ধর্মতত্ত্ব বিশ্বকোষ: পরিচিতি
ধর্ম মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য ও অবিভাজ্য অংশ। পৃথিবীতে এমন কোন জাতি বা গোষ্ঠী নেই যাদের ধর্ম নেই। আবহমানকাল থেকে অদ্যাবধি মানবসমাজে ধর্ম একটি ঐশী শক্তি হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছে। তাই ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এককথায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মের প্রভাব অনস্বীকার্য। এর আবেদন সবর্জনীন। এর মাধ্যমেই মানবাত্মা খুঁজে পায় সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে তার মায়ার বন্ধন। স্থাপিত হয় স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র। ধর্ম মানবজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার কারণে মানবজীবনের আচার-অনুষ্ঠানে বহুমাত্রিক বিশ্বাস ও উপাদানের সংশ্লেষ ঘটেছে। এজন্য আধুনিক সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ববিদগণ পার্থিব জীবনে ধর্মকে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
ধর্মের উৎপত্তির বিষয় নিয়ে ধর্মতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, নৃতত্ত্ববিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তাঁদের এ মতানৈক্যকে ঘিরে ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে দুটি মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। এক. প্রাচীন মতবাদ, দুই. আধুনিক মতবাদ। প্রাচীন মতবাদ অনুযায়ী ঐশী প্রত্যাদেশ থেকে ধর্মের উৎপত্তি ঘটেছে। আর আধুনিক মতবাদ অনুযায়ী মানবীয় বিচারবুদ্ধি থেকে ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। আধুনিক মতবাদটি যুক্তির মানদণ্ডে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এটি কতিপয় নৃতত্ত্ববিদ ও সমাজবিজ্ঞানীর কল্পিত ধারণা যা জ্ঞানের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়। কেননা মানবিক বিচারবুদ্ধি ও আচার-আচরণ থেকে ধর্মের উৎপত্তি হতে পারে না। ধর্ম বিধাতার সৃষ্টি। তিনি আদিমানব আদম আ.-কে সৃষ্টি করে ধর্ম দিয়ে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রত্যাদেশ থেকেই যে ধর্মের উদ্ভব হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রত্যাদেশমূলক ধর্মই হলো পৃথিবীর মূল ধর্ম। পৃথিবীতে আদম আ.-এর আগমনের পর ক্রমান্বয়ে তাঁর বংশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। কালক্রমে তাঁর সন্তানদের মধ্যে অনেকেই আল্লাহপ্রদত্ত ঐশী বিধান ভুলে গিয়ে প্রকৃতিরাজির অর্চনা শুরু করে। ফলে একেশ্বরবাদী ধর্মের মূল বিশ্বাস ক্ষুণ্ণ হয়। সৃষ্টি হয় নানা ধরনের ধর্মমত। এভাবে অসংখ্য ধর্ম ও উপধর্মের জন্ম হয়। আধুনিক ধর্ম গবেষকদের প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীতে রয়েছে প্রায় ৪৩০০ ধর্ম। আবার কারও কারও মতে ধর্মের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি। এসব ধর্মের মধ্যে একেশ্বরবাদী ধর্ম হলো ইসলাম, খ্রিস্টান, ইহুদি, সাবিঈ ও দ্রুজ ধর্ম। আর অবশিষ্ট ধর্মগুলো বহু ঈশ্বরবাদী, প্রকৃতিবাদী ও আঞ্চলিক ধর্ম। আবার কোন কোন ধর্ম অজ্ঞেয়বাদী এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়।
অনুসারীদের সংখ্যার দিক থেকে প্রথম অবস্থানে রয়েছে খ্রিস্টধর্ম। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীর সাতশ কোটি মানুষের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের অনুসারী ৩৩%। সে হিসেবে সারা বিশ্বে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা প্রায় ২০০ কোটি। এর পরের অবস্থান ইসলাম ধর্মের। বিশ্বজুড়ে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ১৫০ কোটি। সাতশ কোটি মানুষের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ২১ শতাংশ। দ্রুত সম্প্রসারণের দিক থেকে পৃথিবীতে ইসলাম ধর্ম রয়েছে প্রথম সারিতে। অদূর ভবিষ্যতে ইসলামধর্ম পৃথিবীতে প্রথম স্থানে পৌঁছে যাবে বলে অনেকের ধারণা। ধর্মের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থান হিন্দুধর্মের। এর অনুসারীর সংখ্যা ৯০ কোটি। শতাংশের হিসাবে পৃথিবীতে হিন্দুধর্মের অনুসারী ১৪%। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, নাস্তিক, অধর্মীয় বা ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে কম নয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এদের সংখ্যা প্রায় ১১০ কোটি। এছাড়া পৃথিবীতে চীনা ঐতিহ্যগত ধর্মের অনুসারী ৩৯ কোটি ৪০ লাখ, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ৩৭ কোটি ৬০ লাখ এবং আদিম আদিবাসী ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি।

ধর্মের ইতিহাস বড়ই বিচিত্র। আবহমানকাল থেকেই ধর্মকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে। বর্তমান বিশ্বও ধর্মজনিত দ্বন্দ্ব-কলহ, হিংসা-বিদ্বেষ ও সংঘাত-সংঘর্ষ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এহেন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধর্মকে যদি সার্বিকভাবে অনুধাবন না করা হয় এবং ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পারস্পরিক সদ্ভাব ও সম্প্রীতি স্থাপন করা না যায়; তাহলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের পরস্পরকে জানা ও তাদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে তোলা সময়ের অপরিহার্য দাবি। আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা এবং কলহ-সংঘাত নিরসনের পরিপ্রেক্ষিতেই একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে তুলনামূলক ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে। এটি এমন একটি অভিজ্ঞান, যার মাধ্যমে প্রাচীন, আধুনিক এবং ঐতিহাসিক ও প্রাগৈতিহাসিক সব রকম ধর্মের বস্তুনিষ্ঠ ও তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন ধর্মের রীতি-নীতি ও বিশ্বাসসমূহকে পর্যালোচনা করে এগুলোর বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করা এবং সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলোকে চিহ্নিত করে পারস্পরিক বিরোধ মীমাংসা করা এবং ধর্মগুলোর মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন স্থাপন করা। এ অভিজ্ঞানের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে যেখানে প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের স্থান খুঁজে পায়। এখানে কোন ধর্মকে অবমূল্যায়ন করা হয় না। এ অভিজ্ঞানটি কয়েকটি সর্বজনীন নীতিমালার ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. সকল ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু মনোভাব প্রদর্শন করা এবং বিরূপ মন্তব্য পরিহার করা;
২. প্রত্যেক ধর্মের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা বজায় রেখে ধর্মীয় আচার ও রীতি-পদ্ধতি সম্পর্কে নিরপেক্ষ পর্যালোচনা করা;
৩. বিভিন্ন ধর্মের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যকে যথাযথভাবে অনুধাবন করা এবং মিলের মাঝে যে অমিল আর অমিলের মাঝে যে মিল আছে তা খুঁজে বের করা;
৪. বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সহযোগিতা ও ঐক্যের মনোভাব সৃষ্টি করা;
৫. অন্য ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা এবং চরমপন্থা ও উগ্রতা পরিহার করা;
৬. সকল ধর্মের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করা এবং খোলা মন নিয়ে ধর্মীয় আচার-রীতিনীতির নিরপেক্ষ পর্যালোচনা করা;
৭. বিভিন্ন ধর্মের বিষয়বস্তুর তুলনামূলক পর্যালোচনা করা, যাতে মৌলিক ঐক্যসূত্র বেরিয়ে আসে;
৮. পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি স্থাপনে সহায়ক শক্তি হিসেবে ধর্মের মূল শিক্ষাকে গ্রহণ করা।
তুলনামূলক ধর্ম অভিজ্ঞানটি প্রাচ্যবিদদের উদ্ভাবন বলে অনেকেই ধারণা করলেও মূলত এটি মুসলিমদের উদ্ভাবন। ইসলামের অভ্যুদয়ের পর পরই এ অভিজ্ঞানের সূত্রপাত ঘটে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে তৎকালীন প্রচলিত ধর্মসমূহের মধ্যে পারস্পরিক পরিচয় ও সম্পর্ক ছিল না। ফলে এক ধর্মের অনুসারীরা অপর ধর্মের অনুসারীদেরকে ভ্রান্ত মনে করতো। যখন ইসলামের আগমন ঘটল তখন ইসলাম তৎকালীন ইহুদি, খ্রিস্টান ও সাবিঈ ধর্মের সঙ্গে পরিচিত হল এবং ধর্মসমূহের মূলতত্ত্ব অনুধাবন করে এগুলোর কিছু কিছু অসারতা তাদের অনুসারীদের সামনে তুলে ধরল।
হিজরী দ্বিতীয় শতকে ইসলামী অন্যান্য জ্ঞানশাখার সঙ্গে এ অভিজ্ঞান যুক্ত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও শাস্ত্রীয় রূপ পরিগ্রহ করে। যদিও তখন সরাসরি এ নামটি প্রযুক্ত হয়নি; বরং তা ইলমুল কালাম, ইলমুল মুনাযারা হিসেবে আলোচিত হতে থাকে। পরবর্তীকালে এটি ইলমুল আদইয়ান নামে এক স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত হয়। হিজরী তৃতীয় শতক থেকে শুরু করে হিজরী দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম পণ্ডিতগণ এ শাস্ত্রের বিকাশ সাধনে অভূতপূর্ব অবদান রাখেন। এরপর বিদ্যাচর্চায় মুসলিম খলীফাগণের উদাসীনতা, মাযহাবি গোঁড়ামি ও ক্রুসেড যুদ্ধের কারণে এ অভিজ্ঞানের চর্চা স্থিমিত হয়ে যায়। এ সময়ে প্রাচ্যবিদেরা এ বিদ্যাকে লুফে নেয়। তারা এ বিদ্যাকে তাদের মিশনারি তৎপরতার অংশ হিসেবে গ্রহণ করে নানাভাবে এর উৎকর্ষ সাধনে ব্রতী হয়। তারা এ শাস্ত্রের প্রকৃতি, স্বরূপ ও ধরনকে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী পাল্টে দেয়। অতঃপর হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীতে এটি আবার মুসলিম অঙ্গনে ফিরে আসে। মুসলিম পণ্ডিতগণ পূর্বের ন্যায় এ বিদ্যা চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরা অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা হিসেবে এ বিদ্যার বিকাশ সাধন করাকে অপরিহার্য মনে করেন। সত্যধর্ম হিসেবে ইসলামকে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপনের জন্য অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে ইসলামের তুলনা প্রসঙ্গে তাঁরা নতুন আঙ্গিকে এ বিদ্যার বিজ্ঞানসম্মত নীতিমালা উদ্ভাবনে সক্ষম হন। ফলে বিশ্বে ইসলামের সত্যরূপ বিকশিত হয়ে একটি নির্ভেজাল জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
মুসলিম পণ্ডিতদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বে তুলনামূলক ধর্ম একটি জনপ্রিয় শাস্ত্রে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়াসহ আরব বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ধর্ম নামে স্বতন্ত্র বিভাগ চালু করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বিভাগে এ নামে স্বতন্ত্র কোর্স চালু রয়েছে। তুলনামূলকধর্ম বিভাগ ও অধিভুক্ত কোর্সগুলোতে এ অভিজ্ঞান গুরুত্বের সঙ্গে পাঠদান করা হচ্ছে। যাতে ধর্ম নিয়ে অনুসারীদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরিতা দূর হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো বিষয়টি নতুন বলে মনে হয়। এর স্বরূপ, বিষয়বস্তু, প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্যতা বিষয়ে অনেকের ধারণা আজও পরিষ্কার নয়। বিষয়টির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকে বিবেচনায় এনে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়ন বা বিশ্ব ধর্মতত্ত্ব নামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ খোলা হয়েছে। এছাড়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে তুলনামূলক ধর্ম কোর্স হিসেবে পাঠ্যভুক্ত করা হয়েছে। এদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন- আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ঢাকা-তে ইসলামী শিক্ষা বিভাগে বিষয়টি সিলেবাসভুক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এদেশের সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে অনেক প্রাগ্রসর শিক্ষার্থী এ বিষয়ের উপর এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এতদসত্ত্বেও এ বিষয়ের উপর বাংলা ভাষায় গবেষণাধর্মী মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা নিতান্তই কম। মাত্র হাতে গোনা দুএকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে যা এ অভিজ্ঞান চর্চার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই সকল শ্রেণির পাঠক ও শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে বাংলাভাষায় তুলনামূলক ধর্ম নামে গ্রন্থটি রচনার কাজে হাত দিই। এ বিষয়ে আরবি ও ইংরেজি ভাষায় রচিত অসংখ্য প্রামাণ্য গ্রন্থ থেকে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে গ্রন্থটি রচনা করি। এ গ্রন্থে সকল ধর্মমতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ধর্মের ইতিহাস ও তুলনামূলক পর্যালোচনা উপস্থাপিত হয়েছে। এতে ব্যক্তিগত মত পরিহার করে নির্ভরযোগ্য তথ্যের আলোকে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা বিধৃত হয়েছে। ধর্মের তুলনামূলক পর্যালোচনায় ধর্মীয় মূল্যবোধকে অক্ষুণ্ণ রেখে ধর্মের রীতি-নীতি ও আচার-অনুষ্ঠান আলোচনা করা হয়েছে। ধর্মসমূহের মধ্যে তারতম্য ও বিরোধ সৃষ্টি করা এ গবেষণার উদ্দেশ্য নয়; বরং সকল ধর্মের মূল আবেদন মানবতার কল্যাণ সাধন উক্তিটি সামনে রেখে ধর্মসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি স্থাপন করাই হলো এর মূল উদ্দেশ্য। গ্রন্থটি মোট এগারোটি অধ্যায়ে বিভক্ত। নিম্নে অধ্যায়গুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা উপস্থাপন করা হলো:
প্রথম অধ্যায়ে ধর্মের সংজ্ঞা, উৎপত্তি ও বিকাশ এবং ধর্মতত্ত্ব চর্চার কয়েকটি যুগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে তুলনামূলক ধর্মের সংজ্ঞা, তুলনামূলক বিষয়ে কয়েকটি পরিভাষা, পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে তুলনামূলক ধর্মের স্বরূপ, ইসলামের জ্ঞান শাখার সঙ্গে এ অভিজ্ঞানের সম্পর্ক, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, নীতিমালা ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
তৃতীয় অধ্যায়ে তুলনামূলক ধর্মের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রচিত গ্রন্থরাজি পর্যালোচনা করা হয়েছে।
চতুর্থ অধ্যায়ে আসমানি ধর্ম তথা ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের উৎপত্তি, বিকাশ, প্রার্থনা ও উপাসনা রীতি, ধর্মীয় দল-উপদল, ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূলনীতি, বৈশিষ্ট্য এবং ধর্মীয় উৎসব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে। পরিশেষে এসব ধর্মের আকীদা-বিশ্বাসের তুলনামূলক পর্যালোচনাও সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিধৃত হয়েছে।
পঞ্চম অধ্যায়ে প্রাচীন ধর্মসমূহ বিশেষ করে মিসরীয়, ব্যবিলনীয়, সুমেরীয়, গ্রিক ও রোমান ধর্ম সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে ভারতীয়ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখধর্মের উৎপত্তি, বিকাশ, ধর্মীয় বিশ্বাসসমূহ, ধর্মগ্রন্থ ও উৎসব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা বিধৃত হয়েছে।
সপ্তম অধ্যায়ে আঞ্চলিক ধর্মের আলোচনায় সাবিঈ, জরথুস্ত্র, বাহাঈ, কুনফুসীয়, সিন্তো ও তাও ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব ধর্মের ধর্মীয়বিশ্বাস, ধর্মগ্রন্থ, উপাসনা ও প্রার্থনা, মূলনীতি ও ধর্মীয় উৎসব সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে।
অষ্টম অধ্যায়ে আসমানি গ্রন্থসমূহ তথা তাওরাত, যাবূর, ইঞ্জিল ও আল-কুরআন সম্পর্কে একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা বিধৃত হয়েছে।
নবম অধ্যায়ে আসমানি ধর্মের বিশ্বাসসমূহ, যেমন অহী, নবী-রাসূল, পুনরুত্থান ও আকীদা সম্পর্কে তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হয়েছে।
দশম অধ্যায়ে আসমানি ধর্মসমূহের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের কতিপয় বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
একাদশ অধ্যায়ে তুলনামূলক ধর্মচর্চায় মুসলিমদের অবদান সম্পর্কীয় আলোচনায় বিশ্বের প্রাচীন ও আধুনিক কয়েকজন খ্যাতনামা মুসলিম পণ্ডিত যেমন- আবু মুহাম্মাদ আন-নাওবখতী, আবুল হাসান আল-মাসঊদী, আব্দুল করীম আল-শাহরাস্তানী, আবু হামিদ আল-গাযালী, আবু মুহাম্মাদ আলী ইবন হাযম আল-আন্দালুসী, ইমাম আহমদ ইবন ইদ্রিস আল-কারাফী, ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, শায়খ রহমতুল্লাহ কিরানবী, ড. মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ দারায, ড. আহমাদ শালাবী, ইমাম মুহাম্মাদ আবু যাহরাহ, আহমাদ দীদাত, ডা. মরিস বুকাইলি, ড. ইসমাঈল রাজী আল-ফারুকী, প্রফেসর ড. ইবরাহীম আল-খুলী, ড. জাকির নায়েক ও মুনকিয ইবনু মাহমূদ আস-সাক্কার-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তুলনামূলক ধর্মে তাঁদের অবদান সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচিত হয়েছে।
এ গ্রন্থে ব্যবহৃত বাংলা বানানের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে। আরবি শব্দাবলির ক্ষেত্রে প্রতি-বর্ণায়নের নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এ রীতি অনুসৃত না হয়ে সাধারণ পাঠকের বোধগম্যের জন্য গতানুগতিক বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
গ্রন্থটি প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইসলামিক ল রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বিশেষ করে এ সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক জনাব মো. শহীদুল ইসলাম ভাই এর আন্তরিকতা স্মরণীয়। বিগত দুবছর ধরে তিনি বার বার খোঁজখবর নিয়ে আমাকে একাজের সমাপ্তি টানতে উৎসাহিত ও উজ্জীবিত করেছেন। গ্রন্থটি প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর সহযোগিতা স্মৃতির মুকুরে চিরঅম্লান হয়ে থাকবে। এছাড়া সেন্টারে কর্মরত সকলের প্রতি রইল আমার অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। পরিশেষে মহান আল্লাহর সমীপে কায়মনো বাক্যে এ প্রার্থনা জানাই, তিনি যেন অধমের ক্ষুদ্র প্রয়াসটুকু কবুল করেন। এ কাজে ভুল থাকা স্বাভাবিক। তাই প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে নিবেদন, যদি তত্ত্ব ও তথ্যগত এবং মুদ্রণজনিত কোন প্রমাদ আপনাদের গোচরীভূত হয়, তা দীনি দায়িত্ব মনে করে আমাকে অবহিত করবেন। আগামী সংস্করণে তা ইনশাআল্লাহ্ সংশোধন করে।
ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন
প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী
ফেব্রুয়ারি ২০২০ ঈসায়ী।
[ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন এর ‘তুলনামূলক ধর্ম’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত়়।]