যক্তির হাত, যে মানুষের কাছে চায়ও এবং নিজে কিছু দেয়ও না। বিনা প্রয়োজনে মানুষের কাছে হাত পাতা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এরচে’ বরং যে-কোনও হালাল কাজ করা ভালো, তা মানুষের চোখে যতই নিম্নস্তরের কাজ হোক। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
والذي نفسي بيده لأن يأخذ أحدكم حبله، فيحتطب على ظهره خير له من أن يأتي رجلا، فيسأله أعطاه أو منعه
‘যাঁর হাতে আমার প্রাণ, সেই সত্তার কসম! তোমাদের কেউ রশি নিয়ে বের হয়ে যাবে, তারপর (তা দ্বারা) লাকড়ির বোঝা (বেঁধে) নিজ পিঠে করে নিয়ে আসবে, সেটাই এরচেয়ে ভালো যে, কারও কাছে গিয়ে সওয়াল করবে, যে তাকে দিতেও পারে, নাও দিতে পারে।
অন্যের কাছে সওয়াল করা চরম অমর্যাদাকর কাজ। এর দ্বারা নিজের আত্মসম্মান ধূলিসাৎ করা হয়। এরূপ ব্যক্তিকে হাশরের ময়দানেও চরম লাঞ্ছনাকর অবস্থায় উঠানো হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক হাদীছে আছে,
ما يزال الرجل يسأل الناس حتى يأتي يوم القيامة ليس في وجهه مزعة لحم
কোনও ব্যক্তি মানুষের কাছে সওয়াল করতে থাকে। পরিশেষে কিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় আসবে যে, তার চেহারায় গোশত বলতে কিছু থাকবে না।
চেহারা গোশতশূন্য হওয়াটা হীনতা ও লাঞ্ছনার নিদর্শন। কাজেই চরম ঠ্যাকা অবস্থা না হলে কারও কাছে হাত পাতা উচিত নয়। এর দ্বারা আত্মসম্মান নষ্ট হয় ও আখলাক-চরিত্র ধ্বংস হয়। প্রত্যেক ঈমানদারের এর থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।
খরচের খাতসমূহের মধ্যে অগ্রগণ্য কোটি
খরচে কাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, এ সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলোচ্য হাদীছে ইরশাদ করেন, وابدا بمن تعول (তুমি যাদের লালন পালন কর তাদের থেকে খরচ শুরু কর)। অর্থাৎ নিজ সত্তা, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, পিতামাতা এবং আরও যারা নিজ লালন-পালনাধীন থাকে, প্রথম খরচটা তাদের পেছনেই করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও যদি সকলের পেছনে খরচ করা সম্ভব হয় তবে তো সেটাই করবে, অন্যথায় প্রথমে খরচ করবে নিজের জন্য, তারপর কিছু বেঁচে থাকলে শিশুসন্তানের জন্য, তারপর স্ত্রীর জন্য, তারপর পিতা, তারপর মাতা, তারপর দাদা, তারপর বালেগ সন্তান- এ ধারাবাহিকতা অনুসরণ করবে। তারপরও বেঁচে থাকলে পর্যায়ক্রমে অন্যান্যদের মধ্যে খরচ করা হবে। পরিবারের লোককে বঞ্চিত করে অন্যত্র খরচ করা জায়েয নয়। নিজ পোষ্য হওয়ার কারণে তাদের জরুরত পূরণ করা ওয়াজিব ও অবশ্যকর্তব্য। অন্যসব খরচা হয়তো নফল পর্যায়ের অথবা ওয়াজিব হলেও তা এর পরবর্তী স্তরের। কাজেই এদেরকে পেছনে রাখার কোনও সুযোগ নেই।। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জনৈক সাহাবির হাতে কিছু দিরহাম দিয়ে তাঁকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে,
ابدأ بنفسك فتصدق عليها، فإن فضل شيء، فلأهلك، فإن فضل عن أهلك شيء فلذي قرابتك، فإن فضل عن ذي قرابتك شيء فهكذا وهكذا يقول فبين يديك وعن يمينك وعن شمالك
‘তুমি এটা সর্বপ্রথম খরচ করবে তোমার নিজের উপর। তারপর কিছু বেঁচে থাকলে তোমার পরিবার-পরিজনের উপর, তারপর কিছু বেঁচে থাকলে তোমার নিকটাত্মীয়দের উপর। তাদের উপর খরচ করার পরও যদি কিছু বেঁচে থাকে, তবে তা এভাবে এভাবে অর্থাৎ তোমার সামনে, ডানে ও বামে বিতরণ করবে।
আবূ হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, জনৈক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! (যদি এমন হয় যে,) আমার কাছে একটি দীনার আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার নিজের উপর খরচ কর। সে বলল, আমার কাছে আরেকটি দীনার আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার সন্তানের উপর খরচ কর। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে আরেকটি আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার স্ত্রীর উপর খরচ কর। সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে আরেকটি আছে। তিনি বললেন, এটি তোমার খাদেমের (অর্থাৎ গোলামের) উপর খরচ কর। সে বলল, আমার কাছে আরও একটি আছে। তিনি বললেন, এটি কী করবে সে ব্যাপারে তুমিই ভালো জান। এ হাদীছটি বর্ণনা করার পর আবূ হুরায়রা রাদি. বলতেন, এমন না হলে তোমার সন্তান বলবে আমাকে খাওয়াও, তুমি আমাকে কার হাতে ছাড়ছ? স্ত্রী বলবে, আমার খাবার দাও নয়তো আমাকে তালাক দাও। খাদেম বলবে, আমার খাবার দাও নয়তো আমাকে বিক্রি করে দাও।
অবশ্য নিজেকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি প্রত্যেকের সবর ও তাওয়াক্কুলের মাত্রার উপর নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে যার দুর্বলতা আছে, সে নিজের উপরই প্রথম খরচ করবে। যার সবর ও তাওয়াক্কুল অনেক শক্তিশালী, সে নিজেকে পেছনে রেখে অন্যকে অগ্রাধিকার দিলে তা প্রশংসনীয় বৈকি। সাহাবায়ে কেরাম তো এ চরিত্রেরই ছিলেন। নিজে ক্ষুধার্ত থেকে পিতামাতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বহু দৃষ্টান্ত আছে। এমনকি নিজেকে অভুক্ত রেখে অতিথিকে খাওয়ানোর নজিরও আছে অনেক। নিজ স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে এ মাত্রার সবর ও তাওয়াক্কুলের উপর গড়ে তোলা গেলে তাদের উপরও অতিথি বা অন্য কোনও ক্ষুধার্তকে খাওয়ানোর অবকাশ আছে। এ নীতিকে ‘ঈছার’ বলে। কুরআন ও হাদীছে এর প্রশংসা করা হয়েছে। ইসলাম তার অনুসারীদের এরকম উচ্চতর আদর্শে উপনীত হওয়ার উৎসাহ যোগায়।
ইমাম সামহূদী রহ. বলেন, এ হাদীছটির সম্পর্ক যদিও আর্থিক ব্যয়ের সঙ্গে, তবে মুহাক্কিকগণ একে পরকালীন বিষয়েও ব্যবহার করেছেন। যেমন আলেম ব্যক্তি অন্যদের আগে নিজ পরিবারবর্গকে দীনের শিক্ষাদান করবে। কুরআন মাজীদের আয়াত দ্বারাও এর সমর্থন পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে
قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
তোমরা নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিবারবর্গকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও।
জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় শরীআতের অনুসরণ। শরীআতের অনুসরণ করার জন্য প্রথমে শরীআতের ইলম অর্জন করা চাই। সর্বপ্রথম কর্তব্য যখন নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো, তখন ইলমে দীনের শিক্ষায়ও নিজেকে প্রথম স্থানে রাখা জরুরি। তারপর পরিবারবর্গকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো জরুরি হওয়ায় দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদেরকে দীনী ইলম শেখানো কর্তব্য। তারপর সক্ষমতা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে অন্যদের দিকে নজর দেওয়ার পালা।
দান-খয়রাতে কী নীতি অবলম্বন করা চাই
দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে, প্রথমে নিজের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যা প্রয়োজন তা রেখে দেওয়া। তারপর যা অবশিষ্ট থাকে তা থেকেই দান-খয়রাত করা হবে। এ হাদীছে বলা হয়েছে,
وخير الصدقة ما كان عن ظهر غنى
(উৎকৃষ্ট দান সেটাই, যা অভাবমুক্ততা রক্ষার সঙ্গে করা হয়)। অর্থাৎ যা দান করা হয় তার প্রতি যদি দাতার মুখাপেক্ষিতা না থাকে এবং তা ছাড়াও তার পক্ষে চলা সম্ভব হয়, তবে সেই দানই উত্তম। এভাবেও বলা যায় যে, ওই দান উত্তম, যা দেওয়ার পর দাতার হাতে এতটুকু সম্পদ অবশিষ্ট থাকে, যা দ্বারা সে নিজ প্রয়োজন সমাধা করতে পারে। অপর এক হাদীছে কথাটি আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে خير الصدقة ما أبقت غنى “শ্রেষ্ঠ দান তাই, যা প্রয়োজন সমাধা করার মত সম্পদ অবশিষ্ট রাখে।
মূলত এ হাদীছটি কুরআন মাজীদের আয়াত থেকেই গৃহীত। ইরশাদ হয়েছে وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ “লোকে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে) তারা কী ব্যয় করবে? আপনি বলে দিন, যা (তোমাদের প্রয়োজনের) অতিরিক্ত।
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
প্রশ্ন হতে পারে যে, এক হাদীছ দ্বারা তো এর বিপরীত কথাই জানা যায়, তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন্ সদাকা উত্তম, এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন- جهد المقل (দারিদ্র্যপীড়িত ব্যক্তির দান), এ উভয় হাদীছ কি পরস্পরবিরোধী নয়?
উত্তর এই যে, মূলত হাদীছদু’টি দুই স্তরের মানুষের জন্য প্রযোজ্য। নিজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থেকে দান করা যে শ্রেষ্ঠ, এর সম্পর্ক সাধারণ স্তরের লোকদের সঙ্গে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ থেকে দান করা সমীচীন নয়। কেননা খালিহাত হয়ে গেলে পরে যখন কষ্টের সম্মুখীন হবে, তখন সবটা দিয়ে ফেলার কারণে তাদের মনে অনুশোচনা দেখা দিতে পারে। ফলে দানের ছাওয়াব নষ্ট হয়ে যাবে। যেমন ইরশাদ হয়েছে,
وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا
(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণরূপে খুলে দিও না, যদ্দরুন তোমাকে নিন্দিত ও অনুতপ্ত হয়ে বসে পড়তে হবে।
এ কারণেই সাধারণ স্তরের লোকদের জন্য ভালো হল চলার মত টাকা-পয়সা হাতে রেখে দেওয়া, তারপর অতিরিক্ত থাকলে তা থেকে দান-খয়রাত করা।
পক্ষান্তরে আল্লাহর প্রতি যাদের তাওয়াক্কুল যথেষ্ট পরিপক্ক, সেইসঙ্গে কষ্ট-ক্লেশে ধৈর্যও হারায় না, এ শ্রেণীর গরীবগণ যদি তাদের হাতের সবটা সম্পদও দান করে দেয় তাতে ক্ষতি নেই। পরবর্তীতে তাদের অনুশোচনায় ভোগার আশঙ্কা নেই। পরের হাদীছটির সম্পর্ক এই স্তরের লোকদের সঙ্গে। এদের দান অতি উত্তম তাতে সন্দেহ কী? নিজেদের কষ্ট-ক্লেশ উপেক্ষা করে অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় তাদের দানের ছাওয়াব অনেক বেশি।
বস্তুত সব কাজ সবার জন্য নয়। যুদ্ধের জন্য যেমন সৎসাহসের প্রয়োজন হয়, দান-খয়রাতের জন্যও তেমনি হিম্মতের প্রয়োজন। উচ্চমাত্রার তাওয়াক্কুল ও সবর দ্বারা সে হিম্মত গঠিত হয়। এ গুণ যাদের আছে কেবল তাদের জন্যই আল্লাহর পথে সবকিছু উজাড় করে দেওয়া সাজে। তাদেরই জন্য এটা উৎকৃষ্টতর দান। যারা এ পর্যায়ের নয় তাদের জন্য এটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের জন্য উত্তম বাড়তি সম্পদ থেকে দান করা। সাহাবায়ে কেরাম সাধারণত উঁচু হিম্মতের অধিকারী ছিলেন, যদিও তাদের পরস্পরের মধ্যেও এ ক্ষেত্রে পার্থক্য ছিল। তাই দারিদ্র্যপীড়িত অবস্থায়ও আল্লাহর পথে শেষ কড়িটুকুও বিলিয়ে দিতে তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করতেন না। আবূ বকর সিদ্দীক রাদি.-এর স্থান ছিল এ ক্ষেত্রে সর্বশীর্ষে। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দান-সদাকা করার হুকুম দিলে আবূ বকর সিদ্দীক রাদি. ঘরে যা-কিছু ছিল সবটা এনে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি।
হাত না পাতার সুফল
হাদীছটির শেষে দু’টি মহৎ গুণ অর্জনের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। তার একটি হচ্ছে ومن يستعفف يعفه الله। (যে ব্যক্তি সংযমী হতে চায়, আল্লাহ তাকে সংযমী বানান)। يستعفف ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি عفة থেকে। عفة এর মূল অর্থ- কোনও বস্তুর অবশিষ্ট পরিমাণ, অর্থাৎতা ব্যবহার করার বা খাওয়ার পর সামান্য যেটুকু বাকি থাকে। পরিভাষায় বলা হয় এমন চারিত্রিক দৃঢ়তাকে, যা ব্যক্তিকে ইন্দ্রিয়পরবশ হওয়া থেকে রক্ষা করে, অর্থাৎ তাকে মনের খেয়াল-খুশির বশীভূত দেয় না। সুতরাং এর থেকে গঠিত استعفاف (যা يستعفف ক্রিয়াপদটির মাসদার বা ক্রিয়ামূল)-এর অর্থ নিজ স্বভাব-চরিত্রকে এরূপ দৃঢ়তার উপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে চাওয়া অর্থাৎ নিজের অতি সামান্য যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থেকে হারাম বস্তু গ্রহণ ও ভোগ এবং মানুষের কাছে হাত পাতা হতে বিরত থাকা। যে ব্যক্তি সাধনা ও মুজাহাদা দ্বারা এরকম চারিত্রিক দৃঢ়তা অর্জনে সক্ষম হয়, তাকে متعفف (সংযমী ও অল্পেতুষ্ট) বলে। কেননা সে কোনওকিছুর সামান্য পরিমাণ গ্রহণ করে ক্ষান্ত থাকে। সে অভাবক্লিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও মনের ইচ্ছার বশীভূত হয়ে অন্যের কাছে নিজের অভাব প্রকাশ করে না বা অন্যের কাছে হাত পেতে নিজ চরিত্রের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ করে না।
তো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন, যে ব্যক্তি নিজের অল্পবিস্তর যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকে, যতই দারিদ্র্য-জর্জরিত হোক না কেন সংযম বজায় রাখে, হারামভোগে লিপ্ত হয় না, কোনও অবস্থায়ই কারও কাছে হাত পেতে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেয় না বা নিজ অভাব-অনটনের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করে চারিত্রিক দৈন্যের পরিচয় দেয় না, আল্লাহ তায়ালা তাকে সংযম ও সন্তুষ্টি বজায় রেখে চলার তাওফীক দান করেন এবং তাকে সর্বপ্রকার নিষিদ্ধ বস্তু থেকে হেফাজত করেন।
বলাবাহুল্য মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য। যার অন্তরে অল্পেতুষ্টি ও সংযমের গুণ আছে সেই মহাধনী। অন্তরে এ গুণ ধরে রাখতে পারলে আর্থিক দৈন্য আসান হয়ে যায়। এ শ্রেণীর লোক প্রাণশক্তিতে থাকে ভরপুর। অর্থকষ্ট তাদের নিষ্প্রভ করতে পারে না। ফলে তারা বিত্তবানদের সামনে নতজানু হয় না। তাদের প্রাণশক্তির কাছে বিত্তবানরাই বরং পরাভব স্বীকার করে। এটাই সেই গুণ, আল্লাহ তায়ালা সাহাবায়ে কেরামকে যার পরিপূর্ণ হিস্যা দান করেছিলেন। তাদের পদাঙ্ক অনুসারী এ উম্মতের আসলাফ ও আকাবিরও তাদের অন্তরে এ গুণ পুরোপুরি ধারণ করতেন। তাদের নিজেদের জীবন কর্মময় করে তোলার পেছনে এ গুণের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তারা যে দুর্দান্ত তাছীর ও প্রভাবের সঙ্গে সর্বস্তরে দীনের আলো বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন, তাতে তাদের চারিত্রিক ইফফাত ও সংযম-সন্তুষ্টিও বিশেষভাবে কার্যকর ছিল। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকেও এ গুণের অধিকারী হওয়ার তাওফীক দান করুন।
আত্মিক ঐশ্বর্যের মাহাত্ম্য
সবশেষে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন ومن يستغن يغنه الله “যে ব্যক্তি (মাখলুক থেকে) মুখাপেক্ষিতামুক্ত থাকতে চায়, আল্লাহ তাকে মুখাপেক্ষিতামুক্ত রাখেন।
يستغن ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি غنى থেকে। এর মাসদার (ক্রিয়ামূল) হল এ استغناء। غنى এর অর্থ ঐশ্বর্য, অনপেক্ষতা, অভাবমুক্ত অবস্থা। استغناء অর্থ অন্যের মুখাপেক্ষী না হওয়া বা অভাবমুক্ত অবস্থার প্রকাশ। হাদীছটিতে বোঝানো হচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজ অভাব-অনটনের কথা মানুষের কাছে প্রকাশ না করে এবং তাদের অর্থ সাহায্যের মুখাপেক্ষী না হয়, আল্লাহ তায়ালা তার অন্তর ঐশ্বর্যে ভরে দেন। কেননা সে দারিদ্র্যকষ্ট সহ্য করে কোনও মাখলুকের কাছে নিজ অভাবের কথা প্রকাশ করা হতে বিরত থাকছে। আর এভাবে সে এই বিশ্বাসে সবর করছে যে, আল্লাহ তায়ালাই তার দারিদ্র্যকষ্ট দূর করতে সক্ষম। আর আল্লাহ তায়ালা বান্দার সঙ্গে সেরকম আচরণই করেন, যেমনটা বান্দা তাঁর প্রতি ধারণা রাখে।
ইমাম তীবী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের কাছে চায়ও না আবার তাদের কাছে অভাবমুক্ত অবস্থাও প্রকাশ করে না; বরং কেউ কিছু দিলে গ্রহণ করে নেয়, আল্লাহ তায়ালা তার অন্তরকে ঐশ্বর্যে ভরে দেন। ফলে কারও কাছে তার কিছু চাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আর যে ব্যক্তি ধৈর্যের সঙ্গে এরও উপরে থাকতে চেষ্টা করে, কারও কাছে নিজ অভাব-অনটনের কথা প্রকাশ তো করেই না, বরং এমনভাবে থাকে যেন তার কোনও অভাব নেই, ফলে কেউ কিছু দিলেও তা গ্রহণ করে না, সে অধিকতর মর্যাদার অধিকারী।
অভাবের কষ্ট দূর করাটা মনের ঐশ্বর্য দ্বারাও হতে পারে এবং বাহ্যিক স্বচ্ছলতা দিয়েও হতে পারে। মনে ঐশ্বর্য থাকলে বাহ্যিক কষ্ট লাঘব হয়। যদি আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা থাকে, তিনি যা দিয়েছেন তাতে অন্তর সন্তুষ্ট থাকে এবং বিদ্যমান অবস্থাকে নিজের জন্য কল্যাণকর মনে করা হয়, তবে এরূপ বান্দা বাহ্যিক কোনও দুঃখ-কষ্টে মুষড়ে পড়ে না এবং অন্যের কী আছে না আছে তার প্রতিও সে ভ্রুক্ষেপ করে না। এ অবস্থায় অন্যে তাকে যতই অভাবপীড়িত মনে করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তার অন্তরে কোনও অভাববোধ থাকে না এবং থাকে না চাহিদা অপূরণের হাহাকার। এটাই তো ঐশ্বর্য। এরূপ লোকই প্রকৃত ধনী।
একবার ইবরাহীম আদহাম রহ.-কে জনৈক ব্যক্তি কিছু হাদিয়া দিতে চাইলে তিনি বললেন, তুমি ধনী হলে গ্রহণ করবো, গরীব হলে নয়। সে বলল, আমি ধনী। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার যা আছে এর বেশি কামনা কর কি? সে বলল, হাঁ কামনা করি। তিনি বললেন, তবে তো তুমি গরীব।
নিজের যা আছে তাতে সন্তুষ্ট থেকে অন্যের সম্পদ থেকে বিমুখ থাকতে পারা আল্লাহ তায়ালার অনেক বড় নিআমত। এর দ্বারা যেমন নাজায়েয ও হারামে লিপ্ত হওয়া থেকে বাঁচা যায়, তেমনি রক্ষা পাওয়া যায় হাজারও পেরেশানি থেকে। এরই অভাবে অবৈধ উপার্জনের লিপ্ততাসহ দুনিয়ার হাজার বিপত্তি মানুষকে ঘিরে ধরে। এ মহানিআমত তখনই লাভ হয়, যখন বান্দা নিজ মনের সঙ্গে সংগ্রাম করে আল্লাহ তায়ালা যখন যে অবস্থায় রাখেন তাতে সন্তুষ্ট থাকতে এবং অন্যের সম্পদ থেকে বিমুখ থাকতে চেষ্টা করে। নিরবচ্ছিন্নভাবে এই চেষ্টা চালাতে থাকলে একপর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা ঐশ্বর্যের এ নিআমত দিয়ে দেন। اللهم اكفني بحلالك عن حرامك، واغنني بفضلك عمن سواك ‘হে আল্লাহ! আপনি যা হারাম করেছেন তা থেকে রক্ষা করে যাকিছু হালাল করেছেন তাতেই আমাকে সন্তুষ্ট থাকার তাওফীক দিন এবং নিজ অনুগ্রহে আপনার ছাড়া আর সকল থেকে আমাকে মুখাপেক্ষিতামুক্ত করে রাখুন।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. এ হাদীছ দ্বারা দান করার শ্রেষ্ঠত্ব ও দান গ্রহণের হেয়ত্ব জানা যাচ্ছে। তাই আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য দানশীলতার গুণ অর্জন করা।
খ. পরিবার-পরিজন থেকেই খরচ আরম্ভ করা উচিত। তাদেরকে কষ্টে রেখে অন্যত্র দান-খয়রাত করা শরীআতসম্মত কাজ নয়।
গ. সাধারণ স্তরের লোকদের জন্য এটাই শ্রেয় যে, পারিবারিক জরুরত মেটানোর পর উদ্বৃত্ত সম্পদ থেকেই দান-খয়রাত করবে।
ঘ. মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য অর্থকষ্টের সম্মুখীন হলে তাতে ধৈর্যধারণ করা। অন্যের কাছে হাত পেতে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেওয়া উচিত নয়। এটা আল্লাহর সাহায্যলাভের পক্ষেও সহায়ক।
ঙ. ইস্তিগনা অর্থাৎ মাখলূক হতে বিমুখ থেকে কেবল আল্লাহ তায়ালারই মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা ইসলামি আখলাকের উচ্চতর ধাপ। প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য এ স্তরে পৌঁছতে সচেষ্ট থাকা। এর দ্বারা আত্মিক ঐশ্বর্য লাভ হয়।
ক্রমিক নং : ৪১ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي مَسْعُودٍ الْأَنْصَارِيِّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَال: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا أَنْفَقَ الْمُسْلِمُ نَفَقَةً عَلَى أَهْلِهِ وَهُوَ يَحْتَسِبُهَا كَانَتْ لَهُ صَدَقَةً. | অনুবাদ: . আবু মাস‘উদ রাদি. থেকে বর্ণিত। রাবী বলেনঃ আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলামঃ এ কি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে? তিনি বললেন, (হ্যাঁ) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ সাওয়াবের আশায় কোন মুসলমান যখন তার পরিববার–পরিজনের জন্য খরচ করে, তা তার সাদাকায় পরিগণিত হয়।[27] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিবারবর্গের পেছনে অর্থব্যয়কে সদাকা সাব্যস্ত করেছেন, যদি তা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে করা হয়। يحتسب ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি احتساب) (ইহতিসাব) থেকে। ইহতিসাব অর্থ যে আমল করা হয় তাতে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টিলাভের ইচ্ছা রাখা এবং তার জন্য যে ছাওয়াব নির্দিষ্ট আছে তা পাওয়ার আশা রাখা। এ হাদীছ জানাচ্ছে, ইহতিসাবের সঙ্গে পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করলে সে ব্যয় সদাকারূপে গণ্য হয়। অর্থাৎ তাতে সদাকার ছাওয়াব পাওয়া যায়।
সুবহানাল্লাহ! মহান আল্লাহ কতইনা দয়াময়। পরিবার-পরিজনের পেছনে মানুষ স্বভাবতই ব্যয় করে থাকে। এ ব্যাপারে অবহেলা করে ঘোর নিষ্ঠুর কিংবা চরম উদাসীন প্রকৃতির লোক। এরকম লোক ছাড়া প্রায় সকলেই নিজ মনের আনন্দ ও পরিতৃপ্তির জন্যই বিবি-বাচ্চার জন্য টাকা-পয়সা খরচ করে এবং তাদের জন্যই আয় রোযগার করে। তো যে কাজটি মানুষ স্বভাবতই মনের আগ্রহে করে থাকে, কেবল নিয়তের বদলের কারণে তা সদাকা ও ছাওয়াবের কাজে পরিণত হয়ে যায়।
আবার এভাবেও চিন্তা করা যায় যে, পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করা প্রত্যেকের অবশ্যকর্তব্য। শরীআত এটাকে ওয়াজিব করেছে। তাদের পেছনে ব্যয় করার দ্বারা ওয়াজিব আদায় ও কর্তব্য পালন হয়। তো যে ব্যয়ের দ্বারা কর্তব্য পালন হয় তাতে ছাওয়াবের প্রশ্ন কী? কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এতেও ছাওয়াব রেখেছেন। এটা কেবলই তাঁর রহমত ও দয়া। এর জন্য তাঁর হাজারও শোকর।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. পরিবার-পরিজনের পেছনে টাকা-পয়সা খরচ করা কেবল দুনিয়াবী কাজ নয়; এটা ছাওয়াবের কাজও বটে। তাই এরূপ কাজেও ছাওয়াবের আশা রাখা চাই।
খ. দুনিয়ার স্বভাবগত কাজসমূহও নেক নিয়তের কারণে ছাওয়াবের কাজে পরিণত হয়। তাই মুমিন-মুসলিমের কর্তব্য এ জাতীয় কাজেও নেক নিয়তের চর্চা করা।
ক্রমিক নং : ৪২ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ سَلْمَانَ بْنِ عَامِرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الصَّدَقَةُ عَلَى الْمِسْكِينِ صَدَقَةٌ، وَهِيَ عَلَى ذِي الرَّحِمِ ثِنْتَانِ: صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ. (رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ النسائي وَابْنُ مَاجَهْ و الدارمي) | অনুবাদ: . সালমান ইবনে আমির রাদি. থেকেও বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মিসকীনকে সাদ্কা দিলে তা কেবল সাদ্কাই, আর আত্মীয়কে দিলে তাতে রয়েছে দু‘টি সাওয়াব। একটি সাদ্কা এবং আরেকটি আত্মীয়তা রক্ষা।[28] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : পিতা–মাতা ছাড়া অন্যান্য আত্মীয়–স্বজনকে অর্থসাহায্য করা কেবল তখনই ওয়াজিব, যখন তারা আয়–রোজগার করতে অক্ষম হয়, যেমন অন্ধ, পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, শিশু ইত্যাদি। পিতা–মাতার সাহায্য করার ক্ষেত্রে এ শর্ত নেই। কোনও ধনী ব্যক্তির সামনে যদি তার আত্মীয়–স্বজন অনাহারে কষ্ট করে এবং তা সত্ত্বেও সে তাকে সাহায্য না করে, তবে তা আলোচ্য আয়াতের হুকুম অমান্য করার শামিল হবে। এরূপ ক্ষেত্রে দান– খয়রাত করা অবশ্যকর্তব্য।
ক্রমিক নং : ৪৩ | |
আরবি | বাংলা |
قَالَ أَبُو قِلَابَةَ رَحِمَهُ اللهُ: وَأَيُّ رَجُلٍ أَعْظَمُ أَجْرًا مِنْ رَجُلٍ يُنْفِقُ عَلَى عِيَالٍ صِغَارٍ يُعِفُّهُمُ اللهُ أَوْ قال: يَنْفَعُهُمُ اللهُ بِهِ وَيُغْنِيهِمْ..؟ | অনুবাদ: . আবু কিলাবা রাহিমাহুল্লাহ বলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ছোট ছোট সন্তান–সন্ততির প্রতি ব্যয় করে, যার ফলে আল্লাহ তাদেরকে পবিত্র রাখেন, অভাবমুক্ত করেন অথবা উপকৃত করেন এবং তাদের অভাবমুক্ত রাখেন তার চাইতে মহান পারিশ্রমিকের অধিকারী আর কে হতে পারে? [29] |
ক্রমিক নং : ৪৪ | |
আরবি | বাংলা |
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّكَ أَنْ تَذَرَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَذَرَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ. وَإِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلَّا أُجِرْتَ بِهَا، حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِي فِي امْرَأَتِكَ. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ) | অনুবাদ: . রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমার ওয়ারিসদের অভাবমুক্ত রেখে যাওয়া, তাদের অভাবগ্রস্ত রেখে যাওয়া এবং মানুষের কাছে হাত পাতার চাইতে উত্তম। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তুমি যে কোন ব্যয় কর না কেন, তোমাকে তার বিনিময় দেওয়া হবে। এমনকি যা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দিবে (তারও প্রতিদান পাবে)।[30] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছটিতে সাদ রাদি. নিজ ঘটনা বর্ণনা করেন যে, তিনি বিদায় হজ্জের বছর মক্কা মুকার্রামায় কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। সংবাদ পেয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখতে আসেন। কোনও সাহাবি অসুস্থ হলে তাকে দেখতে আসা তাঁর সাধারণ অভ্যাস ছিল। তিনি অন্যদেরকেও রোগী দেখতে যাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। এটা তাঁর সুন্নত এবং এর অনেক ফযীলত।
সাদ রাদি. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দেখতে আসলেন। আমি তাঁকে জানালাম যে, আমার ওয়ারিশ তো মাত্র আমার এক কন্যা।
অন্যদিকে আমার সম্পদ প্রচুর। এ অবস্থায় আমি কি আমার সম্পদের তিন ভাগের দুইভাগ সদকা করে দিতে পারি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করলেন। তারপর তিনি অর্ধেকের কথা বললেন। তাও নিষেধ করলেন। শেষে যখন তিন ভাগের একভাগের কথা বললেন, তখন পরিমাণ হিসেবে এটাকেও বেশিই সাব্যস্ত করলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুমতি দিয়ে দিলেন। সেইসংগে উপদেশ দিলেন যে, ধন–সম্পদ থাকলে তার একটা বড় অংশ সন্তানদের জন্য রেখে যাওয়া চাই। কেননা তা না হলে এ আশংকা আছে যে, তারা মানুষের কাছে হাত পেতে বেড়াবে। আর প্রত্যেক মুসলিমের জন্য এটা অমর্যাদাকর।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীছে অপরের কাছে হাত পেতে বেড়ানোর নিন্দা করেছেন। তিনি ভিক্ষাবৃত্তিকে কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। তাঁর শিক্ষায় অপরের কাছে হাত পাতা অপেক্ষা খেটে খাওয়াই শ্রেয়। সেই শিক্ষা হিসেবেই তিনি সাদ রাদি.–কে তার সম্পদের বড় অংশ ওয়ারিশদের জন্য রেখে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। সেইসংগে আরও জানান যে, অর্থ–সম্পদ থাকলে তা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যে খাতেই ব্যয় করা হোক তাতে ছওয়াব পাওয়া যায়, যদি না তা শরী’আতবিরোধী কোনও কাজে ব্যয় করা হয়। স্ত্রী ও সন্তানদের হক আদায়ার্থে যে অর্থ ব্যয় করা হয়, তাতেও ছওয়াব পাওয়া যায়। এ হাদীছে বলা হয়েছে যে, এমনকি স্ত্রীর মুখে যদি কোনও লোকমা তুলে দেওয়া হয়, তবে তাও ছওয়াবের কাজরূপে গণ্য হয়। এর দ্বারা সম্পদ উপার্জন, সংরক্ষণ ও সঠিক খাতে তা ব্যয়ের প্রতি উৎসাহ পাওয়া যায়।
সাদ রাদি.–এর আশংকা হয়েছিল যে, অসুস্থতার কারণে তাঁকে মক্কায় থেকে যেতে হবে। ফলে তাঁর হিজরত বাতিল হয়ে যাবে এবং হিজরত করে তিনি যে ছওয়াবের অধিকারী হয়েছিলেন তা থেকে মাহরুম হয়ে যাবেন। সে আশংকা থেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমার বন্ধুগণ মদীনায় ফিরে যাওয়ার পরও আমাকে কি মক্কায় থেকে যেতে হবে? আমার মৃত্যু কি এখানেই হয়ে যাবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে আশ্বস্ত করলেন যে, না, তোমার এখানে থেকে যেতে হবে না এবং হিজরতও বাতিল হবে না। বরং এই সম্ভাবনা আছে যে, তুমি দীর্ঘায়ু লাভ করবে এবং দাওয়াত ও জিহাদের মহান তৎপরতায় তোমার সময় কাটবে। ফলে একদিকে তোমার দ্বারা বহু মানুষ হেদায়াত পাবে এবং তারা জাহান্নাম থেকে বেঁচে যাবে। বিভিন্ন যুদ্ধ বিগ্রহে প্রচুর গনীমত লাভ হবে এবং তা দ্বারা মুসলিমগণ উপকৃত হবে। দিকে দিকে ইসলাম ছড়িয়ে পড়বে এবং চারদিকে ইসলামের রাজ্যবিস্তার ঘটবে। মোটকথা তোমার মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ’র প্রভূত কল্যাণ সাধিত হবে। অপরদিকে যাদের ভাগ্যে দীন ও ঈমান নেই, তোমার হাতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কুফরী শক্তি রাজত্ব হারাবে। কেউ যুদ্ধে নিহত হবে এবং জাহান্নামে চলে যাবে। কেউ বন্দি হবে এবং দাসত্বের জীবনযাপন করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিল। তিনি দীর্ঘায়ু লাভ করেন। আবু বকর সিদ্দীক রাদি. ও উমর ফারুক রাদি.–এর আমলে বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কাদেসিয়ার যুদ্ধে তো তিনিই সেনাপতি ছিলেন। আঞ্চলিক গভর্ণর হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি ১৭ জন পুত্র ও ১২ জন কন্যাসন্তান রেখে যান। অথচ এ ঘটনার সময় তাঁর ছিল মাত্র এক কন্যাসন্তান।
অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরামের জন্য দু’আ করেন, যেন আল্লাহ তায়ালা তাদের হিজরতকে কার্যকর করেন এবং তাদেরকে পেছন দিকে ফিরিয়ে না দেন। অর্থাৎ তারা যেন ঈমানের উপরে অবিচলিত থাকেন এবং এমন যেন না হয় যে, তাদের কেউ মদীনা মুনাওয়ারা ছেড়ে পুনরায় মক্কা মুকাররামায় চলে এসেছেন এবং এখানেই তার মৃত্যু হয়ে গেছে।
প্রসঙ্গত এখানে সাদ ইবন খাওলা রাদি.–এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হিজরতের পর তিনি মক্কা মুকাররামায় আসলে এখানেই তার মৃত্যু হয়েছিল। ফলে তার হিজরত অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রতি আক্ষেপ প্রকাশ করেন।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. কেউ অসুস্থ হয়েছে জানলে তাকে দেখতে যাওয়া উচিত। এটা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত।
খ. উল্লেখযোগ্য কোনও কাজ করতে চাইলে সে ব্যাপারে বিজ্ঞজনের সংগে পরামর্শ করা উচিত, যেমন সাদ ইবন আবূ ওয়াক্কাস রাদি. তার সম্পদ দান করে দেওয়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে পরামর্শ করেছেন।
গ. মুমূর্ষু ব্যক্তি যদি তার সম্পদ দান করতে চায় বা সে সম্পর্কে অসিয়ত করতে চায়, তবে তা সর্বোচ্চ এক–তৃতীয়াংশের ভেতর করতে পারে, এর বেশি করা জায়েয নয়। উত্তম হল এক–তৃতীয়াংশেরও নিচে রাখা
ঘ. সম্পদ যদি অল্প হয়, তবে মুমূর্ষুকালে তা দান–খয়রাত না করে ওয়ারিশদের জন্য রেখে দেওয়াই ভালো।
ঙ. অন্যের কাছে কিছু চাওয়া ও হাত পেতে বেড়ানো অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। যথাসম্ভব খেটে খাওয়াই ইসলামের শিক্ষা।
চ. দান–খয়রাতে সুনাম–সুখ্যাতি নয়, বরং একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি কামনাই লক্ষ হওয়া উচিত।
ছ. আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় সন্তান–সন্ততি ও আত্মীয়–স্বজনের পেছনে খরচ করলেও ছওয়াব পাওয়া যায়। এমনকি স্ত্রীর মুখে লোকমা তুলে দেওয়াটাও একটি ছওয়াবের কাজ।
ক্রমিক নং : ৪৫ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ فَاطِمَةَ بِنْتِ قَيْسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ: سَأَلْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الزَّكَاةِ، فَقَالَ: «إِنَّ فِي الْمَالِ لَحَقًّا سِوَى الزَّكَاةِ». ثُمَّ تَلَا هَذِهِ الْآيَةَ الَّتِي فِي الْبَقَرَةِ ﴿لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ﴾الْآيَةَ. | অনুবাদ: . ফাতিমা বিনতে কায়স রাদি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নিজেই অথবা অন্য কেউ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যাকাত সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। তিনি বললেন, যাকাত ছাড়াও ধন–সম্পদে অবশ্যই আরো হক রয়েছে। তারপর তিনি সুরা বাকারার এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। (অর্থ)– কোন পূণ্য নেই তোমাদের মুখ ফিরানোতে ……… শেষ পর্যন্ত (২:১৭৭)।[31] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : পূর্ণ আয়াতটি হল,
لَّيْسَ الْبِرَّ أَن تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَىٰ حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ
তোমরা (নামাযে) পূর্ব বা পশ্চিম দিকে মুখ ফিরাইবে (শুধু) ইহাই নেক কাজ নহে। কিন্তু (প্রকৃত) নেক কাজ তাহার কাজ যে ঈমান আনিয়াছে আল্লাহর প্রতি, শেষ দিনের প্রতি, ফিরিশতাদের প্রতি, (আল্লাহর) কিতাবের প্রতি ও নবীগণের প্রতি এবং আল্লাহর মহব্বতে মাল দান করিয়াছে আত্মীয়দিগকে, ইয়াতীমদিগকে, মিসকীনদিগকে, পথিক মুসাফির ও যাজ্ঞাকারী দিগকে এবং দাস আযাদকরণে। (এতদ্ব্যতীত) কায়েম করিয়াছে নামায ও আদায় করিয়াছে যাকাত। —সুরা বাকারা, আয়াত ১৭৭
দানের পরে এখানে (কুরআনে) যাকাতকে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে। ইহাতে বুঝা গেল যে, যাকাত এবং এই দান এক নহে এবং যাকাতই মালের একমাত্র হক নহে। যাকাত ছাড়াও নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী এ সকল লোককে দান করিতে হইবে। যদি মুসলমানগণ এই নির্দেশ পালন করিতেন, মুসলিম সমাজে কোন গরীব দরিদ্রের অস্তিত্ব থাকিত না। কেহ চীন রাশিয়ার দিকে তাকাইত না। দেশ ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা পাইত।
ক্রমিক নং : | |
আরবি | বাংলা |
قَالَ الْعَبْدُ الضَّعِيفُ: ذَلِكَ لِأَنَّ فِي الْآيَةِ جِهَتَيْنِ لِلإِنْفَاقِ، كُلٌّ مِّنْهُمَا تُغَايِرُ الْأُخْرَى. فَالْجِهَةُ الأولى : أَنَّهُ تَعَالَى ذَكَرَ أَوَّلاً ﴿وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى﴾ الآيةَ. ثُمَّ بَعْدَ ذَلِكَ ذَكَرَ الزَّكَاةَ حَيْثُ قَالَ جَلَّ مَجْدُهُ: ﴿وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ﴾. فَالزَّكاة جِهَةٌ ثَانِيَةٌ لاَمَحَالَةَ.
ثُمَّ إِنَّ هَذَا الْحَقَّ سِوَى الزَّكَاةِ رُبَمَا يَزْدَادُ أهَمِّيَةً، فَيَجِبُ حَتْمًا كَوُجُوبِ الزَّكوةِ. أَلَا تَرَى أَنَّ النَّاسَ حِيْنَ تُحِيْطُهُمُ الْفَاقَةُ وَتَعُمُّهُمُ الْمَجَاعَةُ حَتَّى تَبْلُغَ أَنْفُسَهُمْ يَجِبُ عَلَى كُلِّ مُسْتَطِيْعٍ إِنْفَاقُ مَا اسْتَطَاعَ وَلَوْ حَبَّاتٍ مِّنْ شَعِيْرٍ وَإِلَّا تُحِيطُهُ النَّارُ كَمَا أَحَاطَتْهُمُ الْمَجَاعَةُ كَمَا قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : اتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ.[[32]] وَ هَذَا الْوُجُوبُ لَا يَخْتَصُّ بِصَاحِبِ نِصَابٍ، بَلْ يَعُمُّ كُلَّ مَنْ يَجِدُ مَا يَشْبَعُ بَطْنَهُ وَيُقِيمُ صُلْبَهُ وَهَذَا مَعْنَى قَوْلِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : |
অনুবাদ: . দুর্বল বান্দা বলেন, রাসূল-এর এ আয়াত পাঠের কারণ হলো, কেননা আয়াতে খরচ করার দু’টি দিক বিবৃত হয়েছে, যার একটি অপরটি থেকে ভিন্ন। প্রথম দিকটি হলো, যা আল্লাহ তায়ালা প্রথমে উল্লেখ করেছেন, “আর সম্পদ দান করে আল্লাহর মহব্বতে, আত্মীয়-স্বজনকে।” (আয়াত) তারপর আল্লাহ তায়ালা যাকাতের উল্লেখ করে বলেছেন, “এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে।” সুতরাং নিশ্চিতভাবেই যাকাত হলো দ্বিতীয় দিক। অতঃপর যাকাতের বাইরে এ হক্বটি কখনো কখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। তখন তা যাকাতের মতোই ওয়াজিব হয়ে যায়। তুমি কি লক্ষ করো না যে, মানুষ যখন দারিদ্র্যপীড়িত হয় এবং অনাহার তাদেরকে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত করে এমনকি তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে, তখন সামর্থবান ব্যক্তির যতোটুকু সামর্থ্য আছে, তা (এমনকি গমের কিছু দানা পরিমাণ হলেও) ব্যয় করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
সামর্থ্যবান লোকেরা যদি তখন ব্যয় না করে, তাহলে জান্নামের আগুন তাদেরকে পাকড়াও করবে, যেমন অনাহার ঐ দারীদ্র লোকদের আক্রান্ত করেছে। যেমনটি রাসূলুল্লাহ বলেছেন, “তোমরা জাহান্নামের আগুনকে ভয় করো, এমনকি এক টুকরা খেজুরের দান করে হলেও।” দানের এই ওয়াজিব বিধান কোনো যাকাতের নেসাবের মালিকের জন্য সুনির্ধারিত নয়; বরং এমন প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব, যে নিজে ভরপেট আহার করতে পারে এবং নিজের মেরুদণ্ডকে সোজা রাখতে পারে। এবং এটাই রাসূলুল্লাহ-এর উল্লিখিত বাণীর মর্মার্থ। |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
ক্রমিক নং : ৪৬ | |
আরবি | বাংলা |
لَيْسَ الْمُؤْمِنُ الَّذِي يَشْبَعُ وَ جَارُهُ جَائِعٌ. | অনুবাদ: . সে ব্যক্তি মু’মিন নহে–যে নিজে পেট পুরিয়া ভোজন করে, অথচ তাহার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে।[33] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছে সৎকর্মের আরেকটি দিক তুলে ধরা হয়েছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য, মুসলিম নারীদের পরস্পরে হাদিয়া বিনিময়ে উৎসাহিত করা, যদিও তার পরিমাণ অতি অল্প হয়। একে অপরকে হাদিয়া দেওয়া একটি উৎকৃষ্ট সৎকর্ম। এর দ্বারা পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয় ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। যেমন এক হাদীছে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
تهادوا فإن الهدية تذهب وحر الصدر
তোমরা একে অন্যকে হাদিয়া দাও। কেননা হাদিয়া মনের বিদ্বেষ দূর করে।”
অপর এক হাদীছে আছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
تهادوا تحابوا.
তোমরা একে অন্যকে হাদিয়া দাও। এতে তোমাদের পরস্পরে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে।”
উল্লেখ্য, পরস্পরকে ভালোবাসা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
لا تؤمنوا حتى تحابوا
তোমরা প্রকৃত মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না একে অন্যকে ভালোবাস।
তো প্রকৃত মু’মিন হওয়ার জন্য যখন একে অন্যকে ভালোবাসা জরুরি, তখন যে সমস্ত কাজ দ্বারা পরস্পরে ভালোবাসা সৃষ্টি হয় তার প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন হাদীছে এরকম কাজের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন, বেশি বেশি সালাম দিলে পরস্পরে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। এমনিভাবে হাদিয়া বিনিময়ও ভালোবাসা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বহু হাদীছে একে অন্যকে হাদিয়া দেওয়ার প্রতি উৎসাহ দান করেছেন। আলোচ্য হাদীছটি সেরকমই। এর দ্বারা হাদিয়ার প্রতি উৎসাহদানের পাশাপাশি একটি মূলনীতিও বলে দিয়েছেন। মূলনীতিটি এই যে, প্রত্যেকের পক্ষে হাদিয়া হিসেবে যা দেওয়া সম্ভব হয় তাই দেবে। হাদিয়া কোনও দামী বস্তু হওয়া জরুরি নয়। অনেকে মনে করে দামী জিনিস না হলে হাদিয়া দেওয়া যায় না। তাই গরীবদের অনেকেই এই নেক কাজটির ফযীলত থেকে বঞ্চিত থাকে। দামী হাদিয়া দিতে না পারার কারণে তারা হাদিয়া দেয়ই না। অথচ না দেওয়া অপেক্ষা সামান্য দেওয়াও উত্তম বৈ কি। নেক কাজ যতটুকু করা যায় ততটুকুই লাভজনক। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ অর্থ : সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করে থাকলে সে তা দেখতে পাবে।
এ হাদীছ দ্বারা শেখানো হয়েছে হাদিয়ার জন্য বস্তুটি মূল্যবান হওয়া শর্ত নয়। ব্যাস প্রত্যেকে আপন সংগতি অনুযায়ী দেবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এ হাদীছে ছাগলের খুরের কথা বলা হয়েছে। ছাগলের খুর এমনই তুচ্ছ জিনিস, যা কোনও কাজের নয়। এর দ্বারা রূপকার্থে সামান্য বস্তু বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ যে ব্যক্তি অতি সামান্য কিছু দিতে পারে। সে তা-ই দেবে এবং তাতেই হাদিয়া দেওয়ার ফযীলত পেয়ে যাবে। হাদীছে এ বিষয়টা ব্যক্ত হয়েছে এভাবে যে- يا أبا ذر إذا طبخت مرقة فأكثر ماءها وتعاهد جيرانك “হে আবূ যার! যখন ঝোল রান্না কর, তখন পানি বেশি দিও এবং তোমার প্রতিবেশীদেরকে তা থেকে দিও।
এ হাদীছে যেমন হাদিয়াদাতাকে সামান্য হাদিয়াদানকে তুচ্ছ মনে করতে নিষেধ করা হয়েছে, তেমনি হাদিয়া গ্রহিতাকেও শেখানো হয়েছে, যেন সে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আসা হাদিয়াকে তুচ্ছ মনে না করে। অনেক সময় দেখা যায় মানুষ কোনও বস্তু অল্প দামী হওয়ায় হাদিয়া হিসেবে তা দিতে কুণ্ঠাবোধ করে, তেমনি অনেকে এমনও আছে, যাদেরকে অল্পদামের কোনও জিনিস হাদিয়া দিলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এবং হাদিয়াদাতার সমালোচনা করে। এ হাদীছ তাদেরকে তা নিষেধ করছে। হাদিয়াপ্রদান আন্তরিকতার পরিচায়ক। আর আন্তরিকতা অতি মূল্যবান জিনিস। সুতরাং হাদিয়া হিসেবে দেওয়া বস্তুটির বাজারমূল্য না দেখে দাতার আন্তরিকতার মূল্য দেওয়া চাই। প্রকৃতপক্ষে তার মূল্য এত বেশি যে, টাকাপয়সা দিয়ে তার মান পরিমাপ করা সম্ভব নয়। সুতরাং হাদিয়ার বাজারমূল্য যা-ই হোক না কেন, দাতার আন্তরিকতার প্রতি লক্ষ করে আন্তরিকভাবেই তা গ্রহণ করা চাই এবং সেজন্য তাকে কৃতজ্ঞতাও জানানো চাই।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. এ হাদীছ দ্বারা বোঝা গেল হাদিয়া দেওয়াও একটি নেক কাজ।
খ. এ হাদীছ মু’মিনদেরকে একে অন্যের প্রতি এমন আচরণের শিক্ষা দেয়, যা মহব্বতের পরিচায়ক এবং যা দ্বারা পরস্পরে মহব্বত সৃষ্টি হয়, হাদিয়াও যার একটি।
গ. এ হাদীছ শিক্ষা দেয় হাদিয়ার ক্ষেত্রে যেন কোনও বাড়াবাড়ি করা না হয়। যার পক্ষে যা সম্ভব তা-ই হাদিয়া দেবে।
ঘ. কারও পক্ষ হতে দেওয়া হাদিয়াকে কোনও অবস্থায়ই তুচ্ছ মনে করতে নেই; বরং মহব্বতের নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করে নেওয়া চাই।
ক্রমিক নং : ৪৭ | |
আরবি | বাংলা |
قَالَ عَدِيُّ بْنُ حَاتِمٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : لَيَقِفَنَّ أَحَدُكُمْ بَيْنَ يَدَيِ اللهِ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهُ حِجَابٌ وَلَا تَرْجُمَانٌ يُتَرْجِمُ لَهُ، ثُمَّ لَيَقُولَنَّ لَهُ: أَلَمْ أُوتِكَ مَالاً؟ فَلَيَقُولَنَّ : بَلَى. ثُمَّ لَيَقُولَنَّ: أَلَمْ أُرْسِلْ إِلَيْكَ رَسُوْلاً؟ فَلَيَقُولَنَّ: بَلَى. فَيَنْظُرُ عَنْ يَمِينِهِ فَلا يَرى إلا النَّارَ ثُمَّ يَنْظُرُ عَنْ شِمَالِهِ فَلَا يَرَى إِلَّا النَّارَ فَلْيَتَّقِيَنَّ أَحَدُكُمُ النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ، فَإِنْ لَّمْ يَجِدْ فَبِكَلِمَةٍ طَيِّبَةٍ. (رَوَاهُ البُخَارِيّ) | অনুবাদ: . আদী ইবনে হাতিম রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে ছিলাম, এমন সময় দু’জন সাহাবি আসলেন, তাদের একজন দারিদ্র্যের অভিযোগ করছিলেন আর অপরজন রাহাজানির অভিযোগ করছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, রাহাজানির অবস্থা এই যে, কিছু দিন পর এমন সময় আসবে, যখন কাফেলা মক্কা পর্যন্ত বিনা পাহারায় পৌছে যাবে। আর দারিদ্র্যের অবস্থা এই যে, তোমাদের কেউ সাদ্কা নিয়ে ঘোরাফিরা করবে, কিন্তু তা গ্রহণ করার মত কাউকে পাবে না। এমন সময় না আসা পর্যন্ত কিয়ামত কায়েম হবে না। তারপর (বিচার দিবসে) আল্লাহর নিকট তোমাদের কেউ এমনভাবে খাড়া হবে যে, তার ও আল্লাহর মাঝে কোন আড়াল থাকবে না বা কোন ব্যাখ্যাকারী দোভাষীও থাকবে না। এরপর তিনি বলবেন, আমি কি তোমাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করিনি? সে অবশ্যই বলবে হ্যাঁ, তখন সে ব্যক্তি ডান দিকে তাকিয়ে শুধু আগুন দেখতে পাবে, তেমনিভাবে বাম দিকে তাকিয়েও আগুন দেখতে পাবে। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকের উচিত এক টুকরা খেজুর (সাদ্কা) দিয়ে হলেও যেন আগুন থেকে আত্মরক্ষা করে। যদি কেউ তা না পায় তবে যেন উত্তম কথা দিয়ে হলেও (আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করে)।[34] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে বলেছেন। জাহান্নাম পাপীদের ঠিকানা। সেখানে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তার প্রধান শাস্তিالنار (আগুন)। তাই জাহান্নামের অপর নামই। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তায়ালা বার বার মানুষকে এ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন এবং এর থেকে বাঁচার তাগিদ দিয়েছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে,
فاتقوا النار التي وقودها الناس والحجارة
অর্থ : তোমরা বাঁচ ওই আগুন থেকে, যার ইন্ধন মানুষ ও পাথর। সুরা বাকারা, আয়াত ২৪
জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ পালন করা। অর্থাৎ সৎকর্ম করতে থাকা ও অসৎকর্ম পরিহার করে চলা। সৎকর্ম আছে বিভিন্ন রকম, যেমন পূর্বের হাদীছসমূহ দ্বারা আমরা জানতে পেরেছি। তার মধ্যে একটা সৎকর্ম বলা হয়েছে আল্লাহর পথে দান-সদাকা করা।
এ হাদীছেও প্রধানত সদাকার কথাই বলা হয়েছে যে, একটা খেজুরের একটি অংশ সদাকা করে হলেও জাহান্নাম থেকে বাঁচ। এর দ্বারা সর্বনিম্ন সামর্থ্যের কথা বোঝানো হয়েছে। কারও অবস্থা যদি এমন হয় যে, সে কোনও ক্ষুধার্তকে একটা মাত্র খেজুর দেওয়ারও সামর্থ্য রাখে না, অর্থাৎ দেওয়ার মত একটা খেজুরও তার কাছে নেই, একটা খেজুরের অর্ধেক মাত্র আছে, তবে সে সে অর্ধেকটুকুই দিয়ে দেবে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের দানের অঙ্ক দেখেন না। তিনি দেখেন তার মন। অর্থাৎ তার মনে দেওয়ার ইচ্ছা আছে কি না। যদি দেওয়ার ইচ্ছা থাকে, তবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী যা দেবে তা-ই আল্লাহর কাছে মূল্যবান। তাকেই আল্লাহ তার জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে কবূল করে নেবেন।
এরপর বলা হয়েছে যদি কারও অর্ধেকটুকু দেওয়ারও ক্ষমতা না থাকে, তবে তার যে আর জাহান্নাম থেকে বাঁচার কোনও উপায় রইল না এমন নয়, সে এর জন্য অন্য কোনও উপায় অবলম্বন করতে পারে। সেরকম একটি উপায় হচ্ছে উত্তম কথা বলা।পূর্বে আমরা জানতে পেরেছি উত্তম কথা বলাও সদাকাতুল্য। অর্থাৎ এর দ্বারাও সদাকার ছাওয়াব পাওয়া যায়। সুতরাং যে ব্যক্তি দান-সদাকা করার সামর্থ্য রাখে না, সে যদি উত্তম কথা বলে, তবে এর মাধ্যমেও সে জাহান্নাম থেকে বাঁচতে পারবে।
উত্তম কথা অতি ব্যাপক। এর মধ্যে যেমন কুরআন তিলাওয়াত ও যিকর-তাসবীহ ইত্যাদি রয়েছে, তেমনি মানুষকে সুপরামর্শ দেওয়া, সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা, বৈধ সুপারিশ করা, দীনী ইলম শেখানো, শোকার্তকে সান্ত্বনা দেওয়া ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত।
এ হাদীছের দ্বিতীয় বর্ণনায় বলা হয়েছে কিয়ামতে আল্লাহ তায়ালা মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন এবং তাতে আল্লাহ ও বান্দার মাঝখানে কোনও দোভাষী (ترجمان) থাকবে না।কেননা বান্দাকে নিজ কথা বোঝাতে আল্লাহর কোনও দোভাষীর প্রয়োজন নেই। সকল ভাষা আল্লাহরই সৃষ্টি। তিনি যে-কোনও ভাষায় বান্দার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। বান্দার সঙ্গে সেদিন তিনি কেমন কেমন কথা বলবেন, কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীছও আছে। যেমন এক হাদীছে আছে, আল্লাহ তায়ালা কোনও মু’মিন বান্দাকে কাছে ডেকে নেবেন। তারপর তাকে বলবেন, বান্দা! তোমার কি মনে আছে, তুমি অমুক দিন এই কাজ করেছিলে, অমুক দিন এই কাজ করেছিলে? এভাবে তাকে দিয়ে তার সকল অন্যায় কাজের স্বীকারোক্তি করিয়ে নেবেন। বান্দা যখন তা সব স্বীকার করে নেবে এবং মনে করবে ধ্বংসই তার পরিণতি, তখন আল্লাহ বলবেন,
إني قد سترتها عليك في الدنيا وأنا أغفرها لك اليوم
“আমি দুনিয়ায় তোমার এসব অপরাধ গোপন রেখেছিলাম। আজ আমি এসব ব্যাপারে তোমাকে ক্ষমাই করে দিলাম।- সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৪৪১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৭৬৮
সুবহানাল্লাহ! কতই না দয়াময় মহান আল্লাহ!!
কেউ কেউ বলেন, এখানে ترجمان দ্বারা দূত বা মধ্যস্থ বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আখিরাতে আল্লাহ বান্দার সঙ্গে কথা বলবেন সরাসরি। মাঝখানে কেউ থাকবে না।দুনিয়ায় যেমন আল্লাহ তায়ালা মানুষের কাছে নিজ বাণী পৌঁছান নবী-রাসূলের মাধ্যমে, আখিরাতে তেমন হবে না। সেখানে বান্দাকে যা বলার সরাসরি নিজে বলবেন। এ হাদীছে বলা হয়েছে বান্দা আখিরাতে তার কৃতকর্মসমূহ দেখতে পাবে। ডান দিকে দেখতে পাবে নেক আমল এবং বাম দিকে বদ আমল। তার ছোট-বড় এবং ভালো-মন্দ কোনও আমলই বাদ যাবে না। সবই সেখানে নিজ চোখে দেখতে পাবে। যেমন ইরশাদ হয়েছে,
فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ
অর্থ : সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করে থাকলে সে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করে থাকলে তাও দেখতে পাবে।সুরা যিলযাল, আয়াত ৭-৮
এটা মোটেই অসম্ভব নয় যে, দুনিয়ায় মানুষ যে অবস্থায় ও যে রূপে সৎকাজ ও অসৎকাজ করে থাকে, আখিরাতে হুবহু সেই রূপেই তাকে তা দেখিয়ে দেওয়া হবে। অথবা এর দ্বারা আমলনামা দেখানোর কথা বোঝানো হয়েছে। বান্দা আমলনামায় তার ভালোমন্দ প্রতিটি কাজ লিখিতরূপে দেখতে পাবে।
সামনে দেখতে পাবে বিভীষিকাময় জাহান্নাম। জাহান্নামের উপর থাকবে পুলসিরাত। প্রত্যেককে তার উপর দিয়ে যেতে হবে। যার নেকীর পরিমাণ বেশি থাকবে সে অক্ষতভাবে তা পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবে। আর যার নেকী কম হবে তার পক্ষে পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতে পৌঁছা সম্ভব হবে না। কেটে টুকরো হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। তাই এ হাদীছে বলা হয়েছে জাহান্নাম থেকে বাঁচার চেষ্টা কর। বেশি বেশি নেক আমলই জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়, দান-সদাকা করা ও উত্তম কথা বলা যার অন্যতম।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. ভালো ও মন্দ কোনও আমলকেই অবহেলা করতে নেই। আখিরাতে সবই নিজ চোখে দেখতে পাওয়া যাবে এবং তার পুরোপুরি প্রতিফলও দেওয়া হবে।
খ. দান-সদাকা জাহান্নাম থেকে বাঁচার একটি উপায়। কাজেই যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব দান-সদাকা করা উচিত।
গ. নিতান্ত গরীব ব্যক্তি যদি অতি সামান্য কিছুও দান করে, তবে তাও তার জাহান্নাম থেকে বাঁচার কারণ হতে পারে। কাজেই সামান্য বলে তাকে তুচ্ছ মনে করতে নেই।
ঘ. উত্তম কথা বলাও যেহেতু জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়, তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত যথাসম্ভব ভালো ভালো কথা বলতে সচেষ্ট থাকা এবং কোনও অবস্থাতেই কোনও মন্দ কথা না বলা।
ক্রমিক নং : ৪৮ | |
আরবি | বাংলা |
قَالَ اللهُ تَعَالَى : ﴿وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ﴾ في الدنيا والآخرة. [البقرة: 219] | অনুবাদ: 48. লোকে আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলে দিন, এ দু’টোর মধ্যে মহা পাপও রয়েছে এবং মানুষের জন্য কিছু উপকারও আছে। আর এ দু’টোর পাপ তার উপকার অপেক্ষা গুরুতর। লোকে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে) তারা কী ব্যয় করবে? আপনি বলে দিন, যা (তোমাদের প্রয়োজনের) অতিরিক্ত। আল্লাহ এভাবেই তোমাদের জন্য স্বীয় বিধানাবলী সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা-ভাবনা করতে পার। [সুরা আল-বাকারা : (০২) : 219] |
ক্রমিক নং : ৪৯ | |
আরবি | বাংলা |
49- وَقَدْ حَدَّثَ الْمُنْذِرُ بْنُ الْجَرِيرِ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ: «كُنَّا عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِي صَدْرِ النَّهَارِ، فَجَاءَ قَوْمٌ عُرَاةً حُفَاةً مُتَقَلِّدِي السُّيُوفِ، عَامَّتُهُمْ مِنْ مُضَرَ، بَلْ كُلُّهُمْ مِنْ مُضَرَ، فَتَغَيَّرَ وَجْهُ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم لِمَا رَأَى بِهِمْ مِنَ الْفَاقَةِ، فَدَخَلَ ثُمَّ خَرَجَ، فَأَمَرَ بِلَالًا فَأَذَّنَ فَأَقَامَ الصَّلَاةَ فَصَلَّى، ثُمَّ خَطَبَ فَقَالَ: ﴿يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا﴾ [النساء: 1] وَ﴿اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ ﴾ [الحشر: 18]
تَصَدَّقَ رَجُلٌ مِنْ دِينَارِهِ، مِنْ دِرْهَمِهِ، مِنْ ثَوْبِهِ، مِنْ صَاعِ بُرِّهِ، مِنْ صَاعِ تَمْرِهِ. حَتَّى قَالَ: وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ، فَجَاءَ رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ بِصُرَّةٍ كَادَتْ كَفُّهُ تَعْجِزُ عَنْهَا، بَلْ قَدْ عَجَزَتْ، ثُمَّ تَتَابَعَ النَّاسُ، حَتَّى رَأَيْتُ كَوْمَيْنِ مِنْ طَعَامٍ وَثِيَابٍ، حَتَّى رَأَيْتُ وَجْهَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَتَهَلَّلُ كَأَنَّهُ مُذْهَبَةٌ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: مَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ غَيْرِ أَنْ يُنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئٌ، وَمَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً فَعَلَيْهِ وِزْرُهَا وَوِزْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ غَيْرِ أَنْ يُنْقُصَ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْئٌ»[[35]] |
অনুবাদ: . মুনজির ইবনে জারীর তার বাবা জারীর রাদি. থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, আমরা একবার দুপুর বেলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় কিছু নগ্নদেহী এবং নগ্নপদী লোক তলোয়ার (কাঁধে) লটকানো অবস্থায় আমাদের কাছে আসল। তাদের অধিকাংশ বরং সবাই মুদার গোত্রের ছিল। তাদের অনাহারে থাকার অবস্থা দর্শনে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখমণ্ডল বিবর্ণ রূপ ধারণ করল। তিনি বাড়ীর ভিতর গেলেন এবং বের হয়ে এসে বিলাল (রাযিঃ)–কে আযান দিতে নির্দেশ দিলেন। বিলাল রাদি. আযান দিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামাআতে নামায আদায় করে খুতবা দিলেন এবং বললেন,
অর্থঃ হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতেই সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তা হতে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দু’জন হতে বহু নর–নারী ছড়িয়ে দেন এবং আল্লাহকে ভয় কর যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচঞ্চা কর এবং সতর্ক থাক জ্ঞাতিবন্ধন সম্পর্কে। আল্লাহ তোমাদের উপর তীক্ষ দৃষ্টি রাখেন। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, প্রত্যেকেই ভাবিয়ে দেখুক আগামীকালের জন্য সে কী অগ্ৰীম পাঠিয়েছে। (সুরা নিসাঃ ১ এবং সুরা হাশর ১৮) প্রত্যেকে নিজ নিজ দীনার দিরহাম, কাপড়, এক সা’ গম এবং এক সা’ খেজুর হতেও দান কর বলতে বলতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতটুকু পর্যন্ত বললেন যে, এক টুকরা খেজুর হলেও দান কর। তখন একজন আনসারী সাহাবি একটি থলি নিয়ে আসলেন যেন তার হাত তা বহন করতে অপারগ হয়ে যেতে ছিল বরং অপারগ হয়েই গিয়েছিল। অতঃপর অন্যান্য লোকজনও তার অনুসরণ করল। আমি সেখানে কাপড় এবং খাদ্যের দু’টো স্তুপ দেখতে পেলাম। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেহারা মুবারক উজ্জ্বল ও তাঁকে প্রফুল্ল দেখতে পেলাম। তখন তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ইসলামে কোন উত্তম প্রথা চালু করবে সে তার সওয়াব তো পাবেই উপরন্তু আমলকারীর সমপরিমাণ সওয়াবও পাবে। অথচ আমলকারীদের সওয়াব এর পরিমাণ কিছুমাত্র হ্রাস করা হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলাম ধর্মে কোন খারাপ প্রথা প্রচলন করবে তার জন্য তার গুনাহ তো রয়েছেই। উপরন্তু খারাপ প্রথার আমলকারীদের সমপরিমাণ গুনাহ্ও তার জন্য রয়েছে। অবশ্য তাদের গুনাহ বিন্দুমাত্র হ্রাস করা হবে না। |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : হাদীসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি ইসলামে কোন উত্তম প্রথা চালু করবে সে তার সওয়াব তো পাবেই ‘ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এমন সুন্নত, যা পূর্বে ছিল কিন্তু লোকেরা সে সুন্নতের উপর আমল ছেড়ে দিয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি পুনরায় ঐ সুন্নতকে জীবিত করে দিবে, তার জন্য রয়েছে উত্তম বিনিময়। আবার কারো যেন নিজের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ নতুন সুন্নতের আবিষ্কার করার কথা না বুঝে আসে। কারণ এটা হলো বিদআত।
ক্রমিক নং : ৫০ | |
আরবি | বাংলা |
وَلَا يَذْهَلُ عَنْكَ أَنَّ حَاجَاتِنَا كَثِيرَةٌ، وَالْحَقُّ أَنَّ أَغْنِيَاءَنَا لِأَجْلِهَا فُقَرَاءُ، فَالتَّعْلِيمُ وَالتَّرْبِيَةُ وَإِقَامَةُ إِدَارَةٍ عِلْمِيَّةٍ وَصِنَاعِيَّةٍ وَإِعْدَادُ كُلِّ قُوَّةٍ نُكَافِحُ بِهَا أَعْدَاءَنَا فِي مَيَادِيْنِ الْحَيَاةِ السِّيَاسِيَّةِ وَالْاِقْتِصَادِيَّةِ وَالشَّخْصِيَّةِ وَالْإِجْتِمَاعِيَّةِ كُلُّهَا حَاجَاتُنَا، وَنَحْنُ فُقَرَاءُ لِأَجْلِهَا، فَالإِنْفَاقُ فِي كُلِّهَا وَاجِبٌ عَلَيْنَا وَالإمْسَاكُ هُوَ هَلَكَةٌ، وَقَدْ نَبَّهَنَا اللهُ وَأَنْذَرَنَا أَنْ نُلْقِيَ أَنْفُسَنَا فِي الْهَلَكَةِ حَيْثُ قَالَ:
﴿وَأَنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ﴾ [البقرة: 195] |
অনুবাদ: . এমনিভাবে যে ব্যক্তি ইসলামে কোনো মন্দ প্রথা চালু করে, তাদের পাপের অংশও সে পাবে; এতে তাদের গুনাহের কিছুই হ্রাস করা হবে না। তোমার অজানা নয় যে, আমাদের প্রয়োজনগুলো অনেক। সত্য হলো, এ কারণেই আমাদের ধনীগণ দরিদ্র। কেননা শিক্ষা-দীক্ষা, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা, এমন সকল শক্তি অর্জন করা, যেগুলোর মাধ্যমে আমরা আমাদের শত্রুদের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং ব্যক্তি ও সামাজিক অঙ্গনে প্রতিহত করবো। এর সবগুলোই আমাদের প্রয়োজন।
এ কারণে আমরা দরিদ্র। সতুরাং এ সমস্ত ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় করা আমাদের উপর ওয়াজিব আর অর্থ ব্যয় থেকে বিরত থাকা (আমাদের) ধ্বংসের কারণ। আল্লাহ তায়ালা তো আমাদেরকে নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করতে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, আর আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় কর এবং নিজ হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। এবং সৎকর্ম অবলম্বন কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন। |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
আলোচনার ব্যাখ্যা : আলোচ্য আয়াতে ইশারা করা হচ্ছে যে, তোমরা যদি জিহাদে অর্থ ব্যয় করতে কার্পণ্য কর এবং সে কারণে জিহাদের লক্ষ্য অর্জিত না হয়, তবে সেটা হবে নিজ পায়ে কুঠারাঘাত করার নামান্তর। কেননা তার পরিণামে শত্রু শক্তি সঞ্চয় করে তোমাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
ক্রমিক নং : ৫১ | ||
আরবি | বাংলা | |
قَالَ رَبُّنَا المُتَعَالُ : ﴿هَاأَنْتُمْ هَؤُلَاءِ تُدْعَوْنَ لِتُنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَمِنْكُمْ مَنْ يَبْخَلُ وَمَنْ يَبْخَلْ فَإِنَّمَا يَبْخَلُ عَنْ نَفْسِهِ وَاللَّهُ الْغَنِيُّ وَأَنْتُمُ الْفُقَرَاءُ وَإِنْ تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُونُوا أَمْثَالَكُمْ﴾ [محمد: 38] | অনুবাদ: 51. দেখ, তোমরাই তো তারা, যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য ডাকা হচ্ছে অতঃপর তোমাদের মধ্যে কিছু লোকে কার্পণ্য করছে। আর যে-কেউ কার্পণ্য করে, সে তো কার্পণ্য করে নিজেরই প্রতি। আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং তোমরা অভাবগ্রস্ত। তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তবে তোমাদের স্থানে অন্য কোন সম্প্রদায়কে সৃষ্টি করবেন অতঃপর তারা তোমাদের মত হবে না। [সুরা মুহাম্মাদ : (৪৭) : 38] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
আর যে-কেউ কার্পণ্য করে, সে তো কার্পণ্য করে নিজেরই প্রতি : কেননা আল্লাহ তায়ালার আদেশ মত যদি অর্থ ব্যয় না কর তবে তার ক্ষতি তোমাদের নিজেদেরকেই ভোগ করতে হবে। প্রথমত এ কারণে যে, অর্থ ব্যয় না করলে জিহাদ সংঘটিত হবে না। ফলে শত্রু তোমাদের উপর প্রবল থাকবে। কিংবা যদি যাকাত না দাও, তবে ব্যাপক অভাব-অনটন লেগে থাকবে। আর দ্বিতীয়ত এ কারণে যে, আখেরাতে এ অবাধ্যতার কারণে তোমাদেরকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
القَرْضُ الحَسَنُ |
উত্তম ঋণ (করজে হাসানা) |
ক্রমিক নং : ৫২ | |
আরবি | বাংলা |
وَ سَمَّى اللهُ تَعَالَى الإِعْطَاءَ فِي أَمْثَالِ هَذِهِ الْحَاجَاتِ الْقَرْضَ في سَبِيْلِ اللهِ. وَرُبَّمَا عَبَّرَهُ بِالْإِنْفَاقِ فِي سَبِيْلِ اللهِ، وَفِي كَثِيرٍ مِّنَ الْآيَاتِ أَتْبَعَ أَمْرَ الْقَرْضِ أَمْرَ الزَّكَاةِ كَمَا قَالَ: ﴿وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَقْرِضُوا اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا﴾ [المزمل: 20] | অনুবাদ: . আল্লাহ তায়ালা এ জাতীয় প্রয়োজনগুলোর ক্ষেত্রে দান করাকে আল্লাহর রাস্তায় করজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কখনো কখনো আল্লাহর রাস্তায় ব্যায় বলে আখ্যায়িত করেছেন। অনেক আয়াতে তিনি করজের বিষয়ের পর যাকাতের বিষয় এনেছেন। যেমন বলেছেন, এবং নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর ও আল্লাহকে ঋণ দাও উত্তম ঋণ। [সুরা আল-মুয্যাম্মিল : (৭৩) : 20] |
قَالَ اللهُ تَعَالَى : ﴿الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ سِرًّا وَعَلَانِيَةً فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ﴾ [البقرة: 274] | অনুবাদ: 52. যারা নিজেদের সম্পদ দিনে ও রাতে ব্যয় করে প্রকাশ্যেও এবং গোপনেও, তারা তাদের প্রতিপালকের কাছে নিজেদের সওয়াব পাবে এবং তাদের কোনও ভয় থাকবে না আর তারা কোনও দুঃখও পাবে না। [সুরা আল-বাকারা : (০২) : 274] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
এবং নামায কায়েম কর : এর দ্বারা পাঁচ ওয়াক্তের ফরয নামায বোঝানো হয়েছে।
আল্লাহকে ঋণ দাও উত্তম ঋণ : এর অর্থ সদকা করা ও অন্যান্য সৎকাজে অর্থ ব্যয় করা। একে রূপকার্থে ‘ঋণ’ বলা হয়েছে এ কারণে যে, ঋণ যেমন ফেরত দেওয়া হয়ে থাকে, তেমনি আল্লাহ তায়ালাও আখেরাতে সওয়াব ও পুরস্কাররূপে এটা ফেরত দেওয়ার ওয়াদা করেছেন। উত্তম ঋণের অর্থ হল, খালেস নিয়তে কেবল আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে দান-খয়রাত করা; মানুষকে দেখানো বা সুনাম কুড়ানোর নিয়ত না থাকা।
ক্রমিক নং : ৫৩ | |
আরবি | বাংলা |
وَعَنْ أَبِي ذَرٍّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم قَالَ: إِنَّ الْمُكْثِرِينَ هُمْ الْمُقِلُّونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِلَّا مَنْ أَعْطَاهُ اللهُ خَيْرًا، فَنَفَحَ فِيهِ يَمِينَهُ وَشِمَالَهُ وَبَيْنَ يَدَيْهِ وَوَرَاءَهُ وَعَمِلَ فِيهِ خَيْرًا. | অনুবাদ: . আবু যর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, কিয়ামতের দিন বিত্তশালী লোকেরাই নিঃস্ব হবে, কিন্তু সে ব্যতীত যাকে আল্লাহ মাল দিয়েছেন, এরপর সে বিলিয়ে দিয়েছে সে সস্পদ ডানে বামে সামনে ও পেছনে এবং এর দ্বারা কল্যাণকর কাজ করেছে।[36] |
ক্রমিক নং : ৫৪ | ||
আরবি | বাংলা | |
٥٤- وَعَنْ أَبِي مَسْعُودٍ الْأَنْصَارِيِّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ إذا أَمَرَنَا بِالصَّدَقَةِ انْطَلَقَ أَحَدُنَا إِلَى السُّوْقِ، فَيُحَامِلُ، فَيُصِيبُ الْمُدَّ، وَإِنَّ لِبَعْضِهِمُ الْيَوْمَ لَمِائَةَ أَلْفٍ. | অনুবাদ: . আবু মাস’উদ আনসারী রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সাদ্কা করতে আদেশ করলেন তখন আমাদের কেউ বাজারে গিয়ে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বোঝা বহন করে মুদ পরিমাণ অর্জন করত (এবং তা থেকেই সাদ্কা করত) অথচ আজ তাদের কেউ লাখপতি।[37] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদীছের ব্যাখ্যা : অর্থাৎ, ইসলামের সূচনালগ্নে যখন সদকা বের করার বিধান হলো, তখন লোকেরা ছিল দরিদ্র ও অভাবী। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা ও রাসূলুল্লাহ সা.-এর আনুগত্যের অবস্থা ছিল এই যে, তারা বাজারে যেতেন এবং পরিশ্রম ও কষ্ট করে যা কিছু লাভ হতো, সদকা করে দিতেন। আজকাল দুনিয়ার অবস্থা হচ্ছে এই যে, ঐ সমস্ত দরিদ্রদের কাছে হাজার হাজার ও লক্ষ্য টাকা-পয়সা সঞ্চিত থাকে। এটা হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার কৃপা। সদকাকারীরা পৃথিবীতেও সেটির প্রতিদান পায়, পরকালেও পাবে সেটির নির্ধারিত পুরস্কার। অতএব, এতে অলসতা না থাকা উচিত।
ذَوِي الْقُرْبى |
আত্মীয়-স্বজন |
ক্রমিক নং : ৫৫ | |
আরবি | বাংলা |
٥٥- وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم قَالَ: إِنَّ اللهَ خَلَقَ الْخَلْقَ حَتَّى إِذَا فَرَغَ مِنْ خَلْقِهِ قَالَتْ الرَّحِمُ: هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطِيْعَةِ. قَالَ: نَعَمْ، أَمَا تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ؟ قَالَتْ: بَلَى يَارَبِّ! قَالَ فَهُوَ لَكِ. | অনুবাদ: . আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা সকল সৃষ্টিকে পয়দা করলেন। যখন তিনি সৃষ্টি কাজ শেষ করেন, তখন আত্মীয়তার সম্পর্ক বলে উঠলঃ সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে আপনার আশ্রয় গ্রহণকারীদের এই (উপযুক্ত) স্থান। তিনি (আল্লাহ) বললেন, হ্যাঁ, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তোমার সাথে যে সুসম্পর্ক রাখবে, আমিও তার সাথে সুসম্পর্ক রাখব। আর যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব। সে (আত্মীয়তার সম্পর্ক) বললঃ হ্যাঁ, আমি সন্তুষ্ট, হে আমার রব! আল্লাহ বললেন, তাহলে এ মর্যাদা তোমাকে দেওয়া হল।[38] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : (حتى إذا فرغ منهم) (তাদের সৃষ্টিকর্ম সমাপ্ত হলে)। এ বাক্যটির হুবহু অর্থ— যখন তিনি মাখলূকদের সৃষ্টিকর্ম হতে অবসর হলেন। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য তাদের সৃষ্টিকর্ম সমাপ্ত করলেন। এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, প্রথমে তিনি তাদের সৃষ্টিকার্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তারপর কাজ শেষ হলে অবসর হলেন। কেননা আল্লাহ তায়ালার জন্য এ অর্থ প্রযোজ্য নয়। কোনও কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ার ধারণা থেকে তিনি বহু ঊর্ধ্বে। কেননা কোনও কাজ করতে তাঁর চেষ্টা-পরিশ্রম করার দরকার হয় না। সেই কাজ করার জন্য তাঁর সরাসরি যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কোনও কাজ করার জন্য তাঁর হাতিয়ার ও সরঞ্জামাদি ব্যবহারেরও প্রশ্ন আসে না। এসবের প্রয়োজন হয় দুর্বল ও সীমিত শক্তির মাখলূকের। আল্লাহ তায়ালার শক্তি ও ক্ষমতা অসীম। তিনি কোনওকিছু করতে চাইলে কেবল বলেন হও। অমনি তা হয়ে যায়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে,
إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ
তাঁর ব্যাপার তো এই যে, তিনি যখন কোনও কিছুর ইচ্ছা করেন, তখন কেবল বলেন, ‘হয়ে যা’। অমনি তা হয়ে যায়।
যাহোক সৃষ্টিকর্ম যখন সমাপ্ত হয়ে গেল, তখন আত্মীয়তা দাঁড়িয়ে গেল এবং বলল। (قامت الرحم فقالت)। প্রশ্ন হয়, আত্মীয়তা তো এক বিমূর্ত বিষয়, এটা একটা আপেক্ষিক অবস্থা ও সম্পর্কের নাম, এর পক্ষে কী করে দাঁড়ানো ও কথা বলা সম্ভব? উলামায়ে কেরাম এর বিভিন্ন উত্তর দিয়েছেন।
এর এক উত্তর তো এই যে, হয়তো আল্লাহ তায়ালা ক্ষণিকের জন্য আত্মীয়তাকে একটা আকৃতি দান করেছিলেন এবং সেই আকৃতিকে বাকশক্তি দিয়েছিলেন। আত্মীয়তা সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছিল। আল্লাহ তায়ালার কুদরত ও ক্ষমতা অসীম। তিনি চাইলে এরূপ করতেই পারেন। তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
কারও মতে এই দাঁড়ানো ও কথা বলার বিষয়টি রূপক। এর দ্বারা আত্মীয়তাকে ওই ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যে কারও পক্ষ থেকে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আশঙ্কা বোধ করে। তাই সে তা থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোনও ক্ষমতাশালীর আশ্রয় গ্রহণ করে এবং তার কাছে নিজের সেই আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে, যাতে তার পক্ষ হতে এ ব্যাপারে সাহায্য লাভ হয়। তো আত্মীয়তাকে ওই ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করে তার আশ্রয়গ্রহণ ও কথা বলার গুণকে তার উপর আরোপ করা হয়েছে। এটা অলংকার শাস্ত্রের একটা নিয়ম। সব ভাষাতেই এর ব্যাপক ব্যবহার আছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য আত্মীয়তার মর্যাদা ও তা রক্ষা করার গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
এরকম ব্যাখ্যাও করা যায় যে, আত্মীয়তা এমন মর্যাদাপূর্ণ একটি বিষয় এবং তা ছিন্ন করা এমনই বেদনাদায়ক যে, আত্মীয়তার যদি শরীর ও বাকশক্তি থাকত, তবে সে আল্লাহ তায়ালার দরবারে দাঁড়িয়ে তার ছিন্নকারীদের বিরুদ্ধে নালিশ জানাত।
যাহোক আত্মীয়তা দাঁড়িয়ে আবেদন জানাল,
هذا مقام العائذ بك من القطيعة
(এটা তার স্থান যে ছিন্ন হওয়া থেকে আপনার আশ্রয় গ্রহণ করে)। অর্থাৎ এই যে স্থানে আমি দাঁড়িয়েছি এটা এমন এক স্থান, যেখান থেকে আপনার আশ্রয়প্রার্থী সম্পর্কচ্ছেদের দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তিলাভের জন্য আশ্রয় গ্রহণ করে। এর দ্বারা ঠিক কোন স্থান বোঝানো হয়েছে, এই দৃশ্যমান জগতে বসে তা বোঝা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
বাক্যটির অর্থ এরকমও হতে পারে যে, আমার এই দাঁড়ানোটা সম্পর্কচ্ছেদের বিপদ থেকে আশ্রয় গ্রহণকারীর দাঁড়ানো। অর্থাৎ এটা সুখের ও আনন্দের দাঁড়ানো নয়; বরং বিপন্নজনের সকাতর ও উদ্বেগপূর্ণ দাঁড়ানো। এ কথা বলার উদ্দেশ্য- ফরিয়াদ ও আর্জি যাতে গ্রহণ করা হয়, সে লক্ষ্যে মহাবিচারপতি আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও সদয়দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
আল্লাহ তায়ালা আত্মীয়তার আর্জি কবুল করলেন। তিনি বললেন,
أما ترضين ان اصل من وصلك واقطع من قطعك
(তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও, যে ব্যক্তি তোমাকে জুড়ে রাখবে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে রাখব আর যে ব্যক্তি তোমাকে ছিন্ন করবে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব?)। اصل ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি الصلة والوصال থেকে। এর অর্থ মেলানো ও সংযুক্ত করা। এখানে জানানো হয়েছে- বান্দা আত্মীয়তা সংলগ্ন ও সংযুক্ত রাখলে আল্লাহ তায়ালা তাকে নিজের সঙ্গে মিলিত ও যুক্ত করে রাখবেন।
আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে কারও স্থানগতভাবে সংযুক্ত থাকা অসম্ভব। কাজেই এর দ্বারা স্থানগত নয়; বরং মর্যাদাগত মিলন ও সংযোগ বুঝতে হবে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আত্মীয়তা রক্ষা করবে, আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি খুশি হয়ে দুনিয়ায় তাকে ইজ্জত-সম্মান দেবেন এবং আখেরাতে তাঁর সন্তুষ্টির স্থান জান্নাতের সম্মানজনক জীবন দান করবেন।
বিজ্ঞজনদের কেউ কেউ বলেন, আত্মীয়তা রক্ষা বলতে মূলত আত্মীয়ের প্রতি সদয় আচরণ বোঝানো হয়। সে হিসেবে বাক্যটির মর্ম হচ্ছে- যে ব্যক্তি আত্মীয়ের প্রতি সদয় আচরণ করবে, আল্লাহ তায়ালাও তার প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্যের আচরণ করবেন।
বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আত্মীয়তা ছিন্ন করবে, আল্লাহ তায়ালাও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। অর্থাৎ তার প্রতি দয়া ও রহমতের আচরণ করা হবে না। বলাবাহুল্য বান্দা প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ তায়ালার রহমতের মুহতাজ। আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত ব্যক্তি দুনিয়ায় প্রকাশ্য ও গুপ্ত হাজারও পেরেশানি ও বালা-মসিবতের শিকার হয়ে যায়। কাজেই আত্মীয়তা ছিন্নের পরিণামে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের যে সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে, তার কঠোরতা ও গভীরতা উপলব্ধি করা চাই। বিশেষত এ কারণেও যে, আখেরাতের নাজাত ও মুক্তি কেবলই আল্লাহ তায়ালার রহমতের উপর নির্ভরশীল। যার সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলবেন, সে কী করে আখেরাতে তাঁর রহমত লাভের আশা করবে?
আত্মীয়তা ছিন্ন করার পরিণাম যে অত্যন্ত ভয়াবহ তা স্পষ্ট করার জন্য হাদীছে কুরআন মাজীদের একটি আয়াতও উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাতে ইরশাদ হয়েছে,
فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ
‘অতঃপর তোমরা (জিহাদ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিলে কি তোমাদের দ্বারা ভূমিতে অশান্তি বিস্তার এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করার সম্ভাবনা আছে? এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লা’নত করেছেন (অর্থাৎ তাঁর রহমত থেকে দূর করে দিয়েছেন।) ফলে তাদেরকে বধির বানিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখ অন্ধ করে দিয়েছেন’। অর্থাৎ জিহাদের ব্যতিব্যস্ততা ছেড়ে দিলে সমাজে অশান্তি বিস্তারে লিপ্ত হয়ে পড়ার ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার আশঙ্কা থাকে। জিহাদ করা অবস্থায় সবটা শক্তি ব্যয় হয় আল্লাহ তায়ালার দুশমনদের দমন করার কাজে। মন-মস্তিষ্কও সেই ফিকিরেই রত থাকে। পক্ষান্তরে জিহাদ থেকে অবসর হয়ে কেবল দুনিয়াবী কাজকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়লে পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ দেখা দেয় এবং তার পরিণামে দেখা দেয় আত্মকলহ। তখন শারীরিক ও মানসিক সবরকম শক্তি-ক্ষমতা একে অন্যকে দমন করা ও দাবিয়ে রাখার পেছনে ব্যয় হয়। যে শক্তি ব্যয় হত দীনের শত্রুদমনে, তা আত্মঘাতী ভ্রাতৃদমনে নিঃশেষ করা হয়। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, বর্তমানকার মুসলিম জাতির আত্মকলহ ও সর্বাত্মক পশ্চাদপদতা তাদের জিহাদবিমুখতারই পরিণাম।
توليتم এর এক অর্থ হতে পারে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ করা। এ হিসেবে আয়াতটির অর্থ হবে- তোমরা যদি কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী হও, তবে কি তোমাদের দ্বারা ভূমিতে অশান্তি বিস্তার এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করার সম্ভাবনা আছে?’ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা মানুষকে আত্মকলহ ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার পথে টেনে নেয়। ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা রক্ষার লোভ এমনই সর্বনাশা ব্যাধি, যা মানুষের অন্তর থেকে মায়া-মমতা কেড়ে নেয়। ক্ষমতালোভী ব্যক্তির কাছে আত্মীয়তার কোনও মূল্য থাকে না। কেবল আত্মীয়তা ছিন্ন করাই নয়, পরমাত্মীয় রক্তের ভাইকে পর্যন্ত হত্যা করতেও সে কুণ্ঠাবোধ করে না। কেননা ক্ষমতার লোভ ও ক্ষমতার দর্পে সে অন্ধ ও বধির হয়ে যায়। না সে সত্য ও ন্যায়ের পথ দেখতে পায় আর না সত্য-ন্যায়ের বাণী শুনতে পায়। এ অবস্থায় কঠিন থেকে কঠিনতর অপরাধে লিপ্ত হতেও তার দ্বিধাবোধ হয় না। এ আয়াতে সে আশঙ্কাই ব্যক্ত হয়েছে। এ অনর্থের কারণেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া উচিত নয়। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যদি ক্ষমতা এসে যায়, কেবল তখনই আল্লাহভীতির সঙ্গে তা গ্রহণ ও পরিচালনা করা চাই।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. এ হাদীছ দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষার ফযীলত ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার অশুভ পরিণাম সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়। সুতরাং প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য আত্মীয়তা রক্ষায় সর্বপ্রকারে যত্নবান থাকা এবং কোনও অবস্থায়ই যাতে আত্মীয়তা ছিন্ন না হয়ে যায় সে ব্যাপারে সাবধান থাকা।
খ. হাদীছটি দ্বারা এ বিশ্বাস জোরদার হয় যে, বিশ্বজগৎ এমনিই সৃষ্টি হয়ে যায়নি; বরং সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাতেই তা অস্তিত্ব লাভ করেছে।
গ. বাকশক্তি আল্লাহ তায়ালার দান। তিনি চাইলে যে-কোনও বস্তু ও যে-কোনও বিষয়কে এ শক্তির অধিকারী করতে পারেন। ‘আত্মীয়তা’ নামক সম্পর্কটিকে এ শক্তি দান করার দ্বারা এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায়।
ঘ. জিহাদ ইসলামের এক স্থায়ী বিধান। এর থেকে বিমুখ হওয়া সামাজিক অশান্তি ও পারস্পরিক কলহ-বিবাদের একটি কারণ।
ঙ. ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া সর্বাত্মক অনিষ্টকর একটি তৎপরতা। প্রত্যেক মুসলিমের এর থেকে বিরত থাকা উচিত।
ক্রমিক নং : ৫৬ | |
আরবি | বাংলা |
وَعَنْهُ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم قَالَ: الرَّحِمُ شُجْنَةٌ مِنَ الرَّحْمنِ. فَقَالَ اللهُ: مَنْ وَصَلَكِ وَصَلْتُهُ وَمَنْ قَطَعَكِ قَطَعْتُهُ. | অনুবাদ: . আবু হুরায়রা রাদি. বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন : ‘রেহম’ শব্দটি ‘রহমান’ হইতে উদ্ভূত। এই কারণে আল্লাহ্ তায়ালা বলিয়াছেন, যে ব্যক্তি তোমাকে মিলাইয়া রাখে আমিও তাহাকে আমার সাথে মিলাইয়া রাখিব। আর যে ব্যক্তি তোমাকে ছিন্ন করে আমিও তাহাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দিব।[39] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : যে ব্যক্তি আত্মীয়তা রক্ষা করবে, আল্লাহ তায়ালা নিজের সঙ্গে তার সম্পর্ক রক্ষা করবেন। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তা ছিন্ন করবে, আল্লাহ তায়ালা তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে কারও স্থানগতভাবে সংযুক্ত থাকা অসম্ভব। কাজেই এর দ্বারা স্থানগত নয়; বরং মর্যাদাগত মিলন ও সংযোগ বুঝতে হবে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আত্মীয়তা রক্ষা করবে, আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি খুশি হয়ে দুনিয়ায় তাকে ইজ্জত-সম্মান দেবেন এবং আখেরাতে তাঁর সন্তুষ্টির স্থান জান্নাতের সম্মানজনক জীবন দান করবেন।
বিজ্ঞজনদের কেউ কেউ বলেন, আত্মীয়তা রক্ষা বলতে মূলত আত্মীয়ের প্রতি সদয় আচরণ বোঝানো হয়। সে হিসেবে বাক্যটির মর্ম হচ্ছে- যে ব্যক্তি আত্মীয়ের প্রতি সদয় আচরণ করবে, আল্লাহ তায়ালাও তার প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্যের আচরণ করবেন।
বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আত্মীয়তা ছিন্ন করবে, আল্লাহ তায়ালাও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। অর্থাৎ তার প্রতি দয়া ও রহমতের আচরণ করা হবে না। বলাবাহুল্য বান্দা প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ তায়ালার রহমতের মুহতাজ। আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত ব্যক্তি দুনিয়ায় প্রকাশ্য ও গুপ্ত হাজারও পেরেশানি ও বালা-মসিবতের শিকার হয়ে যায়। কাজেই আত্মীয়তা ছিন্নের পরিণামে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের যে সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে, তার কঠোরতা ও গভীরতা উপলব্ধি করা চাই। বিশেষত এ কারণেও যে, আখেরাতের নাজাত ও মুক্তি কেবলই আল্লাহ তায়ালার রহমতের উপর নির্ভরশীল। যার সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলবেন, সে কী করে আখেরাতে তাঁর রহমত লাভের আশা করবে?
আত্মীয়তা ছিন্ন করার পরিণাম যে অত্যন্ত ভয়াবহ তা স্পষ্ট করার জন্য হাদীছে কুরআন মাজীদের একটি আয়াতও উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাতে ইরশাদ হয়েছে,
فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ
‘অতঃপর তোমরা (জিহাদ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিলে কি তোমাদের দ্বারা ভূমিতে অশান্তি বিস্তার এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করার সম্ভাবনা আছে? এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লা’নত করেছেন (অর্থাৎ তাঁর রহমত থেকে দূর করে দিয়েছেন।) ফলে তাদেরকে বধির বানিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখ অন্ধ করে দিয়েছেন’। অর্থাৎ জিহাদের ব্যতিব্যস্ততা ছেড়ে দিলে সমাজে অশান্তি বিস্তারে লিপ্ত হয়ে পড়ার ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার আশঙ্কা থাকে। জিহাদ করা অবস্থায় সবটা শক্তি ব্যয় হয় আল্লাহ তায়ালার দুশমনদের দমন করার কাজে। মন-মস্তিষ্কও সেই ফিকিরেই রত থাকে। পক্ষান্তরে জিহাদ থেকে অবসর হয়ে কেবল দুনিয়াবী কাজকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়লে পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ দেখা দেয় এবং তার পরিণামে দেখা দেয় আত্মকলহ। তখন শারীরিক ও মানসিক সবরকম শক্তি-ক্ষমতা একে অন্যকে দমন করা ও দাবিয়ে রাখার পেছনে ব্যয় হয়। যে শক্তি ব্যয় হত দীনের শত্রুদমনে, তা আত্মঘাতী ভ্রাতৃদমনে নিঃশেষ করা হয়। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, বর্তমানকার মুসলিম জাতির আত্মকলহ ও সর্বাত্মক পশ্চাদপদতা তাদের জিহাদবিমুখতারই পরিণাম।
توليتم এর এক অর্থ হতে পারে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ করা। এ হিসেবে আয়াতটির অর্থ হবে- তোমরা যদি কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী হও, তবে কি তোমাদের দ্বারা ভূমিতে অশান্তি বিস্তার এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করার সম্ভাবনা আছে?’ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা মানুষকে আত্মকলহ ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার পথে টেনে নেয়। ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা রক্ষার লোভ এমনই সর্বনাশা ব্যাধি, যা মানুষের অন্তর থেকে মায়া-মমতা কেড়ে নেয়। ক্ষমতালোভী ব্যক্তির কাছে আত্মীয়তার কোনও মূল্য থাকে না। কেবল আত্মীয়তা ছিন্ন করাই নয়, পরমাত্মীয় রক্তের ভাইকে পর্যন্ত হত্যা করতেও সে কুণ্ঠাবোধ করে না। কেননা ক্ষমতার লোভ ও ক্ষমতার দর্পে সে অন্ধ ও বধির হয়ে যায়। না সে সত্য ও ন্যায়ের পথ দেখতে পায় আর না সত্য-ন্যায়ের বাণী শুনতে পায়। এ অবস্থায় কঠিন থেকে কঠিনতর অপরাধে লিপ্ত হতেও তার দ্বিধাবোধ হয় না। এ আয়াতে সে আশঙ্কাই ব্যক্ত হয়েছে। এ অনর্থের কারণেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া উচিত নয়। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যদি ক্ষমতা এসে যায়, কেবল তখনই আল্লাহভীতির সঙ্গে তা গ্রহণ ও পরিচালনা করা চাই।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা করা। এটা আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে নিজ সম্পর্ক অটুট রাখার একটি উপায়।
খ. আত্মীয়তা ছিন্ন করা অতি বিপজ্জনক কাজ। কেননা এর পরিণামে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
ক্রমিক নং : ৫৭ | |
আরবি | বাংলা |
٥٧- وَعَنْ أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم يَقُولُ: مَنْ أَحَبَّ أنْ يُبْسَطَ فِي رِزْقِهِ وَيُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ.[] | অনুবাদ: . আনাস ইবনে মালিক রাদি. বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তার জীবিকার প্রশস্ততা চায় এবং সে দীর্ঘায়ু কামনা করে, সে যেন তার আত্মীয়তার সম্বন্ধ সংযুক্ত রেখে চলে।[40] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছে আত্মীয়তা রক্ষার দু’টি সুফল বলা হয়েছে- ক. রিযিক বৃদ্ধি এবং খ. আয়ু বৃদ্ধি। প্রথমে ইরশাদ হয়েছে,
من أحب أن يبسط له في رزقه
(যে ব্যক্তি কামনা করে যে, তার রিযিক প্রশস্ত করা হোক)।
অপর এক হাদীছে আছে, যাকে এটা আনন্দ দেয় যে, তার রিযিক প্রশস্ত করা হোক। রিযিক প্রশস্ত করার এক অর্থ আয়-রোজগার বৃদ্ধি পাওয়া, আরেক অর্থ বরকত লাভ হওয়া। বরকত লাভ হওয়াটাও একরকম বৃদ্ধিই বটে। কেননা তাতে অল্প দ্বারা বেশি প্রয়োজন মিটে যায়। আয়-রোজগারের মূল্য উদ্দেশ্য প্রয়োজন পূরণ হওয়াই। বিপুল আয় হওয়া সত্ত্বেও যদি প্রয়োজন না মেটে, তবে সে আয়ের কোনও সার্থকতা নেই। অপরদিকে অল্প আয় দ্বারাও যদি প্রয়োজন মিটে যায়,তবে সে অল্পকে অপর্যাপ্ত বলা যায় না। মোটকথা আয় বৃদ্ধি দ্বারা হোক বা বরকত দান দ্বারা হোক, যে-কোনও অবস্থায় প্রয়োজন মিটে যাওয়া আল্লাহ তায়ালার অনেক বড় নি’আমত। এ নি’আমত লাভের একটি বড় উপায় হচ্ছে আত্মীয়তা রক্ষা করা ও আত্মীয়বর্গের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা।
দ্বিতীয়ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
نسأله في أثره فليصل رحمه
(এবং তার আয়ু বৃদ্ধি করা হোক, সে যেন তার আত্মীয়তা রক্ষা করে)। أثر দ্বারা আয়ু বোঝানো হয়েছে। এর মূল অর্থ পায়ের ছাপ। মানুষ যতদিন জীবিত থাকে, ততদিন মাটির উপর তার চলাফেরার চিহ্ন ও ছাপ পড়ে। যখন সে মারা যায় তখন চলাফেরাও বন্ধ হয়ে যায়, ফলে মাটির উপর তার পায়ের ছাপ পড়তে পারে না। বোঝা গেল মাটিতে পায়ের ছাপ পড়াটা বেঁচে থাকার নিদর্শন। এ কারণেই পায়ের ছাপ দ্বারা রূপকার্থে আয়ু বোঝানো হয়ে থাকে। এ হাদীছে জানানো হয়েছে আত্মীয়তা রক্ষার দ্বারা আয়ু বৃদ্ধি পায়।
এ হাদীছটির প্রতি লক্ষ করে কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, কুরআন মাজীদের বক্তব্য দ্বারা তো আমরা জানতে পারি যে, কারও আয়ু বাড়ে কমে না। যেমন ইরশাদ হয়েছে,
فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ
(যখন তাদের সেই নির্দিষ্ট সময় এসে পড়ে, তখন তারা এক মুহূর্তও বিলম্ব করতে পারে না এবং ত্বরাও করতে পারে না) অর্থাৎ যার যখন মৃত্যু স্থির করা আছে ঠিক তখনই মৃত্যু হবে, তার আগেও হবে না, পরেও না। এ অবস্থায় আত্মীয়তা রক্ষা দ্বারা আয়ু বৃদ্ধির কথা বলাটা এ আয়াতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় কি?
এর উত্তর এই যে, হাদীছে মূলত আয়ুর সময়কাল বৃদ্ধির কথা বোঝানো হয়নি; বরং বোঝানো উদ্দেশ্য আয়ুতে বরকত লাভ হওয়া। অর্থাৎ অল্প সময়ে বিস্তর আমল করতে পারা। যে ব্যক্তি আত্মীয়তা রক্ষা করবে, আল্লাহ তায়ালা তার আয়ুতে এত বরকত দান করবেন যে, সে অল্প সময়ের মধ্যেই এতবেশি আমল করতে পারবে, যা অন্যরা অনেক অনেক দীর্ঘ সময়েও করতে সক্ষম হয় না। আমরা আল্লাহ তায়ালার এমন বহু বান্দা সম্পর্কে জানতে পারি, যাদের একেকজন জীবনে এত কাজ করে গেছেন, যা একটি দল বা সংঘের পক্ষেও করা কঠিন। ইমাম আবূ হানীফা রহ., ইমাম তাবারী রহ. ইমাম যাহাবী রহ., হাফেয ইবন হাজার আসকালানী রহ., হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. প্রমুখ ছিলেন এমনই ক্ষণজন্মা মনীষী। তাদের একেকজন উম্মতের ইলমী ও আমলী যে বিপুল খেদমত করে গেছেন, বহু লোকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ও তা সম্ভব নয়। এটিকে তাদের সময়ের বরকত ছাড়া আর কিছু দ্বারাই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
হাদীছটির মর্ম এই যে, আত্মীয়তা রক্ষা আল্লাহ তায়ালার তাওফীক লাভের একটি বড় মাধ্যম। এর দ্বারা সহজে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভ করা যায় এবং অনর্থক ও বেহুদা কাজ থেকে সময়ের হেফাজত হয়।
কারও কারও মতে আয়ু বৃদ্ধি দ্বারা নেক বংশধর বোঝানো হয়েছে। কোনও কোনও হাদীছ দ্বারাও এর সমর্থন মেলে, যাতে বলা হয়েছে- আত্মীয়তা রক্ষা করলে যে আয়ু বৃদ্ধি হয় তার অর্থ মৃত্যু পিছিয়ে দেওয়া নয়; বরং নেক সন্তান দান করা।
ইবন ফুওয়াররাক রহ. বলেন, আয়ু বৃদ্ধি দ্বারা মূলত আত্মীয়তা রক্ষাকারীর বুঝ-বুদ্ধিকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করা বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত তার বুদ্ধি-বিবেক সুস্থ থাকবে, কখনও অপ্রকৃতিস্থ হবে না।
আয়ু বৃদ্ধিকে কীর্তিময় জীবনলাভ দ্বারাও ব্যাখ্যা করা যায়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আত্মীয়তা রক্ষা করে, তার জীবন হবে এমনই কীর্তিময় ও কর্মবহুল, যে কারণে সে মরেও অমর হয়ে থাকবে। সে তার কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার দেহ মাটির নিচে চলে যাবে বটে, কিন্তু তার কর্ম বহুদিন বেঁচে থাকবে। এর সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নবী-রাসূলগণ। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কত হাজার বছর আগে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন, অথচ সারা জাহানের মানুষ আজও তাঁর কথা স্মরণ করে। কুরআন মাজীদে তাঁর দুআ বর্ণিত হয়েছে,
وَاجْعَلْ لِي لِسَانَ صِدْقٍ فِي الْآخِرِينَ
(এবং পরবর্তীকালীন লোকদের মধ্যে আমার পক্ষে এমন রসনা সৃষ্টি করুন, যা আমার সততার সাক্ষ্য দেবে)।
অর্থাৎ এমন সৎকর্ম ও সুকীর্তির তাওফীক দান করুন, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম আমার সুখ্যাতি করে ও আমার অনুসরণ করতে আগ্রহী হয় এবং শেষ জমানায় যেন আমার বংশধরদের মধ্যে নবী-রাসূলের আগমন ঘটে, যারা আমার দীনকে নবজীবন দান করবে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর এ দুআ এমনভাবে কবুল করেছেন যে, আজ সকল আসমানী ধর্মের অনুসারীরা এমনকি যারা তাঁর আদর্শ হতে বিচ্যুত, তারা পর্যন্ত তার অকুন্ঠ প্রশংসা করে এবং নিজেদেরকে তাঁর দীনের পরিচয়ে পরিচিত করতে গর্ববোধ করে। শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো নিজেকে তাঁরই দুআর ফসল বলে প্রকাশ করতেন এবং তিনি ও তার অনুসারীগণ ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এমনই স্মৃতিচারণকারী যে, পাঁচ ওয়াক্তের নামাযে তারা নিত্যদিন উচ্চারণ করেন,
كما صليت على إبراهيم ……. كما باركت على إبراهيم
উপরে যে মহান ব্যক্তিবর্গের কথা বলা হলো, তাঁদেরও রেখে যাওয়া কীর্তি আজও পর্যন্ত মানুষের মাঝে জীবন্ত হয়ে আছে। থাকবে আরও বহুকাল। প্রকৃতপক্ষে এ জীবনই তো মানুষের কাম্য। কর্মহীন শতবর্ষী জীবনের চেয়ে কর্মময় অল্প আয়ুও অনেক অনেক ভালো।
কেউ কেউ হাদীছে বর্ণিত আয়ু বৃদ্ধিকে আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করেছেন। উলামায়ে কেরাম বলেন, আয়ু দুই রকম- চূড়ান্ত স্থিরীকৃত আয়ু ও শর্তযুক্ত আয়ু। লাওহে মাহফুযে শর্তযুক্ত আয়ু লেখা আছে। যেমন তাতে লেখা আছে, অমুক ব্যক্তি যদি পিতা-মাতার আনুগত্য করে তবে তার আয়ু হবে এই, অন্যথায় তার আয়ু হবে এই। এটা হচ্ছে শর্তযুক্ত আয়ু। এটাই ফিরিশতাদের জানানো হয় এবং এটাই আলোচ্য হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। আরেক হচ্ছে শর্তহীন চূড়ান্ত আয়ু। অর্থাৎ ওই ব্যক্তি পিতা-মাতার আনুগত্য করবে কি করবে না তা আল্লাহ তায়ালার জানা আছে। আল্লাহ তায়ালার সেই জ্ঞান অনুযায়ী তার যে আয়ু, সেটাই চূড়ান্ত আয়ু। উপরে বর্ণিত আয়াতে এ আয়ুর কথাই বলা হয়েছে।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. এ হাদীছ দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষার মাহাত্ম্য জানা গেল যে, এর জন্য পরকালীন যে পুরস্কার নির্ধারিত আছে তা তো রয়েছেই, সেইসঙ্গে এতে দুনিয়ারও লাভ আছে। আর তা হলো এর দ্বারা রিযিকের প্রশস্ততা ও আয়ুতে বরকত লাভ হয়।
খ. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা লাভ হলো যে, শরীআতসম্মত পার্থিব কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যেও নেক আমল করা যেতে পারে।
بِرُّ الْوَالِدَيْنِ |
পিতামাতাকে সম্মান করা |
ক্রমিক নং : ৫৮ | |
আরবি | বাংলা |
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ! مَنْ أَحَقُّ النَّاسِ بِحُسْنِ صَحَابَتِي؟ قَالَ: أُمُّكَ. قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: ثُمَّ أُمُّكَ. قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: ثُمَّ أُمُّكَ. قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: ثُمَّ أَبُوكَ. | অনুবাদ: . আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করলো: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার বেশী হকদার? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বললঃ তারপর কে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মা। সে বললঃ তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বললঃ তারপর কে? তিনি বললেন, তারপর তোমার পিতা। ইবনে শুবরুমা ও ইয়াহয়া ইবনে আইয়ুব আবু যুরআ থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।[41] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : উত্তম সোহবত মানে ভালো ব্যবহার করা, খেদমত করা ও সন্তুষ্ট রাখার প্রচেষ্টার সঙ্গে সহাবস্থান করা। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে মানুষকে পিতা-মাতা, ভাইবোনসহ অনেকের সঙ্গেই মেলামেশা করতে হয়। তবে সকলের সঙ্গেই সমপর্যায়ে মেলামেশা ও সহাবস্থান করা হয় না। কারও সঙ্গে বেশি হয়, কারও সঙ্গে কম। আবার যাদের সঙ্গে একত্রে থাকা হয়, তাদের সকলের সঙ্গে সম্পর্কও সমপর্যায়ের নয়। অপেক্ষাকৃতভাবে কারও সঙ্গে সম্পর্ক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়, কারও সঙ্গে কম। এসব বিবেচনায় সদাচরণ ও সদ্ব্যবহারের অধিকারেও তারতম্য থাকার কথা। সে তারতম্যের প্রতি লক্ষ রাখা না হলে অধিকার খর্বের আশঙ্কা থাকে। সে কারণেই জনৈক সাহাবি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রশ্ন করেছেন যে, আমার সর্বাপেক্ষা উত্তম ব্যবহার ও উত্তম সোহবত লাভের অধিকার বেশি কার?
এই প্রশ্নকর্তা কে ছিলেন, এ বর্ণনায় তার উল্লেখ নেই। ইমাম বুখারী রহ. আল আদাবুল মুফরাদ গ্রন্থে এ হাদীছটি উল্লেখ করেছেন। সেখানে প্রশ্নকর্তার নাম বলা হয়েছে মুআবিয়া ইবন হায়দাহ। সুনানে আবূ দাউদ ও সুনানে তিরমিযীতেও মুআবিয়া ইবন হায়দাহ’র নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যাহোক তার প্রশ্নের উত্তরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মা। সাহাবি একই প্রশ্ন বার বার করতে থাকেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও একই উত্তর দিতে থাকেন। পরপর তিনবার তিনি বলতে থাকেন তোমার মা। চতুর্থবার বললেন, তোমার পিতা।
এর দ্বারা বোঝা গেল সদাচরণ ও খেদমতলাভের ক্ষেত্রে মায়ের হক সবার উপরে। এমনকি পিতার চেয়েও তিনগুণ বেশি। কেন তিনগুণ বেশি, তা কুরআন মাজীদের এক আয়াত দ্বারা উপলব্ধি করা যায়। ইরশাদ হয়েছে
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ
আমি মানুষকে তার পিতা-মাতা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি, (কেননা) তার মা কষ্টের পর কষ্ট সয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু বছরে।
এ আয়াতে প্রথমে পিতা-মাতা উভয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের আদেশদানের পর মায়ের বিশেষ তিনটি কাজ উল্লেখ করা হয়েছে- সন্তানকে কষ্ট-ক্লেশের সঙ্গে গর্ভে ধারণ করতে থাকা, প্রসব করা এবং দুধপান করানো। সন্তানের জন্ম ও লালন-পালনে এ তিনওটি কাজ অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এবং এ কষ্ট একা মাকেই বরদাশত করতে হয়। অন্যসব কাজে পিতা-মাতা উভয়ে অংশীদার থাকে। এ কারণেই পিতা-মাতা উভয়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করে যাওয়া সন্তানের একান্ত কর্তব্য। তবে মা যেহেতু বাড়তি তিনটি কষ্টসাধ্য কাজ একাই করে থাকে, তাই খেদমত ও সেবাযত্নও পিতা অপেক্ষা মায়ের তিনগুণ বেশি প্রাপ্য।
হাদীছের দ্বিতীয় বর্ণনাটির শেষে আছে, ثم ادناك ادناك (তারপর পর্যায়ক্রমে তোমার নিকটজন, তোমার নিকটজন)। অর্থাৎ যে যতবেশি কাছের তার হকও ততবেশি এবং তুলনামূলকভাবে যে যত দূরের তার হকও তত কম। উলামায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ এভাবে স্তর বিন্যাস করেছেন যে, সর্বোচ্চ অধিকার মায়ের, তারপর পিতার, তারপর দাদা-দাদীর, তারপর নানা-নানীর, তারপর ভাইবোনের, তারপর চাচার ও ফুফুর, তারপর মামা-খালার, তারপর ভাতিজা-ভাতিজী, ভাগিনা-ভাগিনী, চাচাতো ভাইবোন, ফুফাতো ভাইবোন, মামাতো ভাইবোন, খালাতো ভাইবোন, তারপর আত্মীয় প্রতিবেশীর, তারপর অনাত্মীয় প্রতিবেশীর এভাবে ক্রমবিস্তার হতে থাকবে।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. প্রত্যেক সন্তানের কর্তব্য সেবাযত্ন ও খুশি রাখার চেষ্টা-মেহনতের ক্ষেত্রে মাকে সর্বোচ্চ স্থানে রাখা।
খ. সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতার পর্যায়ক্রম অনুযায়ী সদাচরণের পর্যায়ক্রম রক্ষা করা উচিত।
গ. শরীআতের হুকুম পালনে কোনও ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা বোধ হলে সে বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা উচিত।
ক্রমিক নং : ৫৯ | |
আরবি | বাংলা |
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللهِ! مَنْ أَحَقُّ النَّاسِ بِحُسْنِ الصُّحْبَةِ؟ قَالَ: أُمَّكَ، ثُمَّ أُمَّكَ، ثُمَّ أُمَّكَ، ثُمَّ أَبَاكَ، ثُمَّ أَدْنَاكَ أَدْنَاكَ . (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ) | অনুবাদ: . আবু হুরায়রা রাদি. বলেন, একবার এক ব্যক্তি আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্। আমার সাহচর্যে কে সর্বাপেক্ষা অধিক সৌজন্যমূলক আচরণ পাওয়ার অধিকারী? তিনি বললেন: তোমার মা। তারপর তোমার মা। তারপর তোমার মা। তারপর তোমার বাবা। অতঃপর তোমার (পর্যায়ক্রমে) নিকটতম ব্যক্তিবর্গ।[42] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
ক্রমিক নং : ৬০ | |
আরবি | বাংলা |
قَالَ اللهُ تَعَالى : ﴿وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ﴾ [لقمان: 15] | অনুবাদ: 60. আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারা যদি এমন কাউকে (প্রভুত্বে) আমার সমকক্ষ সাব্যস্ত করার জন্য তোমাকে চাপ দেয়, যে সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তবে তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ভাবে থাকবে। এমন ব্যক্তির পথ অবলম্বন করো, যে একান্তভাবে আমার অভিমুখী হয়েছে। অতঃপর তোমাদের সকলকে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদেরকে অবহিত করব তোমরা যা-কিছু করতে। [সুরা লুকমান : (৩১) : 15] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ভাবে থাকবে : অর্থাৎ দীনের ব্যাপারে পিতা-মাতা কোন অন্যায় কথা বললে তা মানা তো জায়েয হবে না, কিন্তু তাদের কথা এমন পন্থায় রদ করা যাবে না, যা তাদের জন্য কষ্টদায়ক হয় বা যাতে তারা নিজেদেরকে অপমানিত বোধ করে। বরং তাদেরকে নম্র ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়া উচিত যে, আমি আপনাদের কথা মানতে অপারগ। কেবল এতটুকুই নয়; বরং সাধারণভাবে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই তাদের সাথে সদাচরণ করতে হবে। তাদের খেদমত করতে হবে, আর্থিকভাবে তাদের সাহায্য করতে হবে এবং তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের সেবা-যত্ন করতে হবে ইত্যাদি।
এমন ব্যক্তির পথ অবলম্বন করো, যে একান্তভাবে আমার অভিমুখী হয়েছে : মাতা-পিতা যেহেতু ভ্রান্ত পথে আছে তাই তাদের পথ অবলম্বন করা যাবে না কিছুতেই; বরং পথ অবলম্বন করতে হবে কেবল তাদেরই, যারা আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। অর্থাৎ কেবল তাঁরই ইবাদত ও আনুগত্য করে। এর ভেতর এই ইঙ্গিতও রয়েছে যে, দীনের অনুসরণও কেবল নিজ বুদ্ধি-বিবেচনার ভিত্তিতে করা ঠিক নয়; বরং যারা আল্লাহ তায়ালার আশেক ও তাঁর পরিপূর্ণ অনুগত বলে পরিষ্কারভাবে জানা আছে, দেখতে হবে তারা দীনের অনুসরণ করে কিভাবে এবং তাদের আমলের ধরণ কী? তারা যে কাজ যেভাবে করেন ঠিক সেভাবেই তা সম্পাদন করা চাই। সমস্ত আমলে তাদেরই পথ অনুসরণ করা চাই। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে এবং যথার্থই বলা হয়ে থাকে যে, ব্যক্তিগত পড়াশোনার ভিত্তিতে কুরআন ও হাদিসের এমন কোন ব্যাখ্যা করা ও তা থেকে এমন কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কিছুতেই সমীচীন নয়, যা উম্মতের উলামায়ে কিরাম ও বুযুর্গানে দীন থেকে প্রাপ্ত ব্যাখ্যার পরিপন্থী।
ক্রমিক নং : ৬১ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِي بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَتْ: أَتَتْنِي أُمِّي وَهِيَ رَاغِبَةٌ في عَهْدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم فَسَأَلْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : أَصِلُهَا؟ قَالَ: نَعَمْ. | অনুবাদ: . আসমা বিনতে আবু বাকর (রাযিঃ) বলেন, আমার মা নবী করীম (ﷺ)–এর যুগে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট অবস্থায় আমার কাছে আসলেন। আমি নবী করীম (ﷺ)–কে জিজ্ঞাসা করলাম, আমি কি তার সাথে নিকটাত্মীয়ের মত ব্যবহার করব ? তিনি বললেন, হ্যা। [43] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
ক্রমিক নং : ৬২ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : رَغِمَ أَنْفُهُ رَغِمَ أَنْفُهُ قِيْلَ مَنْ يَا رَسُولَ اللهِ! : قَالَ: مَنْ أَدْرَكَ وَالِدَيْهِ عِندَ الْكِبَرِ أَحَدَهُمَا أَوْ كِلَيْهِمَا ثُمَّ لَمْ يَدْخُلِ الْجَنَّةَ. | অনুবাদ: . আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তার নাক ধুলিমলীন হোক, আবার তার নাক ধূলিমলীন হোক, আবার তার নাক ধূলিমলীন হোক। জিজ্ঞাসা করা হল, কার ইয়া রাসুলাল্লাহ! তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা–মাতার উভয়কে অথবা তাদের একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল, এরপরও সে জান্নাতে প্রবেশ করল না।[44] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : ‘তার নাসিকা ধূলিসাৎ হোক’, এটি আরবদের একটি প্রচলিত পরিভাষা। বাক্যটি কোন কোন সময় আদর-সোহাগের স্থলে ব্যবহার করা হলেও সাধারণতঃ অসন্তুষ্টি ও ধ্বংসের তথা অভিশাপের অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর এখানেও এই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘জান্নাতে প্রবেশ করল না’-এর অর্থ আল্লামা নববী বলেন, সে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ পাওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে।
ক্রমিক নং : ৬৩ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي الطُّفَيْلِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم يَقْسِمُ لَحْمًا بِالْجِعِرَّانَةِ إِذْ أَقْبَلَتْ امْرَأَةٌ حَتَّى دَنَتِ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم فَبَسَطَ لَهَا رِدَاءَهُ، فَجَلَسَتْ، فَقُلْتُ: مَنْ هِيَ؟ فَقَالُوْا: أُمُّهُ الَّتِي أَرْضَعَتْهُ. | অনুবাদ: . আবু তুফায়ল রাদি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একবার আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–কে জি’রানা নামক স্থানে গোশত বন্টন করতে দেখি। আবু তুফায়ল রাদি. বলেনঃ এ সময় আমি ছোট একজন মহিলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর কাছে আসলে, তিনি তাঁর চাদর সে মহিলার জন্য বিছিয়ে দেন, যার উপর সে বসে। তখন আমি জিজ্ঞাসা করিঃ এ মহিলা কে? সাহাবিগণ বলেনঃ ইনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর দুধ–মাতা, যিনি তাকে ছোটকালে দুধ পান করান।[45] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : ইনি ছিলেন নবীজির রেযায়ী মা (ধাত্রী) হালীমা সাদিয়া। অর্থাৎ, হাওয়াযিন গোত্রীয় বনী সাদ শাখার হালীমা বিনতে আবু যুআইব। তাঁকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন মায়ের মত সম্মান করতেন।
ক্রমিক নং : ৬৪ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : إِنَّ مِنْ أَكْبَرِ الْكَبَائِرِ أَنْ يَلْعَنَ الرَّجُلُ وَالِدَيْهِ. قِيْلَ: يَا رَسُولَ اللهِ! وَكَيْفَ يَلْعَنُ الرَّجُلُ وَالِدَيْهِ ؟ قَالَ: يَسُبُّ أَبَا الرَّجُلِ فَيَسُبُّ أَبَاهُ وَيَسُبُّ أمَّهُ فَيَسُبُّ أمَّهُ. | অনুবাদ: . আব্দুল্লাহ ইবন্ আমর ইবনুল আস রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কারও তার পিতা–মাতাকে গালি দেওয়া মহাপাপসমূহের একটি। সাহাবিগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোনও লোক কি তার পিতা–মাতাকে গালি দেয়? তিনি বললেন, হাঁ, অন্য লোকের পিতাকে গালি দেয়। ফলে সেও তার পিতাকে গালি দেয়। অন্যের মাকে গালি দেয়। ফলে সেও তার মাকে গালি দেয়।[46] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিতা-মাতাকে গালি দেওয়াকে কবীরা গুনাহ সাব্যস্ত করলে সাহাবায়ে কেরামের আশ্চর্য বোধ হলো। কী করে কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার পিতা-মাতাকে গালি দিতে পারে! যার কিছুটাও বুঝ-বুদ্ধি আছে, পিতা-মাতার মর্যাদা তার জানার কথা এবং তাদের হক সম্পর্কেও তার কিছু না কিছু খবর থাকার কথা। এরূপ ব্যক্তি তো পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। সে সর্বদা তাদের সেবাযত্ন করে তাদেরকে খুশি রাখার চেষ্টা করবে। এর পরিবর্তে সে তাকে গালি দেবে এটা কী করে সম্ভব? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানালেন যে, হাঁ সম্ভব। আর তা এভাবে যে, সে অন্যের পিতা-মাতাকে গালি দেবে।আর তার প্রতিশোধস্বরূপ সেও তার পিতা-মাতাকে গালি দেবে। তো এই ব্যক্তি নিজে তার পিতা-মাতাকে গালি না দিলেও তার কারণেই তো তাদেরকে গালি শুনতে হয়েছে। যেন সে নিজেই তাদেরকে গালি দিয়েছে। কাজেই বলা যায় অন্যের পিতা-মাতাকে গালি দেওয়া নিজ পিতা-মাতাকে গালি দেওয়ার নামান্তর।
এর দ্বারা বোঝা গেল নিজের শ্রদ্ধেয় কোনও ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষার একটি দিক এইও যে, অন্যের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির কোনওরূপ নিন্দা-সমালোচনা করা হবে না। কেননা তা করতে গেলে প্রতিশোধস্বরূপ তারাও তার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির নিন্দা-সমালোচনা করবে। এভাবে সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে তার নিন্দা-সমালোচনা করা হয়ে যাবে। সুতরাং নিজ শিক্ষক, শায়খ ও আদর্শ ব্যক্তির সম্মানরক্ষার খাতিরে আমাদেরকে অন্যদের এ জাতীয় ব্যক্তিদের নিন্দা-সমালোচনা হতে বিরত থাকতে হবে।
এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা অন্যদের ভ্রান্ত ও বাতিল উপাস্যদের পর্যন্ত গালমন্দ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা এর প্রতিশোধস্বরূপ তারাও আল্লাহ তায়ালাকে গালমন্দ করতে পারে। ইরশাদ হয়েছে
وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ
(হে মুসলিমগণ!) তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে (ভ্রান্ত মাবুদদেরকে) ডাকে,তোমরা তাদেরকে গালমন্দ করো না। কেননা পরিণামে তারা অজ্ঞাতবশত সীমালঙ্ঘন করে আল্লাহকেও গালমন্দ করবে। -সুরা আন‘আম (৬), আয়াত ১০৮
ইবন বাত্তাল রহ. বলেন, অন্যায়-অপরাধের দরজা বন্ধ করার পক্ষে এ হাদীছটি একটি মূলনীতিস্বরূপ। এর থেকে শিক্ষালাভ হয়, যার কোনও (বৈধ) কাজের পরিণামে কোনও অবৈধ কাজ ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তখন ওই বৈধ কাজটি করাও তার জন্য নিষেধ হয়ে যায়, যদিও সে ওই অবৈধ কাজ ঘটানোর ইচ্ছা না রাখে।
ইমাম মাওয়ারদী রহ. বলেন, এমন কোনও ব্যক্তির কাছে রেশমী কাপড় বিক্রি জায়েয হবে না, যার ব্যাপারে জানা থাকে যে, ওই কাপড় সে নিজেই পরিধান করবে।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
ক. এ হাদীছ দ্বারা পিতা-মাতার উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়।
খ. নিজ পিতা-মাতার মর্যাদা রক্ষার্থে অন্যের পিতা-মাতাকেও মর্যাদা দিতে হবে এবং তাদের অসম্মান করা হতে বিরত থাকতে হবে।
গ. শিক্ষার্থীর যদি কোনও পাঠ ভালোভাবে বুঝে না আসে, তবে তার কর্তব্য শিক্ষকের কাছ থেকে তা ভালোভাবে বুঝে নেওয়া।
ঘ. যে বৈধ কাজের পরিণামে কোনও অবৈধ কাজ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তা থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।
ক্রমিক নং : ৬৫ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ دِينَارٍ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَجُلاً مِنَ الْأَعْرَابِ لَقِيَهُ بِطَرِيقِ مَكَّةَ، فَسَلَّمَ عَلَيْهِ عَبْدُ اللهِ وَحَمَلَهُ عَلَى حِمَارٍ كَانَ يَرْكَبُهُ وَأَعْطَاهُ عِمَامَةً كَانَ عَلَى رَأْسِهِ. فَقَالَ ابْنُ دِينَارٍ: فَقُلْنَا لَهُ: أَصْلَحَكَ اللهُ! إِنَّهُمُ الْأَعْرَابُ، إِنَّهُمْ يَرْضَوْنَ بِالْيَسِيْرِ. فَقَالَ عَبْدُ اللهِ: إِنَّ أَبَا هَذَا كَانَ وُدًّا لِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، وَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم يَقُولُ: إِنَّ أَبَرَّ الْبِرِّ صِلَةُ الْوَلَدِ أَهْلَ وُدِّ أَبِيْهِ . | অনুবাদ: . আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদি. থেকে বর্ণনা করেন যে, জনৈক বেদুঈন মক্কার পথে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করল। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর তাকে সালাম দিলেন এবং একটি গাধার পিঠে তাকে তুলে নিলেন, যে গাধাটিতে তিনি নিজে চড়তেন। তার মাথায় যে পাগড়িটি ছিল সেটিও তাকে দিয়ে দিলেন। আব্দুল্লাহ ইবন দীনার বলেন, আমরা তাকে বললাম, আল্লাহ তায়ালা আপনার কল্যান করুন। এরা তো বেদুঈন। সামান্যতেই খুশি হয়ে যায়। আব্দুল্লাহ ইবন উমর বললেন, এই ব্যক্তির পিতা উমর ইবনুল খাত্তাব রাদি.–এর বন্ধু ছিল। আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি নেককাজ সমূহের মধ্যে একটি বড় নেককাজ হলো, কোনও ব্যক্তির তার পিতার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করা।[47] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা :
আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদি.-এর একটি ঘটনা
আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদি. থেকে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তিনি আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদি.-এর মাওলা (আযাদকৃত গোলাম)। একবার তিনি আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদি.-এর সঙ্গে মদীনা মুনাউওয়ারা থেকে মক্কা মুকাররামায় যাচ্ছিলেন। পথে জনৈক বেদুঈনের সঙ্গে দেখা হলে ইবন উমর রাদি. তার নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। তাতে জানা গেল সে বেদুঈন তাঁর পিতা উমর ইবনুল খাত্তাব রাদি.-এর একজন বন্ধুস্থানীয় লোক। তখন তিনি নিজের কাছে থাকা অতিরিক্ত গাধাটি তাকে দিয়ে দিলেন। সফরকালে এ গাধাটি তিনি নিজের সঙ্গে রাখতেন। উটনীর পিঠে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি কিছুক্ষণের জন্য ওই গাধাটি ব্যবহার করতেন। তারপর ক্লান্তি দূর হওয়ার পর ফের উটনীর পিঠে সওয়ার হতেন। এরকম প্রয়োজনীয় বাহনটি তো তাকে দিলেনই, সেইসঙ্গে নিজের ব্যবহার করা একটা পাগড়িও তাকে দিলেন।
বেদুঈনকে এরূপ খাতির করতে দেখে আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ.-এর আশ্চর্য বোধ হলো। তিনি বলেই ফেললেন যে, সামান্য কিছু পেলেই যারা খুশি হয়ে যায় তাদেরকে এমন দামী বস্তু দেওয়া কেন? এ কথা বলার আগে তিনি তাঁর জন্য দুআ করে নিলেন যে- اصلحك الله (আল্লাহ তায়ালা আপনার কল্যাণ করুন) এবং غفر الله لك (আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন)। এটা এক সময়কার দীনদারদের মধ্যে ব্যবহৃত সম্বোধনের ভাষা। নিজের চেয়ে বড় ও সম্মানিত ব্যক্তিকে বিশেষ কোনও বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণকালে এরকম দুআ করা হতো। এর দ্বারা তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পাশাপাশি তার যদি কোনও ভুলও হয়ে থাকে, সেজন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। এর জন্য যে কাজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় সেটি ভুল হওয়া জরুরি নয়। সেটি ভুল না হলেও মানুষের জীবনে কোনও না কোনও ভুলত্রুটি ও গুনাহখাতা থাকেই। কাজেই এরকম দুআ যে-কারও জন্যই করা যায়।
যাহোক আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. বিস্ময় প্রকাশ করলে আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদি. বললেন, এই ব্যক্তির পিতা আমার পিতা উমর ইবনুল খাত্তাব রাদি.-এর বন্ধু ছিলেন। আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি—
إنَّ مِنْ أبرِّ البرِّ أنْ يَصِلَ الرّجلُ أهلَ وُدِّ أبِيه بَعْدَ أَنْ يُوَلِّيَ
(নেককাজসমূহের মধ্যে একটি বড় নেককাজ হলো কোনও ব্যক্তির তার পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করা)।
হাদীছটির অর্থ এরকমও করা যায় যে, পিতার প্রতি একটি উৎকৃষ্ট সদাচরণ এইও যে, তার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের প্রতি সদাচরণ করা হবে। অর্থাৎ বন্ধুদের প্রতি সদাচরণ প্রকারান্তরে পিতার প্রতিই সদাচরণ। কেননা এর দ্বারা বন্ধুবর্গের মধ্যে পিতার ইজ্জত-সম্মান রক্ষা পায়। ইবন উমর রাদি. বোঝাচ্ছেন যে, আমি এ অনুসরণার্থেই এই ব্যক্তির প্রতি এরকম আচরণ করেছি।
লক্ষণীয়, ওই ব্যক্তি ছিল বেদুঈন, আমাদের অঞ্চলে যেমন কোনও গ্রাম্য ব্যক্তি। সামাজিকভাবে শহুরে ব্যক্তিদের মত তাদেরকে বিশেষ গুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখা হয় না। কিন্তু ইবন উমর রাদি. তাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখলেন না। কেননা এ জাতীয় সামাজিক বিভাজন ইসলামসম্মত নয়। তিনি তাকে দেখেছেন পিতার বন্ধুরূপে। বন্ধু শহুরে হোক বা গ্রামের হোক, বন্ধুত্বের মর্যাদা তার প্রাপ্য। অনুরূপ যে-কোনও ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্পর্কটাই লক্ষণীয়। বাসস্থান, পেশা ইত্যাদি বিবেচ্য নয়।
উল্লেখ্য, এ হাদীছে পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করার কথা বলা হলেও তার জীবদ্দশায়ও এটা সমান জরুরি। বিশেষভাবে মৃত্যুর কথা উল্লেখ করার কারণ এটা তার জীবিতাবস্থায় সদাচরণ করার একটা বিকল্পও বটে। পিতা যেহেতু জীবিত নেই, এখন কিভাবে তার সেবাযত্ন করা যাবে? তাই যেন একটা বিকল্প উপায় বলে দেওয়া হলো যে, তার বন্ধুদের সেবাযত্ন কর। প্রকারান্তরে এটা তারই সেবাযত্ন বলে গণ্য হবে। তবে এর মানে এই নয় যে, পিতার জীবদ্দশায় তাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। এর সঙ্গে যেহেতু পিতার মান-সম্মানও জড়িত, তাই তার জীবদ্দশায়ও তাদের প্রতি সম্মান দেখানো চাই। একই কথা মায়ের সখী বান্ধবীদের বেলায়ও প্রযোজ্য।
হাদীছটির শিক্ষা
ক. পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধু-বান্ধবদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তাদের খেদমত করাকে পিতৃসেবার বিকল্পরূপে গ্রহণ করা উচিত।
খ. পিতার জীবদ্দশায়ও তার বন্ধু-বান্ধবদের সম্মান করা উচিত। তাতে পিতার মানসম্মান রক্ষা হয়।
গ. পিতার বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি যা করণীয়, মায়ের সখী বান্ধবীদের বেলায়ও তা প্রযোজ্য।
ঘ. পিতা-মাতার সাথে যাদের সম্পর্ক, তারা কোথাকার বাসিন্দা বা কোন্ পেশার লোক তা বিবেচ্য নয়; সম্পর্কটাকেই মূল্যায়ন করা চাই।
ঙ. শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার সময় প্রথমে কথা ও কাজে তার প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদর্শন করা চাই।
চ. মাগফিরাতের দুআ জীবিত ও মৃত এবং বড় ও ছোট যে-কারও জন্যই এবং পেছনে ও সামনাসামনি যে-কোনও অবস্থায়ই করা যায়।
ক্রমিক নং : ৬৬ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ: قَالَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم : رِضَى الرَّبِّ فِي رِضَى الْوَالِدِ وَسَخَطُ الرَّبِّ فِي سَخَطِ الْوَالِدِ. | অনুবাদ: . আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদি. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, জন্মদাতার সন্তুষ্টিতে পরওয়ারদিগারের সন্তুষ্টি আর জন্মদাতার অসন্তুষ্টিতে পরওয়ারদিগারের অসন্তষ্টি।[48] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : ‘জন্মদাতার সন্তুষ্টিতে পরওয়ারদিগারের সন্তুষ্টি আর জন্মদাতার অসন্তুষ্টিতে পরওয়ারদিগারের অসন্তষ্টি’: পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করে এবং তাদের সেবা-যত্নের মাধ্যমে যদি তাদেরকে সন্তুষ্ট করা যায়, তাহলে এর বদৌলতে আল্লাহ তা’আলা ঐ ব্যক্তির উপর সন্তুষ্ট থাকেন। পিতামাতার সাথে খারাপ ব্যবহারের ফলে যদি তারা মনে কোনো কষ্ট পান, তাহলে এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা ঐ ব্যক্তির প্রতি অসন্তুষ্ট হন।
ক্রমিক নং : ৬৭ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم يَقُولُ: الْوَالِدُ أَوْسَطُ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ، فَإِنْ شِئْتَ فَأَضِعْ ذَلِكَ الْبَابَ أَوِ احْفَظه. | অনুবাদ: . আবূদ্ দারদা রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি তার কাছে এসে বলল, আমার এক স্ত্রী আছে। আমার মা আমাকে আদেশ করছেন যেন তাকে তালাক দিয়ে দিই। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, পিতা জান্নাতের শ্রেষ্ঠতম দরজা। এখন তুমি চাইলে সে দরজাটি ভেঙে ফেল কিংবা চাইলে হেফাজত কর।[49] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছের মূল বিষয়বস্তু আগের হাদীছটির মতই। ওখানে ছিল পিতার পক্ষ থেকে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার নির্দেশ, আর এখানে মায়ের পক্ষ থেকে। এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে ভালোবাসত। কিন্তু মায়ের সে বধূ পসন্দ নয়। তাই ছেলেকে হুকুম করছেন যেন সে তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয়। কিন্তু সে কী করবে বুঝতে পারছে না। তাই এ বিষয়ে বিখ্যাত সাহাবি আবুদ দারদা রাদি.-এর কাছে বিধান জানতে আসল। তিনি ফয়সালাস্বরূপ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ শুনিয়ে দিলেন। সে হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
الوَالِدُ أَوْسَطُ أَبْوَابِ الجَنَّةِ
(পিতা জান্নাতের শ্রেষ্ঠতম দরজা)। অর্থাৎ পিতার আনুগত্য দ্বারা শ্রেষ্ঠতম দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করা যায়। আর এটা তো জানা কথা যে, মায়ের হক পিতার তিনগুণ। কাজেই মায়ের আনুগত্য করা জান্নাতলাভের পক্ষে যে আরও বেশি সহায়ক হবে তা অতি স্পষ্ট। আকূলী রহ. বলেন, এর অর্থ- যেসকল উপায়ে জান্নাতে প্রবেশ করা যায় তার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হলো পিতা-মাতার আনুগত্য।
এ হাদীছ শোনানোর পর আবুদ দারদা রাদি. ওই ব্যক্তিকে বললেন,
فَإِنْ شِئْتَ فَأَضِعْ ذَلِكَ البَابَ أَوْ احْفَظْهُ
(এখন তুমি চাইলে সে দরজাটি ভেঙে ফেল কিংবা চাইলে হেফাজত কর)। অর্থাৎ তুমি চাইলে মায়ের অবাধ্যতা করে ও তার হুকুম অমান্য করে জান্নাতের সে দুয়ার নষ্ট করে ফেলতে পার অথবা চাইলে তার আনুগত্য করে ও তাকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে সে দরজা রক্ষাও করতে পার। তোমার ক্ষেত্রে ধারণা তো এটাই যে, তুমি জান্নাতে যাওয়ার দুয়ার রক্ষাই করবে। সুতরাং তোমার কর্তব্য মায়ের কথা শোনা।
উল্লেখ্য, মায়ের কথামত স্ত্রীকে তালাক দেওয়া অবশ্যকর্তব্য হবে তখনই, যখন মায়ের সে হুকুম ন্যায়সঙ্গত হয়। এ প্রসঙ্গে পূর্বের হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
হাদীছটির শিক্ষা
ক. সন্তানের কর্তব্য সর্বাবস্থায় মাকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা।
খ. পিতা-মাতার আনুগত্য জান্নাতলাভের শ্রেষ্ঠতম উপায়।
গ. দীনী কোনও বিষয়ে নিজ কর্তব্য স্থির করতে না পারলে কোনও সুদক্ষ ও পরহেযগার আলেমের পরামর্শ গ্রহণ করা চাই।
ক্রমিক নং : ৬৮ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّهُ سَمِعَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم يَقُولُ: لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعٌ. | অনুবাদ: . জুবাইর ইবনে মুতঈম রাদি. থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ইবনে আবু উমর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, সুফিয়ান বলেছেন, অর্থাৎ আত্মীয়তা সম্বন্ধ ছিন্নকারী।[50] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : এ হাদীছটি আমাদের জন্য এক কঠোর সতর্কবাণী। আমরা যারা নিজেদেরকে মুমিন বলে বিশ্বাস করি এবং বিশ্বাস করি কিআমত আছে, হাশরের হিসাব নিকাশ আছে তারপর আছে জান্নাত ও জাহান্নাম,তাদের কোনও অবস্থায়ই আত্মীয়তা ছিন্ন করা উচিত নয়। কেননা এ হাদীছে জানানো হয়েছে, আত্মীয়তা ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না। যে ব্যক্তি আত্মীয়তা ছিন্ন করতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তার দ্বারা নানাভাবে বান্দার হক নষ্ট হতে থাকে। বান্দার হক নষ্ট করা কঠিন পাপ। এক পাপ আরেক পাপে লিপ্ত হতে উৎসাহ যোগায়। আত্মীয়তা ছিন্ন করার পাপ যাকে পেয়ে বসে আর সে যথাশীঘ্র তা থেকে তওবা না করে, তার পাপপ্রবণতা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে। এরূপ ব্যক্তির তো অশুভ মৃত্যুর আশঙ্কা থাকেই, অর্থাৎ ঈমানবিহীন মৃত্যু। আল্লাহ তায়ালা আমাদের হেফাজত করুন। ঈমান ছাড়া যার মৃত্যু হয় তার পরিণাম স্থায়ী জাহান্নাম।
আত্মীয়তা ছিন্নকারীর মৃত্যু যদি ঈমানের সঙ্গে হয়ও, তারপরও আত্মীয়তার হক খর্ব করার কারণে তার জাহান্নামের শাস্তিভোগের আশঙ্কা রয়েছে। যদি আল্লাহ তায়ালা তার ক্ষমার কোনও ব্যবস্থা না করেন, তবে প্রথমে তাকে জাহান্নামে যেতেই হবে। নির্দিষ্ট পরিমাণ শাস্তিভোগের পর সে মুক্তি পাবে এবং ঈমানের বদৌলতে জান্নাত লাভ করবে। কিন্তু যতদিন তাকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে, ততদিনের দুর্ভোগ কিছু সহজ বিষয় তো নয়। সে দুর্ভোগ থেকে বাঁচতে চাইলে আমাদেরকে অবশ্যই আত্মীয়তা ছিন্ন করা হতে বিরত থাকতে হবে, অবস্থাবিশেষে তা যতই কঠিন হোক না কেন।
হাদীস থেকে শিক্ষা :
যত কঠিন অবস্থাই হোক না কেন, কোনওক্রমেই আত্মীয়তা ছিন্ন করতে নেই। জাহান্নাম থেকে সম্পূর্ণরূপে আত্মরক্ষার লক্ষ্যে আমাদেরকে আমৃত্যু আত্মীয়তা রক্ষা করে যেতেই হবে।
ক্রমিক নং : ৬৯ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم قَالَ: لَيْسَ الْوَاصِلُ بِالْمُكَافِئِ، وَلَكِنَّ الْوَاصِلَ الَّذِي إِذَا قُطِعَتْ رَحِمُهُ وصَلَها. | অনুবাদ: . আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদি. থেকে বর্ণিত, –রাবী সুফিয়ান বলেন, আ’মাশ এ হাদীস মারফুরূপে বর্ণনা করেননি। অবশ্য হাসান (ইবনে আমর) ও ফিতর রাহিমাহুল্লাহ একে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মারফু হিসেবে বর্ণনা করেছেন।– নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রতিদানকারী আত্মীয়তার হক আদায়কারী নয়। বরং আত্মীয়তার হক আদায়কারী সে ব্যক্তি, যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পরও তা বজায় রাখে।[51] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : হাদীসে বলা হয়েছে, কেউ তার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখছে বিধায় সে সম্পর্ক ঠিক রাখছে, তাহলে সে প্রকৃত আত্মীয়তা রক্ষাকারী বলে গণ্য হবে না; বরং সে-ই প্রকৃত আত্মীয়তা রক্ষাকারী গণ্য হবে, যার সাথে কেউ সম্পর্কচ্ছেদ করে, আর সে তা রক্ষা করে।
ক্রমিক নং : ৭০ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ أَبِي بَكْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ: مَا مِنْ ذَنْبٍ أَحْرَى أَنْ يُعَجِّلَ اللهُ لِصَاحِبِهِ الْعُقُوْبَةَ فِي الدُّنْيَا مَعَ مَا يَدَّخِرُ لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْبَغْيِ وَقَطِيْعَةِ الرَّحِمِ. | অনুবাদ: . আবু বাকরা রাদি. রিওয়ায়েত করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমাইয়াছেন, আত্মীয়তা ছেদন এবং বিদ্রোহের মত দুনিয়াতেই ত্বরিৎ শাস্তির উপযুক্ত আর কোন পাপ নাই। পরকালে তার জন্য যে শাস্তি সঞ্চিত রাখা হবে, তা তো আছেই।[52] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : অর্থাৎ, অন্যান্য পাপের বেলায় দুনিয়াতে শাস্তি নাও হতে পারে অথবা বিলম্বিত হতে পারে, কিন্তু উক্ত অপরাধীকে আল্লাহ্ তায়ালা দুনিয়াতেই অবিলম্বে কিছু না কিছু শাস্তি দিয়া দেন।
وَالْيَتَامَى |
এতিম |
ক্রমিক নং : ৭১ | |
আরবি | বাংলা |
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم قَالَ: مَنْ قَبَضَ يَتِيمًا مِنْ بَيْنِ الْمُسْلِمِينَ إِلَى طَعَامِهِ وَشَرَابِهِ أَدْخَلَهُ اللهُ الْجَنَّةَ الْبَتَّةَ إلا أَنْ يَعْمَلَ ذَنْبًا لَا يُغْفَرُ. | অনুবাদ: . ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মুসলিমদের মাঝে কোন ইয়াতীমকে এনে স্বীয় খাদ্য ও পানীয়তে শরীক করে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাকে জান্নাতে দাখিল করাবেন যদি না সে এমন কোন গুনাহ করে যা ক্ষমাযোগ্য নয়।[53] |
সংশ্লিষ্ট আলোচনা |
হাদিসের ব্যাখ্যা : যে ব্যক্তি এতিম-অনাথকে নিজ আহার্য-পানীয় থেকে অংশ দিয়েছেন, চাই তাকে নিজের সঙ্গে একত্রে খাদ্য গ্রহণে আহ্বান করুক কিংবা নিজের খাদ্য থেকে তাকে কিছু খাবার দিয়ে দিক। এক কথায়, এতিম-অনাথ, যার খাদ্য-পানীয় সংস্থানের জিম্মা বহনকারী পিতামাতা নেই, তাকে যে ব্যক্তি পিতৃ-মাতৃ স্নেহ দ্বারা আপ্যায়ন করবে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়। কিন্তু যে ব্যক্তি শির্ক করে, তার জন্য এ শুভ সংবাদ প্রযোজ্য নয়।
ক্রমিক নং : ৭২ | |
আরবি | বাংলা |
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّم قَالَ: أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ فِي الْجَنَّةِ هكَذَا وَأَشَارَ بِإِصْبَعَيْهِ السَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى. | অনুবাদ: . সাহল ইবনে সাদ রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি এবং ইয়াতীমের দায়িত্ব গ্রহণকারী জান্নাতে এত পাশাপাশি থাকবে। এ বলে তিনি তাঁর দুই অঙ্গুলী অর্থাৎ মধ্যমা এবং তর্জনী ইশারা করে দেখালেন। |